মধ্যবিত্তের দিনযাপন
পিনাকী চৌধুরী।। বিত্তের মাপকাঠিতে যিনি মধ্যস্থানে অবস্থান করেন তিনিই মধ্যবিত্ত। তবে অতীতে এই মধ্যবিত্ত শ্রেণীর মানুষজনের একটি আদর্শ নিষ্ঠ জীবন যাপন ছিল। শিক্ষার প্রতি অনুরাগ এবং অবশ্যই মিতব্যয়ী হয়ে কোনোরকমে দিন গুজরান করতেন তাঁরা। মান্ধাতার আমলের সেই বাড়িতে মূলত একান্নবর্তী পরিবার হিসেবেই তাঁরা পরিচিত ছিলেন। সহজ, সরল, অনাড়ম্বর জীবনযাপনে অভ্যস্ত ছিলেন মধ্যবিত্ত শ্রেণীর মানুষজন। মাসের শেষে চূড়ান্ত আর্থিক অনটন থাকা সত্ত্বেও গৃহকর্তা লুঙ্গি পরিধান করে ছেঁড়া থলি হাতে বাজারে ছুটতেন। শুধু কি তাই ?
সেখানে মাছের পেট টিপে রীতিমতো দরদাম করে মাছ কিনতেন। একসময় তাঁরা বাথরুম না বলে বরং তাঁদের স্নানের ঘরকে ‘ কলতলা ‘ বলতেই বেশি স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করতেন। সেই আটপৌরে কলতলায় বেঢপ আকৃতির একটি চৌবাচ্চা থাকত। যখন সন্ধ্যা ঘনাতো তখন মধ্যবিত্তের ঘরে ঘরে শঙ্খধ্বনি শোনা যেত এবং প্রায় প্রতিটি গৃহেই গৃহকর্তীরা তুলসী তলায় প্রদীপ জ্বেলে পরিবারের মঙ্গলকামনা করতেন। তাঁরা বকধার্মিক নয় , বরং ধার্মিক মানুষ হিসেবেই পরিচিত ছিলেন।
শিক্ষার সঙ্গে কোনোরকম সমঝোতা তাঁরা করতেন না, প্রতিদিন সকাল সন্ধ্যায় মধ্যবিত্তের ছেলে মেয়েরা মনযোগ সহকারে পড়তে বসতো। তবে মধ্যবিত্তের সেই কিশোরটি তার পাশের বাড়ির মেয়ের প্রেমে পাগল হয়ে যেতো। চিলেকোঠার ঘর থেকে দু’পলকের দৃষ্টি বিনিময় যেন সেই কিশোর কে এক পরম মানসিক প্রশান্তি দিতো। তখনকার দিনে পাশের বাড়ির মেয়ের প্রেমে পড়াটা যেন মধ্যবিত্তের একটা প্যাশন ছিল, যদিও সেই প্রেম অনেক সময়ই পূর্ণতা লাভ করতো না। বাড়ির সামনের রক ছিল মধ্যবিত্তের কাছে স্বর্গ ! সেই রকে বসে জমাটি আড্ডা দিতে তাঁদের জুড়ি মেলা ভার ! এছাড়াও অমিতাভ বচ্চন ও মিঠুন চক্রবর্তীর সিনেমা মুক্তি পেলেই মধ্যবিত্ত ওপেনিং ডে ওপেনিং শো দেখতে যেতো এবং হলে ঢুকে তুমুল সিটি বাজাতো । সেলুনে চুল কাটতে গিয়ে প্রায়শই মধ্যবিত্ত যুবকটি মিঠুন চক্রবর্তীর স্টাইলে চুল কাটতে অনুরোধ করতেন নাপিতকে । তাঁদের আবার ধূমপানেও আসক্তি ছিল, বিড়ি কানে গুঁজে রাখবার বদভ্যাসও ছিল। অতীতের একসময় মধ্যবিত্তের পরিবারে যেন একটা প্রাণ ছিল, পরিবারের বয়স্করা ঘর আলো করে বসে থাকতেন। পাঁচশো গ্রাম পাঁঠার মাংস কিনে এনে ভাল করে রান্না করে পরিবারের সবাই একসাথে অল্প অল্প করে খেতেন।
মধ্যবিত্ত শ্রেণী কিন্তু তখন PNPC তে ( পরচর্চা পরনিন্দা ) ডিপ্লোমা হোল্ডার ছিলেন। চায়ের দোকান ছিল যেন মধ্যবিত্তের বিশ্ববিদ্যালয়! তর্কবাগীশ মধ্যবিত্ত সেই চায়ের দোকানে মাটির ভাঁড়ে গরম চায়ে চুমুক দিতে দিতে তুমুল তর্ক করতেন। তবে করজোড়ে নমস্কার যেমন ছিল, তার পাশাপাশি অগ্রজদের পায়ে হাত দিয়ে নমস্কারের রেওয়াজটা মধ্যবিত্তের ছিল। কথায় কথায় তাঁরা ‘ আজ্ঞে ‘ বলতেই সাবলীল ছিলেন। সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম আবেগ অনুভূতি মধ্যবিত্তেকে যেন স্পর্শ করতো । দেখনদারিতে নয় , বরং আন্তরিকতায় মধ্যবিত্ত শ্রেণী ছিল অপ্রতিদ্বন্দ্বী। টেলিভিশন চ্যানেলের দাপট ছিল না, সেই জন্য রেডিও স্টেশনের বিভিন্ন সম্প্রচারিত অনুষ্ঠান শুনতেন মধ্যবিত্তরা। তবে আজ এই ২০২১ সালে এসে মধ্যবিত্ত শ্রেণীটি কোথায় যেন প্রায় অবলুপ্ত হয়ে গেছে মাথা তুলে দাঁড়িয়েছে so called উচ্চবিত্ত । তবে আজও কিন্তু মধ্যবিত্ত মানেই যেন এক নস্টালজিয়া ।