বহুরূপী

আন্তন চেখব

আন্তন পাভলোভিচ চেখভ। জন্ম ২৯ জানুয়ারি ১৮৬০ – মৃত্যু ১৫ জুলাই ১৯০৪। আন্তন চেখভ ছিলেন একজন রুশ চিকিৎসক, নাট্যকার ও ছোটগল্পকার। প্রথমে নাট্যকার হিসেবে তিনি আন্তর্জাতিকভাবে পরিচিতি পান থ্রি সিস্টার্স, দ্য সিগাল এবং দ্য চেরি অরচার্ড এই তিনটি নাটকের মাধ্যমে। এরপর ছোট গল্পের জন্যে বিশ্বজুড়ে বেশি পরিচিত ছিলেন তিনি। তৃতীয় পক্ষ আন্তন চেখভ-এর এক ছোট গল্পের অনুবাদ ‘বহুরূপী’ পুনঃপ্রকাশিত করছে ওয়েব মাধ্যমে।গল্পটি ‘ছোট গল্প ও উপন্যাস’ নামক বই থেকে নেওয়া। সোভিয়েত ইউনিয়ন-এর বিদেশী ভাষায় সাহিত্য প্রকাশালয় থেকে প্রকাশিত। অনুবাদক-এর নাম জানা না থাকায় নাম প্রকাশ করা গেল না।

 

পুলিশ ইন্সপেক্টর ওচুমেলভ হেঁটে যাচ্ছিলেন বাজারের মধ্যে দিয়ে। গায়ে তাঁর নতুন ওভারকোট, হাতে পুঁটুলি এবং পিছনে এক কনেস্টেবল। চুলের রঙটা তাঁর লাল, হাতের চালুনিটা ভর্তি হয়ে গেছে বাজেয়াপ্ত করা গুজবেরিতে। কোথাও কোনো সাড়াশব্দ নেই… বাজার একেবারে খালি… ক্ষুদে ক্ষুদে দোকান আর সরাইখানার খোলা দরজাগুলো যেন একসার ক্ষুধার্ত মুখ-গহ্বরের মতো দীনদুনিয়ার দিকে হাঁ করে আছে। ধারে কাছে একটা ভিখিরি পর্যন্ত দাঁড়িয়ে নেই।

হঠাৎ একটা কন্ঠস্বর শোনা গেল, ‘কামড়াতে এসেছ হতচ্ছাড়া বটে? ওকে ছেড়ো না হে। কামড়ে বেড়াবে সে আইন নেই আর। পাকড়ো পাকড়ো! হেই!

কুকুরের ঘ্যান ঘ্যান ডাকও শোনা গেল একটা। ওচুমেলভ সেদিকে তাকিয়ে দেখতে পেলেন, পিচুগিন দোকানীর কাঠগোলা থেকে বেরিয়ে এসে একটি কুকুর তিন ঠ্যাঙে লাফাতে লাফাতে ছুটছে আর তার পেছু পেছু তাড়া করেছে একটি লোক, গায়ে তার মড়মড়ে ইস্ত্রির ছাপা কাপড়ের জামা, ওয়েস্টকোটের বোতাম সব খোলা, সারা শরীর ঝুঁকে পড়েছে সামনের দিকে। হুমড়ি খেয়ে পড়ে লোকটা কুকুরের পিছনের পাটা চেপে ধরল। কুকুরটা আবার কেঁউ কেঁউ করে উঠল, আবার চিৎকার শোনা গেল, ‘পাকড়ো, পাকড়ো!’ দোকানগুলো থেকে মারতে লাগল নানা তন্দ্রাচ্ছন্ন মুখ। দেখতে দেখতে যেন মাটি ফুঁড়ে ভিড় জমে উঠল কাঠগোলার কাছে।

কনেস্টেবল বললে, ‘বেআইনি হল্লা, বলে মনে হচ্ছে, হুজুর’।

ওচুমেলভ ঘুরে দাঁড়িয়ে দুমদুম করে গেলেন ভিড়টার কাছে। কাঠগোলার ফটকটার ঠিক সামনেই তাঁর নজরে পড়ল বোতাম খোলা ওয়েস্টকোট -পরা সেই মূর্তিটি দাঁড়িয়ে। ডান হাত উঁচু করে লোকটা তার রক্ত মাখা আঙুলখানা সবাইকে দেখাচ্ছে। তার মাতাল চোখমুখগুলো যেন বলছে,  ‘শালাকে দেখে নেবো!’ আঙুলটা যেন তার দিগ্বিজয়েরই নিশান! লোকটাকে ওচুমেলভ চেনেন- স্যাকরা খ্রিউকিন। ভিড়ের ঠিক মাঝখানটায় বসে আছে আসামী, অর্থাৎ বর্জোই জাতের একটি বাচ্ছা কুকুর- চোখা নাক, পিঠের ওপর হলদে একটা ছোপ। সর্বাঙ্গ তার কাঁপছে। সামনের দুপা ফাঁক করে সে বসে, সজল দুই চোখে ক্লেশ আর আতঙ্কের ছাপ।

ভিড় ঠেলে ঢুকতে ঢুকতে ওচুমেলভ জিজ্ঞেস করলেন, ‘ব্যাপারটা কী? কী লাগিয়েছো তোমরা? আঙুল তুলে রেখেছিস কী জন্যে? চিল্লাচ্ছিল কে? কে চিল্লাচ্ছিল?

খ্রিউকিন মুঠো করা হাতের ওপর একটু কেশে নিয়ে শুরু করলে, ‘আমি, হুজুর, হেঁটে যাচ্ছিলাম নিজের মনে, কারুর কোনো ক্ষতি না করে। ওই তো ওই রয়েছে মিত্রি মিত্রিচ- উর ঠেঁয়ে লকড়ীর দরকার ছিল হুজুর- তা খামকা, হুজুর, এই কুত্তার বাচ্ছাটা এসে কামড়ে দিলে একেবারে। বুঝুন হুজুর, মেহনত করে খেতে হয় আমাদের… আমার ব্যবসার কাজটিও তেমন সাদা-মাটা নয় হুজুর- এর লেগে ক্ষেতিপূরণ করা করান উদিকে। যা গতিক তাতে আঙুলটি তো আর হপ্তাখানেক লড়াচড়া চলবে না। আইনে তো ইসব নাই হুজুর কি বুনো জানোয়ার-মানোয়ারদের সহ্য করতে হবে আমাদের? সব কিছুই যদি কামড়াতে লেগে যায় তবে জীবনে সুখ কী রইল, আজ্ঞা?’

‘হুম! বটে! গলাখাকারি দিয়ে ভুরু কুঁচকে ওচুমেলভ বললেন কড়া সুরে, ‘বটে, আচ্ছা!… কার কুকুর এটা? এ আমি সহজে ছাড়ছি না! কুকুর ছেড়ে রাখার মজাই দেখিয়ে ছাড়ব! যেসব ভদ্রলোক আইন মেনে চলতে চান না তাঁদের ওপর মন দেবার সময় এসেছে। শালার ওপর এমন জরিমানা চাপাবো যে শিক্ষা হয়ে যাবে, যতো রাজ্যের গরু ভেড়া কুকুর চরতে ছেড়ে দেওয়ার মানে কী! কতো ধানে কতো চাল তা টের পাওয়াচ্ছি!’

কনেস্টেবলের দিকে ফিরে ওচুমেলভ হাঁকলেন, ‘এলদীরিন, তল্লাস লাগাও কার কুত্তা, আর একটা এজাহারও লিখে ফেলো। যা মনে হচ্ছে এ কুকুর ক্ষ্যাপা না হয়ে যায় না- ওটাকে সাবাড় করে ফেলা দরকার এখুনি!… কার কুকুর এটা, জবাব দাও, কার কুকুর?

ভিড় থেকে কে যেন বলে উঠল, ‘মনে হচ্ছে ওটা জেনারেল ঝিগালভের কুকুর!’

‘জেনারেল ঝিগালভ? হুম!… এলদীরিন, আমার কোটটা খুলে দাও… উহ কি গরম! বোধ হয় বৃষ্টি পড়বে। ইন্সপেক্টর খ্রিউকিনের দিকে তাকালেন, ‘কিন্তু একটা ব্যাপার আমার মাথায় ঢুকছে না, তোকে কামড়ালো কী করে? একেবারে হাতের আঙুলে গিয়ে কামড় বসালো, এটা কী রকম? এইটুকু একটা বাচ্ছা কুকুর আর তুই বেটা এমন এক মন্দ জোয়ান? আলবৎ ও আঙুল তুই পেরেক-মেরেকে খুঁচিয়ে এখন মতলব করেছিস ক্ষতিপূরণ আদায় করা যায় কিনা। তোদের চিনতে তো আমার বাকি নেই, শয়তানের ঝাড় সবাই!’

‘ও লোকটা, হুজুর, তামাসা করে কুকুরটার নাকে সিগারেটের ছেঁকা দিতে গিয়েছিল। কুকুরটাও অমনি কামড় লাগিয়েছে। ঐ খ্রিউকিন হুজুর, চিরকালই বদমাইসি করে বেড়ায়।‘

‘মিছে কথা বলছিস, ট্যারা চোখো কোথাকার! আমাকে ছেঁকা দিতে দেখেছো? তবে মিছে কথা বলছে, কে ধম্মকথা বলছে। মিছে কথা বললে আদালতে তার বিচার হোক কেনে। আইন হয়ে গেছে… সব মানুষ এখন সমান বটে। না জানো তো বলি, আমারও এক ভাই পুলিশে আছে…’

‘তর্ক কোরো না, তর্ক কোরো না বলছি!’

‘উঁহু, এটা জেনারেলের কুকুর নয়, কনস্টেবল বললে বিচক্ষণের মতো, ‘অমন কোনো কুকুরই নেই জেনারেলের। ওনার সবকটা কুকুরই শিকারী কুকুর।‘

‘ঠিক জানিস?’

‘ঠিকই বটে, আমিও তাই ভাবছিলাম! জেনারেলের কুকুরগুলো সব দামী দামী, উচুজাতের কুকুর। আর এটা- তাকাতেই ইচ্ছে করে না, হতকুচ্ছিত খেঁকি একটা। অমন কুকুর কেউ পোষে নাকি? তোদের মাথা খারাপ? মস্কো কি পিটার্সবুর্গে ওরকম কুকুর দেখা গেলে কী হত জানো? আইন দেখত না ছাই, পেলেই দফা শেষ করে ছাড়ত। খ্রিউকিন, তোমাকে কামড়েছে মনে রেখো, সহজে ব্যাপারটা ছাড়া হবে না। শিক্ষা দেওয়া দরকার! সময় হয়েছে…’

কনেস্টেবল আপন মনে বলতে শুরু করলে, ‘তা জেনারেলের কুকুরও হয়ে যেতে পারে শেষ পর্যন্ত। চেহারা দেখে কি কিছু বলা যায়। সেদিন জেনারেলের উঠোনে এমনি কুকুর দেখেছিলাম যেন।‘

‘জেনারেলের কুকুরই তো বটে!’ ভিড় থেকে কে একজন বললে।

‘হুঁ!… এলদীরিন কোটটা পরিয়ে দে… দমকা হাওয়া দিল কেমন, শীত করছে… জেনারেলের কাছে এটাকে নিয়ে গিয়ে জিজ্ঞেস করে আয়। বলবি, আমি কুকুরটাকে পেয়ে পাঠিয়েছি। বলবি,  আমি কুকুরটাকে পেয়ে পাঠিয়েছি। বলবি, অমন করে যেন রাস্তায় ছেড়ে না দেন। হয়ত বা দামী কুকুর। শুয়োরগুলো যদি সবাই সিগারেট দিয়ে অমন করে নাকে ছ্যাঁকা দিতে থাকে তবে অমন দামী কুকুরের বারোটা বেজে যেতে কতোক্ষণ? কুকুর হল গিয়ে আদুরে জীব… আর তুই ব্যাটা আহাম্মক, হাত নামা শীগগির! উজবুকের মতো আঙুল দেখাচ্ছিস কাকে? তোরই তো দোষ!…’

‘ওই তো জেনারেলের বাবুর্চি এসে গেছে। ওকেই জিজ্ঞেস করা যাক… ওহে, ও ভাই প্রখ্র, এসো তো বাপু একটু! দেখতো ভালো করে, কুকুরটা কি তোমাদের?’

‘মানে! কস্মিনকালেও অমন কোনো কুকুর আমাদের ছিল না।‘

‘বাস, বাস! ব্যাপারটা বোঝা গেল তাহলে।‘ ওচুমেলভ বললেন, ‘বেওয়ারিশ কুকুর, বাস, ওটাকে খতম করে ঝামেলা চুকিয়ে দেওয়া যাক।‘

প্রখর কিন্তু বলে চলল, ‘এটা আমাদের নয়। এই কিছুদিন হল জেনারেলের ভাই এসেছেন, এটা তারই কুকুর। বর্জোই জাতের কুকুর সম্পর্কে আমাদের জেনারেলের কোনোই শখ নেই। কিন্তু ওর ভাই- ওর পছন্দ হল গিয়ে…’

;কী বললে, জেনারেলের ভাই? ভ্লাদিমির ইভানিচ এসেছেন?’ ওচুমেলভ চেঁচিয়ে উঠলেন, তাঁর সারা মুখ ভরে উঠল এক অপার্থিব হাসিতে, ‘কী কাণ্ড। আর আমি কিনা জানি না! এখন থাকবেন বুঝি?’

‘হ্যাঁ, থাকবেন।‘

‘কী কাণ্ড। ভাইকে দেখতে এসেছেন। আর আমি খবর পাইনি! কুকুরটা তাহলে ওঁরই? ভারি আনন্দের কথা। নাও হে নাও ওটিকে… তোফা ছোট্ট কুকুরটি। ওর আঙুলে কামড়ে দিয়েছিলি! হাঃ-হাঃ-হাঃ-হাঃ! তু-তু, আরে কাঁপছিস কেন?… বিচ্ছুটা চটেছে… কী তোফা বাচ্চা!’

প্রোখর কুকুরটাকে ডেকে নিয়ে কাঠগোলা থেকে চলে গেল। ভিড়ের লোকগুলো হেসে উঠল খ্রিউকিনের  দিকে চেয়ে। ওচুমেলভ হুমকি দিলেন, ‘দাঁড়া না, তোকে আমি দেখাচ্ছি পরে!’ তারপর ওভারকোটটা ভালো করে গায়ে টেনে নিয়ে বাজারের মধ্যে দিয়ে হেঁটে চললেন।

১৮৮৪

শেয়ার করতে:

You cannot copy content of this page