অন্তর্যামী ও বউ কিসসা

শুভায়ুর রহমান

সূর্যটা ঠিক মাথার উপরে আগুনের হলকা নিয়ে হাজির। অসহ্য কাঠফাটা রোদে দু এক মিনিট দাঁড়ানোটা কষ্টের। পিচগলা রাস্তার বুকে সশব্দে দ্রুত পা ফেলতে ফেলতে পথ যাত্রীরা ছায়ার বন্ধু হতে অবিরাম  সচেষ্ট। জৈষ্ঠ্যের নিদারুণ লু, তে প্রতি নিশ্বাসেই লুকিয়ে আদিকালের দাগ। হাঁফানি রুগির মতো অজীর্ণতায় ভরা চোখ মুখ। সঁপসপে ভিজে গায়ে আষ্টেপৃষ্টে লেগে জামার বহর। ফোরটি সেভেন বাই এক বাসটায় চিঁড়ে চ্যাপ্টানো দশা। পিঠ ব্যাগ মাথায় তুলে ভিড়ের বিরুদ্ধে শ্রমের লড়াই খাটিয়ে, চার রাস্তার মোড়ে নেমেই স্বস্তি পাওয়ার বাসনা জাগে। তৃষ্ণার্ত গলায় পায়রা দৃষ্টিতে ইতিউতির গল্প আঁকছে। ভাসিয়ে দিচ্ছে কাউকে দেখার ইচ্ছে। কয়েক পা এগিয়েই দৃশ্যমান হয় বড় সাদা বিল্ডিং। গেটে লাল বোর্ডে জ্বলজ্বল করছে সল্টলেকের হাসপাতালটির নাম। ছাতা ফুটিয়ে অপেক্ষমান মাঝ বয়সী জোবেদ আলি, তার দাঁতের চওড়া হাসিতে স্বস্তি টগবগিয়ে ঝড়ে পড়লো। জোবেদ আলি ছাতাটা ভাঁজ করে চাচাতো ভাই বছর পঁচিশের রওশনকে হাসপাতালের ভিতরে নিয়ে যায়। চিনচিনে ভ্যাপসায় সাঁতারকাটা থেকে দেহটা উদ্ধার করে, এসি ওয়েটিং রুমের ঠান্ডায় ফুরসত দেওয়ার অভিপ্রায়ে সিট দখল নেয় রওশন। জোবেদ আলি ও রওশন আলির মধ্যে বয়সের হেরফের হলেও দাদা ভাইয়ের চেয়ে দু,জনের মধ্যে আটপৌরে সহজ বন্ধুত্বই বেশি প্রকাশ পায়। মিনিট দশেক জিরিয়ে নেওয়ার পর কাঞ্চনকে দেখতে দেবে না? চলো না একবার দেখে আসি জানায় রওশন। জোবেদ উত্তর দিল, আমি রিসেপশনে বলে দেখি। রিসেপশন ম্যাডামের কাছে জোবেদ আলি চওড়া আত্মবিশ্বাসের সুরে অনুরোধ রাখে, ম্যাডাম আইসিইউ বেড নম্বর চার রুম নম্বর শূন্য শূন্য আঠারো। পেসেন্টকে একটু দেখানো সম্ভব কি? কিছুক্ষণ আগে আমার ভাই এসেছে।

-স্যরি! ডাক্তারবাবু এখন রুগি দেখছেন। উনি বেরিয়ে এলে আপনাকে ডেকে দিচ্ছি। ডাঃ রায় বেরিয়ে এলেন গটগট পায়ে। বুটের শব্দ মার্বেল বসানো ঘরের ঝাঁ চকচকে দেওয়ালে লেগে আরো বেশি সাড়া দিচ্ছে। ডাঃ রায় অফিসে ঢুকতে যাবেন এমন সময় পিছন থেকে জোবেদ আলি ডাক্তারের উদ্দেশ্যে বলল, স্যার আমাদের রুগির কি অবস্থা? গত তিন চার দিনের লাগাতার কথাবার্তায় ডাক্তার বাবু জোবেদ আলির চেনা লোক হয়ে উঠেছেন। গ্রামের ধান ক্ষেত, ঝিঁঝি ব্যাঙ শিয়াল ডাক, গাছপালায় ঘেরা মাটির গ্রামে চরাচরের সব আড়ষ্টতা ইমারতের শহরটার গন্ডির মধ্যে ঝেড়ে ফেলেছে জোবেদ আলি। মুখরোচক কথোপকথনে বিঘ্ন না ঘটায় তিন চার দিনেই অভিযোজিত হয়েছে। নিঃসঙ্কোচে হাসপাতালে সকলের সঙ্গে বাক্যালাপের স্পর্শে আসছে। ফলত, ডাক্তার বাবুকে নতুন করে আর রুগি বা বেড রুমের নাম বলার দরকার পড়লো না। ডাঃ রায় উত্তর দিলেন, আপনার ভাগ্নে অনেকটাই বেটার। সবকিছু ঠিকঠাক থাকলে কাল নাগাদ এইচডিইউতে শিফট করবো। ডাক্তারের উত্তরে জোবেদ আলির মুখের গতিপ্রকৃতি আরও উজ্জ্বল হয়। সে ওয়েটিং রুমে ফিরে রওশনের পাশের সিটে আবার হেলান দেয়।

ওয়েটিং রুমের পশ্চিম কোণের একটি মুখকে রওশন পর্যবেক্ষণ করছে। গালে বালি খাদানের ধস। দেহ শ্যামবর্ণ শীর্ণকায় আস্ত পাটকাঠি! অচেনা দুই চোখ শিকার ফেলে অনন্ত কালের সময় পরিমাপ করছে। রওশন উৎফুল্লতায় ওই ব্যক্তিকে উদ্দেশ্য করেই বললো, বড়দা কি অদ্ভুত ব্যাপার দেখো, ওই মানুষটা চিন্তিত, ওর মনের মধ্যে দিয়ে ঝড় বয়ে যাচ্ছে!

-মানে কি, তুই কি করে জানলি?

-কারও মধ্যে ঝড় উঠে যতক্ষণ না তাকে কাবু করছে ততক্ষণ সে কেন হাসপাতালমুখি হবেন?

-তা সে কথা ঠিকই বলেছিস।

-উনাকে ডাক দাও। জোবেদ আলি অচেনা ব্যক্তিকে ডেকে রওশনের পাশের সিটে বসালো। তার জামাটা মলিনতায় যৌবন হারিয়েছে। পিছন অংশ জড়ানো। ঢোলা প্যান্ট। জামার কলারে ভাঁজ করা লাল রুমাল। পিঠ ব্যাগকে সদ্যজাত ছেলের স্টাইলে কোলে রেখে বসেছে। রওশন প্রশ্ন করে, কখন এসেছেন? পেটে দানাপানি পড়েছে? রওশনের খোঁজ খবর নেওয়াতে ওই ব্যক্তি কিছুটা অবাক হল। কিন্তু তার কিছু বলার আগেই আবার রওশন জানালো, ডাক্তার দেখাবেন? কোমরে ব্যাথা। রওশন চেনে কিনা জোবেদ আলি জিজ্ঞাসা করলো, কিরে তুই চিনিস?

-নাহ চিনি না। তবে উনার কপালে জড়ানো ভাঁজ সব বলে দিচ্ছে। শামুক খোলসের জড়তা কাটিয়ে আড়ভেঙে ওই ব্যক্তি উত্তর হাতড়ালো, আমার কোমরে ব্যাথা। খুব কোমরে ব্যাথা। কিন্তু আপনি জানলেন কিভাবে? আরও চমকিয়ে রওশন জানায়, যদি আমার হিসেব ভুল না হয়ে থাকে, তবে আপনার নাম ‘ছ’ বর্ণ দিয়ে শুরু। জোবেদ আলি বেশ বিচলিত হয়ে জিজ্ঞাসা করলো, কি ভাই তোমার নাম?

– নাম ছাপাই ঘরামী। রওশন মিটমিটিয়ে হেসে বলে, আপনার বাড়ি নদিয়া? এক ছেলে রয়েছে। সে এখন কিষানগঞ্জের একটি মাদ্রাসায় পড়ছে। আগে স্থানীয় মাদ্রাসায় পড়তো, সেখান থেকে সরিয়ে কিষানগঞ্জে নিয়ে গিয়েছেন। কথাগুলি শুনে ক্ষণিকে তার উদাসী মনে জীবন্ত দুর্ভিক্ষের অভিমানে টনটনে ভাবটা উথলিয়ে পড়ল। ঘুপচি চুপচাপে কথার উপোষ শুরু হয়। পরিচয়ের ফাঁকে যে বিধিনিষেধের পাঁচিল দেখা দিল, তাতে কিচ্ছুটি বলতে পারে না। তিনজনের মধ্যে এবার নির্জনতা হাজির। কিন্তু প্রাণোচ্ছল আলাপচারিতায় নিশুতি রাত মাখানো নীরবতা রওশনের ভালো ঠেকলো না। সে জানালো, চুপ হয়ে গেলে কেন? ছাপাই  রওশনের হাত দুটি চেপে ধরে প্রশ্ন ছুড়ল, আপনি কে আগে বলুন? আপনার কোতায় বাড়ি? কিভাবে এতসব বলচেন?

-আপনার মনে সুখ নাই। উঠতে বসতে গ্রামের মানুষ খোঁটা দেন, আত্মীয়স্বজন কথা শোনায়। রিসেপশন থেকে ঘোষণা আসে, ‘আইসিইউ বেড নম্বর ফোর, রুম নম্বর জিরো জিরো ওয়ান এইট।

রওশন ও জোবেদ রুগি দেখে হাসপাতালের পূর্বদিকে উপভোগ করছে মেহগনি ছায়া। দূর্বাঘাসের গালিচায় সুন্দর অভ্যর্থনায় ক্লান্তির নির্বাসনে উদযাপন হচ্ছে বিশুদ্ধ বাতাস মেখে ভালো থাকা। জোবেদ আলির জিজ্ঞাসা, তুই এত সব বলছিস? সব গুলিয়ে যাচ্ছে আমার। রহস্যটা আগে বলতো।

-জানতে হয়, জানতে হয় বলে রওশন খ্যাঁকখ্যাঁক করে হেসে ওঠে।

এলেবেলে মন্থর হেঁটে ছাপাই আসে। তার মুখমণ্ডলে অনাবিল কৌতুহলের দ্রাঘিমারেখা। কোনও গুপ্তধনের সন্ধানে অবিচ্ছিন্ন ভঙ্গিমায় তাড়া করছে। চলতে চলতে ভাঁটা এসে জড়ো করেছে স্মৃতির ছেঁড়া এলবামে। এখন শুধুমাত্র জোয়ারের ফেস্টুনের অপেক্ষায় প্রতিকূল ফর্দ টাঙিয়ে সময় ডাক দিচ্ছে। মৌনব্রত কাটিয়ে পাশে বসে বললো, আমি হন্যি হয়ে খুঁজচি। আপনারা এখানে বসে আচেন!

-কি সমস্যা ভাই, আপনার এত খোঁজাখুঁজি কেন? গলা চড়িয়ে রওশন তার দামটা বাড়িয়ে নিলো। বেচারা মুখটা কাঁচুমাচু করে আবেগ তাড়িত হয়। চোখের কোণে মুক্তোদানা চিকচিক করছে।

রওশন আরেকটু বেশিই গম্ভীর ভাব দেখাল। জোবেদের উর্বর মন জমিতে কৌতুহলের বীজ বপন হল। সে অষ্টম আশ্চর্যের সামনে দাঁড়িয়ে! এমনিতেই রওশনের সূক্ষ্ণ বুদ্ধির প্রশংসা পরিবারের লোকেরা করেন। অথচ আজ তো সে সবকিছুকে ছাড়িয়ে যাওয়ার উপক্রম। বয়সে ছোট হলেও মিশুকে ভাব ও পরোপকারী রওশনকে বরাবরই দেখে আসছে জোবেদ আলি। আজকের ঘটনার মধ্যেও তেমন কিছু লুকিয়ে রয়েছে নিশ্চয়, তা বুঝতে অসুবিধা হল না। কিন্তু আসল ঘটনা কি? প্রশ্নের ঘড়বাড়িতে এখন জোবেদের অবস্থান ।

আচ্ছা আপনার কি গ্রামে বাড়ি? রওশন প্রশ্ন করলো

– হ্যাঁ গ্রামেই বাড়ি।

-আপনার গ্রামে কি ধান চাষ হয়?

-হুম ভাই। মাঠ ভর্তি আমন বোরো ধান চাষ হয়।

-লেখাপড়া জানো।

-পাঁচ ক্লাস পর্যন্ত।

-ধানের প্রথম বর্ণ কি?

-ধ ভাই

দুজনের কথোপকথনে থ মেরে তাকিয়ে জোবেদ আলি। রওশন ব্যাগ থেকে একটা লাল তোয়ালে বের করে ছাপাইয়ের হাত দুটো ঢেকে দিল। এরপর রওশন তার হাত দুটোও তোয়ালের মধ্যে রেখে  ছাপাইয়ের হাত দুটি ধরে চোখ বুজলো। রওশন চোখ বুজেই তার কপালের দিকে ছাপাইকে তাকিয়ে থাকতে নির্দেশ দিল। রওশন কয়েকটি প্রশ্ন করলো, তোমার গ্রামের শেষ শব্দ কি?

-পাড়া।

মনে মনে বিড়বিড় করে রওশন জানালো, গ্রামের নাম ধানপাড়া?

-ভাই ভাই মিলে যাচ্চে। ভাই সব মিলে যাচ্চে। ভাই আমারে উদ্ধার করো বলে উত্তেজিত হল ছাপাই।

– পেয়েচি অনেক কষ্টে তোমার মনের রোগ ধরতে পারলাম। এক বছর আগে মানে গত শীতের আগে, তুমি গ্রামের একজন গৃহস্থের খামারে ধান খড়ের গাদা দিতে গিয়ে উপর থেকে পড়ে কোমরে লাগিয়েছিলে। সেটা কখনো কখনো খুবই চাগাড় দিয়ে ওঠে। আর তোমার বউ গ্রামেরই একজনকে বাপ পাতিয়েছিল। সেই বাপের যাতায়াত ছিল তোমার বাড়িতে।

-একদম সত্যি। মিলে যাচ্চে।

-একদিন গ্রামে বাউল গানের আসর বসেছিল। তুমি বাউল গান শুনতে গিয়েছিলে, সেই সুযোগে আট হাজার টাকা নিয়ে বউ পাতানো বাপের হাত ধরে পালিয়েছিল। পাছে কেউ তোমার নড়বড়ে বাড়ির টিনের বাক্সটা চুরি করে, সেজন্য বউয়ের পরামর্শেই টাকাটা বস্তার মধ্যে কাঁথার ভাঁজে লুকিয়ে বস্তাটা ঘরে টাঙানা মইয়ের উপর রেখেছিলে।  যদিও তোমার দোষ ছিল। তুমি দিন রাত বউকে মারধর করতে।

ছাপাই নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছে না। রওশনের পায়ে গড় হয়ে পড়লো। তুমি সব জানো হুজুর। তুমি সব জানো। আমাকে ধোকা দিয়ে আলতা বিবি পালায়।

-ওঠো তুমি, নাহলে আর কিছুই বলবো না।

ধীরে ধীরে ওঠে ছাপাই। সে একেবারে শান্ত হয়ে ভ্যাবাচ্যাকা খেয়েছে। যুগান্তকারী এক উপাখ্যান ধরা গেল ছাপাইয়ের অন্দরে। এক বছরের বেশি সময় ধরে মনের কষ্টে ছাই চাপা দিয়েছে। নিজেকে পালটে ফেলার অভিযান শুরুর চেষ্টা করলেও, ভালোথাকার পাসওয়ার্ড মেলে না। বউ পালানোর পর লোক হাসলো। কোমরের ব্যাথার কারণে খাটুনি নেই। ইনকাম বন্ধ। মনের গভীরে বেড়ে ওঠা সব নিরাকার যন্ত্রণা স্রোত কোন গতিতে বয়ে চলছে ছাপাই তা খুলে বললো।

রওশন উপদেশ দিল, কষ্ট থেকে উদ্ধার পেতে হলে নতুন করে বাঁচতে হবে। অতীত কথা ভুলে আবার নতুন স্বপ্ন দেখতে হবে।

-কিন্তু কিভাবে তা সম্ভব?

-সব হয়ে যাবে ব্যবস্থা।

– হুজুর তুমিই পারো। তুমিই আমাকে এ নরক থেকে উদ্ধার করতি পারো। তুমি সবই জানো। স্বয়ং আল্লাহ তোমার সঙ্গে আমাকে দেখা করিয়ে দিয়েচে।

– তোমার ছেলে আগে যে মাদ্রাসায় পড়তো সেখান থেকে ছেলেকে তোমার বউ নিয়ে যাবে। সেই ভয়ে নিশ্চয় কিষানগঞ্জের মাদ্রাসায় রেখে এসেছো৷

-হুজুর, ঠিক। সব কিচু! কিভাবে সংসার ফেরত পাবো বলো। আমি এমনিতেই দিনমজুর। খেটেখুটে কোনরকমে চলত সংসার। আলতা সেলাই মেসিনে কাঁথা সেলাই করতো। আমি অসুস্থ হয়ে যাওয়ার পর ভারী কাজ করতে পারতাম না। জমিতে খাটা বন্ধ হল। তারপর সব শেষ। আমি এখন ছোট ভাইয়ের বাড়িতে খাই। কিন্তু সে আর কতদিন। ওরাও দেকচি ফিসফিস করে। লজ্জায় মাথা হেঁট হয়। চাচাতো ভাইয়ের কীর্তিতে হতবাক জোবেদ আলি। কিছুই বুঝে ওঠে না। এত কিছুর পর তা চোখে আঁধার ঠেকছে। অথচ রওশন তো চরম ফর্মে। মনে রঙের আবেশ। ফুরফুরে মেজাজে স্বভাব সিদ্ধ ভঙ্গিতে ছাপাইকে পাখি পড়ানো পড়াচ্ছে।

ভেঙে পড়েছে ছাপাই। চোখের নীচে কালি পড়ে ঝুল হয়েছে। কিন্তু এতসবের মধ্যে ক্ষণিকেই আশার আলো ফিরে আসার পথ সুগম হওয়ার ভাবনায় অস্থির।

-ঝড়ের মুখে খড়কুটোর মতো হালকা জিনিস উড়লেও কংক্রিটের ইমারত দাঁড়িয়ে থাকে যেমন, তোমাকে সেভাবে শক্ত হতে হবে। বিপদের সময়ের কাছে মাথা না নুইয়ে বরং সময়কে হারাতে হবে, ছাপাইকে মনোবল জাগাল রওশন।

-তুমি তো অন্তর্যামী! মনের কথা সব বুঝতে পারছো। তুমিই পারো পথ দেখাতে।

-তওবা..তওবা। অন্তর্যামী একথা বলে না। সর্বময় ক্ষমতার যিনি মালিক তিনি নারাজ হবেন। তুমি আবার ঘরে বউ আনো। সংসার সুখে ভরে যাবে। নিজেকে আবিষ্কার করো। বউকে ভালোবাসো। সে তো তোমার মনের মানুষ।

-আমি তাহলে খুব ভুল করেচি।

-মেয়েদের ভালোবাসতে হয়। দশ টাকা বাঁচিয়ে দিনের শেষে কাগজের ঠোঙায় কিছু কিনে এনে হাতে ধরাতে হবে। কিংবা কখনো মেলা থেকে  নতুন চুরি কিনে হাতে পরিয়ে দিতে হয়। মুখে তোলার আগে তাদেরকে জিজ্ঞাসা করতে হয় বউ তুমি খেয়েছ?

-আমি শুনবো, সব শুনবো। শুধু বউ পাওয়ার উপায় বলে দাও।

রাত হল। ছাপাইয়ের কাছে জোবেদ আবার একবার জানতে চায়, এত কথা কিভাবে জেনেছে? কিন্তু রওশন শুধু মুখ টিপে হাসে৷  ওয়েটিংরুমের দেওয়াল ঘেঁষে বেড সিট পেতে তিনজনই শুয়ে পড়লো। একদিকে কাত হয়ে ছাপাই আলোর দিকে তাকিয়ে থাকে। মনের জমানো আমানত তো আলতারই। দিনকে দিন মগজে ভিড় করছে কিলবিল নরক ব্যথা। প্রশ্নরা ঠোকর দিচ্ছে উত্তরের আঁতুরঘরে, সে কেমন উত্তর। চলমান সমান্তরাল জীবনটাকে গিলে খাচ্ছে নিয়তির ঝুলন্ত উপত্যকা। উত্তর খুঁজে পায় না। এত কথা কিভাবে জানতে পারলো?

সকালে হাড় শিরার ডাক্তারকে রিপোর্ট দেখায়। ডাক্তার জানান, আর আসতে হবে না। তবে নিয়মিত ক্যালসিয়াম ট্যাবলেট চলবে। গ্রামেরই ডাক্তার সাহার ভরসায় ছাপাইয়ের এই হাসপাতালে আসা। বাড়ি ফেরার পথে ছাপাই, রওশনের ঠিকানাটা জেনে নেয় সাথে ফোন নম্বরও। মঙ্গলকোটের নিগন গ্রাম। তার মানে নদিয়ার পাশের জেলা বর্ধমান। যাওয়ার আগে রওশনকে আলিঙ্গন করে ছাপাই বলে, চাই তোমাদের রুগি সেরে উঠুক। বাড়ি গিয়ে যোগাযোগ করব। তুমি শুধু আমার ব্যবস্তা করে দিও। ছাপাইয়ের হৃৎস্পন্দন টের পেল। ছাপাইয়ের প্রতি রওশনের বড্ড মায়া জন্মালো।

কয়েকদিন পর রুগি সুস্থ হল। আপ শিয়ালদহ -লালগোলা প্যাসেঞ্জারে চাপিয়ে বাড়ি আনা হয়। একদিন ছাপাই ফোনে খোঁজ নেয় রওশন আদৌ ঘরে ফিরেছে কিনা। জোবেদও খুবই অবাক! চাচাতো ভাইকে জিজ্ঞাসা করে উনার ব্যাপার কিভাবে সহজে বলে দিতে পারছে। কিন্তু আজও রা কাড়েনি। রওশন মিটিমিটিয়ে হেসেছে। দু,সপ্তাহ পর ছাপাই রওশনের বাড়িতে হাজির। লোকটা কি পাগল হয়ে গেল নাকি। কিংবা কতটা উতলা হলে একজন বউ পাগল মানুষ আমার বাড়ি আসতে পারে! সত্যিই সিরিয়াস নিল রওশন। ছাপাইকে কুরে কুরে খাচ্ছে। ছাপাইয়ের আর্তি বুঝে দু,মিনিট ভাবলো তার সংসারে একজন মেয়ে মানুষ অবশ্যই দরকার। মানুষটার বাড়িতে আগমনে সত্যিই চিন্তিত হয়ে পড়ে। লোকটার এক ছেলে রয়েছে। আবার অসুখ বিসুখ বলা যায় না। ভাইয়ের সংসারে তো আর জীবনভর কাটানো যায় না। শোনো তুমি ফের বিয়ে করো। আমি একজনের কাছে পাঠাচ্ছি, তুমি সেখানে যাও। এখন আমার বাড়ি খাবার খেয়ে বাড়ি যাবে। কাল ভোরেই ওই ঠিকানায় বেড়িয়ে পড়বে।

পরের ভোরে গ্রামেরই টোটো চেপে দিঘিরপাড় বাস স্ট্যান্ড। গ্রামের শ্রমিকরা ক্রিং ক্রিং করতে করতে সাইকেলে বেরিয়ে পড়েছে। সবজি বিক্রেতা বাজার যাচ্ছে। মুনিশের দল মাঠে ছুটছে। ভোর চারটে কুড়ির বাস ধরে পলাশি জাতীয় সড়ক বাসস্ট্যান্ডে নামে। সেখান থেকে কিমি তিনেক রামনগর ঘাট। কিছুটা ঝাপসা কেটেছে। অথচ এত সকালে রামনগর ঘাটে যাওয়ার বাস রিক্সা অমিল। ছাপাই তীব্রতায় হাঁটা শুরু করে। দু,দিকে দেবদারু সারি৷ লিকলিকে লতাপাতা। শিরশিরে বাতাস হেলেদুলে গায়ে মাখছে। আড়ম্বরপূর্ণ সতেজ সকালে শিথিল শরীর জেলিফিশের ঘেরাটোপ হতে মুক্তি চাচ্ছে। অন্তঃসারশূন্যতায় পরিপাটি ভাবনারা যখন কাহিল হয়, দুনিয়াও পর হয়। অবশেষে একটা আশার উত্তাপে সেঁক পাচ্ছে। গাছের ফাঁক দিয়ে তখনও দু,একটি তারা তাকিয়ে। নতুন অভিযানে যাচ্ছে সেই পথে ছাপাইয়ের দুরুদুরু মনে উৎচ্ছলতার জোয়ার। রামনগর ঘাটে এসে পোঁছায়। উথালপাতাল ভাগিরথী। ঘাটের দক্ষিণ দিকে বিস্তীর্ণ অংশে চিতা জ্বালানোর ছাপ। তখন দু,একটি চিতা থেকে ধোঁয়া উঠে অসীম শূন্যতায় মিলিয়ে যাচ্ছে। ভোরে মরা পুড়িয়ে কেউ কেউ স্নান সারছেন। ‘বলো হরি..হরি বোল’ বলতে বলতে ম্যাটাডোর, ট্রাকে চেপে লোকজন আরও মরা ঘাটে আনছেন। নৌকার সিঁথিতে বসেছে ছাপাই৷ মায়ের মুখ মনে পড়ছে। বাবার  মুখটা ভিতরে ডুকর দিচ্ছে। বাবা মাকে যেন জ্যান্ত দেখতে পাচ্ছে সে।

 শেষ রাতের ট্রেনে ফেরা ছানা ব্যবসায়ীদের নিয়ে নৌকা ছাড়লো। ছাপাইও অচেনা যাত্রীদের সহযাত্রী। জলের হৃৎপিন্ডে ঢেউ ফেলতে ফেলতে নৌকা তরতরে এগোচ্ছে। সারা রাত মাছ ধরে ক্লান্ত মাঝি তীরের অভিমুখে। নৌকায় জ্বলতে থাকা বাতির আয়ু ফুরিয়েছে। স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে বড় বড় স্টিলের হাঁড়ি সইয়ের ভিতর থেকে বের করছে। ভাগিরথী পেরিয়ে টোটো চেপে বাজার শো রেলস্টেশন, সেখান থেকে ট্রেনে চেপে মুর্শিদাবাদের সালার। পুরনো পাকা বাড়ি। ছাদ বেয়ে  বৃষ্টি নেমে আসার প্রবাহ পথ স্বচ্ছ। বাড়ির সামনে ব্যানার ঝোলানো, প্রজাপতি অফিস। হকচকিয়ে এদিক ওদিক নজর। পিছন থেকে একজন ভারী গলায় জিজ্ঞাসা করলেন?-কি হয়েছে?

-জি, বউ..মানে না..কুদ্দুস মিঁয়া। আমতা আমতা করে বলতে চাইলেও সম্পূর্ণ বাক্য কন্ঠস্বরে আটকে যায়।

-তুমি কুদ্দুস মিঁয়াকে চেনো?

-জি, নাহ।

-কোথা থেকে আসছ?

-জি, ওপারে নদিয়া থেকে।

-আমার সাথে এসো। ভদ্রলোকের কথা শুনে পিছন পিছন ভিতরে প্রবেশ করলো ছাপাই। ভদ্রলোকের পরনে সাদা পাজামা পাঞ্জাবি, মাথায় টুপি। দাড়ি পেকে গলা ছাড়িয়ে বুকে হামাগুড়ি দিচ্ছে। হাতে রুই মাছ, সবজির ঝোলা। ছাপাইকে বসতে বলে বাড়ির ভিতরে চলে গেলেন। বাড়ির বাইরের ঘরে প্রবেশ করে ছাপাই দেখলো বড় হলঘর। স্কুলের ক্লাস ঘরের মতোই দক্ষিণ দেওয়ালের গায়ে চেয়ার টেবিল।  সামনে বেঞ্চি সাজানো। জনা দশেক বসে রয়েছেন বেঞ্চি দখল করে। একজন বললেন, নাম লিখিয়েছেন? নামটা লিখুন। টেবিলে রাখা সাদা খাতায় ছাপাই নামটা লিখলো। সময়কে স্মরণ করিয়ে দেওয়াল ঘড়িটা ঢংঢং বেজে উঠলো। সকাল নটা। বাড়ির ভিতর হতে তিনজন প্রবেশ করলেন। ডেকচিতে লুচি আলুর দম। সকলের সঙ্গে ছাপাইও পেটের সেবা করলো। একটু পরেই সাদা পাজামা পাঞ্জাবি পরিহিত একটু আগে দেখা ভদ্রলোক। হাতে চারটে নতুন পুরনো নাইলনের ঝোলা। টেবিলে রেখে চেয়ারে বসলেন। একটি ঝোলা থেকে দুটো ডায়েরি আরেকটি ঝোলা থেকে পোস্টকার্ড সাইজের অনেকগুলি ছবির বান্ডিল। একেকজন করে নাম ধরে ডাক দিলেন। সুমন. কে আছেন? ছাপাইয়ের বুঝতে অসুবিধা হল না এই ভদ্রলোকের নামই কুদ্দুস মিঁয়া।

প্রথম জন কুদ্দুস মিঁয়ার সামনে বসে জীবনীপঞ্জি জানালেন। বিয়ে হয়ে যাবে, তোমার জন্য ফাস্ট ক্লাস মেয়ে আছে। এই বান্ডিলে একশো মেয়ের ছবি রয়েছে। যেটা পছন্দ বলো জানালেন কুদ্দুস মিঁয়া। অনেক দিন পর নির্বাসন ভঙ্গ করে রোদ হাওয়া মাখতে রঙিন জোৎস্না উড়ছে। শুদ্ধতার নির্যাসে ব্যর্থ আশা আবার জীবনের দরজায় কড়া নাড়বে। শুষ্ক নদীখাতে বয়ে যাবে সমদ্রের আশ্চর্য জলরাশি। পালতোলা নৌকা ছেড়ে মনের সুখে অতিবাহিত হবে বাকি দিনলিপি। মনে মনে খুশি ছাপাই, তবে এত দিনে ঠিক জায়গাতে এসেছে। নীরবে হাজার শুকরিয়া দিচ্ছে রওশনকে। একজন, দুজন এভাবে সবার শেষে ছাপাইয়ের ডাক আসলো। ছাপাই সমস্ত কথা জানায়। অনেক আলোচনায় ছাপাইয়ের মনের কথা বুঝলেন কুদ্দুস মিঁয়া। কুদ্দুস মিঁয়া কিছুটা অভিভাবক গোছের ভূমিকা পালন করে বললেন, রওশন আমাকে ফোনে সব ঘটনা বলেছে। ও আমার নাতির বন্ধু। ওরা একই সঙ্গে উত্তরবঙ্গ ইউনিভার্সিটিতে পড়েছে। অবিবাহিতা, ডিভোর্সী, বিধবা অনেক মেয়েই আছে। কিন্তু আমি পরামর্শ দেবো তুমি আগের বউকে ঘরে তোলো। মীমাংসা করে নাও। তোমার সাজানো সংসার। হয়তো সে ভুল করে ফেলেছিল। তোমার মুখ থেকে যা শুনলাম ছেলেটি দু,দিন পর তোমার বউকে ফেলে দিল্লি পালিয়ে যায়। সেই থেকে তোমার বউ বাপের বাড়িতে। কখনো কি মনে হয়নি যে তোমার বউ আলতা বিবিকে ফিরিয়ে নিয়ে আসবে, এত দিন কি সংসার করলে?

-খুব মনে পড়ে। আয়নায় তাকালি নিজের মুখের জায়গায় আলতাকে দেকি। কিন্তু কোন দিন তাকে আনার কথা ভাবিনি। ছেলের দিকে তাকাতেও পারি না।  কুদ্দুস মিঁয়া মোবাইলটা পকেট থেকে বের করে কানে লাগিয়ে ঘরের বাইরে রোয়াকে পা রাখেন। পাঁচ মিনিট পর ফিরে এসে ছাপাইকে জানালেন, তুমি চিন্তা করো না। বাড়ি ফিরে যাও। তোমার মনের অবস্থা বুজছি। এভাবে তো জীবনটা শেষ হতে পারে না। রওশনকে সব জানিয়েছি।

ফজরের আজান শুরু হতেই গ্রামের ছোট বড় সকলেই গ্রামের পথ, মাঠের সরু আলপথ ধরে হাঁটা শুরু করেছে। আতর সেখ তার নাতনীর হাত ধরে চলছে। ভোরের ঘোমটা সরেনি। মসজিদ পেরিয়ে ছাপাই হাঁক দিল, কই চাচা আসো। আলিবক্স ওজু সেরে পিঁড়িতে উঠেছে। তিনিও উত্তর দিল, তুমি চলো বাপ নামাজ পড়ে আসচি৷ লালভ্রমরা বিলে ‘ভ্রমরা মাছাম’ উৎসব শুরু হবে। বাপ দাদোর আমল এমনকি তারও আগে থেকে জেগে লাল ভ্রমরা বিল। অতীতের মই বেয়ে সে বর্তমানে জীবন অতিবাহিত করছে। পুরনো দিনের জৌলুস না থাকলেও লালভ্রমরার যৌবন একেবারেই ফুরোয়নি। কচুরিপানা, শালুকের পাকা ভিটে এই লালভ্রমরা। লালভ্রমরা সাক্ষী হরেক পাখির আসা যাওয়ায়। ধরিত্রীর মহিমায় লালভ্রমরার নিপাট রূপকথা থরে থরে সাজানো। অথৈ জল কমে গেলে হাঁটু জলে নির্দিষ্ট দিনেই গ্রামের মানুষ পলুই, শিকটি জাল, মশারি, খ্যাপলা জাল, চাবি জাল নিয়ে নেমে পড়েন। বন্দী হয় শোল বোয়াল মাগুর চ্যাঙ রুই কাতলা মৃগেল কই পুঁটি চুনোমাছ। অন্ধকারে হল্লা করতে করতে গ্রামবাসী এগিয়ে চলেছে। মৃদু বাতাসের দয়ায় কেউ গান ধরেছে ‘আকাশটা কাঁপছিল ক্যান, জমিনটা নাচছিল ক্যান, বড়পীর ঘাম ছিল ক্যান..।’ সবার পিছনে ছাপাই। তার পা এগোতে চায় না। মনটাতে তো জরা ব্যাধিতে আক্রান্ত। আকাশ পরিস্কার। গ্রামের মোড়লের ঘোষণায় ‘ভ্রমরা মাছাম’ শুরু হল। বিস্তৃত লালভ্রমরায় কোথাও হাঁটু অবধি আবার কোথাও প্রায় কোমর সমান জল। অগুনতি কালো মাথার মিছিল। মাথায় ফেট্টি, পরনে লুঙ্গি, গায়ে পুরনো ছেঁড়া গেঞ্জি কিংবা জামায় মানুষের হৈ হুল্লোড়ে সমস্ত আনন্দটুকু লালভ্রমরা একদিনের জন্য চুমুক দিচ্ছে। হাসি ঠাট্টায় সে এক বাহারি দৃশ্য। আমজাদ সেখের জিজ্ঞাসা করে, ছাপাই ভাই কতটা মাছ উঠলো? -দুটো পোনা একটা চ্যাঙ আর চার পাঁচটা তেলাপিয়া। মাছ পাওয়ার কথা শুনে আমজাদের মস্করা, অত মাছ কি হবে? ভাবি তো নাই, সে পালিয়েচে।’ আমজাদের কথায় মনে হল ফেরেশতা এসে কলজেটা খুবলে নিল। পারলে লালভ্রমরার বিলে ডুবে মরে। এত অপমান মেনে নেওয়া যায় না৷ মাছ ধরা ছেড়ে ডাঙায় উঠলো। রাগে ফুঁসে বিড়বিড় করে ছাপাই, আজ একটা হেস্তনেস্ত করতেই হবে। সন্ধ্যেই গ্রামের মোড়ল আরিফউদ্দিনের বাড়ি গেল সে। যেভাবেই হোক আলতা বিবিকেই চাই। আরিফউদ্দিন বলেন, ছাপাই চার মাস আগেই তোমাকে বলেচি, ছেলেটার মুকের দিকে তাকিয়ে মীমাংসা করে নাও। আলতা  কতদিন বয়স্ক বাপের ঘাড়ে বসি থাকবি। আলতার বাপ আমাকে এসে মীমাংসাটা করতে বললিও, তুমি রাজি হওনি তকন। যার হাত ধরি পালালো সে তো ছেড়িছুড়ে দিল্লি পালাল। তুমিই বা কত দিন ভাইয়ের সংসারে খাবা।

-বড় ভাই তুমি বললি যখন আমার আপত্তি নাই। তবে আমার এক অন্তর্যামী হুজুর আচেন, তার সঙ্গেও আলোচনা করি। সে আমার ভালো মন্দ অনেক কিচুই জানে। আমার ভালো চায়। আমার একজন মেয়ে মানুষ লাগবি, আলতাকে আনতি হবেই। এলাকার একজন মৌলানার সঙ্গে ছেলে শওকত কিষানগঞ্জ থেকে ফিরেছে। গায়ে ধুম জ্বর। চোখ মুখ গনগনে লাল। কোয়াক ডাক্তারের কাছ হতে ওষুধ আনে ছাপাই। শওকতের মাথা ধুইয়ে দিয়ে বাড়িতে রেখে, গ্রাম থেকে আরিফউদ্দিন মোড়ল, আরও দুইজনকে সঙ্গে নিয়ে ছাপাই রওনা দিল বর্ধমানের হামিদপুর। ছাপাই ফোনে রওশনকে জানিয়ে দিল ওদিক থেকে যেন সে অবশ্যই আসে৷

মাঝে মাঝে সেলাই মেসিনে আলতার পা থেমে যায়। গালে হাত দিয়ে আনমনা হয়ে উঠোনের দিকে চেয়ে থাকে৷ আলতার ভাই জুমোর টিউবওয়েল সারছে। খাঁখাঁ রোদে ভাইয়ের বউ গামলার আচারটা নেড়ে দিচ্ছে। বিস্মৃত মুহুর্ত সংবরণ করছে। নামটা যেমন আলতা গায়ের রঙও দুধে আলতায় গোলা। সেই টনটনে ফর্সা মুখটা খুবই বেজার। মনের ধকল যে পেয়ে বসেছে তা দগদগে ৷ আলতার ধ্যানভঙ্গ হয়। কত দিন পর মানুষটার মুখ দেখছে। আলতার চোখ ছলছল। মোড়লদের নিয়ে ছাপাই হাজির। লোক সঙ্গে নিয়ে জামাইয়ের এ বাড়িতে পা রাখাতে অন্য সদস্যরা বেশ খুশি ৷ জলখাবারের ব্যবস্থা করতে হেঁসেলে ঢোকে আলতা। আরিফউদ্দিন বলেন, আমরা জলখাবার চাই না বউমা।আমরা তোমাকে আনতে এসেচি। ফিরি চলো। এটা তোমার সংসার নয়। তোমার সংসারে নিয়ে যেতে এসেচি। আলতার বাপ সামসেল, ছাপাইয়ের হাত দুটো ধরে জানালো, বাপ অতো অবুজের মতো কাজ করিচে। একটা প্রলোভনে ভুল করেই ফেলিচে। তুমি সব ভুলে যাও৷ মুরুব্বি শ্বশুরের মুখের কথা শেষ করে ছাপাই হেঁসেলে ঢুকে যায়। শওকতের ধুম জ্বর। ঘরে ফিরি চলো। আবার বিয়ে করবো। কথা দিচ্চি আর মারধর করব না। অনেক ভালো রাকবো, চুড়ি ফিতে  কিনে আনব। জিলিপি আনবো। হামিদপুর গ্রামের মোড়ল ও জুম্মা মসজিদের ইমামকে ডাকা হল। আলতার সঙ্গে আবার নিকাহ পর্ব চললো। রওশন বললো, এবার তোমরা ফিরে যাও। আমি বাড়ি যাচ্ছি আমার কাজ শেষ। ছাপাই জানালো, এ ভালো কাজটার মধ্যে তুমিই তো আসল লোক। আর কিছুক্ষণ থাকো। আর হুজুর তুমিই আমার মনের কথা বুজেছিলে। তোমাকে আমি যুগ যুগ, যতদিন এ ধড়ে জান থাকবি তোমাকে হুজুর বলেই মানবো।

-ধুর আমি অসব কিচ্ছু না। মনে পড়ে কি গত বছর হাড়কাঁপানো শীতে মালদা স্টেশনের কথা। কনকনে রাতে আমি উত্তরবঙ্গ থেকে ফিরছিলাম। মালদা স্টেশনে নেমে কাটোয়ার ট্রেনের জন্য অপেক্ষা করছিলাম। সে রাতে তুমিও কিষানগঞ্জ থেকে ফিরছিলে। সিগন্যালের সমস্যার দরুন কিছুক্ষণ তোমার ট্রেনও আটকে ছিল। মালদা স্টেশনে নেমে প্ল্যাটফর্মে বসেছিলে। গায়ে তোমার চাদর থাকলেও মুখ ঢাকা ছিল না। চাদর মাফলারে মুখ ঢাকা এক যুবকের সঙ্গে আলাপ হয়েছিল কি? অল্প সময়ের মধ্যে যাকে মনের কষ্ট উদারভাবে বলেছিলে। কিন্তু আমার নামটাই তুমি জিজ্ঞাসা করোনি। তুমি টানা তোমার ইতিহাসই শুনিয়ে ছিলে। আমি সল্টলেকের হাসপাতালে সেদিন প্রথম দেখেই তোমাকে চিনেছিলাম। চোখ মুখ ঢাকা মালদা স্টেশনে অপেক্ষায় থাকা যুবকই আমি। রওশনের কথায় সবাই হেসে উঠলো। ওহ,আল্লাহ! বলে ছাপাই বিস্ময় প্রকাশ করলো। তার মুখের মানচিত্র পালটে গেল। এতদিনের জমানো ইস্তাহার হাওয়ায় ভাসিয়ে আনন্দের দিন আলতার আঁচলে বেঁধে দিল।

শেয়ার করতে:

You cannot copy content of this page