ধুলো

পর্ব-১

সন্দীপ চক্রবর্তী

বয়েস বাড়লে দৃষ্টি না দৃশ্য কোনটা বেশি ঘোলাটে হয়ে যায় রমেন রায়চৌধুরী ঠিক আন্দাজ করতে পারেন না। ঘরের দুটো জানলাই খোলা। সেই কখন থেকে তিনি ঠাহর করার চেষ্টা করছেন এখন সকাল না সন্ধ্যা। কিন্তু দলা দলা কুয়াশা ছাড়া কিছুই চোখে পড়ছে না।

কোনও শব্দ কি শুনতে পাচ্ছেন? কান খাড়া করলেন রমেনবাবু। মনে হল পাচ্ছেন। একটানা ঘড়ঘড় একটা শব্দ। এ শব্দ তার চেনা। আশ্বস্ত হলেন রমেনবাবু। যাক। আজ তা হলে কফের জঞ্জাল সরিয়ে বুকের ভেতর হাওয়া খেলছে। নয়তো এখনই বুকে গরম তেল মালিশ করতে হত।

এই এক জ্বালা। আলো আছে, মাটি আছে, জল আছে কিন্তু হাওয়া নেই। অন্তত তার জন্য নেই। এ কী অনাসৃষ্টি কাণ্ড রে বাবা! পৃথিবীতে প্রাণী থাকবে আর তাদের নিঃশ্বাস নেওয়ার জন্য পর্যাপ্ত হাওয়া থাকবে না? এ সব কথা মনে পড়লে রমেনবাবু রেগে যান। চাকর নন্দকে গালিগালাজ করেন। যেন নন্দর জন্যই তার শ্বাসকষ্ট।

সোনালদি গ্রামের লোকে বলে বুড়োর ভিমরতি ধরেছে। তাদের অবশ্য দোষ দেওয়া যায় না। বয়েস হয়েছে বই কী রমেনবাবুর। গত চৈত্রে পঁচাত্তরে পা রেখেছেন৷ আধিব্যাধিরও শেষ নেই। তাপমাত্রায় সামান্য হেরফের হলেই হাঁপের টান এমন পর্যায়ে পৌঁছয় যে মনে হয় এ যাত্রায় আর বুঝি টিকলেন না! কিন্তু শেষপর্যন্ত টিকে যান। তার টিকে থাকার রহস্যভেদ করতে না পেরে গ্রামের ছেলেছোকরারা বলে, ‘বুড়ো কীভাবে যমদূতকে কলা দেখায় বুড়োই জানে।’ কথাটা ঠিক। রমেনবাবু জানেন। তার ধনুর্ভাঙা পণ। যতদিন না তার নিরুদ্দিষ্ট পুত্র শোভেন ফিরে আসে ততদিন তিনি এ বাড়ি ছেড়ে কোথাও যাবেন না। স্বর্গেও না।

উঠে বসলেন রমেনবাবু। এ পাশ-ও পাশ নজর করে বুঝলেন কুয়াশা আর নেই। দিব্যি দেখা যায়। হরিশচন্দ্রের সঙ্গে চোখাচোখি হয়ে গেল। বিশাল তৈলচিত্রের ফ্রেমের মধ্যে হাসি-হাসি মুখে তাকিয়ে আছেন। আগে বাবার ছবিতে প্রণাম করে দিন শুরু করতেন রমেনবাবু। এখন আর করেন না। মৃত্যুর মতো মৃতদেরও তিনি মুছে ফেলতে চান। হরিশচন্দ্রের পাশে আরও তিনটে বিশাল তৈলচিত্র। শতাধিক বছরের দীর্ঘশ্বাসের ভারে কালো হয়ে গেছে রংয়ের প্রলেপ। কেউ বলে দিলে জানা যায় ছবিগুলো রমেনবাবুর পিতামহ গোপালচন্দ্র, প্রপিতামহ অনুকূলচন্দ্র এবং অতিবৃদ্ধ প্রপিতামহ প্রতাপচন্দ্রের৷

ছবি দেখতে দেখতে রমেনবাবু হঠাৎ ক্ষিপ্ত হয়ে উঠলেন৷ রাগ নন্দর ওপর। অনেকবার হতভাগা চাকরটাকে ছবিগুলো জঞ্জালের গাদায় ফেলে আসতে বলেছেন কিন্তু সে ফেলেনি। রাগের চোটে বিড়বিড় করতে থাকেন রমেনবাবু। তোর কীসের এত টান রে শুয়োর! ওই মানুষগুলো তোর কে? যত্তসব মরা-হাজা! আমাকে এখনও বিশ বছর বাঁচতে হবে। শোভেনের হাতের জল না খেয়ে আমি কোত্থাও যাব না।

রমেনবাবুর মনে হল খাট থেকে নেমে বাইরে যাওয়া দরকার। খাটটা সাধারণ খাট নয়। পালঙ্ক বিশেষ। হরিশচন্দ্রের বিবাহে দানসামগ্রীর সঙ্গে এসেছিল। রমেনবাবুর মা তরুবালা তখন তেরো বছরের কিশোরী। মেয়ে এত উঁচু পালঙ্কে উঠতে পারবে না বলে রমেনবাবুর দাদামশাই অবিনাশ মিত্তির একটা নীচু জলচৌকি তৈরি করিয়ে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন। তরুবালা জলচৌকিতে পা দিয়ে পালঙ্কে উঠতেন।

রমেনবাবুর জীবনে ওঠার মতো আর কোনও শীর্ষদেশ অবশিষ্ট নেই। এখন শুধুই নামা। কিন্তু তার জন্যেও তো নন্দর হাত নয়তো তরুবালার জলচৌকি প্রয়োজন। অন্যথায় ভারসাম্য রাখতে না পেরে মাথা ঘুরে পড়ে যেতে পারেন।

তিতিবিরক্ত হয়ে রমেনবাবু হাঁক পাড়লেন, ‘নন্দ, অ্যাই নন্দ।’

নন্দর সাড়া পাওয়া গেল না। তার বদলে সাড়া দিল একটা কুকুর। রমেনবাবু বুঝলেন নন্দ বাড়িতে নেই। সদর দরজা আগলে বসে আছে ফুলি। এ পাড়ার মাদি কুকুর। ফুলিকে ট্রেনিং দিয়েছে নন্দ। সে কোথাও গেলে ফুলি রমেনবাবুকে জানিয়ে দেয় নন্দ বাড়িতে নেই। তবে ফিরে আসবে এখনই।

টুকিটাকি কিছু কেনাকাটি সেরে নন্দ যখন বাড়ি ফিরল রমেনবাবু তখনও খাটের ওপর থম মেরে বসে আছেন। চরাচরে লেপ্টে থাকা কুয়াশা এখন আর একেবারেই নেই। জানলার ওপারে রায়চৌধুরীদের বিশাল জমিদারবাড়ির ধ্বংসাবশেষ। সোনালদি, বোষ্টমপাড়া, সোনারচক, বাবুডাঙার লোকেরা এখনও এই বাড়িকে বলে রাজবাড়ি। অথচ যে-দরবারঘরে বসে প্রজাশাসন করতেন অনুকূলচন্দ্র সেখানে এখন সাপখোপের আড্ডা। বিশাল বিশাল বট আর অশ্বত্থ ছাদ ফাটিয়ে মাথা তুলেছে আকাশে। বেঁচেবর্তে থাকা দুটি মাত্র ঘরে রমেনবাবু আর নন্দ থাকেন।

পায়ের শব্দে রমেনবাবুর সম্বিত ফিরল। নন্দকে দেখে দাঁতমুখ খিঁচিয়ে বললেন, ‘এই যে আমার লাটসাহেব! কোন রাজকার্যটা করছিলেন শুনি?’

এই ধরনের সম্ভাষণের সঙ্গে নন্দ পরিচিত। চল্লিশ বছর হয়ে গেল তার এ বাড়িতে। রমেনবাবুর স্ত্রী অন্নপূর্ণাকে সাহায্য করার জন্য দশ বছর বয়েসে এসেছিল। তারপর কত কী ঘটে গেল! শোভেন গৃহত্যাগ করল৷ অন্নপূর্ণা মারা গেলেন। ধ্বংসস্তূপে পরিণত হল রায়চৌধুরীদের সাধের রাজবাড়ি। থেকে গেলেন শুধু রমেন রায়চৌধুরী। তার আশা শোভেন ফিরবে। এবং ছেলেকে দেখে তিনি শান্তিতে মরতে পারবেন।

গালিগালাজ শুনে প্রথম-প্রথম নন্দর রাগ হত। এখন দুঃখ হয়। করুণা হয় মানুষটার জন্য। সে শান্ত গলায় বলল, ‘কয়েকটা জিনিস ফুরিয়ে গিয়েছিল। তাই দোকানে গিয়েছিলুম।’

‘দোকানে গিয়েছিলুম।—তোকে এই ছবিগুলো ফেলে দিতে বলেছিলুম। ফেলিসনি কেন?’

‘আজ্ঞে পূর্বপুরুষের ছবি ফেলে দেবেন?’

‘আমার পূর্বপুরুষের ছবি আমি ফেলে দোব তাতে তোর বাপের কী রে শালা! যা বলছি তাই করবি।’ নন্দ কাঁচুমাচু ভঙ্গিতে বলল, ‘বলছেন যখন তাই করব। কিন্তু ছবি না থাকলে গাল পাড়বেন কাকে?’

কেমন যেন থিতিয়ে গেলেন রমেনবাবু। কথাটা ভুল বলেনি নন্দ। কাউকে পোড়াতে না পারলে তো নিজেই নিজের আগুনে জ্বলেপুড়ে ছাই হয়ে যাবেন। বিচারক এসে দেখবে অপরাধী নেই। শাস্তিই সার হবে জীবনে ক্ষমা আর জুটবে না।

রাজবাড়ির ধ্বংসস্তূপের দিকে তাকিয়ে রমেনবাবু মৃদু গলায় বললেন, ‘তুই এখন যা নন্দ। আমায় একা থাকতে দে।’ (ক্রমশ)

শেয়ার করতে:

You cannot copy content of this page