ধুলো (দ্বিতীয় পর্ব)

প্রথম পর্বের পর

সন্দীপ চক্রবর্তী

বর্ষার শুরুতেই ক’দিন বেশ বৃষ্টিবাদলা হয়ে গেল। শীত আর বর্ষাকে নন্দর বেশি ভয়। এই সময় রমেনবাবু খুব কষ্ট পান। এবারও তার ব্যতিক্রম হল না। অসুস্থ হয়ে পড়লেন রমেনবাবু।
নিদারুণ শ্বাসকষ্টে কথা বন্ধ হয়ে গেল। সারাদিন বাতাসের খোঁজে মানুষটা ছটফট করেন আর বোবা চোখে চেয়ে থাকেন দূরে। এ দৃষ্টি নন্দ চেনে। মৃত্যুপথযাত্রী মানুষ মুক্তির জন্য ঈশ্বরকে ডাকে। রমেনবাবুর ঈশ্বর নেই। শোভেন আছে। রমেনবাবু ছেলেকে ডাকেন। একমাত্র সেই পারে অনুশোচনায় জর্জরিত মানুষটাকে মুক্তি দিতে।

সোনালদির সবে ধন নীলমণি ডাক্তার অবনী ঘোষ ভালো করে দেখেশুনে বলল, ‘আমি ওষুধ দিতে পারি নন্দ কিন্তু রোগ সারাতে পারব না। ওটা তোর কাজ তোকেই করতে হবে।’
নন্দ কিছু বলল না। কারণ কথাটা নতুন নয়। একবার হঠাৎই সে আজগুবি এক চিকিৎসা পদ্ধতি আবিষ্কার করে ফেলেছিল। অবনী ঘোষের নির্দেশে সেবারই প্রথম অক্সিজেনের সিলিন্ডার এসেছিল বাড়িতে। কিন্তু দিনরাত নলের হাওয়া টেনেও রমেনবাবুর বুকের গুমোট কাটেনি। নেতিয়ে পড়া বৃদ্ধের বুকে গরম তেল মালিশ করতে করতে এমনিতেই নন্দ অনেক কথা বলে। সেদিন কী হয়েছিল কে জানে, আচমকা বলে ফেলেছিল, ‘আপনার এরকম বিছানায় পড়ে থাকা চলবে না। উঠে বসতে হবে। শোভেনদা এসে যদি আপনাকে এই অবস্থায় দেখে কত কষ্ট পাবে বলুন তো?’
সেবার এই ঘটনার দু’দিন পরেই উঠে বসেছিলেন রমেনবাবু। ব্যাপার-স্যাপার দেখে একদম ভ্যাবলা বনে গিয়েছিল নন্দ। এ কী কাণ্ড রে বাবা! ভোজবাজি নাকি? তার সামান্য একটু সান্ত্বনায় কী আছে যে রমেনবাবু এরকম চাঙ্গা হয়ে উঠলেন। অবনী ঘোষ বুঝতে পেরেছিল রহস্যটা। বুঝিয়ে দিয়েছিল নন্দকে। তারপর রমেনবাবু যতবার অসুস্থ হয়েছেন অবনী ডাক্তার শুধু ওষুধ দিয়েছে। আর নন্দ দেখিয়েছে স্বপ্ন। যে-মায়ার বাঁধনে রমেনবাবুর জীবন বাঁধা, তাতে দিয়েছে গিঁট। গিঁটের পরে নতুন গিঁট। বাঁধন শক্ত হতেই রমেনবাবুর শ্বাসকষ্ট একটু একটু করে হাওয়ায় মিলিয়ে গেছে। উঠে বসেছেন তিনি। সুস্থ হবার পর যথেচ্ছ গালাগাল দিয়েছেন নন্দকে। মানুষটাকে মৃত্যুর হাত থেকে ফিরিয়ে আনতে পারার আনন্দে ভরে গেছে নন্দর মন।
এইভাবেই চলছে গত পাঁচ বছর।

অবনী ডাক্তার চলে যাবার পর নন্দ কাজে লেগে পড়ল। এই শরীরে রমেনবাবুর স্নান করা চলে না। কিন্তু দাড়ি কামিয়ে দিতে হবে। নয়তো খেতে পারবেন না। নন্দ বসল দাড়ি কামাতে। তারপর রান্না। গলা ভাত আর জিরে-পাঁচফোড়ন দিয়ে বানানো চারা মাছের ঝোল। মা যেভাবে সন্তানকে খাওয়ায়, সেইভাবে খাওয়াতে-খাওয়াতে নন্দ শুরু করল তার ডাক্তারি, ‘শোভেনদার জন্য আমার দুঃখ হয়। আপনাকে কী দেখে গিয়েছিল আর এবার এসে কী দেখবে! মনে আছে এক সময় আপনি ঘোড়ায় চড়তেন? তখন এ তল্লাটে গাড়ি ছিল না। আপনার শুধু একটা সাদা রংয়ের ঘোড়া ছিল। বাপ রে, সে ঘোড়ার কী তেজ! হাওয়া কেটে তিরের মতো ছুটত। শোভেনদার ঘোড়ায় চড়ার খুব শখ ছিল। আপনি শিখিয়ে দিয়েছিলেন। শোভেনদা ফিরে এসে যদি দেখে আপনি—‘
আচমকা থেমে গেল নন্দ। ভালো করে দেখল রমেনবাবুকে। আশ্বস্ত হল দেখে। দৃষ্টিটা আগের থেকে জীবন্ত। ঠোঁটের কোণে অল্প একটু হাসির আভাস৷ অর্থাৎ ডাক্তারিতে কাজ দিয়েছে। এইভাবে চালাতে হবে আরও দু’তিনদিন। তবে রমেনবাবু কথা বলবেন। এই ব্যাপারটা নন্দ ভালো বোঝে না। হাঁপের রুগি তো সে তো কম দেখেনি। সোনালদিতেই দু’জন আছে। টান উঠলে তাদের কারও কথা বন্ধ হয় না৷ কিন্তু রমেনবাবুর হয়। অবনী ডাক্তারকে জিজ্ঞাসা করলে বলে, ‘তোর অত জানার দরকার কী বাপু! তুই যেমন ডাক্তারি করিস, করে যাবি। দেখবি চলে যাওয়া কথা আবার ফিরে এসেছে।’
তা, ফিরে আসে বটে৷ কিন্তু কেন চলে যায় জানতে পারলে নন্দ কখনও যেতেই দিত না। রমেনবাবুর ঠোঁটের কোণে হাসির ঝিলিকটুকু দেখতে দেখতে নন্দ ফিরে গেল ডাক্তারিতে, ‘আমার কথা শুনে হাসি পাচ্ছে বুঝি? কেন, হাসি পাচ্ছে কেন? শোভেনদা কি ফিরবে না? সময় হয়ে গেছে। না এসে যাবে কোথায়?’

(ক্রমশ)

শেয়ার করতে:

You cannot copy content of this page