বইপাড়ার অন্দরমহল

আরে দেখতে পাচ্ছেন না আমার পা টা আপনার পা এর নিচে??
অদ্ভুত পা টা দেখে নামাতে পারেন নি??
জায়গাটা কোথায়?? এদিকে ভ্যান ওদিকে রিক্সা সামনে দুজন কাঁধ ভর্তি বই নিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন, রাস্তাটা সব বই বিক্রেতারা বই সাজিয়ে এত ছোট করে দিয়েছেন হাঁটবো কি করে??
এটাই বইপাড়ার চেনা চিত্র, কিন্তু করোনা কি সেখানে থাবা বসায় নি? বসিয়েছে, অনেকটাই বসিয়েছে। তার দোসর যেন আমফান, তার মধ্যেও তো বইপাড়া লড়ছে?  একের পর এক বই এর প্রকাশক বা বিক্রেতারা ঝাঁপ বন্ধ করে দেননি এটাই তো আশার আলো। হ্যাঁ বাকি অন্যান্য ট্রেডের মতো এঁরাও সেই লড়াইয়ে যেন কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে এগিয়ে যাচ্ছেন,কিন্তু শুধু কি করোনা? শুধু কি সাময়িক একটা বিধ্বংসী ঝড় পুরো বইপাড়াকে তছনছ করে দিয়েছে ?

না,সত্যিই সেটা সাময়িক হলেও তার ঝাপটা অনেকটাই ক্ষতি করে দিয়ে গেছে, কিন্তু এগুলো না হলে কি বইপাড়া তরতর করে গতি বাড়িয়েছিল?
একদমই নয়, তার কারণ বইপাড়ার অন্দরমহলে অনুসন্ধান করলে কপালে চিন্তার ভাঁজ পড়তে বাধ্য। আসলে বইপাড়ার এই সমস্যা গত দু বছরে প্রকট হয়েছে। তবে ২০১১ সালের পরে সারা রাজ্যের স্কুলের বইগুলি যেগুলি স্বাধীন ব্যক্তিগত প্রকাশকরাই প্রকাশ করতেন ও তাঁর সব থেকে বড় মার্কেট ছিল সারা রাজ্যেই। যার আঁতুরঘর এই বইপাড়াকে কেন্দ্র করেই সেটি রাজ্য সরকার অধিগ্রহণ করে নিলেন বিনামূল্যে ছাত্রছাত্রীদের বই বিতরণ কর্মসূচি নেওয়ার মাধ্যমে। কিন্ত রাজ্য সরকার কর্তৃক প্রকাশিত বই প্রোডাকশন খরচ এর একটা বড় অংশ কেন্দ্রীয় সরকারের মাধ্যমে বিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীদের অনুদান স্বরূপই আসছে। সারা রাজ্যের সকল সরকারি বিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীরা একই ধরণের বই পড়ছে তার ফলে বই তৈরির ক্ষেত্রে বিভিন্ন লেখক লেখিকার লেখায় যে বৈচিত্র্য পাওয়া যেত সেটা প্রায় বন্ধ হয়ে গেল, পথে বসলেন পাঠ্য বইয়ের প্রকাশকরা।

সারা রাজ্যের বই বিক্রেতাদের প্রায় ৮০-৯০ শতাংশ একটা মরসুম এই পাঠ্য বইয়ের উপরেই নির্ভর করতেন,তাঁরা রুটি রুজির সংশয়ে পড়লেন,অন্য ব্যবসায়ে কেউ চলে গেলেন। কেউ অন্য পেশায় চাকরি নিলেন। প্রকাশকরা সিঁদুরে মেঘ দেখে বিক্ষিপ্তভাবে আন্দোলন গড়ে তুলেও আটকাতে পারেননি।ব্যর্থ হয়ে এই বড় অংশের প্রকাশকরা ঝুঁকলেন গল্পের বইয়ের দিকে নয়তো ইংরেজি মাধ্যম স্কুল বইয়ের দিকে। কিন্তু সেখানে মারাত্মক অসম প্রতিযোগিতা,দিল্লি মুম্বাইয়ের বৃহৎ পুঁজির প্রকাশনার সঙ্গে বাঙালি ছোট প্রকাশন সংস্থাগুলি প্রতিযোগিতায় কেউ পারলেন,কেউ না পেরে তাঁরাও ঝুঁকলেন গল্পের বই এর দিকে। কিন্তু গল্পের বই, প্রবন্ধের বই যেগুলি ভালো বিক্রয় হয় তার লেখক বা লেখিকার সংখ্যাই বা কত? প্রকাশকের সংখ্যা প্রতিদিন বৃদ্ধি পেয়েছে লেখক লেখিকার সংখ্যার তুলনায়,বরং প্রখ্যাত লেখক লেখিকাদের বয়স বৃদ্ধির জন্য লেখা যেমন কমেছে,তেমন কেউ কেউ প্রয়াত হয়েছেন। আরও সংকটে পড়েছে বইপাড়া। একটা সময় চলছিল যখন বইপাড়ায় নতুন ভাবনার নতুন ধারণার লেখা আসা হ্রাস পাচ্ছিল।সেই সময় কালের নিয়মেই কিছু নতুন প্রজন্মের লেখক লেখিকারা উঠে এলেন। পাঠক পাঠিকারা তাঁদের প্রতি আকৃষ্ট হলেন।বইপাড়া আসতে আসতে একটু একটু করে নতুন আশার আলো দেখছিল উঠে এলেন বেশ কিছু তরুণ প্রকাশকরা।


তৈরি হল বই তৈরির ক্ষেত্রে সৃজনশীলতা।তরুণ প্রকাশকরা প্রায় চমকে দেওয়ার মতো প্রোডাকশন করার চেষ্টা করলেন। সেটা আজও জারি আছে।নতুন বেশ কিছু তরুণ প্রচ্ছদশিল্পী এলেন।যাঁরা বইপাড়াকে আরও অভিনব সৃজনশীল প্রচ্ছদে মুড়ে দেওয়ার অক্লান্ত চেষ্টা শুরু করলেন। নতুন লিটল ম্যাগাজিন তৈরির উদ্যোগ তৈরি হতে শুরু করল নতুন প্রজন্মের হাতে। কিন্তু সবটাই ব্যক্তিগত উদ্যোগে।

বিক্ষিপ্তভাবে, রাজ্যের সংস্কৃতির ক্ষেত্রে অন্যতম অক্সিজেন যে বইপাড়া যোগান দেয় চলচিত্র থেকে নাটক বা সামাজিক ক্ষেত্রে, সেই বইপাড়া আসলে বড্ড অবিন্যস্ত। সাধারণত যাঁরা সৃষ্টিশীল হন তাঁরা যেমন একটু অগোছালো হন স্বভাবগতভাবে। বইপাড়াও যেন অনেকটা তেমনই,অদ্ভুত সৃষ্টিতে মেতে উঠতে গিয়ে ঐক্যবদ্ধ নয়। অগোছালো,কিন্তু সেই বইপাড়াকে একটু গুছিয়ে তোলার চেষ্টা সমষ্টিগতভাবে তৈরিই হলো না। সরকারও কি খুব ভাবলো? ভাবলে তো বইপাড়ার গল্পের বই বিক্রয়ের মূল জায়গা যে গ্রন্থাগার ব্যবস্থা সেটিকে শক্তিশালী করার কথাই ভাবা যেত। বরং নতুন গ্রন্থাগারিক নিয়োগের অভাবে ও গ্রন্থাগার ব্যবস্থার ক্ষেত্রে সমর্থক ভূমিকা বা ভাবনার অভাবে রাজ্যের বৃহৎ থেকে ছোট গ্রন্থাগারগুলিও ধুঁকছে, এ যেন মরার উপরে খাঁড়ার ঘা, তার সঙ্গে গত দু বছর ধরে বইপাড়াকে কেন্দ্র করে সরকারের বিভিন্ন প্রকল্পগুলো বন্ধ হয়ে গেল। কেন্দ্রীয় সরকারের আর এম এস এর মেলা যা মূলত স্কুলমেলা বলে পরিচিত সেটিও বন্ধ হয়ে আরও বিপদে পড়লেন গল্পের বইয়ের প্রকাশকরা। কারণ বন্ধ হওয়ার ঘোষণার পূর্বেই প্রকাশকরা প্রায় ধার করেও পুঁজি ব্যয় করেছেন। এক একটি বই কেউ কেউ ১/২হাজার ছেপে ফেলেছেন। রাজা রামমোহন লাইব্রেরি ফাউন্ডেশনের বই ক্রয়ের প্রকল্পও বন্ধ হয়ে গেল সরকারি আধিকারিকদের গড়িমসি ও ব্যর্থতায়। তার ফল হলো মারাত্মক। যে বই একসময় এক-দু হাজার ইম্প্রেসন দেওয়া হতো সেই বই ৫০০ কিংবা ৩০০ সংখ্যায় নেমে এলো। আর বর্তমানে ১০-৫০টা করেও বই তৈরি হচ্ছে আধুনিক মুদ্রণের দৌলতে।

খুব ধীরে ধীরে কঠিন পরিস্থিতির দিকে চলেছে বইপাড়া। সবটাই কি আশাহত করার মতো? না নবীন কবি, লেখক, লেখিকা, প্রচ্ছদশিল্পীরা যেমন কিছুটা আশার আলো দেখাচ্ছেন, তেমনি নতুন ভাবনার প্রকাশকরাও সেই আশার ক্ষীণ আলো নিয়েই সাহস করে এগোতে চাইছেন। এই মুহূর্তে যেটা প্রয়োজন সেটা হলো অবিন্যস্ত অগোছালো অসংগঠিত বইপাড়াকে সংগঠিত করা। না সেটা বইপাড়ার অসংখ্য প্রকাশক ও বই বিক্রেতাদের সংগঠনগুলি দিয়ে শুধু সম্ভব নয়। প্রয়োজন লেখক-লেখিকা-বুদ্ধিজীবীসহ সরকারের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা প্রয়োজন আধুনিক দৃষ্টিভঙ্গি। প্রয়োজন সংগঠিত করার শুভ উদ্যোগ। প্রয়োজন গ্রন্থাগার পরিকাঠামোর আধুনিকীকরণ। প্রয়োজন বাজেটে বইপাড়ার জন্য অর্থ বরাদ্দ। প্রয়োজন সহযোগিতা। যদি বইপাড়া বাঁচে পাঠক-পাঠিকারা যেমন নতুন সৃষ্টি হাতে পাবেন, তেমনি বইপাড়াকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা প্রুফ কর্মী, প্রচ্ছদ ও অলংকরণ শিল্পী, মুদ্রণ কারখানা, বাঁধাই কারখানাসহ বইপাড়ার অসংখ্য কর্মীসহ ভ্যানচালক, ছোট ছোট পুস্তক বিক্রেতাদের মুখেও ফুটবে আনন্দের হাসি, ভিড় ঠেলাঠেলি বইপাড়া একটু অন্যভাবেই সেজে উঠুক,মানুষ নতুন বইয়ের গন্ধ পাওয়ার জন্য ভিড় করুক বইপাড়ায়..

শেয়ার করতে:

You cannot copy content of this page