বিল্লির বেয়াদপি
পার্থসারথি গুহ
গত কয়েকমাস ধরে একটা ঘটনা নিয়ে রীতিমতো হইহই রইরই চলছে মোহনচকে। মলয় চক্রবর্তী আর প্রসূন পালিতের টানাপোড়েন নিয়ে ব্যতিব্যস্ত হচ্ছে এই জনবহুল চত্ত্বর। একে অবিশ্যি টানাপোড়েন না বলে সার্কাস বলাই ভাল। যা কার্যত রেওয়াজে পরিণত হয়েছে।
সার্কাস কথাটা শুনলে অবাক হবেন না মোটেই। বস্তুত সার্কাসের চেয়েও বেশিমাত্রার রঙ্গ চলছে এখানে।
সময়ঃ সকাল আটটা থেকে নয় ঘটিকার মধ্যে।
মফস্বল শহর মোহনপুরের জমজমাট মোড় এই মোহনচক। সেখানেই সকালের তামাশার ব্যাটন হাতে তুলে নিয়েছেন মলয় চক্রবর্তী। ওনার বিপরীত নটের ভূমিকায় প্রসূন পালিত। এমনিতে নিপাট ভদ্রলোক। তবে একটু ক্ষ্যাপা। সেজন্যই তো মলয় চক্রবর্তীর কথায় এতো রিঅ্যাক্ট করেন। আর তুলকালাম বাঁধান।
এখন যেটা হচ্ছে সেটা গত কয়েকমাসের অ্যাকশন রিপ্লে বলাইবাহুল্য। প্রথম প্রথম একে ড্রামাই বলতেন মোহনপুরকে বটবৃক্ষের মতো ছায়া দিয়ে চলা দীপক চৌধুরী।
আলাপির দোকানে মৌজ করে লিকার চায়ে চুমুক মারতে মারতে বয়োবৃদ্ধ দীপক বলে যেতেন, ” এই ঠাট্টা -ইয়ার্কি গুলো না থাকলে দূষিত কার্বন-ডাই-অক্সাইডে ভরে যাবে মোহনপুর। তখন আমরা কেউ বাঁচবো না। তার চেয়ে থাক না মলয়ের এই ড্রামাবাজি। অক্সিজেনের ভরপুর আমদানি তোমরা বন্ধ করো না মোটেই। ”
মলয় চক্রবর্তীর মানুষের পিছনে লাগা একটা স্তর পর্যন্ত তাও উপভোগ করছিল মোহনপুরবাসী। তারমধ্যে দীপক চৌধুরীর কথা তো আগেই বললাম। তারসঙ্গে আলাপি মণ্ডলের দোকানের মজলিশটার কথাও বিশেষভাবে উল্লেখ করতে হয়।
আগে আলাপির স্বামী চিত্ত মণ্ডলই দোকানটা চালাত। কিন্তু বিগত কয়েকবছর ধরে প্যারালাইসিস হওয়ায় পুরোপুরি শয্যাশায়ী চিত্ত।
রাতে স্ট্রোক মতো হল। বাঁদিকটা পুরো পড়ে গেল চিত্তর। তারপর থেকেই দোকান আলাপির হাতে।
স্বামীর ব্যয়বহুল চিকিৎসা চালানোর জন্যই দোকানটার হাল ধরেছে আলাপি। নচেৎ এর ওর বাড়ি কাজ করে আগের মতো চালিয়ে নেওয়াই যেত। নিঃসন্তান দম্পতির কোনও অসুবিধে ছিল না।
কারা যেন বলে মেয়েমানুষের দ্বারা কারবার হয় না। একথা যে সম্পূর্ণ ভুল তা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে চলেছে আলাপি। চিত্তর আমলের ছোট্ট দোকানটা শুধু চা আর বিস্কুটেই সীমাবদ্ধ ছিল।
আলাপির আলাপনে সেখানে এক এক করে সামিল হয়েছে ডিম পাউরুটি, কলা, মাখন-টোস্ট, ঘুগনি, আলুরদম। ও হ্যাঁ, রাতে আবার রুটি তরকাও বানাচ্ছে ও।
পিছনের দিকের একটু জায়গা বাড়িয়ে দোকানটা গায়েগতরে হয়েছে। এলাকায় নগরোন্নয়নের কাজ চলছে লাফিয়ে লাফিয়ে। পুরনো বাড়ি ভেঙে গজিয়ে উঠছে মস্ত ফ্ল্যাট। এই কাজে প্রচুর মিস্ত্রি,লেবার, হেল্পার আর ঠিকাকর্মী সামিল হচ্ছে। তারাই সকাল থেকে এই দোকানে বডি ফেলে দিচ্ছে। নাস্তা থেকে দুপুর-রাতের খাবার সারছে ।
নগেন ভৌমিক মন্দ বলেন না, ” আলাপির আস্তাবলের একেকটা ঘোড়া হলাম আমরা। আলাপি দিনের পর দিন ঘাসবিচালি খাইয়ে আমাদের হৃষ্টপুষ্ট করে তুলছে। ”
নগেনবাবুর কথায় তাল মেলান প্রফুল্ল পাল, রমেন হালদার, রঘু প্রসাদরা। নগেন থেকে রঘু এনারাও হলেন আলাপির আস্তাবলের পার্মানেন্ট ঘোড়া থুড়ি খরিদ্দার।
আলাপি ছদ্ম অভিমান করে বলে, ” আহা বালাই ষাট! আপনাদের কীনা ঘাসবিচালি খাওয়াব? ধম্মে সইবে? তাছাড়া আপনাদের মতো সজ্জন মানুষদের আশীর্বাদ রয়েছে বলে দুবেলা দুমুঠো জুটছে। সোয়ামির চিকিৎসার অত ঝক্কি সামলাতে পারছি। আপনারা হলেন নমস্য। ”
” আরে নমস্যদের প্রসাদ তো ঘাসবিচালি হতেই পারে? “রসিকতা চালিয়ে যান রঘুবীর প্রসাদ। খানিক পরে অবশ্য এই আলোচনায় বিরাম টানতে হয়।
দেখা যায় মলয় চক্রবর্তী হাজির হয়েছেন দোকানের সামনে। তিনি একা নন। পাশে তাঁর শিকারকেও দেখা যাচ্ছে। বেচারা প্রসূন এই পড়ন্ত বিকেলে কিছু কিনতে এসেছিলেন হয়তো। পড়বি তো পড় মলয় চক্কোত্তির সামনে।
” আজ প্রসূনের ভাগ্যে ডবল ডোজ নাচছে। ” খানিকটা বিলাপ করার মতো বলে উঠলেন প্রফুল্ল পাল। ”
” কিন্তু এভাবে তো আর চলতে দেওয়া যায় না। এবার কিন্তু আটকাতেই হবে মলয়কে। ” রমেন হালদার কমবয়সে দুর্ধর্ষ স্টপার ছিলেন। কথাতেও মাঝেমধ্যেই সে খেলার উপমা উঠে আসে।
” অ্যাই বিল্লি আহ! আহ! ” ততক্ষণে মলয় চক্রবর্তীর খেল আরম্ভ হয়ে গিয়েছে।
হাতের জিনিসপত্র প্রায় ফেলে দেওয়ার উপক্রম তখন প্রসূনের। সমানে গজগজ করছেন। আর কটমট করে চেয়ে আছেন মলয়ের দিকে।
তাতে অবশ্য মলয়ের ভারি বয়েই গিয়েছে। আহ! তু তু। আজা বিল্লি আজা। আমার বেড়াল সোনা, কালি বিল্লি আয়ে আয়ে করে পুরো তল্লাট মাথায় করছেন তিনি।
কাঁহাতক কেউ সহ্য করতে পারে? দিনের পর দিন বেড়াল সম্বোধন শুনলে আপাত নিরীহ মানুষের মটকাও গরম হতে বাধ্য।
প্রসূন পালিতকেই তা বলে বেড়াল বলা কেন? ওনার চেহারার সঙ্গে বেড়ালের কী কোনও সাদৃশ্য আছে? এটা নিয়েও আলাপির মজলিশে অনেক গবেষণা হয়েছে।
তাতে প্রাথমিক একটা রিপোর্ট জমা দিয়েছেনও বটে প্রফুল্ল পালের নেতৃত্বাধীন দুই সদস্যের কমিটি। কমিটির অপর সদস্য হলেন রমেন হালদার। বলাবাহুল্য ওদের মৌখিক গবেষণালব্ধ রিপোর্ট জমা পড়েছে বটগাছসম অভিভাবক দীপক চৌধুরীর কাছে।
সেই রিপোর্ট বলছে প্রসূন পালিতের হোদল কুঁতকুঁত গোছের চেহারার সঙ্গে কোথাও যেন একটা মিল রয়েছে বাঘের মাসির।
ড্যাবডেবে চক্ষুযুগলের সঙ্গে তাঁর ঝাঁটার কাঠির মতো গোঁফ যেন পুরো মিয়াও কাটিং এনে দিয়েছে।
সবথেকে বড় হল ওঁর গলার স্বর। এমন মিনমিন করে কথা বলেন প্রসূন যে খুব কাছাকাছি না গেলে তা সহজবোধ্য হয় না। এই মিনমিনে সুরে কথাকেই মিউ মিউ টিউনিংয়ে ফেলে দিয়েছেন মলয় চক্রবর্তী।
তারওপর প্রসূন পালিত হলেন কুচকুচে কালো । সেই রঙের সঙ্গে মিলিয়ে তাঁকে কালা বিল্লি বানিয়ে ফেলেছেন মলয়।
মানুষকে রাগানোর অনেক গপ্পো আছে প্রায় সব পাড়াতেই। অমুক বাবুকে টমুক বললে চটে যান। দাদু পিসি,মাসি গোছের মহিলাদেরও খেপিয়ে দেওয়ার অনেক কলাকৌশল রয়েছে।
তাবলে কাউকে বেড়াল বলে রাগানো হচ্ছে এমন উদাহরণ বোধহয় অভূতপূর্ব। আর ঠিক এই অন্য ধারার ক্ষ্যাপানোই চলছে এই মোহনপুরে।
প্রসূন নিজের কবর নিজেই খুঁড়েছেন। মলয় চক্রবর্তীর মানুষকে রাগানোর স্বভাব মোটেই ওঁর অজানা ছিল না। তাও ফাঁদে পা দিয়েছেন বোকার মতো।
হয়েছিল কী একদিন প্রবোধের দোকান থেকে টুকটাক ঘরগৃহস্থালির দোকানবাজার করছিলেন প্রসূন।
হঠাৎ মলয় বলে ওঠেন, ” আরে প্রসূনবাবু যে! শুনলাম বাড়িতে নাকি একটা নধর বেড়াল পুষেছেন। যে সে বিল্লি নয়। এক্কেবারে আফগানি চিজ? ”
এটা ঠিক প্রসূনবাবুর বাড়িতে বিগত কিছুদিন ধরেই একটা বেড়াল এসে ঘাঁটি গেড়েছে। ধবধবে সাদা রঙা বেড়ালটাকে দেখে কর্তা গিন্নির ভারী মায়া পড়ে গিয়েছে। একমাত্র মেয়ে বিয়েথা হয়ে বিদেশে থাকে। চার-পাঁচ বছর পর পর আসে।
প্রসূন আর তাঁর স্ত্রী শিপ্রার তাই বড় নিঃসঙ্গ লাগত। সেই নিস্তরঙ্গ জীবনে এক টুকরো শীতল বাতাস নিয়ে এসেছে বেড়ালটা। বেশ দুবেলা মাছভাত খায় আর ওদের পায়ে পায়ে বাড়িময় ঘুরে বেড়ায়।
এই পর্যন্ত ঠিকঠাকই এগোচ্ছিল। মলয় চক্রবর্তীর বেড়াল সংক্রান্ত প্রশ্নের জবাবও দিতে কার্পণ্য করছিলেন না প্রসূন।
মলয় ঘোড়েল মানুষ। কিছুক্ষণ পরে হঠাৎ বলে উঠলেন, ” তা বেশ। আপনাদের বাড়িটা দিব্য সাদা এবং কালো বেড়ালের আড়ত হয়ে উঠেছে। ”
” সাদা বেড়াল একটা এসেছে ঠিকই। কিন্তু কালো বেড়াল আপনি কোথায় দেখলেন? ” চুপ থাকতে না পেরে জিজ্ঞেস করেই ফেললেন প্রসূন।
ব্যাস আর যায় কোথায়? সঙ্গে সঙ্গে মজার টাটকা রসদ হাতে পেয়ে মলয় বললেন, ” কেন কালো বেড়ালটা তো স্বয়ং আপনি। ”
মলয় যে রাগানোর পথে হাঁটছে সেটা বোঝা উচিত ছিল প্রসূনের। কিন্তু তাঁর নিরেট মগজে সেটা ঢুকল না। বরং রাগান্বিত ভঙ্গিতে বলে উঠলেন, ” কী আমি বেড়াল? ”
সেই শুরু। তারপর তো গত কয়েকমাসে প্রসূন পালিতকে পুরোদস্তুর বেড়াল বানিয়ে দিয়েছেন মলয়।
সবসময় একজনকে বেড়াল বলে বলে ওঁর মধ্যে যেন সত্যিকারের ম্যাও পুষির প্রাণ প্রতিষ্ঠা করে ফেলেছেন মলয়। আজকাল তো নিজেকে কেমন বেড়াল বলেই মনে হয় প্রসূনের।
এই তো সেদিন বাড়ির ছাদে দাঁড়িয়ে মুড়ি-বাদাম চিবোচ্ছিলেন। হঠাৎ মনে হল আহা! সত্যি যদি বেড়াল হতুম তাহলে টক করে লাফ দিয়ে পাশের বাড়ির ছাদে যাওয়া যেত।
তুষার মিত্রদের বাড়িতে প্রায়ই মাছ-মাংসের নানা রসনীয় পদ রান্না হয়। রান্নাঘরটা আবার ছাদ লাগোয়া। সেখান থেকে পছন্দমতো দুএকটা বেশ..
পরক্ষণেই সম্বিত ফিরল। এতদিন মাথা উচু করে আছেন।।সবাই কতো মান্যিগন্যি করে। সেখানে চুরির কথা ভাবছেন। ছি!
প্রসূনবাবু এও বোঝেন মলয় চক্কোত্তির এই লাগাতার পিছনে লাগাই এমন উৎকট চিন্তাভাবনার উৎস। কথায় বলে পুরুষসিংহ। কিন্তু তাবলে পুরুষবিল্লি?
ভাবতেই গা’টা কেমন গুলিয়ে উঠল। নিচ থেকে মনে হয় রূপমতী নামের বেড়ালটা ডেকে উঠল। প্রসূনবাবুর মনে হল তাঁকে যেন ব্যঙ্গ করেই এই অসময়ে ডেকে উঠল হতচ্ছাড়া।
প্রসূনবাবুকে বেড়াল বলে ক্ষ্যাপানো শুরু করার বেশ কিছুদিন পর থেকে মলয়ের মধ্যে জোরদার এক পরিবর্তন দেখা দিল।
এই প্রসঙ্গে বলে রাখা ভাল মলয় চক্রবর্তী ভীষণ পেটুক প্রকৃতির মানুষ। নিমন্ত্রণ না পেলেও মানুষের বাড়ি চলে যান তিনি। যা খুবই বেমানান ঠেকত সবার কাছে।
আলাপির চায়ের দোকানেও মাঝেমধ্যে এর ওর টাকা খসাতে শুরু করেছিলেন। কখনও হয়তো প্রফুল্ল পাল সবার জন্য চা,ঘুগনির ফরমায়েশ করেছে। সেখানে রবাহুতের মতো হাজির হয়ে মলয় বলে উঠতেন, ” কী প্রফুল্লদা। আমি বাদ? ”
কখনও দীপক চৌধুরীর কাছে দরবার করতেন, ” কী হে খুড়োমশাই, আপনাদের তো প্রায়ই এটাসেটা উদযাপন হচ্ছে।আর আমি উপেক্ষিত? ”
এরপর ভদ্রতার খাতিরে মলয় চক্রবর্তীকেও টুকটাক খানাপিনার আসরে ডাকতে হয়। এর বাইরেও মোহনপুরে কারো বাড়ি কোনও উপলক্ষ্যে খাওয়াদাওয়ার আয়োজন হলেও প্রায়ই বিনা টিকিটে হাজির হয়ে যান মলয় চক্রবর্তী।
সেই মলয়বাবু পেটুকপনা ছেড়ে দিতে পারে এটা কেউ স্বপ্নেও ভাবতে পারে নি।
মোহনপুরবাসী এতে দুয়ে দুয়ে চার করল।
তাঁদের দৃঢ় ধারনা মলয়বাবুর হ্যাঙলামি ছেড়ে দেওয়ার সঙ্গে নিশ্চিতভাবে যোগ রয়েছে প্রসূন পালিতের কেসের। মানে প্রসূনকে ক্ষ্যাপানো যতই উচ্চগ্রামে চড়েছে ততটাই দ্রুততার সঙ্গে নেমেছে মলয়বাবুর খাই-খাই বাই।
দীপক চৌধুরীরাও এই মর্মে আলাপির দোকানে অনেক চায়ে পে চর্চা চালাল।
কী আশ্চর্য এর সঙ্গে আরও একটা অদ্ভূত জিনিস ঘটতে থাকল। এটা অবশ্য ঘটল প্রসূনের ক্ষেত্রে। এতদিনের নিপাট ভদ্রলোক প্রসূন পালিতের ছুঁকছুঁকানি ব্যাপক আকার নিল।
পাড়ার হেন কোনও নিমন্ত্রণ থাকল না যেখানে সামিল হচ্ছে না প্রসূন পালিত। এর মধ্যে বিনা আমন্ত্রণের কেসও আছে বেশ কিছু। আর হ্যাঁ, আলাপির দোকানের আড্ডার আসরে নিয়ম করে হাজিরাও দিতে শুরু করেছেন তিনি।
প্রসূন নিজেই একদিন কবুল করলেন স্বভাব পরিবর্তনের কথা। দীপক চৌধুরীর উদ্দেশ্যে শুধোলেন, ” চৌধুরী কাকা আমার এতো নোলা হল কেন বলুন তো? আগে তো এমন ছিলুম না। তবে কী সত্যি সত্যি ছোঁচা বেড়াল হয়ে উঠছি? ”
দীপক চৌধুরী যাহোক একটা উত্তর দিলেন বটে। তবে কারো আর বুঝতে বাকি রইল না মলয় চক্রবর্তী সুকৌশলে প্রসূনের মধ্যে বেড়ালের বেয়াদপি ভরে দিয়েছেন।