সুবর্ণভূমে পুষ্পকেতু
অনন্যা পাল
দ্বিতীয় পর্বের পর…
প্রস্তুতি পর্ব
পাটলীপুত্র নগরীর প্রাকারের বাইরে জনবসতি থেকে দূরে শ্রী পদ্মনাভ মন্দির গঙ্গার উপকূলে এক অতি পবিত্র ধর্মস্থান। সেখানে প্রাচীর ঘেরা বিস্তীর্ণ অঙ্গণের মধ্যমণি গুপ্ত রাজবংশের কুলদেবতা শ্রীপদ্মনাভ বিষ্ণু, বহুদূর থেকে চোখে পড়ে মন্দির শিখরের স্বর্ণকলস। এছাড়াও মূল মন্দিরকে কেন্দ্র করে আটদিকে দাঁড়িয়ে আছে অষ্ট দিকপালের পূজাগৃহ; উত্তর দিশায় কুবের, দক্ষিণে যম, পূর্বে ইন্দ্র, পশ্চিমে বরুণ, উত্তরপূর্বে ঈষান, দক্ষিণপূর্বে অগ্নি, উত্তরপশ্চিমে বায়ু ও দক্ষিণপশ্চিমে নৈরতি। স্তাপত্য ও বৈভবে মহিমান্বিত মূলমন্দিরটির বাম পার্শ্বে রয়েছে ভুবনেশ্বরী মন্দির, বিষ্ণূজায়া লক্ষীর পূজাগৃহ। ভুবনেশ্বরী মন্দিরটি আকারে অপেক্ষাকৃত ক্ষুদ্র, কিন্তু অনুপম গঠনশৈলী ও দেওয়ালের সুক্ষ কারুকাজে অতুলনীয় তার সৌন্দর্য্য।
প্রতিদিনকার মত নিরিবিলি নয় মন্দির প্রাঙ্গণ নবান্ন উৎসবের এই বিশেষ দিনটিতে; সম্রাট স্বয়ং আসবেন আজ ভুবনেশ্বরী মন্দিরে। তিনি নতুন ফসলের শস্যতৃণ উৎসর্গ করে মাতা লক্ষীর আশীর্ব্বাদ প্রার্থনা করবেন। ভোর থেকেই তাই সাজো সাজো রবে মেতে উঠেছে ধর্মস্থান, পুরোহিত মন্ডলীর তত্ত্বাবধানে চলছে সেবকদের ব্যাস্ততা। বিষ্ণু মন্দিরেও বিশেষ পূজা আয়োজন রয়েছে, সেখানে ব্রাহ্মণ বিদায়ের বিশদ বন্দোবস্ত। একে একে জমায়েত হয়েছেন আশেপাশের গ্রামগুলির প্রধান ও নগরীর বিশিষ্টজন; দরবারের অমাত্য মন্ডলীসহ সম্রাট এসে পরবেন কিছু সময়েই অগ্রীম বার্তা পৌঁছেছে ঘোষকের মুখে। ভুবনেশ্বরী মন্দির প্রাঙ্গণে চন্দ্রাতপ টাঙ্গিয়ে বসার বন্দোবস্ত, গঙ্গার শীতল বাতাসের প্রভাবে ভাদ্রের সকাল মনোরম। গর্ভগৃহে মাতা লক্ষীর স্বর্ণমূর্তিতে পরানো হয়েছে নতুন বস্ত্র, নব আভরন; স্বর্ণথালিতে থরে থরে সাজানো হয়েছে পূজা উপাচার ও নৈবেদ্য।
চার অশ্বে টানা রাজকীয় রথ এসে দাঁড়ায় মন্দির প্রাকারের প্রবেশদ্বারে, ছত্র ও চামর ধারকদের দূরে রেখে নগ্ন পায়ে সম্রাট হেঁটে যান প্রথমে বিষ্ণু মন্দিরের দিকে; সেখানে দেবতাকে প্রণাম জানিয়ে এগিয়ে যান ভুবনেশ্বরী মন্দিরে। পবিত্র গঙ্গাজলে হাত ও পা ধুয়ে একান্ত ভক্তিতে প্রবেশ করেন তিনি গর্ভগৃহে; প্রধান পুরোহিতের পরিচালনায় অর্ঘ্য দেন প্রথমশস্য দেবীর চরণে। অভয়াদাত্রী মাতৃমুর্তীর পানে চেয়ে আবেগে সজল হয় প্রজাপালক সম্রাটের আঁখি, ক্ষেতকর্মে রাজ্যের উন্নতি, প্রজার অন্নসংস্থান, সৈন্যবাহিনীর তুষ্টি; অভিজ্ঞ ভূপতি মনপ্রাণে বিশ্বাস করেন সেকথা।
সম্রাট বিদায় নিলে শুরু হয় ব্রাহ্মণ বিদায় ও প্রসাদ বিতরনের কর্মব্যস্ততা; নগরীর বিভিন্ন সমিতি ও গ্রামে পাঠানো হয় উপহার সামগ্রী রাজ তহবিল থেকে। রাজার অর্ঘ্য দানের পশ্চাতে, নগর ও গ্রামগুলি মেতে ওঠে নবান্ন উৎসবে; নতুন বস্ত্র পরে বিশেষ ব্যাঞ্জন ও মিষ্টান্ন আহার, প্রিয়জন সাথে প্রীতি ও উপহার বিনিময়, ধনী দরিদ্র নির্বিশেষে ঘরে ঘরে পালিত হয় এই প্রথা পাটলীপুত্র তথা সমগ্র মগধে, আগামী তিনদিন ধরে চলবে এই পার্ব্বণ।
***
উৎসবদিনে কক্ষটিকে নিজের হাতে সাজিয়েছে চম্পা, দরজা ও বাতায়নের খিলানে জাতিপুষ্পের মালা, কুরঙ্গীতে জ্বলছে অগরু, মেঝেতে রঙ্গীন আলপনা। তার নিজের অঙ্গসজ্জাতেও বিশেষ যত্ন লক্ষনীয়; পরনে কাশীপট্টের বুটিদার রক্তবর্ণ ঘাঘরি, পীতবর্ণ উত্তরীয়টি ঘিরে রেখেছে তার ক্ষীণকটি ও বক্ষ, কবরীতে পারিজাতগুচ্ছ, কুঙ্কুম-অলকাতিলকে সুকুমার মুখখানি অপরূপ। একটি সুদৃশ্য আসনের সমুখে সাজানো রয়েছে পানপাত্রে কর্পুর সম্বৃদ্ধ শীতল মধুজা; থালিতে পিষ্টক, মুগমোদক, গুড়পর্পটক ও অম্রুতি; এসকলই নিজহস্তে বানিয়েছে সে বিবাহিত জীবনের প্রথম নবান্ন উৎসবে, তার সদাপ্রসন্ন, সৌখিন পতিদেবের জন্য।
‘এ যে অতি চমৎকার, ভুল করে অমরাবতীতে এসে পরলাম না তো? একটি অপ্সরাও রয়েছে দেখছি?’ কক্ষে প্রবেশ করে চম্পাবতীর চিবুক স্পর্শ করে বলে ওঠেন উল্মুক, স্নেহ ও কৌতুকের মিশ্রণ তাঁর সম্বোধনে।
চম্পা আপ্যায়নে ব্যাস্ত হয়ে পড়ে, আহার্য্য এগিয়ে দিয়ে একখানি চামর নিয়ে বাতাস করতে শুরু করে সে উল্মুককে। তার এই সরল আগ্রহ দেখে আবগে দ্রব হয় উল্মুকের মুখচোখ, চম্পার চামর ধরা হাতখানি নিজবক্ষে চেপে ধরেন তিনি।
‘চামর ব্যাজন অপ্রয়োজনীয় দেবী; তোমার করস্পর্শেই শীতল হবে আমার দেহ মন’। চম্পার মুখ রাঙা হয়ে ওঠে মধুবাক্যে।
‘মিষ্টান্ন কেমন বললেন না তো?’ ভাব প্রকাশে অপটু বালিকার এই যত্নে প্রকাশ পায় অকপট প্রেম।
‘মিষ্টান্ন অতি সুস্বাদু, অমৃতসম; এর স্বাদে মর্ত্যতেই স্বর্গলাভের আশ্বাস।‘
‘মধুজা, সে কেমন হয়েছে?’
‘অহোঃ, সেতো উৎকৃষ্ট মদিরাকেও হার মানায়; সংবাদ পেলে, শূন্ডগৃহে হাহাকার পরে যাবে।‘ চম্পা ঠিক বুঝতে পারেনা এ কৌতুক, না কি সত্যবাক্য।
‘আপনি মদিরা পান করেছেন আর্য?’ তার চোখে মুখে বিস্ময়।
‘না, প্রয়োজন কোথায়? এমন অপ্সরার স্পর্শলব্ধ মধুজা, এতেই যে ঘোর লেগে গেছে’।
‘এ আপনার কৌতুক, আমি জানি!’ এতক্ষণে রসিকতা বুঝতে পেরে ক্ষুব্ধ হয় চম্পা।
‘কৌতুকে বিরাগ কেন প্রিয়ে, গম্ভীর ব্রহ্মজ্ঞানী স্বামী পেলে অধিক সুখী হতে কি? বল তো চেষ্টা করি, বছর কয়েক বনবাস আর কৃচ্ছসাধন, সে আর এমন কি; ফিরব যখন তোমার চুলে পাক, দন্তহীন মুখে হাসিটি আরো মধুর হবে’।
‘এ আপনার ভারি অন্যায়’, অভিমানে কেঁপে ওঠে কন্ঠস্বর। উল্মুক বিচলিত হয়ে পড়েন।
‘ভয় নেই দেবী, তোমার হাতে হাত রেখে কাটাব এ জীবন, যৌবন অন্তে বার্ধক্যকে স্বাগত জানাব দুজনায় একসাথে’, এরপর সব অভিমান ভেসে যায় বাহূবন্ধনে।
শুক্লপক্ষের উৎসবরাত্রিতে, আকাশ যেন রাজমহিষীর রত্নখচিত উত্তরীয়, মৃদুমন্দ স্নিগ্ধ বাতাসে প্রথম প্রণয়ের আবেশ। উল্মুক ও চম্পা জানালার পাশে বসে থাকেন একে অন্যেতে নিমগ্ন, সময় হিসেব হারায়। বহুক্ষণ পরে বস্ত্রের আড়াল থেকে বের করেন উল্মুক একজোড়া মুক্তাখচিত কনক কঙ্কন, ধীরে ধীরে পরিয়ে দেন তা চম্পার দুইহাতে।
‘প্রথম উৎসবে এ আমার প্রেমার্ঘ্য দেবী; এ গহনা নিতান্তই মূল্যহীন, তবু কঙ্কনের সাথে যে হৃদয়টি তুলে দিলাম তোমার করপুটে জানি তাকে গ্রহণ করবে তুমি অশেষ যত্নে’।
‘স্বামী, এ আমার জীবনের শ্রেষ্ঠ প্রাপ্তি, যতদিন প্রাণ আছে, মণিবন্ধনে ধরে রাখব এ কাঁকন প্রেমচিহ্ন জ্ঞানে’। দুচোখে ধারা নামে চম্পার, নতুন প্রেমের অভিষেকে বালিকা যেন নারী হয়ে ওঠে নিজের অজান্তেই।
***
প্রভাতের স্নিগ্ধ রোদের ছোঁয়ায় মস্তকে স্বর্ণাভ আভা, হালকা বাতাসে দুলে উঠছে কেশগুচ্ছ, শ্বেতশুভ্র উত্তরীয় সরে গিয়ে নগ্ন বলিষ্ঠ কাঁধে দেখা দিয়েছে উপবীত। পুষ্পকেতু নিবিষ্ট হয়ে আছেন পাঠে, তাঁর সৌম্যসুন্দর মুখশ্রীতে জ্ঞানের দীপ্তি; এ যেন নবীন ঊষার পূর্বাকাশে সাক্ষাৎ অংশুমালী। তিনি পাঠ করছেন অঙ্গবজ্র; নৌশাস্ত্রের জ্ঞানকোষ এই পুস্তক; আসন্ন সমুদ্রযাত্রার উদ্দেশ্যে নিজেকে প্রস্তুত করছেন কুমার নিজের স্বভাবসিদ্ধ উপায়ে। তাঁর জ্ঞানপিপাসু মন বুঝে নিতে চায় যাত্রার সমস্ত খুঁটিনাটি, পুস্তকে অবগাহন করে তিনি চমকিত, বিস্ময়কর এক অজানা শাস্ত্রের সন্ধান পেয়েছেন এর মাঝে। ভারতীয় নৌবহর ভুবন বিখ্যাত, তবু, তার বিজ্ঞান যে এত উন্নত কল্পনা করেননি কুমার।
ভিন্ন ভিন্ন প্রকার নৌযান ও তাদের কার্যকারিতা লিপিবদ্ধ রয়েছে পুস্তকে; গঠন প্রণালীর ভেদে তাদের ব্যবহার বিশিষ্টতা লাভ করেছে। নৌযান মূলতঃ তাদের আকার অনুযায়ী চারটি শ্রেণীতে বিভক্ত, সমুদ্রগামী মহাবক্ষনাব, মধ্যমকায়, ক্ষুদ্রকায় ও অতি ক্ষুদ্রকায়। নাব ও পোত দুই প্রকার সমুদ্রগামী তরণী; শালিকা, কাদম্ব, সার্গড়, প্লব ও তপঃকর মধ্যমকায়; কট ও বেনু ক্ষুদ্রকায় এবং কুম্ভ, তুম্ব, ধটী ও পিন্ডিকা অতিক্ষুদ্রকায় বহিত্র। প্রতিটি নৌযানের নামকরন ঘটেছে গঠনের বৈশিষ্ট ও উপযোগিতা অনুযায়ী। শালিকা অর্থাৎ যার বক্ষে কক্ষ আছে, কাদম্বের আকৃতি হংস যথা, সার্গড় একটি কাষ্ঠে নির্মিত, প্লব ভাসমান ভেলা সদৃশ, তপঃকর সমনামী মাছের মত দ্রূতগামী। আবার, কট তৈরী হয় শুকনো মঞ্জিঘাস বিছিয়ে, বেনু বংশদন্ড দিয়ে; কুম্ভ ও তুম্ব তৈরী হয় যথাক্রমে কলসী ও অলাবু দিয়ে। ধটীর নির্মাণে ব্যবহার হয় স্ফীত চর্ম এবং পিন্ডিকা একপ্রকার বেত্র নির্মিত গোল নৌকা।
সমুদ্রযানেও প্রকার ভেদ আছে, ব্যবহার বিশেষে। পণ্যবাহী বহিত্রের উদর স্থুল, গতির চেয়ে পণ্যসংগ্রহের স্থান সেখানে অধিক উপযোগী। রাজকীয় নৌবহরে তিনপ্রকার যান ব্যবহারের প্রচলন। নৌবহরের সামনে চলে যুদ্ধনাব, তার পৃষ্ঠমন্দির থাকে যানের সামনের ভাগে, দ্রুতগামী এই যানে অরিত্র বা দাঁড়ের সংখ্যা একশত আশি। রাজসম্পদ বহনের জন্য যে বহিত্র, তার পৃষ্ঠ সম্পূর্ণভাবে মন্দির সর্বস্য অর্থাৎ, যানের উপরিভাগে পুরোটাই সুরক্ষিত কক্ষ। যে নৌবহে যাত্রা করেন রাজপুরুষ ও উচ্চবংশজাত যাত্রী, তার পৃষ্ঠমন্দিরটি থাকে ঠিক মাঝখানে, বিলাস ও আরামের সকল রকম ব্যবস্থা সেখানে রাখা সম্ভব; এই প্রকার বহিত্রে অরিত্রবাহী, নৌকর্মচারী, সেবক, ও যাত্রীসহ সাতশত মানুষের স্থান সঙ্কুলান হয়ে থাকে।
সমুদ্র যানে তিনটি কুপদন্ড, তাতে বটবস্ত্রের ব্যবহার এতই সুচারু যে মৌসুমি হাওয়ার অভিঘাতে যাত্রা হয় বাধাহীন ও গতিময়। যানের স্থুল্ভাগের নির্মাণ কার্যে ব্যবহৃত হয় শাক কাষ্ঠের ফলক; ফলক জুড়তে নারিকেল দড়ি ও কাষ্ঠ কীলক কাজে লাগানো হয়; লৌহ কীলক সামুদ্রিক চৌম্বক পাথরের প্রভাবে খুলে যাবার সম্ভাবনা। এই জোড় যাতে মজবুত থাকে, সেজন্য নিয়মিত লেপন করা হয় নারিকেল অথবা তিসিতৈল।
সমুদ্রযাত্রা মৌসুমী বায়ুর আবর্তে চালিত, শীতকালীন উত্তর পূর্ব বায়ুর প্রভাবে তাম্রলিপ্ত থেকে তরণী বইবে নিশ্চিন্তে পূর্বদিশায়, নারিকালদ্বীপ পেরিয়ে মালব উপকুলে পৌঁছতে লাগবে এক থেকে দেড়মাস কাল, যাত্রাবিরতি ঘটবে কিছুকালের জন্যে তক্কল অথবা কটাহ বন্দরে; আর তারপর একমাসের যাত্রায় শৈলদেশের কাটিগার বন্দরে হবে যাত্রার অন্ত। প্রত্যাবর্তন কাল দক্ষিণ পশ্চিম মৌসুমী বায়ুর ঝঞ্ঝা এড়িয়ে শুরু হবে ভাদ্রমাসের শুক্লপক্ষে। এই রীতিতেই চলে আসছে প্রাচ্যযাত্রা বহুকাল ধরে।
‘এ কি পাঠ করছেন তাতঃ?’ আধো বুলি শুনে ধ্যানভঙ্গ হয় পুষ্পকেতুর। শিশু শুদ্ধের মুখখানি আগ্রহ মাখা।
‘এ নৌশাস্ত্র, কুমারক’।
‘সুবর্নভূম যাত্রায় আমাকে সঙ্গে নেবেন তাতঃ? আমি নৌচালনা জানি, আপনাকে পুঁথি পড়তে হবে না’। কেতুর কোল ঘেঁষে এসে দাঁড়ায় বালক।
‘তোমার পিতৃব্য সামান্য ব্যক্তি, এতবড় নৌবিদের সাথে যাত্রা করে সাধ্য কি?’ হেসে শুদ্ধের কোঁকড়া চুল স্পর্শ করেন কুমার।
***
মহামন্ত্রী হরিষেণের বিশ্রাম কক্ষ, সেখানে মুখোমুখি বসে মন্ত্রীবর ও পুষ্পকেতু; সুমুখে সাজানো রয়েছে রকমারি আহার্য্য, নবান্ন উৎসবের নিমন্ত্রণ পালনে এসেছেন কুমার। হরিষেণ তাঁর গুরুজন, আবার মিত্রও বটে, সঙ্গীতের মায়াবন্ধনে দুজন অসমবয়সীর এই সখ্যতা অনেকের বিস্ময়ের কারণ। কেতুর বীণার ঝঙ্কারে হরিষেণের বাঁশীর লহরী প্রায়শঃই মুখরিত করে মন্ত্রীগৃহের আবহ, স্বর্গীয় সে সুরের ইন্দ্রজালে মুগ্ধ হয়নি এমন ব্যক্তি দুর্লভ। তবে আজকের দিনে সঙ্গীতচর্চায় আগ্রহ নেই কারোরই, আসন্ন যাত্রার প্রস্তুতি নিয়ে আলোচনায় ব্যস্ত দুজনে।
‘শৈলদেশের রাজকুল নাগবংশজ। কথিত আছে, প্রায় তিনশত বছর আগে এক ভাগ্যান্বেষী ব্রাহ্মণ কৌন্দ্যণ্যদেব মালব উপকুল থেকে সমুদ্রপথে সেখানে যান। নাগকন্যা সোমাকে পরাজিত করেন তিনি জলযুদ্ধে, নাগরাজ বশ্যতা স্বীকার করে কন্যা সম্প্রদান করেন বিদেশীর হস্তে। কৌন্দণ্যের বংশধরেরাই শৈলদেশে রাজত্ব করেছিলেন এত কাল। আন্দাজ বিশ বছর আগে কুষাণ বংশীয় রাজপুরুষ চন্দ্রদমন সেরাজ্যে গিয়ে সেনাবাহিনীতে যোগদেন। ক্রমে পদন্যোতি ও শেষে রাজা শ্রীবর্মার মৃত্যুর পশ্চাতে তাঁর কন্যাকে বিবাহ করে রাজা হন তিনি।‘ হরিষেন গন্তব্যস্থলের সম্পর্কে বিশদে জানান পুষ্পকেতুকে।
‘পুত্রের পরিবর্তে জামাতার রাজ্যাভিষেক অভিনব নয় কি দেব?’
‘এক্ষেত্রে নয়; সুবর্ণভূমের ইতিহাস জানলে বুঝবে সে কথা। হিন্দু বণিকদের উপস্থিতি প্রভাবিত করে চলেছে সে অঞ্চলের শিক্ষা, সংস্কৃতি এমনকি ধর্মাচরণ। আমাদের উন্নত শাস্ত্র ও শস্ত্রবিদ্যা, সামাজিক প্রথা আকর্ষণ করেছে সেখানকার অধিবাসী, বিশেষতঃ রাজপরিবারগুলিকে। আর্য রক্তের মিশ্রণে নিজকুলের মর্যাদাবৃদ্ধি হবে এরকম ভাবনা থেকেই এহেন প্রথার সৃষ্টি। কত পরিমান হিন্দু, প্রধানত ব্রাহ্মণ ও উচ্চকুলজাত ক্ষত্রিয় বসত করেছেন সেদেশে জানলে অবাক হবে কুমার। ভাগ্যান্বেষী আর্য সম্প্রদায়কে দুইহাত বাড়িয়ে স্বাগত জানায় সমগ্র প্রদেশ। আজ রোমক মুদ্রার প্রাদুর্ভাবে, স্বর্ণপ্রসু সুবর্ণভূমে বাণিজ্য বেড়েছে শতগুনে, এযেন আর্যভূমির এক সৌহার্দ্যপূর্ণ উপনিবেশ‘।
‘রাজপরিবার তো বুঝলাম সাধারণ প্রজা, তারাও কি এই আর্য প্রভাবে সুখী?’
‘দেখ, আমার ধারণা, ধর্মাচার ও সামাজিক রীতি যতটা রাজকুলকে প্রভাবিত করেছে, ততটা হয়তো সাধারণ প্রজাদের ক্ষেত্রে নয়; কিন্তু তারা আর্যপ্রভাবের বিরোধীও নয়। বিশেষ করে সামুদ্রিক বাণিজ্যের কারণে যে তাদের জীবনযাত্রায় অশেষ উন্নতি ঘটেছে, সে কথা সকলেই বোঝে। আর্থিক স্বাচ্ছল্য থেকেই প্রজাদের আনুগত্য বাড়ে, এ তো নতুন কথা নয়’।
‘ধূর্জটিদেব যাবেন বিষ্ণুমন্দিরে প্রাণপ্রতিষ্ঠা করতে, আমার প্রতি সম্রাটের নির্দেশ কি প্রকার দেব?’
‘কেতু তুমি বুদ্ধিমান, এসকল কার্যে যে কিছু রাজনৈতিক উদ্দেশ্য নিহিত থাকে সে তুমি জানো। শৈলদেশ সম্রাটের অনুগ্রহভোগী মিত্রদেশ, চীনপ্রদেশের সাথে বাণিজ্যিক সংযোগে সে দেশের বন্দর ও আনুকুল্য আমাদের কাছে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
শৈলদেশের পূর্বদিকের প্রতিবেশী অমরাবতী রাজ্য, সামরিক, বিশেষতঃ নৌশক্তিতে পরাক্রমী। চৈনিক সাগরের উপর তাদের প্রতাপ অনেকক্ষেত্রেই চীনদেশের সমুদ্রবাণিজ্যকে বিপদে ফেলেছে। চৈনিক বণিকদের পণ্যে শুল্ক দাবী করে প্রায়ই চীনা সমুদ্রযান আক্রমণ করে সেদেশের নৌবাহিনী। অমরাবতীর রাজা বীরবর্মণ, তাঁর পূর্বপুরুষ চম্পার রাজকুলজাত; অধিকাংশ প্রজার পূর্বজও চম্পা ও কলিঙ্গ রাষ্ট্র থেকে গিয়েছিল সেদেশে ভাগ্যান্বেষনে। সম্রাট সমুদ্রগুপ্তের প্রতি বীরবর্মণ অনুগত, অমরাবতীও আমাদের মিত্রদেশ। কিন্তু শৈলদেশ ও অমরাবতীর সম্পর্ক বন্ধুত্বপূর্ণ নয়, এর প্রধান কারণ সামুদ্রিক বন্দরের আধিপত্য ও শুল্কের অধিকার। চন্দ্রদমন আগে সম্রাটের সাহায্য প্রার্থনা করে দূত পাঠিয়েছেন, উপঢৌকন ও আনুগত্যের বার্তা পাঠিয়েছেন বীরবর্মণও। ওঁদের নিজস্ব কলহে হস্তক্ষেপ করতে আগ্রহী নন সম্রাট, সেকারণে কারো প্রতি পক্ষপাতদুষ্ট নন তিনি।
শৈলরাজ্যে গিয়ে এই কথাটি খেয়াল রেখো। চন্দ্রদমন কোনো ভাবে যদি অমরাবতীর বিরুদ্ধাচরনের প্রসঙ্গে প্রস্তাব তোলেন, বা সম্রাটের কাছে অনুরূপ প্রস্তাব পাঠাতে চান, তুমি তাঁকে নিরস্ত করবে। নিরপেক্ষতাই সমুদ্রবাণিজ্যে আমাদের প্রভাবশালী করেছে, চীনাপ্রদেশ যাত্রায় উভয় দেশই আমাদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ।‘
‘এতো বড় কঠিন সমস্যা, আমি কি পারব দেব?’
‘চিন্তা কিসের কুমার, তুমি দূরদর্শী, উপরন্তু ধূর্জটিদেব থাকবেন সঙ্গে। তিনি কূটনীতিবিদ ও অভিজ্ঞ ব্যক্তি, প্রয়োজনে পরামর্শ নিয়ো ওঁর কাছে’।
‘যেরূপ রেষারেষির সম্পর্ক দুই দেশের, বীরবর্মণ যদি তাঁর রাজ্যে আমন্ত্রণ জানান, যাবো কি সেখানে?’
‘না, এব্যাপারে সম্রাটের মত অতিস্পষ্ট। এই যাত্রা শুধুমাত্র বিষ্ণুমন্দির প্রতিষ্টা উদযাপনে সম্রাটের প্রতিনিধিত্ব করতে; চন্দ্রদমণের আন্তরিক আমন্ত্রণের পরিপ্রেক্ষিতেই এই আয়োজন। বীরবর্মণ আগ্রহী হলে ভিন্ন প্রতিনিধিত্বের ব্যাবস্থা করবে মগধ আগামী দিনে।‘
চিন্তান্নিত দেখায় পুষ্পকেতুকে, কূটনীতির দূরূহ জটিলতায় শঙ্কিত হয়ে ওঠে তাঁর তরুণ মন।
‘ভেবেছিলাম, নতুন দেশ, নতুন সভ্যতা, অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করে পরিপূর্ণ হব, এমন কুটনীতির নাগপাশে জড়াতে হবে ধারণা করিনি’, পুষ্পকেতুর উক্তি আক্ষেপের মত শোনায়।
‘তুমি গুপ্তবংশের রাজকুমার, পাটলীপুত্রের গর্ব, এত সামান্য কারনে ভয় পাবে কেন? তোমার বিচারবুদ্ধির প্রতি পূর্ণ আস্থা রেখে বলছি বৎস্য, সুষ্ঠভাবে রাজপ্রতিনিধিত্ব করে ফিরে আসবে তুমি অনায়াসে। নারায়ণ তোমার সহায় হোন’।
‘আপনি কোথায় চলেছেন আর্য?’ একটি সুরলিত বালিকাকন্ঠের প্রশ্নে মনযোগ ভেঙে যায় দুজনের। চাঁপারঙের ঘাঘরি পরা এক চম্পকবর্ণা কন্যা কক্ষমধ্যে এসে দাঁড়িয়েছে কখন অজান্তে; তার উপস্থিতিতে উজ্জ্বল হয়ে ওঠে বিশ্রামাগার। মেয়েটি হরিষেণের কনিষ্ঠা কন্যা হৈমবতী, মহামন্ত্রীর অতি আদরের সন্তান।
‘কুমার চলেছেন সুবর্ণভূমে, জরুরী রাজকার্যে’, সস্নেহে উত্তর দেন হরিষেণ।
‘সু-ব-র্ণ-ভূম! সে যে অনেক দূর! সমুদ্রে কত ঢেউ, তায় জলদৈত্য! আপনার ভয় করছে না?’
‘ভারি ভয় করছে হৈম,কি করি বল তো?’ লঘুস্বরে উত্তর দেন পুষ্পকেতু। বালিকার সরল সান্নিধ্যে খুশী হয় তাঁর চিন্তাক্লিষ্ট মন।
‘আমি ধাইমাকে বলে জলদেবতার পূজা দেব, আপনি বিপদ্মুক্ত হবেন। ধাইমা বলে প্রার্থনায় ইষ্টলাভ। আপনিও দৈত্যের সমুখে পড়লে ইষ্টমন্ত্র জপ করবেন আর্য, সে নির্বল হয়ে পড়বে তখুনি।‘
‘বেশ, মনে রাখব তোমার উপদেশ। আর দৈত্য নির্বল হয়ে পড়লে, তাকে খাঁচায় পুরে আনব কি তোমার জন্যে?’ হেসে ওঠেন হরিষেণ কুমারের কৌতুকবাক্যে। বালিকা রাগ করে কক্ষ ত্যাগ করে চারদিক সচকিত করে।
***
সন্ধ্যা গতে রাত্রির অন্ধকার নেমেছে বাইরে, ভোজনকক্ষটি প্রদীপের আলোয় উজ্জ্বল। মাটিতে আসন পেতে পাশাপাশি বসে সুমন্ত, পুষ্পকেতু ও উল্মুক, সামনে সাজানো রকমারি ব্যাঞ্জন, সাথে ঘৃত তন্ডুল, গোধূম চূর্ণের রোটিকা ও পর্পট। রাত্রির আহারে বসেছেন তিনজন, গৃহকর্তা বিশাখগুপ্ত বিশেষ কাজে নগরীর বাইরে গেছেন, অতএব কক্ষের পরিবেশ হালকা। উল্মুক আজ রাত্রি কাটাবেন করবেন বন্ধুর গৃহে, আসন্ন বিচ্ছেদের আগে এ এক মিলনোৎসব; তবে চম্পাবতী কয়েকদিনের জন্য পিত্রালয়ে গিয়েছে, সেটাও একটা কারণ। আহার পরিবেশন করছেন সুগন্ধা স্বয়ং, দুটি দাসী চামর দুলিয়ে বাতাস করছে; পুষ্পকেতুর মাতা উপলা তত্ত্বাবধান করছেন কিছু দূরে একটি পীঠিকার উপর বসে।
‘উল্মুক কিছুই তেমন খেলে না তো পুত্র, কুষ্মান্ডের ব্যাঞ্জন, বর্তাক, সবই পড়ে রইল যে।‘
‘চম্পা বেড়ে না দিলে বোধকরি আজকাল খাবার মুখে রোচেনা দেবরের’, মৎস্যব্যাঞ্জন থালিতে দিতে দিতে মুচকি হেসে মৃদু মন্তব্য করেন সুগন্ধা। যথাযোগ্য উত্তর দিতে না পেরে উল্মুকের মুখ রাঙা হয়, পুষ্পকেতু হেসে ওঠেন তা দেখে।
‘হেসে নাও যত পারো, এরপর আমারও দিন আসবে, ভুলোনা সেকথা’।
‘নিশ্চিন্ত থাকো বন্ধু সে সুযোগ সহজে পাবে না তুমি’।
‘কেনো, আপনি কি সংসারত্যাগী হবেন স্থির করেছেন?’ এখন সুগন্ধা ধমকে ওঠেন কেতুকে।
‘না, তবে সংসারী হবারও ইচ্ছে নেই আপাতত, আশে পাশে যে উদাহরণ, তাতে ভরসা হয়না’, কেতু তাঁর বড় ভাই ও উল্মুকের প্রতি ইশারা করে মন্তব্য করেন।
‘বটে!!’ সুগন্ধা কপট ভ্রূকুটি করেন, সুমন্ত গাম্ভীর্য বজায় রাখতে অন্যদিকে মুখ ফেরান।
‘এত কথা কিসের আহার কালে?’ হাসাহাসির কারণ বুঝতে না পেরে বিরক্ত হন উপলা।
‘পুত্রী পরমান্ন দাও সকলকে’।
পুষ্পকেতু পরমান্ন খেতে অস্বীকার করেন।
‘খেয়ে নাও পুত্র, পরমান্নে আয়ুবৃদ্ধি, নিজে হাতে রেঁধেছি আমি এ পায়স; কত দূরদেশে যাবে, পথে কত বিপদ!’ দীর্ঘশ্বাস জেগে ওঠে মাতার কন্ঠস্বরে। পুত্রের সমুদ্রযাত্রায় বিচলিত স্নেহময়ী জননী; ব্যক্তিত্বশালী স্বামীর প্রভাবে আপত্তি করতে পারেননি, তবু আক্ষেপ লুকোতে ব্যর্থ হন বারে বারে।
***
রাত্রি গভীর, পুষ্পকেতুর শয়নকক্ষে দুই মিত্র তখনও জেগে; আসন্ন বিচ্ছেদের পদধ্বনিতে কক্ষের আবহ বিষাদ গম্ভীর। জানালার বাইরে কৃষ্ণপক্ষের ক্ষয়িষ্ণু চাঁদ একাকী জেগে আছে তারাহীন আকাশে, কেতু চেয়ে থাকেন সেদিকে নিঃশব্দে।
‘আজ কি আর ঘুমোবে না কেতু?’ উল্মুক মন্তব্য করেন।
‘তোমার চোখেও তো ঘুম নেই বন্ধু’।
‘আমি গৃহপালিত জীব, এমন দুইএকটি নিদ্রাহীন রাত্রি আমার কাছে বৈচিত্রময়, তোমার মত দুঃসাহসী অভিযাত্রী তো নই’।
‘অভিযাত্রী হতে বাধা তো ছিল না কিছু, আজও বাধা নেই’।
‘বাধা আছে বন্ধু; নোঙ্গর বাঁধা আছে ঘাটে, সে কোমল বাঁধন খুলি সাধ্য কই’ উল্মুকের স্বর আবেগে নরম।
***
‘এই যে এত প্রস্তুতি, চলেছেন অজানা দেশে; আমাদের কথা মনে পড়বে কি সেখানে?’ সুগন্ধা যাত্রার প্রস্তুতিতে দরকারি বস্তু তোরঙ্গে গুছিয়ে দিতে দিতে নতুন উৎসাহে পরিহাস শুরু করেন স্নেহের দেবরের সাথে। ঠিক দশদিন পরে আশ্বিন পূর্ণিমায় যাত্রা শুরু হবে পাটলীপুত্র বন্দর থেকে; রাজজ্যোতিষী নারায়ণ শর্মা গননা করে দিন ধার্য করেছেন। তাম্রলিপ্ত থেকে সমুদ্রযাত্রার শুভদিন কার্তিকের শুক্লদ্বাদশী, সময় নির্ঘন্ট দিবা প্রথম প্রহর।
‘অপরিচিত দেশে ভোজনের কালে, অথবা নিদ্রাহীন রাত্রির অন্ধকারে একটি স্নেহময়ী মুখ অবশ্য মনে পড়বে দেবী; পৃথিবীর যে প্রান্তেই যাই, গৃহকোনে অপেক্ষা করছে যে নিঃশর্ত মমতাময়ী, তাঁকে কি ভুলতে পারি?’ পুষ্পকেতুর কথায় চোখের কোল ভিজে ওঠে ভগিনীসম জ্যেষ্ঠার। পরিবেশ হালকা করতে আবার পরিহাসে মাতেন সুগন্ধা।
‘খালি কথায় চলবে না, বলুন পরদেশ থেকে কি আনবেন আমার জন্যে?’
‘কি চাই বলুন? গজমুক্তার হার, নাকি মনিখচিত তাম্বুলদান?’
‘ওসব নয়, যা চাইব এনে দিতে পারবেন তো?’ সুগন্ধার দৃষ্টিতে কৌতুক খেলা করে।
‘বলেই দেখুন, দেবরের প্রতি ক্রমেই আস্থা হারাচ্ছেন যে!’
‘বেশ তবে সমুদ্র থেকে দেখে শুনে একটি সুন্দরী মৎস্যকন্যা নিয়ে আসবেন আমার জন্য। তাকে ছেড়ে দেব উদ্যানের পুষ্করিনীতে, দিনে রাতে জলকেলি করবে আর মোহময় কটাক্ষ হানবে আপনার দিকে। তাতে আমারো একটি সখী জুটবে, আপনিও ঘায়েল হয়ে সংসারী হবেন।‘
‘সে তো বুঝলাম, মৎস্যকন্যা নাহয় আনা গেলো, কিন্তু তার কটাক্ষবাণে আমার পরিবর্তে অগ্রজ ঘায়েল হন যদি, কি হবে ভেবে দেখেছেন সেকথা?’
‘বটে!!’ শুরু হয় দুজনার কপট কলহ; স্নেহ ও মমতার অক্ষয় বাঁধনে স্মরণীয় হয়ে থাকে আশ্বিনের সোনালী দ্বিপ্রহর।
***
‘বাতিটা কমিয়ে দিন আর্য, চোখে বড় লাগছে’, দুর্বল কন্ঠে মিনতি করে চম্পা; উল্মুক কমিয়ে দেন শিয়রে রাখা প্রদীপের শিখা, পরম মমতায় হাত রাখেন চম্পার ঘামে ভেজা কপালে। পিত্রালয়ে এসে জ্বরে আক্রান্ত হয়েছে চম্পা দিনকয়েক হোল, সংবাদ পেয়ে উল্মুক এসে রয়েছেন তার সাথে। সামান্য অসুখে স্বামীকে উতলা হতে দেখে লজ্জিত হরষে ভরে উঠেছে নববধূর মন।
‘আমার জন্য আপনি কত করছেন স্বামী, এমন অসুখে মরণ হলেও ক্ষেদ থাকবে না মনে’।
‘ছিঃ, ও কি কথা চম্পা, এমন মিলনদিনে মরণের কথা মুখে আনতে নেই’, চম্পার শীর্ণ হাতখানি বুকে চেপে ধরেন উল্মুক, স্তিমিত আলোয় ঝিলিক দেয় হাতের মুক্তাখচিত কঙ্কন, তাঁদের প্রেমের প্রথম সাক্ষর।
শিয়রের পাশে বসে কেটে যায় তন্দ্রালু রজনী, ভোরের প্রথম আলোয় সুষমাময় চম্পার নিদ্রামগ্ন মুখশ্রী, ঘুম ভেঙে মুগ্ধ চোখে চেয়ে থাকেন উল্মুক, না জানি কতক্ষণ।
‘বৈদ্যরাজ অপেক্ষায় আছেন কক্ষের বাহিরে, নাড়িপরীক্ষা করবেন তিনি আর্য’; দাসী এসে সংবাদ দেয়। সম্বিত ফিরে পান উল্মুক, তড়িঘড়ি স্বাগত জানান চিকিৎসককে।
***
যাত্রার ব্যবস্থা সব সম্পূর্ণ হয়েছে, পাটলীপুত্র থেকে সপ্তডিঙ্গায় রওয়ানা হবে উপঢৌকন, নৌসেনা, রাজপ্রতিনিধি ও ব্যক্তিগত সেবকের দল। তিনখানি সমুদ্রপোত তাম্রলিপ্ত বন্দরে প্রস্তুত হচ্ছে মুখ্য যাত্রার উদ্দেশ্যে। পাটলীপুত্র থেকে তাম্রলিপ্ত নদীপথে আন্দাজ অর্ধপক্ষকাল পথ দ্রুতগামী কাদম্ব বা তপঃকর নৌযানে; পথে বিঘ্ন ঘটে দেরী হলেও যথাসময়ে তাম্রলিপ্ত থেকে যাত্রায় বাধা পড়ার ভয় নেই।
‘সদা সতর্ক থাকবে বৎস্য, শুধু যাত্রাপথে নয়, শৈলদেশে অবস্থান কালেও বটে। তুমি বুদ্ধিমান, পররাজ্যে আতিথেওতা সকলসময়ে শঙ্কাহীন হয়না, সেকথা জান নিশ্চয়ই; সেদেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি সম্পর্কেও মহামন্ত্রীর কাছে শুনেছ নিশ্চয়? সর্বদা মনে রাখবে, শৈলদেশে তুমি সম্রাটের প্রতিভূ, তোমার ব্যক্তিগত ইচ্ছা অনিচ্ছা নেহাতই মূল্যহীন সেখানে অবস্থান কালে’; পুত্রকে প্রয়োজনীয় উপদেশ দেন বিশাখগুপ্ত যাত্রার আগে, মহাদণ্ডনায়কের কাঠিন্যের আড়ালে, স্নেহময় পিতার হৃদয় উদ্বিগ্ন হয়ে ওঠে তরুণ পুত্রের প্রথম বিদেশ যাত্রায়।
‘আপনি নিশ্চিন্ত থাকুন পিতা, সম্রাট আমার ওপর যে আস্থা রেখেছেন, প্রাণ থাকতে তার অমর্যাদা করব না আমি’।
‘সে আমি জানি পুত্র, তবু চিন্তা হয়; আর তো মাত্র সপ্ত দিবস। তারপর দীর্ঘ বৎসরকালের অদর্শন; কার্যালয়ে তোমার অভাব বোধ করব আমরা সকলেই।‘ গম্ভীর আলোচনায় ভারী হয়ে ওঠে কক্ষের বাতাস, দুজনেই নিশ্চূপে বসে থাকেন কিছুক্ষণ। পরিবেশ হালকা করতে অন্য প্রসঙ্গে যেতে চান বিশাখগুপ্ত।
‘উল্মুককে দেখিনি কিছুদিন, তোমার যাত্রার আগে তার তো এখানেই থাকার কথা! নাকি অভিমান করেছে বাল্যসখার উপর?’
‘না পিতা, সেসব কিছু নয়; আপাতত সে শ্বশুরালয়ে রয়েছে কিছুদিন’।
‘কাজকর্ম ত্যাগ করে শ্বশুরালয়ে!‘ বিশাখগুপ্তের মন্তব্যে বিরক্তির সুর।
‘তার পত্নী অসুস্থা, সেকারণেই ……।‘
‘সে কি বৈদ্য না কন্যার মাতা, যে শ্বশুরালয়ে পড়ে থেকে সেবা করবে?’ তেজস্বী রাজপুরুষের স্বরে সমর্থনের অভাব স্পষ্ট হয়।
পুষ্পকেতু কষ্টে হাসি সংবরণ করেন।
***
সেদিন মধ্যরাত্রে, হঠাৎই বজ্র বিদ্যুৎ, অকাল ঝঞ্ঝায় ঘনঘোর হয়ে ওঠে আশ্বিনের আকাশ। যাত্রার পূর্বে একি দূর্যোগ! না জানি কি মহাকালের সঙ্কেত বয়ে নিয়ে আসে এই মহানিশা, ভয়ে কেঁপে ওঠে মায়ের বুক, চুপি চুপি পায়ে এসে দেখে যান পুত্রকে; সুখনিদ্রায় মগ্ন কুমার শয্যার উপর, না জানি কোন স্বপ্নের ঘোর খেলা করে তাঁর দুচোখে।
ভোররাতে কক্ষসংলগ্ন বহির্দ্বারে করাঘাতের শব্দ, চমকে চোখ খোলেন কুমার যোদ্ধার অভ্যস্ততায়।
‘কেতু! দ্বার খোল কেতু!’ উল্মুকের কন্ঠ শুনে ব্যস্ত পায়ে দরজা খোলেন পুষ্পকেতু।
বাইরে উন্মত্ত বর্ষণ, চারিদিকে নিশ্চিদ্র অন্ধকার, দরজার সামনে দাঁড়িয়ে প্রিয়মিত্র তৃষিত প্রেতাত্মার মত।
‘নোঙর কেটে গেছে বন্ধু!‘ বুকভাঙা হাহাকার ঢেকে যায় বজ্রপাতের প্রচন্ড শব্দে। চিত্রবৎ স্থানু হয়ে দাঁড়িয়ে থাকেন দুজন বুঝিবা অনন্তকাল।
*** ***
দুরূহ শব্দের অর্থঃ
কাশীপট্ট – বেনারসী সিল্ক, পারিজাত ফুল – শিউলি ফুল, মধূজা – সরবত, পৃষ্ঠমন্দির – জাহাজের কেবিন, কুপদন্ড – মাস্তুল, বটবস্ত্র – পাল, কীলক – পেরেক, ঘৃত তণ্ডুল – ঘি ভাত, রোটিকা – রুটি, পর্পট – পাঁপড়, কুষ্মাণ্ড – কুমড়ো, বর্তাক – বেগুন
ছবি- অন্তর্জাল