ফ্রিল্যান্সার
পিনাকী চৌধুরী।। আজ থেকে প্রায় ১৮ বছর আগে কলকাতার এক নামী সংবাদপত্রের সাথে আমি যুক্ত হলাম, যদিও ফ্রিল্যান্সার হিসেবে ! কিন্তু গোড়ায় গলদ ! নামের শুরুতেই ফ্রি কথাটা রয়েছে, তাই অনেকেই ভেবে বসবেন যে, ছেলেটা বেগার খাটে , পয়সা কড়ি কিছু পায়না! হ্যাঁ, নিন্দুকেরা স্বভাবসুলভ ভঙ্গিতে , এটা বোধহয় জানতেন না যে, ‘ ফ্রিল্যান্সার’ হিসেবে কাজ করাবার মানে আসলে নিরপেক্ষ ভাবে কাজ করা ! ইতিউতি কানে ভেসে আসতো ” তোমাকে টাকা পয়সা কিছু দেয় ?” অথবা ” এবার একটা চাকরি খোঁজো ” ইত্যাদি গোছের কিছু জ্ঞানের বাণী ! তবে বিড়ম্বনার বোধহয় আরও বাকি ছিল!
তখন ইন্টারনেটে লেখা পাঠানোর তেমন একটা চল ছিল না, বরং প্রতিদিনই দুপুর রোদে মুখ পুড়িয়ে সেই ধর্মতলায় সেই সংবাদপত্রের অফিসে গিয়ে হাজির হতাম ! যদি কিছু ‘ অ্যাসাইনমেন্ট’ পাওয়া যায় ! সাদা কাগজে সস্তার ডট পেনে হাতে লিখে সেই লেখা জমা দিতাম। সত্যি কথা বলতে, তখন আমার আড়ষ্টতা কাটেনি , পারিপার্শ্বিক অবস্থা সম্পর্কে সম্যক ধারণাও তেমন একটা নেই ! একদিন বিভাগীয় সম্পাদক সেই লেখা পড়ে আমার মুখের ওপর সেই কাগজ ছুঁড়ে ফেলে দিলেন ! আর আমি ভয়ে জড়সড় হয়ে তিনতলা থেকে নিচে নেমে একটা ‘ রেফারেন্স’ নিয়ে পুনরায় ওই সংবাদপত্রের ক্রীড়া সম্পাদকের কাছে গেলাম ! ” আমি আপনাদের কাগজে একটু লিখতে চাই !” আমার কথাটা শুনেই সেই বিখ্যাত ক্রীড়া সম্পাদক মুখের ওপর রীতিমতো তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে বললেন ” দেখুন শুরুতেই মোহনবাগানে খেলবো, এরকম তো হয় না। আপনি ছোটোখাটো একটা কাগজে লিখতে চেষ্টা করুন ! কিছুদিন পরে আসবেন !” বুঝলাম সাংবাদিকতার অ আ ক খ আমার জানা নেই । তাই বোধহয় এই বিড়ম্বনা ! অগত্যা আমি সেই কাগজের হয়ে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের কভারেজ করতে লাগলাম ! ক্রমে ক্রমে কলকাতার অলি গলি তস্য গলি এবং বিভিন্ন প্রেক্ষাগৃহ আমার চেনা হতে লাগলো। তারও বেশ কিছু দিন পরে ধীরে ধীরে আলাপচারিতার ওপর জোর দিলাম। কারণ, এই লাইনে টিকে থাকতে হলে আলাপচারিতার মাধ্যমে মানুষের মনের কথা যেনতেন প্রকারে টেনে আনাটা জরুরি! বিভিন্ন হাই প্রোফাইল ও লো প্রোফাইল ব্যক্তিত্বের সঙ্গে আমার যোগাযোগ বাড়তে থাকলো। তখন একটা জিনিস লক্ষ্য করতাম, মুখে সেলিব্রেটিরা অনেকেই বলতেন যে ” আমি কিন্তু প্রচার বিমুখ !” কিন্তু আসলে তাঁরা প্রচার মাধ্যমের যাবতীয় আলো শুষে নিয়ে খবরে ভেসে থাকতেই পছন্দ করেন! এভাবেই ব্যস্ততার সঙ্গে দিন অতিবাহিত হতে থাকলো , হাতে কিছু পয়সাও আসতে থাকলো।
এ প্রসঙ্গে বলি, সাংস্কৃতিক বিভাগের ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক আমাকে তখন একটা দামী কথা বলেছিলেন ” শোনো, তুমি এখন অনেক জায়গায় যাচ্ছো তো, অনেক রকম প্রলোভন আসবে। নিজেকে সংযত করতে না পারলেই বিপদ অনিবার্য। প্রলোভনের ফাঁদে কখনও পড়বে না !” সেই কথাটির অন্তর্নিহিত অর্থ তার কিছু দিন পরে বুঝেছিলাম। যাইহোক আড়ষ্টতা ধীরে ধীরে কেটে গিয়ে আমার কলম যেন আগের থেকে কিছুটা হলেও সাবলীল হল ! একটি ঘটনার কথা বলি , কলকাতার একটি বিখ্যাত রঙ্গমঞ্চে একটি বিখ্যাত নাটক মঞ্চস্থ হবে। ঘটনাচক্রে বিভাগীয় সম্পাদক আমাকে আগে থেকে সেই কথা বলতে বেমালুম ভুলে গেছেন। যাইহোক শো শুরু হবার মাত্র এক ঘণ্টা আগে তিনি আমাকে ফোন করে বলেন ” শোনো , তুমি এই মুহূর্তে অহীন্দ্র মঞ্চে চলে যাও । ** নাটকে কিন্তু স্টার কাস্টিং রয়েছে।” তাঁর কথা শুনেই বুঝলাম যে তিনি রীতিমতো বিভ্রান্ত । যাইহোক তাড়াহুড়ো করে কোনোরকমে অটোতে চড়ে সেই প্রেক্ষাগৃহে উপস্থিত হলাম। কিন্তু তখন নাটকের শো শুরু হয়ে গেছে, নিরাপত্তা রক্ষীরা আমাকে প্রেক্ষাগৃহে ঢুকতে বাধা দিলেন। আমি তাঁদের অনুনয় বিনয় করে বললাম ” আমি * পত্রিকা থেকে আসছি !” কিন্তু তাতেও চিড়ে ভিজলো না। অগত্যা আমি সেই কাগজের বিভাগীয় সম্পাদককে ফোন করলাম এবং যাবতীয় ঘটনা বললাম। ওদিকে আমার ফোনটা নিরাপত্তা রক্ষীদের দিয়ে বিভাগীয় সম্পাদকের সাথে কথা বলতে বললাম। ফোনে উত্তপ্ত বাক্যবিনিময় চলতে থাকে। কিন্তু নিরাপত্তা রক্ষীরা তাতেও অনড় । বিভাগীয় সম্পাদক আমাকে অবশেষে ফোনে বললেন ” পিনাকী, তুমি এবার বাড়ি ফিরে যাও । তবে আগামিকাল আয়োজক সংস্থাকে ফোন করে তুমি বলবে যে, নির্দিষ্ট সময়ে উপস্থিত হয়েও সিকিউরিটি আমাকে হলে ঢুকতে বাধা দেয়, তাতে আমি খুব অপমানিত বোধ করেছি। পরেরদিন সকালে আমি ফোন করে সেই শেখানো বুলি আওড়াতে লাগলাম ! ওদিকে আয়োজক সংস্থার ভদ্রলোক রীতিমতো বিনয়ের সঙ্গে আমাকে ফোনে বললেন ” আমরা এর জন্য অনুতপ্ত। আগামী মাসে আরেকটি শো আমাদের রয়েছে। তখন কিন্তু আপনাকেই উপস্থিত থাকতে হবে। ”
বুঝলাম মিডিয়া লাইনে এইসব না করলে টিকে থাকা দায় ! এই লাইনে বোধহয় এটাই দস্তুর ! যাইহোক পরের মাসে নির্দিষ্ট সময়ে প্রেক্ষাগৃহে উপস্থিত হয়ে রাজকীয় সম্বর্ধনা পেলাম । ঘটনা নাটকীয় মোড় নিল ! সেই নাটকের রিভিউ কাগজে সম্পাদকীয় হিসেবে বড় করে প্রকাশিত হল ! অবাক পৃথিবী !