আজি যে রজনী যায়
বুদ্ধদেব হালদার
৪
হুক্কা আচমকাই বলল, ‘বুড়োরপুকুরে যাবি একন?’
ওর কথা শুনে জগন্নাথ অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল তার মুখের দিকে।
চোখ সরু করে মুখে পাখিদের মতো শিস দিতে দিতে দুদিকে সজোরে মাথা নাড়াল।
হুক্কা আবারও বলল, ‘চ না?’
এবারে জগন্নাথ শিস বাজানো বন্ধ করে দিয়ে শুধোলো, ‘ক্যা রে?’
‘ওকেন অনেক কাঁকড়া হইচে। আগের দিন কচিবুড়ি ওকেনতে একঝুড়ি কাঁকড়া ধরে এনচে জানিস?’
‘সত্যি!’
জগন্নাথের চোখ জ্বলে উঠল।
সে অবিশ্বাসী কণ্ঠে আবারও জিগেস করল, ‘সত্যি কইচিস?’
ওর কথা শুনে হুক্কা কৃত্রিম অভিমান দেখিয়ে বলল, ‘আমি কি তোরে মিথ্যে কইতিচি?’
দুজনে ক্ষণকাল চুপচাপ রইল।
আলপথ দিয়ে হেঁটে যেত যেতে ওদের মধ্যে এইরূপ কথাবার্তা চলছিল। আজ শনিবার। কাজেই হাফছুটি। দুপুর একটার সময় ওদের ইসকুল ছুটি হয়ে গেছে। অবশ্য ইসকুলে আজ কোনও পড়াশোনা হয় নি। সকাল থেকেই গিয়ে ওরা সকলে বসে ছিল। ঋতমা দিদিমুনি কীসের কাজে যেন আজ মিছিলে গেচেন। কী একটা মিছিল হচ্ছে তাদের গেরামে। এসব তারা জানে না। তবে শৈলেন মাস্টারমশাই কয়েচেন এই গেরামে নাকি একটা খুব বড়ো ঝামেলা হতে চলেচে। এসবে জড়াতে তিনি সকলের পরিবারকে বারণ করেছেন। তিনি নাকি অনেক কিছু আঁচ করতে পেরেচেন। একটা খারাপ সময় আসতে চলেচে। এসব বলছিলেন তিনি আজ। আজ সারাদিনই হো-হো হি-হি করে তাদের সক্কলের সময় কেটেচে। মাস্টারমশাই বলেচেন খাতা বই খোলার কোনও দক্কার নেই। ছপ্তায় একদিন তোরা নিজেদের মধ্যে খুশমেজাজে গপ্প কর। তাই ওরা ইসকুলে নিজেদের মধ্যে সারাক্ষণ গল্পগুজব করে ছুটির সময় বেরিয়ে এইচে।
চারিদিকে কচি কচি ধানগাছ ভরে আছে। ওরা আলের ওপর দিয়ে হেঁটে আসছিল। হুক্কার হঠাৎ কাঁকড়া ধরতে যাওয়ার শখ হয়েচে। তাই সে জগন্নাথকে এতক্ষণ সে কথাই শুধোচ্ছিল। কিন্তু জগন্নাথ এখনও পর্যন্ত কোনও ইতিবাচক উত্তর দেয়নি। তাই সে-ও নিরাশ হয়ে চুপ করে গেছে। আলের উপর দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে হুক্কা বলল, ‘রঙিন কাগজ কেটে কী সুন্দর মালা তৈরি করে দেচে তা দেকলি?’
জগু মৃদুস্বরে বলল, ‘ও আমিও পারি।’
হুক্কা অবাক চোখে তার দিকে তাকাল- ‘মিছে কতা কইচিস? তুই মালা করিচি কখনও?’
‘হাঁ।’
‘কবে করিচি?’
‘আমি গাঁদা ফুল দে মালা গেঁতিচি অনেকবার।’
হুক্কা বলল, ‘ফুলের মালা সবাই পারে। কাগজ দে মালা তৈরি করিচি আগে কখনও?’
জগন্নাথ কিছু একটা ভেবে জবাব দিল, ‘কাগজেরটা তো নকল।’
চোখ বড়ো বড়ো করে হুক্কা বলল- ‘শৈলেন মাস্টার কাগজ দে কী সুন্দর মালা তৈরি করল বল?’
জগু মুখে কোনও কথা বলল না।
তার বন্ধু আবারও তাকে জিগেস করল- ‘কী রে? সুন্দর না? বল?’
এবারে মাথা নাড়াল সে।
‘শৈলেন মাস্টার বলেচে এসব নাকি পরিক্কায় করতে হবে। রঙিন কাগজ পাব কোতায় রে?’
‘জানি নে।’
সংক্ষিপ্ত উত্তর দিল জগন্নাথ।
ওর কথার কোনও প্রত্যুত্তর না করে হুক্কা আবারও চুপ করে গেল।
ভাদ্রমাসের সূর্য মাথার ওপর জ্বলে আছে। রোদের তীব্রতা ওদের গা-মাথা যেন পুড়িয়ে দিচ্ছে। দূরে ফাঁকা পড়ে থাকা মাঠের পাশে খেজুর গাছের সারি। গাছগুলোর মাথায় জোরে হাওয়া লেগেছে। যেন ঝড় বইছে। আকাশ বেশ উজ্জ্বল। ওপাশের মাটির রাস্তার কাছে একটা সাঁইবাবলার গাছ। তার সবুজ পাতায় রোদ পড়ে চিকচিক করছে। ওরা দুজন মাথা নীচু করে হেঁটে যাচ্ছে আলের উপর দিয়ে। জগন্নাথ হঠাৎ করে কথা বলে উঠল, ‘বুঁচির কতাখানা সত্যি?’
‘কীসের কতা?’ হুক্কা ছোটো ছোটো চোখ করে জিগেস করল।
‘ওই যে ..’
থেমে গিয়ে জগন্নাথ আবারও বলল, ‘ওর বাপ নাকি ভূত দেখেচে?’
‘ওহ। ওই যে ইসকুলে আজ কইচিল সেই কতাটা?’
‘হাঁ।’
‘কইল তো। বর্ষার রাতে সেদিন ওর বাপ মাটির দাওয়ায় শুয়েচেল। আর বাড়ির সক্কলে ঘরে ছেল। এই কতা সত্যি ওর বাপ বাইরের দাওয়ায় মাদুর পেতে ঘুমোয় রাতে। আমি নিজের চোকে দেকিচি। আর ওদের বাড়ির সামনে যে পুকুরটা রয়েচে, সেকেন পুকুরের মাঝে যে তালগাছ রয়েচে, ওকেন যে ভূত আচে তা-ও আমি আগে পদ্মপিসির মুকে শুনেচিলুম। এই ভাদ্দরের বর্ষায় নাকি গাছের ওপর তে মাঝরাতে কে একজন আবছা মূর্তি পুকুরে ঝাঁপিয়ে পড়ে। সারা পুকুর সাঁতরায়। তাপ্পর আবার গাছ বেয়ে উঠে পড়ে। কতাখানা সত্যি। ওর বাপ ভূত দেকেচে। শুনিসনি ফুচুও কইচিল সে জানে?’
জগন্নাথ কোনও কথা বলল না। হঠাৎ করেই সে ঠোঁট ফুলিয়ে ফেলল। তার মুখটা কেমন কাঁদো কাঁদো দেখাচ্ছে।
ওর দিকে অবাক চোখে তাকিয়ে হুক্কা জিগেস করল- ‘কী রে! কী হলো তোর?’
সে মাথা নাড়াল। মুখে কিছু বলল না।
ধানখেতের আলের ওপর দিয়ে হেঁটে যাচ্ছে দুজনে।
জগন্নাথের ডান হাতটা চেপে ধরল হুক্কা- ‘কী রে কাঁদচিস কেন?’
সে ধরা গলায় থেমে থেমে বলল, ‘নোকে বলে আমার বাবারে ভূতে মেরে ফেলেচে।’
ওর চোখের জলটা হাতের চেটো দিয়ে মুছিয়ে হুক্কা বলল, ‘কাঁদিস নে।’
হাঁটতে হাঁটতে ওরা দুজনে বুড়োর পুকুর ধারে চলে এসেছে। নাম বুড়োর পুকুর হলেও আসলে এটা একটা খোলা ধানজমি। এখানে চাষবাস হয় না। তবে মাঝেমধ্যে শীতকালে সর্ষেফুলের চাষ করা হয়। হলুদ ফুলে সারা জমি ভরে যায় তখন। বর্ষায় অবশ্য এখন জমিটা জল জমে রয়েছে। কোথাও বা অল্প উঁচু ঢালের মাটি এখনও শুকনো। তবে বুড়োর পুকুরের এই জমিতে অনেক ফুটোফাটা আর অসম গর্ত রয়েছে মাটিতে। সেকেনে ভালো করে খুঁজলে চিতি কাঁকড়া পাওয়া যায়। যদিও বর্ষাতে সাপের ভয় থাকে বেশি। তাই খুব সাবধানে মাটির গর্তে হাত ঢোকাতে হয়। এসব হুক্কা জানে। জগন্নাথও জানে। ওরা মাঠের মধ্যে নেমে পড়েছে।
হুক্কা বলল, ‘কটা শামুক হলে খুব ভালো হয় বুঝলি?’
‘ক্যা? গর্তে হাত ঢুকিয়ে ধরলেই তো হয়?’
‘যদি সাপে কাটে?’
‘তাওলে ছোটো দেকে একটা লাঠি খোঁজ। ওটা মাটির ভেতর ঢুকিয়ে খোঁচা দিলেই বোঝা যাবে।’
‘একটা ডাল ভেঙে আনি তাওলে। তুই একেন দাঁড়িয়ে থাক।’
হুক্কা গাছের ডাল ভাঙতে চলে গেল। আশেপাশে বনজঙ্গল ভর্তি। এই জমির কাছেই একটা খাল রয়েছে। খালের ওপারে কলাবাগান। আর এপারে খালের ধারে নানারকমের গাছপালা। বিশেষ করে জলজ ঘাসের ঝোপ। এছাড়াও জায়গাটা ছোয়ারা লতায় বন হয়ে আছে। ঝোপের কাছাকাছি চার-পাঁচটা জিউলি। একটা বড়ো অশ্বত্থ গাছও রয়েছে। আর নানারকম জঙ্গুলে লতায় ভর্তি।
মুহূর্তের মধ্যেই একটা গাছের ছোটো ভাঙা ডাল নিয়ে ফিরে এল হুক্কা।
এসে চোখ বড়ো বড়ো করে সে জগন্নাথের দিকে তাকিয়ে রইল, ‘কী রে সুদ কোতায় পেলি?’
‘শামুক ভেঙে বের করিচি। এই সুতোয় বেঁধে গর্তে ঢোকাব।’
‘কাঁকড়া উঠবে বল?’
‘হাঁ। তোরে আর গর্তে হাত ঢুকিয়ে বের করতে হবে নে।’
নিজেদের মধ্যে কথাবার্তা বলতে বলতে হঠাৎ তার চোখ গেল কাছের একটা বালির ঢিবির দিকে। সেখানে বেশ বড়ো বড়ো কয়েকটা গর্ত রয়েছে। সেদিকে সন্দিগ্ধ চোখে তাকিয়ে রইল জগন্নাথ। ওকে এভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে হুক্কা হেসে বলে উঠল, ‘কী রে কী দেকতিচি চোখ বড়ো বড়ো করে?’
‘বালির ঢিবির ওই গর্তগুলো কীসের রে? অত বড়ো বড়ো!’
‘ওগুলো শেলের গর্ত রে বোকা। একেন অনেক শেয়াল রয়েচে। তার মানে কাঁকড়া পাব অনেক। চ খোঁজা শুরু করি এবারে।’
ওরা কাঁকড়া ধরা শুরু করল। মাঠের এবড়ো-খেবড়ো মাটির ভেতর অনেক ছোটো ছোটো গর্ত রয়েছে। সেগুলো বর্ষার জলে ভর্তি। গর্তের ভেতর শামুকের সুদ ফেলে দিয়ে ওরা কিছুক্ষণ বসে রইল। কোনওটায় পেল। কোনওটায় বা পেল না। এরকমভাবে সারা মাঠ ঘুরে ঘুরে অনেকটা কাঁকড়া জড়ো করেছে দুজন মিলে। অনেকরকম কাঁকড়া পেয়েছে। কোনওটার নাম তেলে কাঁকড়া। কোনওটা বা দুধে কাঁকড়া। আবার কোনওটাকে বা চিতি কাঁকড়া বলে। এমনকী সমুদ্দুরে কাঁকড়ার বাচ্চাও পেয়েছে কয়েকটা,- যা দেখে জগন্নাথ অবাক হয়ে গেছে। হুক্কা ওর ব্যাগের ভেতর একটা বড়ো পলিথিন এনেছিল। সেটার ভেতর সমস্ত কাঁকড়াগুলো ভরে নিল। পলিথিনের মুখটা সুতো দিয়ে ভালো করে বেঁধে জগন্নাথের হাতে দিয়ে বলল, ‘এই নে।’
জগু তার মুখের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘আমি কী করব?’
‘বাড়ি নে যা। রান্না করে খাবি।’
‘আর তুই?’
‘আমাদের বাড়িতে গতকাল রাতে বাবা এনেচিল।’
‘কোততে?’
‘জোমরহাট থেকে।’
‘জাল বাইতে গেচিল?’
‘না রে। তিন টেকায় এনেচে। এক কড়াই।’
‘তাওলে তুই নিবিনি এগুলো?’
‘না। এগুলো তোরে দিলুম। তোরা রান্না করে খাস।’
‘ঠিক আচে। তুই বলতিচি যখন নে যাই।’
‘চল। এবার হাঁটা দিই।’
সূর্য তখন মাঠের ধারের অনতিদূরের সেই সাঁইবাবলার গাছটার ডালপালায় আটকা পড়ে গেছে। পশ্চিমে হেলে পড়েছে অনেকটা। রোদের তেজও কমে এসেছে। দুপুর গড়িয়ে কখন যে বিকেল হয়ে এসেছে দুজনের কেউই বুঝতে পারেনি। যে পথে এসেছিল সে পথ ধরে ওরা আবার সবুজ ধানখেতের সরু আল বরাবর হাঁটতে শুরু করল। হাঁটার সময় হুক্কা বলল, ‘আলের ওপরতে চোখ ফেলে হাঁটিস। এই সময় আলকেউটের উৎপাত বাড়ে।’
জগন্নাথ মাথা নাড়াল।
হুক্কা তার দিকে পিছন ফিরে বলল, ‘মাঝেমধ্যে একেন এসে কাঁকরা ধরলে ভালো হয় নে? কী বলিস?’
সে উত্তর দিল, ‘কেন?’