রেনকোওজি মন্দিরে নেতাজি সুভাষ বসু প্রবীর বিকাশ সরকার
টোকিওর সুগিনামি-ওয়ার্ড একটি বিখ্যাত শহর। এই খ্যাতির কারণ নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু। যদিওবা সুগিনামি নগর পৌর ভবনের পাশে মহাত্মা গান্ধীর একটি পূর্ণাঙ্গ ধাতব ভাস্কর্য স্থাপিত হয়েছে কিন্তু মানুষের আকর্ষণ নেতাজির দিকেই। এই ওয়ার্ডেই প্রতিষ্ঠিত আছে প্রাচীন বৌদ্ধ মন্দির রেনকোওজি। মন্দিরের দোতলায় মূল উপাসনাকক্ষে সংরক্ষিত আছে। নেতাজির চিতাভস্ম ১৯৪৫ সালের ১৮ সেপ্টেম্বর থেকে। প্রতি বছর ১৮ আগস্ট মন্দির কর্তৃপক্ষ এই চিতাভস্মের সামনে উপাসনার আয়ােজন করেন নেতাজির পবিত্র স্মৃতিতর্পণের মধ্য দিয়ে। অনুষ্ঠিত হয় স্মরণ সভা। অনেক ভক্ত তাতে অংশগ্রহণ করেন।
জাপানিরা বিশ্বাস করেন যে, নেতাজি এই দিনে তাইওয়ানের রাজধানী তাইপের উপশহরে অবস্থিত মাসুইয়ামা বিমানবন্দরে এক বিমান দুর্ঘটনায় মৃত্যুবরণ করেন। তার মরদেহ সেখানে সক্কার করার পর কিছু চিতাভস্ম দু’জন জাপানি সেনা তথা নেতাজির সহযােদ্ধা টোকিওতে নিয়ে আসেন জাপানি বৌদ্ধধর্ম রীতি অনুসারে। তাঁরা চিতাভস্ম তল্কালীন ভারতীয় স্বাধীনতা লীগের দপ্তরে কর্মরত ভারতীয় বিপ্লবী শ্রী রামমূর্তির কাছে অর্পণ করেন। যুদ্ধে পরাজিত জাপানে তখন। বিজয়ী মিত্র শক্তি আমেরিকার সেনারা অবস্থান নিয়েছে। তাদের পরম শত্রু ভারতীয় স্বাধীনতা যুদ্ধের সেনাপতি সদ্যপ্রয়াত নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুর চিতাভস্ম সংরক্ষণ করা খুবই কঠিন হয়ে দাঁড়ায়। এই সমস্যার সমাধানকল্পে অত্যন্ত সাহসের সঙ্গে এগিয়ে আসেন উক্ত রেনকোওজি বৌদ্ধ মন্দিরের তকালীন প্রধান পুরােহিত নেতাজিভক্ত রেভারেন্ড মােচিজুকি ইয়াসুশি। তিনি সেই ভস্ম সম্মানপ্রদর্শকপূর্বক গ্রহণ করে মন্দিরে সংরক্ষণ করেন এই শর্তে যে, কোনােদিন ভারত স্বাধীন হলে পরে নেতাজির চিন্তাভস্ম তাঁর জন্মস্থানে ফিরিয়ে দেবেন। কিন্তু পরিতাপের বিষয় যে, আজ পর্যন্ত তা হয়নি। বহু দেন-দরবার হয়েছে, হচ্ছে। অনেক বছর ধরে ভারত ও জাপানের মধ্যে মনকষাকষি ছিল নেতাজির বিপুল সােনা-রূপা-রত্নরাজি নিয়ে। যা দক্ষিণপূর্ব এশিয়ার প্রবাসী ভারতীয়রা নেতাজির হাতে উজাড় করে দিয়েছিলেন ভারতীয় স্বাধীনতার জন্য। সেই বিপুল রত্নরাজির সন্ধান আর পাওয়া যায়নি। নেতাজির চিতাভস্মও জাপানেই রয়ে গেল। নেতাজি জাপানেই প্রবাসী হয়ে রয়ে। গেলেন ভারত স্বাধীন হওয়ার পর ৭৫ বছর হতে চলল।
প্রকৃতপক্ষে, নেতাজির মৃত্যু নিয়ে নানা রকম রহস্য ও জটিলতা বিদ্যমান। নেতাজির কোনাে–কোনাে আত্মীয়সহ ভারতীয়রা এখনাে মনে করেন নেতাজি আদৌ তাইওয়ানে মৃত্যুবরণ করেননি, বরং তিনি আজও এশিয়ার কোথাও না কোথাও লুকিয়ে আছেন ১২০ বছরের বেশি বয়সেও! এই বিশ্বাস এখন হাস্যকর ছাড়া কিছুই নয়। সত্যিই নেতাজি তাইওয়ানে মৃত্যুবরণ করেছেন কিনা অনুসন্ধান কাজ চালানাে হয়েছে দুবার প্রধান মন্ত্রী নেহরুর আমলে। তিনবারের অনুসন্ধান অনুষ্ঠিত হয়েছে ২০০২ সালে ভারতের সুপ্রীম কোর্টের অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি এম কে মুখার্জীর নেতৃত্বে। অনুসন্ধানী দল তাইওয়ান থেকে রাশিয়া, লন্ডন এবং জাপানেও আসেন কিন্তু বিমান দুর্ঘটনার কোনাে আলামত তারা খুঁজে পাননি। শেষ পরীক্ষা হিসেবে রেনকোওজিতে রক্ষিত চিতাভস্ম ডিএনএ পরীক্ষার জন্য চাওয়া হলে মন্দির কর্তৃপক্ষ দেননি বলে ভারত সরকার নাকি অভিযােগ করেছে এবং এরপর আর কোনাে অগ্রগতি হয়নি। মন্দির কর্তৃপক্ষ পরীক্ষার জন্য চিতাভস্ম দেবেন না মনে করার কোনাে কারণ নেই।
কিন্তু জাপানি ভক্তরা বিশ্বাস করেন যে, নেতাজি এই তারিখেই ভিয়েতনামের রাজধানী সাইগন থেকে তাইওয়ানের তাইপে হয়ে রাশিয়া যাওয়ার পথে তাইপের অদূরে মাৎসুইয়ামা বিমানবন্দরে এক বিমান দুর্ঘটনায় মৃত্যুবরণ করেন। নেতাজিকে বহনকৃত একটি জাপানি যুদ্ধবিমান দুর্ঘটনায় পতিত হলে পরে তার সারা শরীর আগুনে ঝলসে যাওয়ার ফলে অজ্ঞান অবস্থায় মৃত্যুবরণ করেন মিলিটারি হাসপাতালে। যদিওবা তাকে বাঁচানাের আপ্রাণ চেষ্টা করা হয়েছিল বলে প্রত্যক্ষদর্শী কতিপয় ভারতীয় এবং জাপানির ভাষ্য থেকে জানা যায়। তকালীন তাইওয়ানে কর্মরত জাপানি সেনা-চিকিৎসক য়ােশিমি তানেগােশি কর্তৃক নেতাজির মৃত্যু সংক্রান্ত প্রামাণ্য সনদপত্র পর্যন্ত বলছে নেতাজি তাইওয়ানে মারা গিয়েছেন। লন্ডনের বিবিসি বেতার সেটাকে প্রচারও করেছে। এই ঘটনার সঙ্গে দুর্ঘটনার পূর্বাভাস পাওয়া যায় নেতাজি লিখিত একটি চিরকূটে। ১৯৫৬ সালে গঠিত নেতাজি অনুসন্ধান কমিটি-প্রধান নেতাজির অন্যতম প্রধান সহযােগী যােদ্ধা এবং আজাদ হিন্দ ফৌজের (Indian National Army=INA) প্রাক্তন লেঃ কর্ণেল শাহ্ নেওয়াজ খানের কাছে নেতাজির ব্যক্তিগত বিশ্বস্ত সহকর্মী ই.ভাস্করন কর্তৃক হস্তান্তরকৃত সেই চিরকূটে লেখা ছিল: I am writing this letter because I am going on a long journey. Who knows I won‘t get into a plane accident. তবে এই চিরকূটের বার্তা কতখানি প্রামাণিক বলা মুশকিল।
কিন্তু নেতাজির কন্যা অনিতা বসু (Anita Bose Pfaff, জন্ম ১৯৪২-) অন্ধভাবেই বিশ্বাস করেন যে, তাঁর পিতা তাইওয়ানেই মৃত্যুবরণ করেছেন, তাতে কোনাে প্রকার ভুল নেই। পিতার পবিত্র স্মৃতিভস্ম ভারতে ফিরিয়ে নিয়ে সমাধিস্থ করার জন্য একাধিক প্রধানমন্ত্রীকে আবেদন-নিবেদন করেছেন কাজের কাজ কিছুই হয়নি। এমনকি, নেতাজির ভ্রাতুস্পুত্র আন্তর্জাতিক ইতিহাস গবেষক ড.সুগত বসুও তাই বিশ্বাস করেন।
আবার অন্যদিকে একাধিক দলিলপত্রের বদৌলতে জানা যায় নেতাজির জীবিত থাকার খবরও। যেমন অধ্যাপক ও গবেষক পূরবী রায় বলছেন, নেতাজি ইরানের তেহরান হয়ে রাশিয়ায় গিয়েছেন এবং জীবিত ছিলেন স্টালিনের মৃত্যু পর্যন্ত। স্টালিনের শ্রাদ্ধানুষ্ঠান ধারণকৃত প্রামাণ্যচিত্রে নেতাজিকে উপস্থিত থাকতে দেখা গেছে বলেও প্রবীণদের ভাষ্য থেকে অবগত হওয়া যায় এখনাে। নেতাজি গঠিত রাজনৈতিক দল ফরােয়ার্ড ব্লকের প্রবীণ নেতারা বলছেন, পূর্ববর্তী রাজনৈতিক মতানৈক্যের কারণে নেতাজি যাতে ভারতে প্রত্যাবর্তন করে ক্ষমতা দখল করতে না পারেন তার জন্য প্রতিপক্ষ নেহরু স্টালিনের মাধ্যমে রাশিয়ায় নেতাজিকে আটকে রেখেছিলেন অথবা হত্যা করিয়েছিলেন। কোনাে-কোনাে গবেষকের বিশ্বাস ‘তাইওয়ানে নেতাজির মৃত্যু নেহরুর সাজানাে নাটক।
আবার একটি দুষ্প্রাপ্য আলােকচিত্র যার তারিখ ২৭ মে ১৯৬৪, নেহরুর মৃত্যুতে শেষ শ্রদ্ধা জানাতে নেতাজি সন্ন্যাসীর বেশে উপস্থিত হয়েছিলেন–-যা পরবর্তীকালে বহুল প্রচারিত রহস্যময় ‘গুমনামি ভগবানজি’ নামক জনৈক আধ্যাত্মিক শক্তিধারী সন্ন্যাসীর ঘটনাবলীকে স্মরণ করিয়ে দেয়। তাহলে কি নেতাজির তাইওয়ান বিমান দুর্ঘটনা ছিল নেতাজির নিজেরই সাজানাে একটি পরিবল্পনা অন্তর্ধান হওয়ার জন্য? যাতে করে গােপনে তিনি ভারতবর্ষকে মুক্ত করার জন্য লড়াই চালাবেন? নাকি ক্ষমতা থেকে হটিয়ে রাখার জন্য আসলে নেহরুই সাজিয়েছেন এমন নাটক যাতে মানুষ মনে করে নেতাজি মৃত্যুবরণই করেছেন? বিষয়টি ঘােরতর প্যারাডক্স।
নেতাজির বিশ্বস্ত সহযােগী কর্ণেল হাবিবুর রহমান এবং দু’টি অনুসন্ধান কমিটি–প্রধান শাহ্ নেওয়াজ খান এবং জিডি খােশলা নেতাজি তাইওয়ানেই বিমান দুর্ঘটনায় মৃত্যুবরণ করেছেন এমন প্রতিবেদন দাখিল করলেন নেহরু সরকারের কাছে তাহলে ফলাফল কী দাঁড়ালাে? নেতাজি এবং নেহরু দুজনে মিলেই এই মৃত্যুরহস্যের ধুম্রজাল সৃষ্টি করেছেন যার প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করেছেন মাত্র উপরােক্ত তিন সেনা কর্মকর্তা? এই নাটক নিয়ে নেতাজির সঙ্গে কি তবে জাপানিদেরও গােপন চুক্তি হয়েছিল? এসব কি আদৌ বিশ্বাসযােগ্য? প্রতিপক্ষ প্রতিদ্বন্দ্বী নেহরুর সঙ্গে অমনমনীয় নেতাজি গাঁটছড়া বাঁধতে যাবেন এমন মনে করার আদৌ কোনাে কারণও নেই। বস্তুত, নেতাজির মৃত্যু বা অন্তর্ধান সম্পর্কে বহু তথ্য ও রহস্য বিদ্যমান যার গবেষণা করে শেষ করা যাবে না। আর গবেষণা করে লাভও নেই বরং তাঁর জীবন, কর্ম ও আদর্শ থেকে নতুন এবং অনাগত প্রজন্ম কী শিক্ষালাভ করতে পারে সেটাই উপলক্ষ হওয়া উচিত এই একুশ শতকের এশিয়ায় রাজনীতির ক্ষেত্রে।
তাই দেখা যাচ্ছে যে অধিকাংশ জাপানি নেতাজি-ভক্ত এখন আর নেতাজির রহস্যময় মৃত্যু নিয়ে উচ্চবাক্য করেন না। তথাপি প্রবীণ ভক্তদের অকাট্য বিশ্বাস: নেতাজি তাইওয়ানেই মৃত্যুবরণ করেছেন আজও এই মন্দিরে তাঁর চিতাভস্ম সংরক্ষিত আছে। প্রতি বছর ১৮ আগস্ট সকলের জন্য মন্দির উন্মুক্ত করে দেয়া হয়। একবার যদিওবা আগুন লেগে মন্দিরের কিয়দংশ পুড়ে গেলে চিতাভস্মও বিনষ্ট হয়ে যায় বলে কথিত আছে কিন্তু তার কোনাে সত্যতা খুঁজে পাওয়া যায়নি।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর স্বাধীন ভারতের প্রথম রাষ্ট্রপতি রাজেন্দ্রপ্রসাদ, প্রথম প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরু, কন্যা ইন্দিরা গান্ধী, অটলবিহারী বাজপেয়ী এখানে এসে শ্রদ্ধাজ্ঞাপন করেন। মন্দির পরিদর্শনকালে নেহরু কর্তৃক লিখিত দুছত্রের একটি বাণী সংরক্ষিত আছে যাতে নেহরু একটি বাক্যও লেখেননি নেতাজি সম্পর্ককে বা নেতাজির নামও লেখেননি! আরও এসেছেন নেতাজির আত্মীয় অমিয়নাথ বসু, শিশিরকুমার বসু, কৃষ্ণা বসু, সুগত বসু প্রমুখ। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর কোনাে রাজনৈতিক নেতা রেনকোজি মন্দির পরিদর্শন করেননি। এমনকি, নেতাজির শেষ অনুসারী বলে কথিত বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানও–এটা এক রহস্য! পরবর্তীকালে জিয়াউর রহমান, এইচ এম এরশাদ, খালেদা জিয়া, শেখ হাসিনা একাধিকবার জাপানে এলেও কেউ শ্রদ্ধা নিবেদন করতে যাননি। বাংলাদেশের কোনাে রাষ্ট্রদূতও আজ পর্যন্ত যাননি। আমার জানা মতে বাংলাদেশ থেকে কবি নির্মলেন্দু গুণ, মুক্তিযােদ্ধা ও সাংবাদিক চিত্ত রিবেরু, কবি সমুদ্র গুপ্ত, এফবিসিসিআই এর প্রাক্তন সহ-সভাপতি দেওয়ান সুলতান আহমেদ, কথাসাহিত্যিক ফখরুজ্জামান চৌধুরী, কথাসাহিত্যিক ও অভিনয়শিল্পী দিলারা জামান, প্রাক্তন সচিব, লেখক, গবেষক এবং ঢাকা জাদুঘরের মহাপরিচালক সমর পাল, লােকসাহিত্য বিশেষজ্ঞ শামসুজ্জামান খান রেনকোজি মন্দিরে গিয়েছেন, নেতাজির আবক্ষ ভাস্কর্যের সামনে দাঁড়িয়ে শ্রদ্ধা নিবেদন করেছেন। আমিই তাদেরকে সেখানে নিয়ে গিয়েছি। উল্লেখ্য যে, এই স্মারক ভাস্কর্য স্থাপন করেছেন নেতাজিভক্ত এবং ১৯৫৮ সালে টোকিওতে গঠিত ‘সুভাষচন্দ্র বসু একাডেমীর তৃতীয় সভানেত্রী মাদাম এমােরি কিকুকোর কন্যা মাৎসুশিমা কাজুকো ১৯৯৫ সালে নেতাজির পঞ্চাশতম মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে।
অনেক বছর ধরেই স্মরণসভায় আমিও উপস্থিত থাকি জাপানি বন্ধুদের সঙ্গে। ২০০৮ সালে বেশ কয়েক জন নেতাজি ভক্তের সঙ্গে সাক্ষাৎ ঘটে যারা জাপানের বিশিষ্ট ব্যক্তি। তাদের মধ্যে উল্লেখযােগ্য হলেন নেতাজির দুই দেহরক্ষী ইয়ামামােতাে তেসুরােও এবং ইয়ামাদা ইসাও। সেইসঙ্গে গবেষক নেগেশি মােতােইউকি, গবেষক ওওসুকা তােশিআকি, সাংবাদিক বান তাকেজুমি, গবেষক হারায়ােশিআকি, জাপান-ইন্ডিয়া অ্যাসােসিয়েশনের প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট হিরাবায়াশি হিরােশি ও সিনিয়র ডিরেক্টর হারা ইউজি, রাজনীতিবিদ ও সুগিনামি–ওয়ার্ড পৌর পরিষদ-সদস্যা মাসুউরা য়ােশিকো, নেতাজি গবেষক তেইকোকু বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক নাকামুরা গেন্ প্রমুখ। একবার প্রধান অতিথিদ্বয় ইয়ামামােতাে ও ইয়ামাদা নেতাজি সম্পর্কে আবেগ থরােথরাে কণ্ঠে দীর্ঘ স্মৃতিচারণ করেছিলেন। কীভাবে জার্মানির ডুবােজাহাজ থেকে জাপানি ডুবােজাহাজে নেতাজিকে স্থানান্তরিত করা হয়েছিল সেই লােমহর্ষক বর্ণনা দিয়েছিলেন! তিন জন দেহরক্ষীর একজন শত্রুপক্ষের গুলিতে নিহত হন সেই সময়। ইয়ামাদা নেতাজির সঙ্গে কর্মময় দিনগুলাে নিয়ে নিজব্যয়ে একটি গ্রন্থও প্রকাশ করেছেন ইতিমধ্যে।
নেতাজি সম্পর্কে প্রতি বছরই এখনাে জীবিত তাঁর সহযােগী এবং ভক্তদের স্মৃতিচারণ শুনে মনে হয়: দেশপ্রেমিক নেতাজির তেজস্বিতার আগুন আজও নেভেনি—আজও তাঁর সেই দীপ্ত–দর্পিত স্বাধীনচেতা হৃদয়ের উত্তাপ–উষ্ণতা আমাদেরকে ছুঁয়ে ছুঁয়ে যায়।
নেতাজির আমৃত্যু ভক্ত হায়াশি মাসাও যিনি ১৯৫৮ সালে জাপানে ‘সুভাষচন্দ্র বসু একাডেমী’ গঠন করেছিলেন একদল নেতাজি ভক্তকে সঙ্গে নিয়ে নেতাজির বড়দা শিশির কুমার বসুর অনুরােধে। ২০০৬ সালে তিনি পরলােকে যাত্রা করেন। ১৯৯৫ সালে নেতাজির আবক্ষ স্মারক ভাস্কর্য স্থাপনের পেছনে তার উদ্যোগ ও অবদান অনস্বীকার্য। নেতাজির চিতাভস্ম যদি চলেও যায় ভারতে তথাপি এই সুদর্শন ভাস্কর্যটি এই মন্দির প্রাঙ্গণে স্বমহিমায় দাঁড়িয়ে থাকবে জাপান-ভারত-বাংলার মৈত্রী সম্পর্কের অন্যতম প্রতীক হয়ে বলে অনেক জাপানি নাগরিক মনে করেন তাঁদের মধ্যে ইয়ামামােতাে তেসুরােও অন্যতম।
২০১০ সালের ১৮ আগস্ট ৮৫ বছর বয়সী ইয়ামামােতাে ৩৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস পর্যন্ত ওঠা গ্রীষ্মের প্রচণ্ড খরতাপকে তুচ্ছ করে বহু দূর থেকে এসেছিলেন নেতাজিকে শ্রদ্ধা জানাতে! দাঁড়িয়ে কথা বলার মতাে শক্তি নেই তাঁর তথাপি প্রায় ঘণ্টাখানেক নেতাজিকে নিয়ে কথা বলেছিলেন। মনে হয় সারাদিন কথা বললেও তিনি ক্লান্ত–শ্রান্ত হবেন না! এতখানি ভালােবাসা ও শ্রদ্ধা বহন করছেন প্রবীণ জাপানিরা, যারা একদিন নেতাজির সঙ্গে কাজ করেছেন বা তাঁর সান্নিধ্যে আসার সুযােগ পেয়েছেন।
প্রতি বছরই ৫০ থেকে ৮০ জন নেতাজি ভক্ত সমবেত হন রেনকোওজি মন্দিরে। অবশ্য বাঙালি মাত্র জনা কয়েক। প্রতিবার আমার সেখানে যাওয়ার অর্থ হচ্ছে নেতাজির প্রবীণ সহকর্মীদের সঙ্গে পরিচিত হওয়া এবং নতুন নতুন তথ্য জানা। যেমন ২০০৯ সালে একজন জাপানি নাগরিক মাৎসুমােতাে হিদেহিরাে নিয়ে এসেছিলেন নেতাজির স্বাক্ষরযুক্ত একটি দুর্লভ ছবি, যেটা নেতাজি তার চিত্রশিল্পী পিতাকে উপহার দিয়েছিলেন ১৯৪৪ সালে টোকিওতে। এই ঘটনা নিয়ে আমি ঢাকার দৈনিক প্রথম আলােতে একটি নাতিদীর্ঘ ফিচার লিখেছিলাম। আরেকবার নেতাজিভক্ত তেইকোকু বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ও গবেষক নাকামুরা গে এবং তার বন্ধু জার্মান ভাষার প্রশিক্ষক আনড্রেস সাইমােনজেন যৌথভাবে নেতাজিকে নিয়ে লিখিত একটি গবেষণাপত্র বিনামূল্যে বিতরণ করেছিলেন মন্দিরে উপস্থিত হয়ে। এর আগে ২০০৮ সালে উক্ত অধ্যাপক নাকামুরা গে আমাকে দিয়েছিলেন নেতাজির মৃত্যু রহস্য সংক্রান্ত একটি গবেষণাপত্রের প্রথম খণ্ড। উল্লেখিত যৌথগবেষণায় গবেষণায় দু’জনে নেতাজির জার্মানির জীবনযাপন (এপ্রিল ১৯৪১–জানুয়ারি ১৯৪৩) সম্পর্কে অনেক তথ্য উপস্থাপন করেছিলেন। যেমন কীভাবে সুভাষচন্দ্র বসু ভারত ছেড়ে সুদূর য়ােরােপের জার্মানিতে গিয়ে পৌঁছলেন, হিটলার সরকারের সমর্থন আদায় করলেন, কীভাবে সাহায্য পেলেন, একান্ত সচিব এমিলি শেঙ্কেল যিনি পরে নেতাজির সহধর্মিনী হয়েছিলেন
কীভাবে সাক্ষাৎ হল; তাঁকে বিয়ে করা, জার্মানিতে তাঁর গুরুত্বপূর্ণ কর্মকাণ্ড, জার্মানি থেকে ইতালিতে গমন এবং ব্যর্থতা ইত্যাদি নানা ঘটনার কথা তাদের গবেষণা থেকে জানতে পেরেছিলাম।
খুবই তাৎপর্যপূর্ণ তথ্য পাওয়া যায় তাদের গবেষণা থেকে যে, ভারতত্যাগী সুভাষচন্দ্র বসু এমিলি শেঙ্কেলের সঙ্গে ইতালির রাজধানী রােমে যান ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামে ইতালির প্রেসিডেন্ট বেনিটো মুসােলিনীর সাহায্য ও সহযােগিতা পাবার জন্য কিন্তু সেখানে আগে থেকেই আরেক জন ভারতীয় ঘাঁটি গেড়ে বসেছিলেন ইতালি সরকারের অনুমতি নিয়ে যে কারণে নেতাজি সমর্থন পাননি। রােমে প্রতিষ্ঠিত আজাদ হিন্দু প্রবাসী সরকারের প্রধান ভারতীয় স্বাধীনতা সংগ্রামের সেই প্রবাসী বিপ্লবীর নাম ড. মােহাম্মদ ইকবাল শেদাই, মূলত ছিলেন গদর পার্টির সদস্য। নেতাজির চেয়ে বয়সে বড় ইকবাল বর্তমান পাকিস্তানের শিয়ালকোটে এক অভিজাত পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন ১৮৮৮ সালে। ১৯৪০ সালে তিনি ইতালি যান। ১৯৪১ সালে রােম থেকে রেডিও হিমালয় নামে বেতারের মাধ্যমে সম্প্রচার করতেন স্বাধীনতা সংগ্রামের তথ্য ও সংবাদ। তিনি ছিলেন নেতাজির ঘােরতর প্রতিদ্বন্দ্বী। নেতাজি সম্পর্কে ভুল ব্যাখ্যা দিতেন শ্রোতাদেরকে। এছাড়াও ছিলেন যেমন কট্টর জাতীয়তাবাদী তেমনি ইসলামপন্থী। মনে মনে ভারতের চেয়ে বরং তিনি পাকিস্তানের জন্যই বেশি চিন্তা করতেন এবং সেভাবেই বিদেশে মুসলিমদেরকে ঐক্যবদ্ধ করতে চেয়েছিলেন। তবে বিপ্লবী হিসেবে তাঁর যথেষ্ট অবদান অনস্বীকার্য।
ভারত ভাগের পর তিনি পাকিস্তানে ফিরে যান এবং রাজনীতির সঙ্গে সক্রিয়ভাবে জড়িত হয়ে পড়েন। ভারতীয় স্বাধীনতা সংগ্রামের বয়ােজ্যেষ্ঠ নেতা এবং প্রথম শিক্ষামন্ত্রী মৌলানা আবুল কালাম আজাদ একবার রােমে ড.মােহাম্মদ ইকবালকে ভারতের দিল্লিতে গিয়ে বসবাস করার প্রস্তাব দেন, সুবিধা হিসেবে পাবেন বাড়ি, গাড়ি এবং মােটা অঙ্কের অবসরভাতা। কিন্তু তিনি সেই প্রস্তাব প্রত্যাখান করে বলেছিলেন, পাকিস্তানে জন্মেছেন, পাকিস্তানেই মরতে চান।
বাঙালি হিসেবে এইসব তথ্য জানতে পেরে সত্যিই দারুণ রােমাঞ্চিত হয়েছিলাম। উল্লেখ্য যে, নেতাজি জাপানে যেমন। অত্যন্ত সম্মানের পাত্র তেমনি তাঁকে ঘিরে জাপানিদের আগ্রহের শেষ নেই। তাই আজও হচ্ছে গবেষণা যার শেষ কোথায় জানা নেই। নতুন নতুন তথ্য প্রকাশিত হচ্ছে নবীন–প্রবীণ জাপানিদের গবেষণা এবং স্মৃতিকথায়। জাপানের সঙ্গে নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুর নিয়তি চিরবন্ধনে বাঁধা পড়ে গেছে যা আর ছিন্ন হওয়ার সম্ভাবনা নেই।
শিশুসাহিত্যিক, কথাসাহিত্যিক ও গবেষক