আমি বাংলাকে ভালবাসি

দীপংকর চন্দ

সরাসরি প্রসঙ্গে আসি, সময় নষ্ট করে কী লাভ, সময় যতো নষ্ট হবে হারাতে থাকবো ভাষা, ভাষা হারালে লিখবো কী?

হ্যাঁ, প্রতিনিয়ত আমরা হারিয়ে ফেলছি আমাদের ভাষাকে, বাংলা, বাংলাকে, অথচ এমন হবার কথা ছিলো না, হবার কথা ছিলো বাংলা ভাষা দিয়েই আমাদের বাঙালি পরিচয় গড়ে ওঠার, কিন্তু ভাষা যেন আমাদের ছেড়ে গেলো, অথবা আমরা যেন ছেড়ে গেলাম আমাদের ভাষাকে, কোথায় যেন বিচ্যুতির একটা ভূকম্প এসে ভিত্তিভূমি থেকে শিথিল করে দিলো আমাদের অস্তিত্বের শেকড়!

শেকড়? হ্যাঁ, শেকড়ই তো বলবো, ভাষাই তো একটা জাতিসত্তার শেকড়, এই ভাষা দিয়েই তো আমাদের অস্তিত্বের প্রকাশ-বিকাশ, যেটা আমরা রাজপথ প্রকম্পিত করে জানিয়েছিলাম ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারিতে, আমরা পুরো পৃথিবীকে চিনিয়েছিলাম আমরা বাঙালি, দেখো, বাঙালি কেমন বুক চিড়ে রক্ত দিতে জানে ভাষার মর্যাদা রক্ষা করার জন্য, জীবন দিতে জানে মাতৃভাষাকে একটা অরাজক ভূখণ্ডের রাষ্ট্রভাষায় রূপান্তরের জন্য।

হ্যাঁ, তত্কালিন পূর্ববাংলার কথাই বলছি, পূর্ববাংলার বাঙালি উপলব্ধি করেছিলো ভাষা হারালে কিছুই থাকে না মানুষের, ভাষা হারালে নিজের শেকড় হারিয়ে ফেলে মানুষ, নিজের অস্তিত্ব হারায়, হারায় নিজস্ব ভূখণ্ডের ওপর থেকে নিজেদের আর্থসামাজিক রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণ, হারায় সাংস্কৃতিক কর্তৃত্ব, হারায় নিজস্বতা, স্বকীয়তা, হারায় জাতিসত্তা।

পূর্ববাংলার ভাষা আন্দোলনের সাফল্যের ধারাবাহিকতা কী দেয়নি বাঙালিকে? দিয়েছে একটা স্বাধীন ভূখণ্ড, সার্বভৌমত্ব, একটা নিজস্ব মানচিত্র, দিয়েছে বাঙালি জাতিকে বিশ্ব দরবারে মাথা উঁচু করে দাঁড়াবার সুমহান সনদ।

অথচ, যে ভাষার জন্য এতো প্রাপ্তি আমাদের, তাকে স্বমহিমায় বিকশিত হতে দিতে কেন যেন কুণ্ঠিত হলাম আমরা, কেন যেন মুখ ঘুরিয়ে নিলাম ধীরে ধীরে বাংলা ভাষার দিক থেকে, যে অবহেলা বাংলা ভাষার প্রাপ্য নয়, ঠিক যেন সেসব গ্লানির ভার আমরা চাপিয়ে দিলাম বাংলা ভাষার প্রাণোচ্ছ্বাসে, দিন দিন ক্ষীণ হলো তার ধারাস্রোত, নাব্যতা হারালো তার সুললিত প্রবহমানতা, এবং সেই সুযোগে বিজাতীয় ভাষার অনুপ্রবেশ ঘটলো বাংলায়, এবং রাষ্ট্রযন্ত্রের আনুকূল্যধন্য সেসব বিজাতীয় ভাষার প্রবল প্রবাহে আমরা আমাদের মাতৃভাষা বাংলাকে ভেসে যেতে দেবার ব্যবস্থা করে দিলাম যেন নিজেরাই, সচেতনে অবচেতনে অসচেতনে, নিজ হাতে যেন খনন করলাম আমরা আমাদের জাতিসত্তার সমাধি!

তবে খননকাজ সম্পন্ন হলেও বাংলা ভাষার সমাধিপর্ব সমাপ্ত হয়ে যায়নি এখনও, ক্রুশবিদ্ধ যিশুখ্রিস্টের মতো বাংলা ভাষার পুনরুত্থানের সম্ভাবনা এখনও সমুজ্জ্বল, কারণ এখনও বাঙালি বাংলাকে ভালোবাসে, এখনও বাঙালি বাংলা ভাষাকে ভালোবাসে, কারণ, তাঁরা জানে, বাংলা ভাষার মৃত্যু হলে বাঙালি আর বাঙালি থাকবে না, বাঙালি জাতিসত্তার বিলুপ্তি ঠেকাতে বাংলা ভাষার বেঁচে থাকা প্রয়োজন, বাংলা ভাষার বেঁচে থাকা প্রয়োজন বাঙালি নিশ্চিহ্ন হয়ে যাওয়ার কলঙ্ক ঠেকাতে।

আমার আস্থা আছে বাঙালির ওপর, বাঙালি কোনো ভাবেই বাংলা ভাষার বিলুপ্ত হবার আশঙ্কাকে প্রশ্রয় দেবে না, বাংলা তো বাঙালির ভাব প্রকাশের ভাষাই শুধু নয়, বাংলা বাঙালির মা, মা’কে রক্ষা করা যে সন্তানের কর্তব্য!

শেয়ার করতে:

You cannot copy content of this page