Column

ফ্রিল্যান্স সাংবাদিকের অভিজ্ঞতা

পিনাকী চৌধুরী।। আজ থেকে প্রায় একুশ বছর আগে ধর্মতলায় একটি খ্যাতনামা পত্রিকা অফিসে গিয়েছিলাম। প্রথম দর্শনেই বেশ   ভাল লেগে গেলো সাজানো গোছানো সেই পত্রিকা অফিসটিকে । উদ্যেশ্য ছিল কাগজে প্রতিবেদন লিখে অর্থ উপার্জন করবো।  এখানে বলে রাখা ভাল যে, তখন কিন্তু আমি বেশ আড়ষ্ট, লিখতেও তেমন একটা পারতাম না। যাইহোক একজনের যোগাযোগে এবং সূত্রে সেই পত্রিকার তদানীন্তন একজন বিখ্যাত ক্রীড়া সম্পাদকের কাছে পৌঁছে গেলাম। শীততাপ নিয়ন্ত্রিত নিজের চেম্বারে তিনি তখন ম্যাগাজিনে চোখ বোলাচ্ছেন। আক্ষরিক অর্থেই তিনি একজন সুদর্শন পুরুষ। আমতা আমতা করে বললাম ” স্যার, আপনাদের পত্রিকায় আমি লিখতে চাই!” চোখে চোখ রেখে তিনি বললেন ” দেখুন, শুরুতে মোহনবাগানে খেলবো, এরকমতো হয় না। আপনি বরং ছোটখাটো পত্রিকায় প্রথমে লিখতে চেষ্টা করুন!” বিমর্ষ হয়ে নীচে নেমে এলাম। অতঃপর আবার অন্য একটি বিভাগের সম্পাদকের কাছে গিয়ে যথারীতি অনুনয় বিনয় করলাম। তিনি নিমরাজি হলেন । তবে এটাও বলে দিলেন যে, আমি যেন লেখার গুণগত মান বজায় রাখি । আমি কতটা দিতে পারছি , সেটাই তিনি দেখবেন এবং বিনিময়ে আমি কি পাচ্ছি, সেটা যেন ততোটা বিবেচিত না হয়। যাইহোক এরকম ভাবে কিছু দিন চলার পরে একদিন সেই বিভাগীয় সম্পাদক আমার জমা দেওয়া লেখাটি আমার মুখের ওপর ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে ভর্ৎসনা করলেন ” এটা কি প্রতিবেদন লেখা হয়েছে ? ছাপার অযোগ্য ! ছিঃ।” প্রসঙ্গত, তখন কিন্তু আমি ইন্টারনেট তেমন একটা জানতাম না। সাদা এ -৪ সাইজের কাগজে হাতে লিখে অফিসে গিয়ে জমা দিতাম। যাইহোক ক্রমে ক্রমে আমার আড়ষ্টতা কাটলো এবং ওই প্রকাশনা সংস্থার অপর একটি বিভাগের সম্পাদকের অধীনে নাটক এবং সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের শো কভার করতে শুরু করলাম। বিভিন্ন প্রেক্ষাগৃহে তখন আমার যাতায়াত শুরু হল। যেহেতু নামজাদা কাগজের অফিস থেকে আমি প্রতিনিধি হিসেবে উপস্থিত হতাম,তাই অনেকেই খাতির করতেন। কলকাতার এমন কোনো প্রেক্ষাগৃহ নেই যেখানে আমি যাইনি। এরকম ভাবে রোদে পুড়ে জলে ভিজে আমার খবর সংগ্রহের কাজ চলতে থাকলো। ক্রমে ক্রমে আড়ষ্টতা কেটে গেল এবং মুচমুচে বাংলায় প্রতিবেদন লিখতে থাকলাম। তবে সেই বিভাগীয় সম্পাদক আমাকে বারংবার সতর্ক করে দিয়েছিলেন এই বলে যে বিভিন্ন রকম প্রলোভন আসবে, কিন্তু আমি যেন সাদাকে সাদা এবং কালো কে কালো বলে প্রতিবেদন লিখতে পারি। তাঁর কথার সারমর্ম পরে বুঝতে পেরেছি। একবার হল কি, একদিন সরস্বতী পুজোর সন্ধ্যায় সেই বিভাগীয় সম্পাদক আমাকে ফোন করে বললেন ” তোমাকে বলতে একদম ভুলে গেছি। এখনই চেতলার অহীন্দ্র মঞ্চে চলে যাও। ওখানে একটা বড় নাটকের শো রয়েছে। স্টার কাস্টিং কিন্তু।” শুনেই বুঝতে পারলাম যে তিনি বেশ বিভ্রান্ত রয়েছেন। যাইহোক আমি বললাম ” দাদা এখন তো প্রায় ছটা বাজতে যায়। সাড়ে ছটায় পৌঁছতে পারবো না যে!” ফোনের ওপাশ থেকে তিনি আবার বললেন ” ট্যাক্সি করে চলে যাও !” যাইহোক কোনোরকমে প্রস্তুত হয়ে উপস্থিত হলাম অহীন্দ্র মঞ্চে। তখন সন্ধ্যা সাতটা বাজে। যথারীতি সেখানকার নিরাপত্তা কর্মকর্তা আমাকে ঢুকতে দিলেন না। আমি আমার পরিচয় এবং সংশ্লিষ্ট পত্রিকার নাম বললাম। কিন্তু তাতেও চিড়ে ভিজলো না। অতঃপর আমি বিভাগীয় সম্পাদককে ফোন করে সবিস্তারে জানালাম । তিনি আমাকে বুদ্ধি দিলেন ” শোনো, তুমি এখন বাড়ি ফিরে যাও। আর আগামীকাল সকালে আয়োজক সংস্থাকে ফোন করে বলবে যে আমি নির্দিষ্ট সময়ে উপস্থিত হলেও, আপনাদের নিরাপত্তা কর্মকর্তা আমাকে ঢুকতে বাধা দিন । আমি খুবই অপমানিত বোধ করেছি।” পরেরদিন সাতসকালেই আমি আয়োজক সংস্থাকে ফোন করে ডাহা মিথ্যা কথাগুলো উগরে দিলাম ! সেখান থেকে দুঃখপ্রকাশ করে সাত দিন পরের নাটকের শো কভার করতে আমাকে অনুরোধ করলেন আয়োজকরা। সাত দিন পরে নির্দিষ্ট সময়ে উপস্থিত হলাম আমি এবং বেশ রাজকীয় সম্বর্ধনা পেলাম। কি আশ্চর্য ! আমার সেই প্রতিবেদন পত্রিকায় সম্পাদকীয় লেখা হিসেবে প্রকাশিত হল ! অবাক পৃথিবী ! মনে মনে ভাবলাম এবার বোধহয় পালে হাওয়া লাগছে আমার ।।

শেয়ার করতে:

You cannot copy content of this page