Novelette

ছোট উপন্যাস।। গোপাল গোঁসাই।। সৌপ্তিক চক্রবর্তী

 

হাঁটতে হাঁটতে ভাবতে থাকল কে চোর! তাকে বিজনেসে চিট করে দিল! মিথ্যে মামলায় তাকে ফাঁসাল! তারা এতদিন ভাড়া ছিল এই বাড়িতে তখন প্রোমোটিং করল না! এখন যেই তারা একে একে মরেছে বা সরেছে অমনি প্রোমোটিং করে দিল! ভাগের ন্যায্য ফ্ল্যাটটাও দিল না! বউটাকে কে কী বুঝিয়েছে কে জানে! কোথায় গেল তাই বা কে জানে! 

এরপর… 

তার শ্বশুরবাড়ি এ পাড়াতেই। বেরিয়ে যেতে যেতে তাই একবার ঢুঁ মেরে খোঁজ নিল চন্দনা আছে কিনা। না, নেই, কোথায় গেছে তাও নাকি জানে না শ্বশুর! সদর দরজা থেকেই বিদেয় দিল তাকে! 

‘দেখ, তুমি এখানে আর এসো না। বুঝতেই পারছ, আমার ছোট মেয়েটারও তো বিয়ে দিতে হবে।’ শ্বশুরের শেষকথা ছিল এটাই। 

আর হ্যাঁ, ‘এইটা চন্দনা তোমার জন্য রেখে গেছে’ বলে হাতে ধরিয়ে দিয়েছিল তার ফাইলখানা। তার ভেতর তার সব সার্টিফিকেট, পাশবই, চেকবই আর আধার কার্ডটা ছিল।

পরে জেনেছিল চন্দনা কোথায় আছে। যদিও সত্যি-মিথ্যা জানে না। মোড়ের মাথায় রিক্সাস্ট্যান্ডের ভোম্বল বলেছিল তাকে। ভোম্বল হল সেইরকম মাল যার কাছে আশেপাশের সব পাড়ার খবর থাকে এবং প্রত্যেক বাড়িরই কাউকে না কাউকে  চেনে। এপাড়া-সেপাড়া ঘুরে রিকশা চালানোর জন্যই হয়ত।  

সেই গোপালকে বলেছিল যে বুবাই ফুঁসলেছে চন্দনাকে। এই বুবাই আর পিকলু ছিল তার বিজনেস পার্টনার। যতীন কলোনীরই ছেলে। ওদের ভাড়া বাড়ির প্রোমোটিং দিয়ে এখন বুবাই-পিকলু কনস্ট্রাকশনে পা রাখছে!

তো বুবাই সেয়ানা মাল। এখনও বিয়ে-শাদি করেনি। দক্ষিনেশ্বরে একটা ফ্ল্যাট কিনে সেখানেই নাকি রেখেছে চন্দনাকে! গোপাল বেশ কয়েকবার পুরনো নম্বরে ট্রাই করে দেখেছে চন্দনাকে। নট রিচেবল। কি আর করা যাবে!

এককালে নন্দ মস্তানের ভয়ে যে গোপালের দিকে চোখ তোলার সাহস হত না কারও সেই গোপাল মার খেয়ে চোখ মুছতে মুছতে পাড়া ছেড়েছিল। রাগ তো তার হয়েই ছিল কিন্তু দুঃখটা হয়েছিল আরও অনেক বেশি। 

নিজেকে তার মনে হয়েছিল ‘সর্বহারা’। আগেকার সেই লালপার্টির জমানায় অনেকবার শুনেছিল আর কয়েকবার দেওয়ালেও দেখেছিল শব্দটা। তখন মানেটা ঠিক বঝেনি। 

তিন

কোথায় আর যাবে? ভাবতে ভাবতে গোপাল চলে এসেছিল বড়রাস্তা টপকে পাশের পাড়ায়। তার অয়নমামার বাড়ি। অয়ন অর্থাৎ অয়ন ঘোষ তার দূর সম্পর্কের মামা। কাছাকাছি বাড়ি হওয়ায় ভালই যোগাযোগ ছিল। আর অয়ন তার বাবা নন্দরও ঘনিষ্ঠ ছিল খুব। 

পালাবদলের আগে অবদি তার অয়নমামাও এন্তার রংবাজি করেছে তার বাপের সাথে মিলে। তারপর ঘরে ঢুকে গেছে। ইদানিং আবার ধম্মে-কম্মে মতি দিয়েছে। কোনো এক গুরুর কাছে দীক্ষা নিয়েছে। গলায় একটা রুদ্রাক্ষের মালা পরে। সেটা আসল কিনা গোপাল অবশ্য তা জানে না। পুরোপুরি নিরামিষ আহার। হপ্তায় এক-দু বেলা আবার উপোসও রাখে। গলির মুখে শিবমন্দিরটায় সকাল-সন্ধে বসে থাকে। গত বছর বাইপাস হওয়ার পর বিড়ি ছেড়েছে। মদটাই যা ছাড়তে পারেনি। তবে সামান্যই। শনিবার করে একটা ছোট বাংলার বোতল কেনে। সাথে ছোলা সেদ্ধ। অয়নের বয়স বাহান্ন-তিপ্পান্ন হলেও একটু বেশিই বুড়োটে দেখায়। ইদানিং আবার মৃত্যুচিন্তায় পেয়েছে। নতুন একটা পাথরও ধারণ করেছে। 

অয়নের বাড়িটা পাড়ার একদম ধার ঘেঁষে। একটা কানাগলির ভেতর। বাড়ি শেষ হয়ে পেছনে একটা হাইড্রেন। তারপর রেলের জমি। কিছুটা ছড়িয়ে, ঢালু হয়ে ওপরে উঠে গেছে। সেখানে এখন এক্সপ্রেস হাইওয়ে। আর হাইওয়ে ক্রশ করে আবার ঢালু হয়ে ওপরে উঠে রেললাইন। 

ছোট্ট বাড়ি অয়নের। সদর দরজা থেকে একপাশে কোমর সমান বাউন্ডারির পাঁচিল আর অন্যপাশে ঘরের দেওয়ালের মাঝখান দিয়ে ইট বাঁধানো একটা সরু রাস্তা। পাশাপাশি দুজন ঢোকা যাবে না। এই রাস্তা দিয়ে এসে একটা ছোট উঠোন ঘিরে বাঁদিক থেকে প্রথমে গোয়ালঘরের দরজা। কাঠের ফ্রেমে টিনের পাত বসানো। গোয়ালঘরের দেওয়াল বরাবর কিছুটা নিয়ে কলতলা আর তারপর কয়েক ফুট ফাঁকা জায়গা ছাড়া। ডানহাতে ঘুরে বাথরুম। এরও টিন-কাঠের দরজা। অ্যাসবেস্টসের ছাদ। তারপাশে সিঁড়ি। সিঁড়ির খাঁজে হেঁশেল। আবার ডানদিকে ঘুরে দুটো ঘর। একটা আট বাই সাত। আর একটা দশ বাই দশ কি এগারো হবে। ঘর দুটোর দরজার সামনে একটা করে সিঁড়ি। অন্য দেওয়ালের সাথে রাস্তার দিকেও একটা করে জানলা আছে।  পাকা ছাদ। উঠোন-সিঁড়ি-ঘরের মেঝে নিট সিমেন্ট দিয়ে বাঁধানো। ছাদটা ন্যাড়া। কেউ ওঠে না। কাপড়-জামা শুকানোর জন্য উঠোন। 

গোপালকে নিয়ে বাড়িতে লোক বলতে চারজন। অয়ন, তার দ্বিতীয় পক্ষের বউ মাধবী আর তাদের বছর চোদ্দোর মেয়ে টুসু। প্রথম পক্ষের মেয়ে কুহুর বিয়ে হয়ে গেছে গত বছর। কুহুর যখন আট বছর বয়স তখন অয়নের প্রথম পক্ষের বউ কাবেরী মারা যায়। ছোট্ট মেয়েটাকে কে দেখবে ভেবেই দ্বিতীয় বিয়েটা করা। 

বড় ঘরে শোয় তার অয়নমামা আর মাধবীমামী। ছোট ঘরে মামাতো বোন টুসু। এবার থাকতে গেলে থাকতে হয় উঠোনে কিংবা ছাদে। খোলা আকাশের নিচে। অগত্যা গোপাল ঢুকে গেছে পেছনের গোয়ালঘরে। 

গোয়ালঘরটা লম্বায় পনেরো ফুট আর চওড়ায় প্রায় বারো ফুট হবে। ইটের দেওয়াল। অ্যাসবেস্টসের ছাদ। পরিষ্কার করার সুবিধা হবে বলেই মেঝেটা নিট সিমেন্টে বাঁধানো। ঘরের দরজা থেকে ভেতরে তাকালেই উল্টোদিকে আর একটা দরজা। এটাও ওই টিন-কাঠেরই। তারপর পাশাপাশি বাঁধা দুটো দেশী গোরু। একটা বাদামি। নাম লালি। আর একটা কালো-সাদা। নাম দুলি। পেছনের ওই দরজা খুলে লালি-দুলিকে চড়াতে নিয়ে যাওয়া হয়। ড্রেনের ওপর কাঠের পাটাতন পাতা। তারপর রেলের জমির জঙ্গল কেটে কিছুটা জায়গা পরিষ্কার করেছে অয়ন। ওখানেই খানিক চড়ায় গোরু দুটোকে। পেছনদিকে আর ডান দিকের দেওয়ালে একটা করে জানলা আছে। যদিও সেগুলোয় ফ্রেম-গরাদ-পাল্লা কিছুই নেই। দুপাশের দেওয়ালে পেরেক মেরে দড়ি টাঙিয়ে ভুষির খালি বস্তা ঝোলানো। তার ফাঁক দিয়ে আলো-হাওয়া আসে। মেঝে থেকে ছাদ মেরেকেটে সাড়ে ছ’ফুট। একটা বাল্ব আছে। 

ডানদিকের দেওয়াল ঘেঁষে জানলার কাছে একটা খাটিয়া পাতা। আপাতত তাতেই নতুন তোষক-বালিশ-মশারি নিয়ে গোপাল। দুটো পুরনো চাদর তাকে দিয়েছে তার মাধবীমামী। গোপালের কাছে একমাত্র মুশকিল হল যে গোয়ালঘরে কোনো সিলিং ফ্যান নেই। প্লাগ পয়েন্টও নেই। প্লাস্টিকের টুলের ওপর রাখা চার্জেবল কচি ফ্যানই যা ভরসা। 

এই দুটো গোরুর দুধের আয়েই মূলত সংসার চলে অয়নের। পাড়ার মিষ্টির দোকানে চুক্তি আছে। সকাল সকাল সাইকেলে চেপে অয়ন দোকানে দুধ দিয়ে আসে। এর সাথে সামান্য ফ্ল্যাটবাড়ির দালালি। সেও কালেভদ্রে। এই লাইনে এখন পাড়ায় অন্য উঠতিদের ভীড়। পুরো স্বচ্ছল বলা চলে না। বাড়িতে টিভি, ফ্রিজ, রান্নার গ্যাস থাকলেও মাইক্রোওয়েভ কিংবা মিক্সি নেই। 

গোপাল ভাবে তার অয়নমামার মন আছে না হলে তাকে থাকতে দিত না। অবশ্য অয়ন সেই দলে পড়ে যারা বিশ্বাস করে যে গোপাল চুরি করতে পারে না। প্রতিদানে গোপালও রোজ গোয়াল পরিষ্কার করে আর লালি-দুলিকে খেতে দেয়। মাঝেমধ্যে গা ধুইয়েও দেয়। 

অয়ন খালি লালি-দুলির দুধ দোয় আর মাঝেমধ্যে তাদের চড়াতে নিয়ে যায় পেছনের জমিতে। অয়নের বেশ ভালই লাগে গোরু দুইতে আর চড়াতে। সেই কবের থেকে করে আসছে!

গাঁজা খাওয়ার সময় আর রাতে শোওয়ার সময় গোপাল গোয়ালঘরের দরজাটা ভেজিয়ে দেয়। না হলে খোলাই থাকে সারাদিন। 

চার

ঘুম থেকে যখন গোপাল উঠল তখন পাঁচটা বেজে গেছে। বিছানা ছেড়ে স্যান্ডো গেঞ্জিটা একটু তুলে লুঙ্গিটা টাইট করে বেঁধে দেওয়ালে দড়িতে ঝোলানো গামছাটা টেনে নিল। 

দড়িতে গামছা ছাড়াও দুটো জিন্স, দুটো টি-শার্ট, একটা স্যান্ডো গেঞ্জি, একটা লুঙ্গি আর গোটা দুয়েক জাঙ্গিয়া ঝুলছে। জেলে যাওয়ার সময় একটা জিন্স-টি-শার্ট-জাঙ্গিয়া পরা ছিল। বাকি সব নতুন কেনা।

কলতলায় এসে দেখল মাধবীমামী চা বসিয়েছে। তার দিকে তাকিয়ে হেসে জিজ্ঞেস করলঃ ঘুম হল?

‘হ্যাঁ, দিব্যি, বৃষ্টিটা হয়ে ঠান্ডা হয়েছে একটু’ বলে গোপাল মুখ-হাত ধুয়ে নিল। গামছায় মুখ মুছতে মুছতে হেঁশেলের সামনেটায় গিয়ে দাঁড়াল। মাধবীমামী হাত বাড়িয়ে চা দিল তাকে। 

মাধবীর বয়স চল্লিশ-বিয়াল্লিশ। ভরাট চেহারায় একটা বেশ বাঁধুনি আছে। লালিত্যের সাথে খানিক চটক। গোপাল মনে করে মোহিনী শক্তি আছে ‘মাধবীমামীর’।

সকালে-বিকেলে দুকাপ চা ছাড়া গোপাল এখানে আর কিছু খায় না। মামা-মামী বলেছিল যদিও বার দুয়েক কিন্তু সে রাজি হয়নি। তারা যে তাকে থাকতে দিয়েছে, সাইকেল ধার দিচ্ছে, এই অনেক।

চলবে… 

শেয়ার করতে:

You cannot copy content of this page