আবার এসো ফিরে

কতক্ষণ, জানা নেই ঈশ্বরচন্দ্র দালানে বসে জাগতিক শোভা দেখতে দেখতে কৃত  ক্রিয়ার ভাবনায় ডুবে গিয়েছিলেন। মিলনের পরে ক্লান্ত দীনময়ী ঘুমিয়ে পড়লেও ঈশ্বরচন্দ্রের চোখে ঘুম ছিল না। শয্যা ছেড়ে উঠে এসে বসেছিলেন নির্জন বারান্দায়। আনন্দলোকে বিরাজিত শরীর পূর্ণ তৃপ্ত মনউচ্চমার্গে বিচরণ করছিলেন। ভগবানে তাঁর বিশ্বাস নেই। তবু সেই পরম পুরুষের কাছে একান্ত প্রার্থনা, দীনময়ীর গর্ভে একটা সন্তান আসুক আর, তা যদি কিনা হয় এমন এক নৈসর্গিক মিলনে, তবে তাই হোক তাঁর পরম পাওয়া। সে পাওয়া না শুধু হবে তাঁদের একলার। তা তাঁর মায়ের মনের ক্ষোভ-আশা-আকাঙ্ক্ষা মেটাবে। স্ত্রীকেও তিনি সুখী করতে পারবেন।

তারপর… 

 

দীনময়ীর ঘুম ভেঙে গেল। হাত বাড়ালেন তিনি । স্বামীর স্পর্শ পেলেন না। ঘর মলিন অন্ধকারে ঢাকা।   শয্যা হাতড়ালেন। খালি শয্যা রেখে স্বামী উঠে গেছেন। কোথায়? কী করছেন তিনি? চিন্তা করে নিজেও পা বাড়াতে চাইলেন । তার আগে পরণের বস্ত্রের শিথলতা দূর করলেন । খাট ছেড়ে নিচে নামলেন। পায়ে পায়ে এগিয়ে গিয়ে দরজা খুললেন। দরজার আগল আগে থেকেই খোলা ছিল। একটু টান পড়তে তা খুলে গেল।  চৌকাঠ পেরিয়ে বাইরে এসে দাঁড়ালেন। কাছের মানুষটিকে দেখতে পেলেন । গভীর মনোযোগে চরাচরের শোভা দেখায় তিনি মগ্ন । ঈশ্বরচন্দ্র বুঝতেই পারেননি, পায়ে পায়ে দীনময়ী কখন তাঁর পাশে এসে দাঁড়িয়েছে। গায়ে আলতো স্পর্শ লাগতে চমক ভাঙল। প্রশ্ন করলেন, তুমি উঠে এলে যে?

-ঘুম ভেঙে আপনাকে পাশে না দেখে উঠে এলাম। আপনি শোবেন না?

-শুলে ঘুমিয়ে পড়ব। ঘুমলেই যে এই সুন্দর রাতটা কেটে যাবে।

কথা শেষে ঈশ্বরচন্দ্র হাসলেন। উৎফুল্ল মন তাঁর।

-তা বলে রাতে ঘুমবেন না?

মৃদু অভিযোগ দীনময়ীর।

-চিন্তা কোরো না। এরকম রাত জাগা আমার অভ্যেসের মধ্যে পড়ে। বরং তুমি গিয়ে শুয়ে পড়ো। তোমার শরীর ভালো হয়নি এখনও।

সতর্ক স্বামীর কথা সরিয়ে রেখে দীনময়ী বলে উঠলেন, আপনি এসেছেন। কাছে থাকছেন। আমার শরীর ভালো হয়ে গেছে। এখন এখানে একটু বসি?

-বসবে?

ঈশ্বরচন্দ্র নিজে উঠে ঘর থেকে আর একটা চেয়ার বের করে  আনলেন।

খালি চেয়ারে দীনময়ী বসলেন। অন্য চেয়ারটা তেরচা করে রেখে ঈশ্বরচন্দ্র বসলেন । প্রায় মুখোমুখি। এখন দীনময়ীর মুখটা তাঁর চোখের সামনে।

চুপ করে দুজনে বসে আছেন। কারোও মুখে কোনও কথা নেই। সময় নিজের মনে বয়ে চলেছে। চাঁদের আলো দীনময়ীর মুখে সরাসরি পড়েছে। ঈশ্বরচন্দ্র দেখছেন স্ত্রীর রূপ মাধুর্য। উপভোগ করছেন।

কত কথা মনে পড়ছে। তাতে বিয়ের রাতের কথা মনে এলো। সেদিনও এমন চাঁদের বাহার ছিল। পাঁচ বছরের মেয়েকে বিয়ে করছেন। নিজের বয়স তখন আনুমানিক চোদ্দো। দুজনেই নাবালক । প্রথম রাতে স্ত্রীর মুখ দেখবেন কি? বিয়ের অনুষ্ঠান চলার সময়েই দীনময়ী ঘুমিয়ে কাদা! অনুষ্ঠান শেষ হয়েছে অনেক রাতে। বেচারির আর দোষ কী? শেষে মায়ের কোলে বসিয়ে মেয়ের বিবাহ অনুষ্ঠান শেষ হল। মালা বদলের সময়, তখনও দীনময়ী জাগা। সেই যা একটু সময়ের জন্যে স্ত্রীমুখ দর্শন ঘটেছিল। তাও কাজল লেপা, ঘামতেল মাখা চপচপে মুখ। মাথায় ঘোমটা তোলা। কিন্তু তাতেও যেটুকু দেখেছিলেন, তাতে তাঁর মনে হয়েছিল, এ মেয়ে সুলক্ষণা। কেন জানেন না, বিয়ে হতে দিন কয়েক শ্বশুরবাড়ি এসে থাকার পর যেদিন দীনময়ী আবার বাপের বাড়ি ফিরে যাচ্ছে, সেদিন খুব মন খারাপ হয়ে গিয়েছিল। এমনকি কলিকাতায় ফিরেও মন ঠিক করতে সময় লেগেছিল অনেকদিন । মাঝে মাঝে  বালিকাবধূর মুখ মনে পড়ত। কিছু সময়ের জন্যে অন্যমনস্ক হয়ে পড়তেন।… আর আজ সেই বালিকাবধূ পূর্ণ যৌবনা হয়ে তাঁর সামনে বসা। তিনি দেখে চলেছেন পত্নীর রূপ, সদ্য পাওয়া যৌবনে দীনময়ীর নিটোল রূপ জ্যোৎস্না রাতের চাঁদের আলোর মতো ঝরে পড়ছে। চোখে কাজলের শোভা।  কোমর ছাপানো চুলেররাশিতে বিশাল এক কবরী।।   কোমল মুখ। অর্ধেক আচ্ছাদনে আবৃত। স্বামীর মনোরঞ্জনের জন্যে হয়ত আজ সে নিজেকে সাজিয়েছে।

নীরবতা ভাঙলেন ঈশ্বরচন্দ্র, -দীনময়ী  কেমন বোধ করছ।

-ভালই তো আছি। আপনি সামনে রয়েছেন, শরীর এমনিতেই সুস্থ হয়ে উঠেছে। কেন কিছু বলবেন?

দীনময়ীর কথায় প্রগলভতার প্রকাশ ঘটল।

-কী আর বলব? তবে জানো তো দীনময়ী, এখন গল্প করতে ইচ্ছে করছে ভীষণ।

ঈশ্বরচন্দ্র সামনে হাত বাড়ালেন।  স্ত্রীকে স্পর্শ করলেন। দীনময়ীও পিছিয়ে  রইলেন না। তিনিও হাত এগিয়ে এনে স্বামীর হাতের ওপর হাত রাখলেন। নাড়াচাড়া চলতে লাগল দুটি হাতে। দীনময়ীর হাতের শাঁখা নোয়া, বালা, চুড়ি ঝুনঝুন শব্দ তুলছে। আবেশে দুজনে দুজনের স্পর্শসোহাগ অনুভব করছেন। ঈশ্বরচন্দ্রের মন ধীরে ধীরে ফিরে যাচ্ছে পুরনো দিনে।  বললেন, আমাদের বিয়ের রাতের বাসর ঘরে যাবার আগে  কী কান্ড ঘটেছিল তোমার মনে আছে?

-আবছা মনে পড়ে। তখন কি  বোঝবার বয়স হয়েছিল নাকি আমার?

-শুনবে?

স্বামীর কথায় ঘাড় নেড়ে বললেন, বলুন। আমার শরীর এখন বেশ ঝরঝরে লাগছে। মনে তো হচ্ছে, গল্প করেই বাকি রাতটুকু কাটিয়ে দিতে পারব।-

তাহলে শোনো। ঘটনাটা হয়েছিল বিয়ের কাজ মেটবার পর। বিয়ের ওইটুকু সময়ে তোমাকে আর কতখানি দেখেছি? মুখটাও ঠিক মতো চিনে রাখতে পারিনি। তাও কিনা, তুমি ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে মন্ত্র পড়ছিলে তোমার মায়ের কোলে বসে।  সময় এলো বাসরঘরে যাবার। পাশে দেখি তুমি নেই। নতুন বরের সঙ্গে তামাশা করবার জন্যে তোমাদের বাড়ির কিছু মেয়েরা তোমাকে কোথাও লুকিয়ে রেখেছিল।  বাসর ঘরে পা দিতে তারা বলল, আপনার কনেকে খুঁজে বার করে  নিতে হবে। ভারি মুশকিলের কথা! এক তো, ওই বাড়ির বাকি ঘরের কোনও হদিস ছিল না আমার কাছে। তায় আমার প্রথম আগমন সেখানে। এছাড়াও একদঙ্গল মেয়ে ঘুরছে সারা বাড়িময়। বুঝলাম, ওদের মধ্যে থেকে নিজের অর্ধাঙ্গিনীকে খুঁজে বের করা আমার কম্ম নয়। ভেবেচিন্তে শেষে আমারই বয়েসের বেশ একটি টুকটুকে ফরসা মেয়েকে ধরে বললাম, এই আমার কনে।… ও বাবা, যেমনি ধরা, অমনি এক মহা গণ্ডগোল পড়ে গেল। কে কার ঘাড়ে পড়ে, কে কোথায় পালাবে, তার পথ পায় না। আর আমি তার হাত  ধরে বলছি, তুমিই আমার কনে, তোমাকে হলেই আমার চলবে। আমি আর অন্য কোনও কনে চাই না।  সে মেয়ে তো, বাপরে, মারে গেলাম , বলে চিৎকার জুড়ে দিল। শেষে তোমাদের পরিবারের গিন্নি গোছের দু একজন কাছে এসে বললেন, এ তোমার কনে নয়। ওকে ছেড়ে দাও। বাড়িময় হাসির রোল উঠল। আমিও তখন বেশ মজা পেয়ে গেছি। আমি বললাম, ছাড়ব কেন? খুঁজে নিতে বলেছে, আমি খুঁজে এইটিকেই বার করেছি। এইটি হলেই আমার বেশ মনের মতো হবে। তারপর সে মেয়ে হাতে পায়ে ধরে বলল, আচ্ছা, আমাকে ছেড়ে দাও, আমি তোমার কনে বার করে  দিচ্ছি। নিজেরাই তোমায় এনে হাজির করল । হাসি মজার ছলে আমিও এইভাবে ওই নাছোড়বান্দা মেয়েদের থেকে মুক্তি পেয়ে গেলুম।

হেসে উঠলেন দীনময়ী। বললেন, পারেনও বটে আপনি। পরে প্রশ্ন রাখলেন, প্রথমদিন এসে আপনি যে বলছিলেন, মায়ের সঙ্গে কী বিষয় নিয়ে আলোচনা করবেন, তা কি সারা হয়েছে ?

-হয়নি, দীনময়ী। দুদিন মায়ের কাছে গিয়ে আমাকে ফিরে আসতে হয়েছে। মা চান, আগে তুমি সুস্থ হয়ে ওঠো, তারপর কাজের কথা। আমার কি মনে হয় জানো, মা তো অন্তর্যামী। আমার মনের কথা মা পড়ে বসে আছেন। তাই হয়তো প্রসঙ্গটা উত্থাপনই করতে দিচ্ছেন না।

-ঠিক বলেছেন আপনি। উনি সবার মনের কথা আগে থাকতেই পড়তে পারেন। আমার  অসুখ হওয়ার আগেই উনি আমায় সাবধান হতে বলেছিলেন; কিন্তু আমি অতটা বুঝিনি। এই যে আপনি হঠাৎ করে  এসে পড়লেন, তাও বুঝি উনি জানতেন। বলেওছিলেন।

-তাই নাকি! বিস্ময় প্রকাশ করলেন ঈশ্বরচন্দ্র। প্রশ্ন করলেন, মা কী বলেছিল?

-আপনার নাম নিয়ে উনি বলেছিলেন, ওদেশে আপনার দিনগুলো বোধ হয় ঠিক যাচ্ছে না। একবার এখানে আসলে ভালো হয়।

দেখো দেখি! মা ঠিক বুঝেছিলেন। সত্যিই দীনময়ী আমার দিনগুলো ওখানে খুব একটা সুখে কাটছিল না। সাধে কি ওনাকে আমি সাক্ষাৎ ভগবতী মানি? যেমন আমার মা, তেমনি মাসীও। দুজনাই ছোট থেকে মামা বাড়িতে মানুষ। দাদু, মামার সাহচর্যে। এ কথাটা তুমি নিশ্চয়ই জানতে না?

-আপনি কি কোনোদিন শুনিয়েছেন আপানাদের পরিবারের কথা?

দীনময়ীর অভিযোগ। ঈশ্বরচন্দ্র তা স্বীকার করে নিলেন। বললেন, তা অবশ্য হয়নি। আসলে এগুলো শোনা, বা  শোনানো, সবটাই সুযোগের অপেক্ষায় থাকে । আজ মনে হচ্ছে, তোমার সঙ্গে অনেক কথা কই। নানান প্রসঙ্গ মনে আসছে। মনটাও ঝরঝরে। তাই শোনাতে ইচ্ছে করছে।

-এমন দিন তো আগেও এসেছে। কৈ, এত কথা তো বলেননি? আসলে আপনাকে এতদিন কাজে কাজেই ব্যস্ত থাকতে দেখেছি। গ্রামে আসলেও আপনি গ্রামের ভালোমন্দ, গ্রামের ছেলেদের  শিক্ষার ব্যাপারে ব্যস্ত থেকেছেন। আমার দিকে নজর দেবার সময় কি আপনার ছিল?

-অভিযোগ করছ? ঈশ্বরচন্দ্র মুখ ভার করলেন।

দীনময়ী তা দেখলেন। তাঁর মনে প্রশ্ন জাগল, তবে কি উনি রাগ করলেন? তাড়াতাড়ি বলে উঠলেন, অভিযোগ নয় গো…

হালের দিক পরিবর্তনের মতো কথার স্রোত দীনময়ী অন্যখাতে বইয়ে দিলেন। বলতে থাকলেন, আপনি কত পড়াশোনা করা মানুষ। আমি অজ্ঞ । আমার পেটে সেরকম বিদ্যে তো নেই। ছোট বয়সে বিয়ে । বড় হয়ে এ বাসায় এলাম। সংসার হল। জীবনকে বুঝতে শিখলাম। আপনার সঙ্গ পেলাম। এরপর মা হবার আকাঙ্খা এল। কিন্তু কোথায় তা হতে পারলাম? বছরের পর বছর কেটে যাচ্ছে। অথচ, তাও মা হতে পারছি না। বয়স বাড়ছে। নানান কথা হয় আমাকে নিয়ে। সামনে। আড়ালে। সবকিছু শুনতে হচ্ছে আমাকেই। আমি নাকি, সন্তান ধারণে অক্ষম। আপনি তো আর কাছে থাকেন না। আপনাকে নিয়েও পাড়াপড়শিদের মধ্যে নানান অমূলক আলোচনা হয়। আমাকেই তা শুনতে হয়। উত্তর দিতে পারি না…

একটানা কথা বলে দীনময়ী হাঁপাতে থাকেন। ঈশ্বরচন্দ্র চুপ করে  শুনে যান । শুধু কথা তো নয়।  অভিযোগ। এবার তা সরাসরি। যদিবা এবারের আঁচ অনেকটাই ঢিমা, তবু কিনা, এই মুহূর্তে তা সম্পূর্ণ এড়িয়ে যাওয়া তাঁর পক্ষে যে সমীচীন হবে না, তা বিলক্ষণ বুঝতে পারলেন। সান্ত্বনার ঝাঁপি খুলতে হবেই। তবে তার আগে শুনে নিতে চান, পাড়াপড়শিরা তার নামে কোন অমূলক কথা বলে। প্রশ্ন করলেন দীনময়ীকে, আমাকে নিয়ে আবার কী কথা হয়?

-থাক আপনার সেসব না শোনাই ভালো।

ঝোলা গুড়ের কলসির মতো মুখ ঝুলিয়ে উত্তর দিলেন দীনময়ী।

ঈশ্বরচন্দ্র চেপে ধরলেন স্ত্রীকে। বললেন, তোমাকে তা শুনতে হচ্ছে, অথচ আমায় তা জানাতে পারছ না! এমন কী গূঢ় কথা?

দীনময়ী উত্তরের পরিবর্তে নিজের কথার পুনরুক্তি করলেন।  ঈশ্বরচন্দ্র চেপে ধরলেন। বললেন, আমি তা শুনতে চাই।

আমতা আমতা করতে থাকেন তিনি। মুখ ঘুরিয়ে নিলেন স্বামীর দিক থেকে। ঈশ্বরচন্দ্র বুঝলেন,  কথার ধার এমনই যে দীনময়ীর পক্ষে তা বলা সম্ভব হচ্ছে না। জানতে চাইলেন, কে বলেছে, সেকথা বলবে তো?

দিনময়ী যেন যাঁতাকল থেকে মুক্তি পেলেন। ভাবলেন, নামটা বলেই বিষয়টার সমাপ্তি ঘটাবেন। বক্তার নাম উচ্চারণ করলেন, অন্নপূর্ণা , আমার সই।

-ও সেই বেচালের মহিলা, গা থেকে যার বাসরের গন্ধ না কাটতে সন্তানের জন্ম দিয়েছিল?

কথায় তাচ্ছিল্যের ভাব। দীনময়ী ভাবলেন, বিষয়টার বোধ হয়, ইতি হল। মুখে উত্তর না দিয়ে শুধু ঘাড় নাড়লেন। কিন্তু তা কৈ? ঈশ্বরচন্দ্র প্রশ্ন করে বসলেন, কী বলেছে কী? আমায় বলো। আমি দেখছিখন ওকে।

তাঁরও জেদ চেপে গেছে। তাই ওভাবে কথা বললেন। নচেৎ তিনি স্পষ্ট বক্তার মানুষ হলেও মহিলাদের সম্বন্ধে উক্তি করবার আগে যথেষ্ট সর্তক থাকেন। এটা তার চারিত্রিক গুণ। মহিলাদের কোনও ভাবে অপমান হোক, তা তিনি বরদাস্ত করতে পারেন না। তবে, এখন স্ত্রীর মুখের কথায় এমন কিছুর আভাষ তিনি পাচ্ছেন, যা তাঁকে মুখ খুলতে বাধ্য করল।

স্বামীর উষ্মার আঁচ পেয়ে দীনময়ী তাড়াতাড়ি বলে উঠলেন, না, না, আপনাকে দেখতেও হবে না। কথাও শুনতে হবে না আমার।

-তুমি না আমার স্ত্রী?… আচ্ছা ঠিক আছে। আমি না হয় তাঁকে কিছু বলব না। তুমি কথাটা আমাকে জানাও। তা না হলে তোমার মনকষ্টের জন্যে আমি নিজেকে দোষী ঠাওড়াব। বলো, দীনময়ী…

ঈশ্বরচন্দ্র এবার অনুরোধের পথ ধরলেন।

মুখ নিচু করে দীনময়ী বললেন, আপনি নাকি কলিকাতার বাবুদের মতো মদ খান।

হা, হা, করে ঈশ্বরচন্দ্র হেসে উঠলেন। বললেন, এ বিষয়ে আমি তোমার সইকে দোষ দিই না, দীনময়ী। কলিকাতা শহরের বাবু সংস্কৃতিতে সকলেই বোধ হয় মদ খায়, শুধু আমাকে বাদ দিয়ে। তাহলে এক বাবুর কথা শুনবে?

দীনময়ীর উত্তর, কলিকাতা তো যাইনি। আপানর কাছেই না হয় শুনি কী সে কথা।

-হা হা…। ভদ্রলোক আমার বন্ধুও বটে। নামটা আমারই নামে।  তবে পদবীটা ভিন্ন। আমি ঈশ্বরচন্দ্র শর্মা। উনি ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত। গুপ্ত মশাই কবি মানুষ। কলিকাতায় নামডাক রয়েছে। পত্রিকা সম্পাদক। জ্ঞানীগুণী ব্যাক্তি। তিনি মদ্য পান করেন আবার তাই নিয়ে কবিতাও রচনা করেন। বলে, ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত মশায়ের লেখা একটা কবিতা আউড়ে দিলেন,

‘ছাড়িয়া ঘরের কড়ি ঢেলে দাও গলে।

দেখো দেখো লোকে যেন মাতাল না বলে।।

তবে তুমি পাত্র লও পাত্র যদি হও।

ছুঁয়ো না বিষের পাত্র পাত্র যদি নও।।’

-কী বেহায়া লোক গো উনি! মুখ বেঁকালেন দীনময়ী।

সায় দিলেন ঈশ্বরচন্দ্র।  বললেন, দীনময়ী, এরকম বেহায়া লোকে শহর ভরে রয়েছে। সেখানে এই ঈশ্বরচন্দ্র শর্মা গা বাঁচিয়ে রয়েছে। বুঝতেই পারছ। আরও শুনবে? শোনো,  বাপ-ছেলে মিলে এক টেবিলে বসে মদ্য পান করে । মাইকেল । আমার থেকে চার বছরের ছোট।   সেই মাইকেলের বন্ধু রাজনারায়ণ  মাইকেলের পাল্লায় পড়ে একদিন গলায় মদ ঢেলে বাড়িতে এসে উঠল। ধরা পড়ে গেল, নন্দকিশোর মশায়ের কাছে। রাজনারায়ণের বাবা। ছেলেকে তিনি জিজ্ঞেস করলেন, রাজনারায়ণ, তুমি কি মদ খাও? ছেলে উত্তর করল, হ্যাঁ বাবা, খাই। নন্দকিশোর মশায় তখন ছেলেকে নিয়ে আলমারির সামনে গেলেন। আলমারি খুললেন। গ্লাস বার করলেন। একটা গ্লাস দিলেন ছেলের হাতে। অন্যটা নিজে নিলেন। মদের বোতল বার করলেন। ছিপি খুললেন বোতলের। পরিমাণ মতো দুজনের গ্লাসে মদ ঢাললেন। বাপ ছেলে একসঙ্গে মদ্য পান করে ছেলেকে উপদেশ দিলেন, এবার থেকে যখনই মদ খাবে, বাড়িতে খাবে। আমার সঙ্গে খাবে।…তাহলেই বুঝছ,  এই হচ্ছে শহর কলিকাতা, দীনময়ী…

পড়ুন- আবার এসো ফিরে

আবার এসো ফিরে

আবার এসো ফিরে

-ভারি আমোদের কথা! ওই শহরে আবার ভদ্দরলোকেরা থাকে! মাগো, ছ্যাঃ।

দিনময়ীর মুখে বিকৃতি ঘটল। ঈশ্বরচন্দ্রও কম যান না কিছু। সঙ্গে সঙ্গে উত্তর করলেন, ছ্যা বললে হবে। ওখানে লোককে ইংরেজ সাহেবদের সঙ্গে ওঠাবসা করতে হয়। ওদের দেখে দেখে বাবুরাও ওই অভ্যেস করেছে,…

-আর কোনও অভ্যেস করেনি আপনার বাবুরা?

এটা দীনময়ীর মনের কৌতূহল। অন্নপূর্ণা তার কানে আরও কিছু বিষ ঢেলেছে কি না?

-মানে? ঈশ্বরচন্দ্র কথাটা ধরতে পারলেন না, তাই প্রশ্ন করলেন।

-অন্নপূর্ণা তো এ কথাও আমাকে জিজ্ঞেস করেছে, হ্যাঁ রে, তোর বর তো তোর থেকে বয়সে অনেক বড়। তোদের মধ্যে ভাবভালবাসা ঠিক মতো হয়?

দিনময়ী কথার তোড়ে বলেই ফেললেন সইয়ের বলা কথাটা।

-তুমি কি উত্তর করেছ?

-আমি লজ্জায় কিছুই বলতে পারিনি। চুপ করে  ছিলাম। তখন ও যা বলল, তা শুনে আমার তো প্রাণবায়ু বেরিয়ে যাবার উপক্রম।

-সেটা আবার কী কথা?

-সই বলছিল, শহরে অনেক ভাড়া করা মেয়েমানুষও পাওয়া যায়। তা তোর পতি তো আবার…, না বাবা, আমি আর কিছু বলতে পারব না…

দীনময়ী মুখে কুলুপ আঁটলেন।

ঈশ্বরচন্দ্র গম্ভীর হয়ে গেলেন। চুপ করে  থাকলেন। দীনময়ী বলে উঠলেন, আপনি আমার কথায় কষ্ট পেলেন? আমি আর বলব না।

মুখ খুললেন ঈশ্বরচন্দ্র। বললেন, কষ্ট আমি পেলাম না। কষ্ট তো তোমাকে দিয়ে গেছে তোমার সই। আমার ওপর তোমার বিশ্বাস রয়েছে তো?

ঈশ্বরচন্দ্র উঠে ঘরে চলে গেলেন। অল্প কথার মানুষ তিনি । দুঃখ পেয়েছেন মনে। তবে তার প্রকাশ ঘটাতে চান না। আসল যে কথা বলে তিনি দীনময়ীকে আশ্বস্ত করবেন ভেবেছিলেন, তা আর বলা হল না। মনে মনে তিনিও চান, দীনময়ীর গর্ভে এখন একটা সন্তান আসুক। তবে এও স্থির করলেন, পরে একসময় দীনময়ীর মনের ভুল ভাঙবেন। চেয়ার  ছেড়ে ওঠার আগে বলে গেলেন, অন্নপূর্ণা নামের সই থেকে তুমি দূরে থেকো, দিনময়ী।

ছবি – গুগল 

শেয়ার করতে:

You cannot copy content of this page