আবার এসো ফিরে

    রামেশ্বর দত্ত

কলেজ তো আর শুধু ছাত্র বেতনের ওপর চলে না? কোম্পানির অনুদান নিতেই হয়। এখন অবশ্য এই অনুদানের পরিমাণে অনেকটাই ধরাকাট হয়ে গেছে। কারণ ইতিমধ্যে  বড়লাট লর্ড হার্ডিঞ্জ ঈশ্বরচন্দ্রের দেওয়া প্রস্তাব মতো বাংলায় একশ’টা  ইশকুল প্রতিষ্ঠা করিয়েছেন। শিক্ষার মাধ্যম বাংলা ভাষা। সেখানে শিক্ষক নিযুক্ত হয়েছেন সংস্কৃত কলেজ থেকে সদ্য পাস করা ছাত্ররা তারা  সেখানে মাষ্টারী করছেইশকুল সবই অবৈতনিক। আবার শিক্ষকদের বেতন না দিয়ে তো পড়াতে বলা যায় না? তাই এত জনের বেতন সবটাই কোম্পানির ঘর থেকে আসেযে কারণে কলেজের অনুদানে বেশ টান পড়েছে।

ঈশ্বরচন্দ্রের প্রস্তাব মতো এই সব ইশকুল স্থাপনা হয়েছে। তাতে ঈশ্বরচন্দ্রেরই কাজের বহর কয়েকগুণ বেড়ে গেছে। তিনি না হয়, গায়ে গতরে খেটে পুষিয়ে দিচ্ছেন। কিন্তু সঙ্গে উড়ো খাগড়ার মতো এসে জড়ো হয়েছে মানুষের ঈর্ষা । কী? না, বয়সে নবীন হয়েও ঈশ্বরচন্দ্র বড়লাটের কাছে এতখানি গুরুত্ব পাচ্ছেন! আর তাঁরা প্রবীণ, অভিজ্ঞ কলেজ শিক্ষক হয়ে পিছনে পড়ে থাকছেন! রাগ, ঈর্ষা  মধ্যমেধা বাঙালির সহজাত প্রবৃত্তি।  ঈশ্বরচন্দ্র তা বোঝেন। তিনি তা পরোয়া করেন না। মাথা উঁচু রেখে অন্যের দ্বেষ, হিংসাকে গায়ে না মেখে অক্লান্ত পরিশ্রম করে  নিজের কাজ করে যাচ্ছেন তিনি।

ঘরে বসে ঘাড় গুঁজে কাজ করছিলেন । কেউ একজন প্রবেশ করল। সেদিকে তাঁর নজর নেই। হঠাৎ পিঠে জোর এক বিরাশি সিক্কা। সঙ্গে কথা, তুমি যে ভাই কেল্লা ফতে করে  দিয়েছ?

উঃ, শব্দ করে ঈশ্বরচন্দ্র মুখ তুললেন। পিছন দিকে তাকালেন। মদনমোহনকে দেখলেন। বর্তমানে দুজনে একই কলেজে কাজ করছেন। কাজের ফাঁকে মাঝে মধ্যে দুজনের মোলাকাত হয়। তবে এখন এই সময়ে এই সোচ্চার মোলাকাতে ঈশ্বরচন্দ্র সামান্য বিস্মিত হলেন। প্রশ্ন করলেন, কী হল!

মদনমোহনের চপেটাঘাতটা তাঁকে যেমন বিস্মিত করেছে তেমনই তা আঘাত হেনেছে পৃষ্ঠদেশের উপরিভাগে। বন্ধুর উপর বিরক্তি প্রকাশ করতে গিয়েও নিজেকে সামলে নিয়ে ফের প্রশ্ন করলেন, -কী আবার কেল্লা মারলাম, ভাই মদন? কী সংবাদ নিয়ে এসেছ?

কলেজে ঈশ্বরচন্দ্র নিজের সম্বন্ধে বিশেষ খোঁজ খবর রাখেন না; যা কিনা মদনমোহন করেন। তা শুধু নিজের জন্যে নয়; অপরের বিষয়েও তাঁর যথেষ্ট আগ্রহ রয়েছে । বন্ধুর কাজে উন্নতি সম্বন্ধে  বিশেষ সংবাদটা সদ্য তিনি পেয়েছেন। তা আর চাপা রাখতে পারেননি। সোজা চলে এসেছেন।

-সংবাদটি শুনলে তুমি এখনই লাফিয়ে উঠবে, ঈশ্বরচন্দ্র।  শরীর দুলিয়ে কথাটা বললেন মদনমোহন।

-মদন, আমি লেঙ্গুরবিহীন বাঁদর বা শিং যুক্ত বাছুর, কোনটাই নয়। বলো, কী সংবাদ এনেছ। ঈশ্বরচন্দ্র তাঁর স্বভাবসিদ্ধ ভঙ্গিতে কথায় কৌতুক যোগ করলেন।

-আরে ভায়া, সংস্কৃত কলেজে ব্যাকারণের ১ম ও ২য় শ্রেণীর অধ্যাপকের পদ খালি হয়েছে। গুঞ্জন চলছে, ওই পদে বহালি করে  তোমাকে ওখানে নিয়ে যাবে!

-কোন ঘোড়ার মুখের সংবাদ এটি?

-খোদ শিক্ষা সমিতির অধ্যক্ষ ডাক্তার ময়েট সাহেবের। তিনি আমাদের কলেজ অধ্যক্ষকে অনুরোধ করেছেন, ওই পদের শিক্ষক ঠিক করে  দিতে। তাতেই তোমার নাম উঠে এসেছে মার্শাল সাহেবর মুখে।

কথাটা উগরে তিনি ঈশ্বরচন্দ্রের মুখের দিকে তাকিয়ে রইলেন। বন্ধুর প্রতিক্রিয়া দেখতে চাইছেন। কিন্তু ঈশ্বরচন্দ্র নির্বিকার। বরং উল্টে মদনমোহনের কথার গুরুত্ব নাশ করে দিয়ে বলে উঠলেন,   আমার নাম! কত খবর রাখো হে ভাই তুমি? কৈ আমি তো জানি না?

-তুমি আর নিজের বিষয়ে কতটুকু খোঁজ রাখো?

-তা ঠিক বলেছ।  তবে ভাই, এতে এত খুশি হওয়ার কী হল? তাছাড়া তুমি যেভাবে আমাকে লালাকেল্লাতে তুলতে এসে  সিক্কাটা পিঠে বসিয়েছ, তাতে পৃষ্ঠদেশের উপরিভাগ এখনও আগুনের তাপ দিচ্ছে। আচ্ছা…, বসো, বসো। জল খাবে?

-তা হলে ভালোই হয়।

ঈশ্বরচন্দ্র উঠে ঘরের কুঁজো থেকে গ্লাসে জল ঢেলে এনে মদনমোহনকে দিলেন। -আজ কিন্তু বাইরে বেশ গরম। জল পানের মাঝে মদনমোহন কথাটা বললেন। গ্লাস খালি হতে এবার নিজে উঠে গেলেন তিনি। কুঁজো থেকে ফের কিছুটা জল গ্লাসে ঢেলে নিয়ে হাত দিয়ে গ্লাসটা ভালোমতো ধুয়ে যথাস্থানে রেখে দিয়ে এসে বসলেন। শুরু হল আসল কথা। ঈশ্বরচন্দ্র বললেন, সুসংবাদই এনেছ বটে ভাই। তবে, ওখানে আমার চাকরী করতে যাবার ইচ্ছে নেই।

-সেকি!

মদনমোহন অবাক। বললেন, বেতন জানো?…মাসে নব্বুই টাকা!

-ঈশ্বরচন্দ্র তাতে খুব কিছু উৎসাহ দেখালেন না। কাজে মন লাগাবার ভাণ করলেন। মদনমোহন বলতে শুরু করলেন, দেখবে, মার্শাল সাহেবই তোমাকে অনুরোধ জানাবেন। তখন না, বলতে পারবে? ময়েট সাহেব মার্শাল সাহেবকে এই দায়িত্ব দিয়েছিলেন । মার্শাল সাহেব আবার তোমা ভিন্ন অন্য কাউকে পছন্দ করবেন বলে মনে হয় না। উনি তোমার গুণগ্রাহী ব্যক্তি। দেখো, খবর এলো বলে…

-আচ্ছা, যখন আসবে, দেখা যাবেখন।

বন্ধুর উৎসাহে জল ঢেলে দিলেন। স্থির হয়ে বসে থাকলেন কিছুটা সময়। বুঝলেন, সেদিনের মতো হাতের কাজ শেষ হতে চলেছে। প্রশ্ন করলেন, আমি বেরচ্ছি। তুমি কি এখন বেরবে?

-চলো। আজকের মতো পাত্তাড়ি গোঁটাই। যাবার পথে একবার কলেজ স্ট্রীট হয়ে ফিরব। ছাপাখানায় যেতে হবে।

-আজ আর আমি ছাপাখানায় যাচ্ছি না। বাসায় কিছু কাজ রয়েছে, বলে, ঈশ্বরচন্দ্র খাতাপত্র তুলে গুছিয়ে রেখে কলেজের বাইরে বেরলেন। মদনমোহন তাঁর সঙ্গে যোগ দিলেন। দারোয়ানকে বললেন, অফিসঘর  বন্ধ করে  কলেজ গেটে তালা দিয়ে দিও, রামসেবক।

বাইরে ফুটপাথে এসে দাঁড়ালেন। দিনের আলো কমে এসেছিল। সন্ধে গড়াবে আর একটু পরে। রাস্তার বাতি জ্বলে ওঠার সময় এটা। পথ আলো করবার জন্যে কুপিবাতির চলন। বাতিগুলো আকারে চৌকো বাক্সর মতো । তার চারদিকে কাচের ঢাকনা। ভিতরে কাপড়ের সলতে। নিচে তেল দান। রেড়ির তেল ভরা থাকে। বাতি ছোট ছোট স্তম্ভের ওপর লাগানো। সেখানে সিঁড়ি বেয়ে উঠতে হয়। সন্ধের মুখে শহরের রাস্তায় বাতি জ্বালানোর কাজটার জন্যে নির্দিষ্ট কিছু লোক রয়েছে। তারা সরকারী লোক, বাতিওয়ালা নাম তাদের। এরকম এক বাতিওয়ালাকে পাশ কাটিয়ে পথ চলতে শুরু করলেন দুজনে।

চলেছেন উত্তর দিকে । পথের একধারে প্রেসিডেন্সি কলেজের দেওয়াল। দেওয়ালের গায়ে ছোট ছোট চালা। বইয়ের দোকান। পুরনো, নতুন, নানান বই বিক্রি হচ্ছে। একটা দোকানে ঈশ্বরচন্দ্রের লেখা বই। মদনমোহনের লেখা বই রাখে অন্য একটা দোকান। দোকানীদের সঙ্গে লেখকদের যথেষ্ট পরিচয় রয়েছে। দোকানের সামনের পথ পেরবার সময় দোকানী, সুকুমার সোম ঈশ্বরচন্দ্রকে দেখে নমস্কার জানাল। সন্ধ্যেবাতি দিচ্ছিল সে। তা বন্ধ রেখেই হাত জোড় করল। আহ্বান জানাল দু দণ্ড অপেক্ষা করবার। ঈশ্বরচন্দ্র দাঁড়িয়ে পড়লেন। মদনমোহন দু পা এগিয়ে গিয়ে তাঁর লিখিত বই বিক্রেতার দোকানের সামনে গেলেন। উদ্দেশ্য; কেমন বিক্রি হচ্ছে তাঁর রচিত বইগুলো, তা জানার।

-বিদ্যাসাগরমশাই, আপনার দুটো বইয়ের স্টক কম হয়ে এসেছে। নতুন স্টক আনাতে হবে।  সুকুমার সোম জানাল।

-কোন কোন বইয়ের? ঈশ্বরচন্দ্র জানতে চাইলেন।

-কথামালা, বর্ণপরিচয়। সঙ্গে বেতাল বইটাও দু’শ দু’শ করে পাঠালে ভালো হয়।

-ঠিক আছে, এক দু দিনের মধ্যে পাঠিয়ে দোবো।… গতমাসের বই বিক্রির টাকাটা কবে দিচ্ছেন, সুকুমারবাবু?

-এই তো মাস পড়ল,স্যার। দুদিন পরে দিচ্ছি। আপনাকে আসতে হবে না। আমি নিজে আপনার ছাপাখানায় গিয়ে দিয়ে আসব।

-হ্যাঁ, হ্যাঁ। দেরী করবেন না। বুঝতেই পারছেন…

  কথার মাঝে ঈশ্বরচন্দ্র পা বাড়ালেন। এগিয়ে মদনমোহনকে ধরলেন। তাঁর কাজও শেষ হয়েছিল। নিত্যকার কাজ এটা। যাওয়া আসার পথে এমন দেখা , কথাবার্তা প্রায় দিনই হয় লেখক-প্রকাশক আর পুস্তক বিক্রেতার মধ্যে।

হাঁটা শুরু করলেন। এখনও অনেকটা পথ দুজনে একসঙ্গে যেতে পারবেন। তারপর ঈশ্বরচন্দ্র বাঁ দিকে বাঁক নেবেন। মদনমোহন যাবেন সোজা পথে।

এক বাতিওয়ালাকে চোখে পড়ল। ঘাড়ে মই। হাতে জ্বালানি ভরা ঝোলানো পাত্র। একটা বাতিস্তম্ভের সামনে গিয়ে সিঁড়িটা রাখল। স্তম্ভের গায়ে। চটপট তাতে উঠে পড়ল। বাতিদানের একদিকের কাচের দরজার ছিটকিনি খুলল। চিমনির ভিতরে হাত ঢুকিয়ে দিল। হাতে ধরা কাপড়ের টুকরো দিয়ে চতুর্দিকের কাচের দেওয়াল পরিষ্কার করল। বাতির কোটরে কিছুটা তেল ঢালল। লম্বা বড় মাপের কাঠি যুক্ত বিদেশি দেশলাই বাক্স থেকে কাঠি বার করে বাক্সের গায়ে ঘষে আগুন জ্বালল। জ্বলন্ত কাঠি সলতের মুখে ধরল। ফস করে  বাতি জ্বলে উঠল। কুঠুরির কাচের দরজা বন্ধ করে ছিটকিনি লাগিয়ে নীচে নেমে এলো। মই ঘাড়ে ফেলে আবার চলল পরের বাতির দিকে। বাতিস্তম্ভগুলো অনেকটা দূরে দূরে।

  ঈশ্বরচন্দ্র বাতিওয়ালার কাজ কারবার দেখতে দাঁড়িয়ে পড়েছিলেন। তার কাজ শেষ হতে মদনমোহনকে বললেন, দেখলে তো ভাই, এই করে লোকটা শহরে রাতের পথকে কেমন উজ্জ্বল করে রাখে। কী মনোযোগ আর ক্ষিপ্রতার সঙ্গে কাজ সারছে। কত বাতি …!

-যার যা কাজ। মদনমোহন হাসলেন। জিজ্ঞেস করলেন, মুড়ি খাবে?

-চলতে পারে। সঙ্গে ছোলা ভাজা মিশিয়ে নিও।

রাস্তার ধারেই মুড়িওয়ালার দোকান। মদনমোহন এক পয়সার মুড়ি, ছোলা সেদ্ধ কিনলেন। দুটো ঠোঙায় ভাগ করে ছোলামুড়ি চিবোতে চিবতে আবার হাঁটা শুরু করলেন।  অনেকটা পথ পার করে এসে দুজনে দুদিকে চলে গেলেন।

ঈশ্বরচন্দ্র বাসায় ফিরে লেখা নিয়ে বসলেন। কিছুটা লিখলেন। ভাইরা যে যার কাজে ব্যস্ত। তিনি লিখে চলেছেন। কিন্তু বারবার আজকের দিনটাকে স্মরণ করছেন। থেকে থেকে উদাস হয়ে যাচ্ছেন। পাঁচ বছর হতে চলল, অথচ এই দিনটাকে কিছুতেই ভুলতে পারেন না। সেদিনটার দৃশ্য চোখের সামনে ভেসে ওঠে।- ভাইয়ের কাতর উক্তি, আমাকে মায়ের কাছে নিয়ে চলো, দাদা। আমি আর বাঁচব না। ভীষণ যন্ত্রণা হচ্ছে। আমার সারা শরীর অবশ হয়ে যাচ্ছে। হাতপা নাড়াতে পারছি না,। কিসে টেনে ধরছে। মাকে ডাকো।

তিনি বলছেন, মা আসছে। দিনু দাদা আনতে গেছে মাকে। কালকেই এসে পড়বে।

-ডাক্তারবাবু কি আমাকে সারিয়ে তুলবে না?

-তুই সেরে উঠবি। নিশ্চয়ই সেরে যাবি।

ছোট ভাইকে স্তোক বাক্য শোনাচ্ছেন। তিনি বুঝতে পারছেন কী হতে যাচ্ছে। অথচ নিরুপায়। হরচন্দ্র তাকে ডাকছে,  -ও দাদা, দাদা। আমার এতবার বাহ্যি বমি হচ্ছে কেন? এ কী অসুখ, দাদা? আমাকে ওষুধ দাও না…

অসহায়ের মতো ঈশ্বরচন্দ্র সব দেখছেন। অথচ মুখে সান্ত্বনা দেওয়া ছাড়া আর কিছুই করতে পারছেন না। দুরারোগ্য অসুখ, ওলাওঠা। মারণ রোগের কোনও ওষুধ আবিষ্কার হয়নি। রোগীর মৃত্যু অবধারিত। ডাক্তারবাবুও অসহায়ের মতো সেকথাই জানিয়ে গেছেন। তবু  সেকথা কি আর রোগীকে বলা যাবে? মিথ্যে আশ্বাস বাক্য শোনাতে হচ্ছে তাকে। ওলাওঠা সারা দেশে ছেয়ে গেছে। কলিকাতা শহরও তা থেকে বাদ যায়নি। কত মানুষ মারা যাচ্ছে, তার হিসেব নেই। ধনী গরীব, উচ্চবিত্ত মধ্যবিত্ত, কাউকে ছাড় দিচ্ছে না।  কে জানে, হরচন্দ্রকেও এ থেকে বাঁচানো যাবে কি না?

তিনি কাঁদছেন আর ভাবছেন, মাত্র ক’বছর আগে একই রোগে তাঁর ছোট দু ভাই পরপর মারা গেছে। আদরের ভাইরা চলে গেল। কে জানে, বীরসিংহে থাকলে হয়তো এ থেকে ওরা রক্ষা পেত।

 ঠিক এ কথাটাই ধ্বনিত হয়েছিল সেদিন ভগবতীদেবীর মুখে। বীরসিংহে পৌছিয়ে দীননাথ সংবাদটা দেওয়া মাত্র মা  এক বস্ত্রে পাগলিনীর বেশে ছুটে চলে এসেছে । নাড়ির টান। এক এক করে মা তার সন্তানদের হারাচ্ছে। চোখের আড়ালে। কোন নারী স্থির থাকতে পারে?

কাঁদতে কাঁদতে মা বাড়িতে এসে ঢুকল। ছুটে গেল ছেলের ঘরে। সেখানে বাবাও বসা। তাঁকে সরিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ল হরচন্দ্রের বিছানার ওপর। দুহাতে আঁকড়ে বুকে তুলে নিল ছেলেকে। নেতিয়ে চোখ বন্ধ করে পড়েছিল সে। মায়ের ডাক কানে যেতে চোখ চাইল। হাতের স্পর্শ পেয়ে মা, মা বলে, চিৎকার করে উঠল। তারপরেই সব শেষ। হরচন্দ্রের দেহ  নেতিয়ে পড়ল। চোখ বুজল। মৃত্যু এসে অকালে ছিনিয়ে গেল  প্রাণটা। মায়ের আসার অপেক্ষাতেই যেন হরচন্দ্রের প্রাণবায়ু দেহের খাঁচায় আটকে ছিল।  মা, মা, ডাক দিয়ে মুক্ত হয়ে সে পরলোকে পাড়ি জমাল ।  ঘরে কান্নার রোল উঠেছিল।  ঠিক তখনই মা চিৎকার করে বাবার উদ্দেশ্যে বলে ওঠেছে, এদেরকে এখানে এনে আমার কোল শূন্য করে দিলে তুমি। গ্রামে থাকলে হারাতে হত না আমার ছেলেদের…। বাবা নিরুত্তর। ঝরঝর করে কাঁদছেন…

পুরনো দিনের কথা মনে করে বুক ভেঙে যাচ্ছে ঈশ্বরচন্দ্রের। লেখার ব্যাঘাত ঘটছে। কলম চলছে না। সামনে খোলা খাতা। অনেকক্ষণ পর উঠে পড়লেন। রাতের খাওয়া সেরে শুতে গেলেন।

পরের দিন। কলেজে গেছেন। ডাক পড়ল মার্শাল সাহেবের। মদনমোহনের কথা সত্য প্রমাণ করে মার্শাল সাহেব তাঁকে ডেকে পাঠিয়েছেন।  ঈশ্বরচন্দ্র বুঝলেন, আসল সংবাদটা খোদ লোকের মুখ থেকে শুনতে হবে। কিন্তু তাহলেও, মন প্রস্তুত করে  ফেলেছেন, এই চাকরী তিনি গ্রহণ করবেন না। পরিবর্তে কী করবেন, সময়েই তা জানাবেন মার্শালকে।

ঈশ্বরচন্দ্র গিয়ে ঢুকলেন আধিকারিকের  ঘরে। এ ঘর তাঁর চেনা। এখানে বসে মার্শাল সাহেবের সঙ্গে অনেক কথা হয় তাঁর।  ঘরে প্রবেশ করতে তিনি ঈশ্বরচন্দ্রকে বসবার আহ্বান জানালেন। চেয়ার টেনে  মুখোমুখি বসলেন ঈশ্বরচন্দ্র।

মার্শাল কথা শুরু করলেন, বাবু ভিদ্যাসাগর মহাশয়, আ প নার জন্যে একটা উত্তম প্রস্তাব রয়েছে।

এমন কথায়ও ঈশ্বরচন্দ্রের মধ্যে কোনও হেলদোল নেই। তিনি বললেন, প্রস্তাবটা কী, তা কি শোনাবেন, অধ্যক্ষমশাই?

-আপনাকে সংস্কৃত কালেজে ব্যাকারণের পণ্ডিত নিযুক্ত কবার প্রস্তাব রাখছি।

  মার্শাল ঈশ্বরচন্দ্রের মুখের দিকে তাকালেন। উত্তর পেতে তিনি উদগ্রীব। ঈশ্বরচন্দ্রের কাছে থেকে প্রত্যুত্তর এল, আপনার প্রস্তাব অতি উত্তম। তবে দুঃখিত। আমি ওই পদে যেতে প্রস্তুত নয়।

মার্শাল বিস্মিত হলেন। এমন উত্তর  তিনি আশা করেনি। বলে উঠলেন, কেন!  পরে আবার কথা যোগ করলেন, এই চাকরীতে অনেক বেশি মাইনে। মাসে নব্বুই টাকা।

হয়তো বা তিনি ভাবলেন, বেশি মাইনের কথা শুনে ঈশ্বরচন্দ্র যদি উৎসাহিত হন। কিন্তু ফের উত্তর এল, -ধন্যবাদ। মহাশয়, টাকার প্রত্যাশা আমি করি না। আপনার এই প্রস্তাবের জন্যে আমি কৃতজ্ঞ। তবে কি না, আপনার সঙ্গে থাকলে, আমি বেশি লাভবান হব। নতুন নতুন উপদেশ পাই আপনার কাছ থেকে…

মার্শালের উৎসাহে ভাঁটা পড়ল। কিছুটা নিরুৎসাহ। বললেন, আপনি তাহলে ওই পদ প্রত্যাখ্যান করছেন?

-দুঃখিত, মহাশয়। তবে আমি আপনাকে নিরাশ করব না। পদ দুটো কীসের, তা কি বলবেন?

-অবশ্যই। তা হচ্ছে, ব্যাকরণের ১ম ও ২য় শ্রেণীর অধ্যাপকের পদ। সত্বর তা পূরণ করবার আদেশ এসেছে।

সামান্য সময়ের জন্যে ঈশ্বরচন্দ্র কী ভাবলেন। মনে চিন্তা এসে গেছে। একজনের মুখ তখন তাঁর চোখের ওপর ভাসতে শুরু করে দিয়েছিল। মানুষটার নাম, তারানাথ বাচস্পতি।  অম্বিকা-কালনায় তাঁর বাস ।

সোজা হয়ে বসেছিলেন। বসলে তাঁর মেরুদণ্ড শক্ত বাঁশ কাঠির মতো ঋজু হয়ে থাকে। অথচ হঠাৎ তাতে সামান্য বিচ্যুতি ঘটল। শিরদাঁড়া বেঁকিয়ে মার্শালের দিকে ঝুঁকে পড়লেন। বললেন, আমি আপানাকে লোক নির্বাচন করে দেবার প্রতিশ্রুতি দিলে আপনি কি তা গ্রহণ করবেন?

-আ প নি লোক ঠি..ক…,

বিস্ময়ে মার্শাল তোতলাতে শুরু করলেন। কথা যুক্ত করলেন, কাকে উক্ত পদপ্রাপ্তির যোগ্য মনে করেন  আ প নি?

মগজ থেকে নামটা বের করে মুখে উচ্চারণ করলেন, তারানাথ বাচস্পতি । -মানুষটি সংস্কৃত কলেজ ও কাশীর পণ্ডিতদের কাছে বিদ্যালাভ করে সর্বশাস্ত্র বিশারদ এবং অদ্বিতীয় বৈয়াকরণ হয়েছে।  থাকেন কিঞ্চিৎ দূরস্থানে। আমার যতদূর জানা আছে, তিনি সেখানে টোল খুলে বালকদের ব্যাকরণ ও শাস্ত্র পড়ান। সঙ্গে অবশ্য কিছু ব্যবসাও করেন। আমার মতে প্রথম পদ ওনারই প্রাপ্য। কথাগুলো বলে গেলেন তিনি।

মার্শাল বলে উঠলেন, ও হো।

কিছুটা হতাশাও প্রকাশ হল ওই দুটি শব্দ দিয়ে। ঈশ্বরচন্দ্র তা বুঝেই কি না, বললেন,  আমি তাকে অনুরোধ করলে আমার কথা তিনি রাখবেন। তবে, কবে ওনাকে কাজে যোগ দিতে হবে, অধ্যক্ষ মহাশয়?

-সামনের সোমবার। আজ কিন্তু স্যাটার ডে। মাঝে মাত্র একটা দিন।  পত্র দিলে তো ওনার আসতে অনেক দেরী হয়ে যাবে…

সব কটা শব্দেই নিরাশা ধ্বনিত হল। ঈশ্বরচন্দ্র আবার চুপ থাকলেন। ভাবলেন। পরে হঠাৎ বলে উঠলেন, নিশ্চিত থাকুন। বাচস্পতি মহাশয় সোমবারেই কাজে যোগ দেবেন।

-মানে!

মার্শালের মনে বিস্ময়। ঈশ্বরচন্দ্র তাঁকে পুনরায় আশ্বস্ত করে  বিদায়বার্তা জানিয়ে উঠে পড়লেন। কী করতে যাচ্ছেন, তা ব্যক্ত করবার কথাও তখন তার মনে এল না।

কথা হল, বেলা এগোরাটায় আর দুপুরের মধ্যেই ঈশ্বরচন্দ্র অম্বিকা-কালনা যাত্রা করলেন।

সাধে কি ঠাকুরদা তাঁর পৌত্রকে এঁড়ে আখ্যা দিয়েছিলেন? যাবেন তো যাবেনই। তাও একেবারে পদব্রজে। জলপথ তো আর ওদিকে নেই? আছে যদি বা গরুরগাড়ি।  সে তো চলবে গদাই লস্কর চালে। একদিনের পথ তিনদিন লাগিয়ে দেবে। তাই হন্টনই উপযুক্ত পন্থা; যাতে তাঁর এতটুকু বিরক্তি নেই। যাবেন মনস্থ করে  বেরিয়ে পড়েছেন। সঙ্গে একজনকে রাখলেন।  ছেলেটা তাঁর আত্মীয়। আত্মীয় হলেও দূর সম্পর্কের। নাম গোকুল। অল্প বয়স। সতেরো পেরিয়ে আঠারোয় পা দিয়েছে।  শক্ত সমর্থ ছেলে। ঈশ্বরচন্দ্রকে সে কাকাবাবু করে  ডাকে।

পথের দূরত্ব প্রায় চল্লিশ ক্রোশ। এতটা হেঁটে যাওয়া এবং আসা তা কিছু চাট্টিখানি কথা নয়! তবে নিজের হাঁটার জন্যে চিন্তা করেন না। হাঁটায় তিনি দর। ক্রোশের পর ক্রোশ হেঁটে পার করতে পারেন। চিন্তা তাঁর লেজুড়টির জন্যে। যদিবা লেজুড়টিকে তিনিই জড়িয়েছেন। রাতে পথ হাঁটবেন। কোথায় কিসের  প্রয়োজন হয়, বলা যায় না।  শেয়াল দর্শন যখন তখন হবে, এটা নিশ্চিত। নেড়ি কুকুরের পাল থাকলে শেয়াল মানুষের ধারেকাছে ঘেঁষত না। কিন্তু, সে কুকুর এখন এদেশে কোথায়? ইংরেজের হাত ধরে কিছু বিলিতি কুকুর দেশে এসেছে বটে। তবে তাদের ঔরসে মিশ্রজাতির নেড়ির জন্ম এখনও এদেশে হয়নি। তাহলে বাকি রইল, চোর ডাকাতের ভয়। নাহ, সেরকম পয়সা কড়িও সঙ্গে রাখেননি। তবু কম বয়সের একজনকে সঙ্গে নিলেন।  বেরবার আগে গোকুলকে জিজ্ঞেস করেছেন, চল্লিশ ক্রোশ পথ  হাঁটতে পারবি তো?

-খুব পারব, কাকাবাবু, বলে, গোকুল তাঁকে নিশ্চিত করেছিল। তাইতে তাকে সঙ্গে নিয়ে বেরিয়ে পড়েছেন।

  বড়বাজার থেকে  বেরিয়েছেন দুপুরে। নৌকোয় গঙ্গা পেরিয়েছেন। হাঁটতে থেকেছেন বড় রাস্তা ধরে। বর্ধমানের পথ ধরেছেন। শহরের সীমানা পেরতেই ফাঁকা স্থানে গিয়ে পড়লেন। কিছুদূর পর্যন্ত পথের  দুপাশে ধানক্ষেত পড়ল। তখনও এপাশ ওপাশ করে ঘরবাড়ি নজরে আসছে। মাটির ঘর। একচালা দোচালা। পাকাবাড়ির দেখা নেই। শহর ছাড়তে পাকাবাড়ি সব উধাও। মাইল পাঁচেক চলবার পর ধান ক্ষেতও অদৃশ্য হল। এবার শুধু লম্বা পথ। চলেছে এঁকেবেঁকে। পথের দুধারে এখন জঙ্গল। গাছ গাছালিতে ভরা। দুজনে হাঁটছে। মাঝে মধ্যে এক আধটা জনবসতি পার করছেন। সেখানে দেখা মিলছে লোকজনের। গোরুর গাড়ি, পাল্কি , দু একখানা ঘোড়ায় টানা গাড়িরও দেখা মিলছে। কিছু দোকানপাট। ক্রেতা বিক্রেতার ভিড়।

সন্ধে নামতে পুটুস পুটুস এদিক ওদিকে বাতি জ্বলে উঠল। গৃহস্থ বাড়িগুলোতে। লোকজন  যে যার বাড়ি ঢুকে গেল। পথ শুনশান হয়ে পড়ল। গোকুলকে নিয়ে ঈশ্বরচন্দ্র পথ ভাঙছেন। টানা প্রায় আট ঘণ্টা হাঁটলেন। ধনেখালি পৌঁছলেন। অর্ধেকটা পথ পেরিয়েছেন।

পথ যে খুব জানা, তা নয়। মাঝে মাঝে পথদিশার-ফলক পথের দূরত্ব জানাচ্ছিল। দিনের আলোয় তা স্পষ্ট দেখা যাচ্ছিল। অন্ধকার নামতে চোখ জ্বেলে দেখতে হচ্ছে। তাই দেখছেন আর পথ পার করছেন। রাস্তার ধারে ফলক পড়া তো তাঁর আজকের স্বভাব নয়? আট বছর বয়সেই তা শুরু করেছিলেন।  বাবার হাত ধরে বীরসিংহ গ্রাম থেকে কলিকাতা আসবার পথে ইংরিজিতে সংখ্যা লেখা ফলক একবার দেখে তিনি ইংরেজির এক দুই তিন থেকে নয় সংখ্যা পর্যন্ত শিখে ফেলেছিলেন। তারপর একের পিঠে শূন্য দেখে বাবকে জিজ্ঞেস করে জেনে নিয়েছিলেন, ওটা দশ। পরের সংখ্যাগুলো আর তাঁকে বলে দিতে হয়নি। তা সেই তিনিই আজ পথের নিশানা লেখা ফলক দেখে রাস্তার দূরত্ব মাপবেন, তাতে আর আশ্চর্য কি? অজানা পথ পার করতে মাইল ফলকই স্বর্গ মর্ত পাতাল সর্বত্রর দূরত্ব জানিয়ে দেবে। তাছাড়াও পথ তো সোজা এগিয়ে গেছে। দিশা হারাবার সুযোগ কম। সেই পথ ধরে চলেছেন।

দূরত্বের একটা আন্দাজ অবশ্যই রয়েছে।  তিনি জানেন, ধনেখালির পর বসতি আসবে গুরাপ; তারপর আসবে বৈঁচি;  বৈঁচি পেরিয়ে উত্তরের পথ ধরে অম্বিকা-কালানায় ঢুকতে হবে।

একটানা হেঁটে গোকুল  ক্লান্ত বোধ করছিল। কাকাকে বলল, একটু বিশ্রাম নিলে ভালো হয়।

ঈশ্বরচন্দ্র তার কথায় সায় দিলেন। পথের একধারে একটা বিশাল গাছ দেখে গোকুলকে বললেন, চল, গাছ তলায় গিয়ে বসি।

পাকা পথ ছেড়ে সামান্য ভিতরে ঢুকে গাছটা। সেদিকে এগিয়ে গেল দুজনে। গাছতলায় শুকনো পাতার মেলা। চারিদিকে ছড়িয়ে রয়েছে। কাঁধ থেকে গামছাটা নামিয়ে পাতার ঢেরির ওপর বিছিয়ে দিল গোকুল। বিছানার মতো হয়ে গেল। সে শুয়ে পড়ল। ঈশ্বরচন্দ্র অবশ্য শুলেন না। পাশে বসলেন।

মাথার উপরে গাছের ডালপালা ছড়িয়ে রয়েছে। নিচে সবুজ ঘাসপাতার পাটি ।  গা এলিয়ে দিয়েছে গোকুল।  শুয়ে শুয়ে ডালপালার ফাঁক দিয়ে সে আকাশ দেখছে। রাতের আকাশে একটা একটা করে তারা উঠছে। ধীরে ধীরে চারিদিক অন্ধকারে ছেয়ে গেল। ক্লান্তিতে গোকুলের চোখ বুঁজে এল। সে ঘুমিয়ে পড়ল। অথচ ঈশ্বরচন্দ্রের শরীরে কোনও ক্লান্তি  নেই। তিনি চোখ চেয়েই বসে রয়েছেন।  মনে ধন্ধ, অন্ধকারে যদি তেনাদের আগমন ঘটে? হাস মুরগি থেকে মানুষ, মাংসের গন্ধ তেনাদের সরেস নাকে গেলেই এই অন্ধকারেই হুঁকা হুয়া, ডাক দিতে দিতে দল বেঁধে বেরিয়ে আসবে । বাড়ির মুরগিটা, হাঁস জোড়া, নিদেন পক্ষে ইঁদুর ছুঁচর গন্ধ নিয়ে নিজেদের খাদ্যের জোগান মেটাবে। আর সামনে মানুষ পেলে আশপাশ দিয়ে ছোঁক ছোঁক করে ঘুরতে থাকবে।

তিনি জানেন, এসব পথে অনেক তীর্থ যাত্রীরও চলাচল রয়েছে। তারা পদব্রজেই যায়। যাত্রী যদি কোনোভাবে অসুস্থ হয়ে পথে পড়ে মারা গেল তো, ব্যাস, শেয়ালের দলের সেদিন বনভোজনের আয়োজন হয়। সংখ্যায় এক’শ দু’শও চলে আসে। সেখানে এখন অবশ্য দু দুটো জলজ্যান্ত মানুষকে যদি ঘুমের দেশে পায়, তো তাদের আক্রমণ করতে দেরী করবে না। এ বিষয়ে তিনি নিশ্চিত। বেলা থাকতে থাকতে গাছের পাকাপোক্ত বড়সড় একটা ডাল ভেঙে লাঠি বানিয়ে সঙ্গী করে  ফেলেছেন তিনি। সেটা পাশে রেখে চোখ চেয়ে বসে রয়েছেন।

 

  ফাঁকা জায়গা। চারিদিকে ধু ধু করছে মাঠ। হঠাৎ প্যাঁ পোঁ, ঢুম ঢুম শব্দ! কান খাড়া করলেন।  বাদ্যি বাজার শব্দ! বাঁশের বাঁশির সুরেলা আওয়াজ। অন্ধকারের বুক চিরে শব্দ তাঁদের দিকে এগিয়ে আসছে। ঈশ্বরচন্দ্র সজাগ হলেন।

আওয়াজ ধীরে ধীরে কাছে এগিয়ে আসছে।  আলো দেখতে পেলেন। উঠে দাঁড়ালেন। বাজনদারের দল  সামনে এসে পড়ল। পিছনে একটা পাল্কি । ভদ্র গোছের কিছু মানুষ ভালো সাজ পোশাকে পাল্কির সামনে পিছনে করে চলছে।  রয়েছে বাতিদারের দল। চারটে লোক , ছেঁড়াখোঁড়া জামাকাপড়, দিনমজুর হবে। উজ্জ্বল আলোযুক্ত রেড়ির তেলের লম্বা লম্বা বাতিদান মাথায় তুলে তারা হাঁটচ্ছে।  সামনে আসতেই অন্ধকার জায়গাটা আলোয় আলময় হয়ে উঠল।  পাল্কি চেপে বর বিয়ে করতে যাচ্ছে। সঙ্গে বরযাত্রীর দল। বাজনার শব্দে গোকুল উঠে বসেছিল। সেও দৃশ্যটা দেখল। দলটা পায়ে পায়ে এগিয়ে গেল। জায়গাটা আবার আগের মতো অন্ধকারে ডুবে গেল। ঈশ্বরচন্দ্র বসলেন। গোকুল ফের শুয়ে পড়ল। শরীর তার বেশ ক্লান্ত।

বরযাত্রী আর বাজনা দেখে তিনি আনমনা হয়ে পড়েছেন। মনে ভিড় করে এলো  ভাই, হরিশ্চন্দ্রের কথা। বীরসিংহ গ্রামে এরকমই কোনও এক  বিয়ের অনুষ্ঠনে বাজনা শুনে হরিশচন্দ্র বলেছিল, দাদা, আমার বিয়েতেও কিন্তু  বাজনা করতে হবে ।  ছেলের বয়স তখন মাত্র আট বছর। কিন্তু হায়! ভাইয়ের বিয়ে করবার শখ আর মিটল কৈ? তায় বিয়ের বাজনা! আট বছর বয়সে সে ইহলোক ছেড়ে চলে গেল। হরচন্দ্রের আগেই সে মারা গেছে। কলকাতার বাসায়। একই ওলাওঠার আক্রমণে।

ঈশ্বরচন্দ্রের মনে চিরকালের জন্যে ভাইয়ের কথার আঁচড় পড়ে রয়েছে। সে কথা স্মরণ করে  তাঁর  চোখ জলে ভিজে উঠল। কোমল হৃদয় তাঁর । খানিকটা কাঁদলেন। মন শান্ত হতে ফের তৈরী করে নিলেন নিজেকে। গোকুলকে ডেকে তুললেন। তার তন্দ্রা এসে গিয়েছিল। চোখ রগড়ে নিয়ে সে উঠে দাঁড়াল। পথ চলা শুরু হল আবার।

চলবে… 

শেয়ার করতে:

You cannot copy content of this page