উৎসবের আঁতুড়ঘর

পিনাকী চৌধুরী।। অতীতে দুর্গোৎসবের দিন কয়েক আগে ফি বছর গভীর রাতে কুমোরটুলিতে গিয়ে হাজির হতাম। নিজ এলাকার মন্ডপে দুর্গা প্রতিমা নিয়ে আসার জন্য। অসংখ্য ছোট ছোট স্টুডিওতে তখন মৃৎশিল্পীরা শেষ তুলির টান দিতে ব্যস্ত! কুমোরটুলির পাশ দিয়ে বয়ে চলেছে স্রোতস্বিনী গঙ্গা ! সেই নদীর তীরে গভীর রাতে আমরা ক’জন বন্ধুবান্ধব একটু জিরিয়ে নিয়ে আবারও স্টুডিওতে গিয়ে অবাক নয়নে তাকিয়ে দেখতাম দেবী প্রতিমা নির্মাণের কাজ। সত্যি, এ যেন এক বিচিত্র কর্মযজ্ঞ ! শুধু দেশে নয়, বিদেশেও সমাদৃত কুমোরটুলির বিখ্যাত দেবী প্রতিমা। একবার একজন মৃৎশিল্পীকে প্রশ্ন করেছিলাম ” আপনাদের এই সময়ে আয় কেমন হচ্ছে ?” প্রশ্নটা শুনে দু’দন্ড থেমে তিনি জানান ” বাঁশ আর খড়ের দাম বেড়েছে , আর সেই সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বেড়েছে গঙ্গা মাটির দাম । সেই তুলনায় আমরা প্রতিমার দাম বাড়াতে পারি না, কারণ- অনেক পুজো উদ্যোক্তা বেশি মূল্য দিতে চান না ।”

যদিও এই ২০২১ সালে করোনা আবহে কুমোরটুলিতে এখনও দেবী প্রতিমা নির্মাণের ব্যস্ততা শুরু হয় নি । তবুও বেশ কিছু বরাত ইতিমধ্যেই এসে গেছে। বিশেষ করে বিদেশে যেসব দুর্গা প্রতিমা পাঠানো হবে, তার প্রস্তুতি চূড়ান্ত । উত্তর কলকাতার এই বিখ্যাত কুমোরটুলিতে আজও দেশী বিদেশী পর্যটকদের আনাগোনা লেগেই রয়েছে । বস্তুতঃ কুমোরটুলি যেন বিশ্বের বিস্ময়! আর অতীতে এই প্রতিবেদকের কাছে ছিল যেন এক সব পেয়েছির দেশ ! কিছুতেই যেন আশ মিটতো না উৎসবের আঁতুড়ঘরে এসে ! এবার ফিরে যাই অতীতের সেইসব সাদা কালো দিনে ।

১৭৫৭ সালে পলাশীর যুদ্ধে জয়লাভ করে ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ভারতে ঔপনিবেশিক সাম্রাজ্য বিস্তার করতে উদ্যোগী হল । গোবিন্দপুর গ্রামে কোম্পানি ফোর্ট উইলিয়াম দুর্গ স্থাপনের সিদ্ধান্ত নেয় । সেই অঞ্চলের বাসিন্দাদের সুতানুটি অঞ্চলে নিয়ে আসা হয়। গোবিন্দপুরের ধনী সম্প্রদায়ের মানুষজন পাথুরিয়াঘাটা ও জোড়াসাঁকো এলাকায় বসতি স্থাপন করে। এরপর কোম্পানির ডিরেক্টরদের আদেশানুসারে জন জেফানিয়া হলওয়েল কোম্পানির মজুরদের জন্য আলাদা আলাদা অঞ্চল বন্টন করেন।

সেই সময়ে কলকাতার দেশীয়দের অঞ্চলগুলো বিভিন্ন পেশাভিত্তিক পাড়ায় বিভক্ত হয়ে পড়ে। এইভাবেই কুমোরটুলি, শুড়িপাড়া, কলুটোলা , আহিরীটোলা অঞ্চলের উৎপত্তি হল । এখানে বলে রাখা ভাল, ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষ ভাগে বড়বাজার অঞ্চলের আগ্রাসনের শিকার হয়ে তদানীন্তন উত্তর কলকাতার মৃৎশিল্পীরা দলে দলে শহর ছেড়ে চলে যেতে বাধ্য হন। কিন্তু কুমোরটুলির মৃৎশিল্পীরা, যাঁরা কিনা গঙ্গামাটি সংগ্রহ করে মাটির পাত্র নির্মাণ করে সুতানুটি অঞ্চলে বিক্রি করতেন , শুধুমাত্র তাঁরাই টিকে রইলেন। পরবর্তী সময়ে তাঁরাই ধনী সম্প্রদায়ের বাড়ির পুজোর নিমিত্তে বিভিন্ন দেবদেবীর মূর্তি নির্মাণ শুরু করলেন। সময় থেমে থাকেনি। তারপর গঙ্গা দিয়ে বয়ে গেছে অনেক জল ! তবে আজও কুমোরটুলি আছে কুমোরটুলিতেই ! মেঘ বৃষ্টির লুকোচুরির মতো এখানে নিরন্তর খেলা করছে শিল্পের চরম উৎকর্ষতা !

শেয়ার করতে:

You cannot copy content of this page