এক সীমান্তহীন রঙিন পৃথিবীর স্বপ্ন
সাক্ষাৎকারে- চারু পিন্টু
১)দুই দেশের লিটল ম্যাগাজিনের ঘরানার মধ্যে তফাৎ সম্বন্ধে কিছু বলুন?
চারু পিন্টু- দেখুন সারা পৃথিবীর লিটল ম্যাগাজিনের ভাষা এক। এটা একটা আন্দোলন। রাজনৈতিক সংস্কৃতি পরিবর্তনের জন্য লিটল ম্যাগাজিনগুলো তার শিরদাঁড়া টানাটান করে আছে। আপনি যদি বাংলাদেশের লিটল ম্যাগাজিনগুলো দেখেন দ্রষ্টব্য, করাতকল, যশোর রোড, গাণ্ডিব, প্রতিশল্প, শিং, শাব্দিক, ওপেন টেক্সট, শিরদাঁড়া, সূর্যঘড়িসহ ভারতের কাগজগুলো দেখুন, জারি বোবাযুদ্ধ, গ্রাফিত্তি, মধ্যবর্তি, একশো আশি ডিগ্রি, হারিকিরি, বিজ্ঞাপনপর্ব সহ কাগজগুলোর দিকে তাকান একইরকমের ভাষা পাবেন। দুইবাংলার রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক আর ক্ষমতার তফাৎ আছে যার প্রেক্ষিতে আন্দোলনের বিষয়বস্তু, ভাষার বিষয় বিন্যাসের পার্থক্য খুঁজে পাবেন। কিন্তু সামাজিক আর সাংস্কৃতিক রীতি তো অভিন্ন সেই পার্থক্য হয়তো টের পাবেন না। মোটকথা পুঁজিবাদের বিরুদ্ধে যে লড়াই, ক্ষমতার দাম্ভিকতার বিরুদ্ধে যে লড়াই, সাংস্কৃতিক আগ্রাসনের বিরুদ্ধে যে লড়াই, অস্ত্র আর অর্থের চোখ রাঙানির বিরুদ্ধে যে পাল্টা ভাষা তা সারা পৃথিবীর লিটল ম্যাগাজিনের সেই একই ভাষা। তবে হ্যাঁ, লিটল ম্যাগাজিনের দাবি করা যে সাহিত্য পত্রিকাগুলো আছে যারা বাজারি মানসিকতা লালন করে, ক্ষমতার পদতলে নতজানু হয়, পুঁজির আগ্রাসনে নিজেকে সস্তা দরে বিক্রি করে দেয় সেই চরিত্রের কাগজগুলোও কিন্তু দুই বাংলায় যথেষ্ট পরিমানে আছে। যাদের কাছে ঘি আর নোংরা দুটোই সমান। কোন কিছুতেই তাদের না নেই।
২)কলকাতায় প্রথম থেকে এত বছর কাজের অভিজ্ঞতা নিয়ে কি বক্তব্য আছে?
চারু পিন্টু- আসলে কলকাতা আলাদা কিছু নয় অন্তত সাহিত্যে বা চিত্রকলায়। রাজনৈতিক কারনে আলাদা দেশ কিন্তু সংস্কৃতিতো একই। সাহিত্যটাও একই। কলকাতা কয়েকটি প্রকাশনার সঙ্গে কাজ করার অভিজ্ঞতা আমার হয়েছে। আত্মজা, হর্ণবিল বা অভিযানের মতো বেশ কিছু পাবলিকেশনের সঙ্গে কাজ করার দারুণ অভিজ্ঞতা আছে। এছাড়াও ইন্ডিবিউজল লেখকদের সঙ্গেও দীর্ঘদিন কাজ করেছি। প্রফেশনাল প্রকাশনীগুলো টেকনিক্যাল জায়গা প্রিন্ট আউটপুটের জন্য যে সফটওয়ার ব্যাবহার করা হয় তা ঠিকঠাক আছে কিন্তু কিছু কিছু ক্ষেত্রে প্রযুক্তির ধারণা না পাওয়ায় তারা প্রিন্ট কোয়ালিটি খারাপ করে ফেলে সেটাও দেখেছি। তবে শিল্পের জায়গায় কলকাতার লেখক বা বাংলাদেশের লেখক এই বৈষম্য আমি করি না অথবা কোনও শিল্পী সেটা করে না। কারণ শিল্প এমন এক আন্তর্জাতিক বা সার্বজনীন ভাষা তা কাঁটাতারকে উপেক্ষা করে, কখনো কখনো ডমিনেটও করে।
৩)শিল্প সাহিত্য সংস্কৃতিতে ভারত বাংলাদেশের সম্পর্ককে কোন দিকে দেখছেন ?
চারু পিন্টু- আগেই বলেছি শিল্পের জায়গায় পশ্চিমবঙ্গ বা ত্রিপুরা বা বাংলাদেশ অভিন্ন জায়গা। সেটা শিল্পের সব সেক্টরেই। তবে আলাদা স্বতন্ত্র দেশ হওয়াতে এই সম্মিলিত চর্চা বা শিল্পের আদান প্রদানটা রাজনৈতিক সংস্কৃতিকে ডেভলপ করে, সমৃদ্ধ করে। আত্মার মেলবন্ধন ঘটায়। দুই দেশের রাষ্ট্রীয়গত জায়গায় এই সব শিল্পকলার আধিক্য বেশি হওয়া জরুরী।
আমার মতে- শিল্পের জায়গা ছাড়াও মানুষের রাজনীতি অথবা নাগরিক আদান-প্রদানের সমষ্টিও কিন্তু বেশি কাছাকাছি টেনে নিয়ে যায়। সব থেকে অদ্ভুত লাগে সব শ্যামবর্ণের মানুষ, সব ভাষা বাংলা, একই রবীন্দ্রনাথ একই নজরুল জীবনানন্দ পড়ে বেড়ে ওঠা মানুষের ভেতর এই কাঁটাতারই দুরত্ব ঘটায় কিন্তু মনের ভেতর যে লালন সাঁইজ্বী বাস করেন তা কেবল আত্মার মিলনই ঘটায় বলে আমি মনে করি।
৪)পাশ্চাত্যের শিল্পরীতির সঙ্গে উপমহাদেশের শিল্পরীতির মেলবন্ধনকে কী নজরে দেখছেন?
চারু পিন্টু- পাশ্চাত্যের রীতি আর আমাদের ভারতীয় রীতি ভূমি আবহাওয়া বা মানুষের গড়ন কিন্তু আলাদা, বৈশিষ্ট্য আলাদা, খাদ্যাভ্যাস আলাদা। কিন্তু আপনি ভারতীয়রা আঘাত পেলে চোখে জল ঝরে, পশ্চিমারাও কিন্তু আঘাত পেলে চোখে জল ঝরে। আসলে সব বেদনার, কান্নার চিৎকারের ভাষা এক, আনন্দের হাসির চেহারা এক। হয়তো আমরা আমাদের ভুমিগত জায়গা থেকে নৃত্য করছি আমাদের ঢঙে, ছবি আঁকছি আমাদের ঢঙে পশ্চিমারাও তাদের ঢঙে। কিন্তু সীমান্তহীন পৃথিবী যারা স্বপ্ন দ্যাখেন তাদের কাছে এই পশ্চিমা থেকে এই উপমহাদেশের শিল্পের আদান প্রদান কিন্তু পজেটিভ চিন্তার স্বাক্ষর দেয়।
৫)প্রচ্ছদ ও চিত্র শিল্পে বর্তমান রাজনৈতিক প্রভাব খাটে কী!
চারু পিন্টু- মোদ্দাকথা, রাজনীতির বাইরে কিছু নেই। যা আছে তা কেবল সুবিধাবাদি চিন্তার। একজন শিল্পী রাজনৈতিক দৃস্টিকোণে যতটা দেখতে পায় অগ্রীম, মাঠের পলিটিশিয়ানরা ততদুর দেখতে পায়না। কারণ আমাদের উপমহাদেশে রাজনৈতিক চরিত্রটি বেশিরভাগ ক্ষেত্রে অর্থনৈতিক চিন্তায় জড়িত থাকবে এটা অস্বাভাবিক নয়, কিন্তু শিল্পীরা কেবল সুন্দর আগামীর পথ খোঁজে উদ্দ্যেশ্য ছাড়াই। এটাই পার্থক্য। আর চিত্রকলায় রাজনৈতিক ব্যাখাতো থাকেই। যদি আপনি লোকচিত্র আঁকেন যদি আপনি অ্যাবস্ট্রাক্ট আঁকেন, যদি আপনি পোট্রেট আঁকেন যাই আঁকুন না কেন রাজনৈতিক চিত্র অবশ্যই আঁকেন যখন শিল্পী তার ভেতর অসমতা বা ক্রাইসিস অনুভব করেন। এটা ক্যানভাসের বা দেয়ালচিত্রের ভেতর দিয়েই প্রকাশ পায় বেশি।
আর প্রচ্ছদ এর ক্ষেত্রে যখন আপনি মুক্তিযুদ্ধ বা দেশ প্রেমের বইয়ের প্রচ্ছদ আঁকছেন অন্যদিকে দেশ বিরোধী কোন বই বা মৌলবাদীত্ব উস্কে দেয় এমন বইয়ের প্রচ্ছদ আঁকছেন না সচেতনভাবে। এই যে আঁকছি আর আঁকছিনা এই সিদ্ধান্ত নেওয়াটাওতো রাজনৈতিক দৃস্টিভঙ্গি তাইনা।
৬) আপনার শিল্পভাবনায় চিত্রকলার ভাষা কি?
চারু পিন্টু- আমার দৃষ্টিতে চিত্রকলার ভাষা হরেক রকম। চিত্রকলার ভাষা এমন একটা ভাষা যে শিল্পী আঁকে কিন্তু বলেনা মুখে। কিন্তু যে দর্শক বা শিল্পপিপাসু দ্যাখেন সে শুধু দ্যাখে না তার মতো করে গল্পটাকে সাজিয়ে নেয়।
এই যে নিজের মতো করে বুঝে নিজের ভাবনায় গল্প দাঁড় করায় এটাই তার ভাষা। মনের ভাষা, চোখের ভাষা, অনুভূতির ভাষা। একটা পাখি যখন কিচিরমিচির করে তখন আমরা ধারণা করি বা বোঝার চেষ্টা করি পাখিটা কেন কিচিরমিচির করছে ওর চাওয়াটা কি! ওর চাওয়াটা যখন নিজে ধারণ করে নিচ্ছি যে পাখিগুলোর খিদে লেগেছে অথবা বাসায় যাবার জন্য অন্যপাখিকে ডাকছে। এই যে মানুষের ভেতর উপলব্ধি ঘটে এই উপলব্ধিটাই শিল্পের ভাষা।
৭) আপনি একজন চিত্রশিল্পী তার পাশাপাশি থিয়েটারেও আপনার অভিনয় চোখে পরার মতো। এই যে দু’টো ভিন্ন ধরনের শিল্প এক হয়ে যাচ্ছে, এক্ষেত্রে আপনার মতামত কি?
চারু পিন্টু- হ্যাঁ আমি চিত্রকলার পাশাপাশি থিয়েটার করি অনেক আগে থেকেই। বাংলাদেশে প্রথিতযশা নাট্যদল “পালাকার” এর সঙ্গে কাজ করছি ২০০৫ সাল থেকে। থিয়েটার আর চিত্রকলা আমার কাছে কোনভাবেই আলাদা মনে হয়না। একই ভাষা বা বক্তব্য, একটা ক্যানভাসে প্রয়োগ করি অন্যটা মঞ্চে প্রয়োগ করি। পার্থক্য ছোট্ট- একটা এককভাবে পারফর্ম করা অন্যটি সমষ্টিগত পারফর্ম করা। কিন্তু মঞ্চনাটকের দৃশ্যগুলো পার্ট বাই পার্ট ভাবুন, গল্প বুনোন ভাবুন আর পেইন্টিং এর ধারাটা ভাবুন। একই জিনিস একই রঙের বিস্তার, একই সাউন্ড। দুটোকে একসাথেই আমি উপভোগ করি।
৮) এখন অনেক বেশি ডিজিটাল প্লাটফর্মে সব কিছুই সময়ের সঙ্গে সঙ্গে উন্নত হচ্ছে। কোথাও গিয়ে কি চিত্রকলা, লিটল ম্যাগাজিন তার চরিত্র হারাচ্ছে?
চারু পিন্টু- দেখুন ডিজিটাল ফর্ম হোক আর রিয়েলটি ফর্ম হোক, আমি মনে করি কেউ কারো অন্তরায় নয়। ডিজিটাল ফর্ম এ লেখা বা আঁকা হচ্ছে এটা একটা বাড়তি সুবিধা বটে তবে ক্যানভাস বা কাগজ কলম বা প্রিন্ট ভার্সনটা চিরিকালই থাকবে। পৃথিবী যত এগিয়ে যাবে প্রযুক্তি ততই জায়গা দখল করবে যেমন সত্য তেমন সত্য হাজার বছর ধরেও এই লিটলম্যাগ অথবা পেইন্টিংও রেললাইনের মতো পাশাপাশি চলবে।
৯) এখনও পর্যন্ত পনের হাজার প্রচ্ছদ করেছেন বাংলাদেশ, ত্রিপুরা, পশ্চিমবঙ্গ মিলিয়ে, নতুন প্রজন্মকে এগিয়ে আসার জন্যে কি বলবেন?
চারু পিন্টু- হ্যাঁ দীর্ঘদিনের কাজের সঙ্গে আমার চলার কারনে এতটা কাজের সঙ্গে নিজেকে সম্পৃক্ত করতে পেরেছি। তবে নতুনদের জন্য আসলে বলবার কিছু নেই। শুধু একটাই কথা প্রচ্ছদ অনেক স্লো মিডিয়া সুতরাং অল্পতে হতাশ হওয়া যাবেনা, ধৈর্য্য এবং অধ্যাবসায় এর বিকল্প নেই। প্রতিযোগিতা নয়, দরকার নিজেকে প্রতিনিয়ত অতিক্রম করা। তাহলে উন্নয়ন হবে নিজের শিল্পচিন্তার।
১০) ইংরেজি প্রকাশনার প্রচ্ছদ ভাবনা নিয়ে আপনার কি মনে হয়?
চারু পিন্টু- ইংরেজি প্রকাশনাগুলোর সঙ্গে টুকটাক কিছু কিছু কাজ হয়েছে আমার। তবে সম্পূর্ণ ইংরেজি ভার্সন অথবা ইন্টারন্যাশনাল ভার্সনে ভারতীয় একটি প্রকাশনা সংস্থার সঙ্গে রিসেন্টলি কাজ করবার অভিজ্ঞতা ঘটবে আশা করি তখন সব পাঠকই জানতে পারবেন। আশা করি যাত্রাটা দীর্ঘদিনেরই হবে।
১১) একটা প্রচ্ছদ তৈরিতে একজন লেখক আর একজন প্রচ্ছদশিল্পী দুজনেরই সমান মানসিকতা থাকা দরকার হয় কি?
চারু পিন্টু- অবশ্যই একজন লেখকের শিল্পীর ভাষা বোঝা জরুরী একজন শিল্পীরও লেখার ভাষা বা সারসংক্ষেপ বোঝাও জরুরী। লেখক শিল্পীর আড্ডা হতে পারে চায়ের শপে। কিন্তু প্রচ্ছদের ক্ষেত্রে চিত্রকলা ও লেখার সখ্যতা বেশি জরুরি।