কিয়ারোস্তামি বিনির্মিত

লিখছেন ঋতব্রত ঘোষ
তাৎক্ষণিকতা একটা আমেজ। কৃষ্ণচূড়ার সাথে আকাশের আবীর খেলার মতন। “চেরীর স্বাদ” (Taste of Cherry) ছবিটায় কিয়ারো আরো ব্যাপকভাবে বুঝিয়েছিলেন। যেমন গোদারের Alphaville। Jim Jarmuschএর Dead Man.
কিয়ারো প্রশ্ন ছুঁড়ে দেন সামনে, নিজের মত করে ছবি তৈরি করতে বলেন। যে যেমনভাবে দেখছে বা বুঝছে। আর তারপর বুনোটের আমোদে একদম অন্য একটা জায়গায় এনে ফেলেন। দর্শকের সাথে অনবরত mindgame খেলতে থাকা। আর এই খেলায় ভাগ নেবে না এমন দর্শক মেলা ভার।
Certified copy (copie conforme ) নিয়ে মুনিগণের মতামতের মধ্যে এটা একটু খেয়াল করুন – “ Each framework is a fixed organic tableau where the depth of field and the games of mirrors shape a sensory architecture. One can perceive the remains of the past and the possibilities of an idyll.”
প্রতিফলনের বৈষম্যর কথা বলেছে। games of mirror। কিভাবে ছুঁড়ে দেবে তোমার অনুকরণ, মেঘের অস্পষ্টতা জুড়ে?
নেমা-এ নজদিক্ (Close-up) – ছবির কাহিনী ও পরিচালনা আব্বাস কিয়ারোস্তামি। ছবির সব চরিত্র বাস্তবের নাগরিক। হোসেন সবজিয়ান ওই নামের চরিত্রকেই রূপায়ন করেছেন, মোহসেন মাখমালবাফ সেই তিনিই তাঁর, আবোলফাজি আহাঙ্খা সে-ও। বাস্তব চরিত্রের নামেই কাহিনীর চরিত্রের নাম। এতটাই ডকুড্রামা, এতটাই প্র্যাক্সিস্ থেকে ছিটকে সরে তৈরি এই ছবি। ছবির শুরুতে ক্রেডিটস্ চলাকালীন বলা হয়, সত্য ঘটনা অবলম্বনে। চেতনার গভীরতম কোণ থেকে উঠলে বেরিয়ে আসছে বাঁধভাঙা মূত্রের স্রোত। ধর্মের নামে অনুশাসনগুলি স্পষ্ট হয়ে উঠছে। ধর্মান্ধ মানুষগুলোর আচ্ছাদিত জীবনের অসারত্ব ফটফট করে চোখের সামনে একের পর এক খুলে যাচ্ছে।
জমির মতনই কাহিনী কারো বাপের নয়। এ কথা রজার এ্যাক্রয়েড ছাড়া কে বেশি করে জানে! রিয়্যালিটী বা বাস্তবতা – বিশেষকরে এক ঐহিক বাস্তবতা স্পন্দনশীল, তার দৈশিক পরিসর এবং কাল পরিসরকে স্থির ভাবা যায় না। তার কাঠামো অপরিবর্তিত রেখে সে অক্ষ্য বদল করে। স্বয়ং কাল যেখানে অপ্রাসঙ্গিক ভৌগলিক চিত্র যেখানে অবান্তর সেখানে কে সে দুর্জয়ী পরাক্রান্ত মানুষ যে বাস্তবকে রূপায়িত করতে পারে? প্রশ্ন সহজ নয়, অজানা উড়তে থাকা পাখির মত উত্তর নির্বাক। কাহিনীর রূপ, বিন্যাস, হেতুবাদী সূত্র, উৎপত্তি, অনীহা, পার্শ্বপন্থা, গতি, সান্নিধ্য, অভিপ্রায় কিছুই স্তিতপ্রজ্ঞ নয়। নন্দনতত্ত্বে এমন প্রবাহের নাম দেয়া হয়েছিল তাৎক্ষণিকতা (immediacy)। কাণ্টীয় দর্শনের সময় থেকে আবহমান তাৎক্ষণিকতার ভাব ও ধারণা যেমন বদলেছে, চলচ্চিত্রে তাৎক্ষনিকতারও নান্দনিক পরিবর্তন ঘটেছে। পাল্লা দিয়ে এবং যেহেতু ফিল্মে বাস্তব ও সত্যকে মাত্রাতিরিক্তভাবে ডিসটর্ট করা যায় তাই চলচ্চিত্রে তৎক্ষণিকের প্রয়োগ আরো বেশি করে উপলব্ধি করা গেছে। এমনটা ভাবা যায় যে নিও-রিয়্যালিসম্ ও নিউ-ওয়েভ (Nouvelle Vague) পরবর্ত্তী যুগে যে সমস্ত চিত্রপরিচালক দলিল তৈরি করেছেন, মানবতার নথি তৈরি করেছেন, কিয়ারো তাদের পথিকৃত। নিউ-ওয়েভের সময়েও তাৎক্ষনিকতার এক ভিন্ন মূল্যায়ন করেছেন গোদার। তখন নির্মাণে তাৎক্ষনিকতার উন্মোচন। কিয়ারো’র ছবিতে ততক্ষণের প্রয়োগ আবার বাস্তবের নির্লিপ্ত ঘটনার মাধ্যমে। এক সপ্তাহ আগে ঘটে যাওয়া ঘটনাবলির যেন কি-টেলিকাস্ট হচ্ছে।
দক্ষ নিপুণ কারিগরের মত করে কিভাবে চলচ্চিত্র তার সৃষ্ট জাগতিক বাস্তবকে প্রথমত পরিকল্পনা তারপর, নির্মাণ এবং অবশেষে অতথোচিত বিভ্রান্ত করে তোলা যায় কিয়ারো তাঁর একের পর এক ছবিতে দেখিয়ে গেছেন।সবথেকে বেশি যে ছবিটির কথা মনে পড়ে, সেটি তাঁর ১৯৯৯ সালে তৈরি  একটি অসম্ভব জট-পাকানো এবং প্রতিবিম্বিক ডকুড্রামা, নেমা-এ নজদিক্ (Close-up)।
চলচ্চিত্র শুরু হবার আগে সচরাচর নির্দেশিকা দেয়া হয়ে থাকে, সব চরিত্র কাল্পনিক, কাহিনীর সাথে বাস্তবে কোন চরিত্রের মিল থাকলে তা সম্পূর্ণ অনিয়োজিত। এই সমানুপাত দর্শকের দায়বদ্ধতা থেকে মুক্তি দেয়। পাঠক লক্ষ্য করবেন আমি দর্শকের দায়বদ্ধতা বলছি, অতএব সিনেমা চলাকালীন যা কিছু ঘটবে সবটাই পুনর্নির্মিত। দার্শনিক যাকে বলেছেন reflexive, সুতরাং চিত্রিত রূপকল্প, সত্য এবং বাস্তব কোনটাই নয়। ক্লোজ-আপ ঠিক তেমনটি নয়। বুঝতেই পারলাম না মাইরি বলছি, কখন যে ডকুমেন্টারি / দলিল শেষ হয়ে কাহিনী নির্মাণ শুরু হল নাকি আদৌ কাহিনী গঠন করা হয় নি ছবিতে, সবটাই এটা একটা নথিচিত্র, না, সত্য ঘটনা অবলম্বনে পুরো ছবিটি তৈরি করা। বোঝা হল না।
হোসেন সবজিয়ান এক আম্-বেকার যুবক, তেহেরানে থাকে, ফিল্মের পোকা, যাকেঘিরে কিয়ারো’র ক্লোজ-আপ। প্রবঞ্চকতা ছাড়া আর কোনো বদ্গুণ চোখে পড়ে না। পরিস্থিতির অভিসন্ধি খেয়াল পড়ে। হোসেন একদিন সহযাত্রীদের বড়াই করে বলে, তার নাম মোহসেন্ মাখমালবাফ। হোসেনের সৌভাগ্যক্রমে সেই বাসে মিসেস আহাঙ্খা-ও ছিলেন। হোসেন বলে যে সে আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন চিত্র পরিচালক, সম্প্রতি শেষ করেছেন দ্য সাইকলিস্ট ছবির কাজ। এবং তাঁর আগামী ছবির জন্য লোকেশান্ খুঁজে বেড়াচ্ছেন। মিসেস আহাঙ্খা তেহেরানের এক সম্ভ্রান্ত পরিবারের বধূ। তখনকার দিনে ইরানের অভিজাত পরিবারের সদস্যরা শিল্পের ঘোরতর পৃষ্ঠপোষকতা করতেন। মিসেস আহাঙ্খা অনুগত হয়ে পড়লেন মাখমালবাফ-রূপী এহেন হোসেন সবজিয়ানের। এসবই আমাদের শোনা কথা। এরপর জানা যায় হোসেন এক সম্ভ্রান্ত পরিবারের সংস্পর্শে আসে, যারা তাকে প্রসিদ্ধ ফিল্মমেকার হিসেবে ভুল করে এবং তার পৃষ্ঠপোষণ শুরু করে। পরবর্ত্তীকালে তারা তাদের ভুল বুঝতে পারে এবং হোসেন সবজিয়ান এর বিরুদ্ধে তঞ্চকতার অভিযোগে পুলিসে ডায়রি করে। এসমস্তটা আমাদের লোকমুখে শোনা এই তথ্যচিত্রের মাধ্যমে (আমার ভুল, আমি কিয়ারো’র ক্লোজ-আপ ছবিটি একটি তথ্যচিত্র বলে মনে করেছি), অভিযোগ দায়রা করার প্রায় এক সপ্তাহ পরে এই ঘটনাটি কভার করতে আসার সময় সাংবাদিক হোসেন ফারাজমান্দ এসব তথ্য জানান ট্যাক্সি-ড্রাইভারকে।
যে কোন সত্য ঘটনার এক বিমূর্ত পরাঘটনা থাকে, ঘটনার বিনির্মাণ করার সময় তাকে নজরে আসে। অনেক সময় সাজানো ঘটনাকে সত্য বলে ভ্রম হয়। এখানেই তাৎক্ষণিক অবস্থান্তর ঘটে যায় নজরবিহীন হয়েও। ডকুমেন্টারি আর তার আবর্তে ঘোরাতে থাকে না দর্শককে। পথ যেন-বা ঠাওর হয় দীর্ঘ টানেল ধরে চলার পর।
গন্তব্যে পৌঁছে সাংবাদিক ফারাজমান্দ ফাটক খুলে ঢুকে যায় সেই অভিজাত পরিবারের এস্টেটে। একা। ক্যামেরা থেমে যায় এখানেই। শুরু হয় ট্যাক্সির পেছনের সীটে বসা রক্ষীবাহিনীর দুইজন সিপাহির সাথে ট্যাক্সিচালকের কথোপকথন। সহজ হতে চায় চালকটি। সিগারেট অফার করে। জানতে চায় তারা কোথাকার। তেহেরান থেকে দূরে কোন গ্রামে তাদের বাড়ি। ভিন্ন গ্রামের। কথোপকথন সংক্ষিপ্ত থেমে যায়। তারপর গাড়ি থেকে নেমে চালক ইতস্তত এদিক ওদিক করতে করতে একটা সরু ঢাকনা দেয়া টিনের সিলিণ্ডারে লাথি মারে। ডিব্বিটি গড়াতে গড়াতে
পাশ্চাত্যে একটা সময়ের পর কাণ্টীয় তাৎক্ষণিকতাবাদ (immediacy) -এর মধ্যে দিয়ে সুন্দরের যৌক্তিকতা এবং নৈতিক উৎকর্ষতার দম্ভকে ধীরে ধীরে বর্জন করা হয়েছিল। সৌন্দর্যকে পরিশোধিত করে তোলে রুচি, মূলভিত্তিও রুচিকেন্দ্রিক। যে রুচি বলত অক্সফোর্ডে শিক্ষা নেয়া যুবক গোলাপী রঙের ট্রাউজার পরাকে রুচিবিরুদ্ধ মনে করবে। কিয়ের্কগার্ড বললেন,
আমার কোলাজ্
An adaptation from Sohrab Sepehri’s “Address”
ঠিকানা
শোহরাব সেপেহরী (১৯২৮ – ১৯৮০)
ফুটফুটে জ্যোৎস্নায় ভোরের আলো ফুটল বলে ভ্রম হয়েছিল,
ঠিক তখুনি চালক জিজ্ঞাসা করল –
বন্ধুর বাড়ি কোন দিশায়?
Where is the friend’s house?
এই নামে ছবি করেছিলেন একখান কিয়ারোস্তামি, আদরের কিয়ারো আমার।
নাম রেখেছিলেন –  বন্ধুবাড়ি কোন দিশা?
শোহরাবের থেকে কিয়ারো ছিলেন পাক্কা বারো বছর ধরে ছোট, কিশোর বয়স থেকেই তার alter-ego
অদ্বিতীয় দ্বৈত সত্ত্বার প্রতি-অহমিক জটিলতায় কিয়ারো শোহরাবের কবিতার লাইন ধরে তৈরি করেছিলেন তার ছবিটি।
শোহরাব লিখলেন –
ফুটফুটে জ্যোৎস্নায় ভোরের আলো ফুটেছে – তাই ভ্রম হয়েছিল,
ঠিক তখুনি চালক জিজ্ঞাসা করল –
বন্ধুর বাড়ি কোন দিশা?
আকাশ গহীনে থমকে দাঁড়াল
পথিক এক নির্জনে
ধূ ধূ বালিয়াড়ির নিশীথে
আলোকশাখার স্টক্ টিকে মুখে এঁটে ধরে পথ দেখাল তাবৎ প্রলেম্-ধিন্ টা।
তর্জনী তুলে নির্দেশ করেছিল মগডালের দিকে
বলেছিল – এ মহীরুহের শিখরে পৌঁছানোর আগে
পথিমধ্যে এসে পড়বে এক অ্যাভিনিউ এর প্রান্ত,
ঈশ্বরীর স্বপ্নের চাইতে সবুজ সেখানকার সবকিছু,
আর ওই বাগানপথে জানো,
যতদূর পাখা মেলে গ্লাইড করতে করতে,
এয়ারোফয়েলে ভাসতে ভাসতে
যেতে পারো বাজপাখির পিঠে চেপে
দেখবে ভালবাসার রঙ নীল।
বাজ না পারলেও তুমি কিন্তু একদিন পৌঁছে যাবে ওই রাস্তাটা মানে  অ্যাভিনিউ এর শেষ সীমায়
তোমার তখন কৈশোর পেরিয়ে গেছে
একাকীত্বের মল্লিকাবনে তুমি নিস্পন্দ,
দুই পা দুই পা করে যেখানে মুকুল ফুটে রয়েছে…..
বহু প্রাচীন গল্পগাথায় ঘেরা পাহাড়ের নীচু কোল ঘেঁষে চলচ্ছক্তি তোমার হ্রাস হয়ে আসে
তুমি থেমে রইলে এখানে, রয়ে গেলে
জলের মতন স্বচ্ছ এবং একা একটা ভয় এসে সেঁধোয়, মুড়ে ফেলতে চায় তোমায়,
আবহমান পরিসরের অন্তরঙ্গে
যেন শুনতে পেলে শুকনো পাতায় পাতায় হেঁটে যাওয়ার খসখস,
ছোট্ট শিশুটির সাক্ষাত পেয়েছ বলে ওপর দিকে তাকালে,
ও তখন হুই তালগাছটার ডগায়,
মুঠোয় তার মুরগির ছানা,
আলোর বাসা থেকে উদ্ধার করেছে সেটিকে,
আলোর দিকে তাকিয়ে তুমি উথলে ওঠো,
শিশুকে জিজ্ঞাসা করেছ
বলতে পারো আমার সখার বাড়ি কোনদিকে? কোথায় আছে তার বাসা?
নিবিয়ে দিই সুইচ, ঝাপসা হয়ে যাচ্ছে কাঁচ জুড়ে দেখা মোমের আলো, সেপেইরির কবিতা পাঠ শেষ হবার আগেই।
শেয়ার করতে:

You cannot copy content of this page