পার্টির মামা
পিনাকী চৌধুরী।। গত শতাব্দীর নব্বইয়ের দশকের মাঝামাঝি সময়, তখন আমি ঠাকুরপুকুর বিবেকানন্দ কলেজের ছাত্র। আর তখন বেহালাকে বলা হত বামদুর্গ ! অবধারিতভাবেই আমি তখন কলেজে ছাত্র আন্দোলনের সাথে যুক্ত হয়ে পড়লাম , হ্যাঁ, ঠিকই ধরেছেন, এসএফআই ! যাদের পতাকায় জ্বলজ্বল করে ‘ স্বাধীনতা, সমাজতন্ত্র ও গণতন্ত্র’ কথাটি । সময়টা বড়ই মধুর ! আমার তরুণ দু’চোখে তখন এক সুন্দর পৃথিবীর স্বপ্ন ! সমাজকে পথ দেখানোর স্বপ্ন ! আর কলেজের ক্লাস বাঙ্ক করে তখন আমি হয় শহীদ বেদীতে আড্ডায় মগ্ন অথবা কলেজের ইউনিয়ন রুমে মিটিং এ ব্যস্ত ! পড়াশোনা তেমন একটা করতাম না !
যাইহোক কোনোক্রমে কলেজের একটা ডিগ্রি অর্জন করলাম। পরিবারের সকলে ভাবলেন যে, এইবার হয়তোবা ছেলেটার মাথা থেকে পার্টি শব্দটি উঠে যাবে ! অনেকেই তখন স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললেন ! কিন্তু না! কলেজ জীবন থেকে বেরিয়েও পুনরায় কলকাতা পুরসভার অন্তর্গত ১২৭ নম্বর ওয়ার্ডে বেশ দাপিয়ে সিপিএম করতে লাগলাম। ক্রমে ক্রমে সরশুনার রূপকার প্রয়াত নির্মল মুখার্জীর খুব ঘনিষ্ঠ হয়ে উঠলাম। সেই সুবাদে তখন এমন একজন ব্যক্তির সন্ধান পেয়েছিলাম, যিনি কিনা সিপিএম পার্টি অন্ত প্রাণ ! নাম ছিল শান্তিপদ দাশ , যাঁকে কিনা সবাই ‘ মামা’ নামেই তখন চিনতো ।
আজকাল তো পার্টি পলিটিক্স নিয়ে এতো তরজা, হিংসা ! কিন্তু সেইসময় সেই ‘ মামা’কে শুধুমাত্র বামপন্থীরাই যে ভালোবাসতেন , তা নয় , বরং কংগ্রেস এবং ‘৯৮ সালের পর থেকে তৃণমূল কংগ্রেসেও অত্যন্ত ভালোবাসার এবং অবশ্যই শ্রদ্ধার পাত্র ছিলেন সেই অশীতিপর ‘ মামা ‘। তদানীন্তন হাউজিং বোর্ড তখন তিনি কর্মরত ছিলেন , এবং পাশাপাশি তিনি ছিলেন একজন আদর্শ কমিউনিস্ট এবং অবশ্যই পার্টির প্রতি নিবেদিত প্রাণ ! খুব ঘনঘন সিগারেট খাওয়াটা তাঁর একটা বদভ্যাস ছিল , কিন্তু সেটাই ছিল তখন তাঁর ট্রেডমার্ক ! মুখে লেগে থাকতো অমায়িক হাসি ! পোষ্টার লাগানো থেকে শুরু করে স্লোগান সাউটিং , সবেতেই তিনি ছিলেন অপ্রতিরোধ্য।
আকর্ষণীয় চেহারার অধিকারী না হয়েও বাম – ডান সব দলের কাছেই তিনি ছিলেন একাধারে দায়িত্বশীল , এবং অবশ্যই শান্তির দেবদূত ! মনে পড়ে , একবার মামা আমাকে বলেছিলেন ” অন্য দলের সমর্থকদেরও তুই শ্রদ্ধা ও সম্মান করবি, শুধুমাত্র বিরোধিতার জন্য বিরোধিতা নয় !” কথাগুলো হয়তোবা আজও প্রাসঙ্গিক ! আজ বহুবছর আগে সেই ‘ মামা’ প্রয়াত হয়েছেন , কিন্তু তিনি যে ত্যাগের আদর্শ সমাজে রেখে গেছেন, তা সত্যিই তুলনারহিত !