প্রজাপতির স্বপ্ন  

বৈশাখী নার্গিস 

পাড়া বেড়োনোর আগে একমাত্র জানালা আমার বিষাদের মুহুর্ত জেনে যায় নোনা স্রোতে পা ডুবিয়ে নেওয়ার পর পায়ের সামনে পড়ে-থাকা সময়ের ছায়াগুলো অতি আদরে জমিয়ে তারপর, আরও কিছুক্ষন অপেক্ষা যতক্ষণ না দরজায় তার একঘেয়ে টকটক বেজে ওঠে। 

আমার মনে হয় অন্য দিকে ফিরলেই ছায়াগুলো মেঝে থেকে পিছলে গিয়ে রাতের শরীরে হারিয়ে যাবে। ঘন জঙ্গল যেভাবে অপেক্ষা করে থাকে রঙ্গিন প্রজাপতির আমিও সময়ের অসীমতার মাঝে গিলে নিতে থাকি নীরবতা অনেক আশা নিয়ে, চঞ্চল ছায়াগুলো ওৎ পেতে থাকে কখন আমি পাশ ফিরব 

ঠিক তিনটে কুড়িতে যখন ফোনের রিং বেজে উঠল আমি তখন বিছানার উপর হাত পা ছাড়িয়ে সিলিঙয়ের দিকে তাকিয়ে। বসন্ত দুপুরের একখণ্ড রোদ আমার গায়ের উপর। ঠিক যেন একটা মরা মাছি। পাগল, পাগল অনুভূতি নিয়ে অনেককিছু ভাবছি যেন বহুদূর থেকে এক কানাডিয়ান কৃষকের গীটারের সুর বেজে চলেছে আর আমি একতরফা প্রেমের মতো বুঁদ হয়ে অলস প্রেমময় 

প্রথমে ঠিক বুঝতে পারিনি যে ফোনের রিং এটা, বরং মনে হলো অনেকদিনের পুরনো অচেনা স্মৃতি, এই হস্টেলের দেওয়ালের বাতাসে আটকা পড়ে আছে। ধীরে ধীরে শব্দটা একটা অবয়ব পেল, শেষপর্যন্ত মাথায় ঢুকল, ফোন বাজছে একটানা ঝি ঝি পোকার মতো 

আলসে কাটিয়ে ফোন হাতে নিতেই, অন্য দিক থেকে একটা গলা, এত মিহি সমুদ্রের ঢেউয়ের মতো অদ্ভুতভাবে, শুধু বলেই চলেছে আর আমি, যে কিনা হয়তো বিকেল সাড়ে তিনটের ছায়ায় পুরোপুরি হারিয়ে যাব। এমন একটা ভাব করে শুনছি বহুকাল ধরে শুনেই আসছি উত্তরে বলছি- হ্যাঁ, স্বপ্ন দেখছি এই মাত্র একটা প্রজাপতির স্বপ্নে নিজেকে দেখছি আর ছবি আঁকছি আপনি কে বলছেন?

নাহ, উত্তর, আসেনা আর কোনও   

আমি কাল্পনিক চিত্রপটে স্বপ্নের রঙ এঁকে দিই। তুলি হাতে ক্যানভাস জুড়ে শুধু সমুদ্র আর বিষাদ সমুদ্র আর… ঢেউ

যখন ফোন রাখলাম মেঝের উপর পড়ে থাকা আলোটা দু’এক ইঞ্চি সরে গেছে। আমি নিজেও সরে এসে আবার রোদের নিচে শুয়ে পড়লাম, তারপর তাকিয়ে থাকলাম সিলিঙের দিকে। একটা টিকটিকি লেজ নাড়িয়ে আমার কাল্পনিক ছবির দিকে অবাক চেয়ে

কিন্তু না, প্রতিবার আমি ঘাড় নেড়ে নিজের ছায়াকেই বলি না এরকম নয়, অন্যরকম অন্যকিছু– বিশেষ করে বৃষ্টির দিনগুলোতে-আমার কেমন এক অনুভূতি হতো, মনে হতো কেউ একজন এখনই দরজায় কড়া নাড়বে। তবে নির্দিষ্ট কেউ নয়, প্রত্যেকবার আলাদা কারও কথা মনে হতো। কখনো অচেনা কেউ, কখনো এমন কেউ যাকে আমি চিনি। কিন্তু কেউ আসে না এই দুপুর বিকেলের খেলায় আমি হারিয়ে যেতে দিই সময় আমার বৈপ্লবিক চিন্তাধারা ঘোরাফেরা করে চার দেওয়ালে কখনও মাথা ঠোকে পূর্বদিকের ঘড়িটায় আবার ভাবি আমার কি বাস্তু দোষ আছে যার কারণে ঘর শুধু আলসে মাখা চারপাশের কোলাহল ওই গান বাজনা, লোকজনের চলাফেরা কিছুই অবশ্য হস্টেলের ভিতরে ঢোকে না। স্মৃতির ছোট ছোট টুকরোর মতন দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে থাকে সবাই, দরজায় কড়া না নেড়েই, তারপর এক সময় চলে যায়।

বসন্তের পর গ্রীষ্ম,  গ্রীষ্মের পর বর্ষা, আমি কল্পনা করেই গেলাম যেন এই ভাবের ঘোরে থাকা এক ধরনের প্রতিশোধ। হ্যাঁ প্রতিশোধ, কখনো নিজের প্রতি কখনও বা সময়ের গায়ে জ্বালা ধরানোর জন্যে যেভাবে একটা নিঃসঙ্গ, খেয়ালী মেয়ে তার প্রেমিকের লেখা পুরনো চিঠি টুকরো টুকরো করে  সেভাবে আমিও হাতের মুঠোয় সময় কুচি কুচি করে ছুঁড়ে মারতে শুরু করি।

যেসব ছায়া সময় ধরে ছবি হতে থাকে তাদের নিয়ে খুব বেশি ভাবাও কেমন উদ্ভট ব্যাপার। এখন আমার মাঝে মাঝে দুঃখ হয়,  তবে খুব সামান্য, আমি কাউকেই কিছু বলিনি। হয়তো বলা উচিৎ ছিল। এই দেওয়াল ঘড়ি, দরজা, ক্যানভাস সব কিছু আমার আত্মীয় দেওয়ালও ফিসফিস করে আমার সঙ্গে কথা বলতে চায় আমি বুঝি সব   

ফোন রেখে দেওয়ার পর মনে হয়েছিল, আসলেই কি সে বিকেল সাড়ে তিনটের ছায়ায় হারিয়ে গেছে? এর মানে কি আমিও এর জন্যে খানিকটা দায়ী? আমি অবশ্য চাই সবাই আমার অবস্থাটা বুঝুক। আসলে ঐ সময়ের ভেতর আমি কারো সাথে জড়াতে চাইনি। এই যেমন এখন কুলকুল শব্দের ভেতর একটা দিগন্ত বিস্তৃত খোলা মাঠ আমার মধ্যে জন্ম নিচ্ছে, আর আমি নিজেই সেই সবুজে মাথা তুলছি 

শেয়ার করতে:

You cannot copy content of this page