মন নিয়ে কত কথা
মনের অনেক দরজা আছে, সেখান দিয়ে অসংখ্যজন প্রবেশ করে এবং বের হয়ে যায় তাই সবাইকে মনে রাখা সম্ভব হয় না। আসলে মানুষ দ্বিমনা। তার ভেতরে দুটি মন আছে, একটা খোলা মন একটা ভালো মন। তার একটা অবজাত একটা অভিজাত। তাদের একজন ছোটলোক একজন ভদ্রলোক। আর আমাদের মনের উপর কারও হাত নেই। আজ মন নিয়ে আলোচনায়
পিনাকী চৌধুরী এবং শিখা গাঙ্গুলী।
পিনাকী :- আমাদের মন বড়ই বিচিত্র ! এই এখানে তো পরমুহূর্তেই সুদূর কোনো নাম না জানা দেশে ! লক্ষ্য করে দেখেছেন কি ইদানিং আমাদের ডিপ্রেশনের বাড়বাড়ন্ত হয়েছে। কি মনে হয় আপনার ?
শিখা- মনের হদিশ একমাত্র মনের মালিক ছাড়া আর কি কেউ জানে, বোঝে। মন সময়ের থেকেও দ্রুত গতিতে চলতে পারে, আমার মনে হয়। আর ডিপ্রেশন সেটা তো বাড়তে বাড়তে মাথার ওপর।
পিনাকী :- হ্যাঁ একদমই তাই। এই প্রসঙ্গে বলি, গীতার একটি শ্লোকে বলা হয়েছে ” কামনা বাধাপ্রাপ্ত হলে, তাহা হইতে ক্রোধের উদ্ধব হয় ” ! আর এই ক্রোধ যতই আমাদের গ্রাস করে এবং আমাদের পার্থিব জীবনের চাহিদা যত বেশি হবে, এই ডিপ্রেশন আরও বাড়বে !
শিখা- আসলে এই ডিপ্রেশন কথাটাই তো নতুন। যেখানে ছিল মনের ব্যাপার। মন খারাপের কারণ হতো। এখন সেটার গাল ভরা নাম ডিপ্রেশন।
কেন আসে এই ডিপ্রেশন, একটু বলতে পারবেন, আপনার মতে…
পিনাকী :- মনস্তাত্ত্বিক দিক থেকে বিচার করলে এর একাধিক কারণ রয়েছে, তার মধ্যে না পাওয়ায় বেদনা যেমন রয়েছে, ঠিক তেমনই যে কোনো ধরনের ভয়ভীতি অপর একটি কারণ । এছাড়াও পরীক্ষায় অকৃতকার্য হওয়া, কর্মস্থলে আশানুরূপ উন্নতি না হওয়া এবং প্রেমে প্রত্যাখ্যাত হয়ে অনেকেই এই ডিপ্রেশনের শিকার হন।
শিখা- ঠিক তাই, কিন্তু এ বাইরেও আরও অনেক কিছুই রয়েছে। কারোর সাথে মিশতে না পারার ভয়, অন্ধকারের ভয়, কথা বলতে পারার ভয়। তার পর কে কি বলবে সেই ভয়। মনের উপর জোর খাটানো যায় কি কখনো?
পিনাকী – আমরা আমাদের মনকে নিয়ন্ত্রণ করতে অক্ষম, বরং মনই আমাদের নিয়ন্ত্রণ করে। মোদ্দা কথা হচ্ছে মন হল অবাধ্য।
শিখা- আমার যেমন অনেক কিছুতে ভয় রয়েছে। আপনারও সেরকম কিছু রয়েছে। আসলে আমাদের প্রত্যেকেরই এই মন সংক্রান্ত কিছু না কিছু ভয় রয়েছেই। যেখান থেকে কেউ বেঁচে ফিরতে পারে, কেউ অচিরেই হারিয়ে যায়। যেমন সুশান্ত সিং রাজপুত, যেমন পারভিন ববি, এরকম আরও অনেকেই রয়েছেন, যাঁদের আমরা হারিয়েছি। আসলে মন খুলে কথা বলার মানুষের অভাব।
পিনাকী – ধ্রুব সত্য ! এপ্রসঙ্গে বলি, কেউ যদি এই ভয়ানক ডিপ্রেশনের শিকার হন, তাহলে যদি তিনি পাঁচ জনের মধ্যে গিয়ে বসেন এবং কোনো কথা না বলে, যদি অপর ব্যক্তিদের সাবলীল ও মনোগ্রাহী কথাগুলো শুধুমাত্র শ্রবণ করেন, তাহলে অবশ্যই তিনি সাময়িক স্বস্তি বোধ করবেন।
শিখা- আর এখানে যদি সেই ইচ্ছেটাই না থাকে, অথবা প্রিয় মানুষটাকে ছাড়া আর কারোর সঙ্গেই খোলাখুলি সে কথা বলতে না পারে, তখন?
পিনাকী – কিছুটা হলেও বিশ্বাস করতে হবে অপর কাউকে।
শিখা- কিন্তু যারা ডিপ্রেশনের শিকার হন, অধিকাংশ সময় তাঁদের কথার গুরুত্ব দিতে চান না অনেকেই। হেসে উড়িয়ে দেন, আর এতেই ঘটে বিপত্তি। তখন সেই মানুষটি নিজেকে গুটিয়ে রাখতে রাখতে আরও বেশি ডুবে যান ডিপ্রেশনের ভেতর, মন তখন এটাই বিশ্বাস করে, যে তার কথা কেউ শুনতে চায় না, তাঁকে সবাই একা করে দিতে চায় শুধু, তার জন্যে কারোর সময় নেই। আর অন্ধকার আরো বেশি চেপে ধরে, ভুল সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য হয়। কিন্তু সঠিক সময়ে যদি সঠিক লোক কথা বলত, তাহলে হয়ত ভালো কিছুই ঘটত। আমরা এই জেট যুগে শুধু সোশ্যাল মিডিয়ার দেখনদারিতে বিশ্বাস করি। কেউ কথা বলি না এঁকে অপরের সাথে। যেটা আগেকার দিনে সম্ভব ছিল না, তার কারণ জয়েন্ট ফ্যামিলি।
পিনাকী- ঠিক তাই । পারস্পরিক মেলামেশা কমেছে, আরও কমেছে ভাবনার আদান প্রদান , যেগুলো সম্ভবপর ছিল অতীতের সেই একান্নবর্তী পরিবারে।
শিখা- আবার একান্নবর্তী পরিবারেও অনেক সমস্যা রয়েছে। কিন্তু সেগুলো বাদ দিয়ে মানসিক কথা বলার সময়গুলো ছিল। এখন সময় এত দ্রুত চলছে, মানুষ এত দ্রুত নিজের ভাবনা বদলে নিচ্ছে। আজ এক রিলেশন, কাল এক রিলেশন, আজ এই জব, কাল এই জব। আজ এই কথা, কাল এই কথা। স্থির নেই কেউ। শুধু ইঁদুর দৌড় ছাড়া যেন জীবন নেই। মনের সমস্যার সমাধান নেই, তাই…
পিনাকী – এর থেকে পরিত্রাণ পাওয়ার বিভিন্ন উপায় রয়েছে, যেমন অফিসের ঝামেলা বাড়িতে এসেই ভুলে যাওয়া। নিজের সাধ এবং সাধ্যের পার্থক্যটা বুঝতে পারা । এছাড়াও দিনের একটা সময়ে যদি মেডিটেশন করা যায়, তাহলে হয়তো আমাদের মনটা অনেক উজ্জীবিত হয় ।
শিখা- হ্যাঁ, তার সঙ্গে বন্ধুবান্ধবদের সঙ্গে সময় কাটানো, প্রিয়জনকে জানিয়ে রাখা যে তার এই সমস্যা রয়েছে। যেন সে তার পাশে থাকে। এই মনের অবস্থা থেকে তাঁকে ধীরে ধীরে বের করে আনে। অবশ্যই বন্ধুদেরও এটা জানা প্রয়োজন। আর সেই মানুষটিকে যথাসাধ্য সেই অবস্থা থেকে সরিয়ে আনার চেষ্টা করা উচিৎ। তার কথা শোনা প্রয়োজন। কোথায় সমস্যা হচ্ছে, সেটা খতিয়ে দেখা প্রয়োজন। ‘হয়ত মধ্যরাতে কখনো কোনও বন্ধুর কাছে ফোন এলো, আর সে ইগনোর করে গেল ব্যাপারটা, সকাল হতেই দেখল অনেক দেরি হয়ে গেছে’, এই ব্যাপারটা যাতে না হয়। সব শেষে যদি এতেও না কমে, তাহলে মনোবিদ তো রয়েছেনই। হাসুন এবং হাসাতে থাকুন। বাঁচুন এবং বাঁচান। তাই নয় কি!
পিনাকী – হ্যাঁ আমাদের হয়তো আরও মানবিক হতে হবে। এছাড়াও শিশুদের সঙ্গে সময় কাটাতে হবে এবং চটুল হিন্দি গান নয় , বরং কিছু রবীন্দ্র সঙ্গীত শুনতে হবে। এক্ষেত্রে মিউজিক থেরাপি বেশ আশাপ্রদ ফল দেয়।
শিখা- ঠিক তাই, সবসময় মনে রাখতে হবে, মন খুলে হাসির মতো আর কোনো ওষুধ নেই। নমস্কার! ভালো থাকবেন আপনি।
পিনাকী- আপনিও ভালো থাকবেন। সুস্থ থাকবেন।