সুবর্ণভূমে পুষ্পকেতু

অনন্যা পাল

শেষ পর্ব 

‘কাটিগার ও অভিরাজ দুইক্ষেত্রেই বিষবাহী পানীয় ও খাদ্য পরিবেশন করেছিল কোনও আটবিক সেবক, আর তাদের প্রভু হলেন ত্রিগুণবর্মা, সেইথেকেই সন্দেহ প্রবল হয়। জম্বুক তার বয়ানে জানিয়েছিল, সুরা বয়ে নিয়ে যাবার কালে মৎসাণ্ড ভক্ষণ করতে বোরা অঙ্গনে দাঁড়িয়েছিল কিছুসময়। প্রথমদিকে কথাটির গুরুত্ব না বুঝলেও, কর্মরাঙ্গা কাণ্ডের কথা জানার পর ঘটনাটি আমাকে চিন্তিত করে তোলে, তখনই জম্বুককে দ্বিতীয়বার প্রশ্ন করে জানতে পারি, সে বোরাকে পিছন থেকে দেখে ধরে নিয়েছিল সে ভক্ষণ করছে। বাস্তবে, বিষ মেশানোর কাজটি তখনই করেছিল বোরা। সুরাপাত্রে মক্ষিকা পড়েছে, এটি সম্ভবতঃ বিষপ্রয়োগের সঙ্কেত বাক্য ছিল বোরার প্রতি, সেসময়, তাকে ভাণ্ডের সুরা ফেলে দিয়ে নূতন করে ভরে আনতে বলে উদয়বর্মা অজান্তে সাহায্যই করেন।‘

‘অমরাবতী হত্যাকাণ্ডে যুক্ত নয়, এই বিশ্বাস কেন হোল আপনার; বিশেষতঃ যখন তাদের প্রতিহিংসার বিভৎস্য রূপ প্রত্যক্ষ করেছি আমরা অল্পদিন আগেই?’ মকরধ্বজ জানতে চান।

‘ভদ্রবর্মণ বীরপুরুষ, অমরাবতীকে শিক্ষা দিতে গুপ্তহত্যার সাহায্য নেবেন, বিশেষতঃ সেই হত্যায় একটি শিশুকে সামিল করবেন, এ আমি মানতে পারিনি কিছুতেই।‘

বাইরে সন্ধ্যা নেমে আসে ধীরে, সভাভঙ্গ হয় সেই সাথে। বহূদিন বাদে নিজকক্ষে গিয়ে বীণায় সুর ধরেন কুমার, মন্দ্রমধুর সুরলহরীর আবেশে পরিপূর্ণ হয়ে ওঠে পরিবেশ।

এরপর… 

অরুণোদয়

রাজসভায় সর্বসমক্ষে মগধশক্তি ও পুষ্পকেতুর প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেছেন মহারাজ চন্দ্রদমন, সেইমত সম্রাটের উদ্দেশ্যে একটি লিপি প্রদান করেন তিনি ধূর্জটিদেবকে। বিশেষ নৃত্যগীতের আয়োজনে উৎসবমুখর হয়ে ওঠে সভাকক্ষ, প্রজাদের ঘরে ঘরেও ছড়িয়ে পড়েছে আনন্দবার্তা, শ্রীপদ্মনাভ মন্দিরে চলছে বিশেষ পূজার্চনা।

মহারাজের একান্ত বিশ্রামকক্ষে মুখোমুখি হয়েছেন তিনি পুষ্পকেতুর সাথে, কিছু আগে তাঁরই ইচ্ছায় দুজনে মধ্যাহ্নভোজন করেছেন একসাথে; পট্টমহিষী ও রাজকুমারী উপস্থিত ছিলেন আহার্য পরিবেশন কালে।

‘আমার সৌভাগ্য আপনাকে এই ঘোর সঙ্কটে পাশে পেয়েছিলাম কুমার, না হলে কি যে হোত ঈশ্বরই জানেন।‘

‘ধরে নিন ঈশ্বরই করিয়েছেন এই কার্য, আমি তো নিমিত্ত মাত্র।‘

‘হ্যাঁ আপনি সত্যই দেবদূত হয়ে এসেছেন কুমার, সেকারণেই আপনাকে ছেড়ে দিতে মন চায় না। আপনি অসাধারণ ব্যক্তি, অনেক মহৎ কার্য সম্পন্ন হবে আপনার দ্বারা ভবিষ্যতে, এ আমি বিশ্বাস করি।‘

‘আপনার প্রশংসা বাক্যে ধন্য বোধ করছি রাজন। আপনার এই আন্তরিকতা আমার চিরকাল স্মরণে থাকবে।‘

‘শুধু স্মৃতিতে নয়, বাস্তবে আপনাকে পাশে পেতে চাই কুমার; সে উদ্দেশ্যে একটি প্রস্তাব আছে। সোমাশ্রীকে আপনার হস্তে সমর্পন করতে চাই আমি, পট্টমহিষীরও সেরকমই ইচ্ছা, আমি জানি সোমাশ্রীও অরাজী হবে না এই বিবাহে।‘

‘এ আমার সৌভাগ্য রাজন।‘ অভিভূত স্বরে উত্তর দেন পুষ্পকেতু।

‘বিবাহের পশ্চাতে আপনাকে যুবরাজ ঘোষণা করব আমি, শৈলদেশের উত্তরাধিকারত্ব আপন মহিমায় অর্জন করেছেন আপনি।‘ মহারাজের পরবর্তী বক্তব্য শুনে বহুক্ষণ স্তব্ধ হয়ে থাকেন কেতু, অবশেষে উত্তর দেন মন্দ্রস্বরে।

‘সোমাশ্রীকে তাঁর নিজগুণে গ্রহণ করতে সম্মত ছিলাম আমি, কোনও শর্তসাপেক্ষে নয়। আপনি যৌবরাজ্যের প্রস্তাব করেছেন, এতে আমি সম্মানিত, কিন্তু সে সম্ভব নয় রাজন। এদেশে এসেছিলাম পর্যটকের মত, ফিরে যাব কিছু মধুর স্মৃতি ও অভিজ্ঞতা নিয়ে; আমার আনুগত্য শুধুমাত্র মগধ রাষ্ট্রের প্রতি, এর অন্যথা হবে না কোনও অবস্থাতেই।‘

‘ধন্য আপনার পিতা-মাতা, ধন্য মগধ দেশ; আপনি সফল হোন জীবনের পথে এই কামনাই করি। তবু ধরে রাখতে পারলাম না আপনাকে, এই ক্ষেদ রয়ে যাবে মনে।‘ মহারাজের কন্ঠস্বরে হতাশা ফুটে ওঠে।

সুবর্ণভূমে পুষ্পকেতু

***

ভাদ্রমাসের শুক্লাপঞ্চমী, রাজকীয় তরণীতে কাটিগার যাত্রা করবেন মগধ প্রতিনিধিদের দল, মহারাজ নিজে এসেছেন তাঁদের বিদায় জানাতে। মকরধ্বজ যাবেন সঙ্গে কাটিগার অবধি, একটি পৃথক তরণীতে সোমাশ্রী চলেছেন অভিরাজকে সঙ্গে নিয়ে। প্রণালীর দুইপাশে রঙীন পতাকার সারি দিয়ে সুসজ্জিত করা হয়েছে জনপথ, সেখানে নগরবাসী সারে সারে দাঁড়িয়ে আছে অতিথিদের সম্ভাষন করতে, কারো হাতে ফুলমালা, কারো বা শঙ্খ; এই আন্তরিক কৃতজ্ঞতায় সজল হয়ে ওঠে মাগধী যাত্রীদের চক্ষু।

‘আপনাদের অভাব অনুভব করব খুবই, এ কটামাস বড় আনন্দে কেটেছিল আপনাদের সান্নিধ্যে।‘ কথাগুলি বলতে বলতে কন্ঠরোধ হয়ে আসে মকরধ্বজের। কাটিগার বন্দরে উপনীত হবার পূর্বদিন সন্ধ্যায় তরণীর বিশামকক্ষের জমায়েত বড় আবেগমেদুর।

‘শুনতে পাই আপনি উপমন্ত্রীণ পদ পেয়েছেন অমাত্য সৌমিকের অধীনে? আপনাকে অভিনন্দন।‘ পুষ্পকেতুর কথায় হাসি ফোটে মকরধ্বজের মুখে।

‘ভদ্র তাহলে এদেশেই থেকে গেলেন কি বলুন?’ উল্মুক মন্তব্য করেন।

‘হ্যাঁ, দেশে ফেরার তেমন কোনও পিছুটান তো নেই, এদেশের মানুষ ভালোবেসে আপন করে নিয়েছেন, সে আমার সৌভাগ্য।‘

‘প্রয়াত মহামাত্যের কনিষ্ঠা কন্যাটি ভারি লক্ষীমন্ত, শুনেছি সেকথা; আপনি সুখী হবেন ভদ্র।‘ উল্মুকের কথায় রক্তিম হয়ে ওঠে মকরধ্বজের মুখমণ্ডল।

***

চতুর্দশীর পূণ্য প্রভাতের প্রথম প্রহর, কাটিগার বন্দরের উন্মুক্ত বেলাভূমিতে মুখোমুখি দাঁড়িয়ে পুষ্পকেতু ও সোমাশ্রী; পূবের আকাশ অগ্নিবর্ণ হয়ে উঠছে ধীরে ধীরে, আর তারই লালিমায় সমুদ্রের জল যেন তরল সোনা।

‘আমার কারণে মনে কোনও ক্ষেদ রাখবেন না রাজকুমারী, এই বিচ্ছেদ আমাদের ভবিতব্য।‘

‘ভবিতব্যকে পুরুষাকার দিয়ে জয় করাও যায় দেব।‘

‘সত্যকার পৌরুষ কর্তব্যপরায়নতায়; আজ আবেগের বশে যদি আদর্শ ত্যাগ করি একইভাবে সম্মান করতে পারবেন কি আর্যে?’

‘ভেবে দেখিনি সেকথা, তবে এটুকু জানি, যদি একবার আহ্বান করেন, একবস্ত্রে সঙ্গী হতে পারি আপনার’, সোমাশ্রীর অশ্রুধোয়া মুখশ্রী ভোরের শিশিরের মত আবেগে টলমল।

‘সোমা! এই প্রীতিটুকু সম্পদ হয়ে থাকবে চিরকাল। তুমি সুখী হবে দেবী, আমার আশীষ রইল।‘

সমুদ্রকুল থেকে ভেসে আসে আচার্যের কন্ঠে বেদমন্ত্র ধ্বনি, মুহূর্মুহূ বেজে ওঠে মঙ্গলশঙ্খ, আর দেরী নেই, সময় হয়েছে সুদুর যাত্রার, দীর্ঘমুহূর্ত একে অন্যের পানে চেয়ে থাকেন দুজনে তৃষিত নয়ণে। প্রিয়তমার কোমল মুখচ্ছবি বুঝিবা চিরকালের মত ধরে রাখতে চান নিজের দুচোখে পুষ্পকেতু; বিদায় বেলার সম্ভাষণ প্রকাশ পায় রাজকুমারীর নীরব অশ্রুতে।

***

অর্ণবপোতে উপস্থিত হয়েছেন পুষ্পকেতু ও উল্মুক, উন্মুক্ত পাটাতনে দাঁড়িয়ে লক্ষ্য করছেন মালবাহী সেবকদের আনাগোনা। সহসা, দ্বৈরথ এসে একখানি লিপি এগিয়ে দেয় কুমারের পানে।

‘কি এ?’ বিস্মিত হন কেতু।

‘এক পণ্যবাহক এটি আপনাকে দিতে বলে অদৃশ্য হোল নিমেষে।‘

লিপিখানি তৎক্ষনাৎ খুলে দেখেন পুষ্পকেতু;-

“শ্রী শ্রী ভদ্রেশ্বর সহায়।।

কুমার পুষ্পকেতু,

আপনার অকৃত্রিম প্রচেষ্টায় শৈলদেশে ঘটিত হত্যাকাণ্ডের কলঙ্ক কলুষিত করতে পারেনি অমরাবতীর মর্যাদাকে, এর জন্য আপনার প্রতি আমি আন্তরিক ভাবে কৃতজ্ঞ। এই যাত্রায় সিংহপুর আপনার উপস্থিতি থেকে বঞ্চিত হোল, আশা রাখব ভবিষ্যতে সেই আশা পূর্ণ হবে, হয়তো বা কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপনের সুযোগ ঘটবে তখন। আপনার যাত্রা শুভ হোক।

যুবরাজ ভদ্রবর্মন।“

‘আশ্চর্য, এত সংবাদ রাখেন যুবরাজ সুদুর সিংহপুরে বসে?’ উল্মুক বিস্ময় চেপে রাখতে পারেননা লিপি পাঠ করে।

‘তাহলেই বুঝতে পারছ, কি নিপুণ তাঁর গুপ্তচর বাহিনী? ভদ্রবর্মনের সামরিক প্রতিভা তাঁকে কালজয়ী করবে সুবর্ণভূমির ইতিহাসে। এ ভাবে কৃতজ্ঞতাজ্ঞাপনেও তাঁর মহত্তই প্রকাশ পেয়েছে।‘

‘হ্যাঁ, ভদ্রবর্মন আদর্শ ক্ষত্রিয়পুরুষ, শত্রুতা যেমন ভোলেন না, উপকারও না’, উল্মুক মন্তব্য করেন স্বভাবসিদ্ধ রসিকতার ভঙ্গীতে।

আবার এসো ফিরে

***

মাগধী নৌবহর কটাহ বন্দরে এক পক্ষকাল কাটিয়ে, আবার যাত্রা শুরু করেছে আর্যাবর্তের উদ্দেশ্যে; কটাহ থেকে গৃহে ফিরে গেছে ধী, যাবার কালে তার সরল চোখের অভিব্যক্তিতে ছিল কৃতজ্ঞতা ও ভালোবাসার অপূর্ব মিশ্রণ। সেসময়ে দ্বৈরথও স্থির থাকতে পারেনি, আন্তরিক আলিঙ্গনে বিদায় জানিয়েছিল সে অরণবাসী বালককে। পর্যটক জীবনের রীতিই যে এই, এখানে চলার পথে সঞ্চিত হয় অজস্র স্মৃতি, তার সাথে জড়ো হয় বিচ্ছেদ বেদনাও।

পুরোনো অভ্যাস মত গোধূলিবেলায় উন্মুক্ত পাটাতনে দাঁড়িয়ে পশ্চিম দিগন্তে রঙের খেলা প্রত্যক্ষ করছেন পুষ্পকেতু, তাঁর দুচোখের দৃষ্টি আনমনা, উদাসীন।

‘কি ভাবছ বন্ধু?’ উল্মুক অলক্ষ্যে পাশে এসে দাঁড়িয়েছেন তাঁর।

‘ভাবছি এমনই এক গোধূলিবেলার কথা, সেদিনও রামধনু খেলা করেছিল জলের প্রতিবিম্বে, আর সেই আলোয় এক অপরূপা তার হৃদয়ের সবটুকু উজাড় করে দিতে চেয়েছিল আমায়।‘

‘আমি তো আগেও বলেছি কেতু, আদর্শের জন্য অনেক দুঃখ পেতে হবে তোমায়।‘

‘দুঃখ দিতেও যে হবে, শুধু সে কথাটিই জানা ছিল না। সে কি ক্ষমা করতে পারবে আমায় কোনওদিন, বন্ধু?’

‘গৃহের নিভৃত কোনে, একাকী মুহূর্তে সে তোমাকে স্মরণ করবে চিরকাল, সেসময় গোপন গর্বে ভরে উঠবে তার দুটি আঁখি; একথা নিশ্চিত জেনো।‘

উন্মুক্ত সমুদ্রে ভেসে চলে অর্ণবযান, আবার নতুন প্রভাত, আবারও নূতন ঠিকানা, হয়তো এভাবেই ভেসে চলবেন পুষ্পকেতুও নির্মোহ যাযাবরের মত আর সঞ্চয় করবেন বিচিত্র অভিজ্ঞতা।

শেয়ার করতে:

You cannot copy content of this page