সুবর্ণভূমে পুষ্পকেতু

সপ্তম পর্বের পর…

অনন্যা পাল

মঙ্গলানুষ্ঠান

নগরীর কেন্দ্রস্থল ছাড়িয়ে উত্তর পূর্ব দিশায় এক বনভূমি সংস্কার করে তৈরী হয়েছে অনন্ত-বাসুদেব মন্দির; জলপূর্ণ পরিখা ঘেরা সুবিশাল মন্দির চত্ত্বরের মোট চারখানি তোরণ; যদিও পূর্ব তোরণটিই মূল প্রবেশ দ্বার। পরিখার উপর তৈরী পাথরের সেতু তোরণ অবধি গিয়েছে, সেতু মুখের দুপাশে দুটি অনন্তনাগের মূর্তি নয়মুখী ফণা বিস্তার করে উদ্যত রয়েছে দ্বারপালের মত, তাদের বিশাল দেহ সর্পিল ভঙ্গিতে সেতু-প্রাচীর বেয়ে সিংহদরজা অবধি বিস্তৃত। সুবিশাল মন্দির প্রাঙ্গনে রয়েছে পুষ্করিনী ও তার চারপাশ ঘিরে সুরম্য উদ্যান; প্রাঙ্গনের একপাশে অতিথিশালা, ধর্মসভাগৃহ, অন্যপাশে পাকশালা ও ভান্ডারগৃহ। মূল মন্দিরে প্রবেশের একখানি সুউচ্চ দরজা, তার ভিতরে পাথরে বাঁধানো অঙ্গন, সেই অঙ্গনের বহির্প্রাকার সংলগ্ন আটদিকে অষ্টদিকপালের পূজাগৃহ; মন্দিরগৃহটির ভিত ভূমি থেকে অনেকটা উত্থিত, সুপ্রশস্ত সিঁড়ি চলে গেছে প্রবেশদ্বার অবধি। মন্দিরগাত্র ও প্রাচীরে সুক্ষ ভাস্কর্যে কোথাও ফুটে উঠেছে অপ্সরা বা কিন্নর কিন্নরী, আর কোথাও পাতালরাজ্যে নাগকন্যাদের প্রতিকৃতি। মূলভবনের চারপাশ বেষ্টন করে প্রশস্ত অলিন্দ এবং অলিন্দের দেওয়ালে সমুদ্রমন্থন, বিষ্ণুর অনন্তশয্যা, ত্রিশক্তি অর্থাৎ ব্রহ্মা, বিষ্ণু, মহেশ্বর এবং দেবীলক্ষীর আবির্ভাবের কাহিনীর অনুপম ভাস্কর্য। ভিতরে প্রবেশ করে প্রথমে একটি চতুষ্কোন সভাগৃহ, তার ভিতরে দর্শনকক্ষ এবং সর্বশেষে গর্ভগৃহ, সেখানে কুন্ডলীকৃত সর্পদেহে অর্ধশায়িত মঙ্গলময় শ্রীবিষ্ণুর স্বর্ণমূর্তি, তাঁর মাথার উপর অনন্তনাগের সুবিশাল ফণা। বিগ্রহের চার হাতে শঙ্খ, চক্র, গদা, পদ্ম, মুখভাব করুণাঘন, চরণকমলে মণিখচিত স্বর্ণনুপুর। নাগের ফণার চক্ষুগুলি একেকটি গাঢ় সবুজ বর্ণের মরকতমণি, প্রদীপের আলোয় যেন সম্মোহনী তাদের দৃষ্টি।

অনুষ্ঠান উপলক্ষে পুষ্করিনীর দুইপাশে চন্দ্রাতপ যুক্ত অস্থায়ী মণ্ডপ তৈরী হয়েছে, তার একটিতে যজ্ঞানুষ্ঠানের ব্যবস্থা ও অন্যটি বিশিষ্ট অতিথিদের বসবার স্থান। পাঁচদিন ব্যাপী মঙ্গলানুষ্ঠান, অতিথি হবেন মালব উপত্যকার রাজপ্রতিনিধিরা, শোনা যাচ্ছে আসবেন অমরাবতীর যুবরাজও; এছাড়া বিশিষ্ট বণিক ও সামন্ত রাজারাও সামিল হবেন এই মহাযজ্ঞে। অনুষ্ঠানের শুরুতে প্রথম দিন নবস্বর্ণকলসযাত্রা ও শিখরস্থাপনা। এরপর তিনদিন যজ্ঞাহূতি ও হোম, তৃতীয় দিনে বিগহে প্রাণ প্রতিষ্ঠা, আর বাকী দুদিন সামগান, ব্রাহ্মণ অর্চনা ও দান। উৎসব উপলক্ষে সেজে উঠেছে সমস্ত নগরী, পান্থশালাগুলিতে পর্যটকদের ভীড়; রাজ্যের অন্যদুটি গুরুত্বপূর্ন নগরী অনিন্দিতপর ও শ্রেষ্ঠপুর থেকে বিশিষ্ট ব্যক্তিরা এসেছেন মন্দির প্রতিষ্ঠা উপলক্ষে।

***

রাত্রি অবসানের ব্রহ্মমূহূর্ত থেকেই মঙ্গলশঙ্খধ্বনি দিয়ে শুরু হয়েছে উৎসবের আচার, আচার্য ধূর্যটিদেবের নেতৃত্বে দশজন বৈদিক ব্রাহ্মণ বসেছেন পূজায়। প্রথমেই ভগবদ অনুজ্ঞা, অর্থাৎ স্বর্গস্থ দেবতাদের অনুমতি নেওয়া ও তারপর গণপতি পূজা দিয়ে শুভারম্ভ। সম্মিলিত স্বরে বেদমন্ত্রের উচ্চারণে মাঘের নবীন সকাল ধ্যানগম্ভীর, অতিথিরা চন্দ্রাতপ ঘেরা বসবার স্থানে উপস্থিত হতে শুরু করেছেন একে একে। মহারাজ চন্দ্রদমন পূজামঞ্চে ব্যস্ত, সেকারণে কুমার উদয়, ত্রিগুণ ও দুর্জয় বর্মা সহ উচ্চপদস্থ রাজপ্রতিনিধিরা অতিথি অভ্যর্থনায় উপস্থিত আছেন মন্দির প্রাঙ্গণে।

পুষ্পকেতু ও উল্মুক প্রাতঃস্নান ও ফলাহার সেরে প্রস্তুত হয়েছেন অনুষ্ঠানে অংশ নিতে; কুমার  মগধেশ্বরের প্রতিভূ, তায় রাজবংশজাত, উৎসব দিনে তাঁর সাজসজ্জাও সেকারনে বিশিষ্ট। ঘৃতবর্ণ কাশীপট্টের চওড়া রেশমী পাড় দেওয়া অন্তরীয়, স্বর্ণজরির কাজ করা অঙ্গরক্ষা ও সুক্ষ চিনাংশুকের অঙ্গবস্ত্রে তিনি যেন ভোরের অংশুমালী; রূপ ও বুদ্ধির ছটায় দীপ্ত। আজকে আর পদব্রজে নয়, হস্তিপৃষ্ঠে রওয়ানা হন দুই মিত্র।

চন্দ্রাতপের ঘেরাটোপে বিশেষ আসনের ব্যবস্থা হয়েছে মাননীয় অতিথিদের জন্য, পুষ্পকেতু ও উল্মুক বসেছেন সেখানে; রয়েছেন কটাহ রাজ্যের যুবরাজ, কর্পূরদ্বীপের রাজভ্রাতা ও কিছু চৈনিক রাষ্ট্রদূত। সুগন্ধী তক্র ও তাম্বুলযোগে আপ্যায়ন চলছে সম্মানিত অতিথিদের, রাজ কর্মচারী ও সেবকদের চলাচলে স্থানটি প্রথম প্রভাতেও কোলাহলপূর্ন।

‘চল ঘেরাটোপের বাইরে থেকে ঘুরে আসি, স্থানটি ভালোমত পরিদর্শন করা হবে’, পুষ্পকেতু প্রস্তাব করেন।

‘সেই ভালো, রাজা রাজরার রীতিনীতিতে হাঁপিয়ে উঠেছি যাহোক’, উল্মুক উৎসাহভরে সম্মতি দেন।

দুই বন্ধু এরপরে মূল মন্দির অঙ্গণে প্রবেশ করেন, মন্দিরের দ্বার রুদ্ধ, খোলা হবে বিগ্রহে প্রাণ প্রতিষ্ঠার প্রাক্কালে, প্রাচীর ঘেরা অঙ্গনেও প্রহরা, তবে রাজ অতিথিদের প্রবেশে বাধা নেই সেখানে। প্রাচীর ও মন্দির গাত্রের অসামান্য ভাস্কর্য দেখতে দেখতে দুই বন্ধু আলাদা হয়ে পড়েছেন কিছুটা; কুমারের সৃষ্টিশীল সত্ত্বা বুঝিবা আত্মবিস্মৃত হয়েছে আরেক অসামান্য সৃষ্টির মহিমায়। একখানি অপ্সরামূর্তি, মধুর বিভঙ্গে দাঁড়িয়ে আছে সে অন্যমনে, হাতে একখানি মালা, বসন্ত প্রভাতের নরম আলো পড়ে তার মুখশ্রী বড় মোহময়, মুগ্ধচোখে তাকিয়ে থাকেন কুমার। ধীরে একটি ছায়া ঘন হয় সূর্যালোক আড়াল করে, সেদিকে চোখ ফেরান কেতু, দুচোখের মুগ্ধতা বুঝিবা বেড়ে যায় আরও। সামনে দাঁড়িয়ে যে সেও কি অপ্সরা? তেমনই কমনীয় দেহভঙ্গী, বস্ত্র পরিধানের ধরণটিও একইরকম আকর্ষণীয়, অপরূপ মুখশ্রীতে সরল কৌতুহল, সারা অঙ্গে যেন নারীত্বের জয়জয়কার, তবু কোনও ঔদ্ধত্ব নেই তাতে। একে অন্যের পানে চেয়ে থাকেন দুজনে না জানি কতক্ষণ, অবশেষে নারীমূর্তি প্রশ্ন করে সলজ্জ ভঙ্গীতে, ‘কে আপনি?’ তার কন্ঠস্বর সুরলিত সঙ্গীতের মত শোনায় মন্ত্রমুগ্ধ কুমারের কানে; তিনি নিশ্চুপ হয়ে থাকেন মোহাবিষ্ট অনুরাগীর মত।

‘ইনি কুমার পুষ্পকেতু, মগধেশ্বরের প্রতিভূ হয়ে এসেছেন এই রাজ্যে; আপনার পরিচয় কি আর্যে?’ ইতিমধ্যে কুমারের পাশে এসে উপস্থিত হয়েছেন উল্মুক। উল্মুকের উত্তরে সমীহ জেগে ওঠে তরুণীর চোখে, নিজ পরিচয় দিতে ইতস্তত করে সে।

‘রাজকুমারী, পূজামঞ্চে ডাক পড়েছে, আর কত বিলম্ব করবেন?’ প্রাচীর দ্বার থেকে দ্রুত পায়ে এগিয়ে আসে এক সখী ঠিক সেই মূহূর্তে, মুখের কথা অব্যক্ত রেখেই ধীরে স্থান ত্যাগ করেন কন্যা, যেতে যেতে এক গভীর দৃষ্টিতে অভিষিক্ত করে যান তরুণ পুষ্পকেতুর মনপ্রাণ।

‘তুমি যে একেবারে বাক্যহারা হয়ে পড়লে হে, ব্যাধপুরে এসেই বধ হলে শেষমেষ?’

‘কি যে বল উল্মুক, সব তাতেই তোমার রসিকতা’, এতক্ষণে কথা বলেন পুষ্পকেতু অপ্রস্তুত স্বরে।

‘রসিকতা নয় একেবারেই, রাজদুহিতার দৃষ্টিবাণে বধ হওনি বলতে চাও?’ কথাটি বলে হেসে ওঠেন কৌতুকপ্রিয় উল্মুক।

‘চলো, ওদিকে যাওয়া দরকার এবার’, পুষ্পকেতু স্থান ত্যাগের উদোগ নেন প্রসঙ্গ পরিবর্তন করতে, তাঁর মুখশ্রী তখনও রক্তবর্ণ।

***

‘আপনাকেই সন্ধান করছিলাম এতক্ষণ কুমার, ভিতরে আসন গ্রহন করুন দয়া করে; বিশিষ্ট রাজপুরুষেরা সকলেই আগ্রহী আপনার সাথে বাক্যালাপে’, অতিথি-মন্ডপের প্রবেশ পথে ত্রিগুণবর্মা এগিয়ে আসেন। ত্রিগুণবর্মা শৈলরাজের কনিষ্ঠ শ্যালক, বয়স যৌবনের মধ্যগগনে, চেহারায় আর্যরক্তের তুলনায় দেশীয় প্রভাব অধিক স্পষ্ট; তাঁর কথা বলার ভঙ্গী বিনীত, রাজগরিমার ছোঁয়া নেই স্বভাবে। সব মিলিয়ে, উদয়বর্মার তুলনায় সম্পূর্ণ বিপরীত মেরুর ব্যক্তিত্ব ত্রিগুণের, একথা বুঝতে সময় লাগেনা। এর আগে রাজসভায় তাঁর সাথে পুষ্পকেতুর সামান্য আলাপ হলেও অন্তরঙ্গতার সুযোগ হয়নি এপর্যন্ত। ত্রিগুণের কথামত তাঁর সাথে ভিতরে প্রবেশ করেন দুই বন্ধু, সেখানে রাজপুরুষদের জন্য সংরক্ষিত অংশের একপাশে দুটি সুখাসনে বসতে উদ্যত হন তাঁরা।

‘ওখানে নয়, আপনারা এদিকে আসুন’। বিশিষ্টজনেদের মধ্যমনি হয়ে বসে আছেন এক তেজস্বী যুবাপুরুষ, দীর্ঘদেহী, বৃষস্কন্ধ, বুদ্ধিদীপ্ত চেহারা, দূর থেকেও সহজেই তাঁকে চিহ্নিত করা যায় ব্যক্তিত্বের প্রভাবে; ত্রিগুণ তাঁর পাশের দুটি আসনে বসতে ইঙ্গিত করেন কুমার ও উল্মুককে।

‘ইনি প্রতিবেশী রাজ্য অমরাবতীর মহাপরাক্রমী যুবরাজ শ্রী ভদ্রবর্মন’, ত্রিগুণ পরিচয় করিয়ে দেন। যুবরাজ এক অন্তর্ভেদী দৃষ্টি নিয়ে তাকিয়ে থাকেন কুমারের দিকে কয়েক মূহূর্ত তারপর স্মিত হাসি দেখা দেয় তাঁর মুখে।

‘আপনি বয়সে নবীন, তবে মেধায় নয়; সুবর্ণভুমে সুস্বাগতম কুমার পুষ্পকেতু’, তাঁর মার্জিত গম্ভীর কন্ঠস্বর চেহারার মতই ব্যক্তিত্বপূর্ণ।

এরপর প্রাথমিক সৌজন্য বিনিময় ও আলাপচারিতায় কেটে যায় কিছুটা সময়, যুবরাজ স্বল্পবাক ব্যক্তি, তবু পুষ্পকেতুর প্রতি তিনি আগ্রহ বোধ করছেন, বোঝা যায় সেকথা। ইতিমধ্যে মূহূর্মূহূ বেজে উঠেছে মঙ্গলশঙ্খ, বাহ্মণবর্গ কলস হাতে এগিয়ে চলেছেন মূল মন্দিরের দিকে, ধূর্জটিদেব চলেছেন দুগ্ধভান্ড হাতে; কলস স্থাপনাকালে দুগ্ধবারি ছিটিয়ে শিখর প্রতিষ্ঠা হবে।

‘আপনার সাথে একান্তে আলাপ করতে ভালো লাগবে কুমার, উৎসব শেষে সাক্ষাতের ইচ্ছা রইল’। পুষ্পকেতু ঈষৎ হেসে সম্মতি জানান যুবরাজের প্রস্তাবে।

***

পাঁচদিনের অনুষ্ঠান সমাপ্ত হয়েছে,যদিও নগরী এখনও উৎসবমুখর। বিদেশী রাজপুরুষেরা এখনও রাজআতিথ্য উপভোগ করছেন ও সেইসঙ্গে বৈদেশিক সম্পর্ক সুদৃঢ় করতে সচেষ্ট হয়েছেন; পরাক্রমী শৈলরাজের সাথে সুসম্পর্ক রক্ষায় সকলেই আগ্রহী। এরইমধ্যে একদিন বিকালে, রাজোদ্যানের একপাশে একটি গোপুর-চম্পক বৃক্ষের নীচে সভা বসেছে যুবরাজ ভদ্রবর্মন ও পুষ্পকেতুর মধ্যে; কুমারের সাথে আছেন উল্মুক ও দধিচী, অপরপক্ষের সঙ্গী অমরাবতীর দুইজন অমাত্য ও দেহরক্ষী। যুবরাজের অনুরোধে এই সাক্ষাতের বন্দোবস্ত করে দিয়েছেন স্বয়ং উদয়বর্মা; দুর্জয় ও ত্রিগুণের অমত সত্ত্বেও তিনি এই ব্যবস্থা করেছেন শিষ্টাচার রক্ষার্থে।

‘যুবরাজ বিচক্ষণ ব্যক্তি, তাঁর ন্যায়বোধে আমার বিশ্বাস আছে; কোনও অন্যায় প্রস্তাব তিনি করবেন না কুমার কেতুর কাছে’, এই ছিল উদয়ের যুক্তি’।

‘কাটিগারমুখী চৈনিক বাণিজ্যতরী লুঠ করার সময় যুবরাজের এই ন্যায়বোধ তেমন সজীব থাকে না বোধ করি’।

‘এবিষয়ে তর্কের অবকাশ আছে, তবে আপাততঃ সম্মানিত অতিথিকে অযথা রুষ্ট করা বুদ্ধিমানের কাজ হবে না’, দুর্জয়ের ব্যঙ্গোক্তিকে উপেক্ষা করে উদয়বর্মা তাঁর সিদ্ধান্তে অটল থাকেন।

 

বৃক্ষতলে কয়েকটি সুখাসন ও উৎপীঠিকা সাজানো হয়েছে মাননীয় অতিথিদের আপ্যায়নের জন্যে, শীতল কালিঞ্জরস ও তক্রের ব্যবস্থা রয়েছে সেইসাথে। সৌজন্যমূলক দূরত্বে উপস্থিত আছে কয়েকটি প্রহরী ও দুই রাজ কর্মচারী। প্রাথমিক শিষ্টাচারের পরে আলাপ জমে উঠেছে, আলাপচারী মূলতঃ যুবরাজ ও পুষ্পকেতু।

‘মগধের রাজ প্রতিভূরূপে কুমার অমরাবতীর আতিথ্য গ্রহণ করবেন কিছুদিনের জন্যে, মহারাজ বীরবর্মন সেরকমই আশা পোষন করেন মনে’, যুবরাজের নিমন্ত্রন আন্তরিক শোনায়।

‘মহারাজকে আমার বিনম্র শ্রদ্ধা, তবে এই যাত্রায় অমরাবতীতে মগধের প্রতিনিধিত্ব করা আমার পক্ষে সম্ভব নয় যুবরাজ।‘

‘কিন্তু কেন? অমরাবতী তার আনুগত্য দেখিয়ে এসেছে এযাবৎ সম্রাট সমুদ্রগুপ্তের প্রতি, একথা তো আপনার অজানা নয়!’

‘ধরে নিন, সম্রাটের সেরকমই ইচ্ছা, আমি আজ্ঞাপালক মাত্র। আপনি মগধের প্রতিনিধিকে আমন্ত্রণ জানাতে চান, সে প্রস্তাব নিয়ে মগধে দূত পাঠান, যেরূপ শৈলরাজ পাঠিয়েছিলেন।‘

‘সমুদ্রের আধিপত্য ও বাণিজ্যশুল্ক নিয়ে দুইরাজ্যে বিরোধিতা চলছে, মগধেশ্বরের কাছে সে বিষয়েই বার্তা প্রেরণ করতে চেয়েছি আমি; তাঁর মধ্যস্থতায় বিরোধ দূর হোক এই আমদের ইচ্ছা। আমি এবিষয়ে আপনার সাহায্যপ্রার্থী।‘

‘আমি দুঃখিত রাজন, এ আমার সাধ্যাতিত’।

‘বেশ, মগধ প্রতিভূরূপে না হোক, অন্তত ব্যক্তিগত মিত্রতার কারণে আমার সাথে অমরাবতী চলুন আপনি কিছুদিনের জন্য।‘ যুবরাজের কন্ঠে আগ্রহের সুর স্পষ্ট হয়।

‘রাজকার্যে এসে কোনও কিছুই ব্যক্তিগত থাকে কি? আপনি বিচক্ষণ রাজনীতিবিদ, রাষ্ট্রের উর্দ্ধে নিজ সত্ত্বাকে গুরুত্ত্ব দেওয়া চলে না একথা আপনার থেকে বেশী আর কে জানবে; আমাকে ক্ষমা করুন আর্য।‘

‘বুঝলাম, শুধু প্রশ্ন একটিই, আপনার ব্যাধপুরে বসবাস কালে যদি দুই রাজ্যে বিরোধ বাধে, আপনি নিরপেক্ষ থাকবেন তো?’

‘অবশ্য রাজন, বিরোধ যতক্ষণ রাজনৈতিক, মগধ প্রতিনিধিদল নিরপেক্ষই থাকবে, এ আমি কথা দিলাম।’

‘আর সংঘাত যদি ব্যক্তিগত পর্যায়ে যায়, তখন?’

‘সেক্ষেত্রে, অতিথিধর্ম পালন করতে গৃহস্বামীর স্বার্থরক্ষায় সচেষ্ট হব একথা সত্য’, কিছুটা সময় নিয়ে উত্তর দেন কেতু।

‘বেশ, মিত্ররূপে পাশে পেলাম না আপনাকে এ দুঃখ নিয়েই বিদায় নেব তাহলে’।

‘আপনি অসাধারন পুরুষ, ব্যক্তিগত বন্ধুত্বের সুযোগ কখনও হবে কিনা জানিনা, তবে আপনার প্রতি আমার শ্রদ্ধা থাকবে চিরকাল।‘

আন্তরিক আলিঙ্গনের মাধ্যমে সভাভঙ্গ হয়; মনে মনে স্বস্তি বোধ করেন দধিচী ও শৈলদেশের রাজকর্মচারীরা।

***

‘ভদ্রবর্মনের কূটনৈতিক চালে পড়তে হোলনা, এ যাত্রায় বাঁচা গেছে কি বল?’

‘কি জানি’; পুষ্পকেতুর কন্ঠস্বর দ্বিধাগ্রস্থ শোনায়। সভাশেষে সেদিন রাত্রে দুইবন্ধুর আলাপচারিতায় পুষ্পকেতু যেন কিছুটা বিমনা।

‘তুমি কি কিছু বিবাদের আশঙ্কা করছ? কিন্তু সম্রাটের আজ্ঞাপালক আমরা, একথা তো স্পষ্ট করেছ বারংবার।‘

‘তবু অমঙ্গল আশঙ্কায় মন ভারী হয়ে রয়েছে বন্ধু, কুচিন্তা দূর করতে পারছি না কিছুতেই।‘

‘আমার কিন্তু মনে হয়েছে যুবরাজ তোমার কোনও অনিষ্ট চিন্তা করবেন না কখনই।‘

‘প্রতিবেশী ঈর্ষা বড় মারাত্মক উল্মুক; অর্থিনীতি,পররাষ্ট্রনীতি সবই ক্ষুণ্ণ হয় এতে। সমুদ্রপথের শান্তি নষ্ট হলে, আর্যাবর্ত, চীনদেশ তথা পাশ্চাত্য, সকল দেশের বাণিজ্যেই এর প্রভাব পড়বে, সে অতি আশঙ্কার কথা।‘

‘তুমি অনেক দূরের কথা ভাবছ কেতু, আমরা সেব্যাপারে কি করতে পারি?’

‘কিন্তু আমাদের উপস্থিতে গৃহস্বামীর স্বার্থনষ্ট হলে, তার দায় এড়ানো যাবে কি? আমার চিন্তা সেখানেই’। দুই বন্ধুর আলোচনা আর এগোয় না।

রাত্রি ক্রমশঃ গভীর হয়, জোছনা মাখা মায়াময় রাত আচ্ছন্ন করে তরুণ হৃদয়; উল্মুক ঘুমিয়ে পড়েছেন অনেক্ষণ, পুষ্পকেতু চন্দ্রমার পানে চেয়ে কোনও এক সুখ স্মৃতিতে ছোট্ট দীর্ঘশ্বাস ফেলেন জানালার পাশে দাঁড়িয়ে।

***

‘অবশেষে রাজকার্য থেকে অবকাশ মিলল? সুস্বাগতম ভদ্র!’ মকরধ্বজকে দেখে উচ্ছসিত হয়ে ওঠেন উল্মুক, বিগত কয়েকদিনে সত্যিই তাঁর দেখা পাওয়া দুষ্কর ছিল।

‘হ্যাঁ, রাষ্ট্রদূতেরা প্রায় সকলেই বিদায় নিয়েছেন, এখন কিছুটা নিশ্চিন্ত; অবশ্য যুবরাজ ভদ্রবর্মন যতদিন না নিজদেশে রওয়ানা হন, স্বস্তি নেই সম্পূর্ণভাবে। কুমার কোথায় দেখছি না তাঁকে?’

‘ভদ্রবর্মন কি থাকবেন কিছুদিন?’ মকরধ্বজের কন্ঠস্বর শুনে অন্দর থেকে বিশ্রামকক্ষে প্রবেশ করেন পুষ্পকেতু; তাঁর মুখে স্মিত হাসি, ব্রাহ্মণকে দেখে তিনি খুশী হয়েছেন বোঝা যায়।

‘সঠিক বলতে পারিনা, তবে বাকী রাজপুরুষদের বিদায়ের পশ্চাতে সম্ভবত মহারাজের সাথে রাজনৈতিক আলোচনায় আগ্রহী তিনি, সেকারণেই রয়েছেন এখনও।‘

‘যুবরাজ সামুদ্রিক আধিপত্য জনিত জটিলতা দূর করতে আন্তরিক বুঝতে পারছি; আপোষে সমস্যা মিটলে উভয় পক্ষেরই মঙ্গল’, পুষ্পকেতু মন্তব্য করেন।

‘আপাততঃ আপনাকে আমার একটি সমস্যা দূর করতে হবে কুমার।‘

‘সে কিরকম?’

‘প্রতিমাসের পূর্ণচন্দ্র তিথিতে উদ্যান সরোবর তীরের নাটমন্দিরে কাব্যসভা বসে কুমার ত্রিগুণবর্মা ও কুমারী সোমাশ্রীর উৎসাহে; মূলতঃ রাজপরিবারের নবীন সদস্যরাই অংশ নিয়ে থাকেন এই সভায়, আর থাকেন কিছু কাব্যপ্রেমী রাজপুরুষ। এই অধমও অল্পস্বল্প কাব্যচর্চা করে থাকে, সেইসূত্রে এই সভায় নিয়মিত যাতায়াত। আজ পূর্ণিমাতিথি, ত্রিগুণবর্মা অতিথিসৎকারে ব্যস্ত, সেকারনে এবারের সভার আয়োজনের দায়িত্বে আছেন রাজকুমারী, আর তাঁর সহযোগী হিসাবে আমি।‘

‘সোমাশ্রী? রাজকুমারীর নাম সোমাশ্রী?’ পুষ্পকেতুর কন্ঠে আগ্রহের সুর উল্মুকের মনযোগ এড়ায় না।

‘হ্যাঁ, কুমারী নিজেও কাব্যচর্চা করেন, সভার বিষয়ে তাঁর উৎসাহই সর্বাধিক’।

‘কাব্যচর্চা করেন? ভারি বিদূষী দেখছি শৈলরাজদুহিতা?’ উল্মুক মন্তব্য করেন এতক্ষণে।

‘কিন্তু আপনার সমস্যার কারণ এখনও স্পষ্ট হোলনা ভদ্র’, পুষ্পকেতুর কন্ঠে প্রশ্নের সুর।

‘আজকের সভায় আপনারাও নিমন্ত্রিত, আপনারা যেতে সম্মত হলেই সমস্যা দূর হবে দেব’, মকরধ্বজের বাক্চাতুরীতে হেসে ওঠেন দুজনেই।

‘এ আর এমনকি কথা, আমরা যাব অবশ্যই, বলবেন রাজকুমারীকে’, উল্মুক উত্তর দেন।

‘আরো একটি আর্জি আছে কুমারের কাছে; শুনতে পাই, আপনি একজন সঙ্গীতজ্ঞ, আপনার বীনাবাদন শ্রবনের সৌভাগ্য লাভ করতে উদগ্রীব আমরা সকলেই।‘

‘সেকি, আবার সঙ্গীত কেন? দর্শকাসনেই আমি অধিক স্বচ্ছন্দ বোধ করব ভদ্র।‘

‘এই অনুরোধ কি রাজ্ঞী সোমাশ্রীর? কুমার অবশ্যই বাজাবেন, আপনি নিশ্চিন্ত থাকুন’, উল্মুক মধ্যস্থতা করতে সচেষ্ট হন।

***

অপরাহ্ন গতে রাত্রির প্রথম প্রহরে নাটমন্দিরে শুরু হয়েছে কাব্যপাঠের আসর; সূর্য অস্তাচলগামী, ছায়ামাখা রক্তিম আলোয় স্বপ্নিল পরিবেশ। কারুকার্যময় স্তম্ভযুক্ত গোলাকৃতি নাটমন্দিরের চারদিক উন্মুক্ত, যাতে সভাগৃহের বাইরে থেকেও অনুষ্ঠানের রসগ্রহণ করা চলে। মন্দিরের মধ্যস্থলে উঁচু বেদিকা, আর তার চারপাশ ঘিরে মাটিতে কোমল আস্তরণ ও উপধানসহ বসবার ব্যবস্থা। কাব্যপাঠের শুরু হয় মকরধ্বজের লেখা ‘কবিমানস’ নামের কাব্যগ্রন্থের একটি অধ্যায় দিয়ে। একে একে অংশ নেন কুমার উদয়বর্মার পুত্র, রাজসভার কিছু সদস্য ও কুমার ত্রিগুণবর্মা। শৈলদেশে কাব্যচর্চা জনপ্রিয় একথা বোঝা যায় কাব্যের মান ও দর্শকের উপস্থিতি দেখে। আসর শুরুর কিছু পরে উদয়বর্মার সাথে সভায় উপস্থিত হন যুবরাজ ভদ্রবর্মন, তাঁকে দেখে কিছুটা তটস্থ হয়ে পড়েন অংশগ্রহনকারীরা; পূর্বেকার ঘরোয়া পরিবেশ যেন আচমকা বিধিবদ্ধ হয়ে পড়ে এর পরে। যুবরাজের সম্মান রাখতে এই অনুষ্ঠানে কাব্যপাঠ করেন সভাকবি গুণনিধিও। সভাকবির মন্দ্রকন্ঠের আবৃত্তি এক ভাবগম্ভীর কল্পলোকের আবর্ত তৈরী করে, মুগ্ধ আবেগে নিশ্চুপ হয়ে থাকে সভাগৃহ পাঠ শেষের পরেও। কাব্যপাঠের শেষ পর্যায়ে বেদিকায় এসে বসেন রাজকুমারী সোমাশ্রী, তাঁর অগ্নিবর্ণ উত্তরীয়ে গোধূলির আকাশ ধরা দিয়েছে, মৃদুমন্দ বাতাসে দুলছে কপালের অলোকগুচ্ছ, শান্ত সুকোমল মুখশ্রীতে সলজ্জ বিনম্রতা। পাঠ শুরু হয়, ঋতু বসন্তে এক তরুণী হৃদয়ের মুগ্ধতা ফুটে ওঠে কবিতার প্রাঞ্জল অভিব্যক্তিতে; কাব্যের সুগভীর শব্দজালের মায়াবিস্তার নেই সেখানে, শুধু আছে আন্তরিক আবেগ, সুরলিত কন্ঠের আবৃত্তিতে তা ছুঁয়ে যায় সমগ্র শ্রোতামন্ডলীকে। পাঠের অন্তে পুষ্পকেতুর বীনাবাদন এক স্বর্গীয় সুরলহরীতে ভরিয়ে দেয় আবহ; কুমার ডুবে যান নিজের মধ্যে কোনও গভীর আবেগে, হৃদয় মথিত সুরসন্ধানে স্তব্ধ হয়ে থাকে সমগ্র সভা। বেদিকার সামনে বসে রাজকুমারী মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে শোনেন, তাঁর মুখভাবে জেগে ওঠে অপূর্ব আভা, দুফোঁটা মুক্তাবিন্দু জমা হয় দুটি চোখে।

বাজনা সমাপ্ত হয় একসময়, শ্রোতারা নীরব শ্রদ্ধায় জয়দ্ধনি দিতে ভুলে যায়; সভাভঙ্গ হয় নিজ নিয়মে। সর্বপ্রথমে যুবরাজ সভা ত্যাগ করেন, তাঁকে বিদায় জানাতে বহির্পথে এগিয়ে যান সোমাশ্রী উদয়বর্মার ইঙ্গিতে।

‘আপনার উপস্থিতিতে ধন্য হোল আজকের সভা যুবরাজ’, শিষ্টাচার দেখান রাজকুমারী।

‘আপনার সাথে পরিচয় হোল, এ আমার সৌভাগ্য দেবী। আপনি বিদুষী, শাস্ত্র চর্চায় রুচি রাখেন; শস্ত্র চর্চাকেও শ্রদ্ধার চোখে দেখেন কি? জানতে আগ্রহ হচ্ছে’।

‘আমি ক্ষত্রিয়কন্যা, অবশ্যই বীরত্বের পূজারী; তবে কাব্যগুণে হৃদয়জয়ে অধিক আস্থা রাখি দেব’, ঈষৎ হেসে উত্তর দেন সোমাশ্রী।

‘সোমা লক্ষ্যভেদে অতীব পারদর্শিনী যুবরাজ, আপনার কাছে বিনয় করছেন মাত্র’, উদয়বর্মা ভাগিনেয়ীর সপক্ষে যুক্তি দেন।

‘জেনে সুখী হলাম কুমার, রাজ্ঞী সোমাশ্রীর প্রতি আমার শুভেচ্ছা রইল’, বিদায় সম্ভাষনের সাথে স্থান ত্যাগ করেন ভদ্রবর্মন।

‘এমন স্বর্গীয় সুরজাল কেমন করে সৃষ্টি করেন আর্য, অন্তঃস্থল মথিত হয়ে ওঠে’, অতিথিরা প্রায় সকলেই বিদায় নিয়েছেন একে একে, দীপদন্ডের আলোয় সভামন্দির ছায়াঘন; পূর্ণচন্দ্রের জোছনায় বহির্প্রকৃতি স্বপ্নময়; রাজকুমারী পুষ্পুকেতুর নিকটে এসে অস্ফুটে বলে ওঠেন কথাকটি।

‘আপনার ভালো লেগেছে, এ আমার পরম ভাগ্য দেবী’।

‘না না, এমন করে বলবেন না আর্য, আমি সামান্যা নারী সঙ্গীতের কি বা বুঝি’।

‘আপনি সামান্যা নন, আজকের সভায় বুঝেছি সে কথা সমস্ত অন্তর দিয়ে‘, পুষ্পকেতুর কন্ঠস্বর আবেগে দ্রব। চন্দ্রমার আলোয় ঠিকরে ওঠে রাজকন্যার সিঁথির পদ্মরাগ, চোখের ভাষায় ফুটে ওঠে অব্যক্ত আকুতি। কুমার মুগ্ধ আবেশে চেয়ে থাকেন, চারপাশের পরিবেশ তুচ্ছ মনে হয় এই মূহূর্তের কাছে। কিছু সময় পরে, সখীদের ডাকে সম্বিত ফেরে রাজকুমারীর, তটস্থ হয়ে বিদায় নিতে চান তিনি।

‘আবার দেখা পাব কি দেবী? এত স্বল্প আলাপে মন সন্তুষ্ট হোল কই!’ কুমারের স্বরে ব্যাকুলতা প্রকাশ পায়, যা তাঁর স্বভাবিরূদ্ধ।

‘এই সরোবর তীরে প্রায়ই আসি আমি অপরাহ্নে’, কথাটি বলে সলজ্জ ভঙ্গীতে স্থান ত্যাগ করেন সোমাশ্রী।

উল্মুক কিছুদূর থেকে লক্ষ্য করছিলেন সমস্ত ঘটনা, আজ বহূদিন পরে তাঁর দুচোখে অশ্রু দেখা দেয়, না জানি কোন অতীতের স্মৃতিতে। নিঃশব্দে মিত্রের কাঁধ স্পর্শ করেন তিনি গভীর আবেগে।

***

রাজসভা সংলগ্ন একান্ত কক্ষে বসেছে জরুরী সভা, মহারাজ চন্দ্রদমন ও তাঁর দুই ভ্রাতা সহ উপস্থিত আছেন দুর্জয় বর্মা আর অমরাবতীর দুই অমাত্য বসুদত্ত ও স্বয়ম্ভূ। সভার মধ্যমনি হয়ে মহারাজের মুখোমুখি বসে যুবরাজ ভদ্রবর্মন, যৌবনের দীপ্তি ও ব্যক্তিত্বের সমন্বয়ে তিনি যেন দেবসভানায়ক ইন্দ্র। এই মূহুর্তে পরিবেশ গম্ভীর, সকলেই নীরব হয়ে রয়েছেন; মহারাজের মুখ চিন্তাক্লিষ্ট তীব্র সংশয়ে। শৈলদেশের কাটিগার ও অমরাবতীর সিংহপুর সংলগ্ন কলিঙ্গপত্তন, এই দুইটি বন্দর আর্যাবর্ত ও চীনদেশ থেকে আসা তরীগুলির জন্যে বাণিজ্যকেন্দ্র। কিন্তু, বাণিজ্যতরণীর বিভাজন তথা শুল্কবন্টনের কোনও উচিৎ পন্থা স্থির হয়নি এত বছরেও। মূলতঃ বণিকদের নিজস্ব ইচ্ছা ও সমুদ্রে আপন আধিপত্ত বলে দুইদেশ বাণিজ্যতরণী গুলির উপর অধিকার অর্জন করে এসেছে। কিন্তু এর ফলে আন্তঃ কলহ ও শক্তিপাত এক নিত্যঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছে দুটি রাজ্যের মধ্যে। ভদ্রবর্মন এর নিষ্পত্তি করতে বদ্ধ পরিকর এবং সে বিষয়েই চলছে আলোচনা।

‘আর্যাবর্ত থেকে আসা প্রতি দশটি তরীর মধ্যে পাঁচটিকে আপনি কলিঙ্গপত্তনমুখী করবেন, আর আমিও অনুরূপভাবে চৈনিকতরণী কাটিগারমুখী করতে সচেষ্ট হব। এই আমার প্রস্তাব’। যুবরাজ জানিয়েছিলেন তাঁর পরিকল্পনা।

‘কিন্তু এই হিসাবের মর্যাদা রক্ষা হবে ভবিষ্যতে তার ভরসা কি?’ দুর্জয়বর্মা প্রশ্ন করেন প্রস্তাব শুনে।

‘আপনি কি আমাদের সততার প্রতি সন্দিহান? এবিষয়ে লিখিত সন্ধিপত্র নামাঙ্কিত হবে উভয়পক্ষ থেকে। তাছাড়া একে অপরের বন্দরে প্রতিনিধি রাখে যেতে পারে পরিসংখ্যান পরীক্ষা করার উদ্যেশ্যে’ কঠিনস্বরে প্রতিমন্তব্য করে ওঠেন অমাত্য বসুদত্ত।

‘আপনি শান্ত হোন ভদ্র, যুবরাজকে অপমান করা আমাদের উদ্দেশ্য নয়, মহামাত্য কেবল সম্ভাব্য আশঙ্কার কথাই উল্লেখ করতে চেয়েছিলেন, বিবাদ আমরাও চাই না‘, ত্রিগুণবর্মার বাক্যে আপোষের সুর।

‘একে অপরের আস্থা অর্জনের নিমিত্তে আমার একটি প্রস্তাব আছে রাজন’, ভদ্রবর্মন মহারাজের উদ্দেশ্যে কথাটি বলে উদয়বর্মার প্রতি ইঙ্গিতপূর্ণ দৃষ্টিপাত করেন। বোঝা যায় রাজভ্রাতার সাথে যুবরাজের এই বিষয়ে পূর্বেই আলোচনা হয়েছে।

‘যুবরাজ ভদ্রবর্মন এই সমস্যার মিমাংসায় আত্মীয়তা প্রতিষ্ঠা করতে আগ্রহী আমাদের সাথে; তিনি রাজকুমারী সোমাশ্রীর পাণিগ্রহনে ইচ্ছুক হয়েছেন মহারাজ’, উদয়বর্মা যুবরাজের হয়ে প্রস্তাব রাখেন।

চিন্তামগ্ন হয়ে পড়েন রাজা চন্দ্রদমন, আকস্মিক প্রস্তাবে বিহ্বল হয়ে পড়েছেন তিনি। এ অবস্থায়, যুবরাজের কাছে কিছুদিন সময় ভিক্ষা করে নেন দুর্জয়বর্মা, আপাতত সভাভঙ্গ হয়।

***

ভদ্রবর্মন ফিরে গেছেন নিজদেশে, কিন্তু তাঁর বিগত উপস্থিতি এখনও প্রলম্বিত ছায়ার মত ঘিরে রেখেছে মহারাজ চন্দ্রদমনকে। যুবরাজকে শীঘ্রই মতামত জানানো প্রয়োজন, এই মধ্যবয়সে শৈলরাজ যুদ্ধবিলাসী নন, গৃহশান্তি বজায় রাখাই দেশনায়ক হিসাবে তাঁর আন্তরিক লক্ষ্য।

‘অমরাবতীর সাথে আত্মীয়তা ঐতিহাসিক সিদ্ধান্ত হবে বলে আমার বিশ্বাস, উভয়পক্ষেরই এতে মঙ্গল’, উদয়বর্মা নিজমত প্রকাশ করেন স্পষ্ট ভাষায়। যুবরাজের প্রস্তাব নিয়ে একান্ত আলোচনা বসেছে চারজনের মধ্যে।

‘ভদ্রবর্মন প্রবল পুরুষ ও অতীব উচ্চাকাংক্ষী, শুধুমাত্র আত্মীয়তাতেই থেমে থাকবেন সে ভরসা আছে কি?’ রাজা চন্দ্রদমনের কন্ঠস্বর ভারাক্রান্ত শোনায়।

‘কিন্তু এছাড়া উপায়ও তো কিছু দেখছি না, ভদ্রবর্মন শুল্কবন্টন নিয়ে কোনও সিদ্ধান্তে না পৌঁছে ছাড়বেন না; ব্যাধপুরে তাঁর আগমনের উদ্দেশ্যই ছিল তাই‘, দুর্জয় কিছুটা দ্বিধাগ্রস্ত, এখনও বুঝে উঠতে পারছেন না উদয়বর্মার বক্তব্যে সায় দেবেন কিনা।

‘এবিষয়ে সিদ্ধান্ত নেবার পূর্বে একবার সোমাশ্রীর মত নেওয়া প্রয়োজন বলে আমি মনে করি’, ত্রিগুণবর্মা নিজের বক্তব্য জানান।

‘সোমাশ্রীর মত? কি কারণে? রাষ্ট্রনীতির গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত বালিকার ব্যসন নয়!’ গর্জে ওঠেন উদয়বর্মা।

‘কিন্তু বিবাহ ব্যক্তিগত বিষয়, এব্যাপারে তার মতামত আবশ্যক।‘

‘ব্যক্তিস্বার্থ রাষ্ট্রস্বার্থের থেকে বড় নয় ত্রিগুণ, রাজদুহিতা বুঝবেন সেকথা।‘

‘এবিষয়ে আপনার উৎসাহ কিছু অধিক, লক্ষ্য করছি শুরু থেকেই, রাষ্ট্রস্বার্থের আড়ালে আপনার কোনও ব্যক্তিস্বার্থ লুকিয়ে নেই তো?’ ত্রিগুণবর্মার কটাক্ষে রক্তবর্ণ হয়ে ওঠে উদয়বর্মার মুখ দুরন্ত ক্রোধে।

‘রাজদুহিতার কর্তব্যজ্ঞান সম্পর্কে তোমার সম্যক ধারণা থাকার কথা নয় জানি, তবু মাতৃপরিচয় দূরে রেখে ক্ষত্রীয় রাজপুরুষের মত ভাবতে পরামর্শ দেব তোমায়‍!’ উদয়বর্মার তিরস্কারে স্তব্ধতা নেমে আসে কক্ষ মাঝে। চরম অপমানে আসন ছেড়ে তাঁর দিকে অগ্রসর হতে যান কুমার ত্রিগুণ।

‘আলোচনা বন্ধ হোক এই ক্ষণে, গৃহবিবাদের সময় নয় এখন!’ চন্দ্রদমন গম্ভীর স্বরে ঘোষনা করেন। ত্রিগুণবর্মা আর অপেক্ষা না করে কক্ষত্যাগ করেন উদ্ভ্রান্তের মত।

***

রাজোদ্যানের সরোবর খানি বৃহৎ এলাকা জুড়ে ব্যপ্ত, তার চারপাশে রম্য বনবীথি; কাকচক্ষু জল নিস্তরঙ্গ, চৈত্রদিনের শেষবেলায় ফুলে ফুলে সজ্জিত একটি ছোটতরী ভেসে চলেছে আপন খেয়ালে। তরনীর বৈঠা বাইছে দুটি সুশ্রী যুবতী, তাদের মুখের স্মিত হাসিতে কোনও গূঢ় খুশীর আভাস। নাওয়ের মাঝখানের চন্দ্রাতপ ঘেরা অংশে মুখোমুখি বসে সোমাশ্রী ও পুষ্পকেতু, দুজনেই নীরব তবু বাঙ্ময় চোখের ভাষায় ভাবের আদান প্রদান ব্যাহত হয় না। সেদিন প্রাতে দূতী মাধ্যমে নৌকাবিহারের আমন্ত্রন জানিয়েছিলেন রাজকুমারী; ‘আজ তুমি একাই যাও কেতু’, উল্মুক অতিথি ভবনে থেকে গিয়েছিলেন যাবার কালে, কুমার আপত্তি করেননি।

‘আমাদের দেশ আপনার কেমন লাগছে আর্য?’

‘এতদিন ভালো লেগেছিল, এখন স্বর্গীয় মনে হচ্ছে’।

‘শুনেছি মগধ সাম্রাজ্য এক সুবিশাল ভূখন্ড, কত বৈচিত্র সেখানে!’

‘একথা সত্যি, তবু নারীস্বাধীনতা, বর্ণবৈষম্যহীনতা, অনেক দিক থেকেই শৈলদেশ অগ্রগন্য।‘

‘এ আপনার উদারতা দেব’।

‘উদারতা তো আপনার আর্যে, আপনি রাজদুহিতা, আমি সামান্য রাজপুরুষ।‘

‘মগধরাজকুমার আপনি, সামান্য কোন অংশে?’

‘আমি রাজবংশজাত একথা সত্যি, কিন্তু রাজকুমার নই। আমার পিতা একজন উচ্চপদস্থ আধিকারিক, এর বেশী কিছু নয়।‘

‘রাজসুখ সকলের কাছে কাঙ্ক্ষিত নয় আর্য, শীতল গৃহকোণের পরম শান্তি বড় লোভনীয়।‘ রজকুমারীর কন্ঠ কেঁপে যায় গভীর আবেগে।

‘সোমাশ্রী! ব্রাহ্মণ কৌন্দন্য সমুদ্রযুদ্ধে জয় করেছিলেন নাগকন্যা সোমাকে; আমি সৌভাগ্যবান, বিনা যুদ্ধেই লাভ করেছি তোমার আনুকুল্য।‘

গোধুলীর অস্তরাগে লজ্জানতা রাজকুমারীর মুখশ্রী স্বর্গীয় সুষমাময়, চোখ ফেরাতে পারেননা কুমার। ধীরে ধীরে নৌকা তীরগামী হয়, নিঃশব্দ পরিবেশে বৈঠার ছলাৎকারে যেন দুটি অনুরক্ত হৃদয়ের স্পন্দন ধ্বনিত হয়।

***

সন্ধ্যা নেমে এসেছে, দীপের শিখায় আলোকিত অতিথিগৃহ, পুষ্পকেতু বিশ্রামকক্ষে প্রবেশ করেন ধীরপায়ে; উল্মুক বসে আছেন সেখানে নতমস্তকে, ছায়ান্ধকারে তাঁর মুখভাব স্পষ্ট নয়।

‘একলা এভাবে বসে কেন মিত্র? আমার অভাবে বড় কাতর হয়েছ দেখছি?’ কুমার হাসিমুখে রসিকতা করে ওঠেন।

‘মকরধ্বজ এসেছিল, তোমার জন্য অপেক্ষা করে বিদায় নিল কিছু আগে’, উল্মুকের কন্ঠস্বর গম্ভীর শোনায়, তবে আত্মমগ্ন কুমার লক্ষ্য করেননা তা।

‘আহো, তাহলে তোমার অপরাহ্ন মন্দ কাটেনি কি বল?’

‘ভদ্রবর্মন সোমাশ্রীকে বিবাহের প্রস্তাব করেছেন কেতু!’ উল্মুক বলে ওঠেন; আকস্মাৎ এই তথ্যে থমকে যান কুমার, নিজেকে সামলে নিতে জানালার পাশে গিয়ে দাঁড়ান তিনি। কৃষ্ণপক্ষের গাঢ় অন্ধকার আচ্ছন্ন করে তোলে কক্ষের পরিবেশ গভীর বিষণ্ণতায়।

‘এ অতি শুভ সংবাদ মিত্র, সমুদ্রবাণিজ্যে শান্তি ফিরতে দেরী হবে না আর।‘ অদম্য হাহাকারের মত শোনায় পুষ্পকেতুর এই মন্তব্য।

***  ***

দুরূহ শব্দের অর্থঃ

গোপুর চম্পক বৃক্ষ – কাঠ গোলাপ গাছ

 

শেয়ার করতে:

You cannot copy content of this page