আজি যে রজনী যায়

বুদ্ধদেব হালদার

অন্ধকার কুক্‌কুক্‌ করছে। আকাশে প্রক্ষিপ্ত মেঘ। চাঁদটা কখনও মেঘে আড়াল হয়ে আসছে। কখনও-বা ভেসে উঠছে মহাকাশে। মেঘভাঙা জ্যোৎস্নায় চারদিকে প্রকৃতির এক অদ্ভুত রূপ। হেঁতালদুনি গ্রামের পশ্চিমে এক বিরাট বাঁধানো খাল রয়েছে। সেই খালের পার জুড়ে আছে বিশাল বড়ো কলাবাগান। এখানে মানুষের যাতায়াত নেই। দিনের বেলায় যদিও-বা লোকের দেখা পাওয়া যায়, রাত্রে এদিকটা শ্মশানের মতো নিস্তব্ধ ও নিশ্চুপ। কিন্তু আজ এখানে অন্ধকারের ভেতর থেকে কিছু মানুষের কথাবার্তা ও ফিসফিসানি শোনা যাচ্ছে। এমনকী মাঝেমধ্যে একটা গোঙানির মতো কিছু ভেসে আসছে বাতাসে। অন্ধকারে কিছুই স্পষ্ট দেখা যায় না। গ্রামের প্রকৃতি ছদ্মবেশ ধারণ করে যেন জেগে রয়েছে।

         অন্ধকারের ভেতর হঠাৎ করেই দমকে দমকে কয়েকবার কেউ কেশে উঠল। তারপর জড়ানো গলায় বলল, ‘মদটা ঢালচিস না কেন রে তাপস?’

প্রত্যুত্তরে তাপস খসখসে গলায় বলে উঠল, ‘এখন এত গিলচিস কেন? আগে এই শুয়োরের বাচ্চাকে উপযুক্ত শিক্ষাটা দিয়ে দিই। তারপর মোচ্ছব হবে সকলে মিলে। কী বলিস রে নন্দী?’

উদ্দিষ্ট দুজন ব্যক্তির কথোপকথনে তৃতীয় একজন বেশ উচ্চগ্রামে হেসে উঠল। তিন নম্বর লোকটি তার সর্দিধরা গলায় চিবিয়ে চিবিয়ে বলল, ‘মদ তো খাবোই। তার আগে সতীশকে খাবো সকলে মিলে। মদের থেকে অন্যদলের লোককে খেতে বেশি মজা? কী বলিস তোরা? অ্যঁ?’

নিজের কুৎসিত রসিকতায় নিজেই হেসে উঠল লোকটি। তার নাম কালু মোড়ল। কথাটা যে দুজনকে উদ্দেশ্য করে বলা হলো তাদের একজনের নাম তাপস কর্মকার। এবং অন্যজন হল নন্দী বাগদি। এরা কেউই হেঁতালদুনির লোক নয়। এরা এসেছে পাশের গাঁ থেকে। একটি বিশেষ রাজনৈতিক দলের আনুগত্যে এরা বিভিন্ন অপরাধমূলক কাজকর্ম করে থাকে। যেহেতু দলের সমর্থন আছে তাই এদেরকে সহজে পুলিশ পাকড়াও করতে পারে না। দল এদেরকে সরাসরি নিজেদের কর্মী বলে ঘোষণা করে না। তবে যাবতীয় গোপন কাজকর্ম তাদেরকে দিয়েই করানো হয়। এরকম লোকজন আজকাল দলে বেশি করে আমদানী করা হচ্ছে। যাতে এই দলীয় শাসন গ্রামেগঞ্জে শহরে মফস্‌সলে প্রত্যেকটা জায়গায় কায়েম রাখা যায়।

এই মুহূর্তে মাটিতে হাত-পা বাঁধা অবস্থায় পড়ে রয়েছে সতীশ বিশ্বাস। সে এই গ্রামেরই ছেলে। অন্য একটা দল করে। ক্রমবর্ধিত অত্যাচার ও অপশাসনের হাত থেকে তৃণস্তরের মানুষকে সে মুক্ত করতে চায়। সাধারণ মানুষকে এই ভয়ঙ্কর পরিস্থিতির স্রোত থেকে বের করে আনতে চায়।

সতীশের বয়েস খুবই কম। কলকাতার কোন এক কলেজ থেকে স্নাতক পাশ করে সরাসরি নিজের গ্রামে চলে এসেছিল। তার ইচ্ছে ছিল হেঁতালদুনির মানুষদের শোচনীয় দুর্দশা থেকে তাদেরকে মুক্ত করা। এবং এ পথ শিক্ষার আলোতেই সম্ভব। ভয়হীন সুস্থ স্বাভাবিক সমাজ তৈরির জন্য মানুষের চেতনাকে জাগ্রত করা প্রয়োজন। তাই গ্রামে পাকাপাকিভাবে থাকতে এসে মানুষের পক্ষে যে দল সওয়াল করে, সেই দলে নাম লিখিয়েছিল সে। এবং যেহেতু খুব কম সময়েই অনেক মানুষের বিশ্বাস ও ভরসা অর্জন করতে সফল হয়েছে, তাই বিরোধীপক্ষ শেষপর্যন্ত তাকে সরিয়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছিল আগেই। সুযোগ কোনওভাবেই আসছিল না। কারণ সতীশকে বাগে আনা অত সহজ ব্যাপার নয়। ওর দলের লোকবল ও ক্ষমতা কম হলেও গ্রামের অনেক সংখ্যক সাধারণ মানুষের আশীর্বাদরূপী হাত ওর মাথায় রয়েছে। তাই ওকে হঠাৎ করে খুন করে ফেলা যাবে না। অনেক ভেবেচিন্তে তবেই এই কাজে নেমেছে বিরোধী দলের লোকেরা। পথের কাঁটাকে এখনই না সরিয়ে ফেলতে পারলে সমূহ বিপদ অপেক্ষা করে আছে। তাই আজ মিটিং সেরে ফেরার সময় তেঁতুলতলার পথ দিয়ে যখন সতীশ সাইকেল চালিয়ে ফিরছিল, ঠিক তখনই কালু মোড়ল ও নন্দী বাগদি তাকে প্রথমে মাথায় আঘাত করে। অজ্ঞান হয়ে যাওয়ায় খুব সহজেই তার হাত-পা বেঁধে নিয়ে তাকে খালপাড়ের এই কলাবনে নিয়ে এসে ফেলে। এখানে আগে থেকেই ওদের জন্য অপেক্ষা করছিল তাদের আরেক শাগরেদ তাপস কর্মকার।

এতক্ষণে জ্ঞান ফিরেছে সতীশের। চোখ খুলেই সে নড়াচড়া করার চেষ্টা করল। কিন্তু তার হাত বাঁধা রয়েছে। পায়ের কাছটাও শক্ত নারকোল দড়ি দিয়ে বাঁধা। ফলত কোনওভাবেই সে নিজেকে মুক্ত করতে পারল না। মুখ দিয়ে তার গোঁ-গোঁ শব্দ বেরলো। মুখের মধ্যেও মোটা কাপড় টান করে বাঁধা রয়েছে। তাকে দেখে কালু মোড়ল এগিয়ে এসে তার কোমরে সপাটে এক লাথি চালাল। এই দেখে বাকি দুজন হি হি করে হাসতে শুরু করেছে। কালু সতীশের মুখের দিকে ঝুঁকে এসে বলল, ‘বড্ড নেগেচে? মালিস করে দেব?’

তার এই বিদ্রূপে আবারও হেসে উঠল বাকি দুজন।

তার দিকে তাকিয়ে নন্দী বাগদি বলে উঠল, ‘কালু, তুই শালা মাইরি ভালো মাজাকি মারতে পারিস?’

নন্দীর দিকে তাকিয়ে কালু শুধায়, ‘কেন রে শালা?’

‘ওর মুখটা খুলে দে না রে মাইরি?’

ওদের কথার মাঝে তাপস বলে উঠল, ‘কেন রে সোগো মারানির ভাই? মুখের বাঁধন খুলে দিয়ে শেষে কি বেপদে পড়তে চাস?’

তাপসের কথা শুনে নন্দীর হয়ে কালু জবাব দিল, ‘কীসের বেপদ? এখানে তো যদ্দূর দেখা যায় কেউ নেই। এত ভয় পাচ্চিস ক্যা রে?’

সে বলল- ‘বলা যায় নে। কোথা থেকে কী হবে। তাড়াতাড়ি কাম তামাম করে দেওয়াই ভালো।’

কালু কিছুটা জিরিয়ে নিয়ে বলল, ‘তাড়াহুড়োর দরকার নেই। ওকে যন্ত্রণা দিয়ে মারব। ধীরে সুস্থে মারব। এমন হাল করব যেন ওদের দলের হয়ে কখনও কথা বলতে এ গাঁয়ের লোকজন ভয় পায়। আমাকে বিদ্যুতদা কয়ে দিয়েচে। সতীশের লাশ দেখে যেন পশুপাখিও শিউরে ওঠে।’

‘ঠিক আচে গুরু। তাহলে তুমি তোমার মতোই করো। এই আমি একটু একেন বসলুম।’

কলা বাগানের ভেতর জল জমানোর জন্য যে ছোটো নালা কাটা রয়েছে, তার উঁচু করা মাটির ঢিবির ওপর তাপস বসে পড়ল। হাতে তার দেশি মদের বোতল। কালু হঠাৎ করে বয়স্ক নন্দী বাগদির মুখের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘নন্দীদা, ছোঁড়ার মুখের বাঁধনটা খুলে দে।’

আদেশ পাওয়া মাত্র সতীশের মুখে টান করে বাঁধা কাপড়টাকে খুলে দিল নন্দী।

মুখ থেকে কাপড় খোলা মাত্র সতীশ কেশে উঠল। বড়ো বড়ো করে শ্বাস নিল কিছুক্ষণ। তারপর ওদের তিনজনের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘আমাকে তোমরা কেন মারতে চাইছ? আমি তোমাদের কী ক্ষতিটা করেছি?’

তার কথা শুনে তাপস হিহি করে হেসে উঠল।

ষাট বছরের নন্দী বাগদি কোনও কথাই বলল না। সে হাত দিয়ে হাওয়া আড়াল করে দেশলাই জ্বালিয়ে একটা বিড়ি ধরাল। কালু যেমন দাঁড়িয়ে ছিল তেমনই দাঁড়িয়ে রইল।

সতীশ আবারও প্রায় কাঁদো কাঁদো হয়ে বলল- ‘কেন আমাকে মারছ তোমরা? আমাকে ছেড়ে দাও। আমাকে বাড়ি যেতে দাও।’

ওর কথা শুনে এবারে কালু হা হা করে হেসে উঠল। শয়তান যেভাবে হাসে, এ হাসি ঠিক তেমনই শুনতে লাগল।

সে হেলেদুলে সতীশের কাছে এগিয়ে এসে বসে পড়ল। তার মুখের কাছাকাছি মুখ নিয়ে গিয়ে বলল, ‘বাড়ি নয়। তোকে সগ্‌গে পাঠাবার অর্ডার পেইচি আমরা।’

‘আমার কী দোষ? কী করেছি আমি?’

ওর কথা শুনে কালু মুখ বিকৃত করে বলল, ‘কী দোষ? নতুন করে গেরামে দল খুলতে কে কয়েচে তোরে? তাও আমাদের বিরুদ্ধে লোকজনদের উসকানি দিতে শুরু করেচিস?’

‘এই গ্রাম আমার মা। এই মাটি আমার জন্ম। আমি যদি এই গ্রামের মানুষের পাশে না দাঁড়াই তাহলে বাইরের কেউ কি কখনও নিজে থেকে এগিয়ে আসবে? দল তোমাদের অন্ধ করে দিয়েছে। তাই বুঝতে পারছ না তোমরা কেউ। কত ক্ষতি করছি আমরা নিজেরা নিজেদের। এ গ্রামে আলো নেই। ভালো কোনও স্কুল নেই। কাজবাজ নেই। চাষ করার জমিও একে একে চলে যাচ্ছে নেতাদের ব্যক্তিগত সম্পত্তির তালিকায়। তোমরা কবে চোখ খুলবে? কবে থামাবে তোমাদের দলীয় সন্ত্রাস?’

কালু চিবিয়ে চিবিয়ে সতীশকে বলল, ‘শহরে পড়াশোনা করে ভালো বুলি ফুটেচে বাবুর মুখে কী বলিস রে তাপস?’

তাপস এতক্ষণ বুঁদ হয়ে বসেছিল মাটিতে। সে এবার উঠে দাঁড়াল। টলতে টলতে সতীশের কাছে এসে থামল। এরপর ফুলপ্যান্টের বোতাম খুলে সতীশের মুখে পেচ্ছাব করা শুরু করল। ওর আচরণ দেখে হাসিতে ফেটে পড়ল বাকি দুজন।

নন্দী কালুর দিকে তাকিয়ে ফিসফিস করে উঠল- ‘অযথা সময় খোয়াচ্চিস কেন? মেরে দে এবার।’

সতীশ এই জানোয়ার গুলোর মুখের দিকে তাকিয়ে কান্নায় ভেঙে পড়ল। সে জানে তার ভবিষ্যত কী হতে চলেছে। তবুও শেষ পর্যন্ত সে বোঝাতে চায় এদের। ভুল পথে তাদেরকে চালনা করা হচ্ছে। তারা যেন মানুষের হয়ে মানুষের পাশে দাঁড়াতে শেখে। তাদের সকলের যেন এই বোধোদয় হয়।

কালু হঠাৎ করে এগিয়ে এসে লাথি মারা শুরু করল। তাপসও ওকে সঙ্গ দিল। যন্ত্রণায় চেঁচাতে লাগল সতীশ। কাঁদতে কাঁদতে বলল, ‘আমি মরে যাব জানি। কিন্তু এই গ্রাম তোমাদের সকলের মা। তাকে অন্যের হাতে তুলে দিয়ে বেইজ্জত কোরো না তোমরা। সকলে পথে নামো। নিজেদের অধিকার টুকু কেড়ে নাও। মনে রেখো গরীবদের কখনও কোনও দল হয় না। রাজনীতি কখনও মানুষের জন্য তৈরি হয় না। আমি চেয়েছিলাম মানুষের জন্য লড়তে। মানুষের পাশে থাকতে আমি চেয়েছিলাম  ..।’

জোরে শব্দ হলো। লোহার শাবলের পেছন দিয়ে তার মুখে আঘাত করেছে নন্দী। সামনের নাকের উপরের অংশটা উপড়ে গেছে। গলগল করে রক্ত বেরোচ্ছে। সামনের পাটির সমস্ত দাঁত ভেঙে গেছে। মুখ দিয়ে গোঁ-গোঁ শব্দ বের হচ্ছে সতীশের। নন্দীর হাত থেকে শাবলটা কেড়ে নিয়ে সতীশের বুকের উপর জোরে জোরে আঘাত করতে লাগল তাপস। মারতে মারতে কিছুক্ষণের মধ্যেই হাঁফিয়ে উঠল সে। ওদের তিনজনের চোখের সামনে নিস্তেজ হয়ে পড়ে রয়েছে বছর আঠাশের সতীশ বিশ্বাস। সে তার গ্রাম ও গ্রামের মানুষকে নতুন পথ দেখাতে চেয়েছিল। নতুন আলোর সন্ধান দিতে চেয়েছিল সে। নিজেদের অধিকার গুলোকে পাইয়ে দিতে চেয়েছিল। ছেলেটা পারল না। মুখ উলটে রক্তে ভিজে মাটির ওপর পড়ে রয়েছে। মায়ের কোল খালি করে চলে যাচ্ছে সে।

কালু মোড়ল ওদের দুজনের চোখের দিকে তাকিয়ে পাতলা গলায় বলল, ‘কেরোসিন তেলের পিপেটা কোথায় রেখেচিস?’

তাপস মিনমিন করে বলল, ‘কলা গাছের নীচে রাখা আছে। নিয়ে আসব?’

নন্দী হাত নাড়িয়ে বলল, ‘তাড়াতাড়ি আন।’

সতীশের সারা গায়ে কেরোসিন ঢেলে আগুন ধরিয়ে দিল তারা।

এখন মধ্যরাত। রাত শেষ হওয়ার আগেই তাদেরকে বেরিয়ে যেতে হবে। সতীশের লাশটা পুড়ে ছাই হতে সময় লাগবে। অবশ্য সে যে মরে গেছে সে বিষয়ে সন্দেহ নেই। শাবল দিয়ে ওর বুকে যখন জোরে জোরে মারছিল তখনই সে মারা গেছে। তাই নিশ্চিত হয়েই এবার বাড়ির দিকে রওনা দেওয়া যায়। ওরা তিনজনে জ্বলন্ত লাশকে ফেলে হাঁটতে শুরু করল। যে যার বাড়ি পৌঁছবে। খবরটা বিদ্যুত কর্মকারের কানে কাল আপনাআপনি ঠিকই পৌঁছে যাবে। তাছাড়া এ কাজের জন্য তিনহাজার করে টাকা পাবে তারা। সেসব গোপনে ঠিকই পাঠিয়ে দেওয়া হবে তাদের কাছে। এখন আপাতত জোরে পা চালাল তারা তিনজনেই।

চলবে…

ছবি- ইন্টারনেট

শেয়ার করতে:

You cannot copy content of this page