আজি যে রজনী যায়

বুদ্ধদেব হালদার

 

হেঁতালদুনি গ্রাম যেন ভেতর ভেতর পালটাতে শুরু করেছে। দুদিন আগেও লোকে পুরনো দলের নামে কিছু বলতে ভয় পেত। অন্যায় দেখলেও কেউ মুখ খুলতে চাইত না। কিন্তু সতীশের খুনের পর গোটা গেরাম মিলে প্রতিবাদে নেমেছে। আর নামবে নাই-বা কেন? এভাবে আর কতো দিন? সতীশ সকলের ঘরের ছেলে ছিল। লোকের আপদ-বিপদে সে-ই এগিয়ে আসত। গ্রামের লোকেদের যেকোনও সমস্যাতেই সে তাদের পাশে গিয়ে দাঁড়াত। হেঁতালদুনির সমস্ত মানুষকে জড়ো করে এক সুতোয় বেঁধে ফেলতে পেরেছিল সে। এক নামে সকলেই চিনত তাকে। তার স্নেহে আর ভালোবাসায় এই গ্রাম নতুন করে সেজে উঠতে শুরু করেছিল। আর সেই ছেলেটাকেই কিনা বিদ্যুৎ কর্মকারের পোষা কুকুরেরা খুন করে পুড়িয়ে মেরেছে? গ্রামের সব লোক এক হয়ে আজ রাস্তায় নেমেছে। এর বদলা তারা চায়। যেভাবেই হোক সতীশের খুনিদের তারা খুঁজে বের করবেই। কাউকে ছেড়ে কথা বলবে না। উত্তাল হয়ে উঠেছে মানুষ। আজ সকালেই শোনা গেছে পাশের গ্রামের তিন খুনীর বাড়িতে আগুন লাগিয়ে দিয়েছে এই গ্রামের কয়েকজন যুবক। এই যুবকেরা সকলেই সতীশের সহকর্মী। নতুন দলের পথিক। মানুষের পক্ষে সওয়াল করে তারা। মানুষের জন্য লড়াই করে। তাদের কোনও ডর নেই। মাথা উঁচিয়ে বদলের পক্ষে পথে নেমেছে তারা।

        সতীশের নৃশংস খুনের জন্য যে বিদ্যুৎ কর্মকারই দায়ী তা সহজেই বোঝা গেছে। কিন্তু তা সত্ত্বেও পুলিশ সাঙ্ঘাতিক রকম উদাসীনতা দেখিয়ে চলেছেন। তাই আজ থানা ঘেরাও করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সারা গ্রাম। কালু মোড়ল আর তাপস কর্মকার ইতোমধ্যেই বাড়ি ছেড়ে পালিয়েছে। নন্দী বাগদী গ্রামেই কোথাও ঘাপটি মেরে লুকিয়ে রয়েছে। তাকে খুঁজতে শুরু করেছে নতুন দলের ছেলেরা। হাতের কাছে পেলে আস্ত রাখবে না। কিন্তু এই যে অন্যায় অবিচারের বিরুদ্ধে নতুন দলের পাশে গ্রামের সমস্ত মানুষ আজ এগিয়ে এসেছে, এই পরিবর্তন বোধয় নতুন এক যুগের সূচনাকেই নির্দেশ করে দিচ্ছে। ওদের এই প্রতিবাদে সকলের সঙ্গে তরুণসঙ্ঘ বিদ্যালয়ের শিক্ষিকা ঋতমা চৌধুরীও আছেন। এমনকী সর্দার পাড়ার অগ্রদীপ দত্ত-ও রয়েছেন। এরা প্রত্যেকেই সতীশের পরিচিত ও বন্ধুস্থানীয়।

অগ্রদীপ পাশের গাঁয়ের ছেলে। কলকাতা থেকে হোমিওপ্যাথি পাশ করে এসে গ্রামেই চিকিৎসা শুরু করেছেন। তিনিও মনেপ্রাণে চান এই পোড়া দেশে তার মাতৃভূমি শিক্ষার আলো পাক। মানুষ তার সার্বিক অধিকার ফিরে পাক। পেট ভরে দুবেলা খেতে পাক সকলে। হাসি ফুটে উঠুক তার গ্রামের ছেলেমেয়েদের চোখে মুখে। সমস্ত মানুষের প্রাণে বেজে উঠুক শান্তির ললিত বাণী। তিনিও চেয়েছেন একটা নতুন সকাল। একটা নতুন যুগের সূচনা। কিন্তু নোংরা রাজনীতি ও পরিবেশ ক্রমশই অন্ধকারময় এক অধ্যায়ে আবদ্ধ করে ফেলেছে এই গ্রামের জনজীবনকে। তাই এই অন্ধকারের বিরুদ্ধে জোটবদ্ধ হয়ে একসাথে নেমেছিলেন গ্রামের সতীশ বিশ্বাস, প্রতীপ সরকার, অগ্রদীপ দত্ত প্রমুখেরা। এবং তাদের সঙ্গে গ্রামবাসীদের মতোই এই লড়াইতে থাকতে চেয়েছেন ঋতমা চৌধুরীও। সেই সূত্রে একটা অরাজনৈতিক সংগঠন তৈরি করেছেন তারা। নাম দিয়েছেন ‘আমাদের লড়াই’। এই সংগঠনে গ্রামের সাধারণ মানুষ থেকে শুরু করে শহরের বিশিষ্ট ব্যক্তিত্বরাও রয়েছেন।

সকাল এগারোটা বেজে গেছে। আজ শনিবার। থানার সামনে বিক্ষোভ কর্মসূচি চলছে। থানাকে ঘিরে রেখেছে হেঁতালদুনি গ্রামের সমস্ত লোকজন। থানার বড়বাবু এখনও পর্যন্ত কোনওরকম মুখ খোলেননি। তিনি ইচ্ছে করেই অপরাধীদের আড়াল করতে চাইচ্ছেন। আর বিদ্যুৎ কর্মকার তো তার পেয়ারের লোক। পার্টির বড়ো নেতা। তাকে যে তিনি চট করে ছুঁতে পারবেন না তা বলাইবাহুল্য। মানুষের নিরাপত্তা যাদের হাতে রয়েছে, তারাই যে নিজ স্বার্থ ও প্রয়োজনে অন্যায়কে প্রশ্রয় দিয়ে চলেছেন তা আর বুঝতে বাকি নেই কারোর। তাই আজ এই থানা ঘেরাও কর্মসূচী ততক্ষণ পর্যন্ত চলবে যতক্ষণ না অপরাধীদেরকে গ্রামবাসীদের হাতে তুলে দেওয়া হচ্ছে।

বিরোধী দলের নেতারা ভেবেছিলেন, নতুন দলের যে-কোনও একজনকে খুন করে ফেলে সাধারণ গ্রামবাসীদের মধ্যে ত্রাস জাগিয়ে রাখবে। এমনকী তাই করে মানুষের মনোবল ভেঙে দিয়ে তাদেরকে মুষড়ে দিতে চেয়েছিল ওরা। কিন্তু হঠাৎ করে যে অন্য দিকে জল বইতে শুরু করবে তা কল্পনাও করেনি কখনও। মানুষ জেগে উঠেছে। তারা কেউ অন্ধ নয়, কাজেই প্রতিবাদ শুরু হয়েছে। নতুন আলোর জন্য বিপ্লবে পা মিলিয়েছে সকলে।

থানার বাইরে হাজার লোকের সমাগম। হঠাৎ করে ভিতর থেকে প্রায় জনা দশেক পুলিশ এসে সকলের সামনে দাঁড়ালেন। বড়বাবু ধীরেসুস্থে এগিয়ে এসে একবার নতুন দলের প্রতীপ সরকারের মুখের দিকে তাকিয়ে নিলেন। সে-ই তো এই দলের অন্যতম মাথা। তাই তার দৃষ্টি আকর্ষণ করাটা জরুরি মনে করলেন বোধয়। প্রতীপ সরকার নতুন দল তথা ‘আমাদের লড়াই’ সংগঠনের প্রধান সভাপতি। তিনি কলকাতার নামী এক সংবাদপত্রের সহকারী সম্পাদক। এই গ্রামেরই মানুষ তিনি। হেঁতালদুনিতে তার আদিবাড়ি। যদিও এখন আর এখানে কেউ থাকেন না। বেশিরভাগ সময়টাই তিনি কলকাতায় থাকেন। কিন্তু তার গ্রামের বাড়িতেই সংগঠনের যাবতীয় কাজকর্ম চলে। এই গ্রামকে ও গ্রামের মানষকে যেভাবেই হোক সমস্ত অন্ধকার থেকে বের করার জন্য তিনি দৃঢ় প্রতিজ্ঞ। কারণ এই গেরাম তার বাপ ঠাকুদ্দার গ্রাম। এর মাটিকে তিনি কিছুতেই নষ্ট হতে দেবেন না। যতোই রাজনৈতিক বিদ্বেষ ও আক্রমণ থাকুক না কেন, তিনি মানুষের হয়ে লড়বেনই। যাই হয়ে যাক না কেন।

সকলের সামনে হাতজোড় করে নিয়ে বড়োবাবু নরম গলায় বললেন- ‘আপনাদের সকলের কাছে একটাই বিনীত অনুরোধ, আপনারা ধৈর্য বজায় রাখুন। সতীশ বিশ্বাসের মতো একজন সমাজ সচেতন ও পরোপকারী যুবাকে যে বা যারা নৃশংসভাবে খুন করেছে তাদেরকে আমরা খুঁজে বের করবোই। আপনারা দয়া করে আমাদেরকে সহযোগিতা করুন। আমাদেরকে সময় দিন।’

বড়োবাবুর কথা শেষ হওয়ার আগেই অগ্রদীপ দত্ত বলে উঠলেন, ‘আপনারা খুব ভালো করেই জানেন কার অঙ্গুলি হেলনে এই কাজ করা হয়েছে তা সত্ত্বেও আপনারা চুপ কেন? সেই অপরাধী একটি রাজনৈতিক দলের মাথা বলে কি আপনারা হাতে হাত রেখে বসে রয়েছেন এখনও? নাকি সেই দলের হুকুম মতো আপনারা কাজকর্ম করেন?’

বড়োবাবু অগ্রদীপ দত্তের দিকে কালো নজরে তাকিয়ে রইলেন।

গলায় একই স্বর বজায় রেখে বললেন, ‘পুলিশ তার কাজ করছে। আমরা কেউই প্রমাণ ছাড়া কোনও স্টেপ নিতে পারি না। তাই আপনাদের কাছে অনুরোধ অহেতুক সমস্যা না তৈরি করে আমাদেরকে সহযোগিতা করুন।’

প্রতীপ সরকার এগিয়ে এলেন। বড়বাবুকে উদ্দেশ্য করে রুক্ষ কণ্ঠে বললেন- ‘আমরা আপনাদেরকে তিনদিন সময় দিচ্ছি। এই তিনদিনের মধ্যে সতীশের খুনের সঙ্গে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে যুক্ত প্রতেককে অ্যারেস্ট করতে হবে। ইতিমধ্যেই আপনাদেরকে আমাদের তরফ থেকে ওই তিনজন অপরাধীর নাম আমরা জানিয়েছি। এবং এও জানিয়েছি কার প্ল্যান মাফিক এই কাজ করা হয়েছে। বেঁধে দেওয়া সময়ের মধ্যে যদি আপনারা ওই খুনিদেরকে না গ্রেপ্তার করেন, তাহলে পরবর্তীতে আমরা বৃহত্তর আন্দোলনে যাবো। এবং যা কিছু ঘটবে সেসব কিছুর জন্য আপনারা দায়ী থাকবেন। এই আমাদের শেষ কথা।’

বড়োবাবু কিছুক্ষণ থমকে রইলেন। কোনও উত্তর করতে পারলেন না। অতঃপর রুমাল দিয়ে গাল ও ঘাড়ের ঘাম মুছতে মুছতে মাথা নাড়িয়ে সকলকে আশ্বস্ত করলেন। উপস্থিত সকলে মিছিলে স্লোগান দিতে দিতে ফিরে যাওয়ার উদ্যম নিল। এমন সময় ভিড়ের মধ্যে থেকে ঋতমা চৌধুরী এগিয়ে এলেন। অগ্রদীপের কাছে গিয়ে দাঁড়ালেন তিনি। ইতিমধ্যেই লোকের ভিড় সরতে শুরু করেছে। অগ্রদীপের দিকে তাকিয়ে ঋতমা বললেন, ‘শুনছিলাম তোমার মায়ের শরীরটা ভালো নেই?’

অগ্রদীপ তার দিকে স্থির নয়নে তাকিয়ে রইলেন।

উত্তর না পেয়ে ঋতমা বললেন, ‘কিছু বলছ না যে?’

‘চলো ওই গাছতলায় দাঁড়িয়ে কথা বলি।’

কিছুটা দূরেই লাল ইঁটের রাস্তা। সেখানে পথের দুধারে ঘন জঙ্গল ও নানারকম গাছপালা। রাস্তার নীচের জমিতে একধারে ধানখেত। অন্যদিকে ছোটোখাটো খানাখন্দ এবং এঁদো ডোবা। কিছুটা এগোলেই একটা বড়ো কদম ফুলের গাছ। তার নীচে গিয়ে ঠাণ্ডা ছায়ার তলায় গিয়ে দাঁড়াল দুজন। একে অপরের চোখের দিকে দুপলক তাকাল ওরা।

ঋতমা বললেন, ‘মা কেমন আছেন এখন?’

‘অনেকটাই ভালো আছে।’

‘কী হয়েছিল তার?’

‘প্রেসারটা হঠাৎ করে বেড়ে গিয়েছিল।’

‘এখন কন্ট্রোলে আছে?’

‘হুম, অনেকটাই। দুশ্চিন্তার কিছু নেই।’

‘তুমি তো আর দেখাও করো না আমার সঙ্গে?’

‘সময় পাই না সেভাবে। সপ্তাহে দুদিন কলকাতায় যেতে হয়। গ্রামে বাড়ি বাড়ি ঘুরে ওষুধ দিতে হয় সকলকে। বুঝতেই তো পারছ?’

‘অগ্রদীপ, আমি তোমার উত্তরের জন্য আজও এতদূর হেঁটে এসেছি। তুমি জানো নিশ্চই?’

‘দেখতেই তো পারছ আমাদের জীবনযাত্রা। পারবে তুমি এসবের সঙ্গে মানিয়ে থাকতে?’

‘সব পারব।’

কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল অগ্রদীপ। এমন সময় প্রতীপদাকে তাদের দিকে এগিয়ে আসতে দেখল। তার সঙ্গে বাবলু হালদার ও বিশু প্রামানিক ছাড়াও সংগঠনের আরও কয়েকজন রয়েছেন। ওদের কাছাকাছি এসে প্রতীপদা বললেন, ‘আমি আগামীকাল ভোরবেলা কলকাতায় যাচ্ছি। বিকেলের মধ্যেই ফিরে আসব। সন্ধ্যাবেলায় মিটিং আছে। তোরা দুজনে ছটার মধ্যে চলে আসিস। লড়াই শুরু হয়ে গেছে। এবারে প্রত্যেককে একে অপরের দায়িত্ব বুঝে নিতে হবে।’

ওরা দুজনেই প্রতীপদার কথায় মাথা নাড়ল।

বাবলু বলল, ‘চলো, সকলে এবার এগোনো যাক।’

‘চলো।’

কাঁচা ইঁটের রাস্তার উপর দিয়ে হাঁটতে শুরু করল সকলে।

সূর্য তখন মাথার উপর।

 

চলবে…

ছবি- গুগল

শেয়ার করতে:

You cannot copy content of this page