আবার এসো ফিরে

             রামেশ্বর দত্ত

                    উৎসর্গ

                              শ্রী চঞ্চলকুমার ঘোষ

                        ভ্রাতৃপ্রতিম সুহৃদ ও প্রখ্যাত সাহিত্যিক

                        যাঁর অনুপ্রেরণা ও প্রত্যক্ষ সাহায্যে এই

                        এই গ্রন্থ রচনা সম্ভব হয়েছে

 

ভোরের আলো ফোটার আগে ঈশ্বরচন্দ্রের ঘুম ভেঙে গেল। গতকাল তিনি অনেক রাতে শুয়েছেন। শুতে শুতে প্রায় মাঝ রাত হয়ে গিয়েছিল। চাকরীতে ইস্তফাপত্রের মক্সো করতে সময় গেছে। জীবনে এতবড় একটা সিদ্ধান্ত নিতে চলেছেন; তাও মা ভগবতীদেবীকে না জানিয়ে। যা তিনি সচরাচর করেন না। তিনি সব কাজ মাকে জানিয়েই করে থাকেন; অথচ এই কাজটা করবার আগে তাঁকে জানানো হয়নি, এমন চিন্তা মাথায় নিয়ে তিনি বিছানা ছেড়ে উঠে পড়লেন। কলঘরে গিয়ে প্রাতঃকৃত্য সারলেন।  তারপরে ছাদে গিয়ে দাঁড়ালেন।

১৫ নং হিদারাম ব্যানার্জী লেনের তিনতলা বাড়িটার একতলায় তাঁর বাস। ওপর নিচ করে একাধিক ঘর। সব ঘর ভাড়ায় দেওয়া। একতলা দু’তলায় গোটা ষোলো ঘর ভাড়াটেতে ভর্তি থাকার কারণে ঈশ্বরচন্দ্রের জন্য বরাদ্দ হয়েছে বাড়ির বৈঠকখানা। লম্বায় চওড়ায় বেশ বড় ঘরখানা। ভাইদের সঙ্গে একটাই ঘর ভাগ করে থাকছেন তিনি।

কুয়াশায় ঢাকা ভোর।  সূর্য উঠতে অনেকটা দেরী আছে।  প্রশস্ত ছাদে এদিক ওদিক করে হাঁটাহাঁটি শুরু করলেন । এ তাঁর রোজকার অভ্যাস। তিনতলা বাড়িটা অনেকখানি জায়গা জুড়ে। ছাদের এমুড়ো ওমুড়ো করে বার কয়েক হাঁটলে মাইল খানেক হাঁটা হয়ে যায়।

ঘোরাফেরা করতে করতে ভোরের কুয়াশা ভেদ করে ঈশ্বরচন্দ্রের চোখ চলে যাচ্ছে পূবে । পর পর দাঁড়িয়ে থাকা উঁচু ঝাঁকড়া মাথাওয়ালা গাছের সারি। তার ফাঁক দিয়ে দৃষ্টিতে ধরা পড়ছে অদূরের লাল রঙা বাড়িটার কিছু অংশ। লালবাজার। কলিকাতা পুলিশের হেড কোয়ার্টার । তারও পরে রয়েছে বিস্তীর্ণ জলাশয়, লালদিঘী। লালদিঘী পেরিয়ে শহরের প্রধান ডাকঘর। ডাকঘরের উঁচু গোলাকৃতি চুড়োর আগা দৃশ্য হচ্ছে। পিছনে বহমান গঙ্গা। তা অবশ্য নজরে আসছে না। তবে গঙ্গার ওপর দিয়ে বয়ে আসা ঠাণ্ডা বাতাসের স্পর্শ ঈশ্বরচন্দ্রের গায়ে লাগছে। ফাঁকা হওয়ার কারণে কলিকাতার এই ব্যস্ত অঞ্চলেও দূর থেকে দূরান্তের বস্তু দেখা যায়। যদিবা এখন তা মসৃণ কুয়াশার চাদরে ঢাকা পড়ে রয়েছে ।  এছাড়াও বাড়িটা আশপাশের বসতবাড়ির তুলনায় অনেকটা উঁচুতে, অন্যান্য বাড়ির মাথা ছাড়িয়ে, তাই দৃষ্টির গতি এখানে অবাধ।

জায়গাটা বউবাজার অঞ্চলের মধ্যে পড়ে। মধ্য কলিকাতায় অবস্থিত। পুরনো জায়গা । প্রচলিত ধারণা, জায়গাটা ছিল মাড়োয়ারি ব্যবসায়ী বিশ্বনাথ মতিলালের। তাঁর পুত্রবধূ ছিলেন বাঙালি। মতিলাল তাঁর পুত্রবধূকে(বহুকে) জায়গাটা দান করেন। সেই থেকে এর নাম হয় বহুবাজার। পরে তা রূপ নেয়,বউবাজার শব্দে। দেশীয় পয়সাওয়ালা ব্যবসায়ীদের বাস বেশি। তাদেরই বানানো এইসব বাড়ি।

এখানে পুরনো আমলের অনেক বাবুদের বাড়ি রয়েছে। বাবু-কালচারও সমানভাবে চলছে। ঈশ্বরচন্দ্রের অবশ্য সেসব দিকে মন নেই। তিনি অন্য ধাঁচের মানুষ। উপার্জনের প্রায় সবটাই স্বজন-প্রিয়জন ও আর্তের সেবায় উৎসর্গ করেন। শহুরে এই বাবুকালচারকে তিনি মনে মনে অত্যন্ত ঘৃণা করেন। তিনি তো আদত শহুরে লোকও নন। এসেছেন গ্রাম থেকে। মানে এসেছিলেন, তাও সে অনেক বছর আগে বাবা, ঠাকুরদাসের হাত ধরে। পরে ঠাকুরদাস গ্রামে ফিরেছেন। জীবনের অনেকটা সময় ধরে যুদ্ধ চালিয়ে  ছেলেদেরকে পড়াশোনা শিখিয়ে মানুষের মতো মানুষ করে দিয়ে তিনি ফিরেছেন; সেটাও কিছুটা অনিচ্ছাকৃত হয়ে, শুধু মাত্র ছেলের জোড়াজুড়িতে। এখন তিনি গ্রামে থিতু হয়ে হয়েছেন। ঘর বাড়ি দেখাশোনা, সামান্য চাষবাসে নিজেকে ব্যস্ত রাখেন। আর শহরে পড়াশোনা ইত্যাদিতে রত  ভাইদের দায়িত্ব ঈশ্বরচন্দ্র নিজের ওপর তুলে নিয়েছেন।

সুবর্ণভূমে পুষ্পকেতু

মাঝে দীর্ঘ বারো বছর কেটে গেছে। এই সময়ে কলিকাতায় জনসংখ্যা বেড়েছে । তাই এইসব বড় এবং উঁচু বাড়ির বিশাল বৈঠকখানা ঘরগুলো ভাড়া দিয়ে দেওয়া হচ্ছে বহিরাগতদের। তারা মেসবাড়ি করে থাকছে। এক একটা ঘরে দশবারো জন করে থাকে। তাদের মধ্যে বয়জ্যেষ্ঠ কেউ একজন শহরে এসে চাকরিবাকরি নিলে গ্রাম, পাড়াপড়শী, আত্মীয়দের মধ্যে থেকে লোকজনকে একে একে কলিকাতায় এনে ঠাঁই দেন। সেইসব বাসিন্দারা কেউ থাকে চাকরীর খোঁজে, কেউ করে  ইশকুল কলেজের পড়াশোনা। কচি ছোট ছেলের দল, তারা  ওই পরিবারের কর্তার ভাই, ভাইপো বা কখনও সখনও পাড়া প্রতিবেশীর ছেলে হয়ে থাকে ।

ঈশ্বরচন্দ্রের ক্ষেত্রেও ঠিক এমনটা হয়েছিল। তাও তা ঘটেছিল অনেক বছর আগে । তিনি তখন আট বছরের বালক। বাবা ঠাকুরদাস হাত ধরে তাকে শহরে এনেছিলেন এবং নিজের তত্ত্বাবধানে রেখে পড়াশোনা শেষ করান। ঈশ্বরচন্দ্র এখন চাকরী করছেন । কলেজ অধ্যাপকের চাকরী। মাস মাইনে পান পঞ্চাশ টাকা। পুষ্যি তিনি ছাড়াও রয়েছে নিজের মেজ ও সেজ ভাই; সঙ্গে  মাসতুত, পিসতুত, খুড়তুত ভাইয়েরা । তারাও কিছু যে একলা, তা নয়। দুজন করে খুড়তুত, পিসতুত আর একজন মাসতুত ভাই রয়েছে। সঙ্গে একজন ভৃত্যকেও ঈশ্বরচন্দ্র আনিয়ে নিয়েছেন । না হলে এত জনের রান্না খাওয়া, বাজারহাট করার কাজ চলবে কেমন করে? তাই সর্বসাকুল্যে লোক হয়েছে ন’জন। এক ঠাঁই, এক খাওয়া, শোয়া করে দিন কাটছে সকলের। খরচ ঈশ্বরচন্দ্রের ওই পঞ্চাশ টাকা মাইনে থেকে চলছে। ভালোই দিন কাটছে তাঁর । নিত্যকার কাজে কোনও বিরাম নেই। তবে, আজ তাঁর মনটা বেশ চঞ্চল। তাই রাত থাকতে ঘুম ভেঙে গেছে। ছাদে উঠে এসেছেন।

ভোরের কুয়াশা মেখে ছাদে হাঁটছেন তিনি। গায়ে রয়েছে মোটা চাদর।  সূতির। হাতে বোনা। মা ভগবতীদেবীর দান।

ঈশ্বরচন্দ্রের পৈতৃক বাড়িতে মাকু রয়েছে। ভগবতীদেবী তাতে নিয়মিত তাঁত বোনেন। পেশায় নয়; নেশায়। সময় পেলেই তিনি তাঁত বুনতে বসেন। তাঁর হাতে এটাসেটা বোনার কাজ চলতেই থাকে। এছাড়াও বাড়ির অন্যান্য মেয়েরাও মাকু চালায়। দরকার মতো কিছু কিছু বানিয়ে নেয়। আসলে,  বাংলার গ্রামঘরে তাঁত বোনার চল ভালো রকম বিদ্যমান। নিত্যকার পরিধেয় অনেক কিছুই ঘরে বানিয়ে নেওয়া হয়। কেউ বা তা বাজারে বিক্রির জন্যেও বোনে।

কুয়াশায় ঈশ্বরচন্দ্রের গায়ের চাদরটা স্যাঁতস্যাঁত করছে । কাঁচা হিমে মাথায় জড়ানো গরম কাপড়ের ফেট্টিও বেশ ভিজে উঠেছে। সচরাচর তিনি এত ভোরে ছাদে ওঠেন না। তাও এই শীতের সময়। কারণ সর্দির ধাঁচ রয়েছে তাঁর।  যদিবা নিয়মিত ব্যায়াম কসরৎ করা শরীর;  কিন্তু শ্লেষ্মার ধাত  থেকেই তা হয়; যা কিনা তাঁর শরীরে বাসা বেঁধেছে অতীতে। ছোটবেলায় কলিকাতায় পা রাখার পর থেকে । এমনিতে গ্রামে গিয়ে থাকলে এসবের বালাই থাকে না। কিন্তু কলিকাতার বাতাসে যেন ময়ালের নিঃশ্বাস রয়েছে, যা তাঁকে মাঝে মাঝেই সর্দিকাশিতে কাবু করে  ফেলে। হতে পারে, একেবারে সেই ছোট বয়সে বড়বাজারের জগত সিংহ মশায়ের বাড়ির নিচের স্যাঁতসেঁতে ঘরে থেকে অসুখে পড়ার ফল এখনো তাঁর পিছু ছাড়েনি।

জগত সিংহ ছিলেন শেঠ মানুষ। তাঁর বাড়ি বড়বাজার অঞ্চলে; ১৩ নং দয়েরহাটা স্ট্রীটে। সেখানে নিচের তলায় ভাড়ায় ছিলেন ঠাকুরদাস। ঠাকুরদাসের বন্ধু মানুষ জগত সিংহ। স্বল্প আয়ের মানুষ ঠাকুরদাসকে তিনি নামমাত্র ভাড়ায় ঘর ভাড়া দিয়েছিলেন। ঈশ্বরচন্দ্রের ছোট বয়সের অনেক কটা বছর সেখানেই কেটেছিল। সেই থেকে শ্লেষ্মা বসে গেছে শরীরে।

পায়চারী, শরীরিক ব্যায়াম করা ঈশ্বরচন্দ্রের ছোটবেলা থেকে অভ্যেস। তবে তিনি তা করেন   সকালে রোদের ছটা বেরবার পর। আজ আর সেই পর্যন্ত সময় বিছানায় থেকে  কাটাতে পারেননি। মাঝ রাতেই ঘুম ভেঙে গিয়েছিল। তারপরেও শুয়ে শুধু এপাশ ওপাশ করেছেন। ভোরের প্রথম কাক ডাকার শব্দ কানে যেতেই উঠে পড়েছেন। ঘড়িতে চোখ রেখে দেখেছিলেন চারটে দশ। নির্জন ছাদে এখন হাঁটছেন আর নানান কথা ভাবছেন।  – জীবনে কোনও কাজ করতে গেলে সচরাচর পিছনে ফিরে তাকান না। মনে তাঁর এতটাই জোর, তিনি জানেন, যে পথে এগোচ্ছেন, সেটা সঠিক। জেদ তাঁর অদম্য । তবে নিজের বিচার বুদ্ধির ওপরেও যথেষ্ঠ আস্থা রাখেন। তাই, একবার  যে কাজ করবার সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেন, তা থেকে পিছু হটেন না। ঠিক যেমন এখনকার সিদ্ধান্তটা। যা হচ্ছে কিনা, বর্তমান কাজে ইস্তফা দেওয়া। মাকে না জানিয়ে কাজে ইস্তফা পত্র জমা দেওয়াটা কি ঠিক হচ্ছে? মায়ের অনুমতি বিনা কোনও কাজ তিনি করেন না।

মনে দোলাচল, কী করবেন? ইস্তফা পত্র তৈরী। তা জমা দিয়েই বাড়ি যাবেন; নাকি আগে বীরসিংহে ঘুরে আসবেন? মায়ের অনুমতি নিয়ে আসবেন?

ইস্তফা যে দেবেন, তাতে তিনি হিমালয়ের মতো নিশ্চল। প্রশ্নটা, আগে মাকে জানানো, নাকি পত্র জমা দিয়ে মাকে গিয়ে বলা? নিজের নিয়ম নীতি মেনে কাজটা হচ্ছে না বলেই মনে এত দোলাচল। তা থেকে মুক্ত হবার জন্যে ছাদে ঘনঘন এদিক ওদিক যাওয়া আসা করছেন । আশু কর্তব্য স্থির করতে পারছেন না। এ সময় বিষয়টা নিয়ে কারোও সঙ্গে আলোচনা করতে পারলে দোলাচল থেকে মুক্তি পেতেন। কর্তব্য স্থির করে  ফেলতেন; কিন্তু কার সঙ্গে আলোচনা করবেন? বাবাকেও গ্রামে পাঠিয়ে দিয়েছেন। সঙ্গের ভাইরা সব ছোট । যদিবা মেজভাই, দীনবন্ধু এখন অনেকটাই বড় হয়েছে। তবে, সেও তো ঘুমিয়ে রয়েছে। অথচ হাতে সময় নেই। আজকেই ইস্তফা পত্র জমা দেবেন ঠিক করে রেখেছেন।

দীনবন্ধুরও ঘুম সকালে ভাঙে। ঘরকন্নার কাজে দাদার মতো তিনিও ভৃত্য, শ্রীরাম নাপিতকে সাহায্য করেন । ঘুম ভাঙার পর প্রাতঃকৃত্য সেরে নিলেন তিনি। রান্নার জায়গায় উঁকি দিলেন। দাদাকে সেখানে দেখতে পেলেন না। শ্রীরামকে প্রশ্ন করে জানলেন, সেই ভোর থেকে দাদা ছাদে রয়েছে; এখনও নামেনি।

ছাদে উঠে এলেন দীনবন্ধু । দেখলেন, বড়দা আপন মনে পায়চারি করে চলেছেন । কিছুটা আনমনা ভাবেই ঘুরছেন ফিরছেন।  কেউ ছাদে এসেছে,  দাদা খেয়াল করছে না । তাঁকে বিরক্ত না করে  তিনিও দাদার পিছন পিছন হাঁটতে শুরু করলেন । ভোরের ঠাণ্ডা বাতাস গায়ে লাগছে। ভালোই লাগছিল তাঁর।

অনেকক্ষণ পরে ঈশ্বরচন্দ্রের চোখ পড়ল ভাইয়ের ওপর। প্রশ্ন করলেন, কিরে, তুই কখন এলি?

-কিছুটা আগেই এসেছি। তুমি আপন মনে চলাফেরা করছ দেখে সাড়াশব্দ করিনি।… কী এত ভাবছো, দাদা? গতকাল অনেক রাত পর্যন্ত লেখালিখি করেছ। তারপর আজ ভোর হবার আগে ছাদে এসে আনমনা হয়ে ঘুরছ! তুমি কি…

ভাইয়ের কথার মাঝে ঈশ্বরচন্দ্র বলে উঠলেন, তুই যখন এসে গেছিস ভালোই হল। কথাটা তোকেই বলি। সত্যিই আমি একটু চিন্তার মধ্যে রয়েছি রে, দীনু।

কাজে দাদার ইস্তফা দেওয়ার বিষয়টা দীনবন্ধুর গোচরে ছিল। কলেজ থেকে তা শুনেছেন। যদিবা তাঁর নিজের কলেজ ফোরট উইলিয়াম আর দাদার হচ্ছে সংস্কৃত কলেজ। তবে কথাটা চাপা থাকেনি। দাদার কলেজের সেক্রেটারি, রসময় দত্ত মহাশয়ের সঙ্গে যে কলেজের নিয়ম সংস্কার সংক্রান্ত নানান বিষয় নিয়ে দাদার মতবিরোধ চলছে, এ এখন তাঁর মতোই অনেকের জানা হয়ে গেছে। সে নিয়েই প্রশ্ন করলেন তিনি,  তোমার চাকরীর ইস্তফার বিষয় নিয়ে এত ভাবছ?

-তাই বটে। ঠিকই ধরেছিস তুই ।… আচ্ছা দীনু, আমি কাজে ইস্তফা দিলে মাঝের কটা মাস তুই সকলকে নিয়ে চালিয়ে নিতে পারবি না?

-খুব পারব দাদা। চিন্তা কোর না। তুমি যা মনস্থ  করেছ, সেদিকেই এগিয়ে যাও।

বুক ভরে বাতাস টানলেন ঈশ্বরচন্দ্র। ভোরের স্নিগ্ধ বাতাস মস্তিষ্কের কোষে কোষে ছড়িয়ে পড়ল। মনের উদ্বেগ কমে এল। স্বস্তির কথা শোনালেন।  বললেন, তুই আমাকে চিন্তামুক্ত করলি রে দীনু। এখন নিশ্চিন্তে আমার ইস্তফা পত্রটা দিয়ে দিতে পারি। তুই তো জানিস কী কারণে আমার ইস্তফা?

-কিছুটা জানি। প্রকৃত কারণটা জানতে পারলে ভালো হয়।

ঈশ্বরচন্দ্র বলতে শুরু করলেন, আসলে, বাবু রসময় দত্ত মানুষটাকে বোঝাতে চাই, ‘শিক্ষা সংস্কার পরিক্রম্য’ রিপোর্ট আমি অনেক ভাবনাচিন্তা করেই করেছি। সংস্কৃত কলেজটাকে তো আর আমি আজ থেকে দেখছি না, দেখছি আমার শিক্ষাকাল থেকে। নিজের নখের মতো চিনি। অথচ চোখের সামনে দেখছি, দিনে দিনে কলেজের কী অধঃপতন হচ্ছে। পণ্ডিত মশাইরা সময়ে আসছেন না। যে যাঁর সময় মতো এসে কলেজে ঢুকছেন।  ক্লাসে বসে ছাত্রদের দিয়ে হাতপাখা নাড়াচ্ছেন। ছাত্রদের এমন এমন সব রসময় কবিতার শ্লোক পড়াচ্ছেন, যা পড়ে তাদের মধ্যে রসালাপের উদ্রেক ঘটছে।। তারপরেও, ইংরিজির পাঠ দেওয়া হচ্ছে না। যা অবশ্য আমার পড়ার সময়েও ছিল না। ছ বছর আগে আমি ওই কলেজ থেকে পাশ করে বেরিয়েছি। তা তো তুই জানিস। কিন্তু এই ছ বছরে পাশের হিন্দু ইশকুলের ছাত্ররা পড়াশোনায় কত এগিয়ে গেছে। ছেলেরা সেখানে ইংরিজি শিখছে। আর আমার কলেজে…

একটানা কথা বলতে বলতে ঈশ্বরচন্দ্র হাঁপিয়ে উঠলেন। দীনবন্ধু এসবের কিছুটা জানলেও পুরোটা তার গোচরে ছিল না। দাদার কথা তাই নিশ্চুপে শুনছিলেন। কথা বন্ধ হতে বললেন, দাদা, আমি জানি, তুমি যে কাজ করো, তার পিছনে কারণ অবশ্যই থাকে। বেশ ভেবেচিন্তেই করো…

দীনবন্ধুর কথার মাঝে ঈশ্বরচন্দ্র দম নিয়ে বলতে শুরু করলেন আবার। পুরনো প্রসঙ্গ ধরে বলতে থাকলেন, অধ্যাপকরা সবাই আমার পূর্বতন শিক্ষক। তাই তাঁদের বিশেষ কিছু বলতে পারছি না। এসব কারণেই না শিক্ষা সংস্কারের প্রয়োজন অনুভব করে আমি রিপোর্ট দিয়েছিলাম। আরোও কারণ, কলেজে ইংরেজির পাঠ নেই, তাই বহু ছাত্র সংস্কৃত কলেজ ছেড়ে পাশের হিন্দু ইশকুলে চলে যাচ্ছে ইংরেজির পাঠ নিতে। তাহলে, এখনও যদি আমরা কলেজে নতুন ভাষার শিক্ষা চালু করতে না পারি, আর কবে তা করব? কলেজ যখন আমআঁটির মতো শুকিয়ে যাবে, তখন? ময়েট সাহেব এটা বুঝতে পেরেছেন বলেই না আমাকে কাজে লাগিয়েছেন? আর সেখানে কিনা, সেক্রেটারি দত্ত মশাই আমায় দিয়ে ওই রিপোর্টকে লঘু করিয়ে নিয়ে ওপরওয়ালাদের কাছে পাঠাতে চাইছেন! দ্যাখ, উনি জজিয়তি করা মানুষ। ওনার সঙ্গে এই নিয়ে আমি তর্ক বিতর্কে নিজেকে জড়াতে চাই না। তবে, এ চাকরি করা আমার দ্বারা হবে না রে দীনু । তার থেকে কাজে ইস্তফা দেওয়াই শ্রেয়।

দীনবন্ধু  মনোযোগ দিয়ে দাদার কথা শুনছিলেন।  কথা শেষ হতেই তিনি  দাদাকে অন্য বিষয়ে প্রশ্ন করলেন। তাঁর জিজ্ঞাস্য, এ বিষয়ে কি তুমি  মদনমোহন তর্কালঙ্কার মশায়ের সঙ্গে আলোচনা করেছ?

মদনমোহন তর্কালঙ্কার ঈশ্বরচন্দ্রের সুহৃদ, সহকর্মী এবং দুজনেই এক যৌথ ব্যবসার অংশীদার। দুজনে মিলে একটা বই ছাপার প্রেস চালান এবং বই প্রকাশও করেন সেখান থেকে।

ঈশ্বরচন্দ্র উত্তর করলেন, তা করেছি । তবে মায়ের অনুমতি নেওয়া হয়নি। সেটাই আমাকে ভাবাচ্ছে; আমার কাছে একটা বড় বিচ্যুতি মনে হচ্ছে এখন।

ঘাড় নিচু করে  দীনবন্ধু অনেকটা সময় চুপ করে রইলেন। কী যেন ভাবছেন।  পরে দাদার কথিত ইস্তফা বিষয়ের প্রসঙ্গে আসলেন প্রথমে। বললেন, দাদা, কাজে ইস্তফা দেওয়া, না দেওয়ায় তোমার বিবেচনাই শেষ কথা। তবে ইস্তফা দিলে, মায়ের অগ্রিম অনুমতি না নেওয়াতে বুঝছি, তোমার মন দোলাচলে রয়েছে। সেই কারণে বিনয়ের সঙ্গে বলতে চাই, তোমাকে আমার উপদেশ দেওয়া ঠিক মানায় না। তবে, আমার একটা কথায় দোষ নিও না।

-কী বলবি বল না। তুই তো আমার ভাই-ই, দীনু। তুই যা বলবি, নিশ্চয় ভেবেই বলবি।

মাথার চুলে পাকদণ্ডী কাটতে কাটতে দীনবন্ধু বললেন, ইস্তফাপত্র জমা দেওয়াটা দিন কয়েক পিছিয়ে দিলে  হয় না, দাদা?

-কেন বলতো?

ঈশ্বরচন্দ্র সপ্রশ্ন দৃষ্টি রাখলেন দীনবন্ধুর দিকে। তাঁর ভ্রম হল, ভাই কি তাহলে অন্য কোনও প্রসঙ্গ টেনে আনবে? তবে, তা নয়। দীনবন্ধু বললেন, আমার মন বলছে, আগে তুমি মায়ের কাছে যাও। বিষয়টা একবার মাকে জানিয়ে এসে ইস্তফাপত্র জমা করো। তাতে তোমার চিন্তা যেমন দূর হবে, মঙ্গলও হবে।

দীনুর কথাটা মনে ধরেছে ঈশ্বরচন্দ্রের । তিনি বললেন, এটাই আমি স্থির করতে পারছিলাম না। তুই আমাকে নিশ্চিন্ত করলি। তাহলে, আগে মায়ের কাছে যাই, কী বল? মাকে না জানিয়ে কোনও কাজই তো আমি করিনি আজ পর্যন্ত। এই কাজটাই বা করি কেন?

 

চলবে…

ইলাস্ট্রেশন- গুগল 

শেয়ার করতে:

You cannot copy content of this page