আবার এসো ফিরে

রামেশ্বর দত্ত

 

ঈশ্বরচন্দ্র সপ্রশ্ন দৃষ্টি রাখলেন দীনবন্ধুর দিকে। তাঁর ভ্রম হল, ভাই কি তাহলে অন্য কোনও প্রসঙ্গ টেনে আনবে? তবে, তা নয়। দীনবন্ধু বললেন, আমার মন বলছে, আগে তুমি মায়ের কাছে যাও। বিষয়টা একবার মাকে জানিয়ে এসে ইস্তফাপত্র জমা করো। তাতে তোমার চিন্তা যেমন দূর হবে, মঙ্গলও হবে

দীনুর কথাটা মনে ধরেছে ঈশ্বরচন্দ্রেরতিনি বললেন, এটাই আমি স্থির করতে পারছিলাম না। তুই আমাকে নিশ্চিন্ত করলি। তাহলে, আগে মায়ের কাছে যাই, কী বল? মাকে না জানিয়ে কোনও কাজই তো আমি করিনি আজ পর্যন্ত। এই কাজটাই বা করি কেন?

তারপর… 

দীনবন্ধুর মুখে সামান্য হাসি ফুটল। দাদার জেদ তো ভাই জানে; যা কিনা একমাত্র মা-ই প্রশমন করতে পারে ।  সাথে সাথে একথাও তিনি ভাবলেন, মায়ের সঙ্গে আলোচনার পর দাদা যদি কিনা সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করে..,

দাদা তাঁর মত গ্রহণ করায় দীনবন্ধু উৎসাহিত হলেন। ফের প্রশ্ন করে বসলেন, মদনমোহন তর্কালঙ্কার মশায়ের সঙ্গে যে সংস্কৃত যন্ত্র নামে ছাপাখানাটা বসিয়েছ, তার কী হবে, দাদা?

-ছাপাখানা আমরা প্রাণ দিয়ে বসিয়েছি। তার জন্যে আমার ছ’শ টাকা কর্জ হয়েছে। তা তো আমাকে শোধ করতেই হবে। তবে সেজন্যে  চিন্তা করি না।  এই তো দ্যাখ না, বই বেচার তিন’শ টাকা পেয়েছি। বাকিটাও এসে যাবে…

-হ্যাঁ দাদা, আমার বিশ্বাস তা অবশ্যই হয়ে যাবে। কারণ তোমার বই,  বেতালপঞ্চবিংশতি কলেজে বেশ চলছে। দেখছি তো, সকলে মনোযোগ সহকারে পড়ছে। বলছে, এত ভালো বই বাংলা ভাষায় এর আগে লেখা হয়নি।

-তোর কথা শুনে আমার মনে বল আসছে। ভালোও লাগছে। জানিস তো, আমারও ইচ্ছে ছিল, সহজ সরল বাংলা ভাষায় একটা বই রচনা করার। এটা আমার মৌলিক রচনা নয়, তা বোধ হয় তুই জানিস।   নেহাৎ আমার কলেজ অধ্যক্ষ মেজর জি টি মার্শাল আমাকে এই সুযোগটা দিয়েছিলেন। তিনি বলেছিলেন, হিন্দিতে রচিত বৈতালপচীসী নামের যে বইটা এখন পড়ানো হচ্ছে, তার কোনও কোনও অংশ এত দুরূহ এবং অসংলগ্ন যে ছাত্রদের কাছে তা অর্থবোধ ও তাৎপর্যগ্রহ হয়ে ওঠে না। পরিবর্তে ওই বইয়ের পুস্তকান্তর করা উচিত। তিনিই কাজটা আমার হাতে দিয়েছিলেন। এজন্যে আমি অবশ্যই ওনার কাছে কৃতজ্ঞ। তবে কাজে হাত দিয়ে বুঝেছিলাম, বইটা প্রকৃতই ভালো রচনা। কিন্তু মাতৃভাষায় তা রচনা করতে গেলে, বাংলা ভাষাকে আরও সহজ সরল করবার প্রয়োজন রয়েছে।  সেভাবেই আমি মূল বইয়ের ভাষান্তর করেছি।

-সত্যিই দাদা, বইটা সুখপাঠ্য হয়েছে। বিশেষ করে লেখায় দাঁড়ি, কমা অনুচ্ছেদ ইত্যাদির ব্যাবহারে তা এখন সাধারণের বোধের মধ্যে এসেছে। পড়ে সুখ পাওয়া যাচ্ছে।

ভাইয়ের কথায় উৎসাহিত বোধ করলেন ঈশ্বরচন্দ্র । জানতে চাইলেন, বইটা পড়েছিস?

-অবশ্যই পড়েছি। তোমার লেখা প্রথম বই, আর আমি পড়ব না? দীনবন্ধু উত্তর করলেন।

ঈশ্বরচন্দ্র বললেন, এর জন্যে আবারও আমি মার্শাল মহাশয়কে ধন্যবাদ জানাই। কলেজ কতৃপক্ষ বইটা প্রকাশ করে সকলের অসীম উপকার করেছে। আমার আশা ছিল না,  এই বই সর্বত্র গৃহীত হবে। কিন্তু সৌভাগ্যক্রমে বাংলা ভাষার অনুশীলনকারী ব্যক্তিমাত্রেই তা সাদরে গ্রহণ করেছে।  এতে আমি অত্যন্ত আনন্দিত। বইটা দেশীয় প্রায় সব বিদ্যালয়ে প্রচলিত হয়েছে। প্রথম সংস্করণ শেষের মুখে।

-এর দ্বিতীয় সংস্করণও কি প্রকাশিত হবে , দাদা?

-তার তোড়জোড় চলছে। এবার বইটায় আরও উৎকর্ষতা আনছি, বুঝলি?

-যেমন?

-বইয়ের যে যে স্থানের কোনও অংশ অপরিশুদ্ধ ছিল, তা ঠিক করছি। অশ্লীল পদ, বাক্য ও উপাখ্যান বাদ দিচ্ছি। এভাবেই জানিস তো, আমাকে বাংলা ভাষার উন্নতির জন্যে এখনও অনেক কাজ করে  যেতে হবে। তাই ভবিষ্যতে কী করব, তা এখন থেকেই ছক কষে পা ফেলছি…, হঠাৎ প্রসঙ্গ পরিবর্তন করে বলে উঠলেন, দীনু, তোর কথা মতো ইস্তফাপত্র আজকে জমা দিচ্ছি না।

দীনবন্ধু যেন অনেকটা স্বস্তি পেলেন। দুজনের মাঝে দাঁড়ানো অবস্থানের দূরত্বটা কমিয়ে আনলেন ছোটভাই। দাদা তাঁর পরামর্শটা মেনে নেওয়ায় কৃতজ্ঞতায় মাথা নুইয়ে গেল তাঁর। দাদার পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করলেন। ঈশ্বরচন্দ্র ভাইকে বুকে তুলে ধরলেন। তাঁর কাঁধে হাত রাখলেন । বলতে শুরু করলেন, দীনু, আমাদের মা শুধু নামেই ভগবতী নন, মা হচ্ছেন সাক্ষাত দেবী ভগবতী। দয়াধর্ম , ক্ষমাগুণ, সঙ্কটে বিচক্ষণক্ষম, বুদ্ধি পরামর্শে জ্ঞানমন্ডিত এক মহিলা। তাঁর মত বিনে কাজে ইস্তফাপত্র জমা দিয়ে আমি বোধ হয়, অনেক বড় দোষ করতে যাচ্ছিলাম। তুই আমাকে সত্যিই উদ্ধারের পথ দেখালি। ঠিক আছে আগে বীরসিংহে যাই; মাকে জানিয়ে আসি, তারপরে মা যেমন আজ্ঞা করেন, তাই করব। …

ঈশ্বরচন্দ্র জানিয়ে দিলেন, আগামীকাল বীরসিংহ গ্রামে যাচ্ছেন তিনি ।

(২)

ঈশ্বরচন্দ্র ভাইদের সঙ্গে নিয়ে বীরসিংহে চলেছেন। তারাও দিনকয়েক স্বগ্রাম ঘুরে আসুক, এই ইচ্ছে ঈশ্বরচন্দ্রের । বাসা বাড়ি ছেড়ে একটানা কলিকাতায় পড়ে থাকতে থাকতে ছেলেগুলো হাঁপিয়ে উঠেছে। মা বাবা, ভাই বোনের সঙ্গে কয়েকটা দিন কাটিয়ে আসলে ওদেরও মনটা তরতাজা হয়ে যাবে; ফিরে যে যার কাজে ভালভাবে মন বসাতে পারবে। এই ভাবানাই ভাইদেরকে সঙ্গে নেবার কারণ হয়েছে ঈশ্বরচন্দ্রের।

মেদিনীপুর হয়ে বীরসিংহ গ্রামে যাচ্ছে সকলে। কলিকাতার বউবাজার থেকে বেরিয়ে হাঁটতে শুরু করলেন। এই শুরু হল হাঁটা।

মেদিনীপুর দীর্ঘ পথ। প্রায় সবটা পথই হেঁটে পেরবেন, মনস্থির করেছেন । অন্য উপায়ও তো সেরকম কিছু নেই। যা রয়েছে, তা অতি মূল্যযুক্ত। খরচের সে ক্ষমতা নেই ঈশ্বরচন্দ্রের।

প্রথম তো দলটাকে নিয়ে পৌঁছলেন কলিকাতার হাটখোলায়। এরপর গঙ্গা। এদিকের হাঁটা পথ আপাততঃ শেষ। এবার নদী  পেরতে হবে। খেয়া পাড়ে এসে দাঁড়িয়েছেন। পাশে ভাইরা। সকলে স্থির। চোখ গঙ্গার জলে।  স্রোতস্বিনী গঙ্গা। কুলকুল রবে বয়ে চলেছে। নৌকো ভাসছে নদীর বুকে। কিছু নৌকো যাত্রী বহন করে চলেছে। কিছুবা অলস হয়ে শুধুই ভাসছে। সেগুলো মেছো নৌকো। তা থেকে নদীর জলে জাল বেছানো হয়েছে।  দুটো নৌকো তাদের বেছানো জাল ধীরে ধীরে গোটাচ্ছে। অর্থাৎ মাছের দেখা পেয়েছে তারা। কলকাতার গঙ্গায় ইলিশের ঝাঁক এসময়েই আসে। ঈশ্বরচন্দ্র জল থেকে চোখ সরিয়ে এবার আকাশের দিকে তাকালেন। আকাশ আপাততঃ পরিষ্কার। তবে মাঝে মাঝেই মেঘ করছে। ঝিরঝিরে বৃষ্টি হচ্ছে এ’কদিন।

ঘাটে ছোট বড় করে বেশ কিছু নৌকো যাত্রী পাবার আশায় অপেক্ষারত। সেখান থেকে মাঝিদের হাঁকডাক কানে আসছে। ঘাটের সিঁড়ি বেয়ে ঈশ্বরচন্দ্র নীচে নামলেন। একটা ফেরি নৌকো বাছলেন। মাঝির সঙ্গে দরদাম করে ভাড়া স্থির করলেন। ভাড়া এক টাকা। নৌকো ওপারে শালকিয়া ঘাটে পৌঁছিয়ে দিল সকলকে ।

হাওড়া জেলায় পড়লেন। জি টি রোডে এসে উঠলেন। দীর্ঘ এ পথ। চট্টগ্রাম থেকে শুরু হয়ে ভারতের বুক চিরে চলে গেছে সুদূর আফগান দেশ পর্যন্ত। এই পথই যে হাওড়াকে ছুঁয়ে বর্ধমান হয়ে আরও উত্তরে চলে গেছে, তা ঈশ্বরচন্দ্র জানেন। তবে তাঁকে ওই পথ ধরে আগে যেতে হবে মশাট। বর্ধমানের পূর্বেই তা আসবে। সেখান থেকে অন্য পথ ধরে এগোতে হবে মেদিনীপুরের দিকে।

জি টি রোড, আদতে যা ছিল উত্তরাপথ, বা সড়ক-ই-শেরশাহ নামে পরিচিত। ওই পথে একসময় হাতি আর ঘোড়া চলার চল ছিল। দূর দূর দেশে বাণিজ্য চলত ওই পথ ধরে। এখন সেখানে পথে চলেছে গোরুর গাড়ি। ঘোড়ায় টানা গাড়ি। অশ্বারোহীর বদলে বেশি গাধা বা খচ্চরের চল। কিছু পাল্কী। আর পায়ে হাঁটা মানুষের দল। ঈশ্বরচন্দ্র নিজের দলটাকে নিয়ে পায়ে হাঁটা দলে ভিড়ে গেলেন।

পাকা সড়ক । ইংরেজ কোম্পানির দৌলতে তা তৈরী। লেফট রাইট করবার তালে পা ফেলছেন ঈশ্বরচন্দ্র।  আগে আগে তিনি, পিছনে এগোচ্ছে তাঁর ফৌজ। পথের ধারে বৃক্ষের সারি। বট অশ্বত্থ আমের বৃক্ষ। আকারে বেশ বড়। উঁচুতে মাথা তুলে ঝাঁকড়া ডালপালা আর পাতার ঝাড় নিয়ে দাঁড়িয়ে। পথশ্রান্ত পথিকের বিশ্রামস্থল।

দিনের বেলা পথ ধরে হাঁটছে সকলে। হাঁটায় ঈশ্বরচন্দ্রের সঙ্গে পেরে ওঠা দায়। হনহনিয়ে মাইলের পর মাইল হেঁটে চলতে পারেন তিনি। তবে, আজ সঙ্গে ছোট ভাইরা রয়েছে। দীনবন্ধু বাদ দিয়ে আর সকলে এসেছে। দীনবন্ধু কলেজের কাজে ব্যস্ত। তিনি কলিকাতায় থেকে গেছেন। সুবল, তারাপদ, করে অন্যেরা জনা ছয় সম্পর্কীয় ভাইগুলো সকলে এসেছে। তাদের পথশ্রম বাড়বে ভেবেই ঈশ্বরচন্দ্র নিজের চলন সংযত রেখেছেন।

আকাশে ক্ষণস্থায়ী মেঘের ছায়া গায়ে মেখে চলেছে সকলে। রোদ তেমন নেই ।পথ চলায় কষ্ট হচ্ছে না। সকালে বেরিয়ে ঘণ্টা ছয় হেঁটে অনেকটা পথ পার হয়েছেন। দুপুর গড়াতে শুরু করেছে। এবার খিদেয় পেট  ডাকা শুরু হয়েছে । সঙ্গে পুটুলি ভরে আনা চিঁড়ে মুড়ি, গুড় দিয়ে আহার হল। ভরপেট জল পান করা হল। আবার হাঁটা শুরু।

এত করেও দিন শেষে মশাটকে ছুঁতে পারল না ঈশ্বরচন্দ্রের দলবলের ছেলেরা। সন্ধ্যা নেমে আসল। রাতে পথ চলা নাস্তি। বিরামের প্রয়োজন। সঙ্গে বিশ্রামও হবে। পথ পাশে সরাইখানা দেখলে সেখানেই রাত কাটানো হবে।

চলতি পথে এধরণের সরাইখানা মাঝে মধ্যেই পাওয়া যায়। এগুলো ধনী ব্যক্তিদের দান। যাত্রীদের রাত্রি যাপনের জন্যে তৈরী করে রাখা। এর বাণিজ্যিক দিকটাকে উপেক্ষা করেই ধনীরা তাঁদের অঢেল অর্থের কিছুটা অন্যের উপযোগিতায় ব্যয় করেন। কোনটা বা উৎসর্গকৃত হয় পরলোকগত মাতা পিতার নামে; আবার কোনটা ঠাকুর দেবতার নামে; নির্মাতার পাপ পুণ্যের দাঁড়িপাল্লাকে সমান রাখতে। তবে  সবক্ষেত্রে তা দাতব্য নয়। কেউ বা কেউ প্রকৃতই সহৃদয় থাকেন। আবার কোনও ব্যক্তি বাণিজ্যিক ভাবে সেখানে স্বল্প খরচে থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা করে রাখেন। যাত্রীরা খেয়েদেয়ে রাত্রিবাস করে সকালে গন্তব্যের দিকে রওয়ানা দেয়।

ঈশ্বরচন্দ্রও এরকম একটা সরাইখানায় স্বল্প পয়সার ঘর ভাড়া নিয়েছেন। দুটো ঘর। আট জনের দলের রাতে থাকা, সঙ্গে খাওয়া। সর্বসাকুল্যে খরচ এক টাকা ।

রাতের খাওয়া সারা হল। এবার ছেলেরা তাদের ঈশ্বর দাদাকে ঘিরে বসল। গল্প করতে হবে। তাও যে সে গল্প নয়! আবদার, দাদার নিজের কথা শোনাতে হবে।

ভাইদেরকে কলিকাতার বাসায় রেখেছেন বটে ঈশ্বরচন্দ্র, তবে তারা তাদের এই দাদা সম্বন্ধে খুব অল্পই জানে। ওদের মনে কৌতুহল, দাদা এত পরিশ্রম করে কী করে? এক তো কলেজে পড়ানো, তারপর বই লেখা, ছাপাখানা চালানো, অবিরাম আসা আগন্তুকদের নানান সমস্যার সমাধান করে দেওয়া ইত্যাদি, এতসব কাজ দাদা হাসি মুখে সামলাচ্ছে কেমন করে? মনের ভাবটা তারা প্রকাশও করে বসল।

ভাইদের মুখের দিকে তাকিয়ে ঈশ্বরচন্দ্র ঈষৎ হাসলেন। বললেন, কী করব বল? হাসি মুখে কাজ করে যাই। কাজকে কখনও কষ্ট মনে করি না। তোরাও করবি, দেখবি কঠিন কাজ  সহজ হয়ে তোদের কাছে ধরা দেবে। কাজ বিনে মানুষ তো মৃতের সমান রে।

দাদা, আপনার ছোটবেলার কথা কিছু মনে আছে? সুবল কথাটা জিজ্ঞেস করল।

ঈশ্বরচন্দ্র উত্তর দিলেন, মনে আবার নেই? কেন, তা শুনবি নাকি?

সোৎসাহে সকলে বলে উঠল, বলুন দাদা। আমরা তো আমাদের বড় বয়সে এখানে এসে আপনাকে দেখছি। কলিকাতায় আপনার  ছোটবেলা কেমন ছিল?

ঈশ্বরচন্দ্র বলতে থাকলেন,-আমি বাবার সঙ্গে কলিকাতার বড়বাজারের বাসায় থাকছি। তোদের দীনুদা, শম্ভুদা, তারা তখনও কলিকাতায় আসেনি। বাবা আট টাকা মাস মাইনে পেতেন। আমি এসেছি, তাই বাবার দু টাকা মাইনে বেড়ে গেল। কিন্তু তা হলে কী হবে? বাবা আমার জন্যে হিন্দু ইশকুলে মাসিক পাঁচ টাকা বেতন দিয়ে পড়াবার মনস্থ করছেন। সরকারী ইশকুল। একমাত্র ওই ইশকুলেই তখন মাইনে দিয়ে পড়তে হত। বাবার প্রস্তাব শুনে অনেকে তো অবাক! পাঁচ টাকা ছেলের জন্যে খরচা করলে বাকি পাঁচ টাকায় চলবে কেমন করে? তাও বাবা বলছেন, বাকি টাকা গ্রামের বাড়ির খরচ চালাবার জন্যে পাঠিয়ে দেবেন। অনেকেই বাবার কথায় আস্থা রাখতে পারলেন না। তবে আমাকেও আর হিন্দু ইশকুলে ভরতি না করে সংস্কৃত কলেজে  ভর্তি করে দেওয়া হল। তা ছিল অবৈতনিক।

-এদিকে আমি ইশকুলে যাই। সেখানে আমার বেশ কিছু বন্ধু হয়েছে। ওরা সব পয়সাওয়ালা ঘরের ছেলে। কলেজে আসছে ফিটন গাড়ি চড়ে । কেউবা পালকি চেপে। কেউ জুড়ি  গাড়ি হাঁকিয়ে। আমি হেঁটে যাই। বড়বাজার থেকে কলেজ স্ট্রিট হাঁটা পথে বাবার হাত ধরে ইশকুলে গিয়ে পৌছাই। আমার কিন্তু একটুও কষ্ট হত না। তবু অন্যেরা আমাকে নিয়ে উপহাস করত। তাছাড়া আমার সাজপোষাকও ওদের মতো অত চকচকে হত না। সামান্য ধুতি ফতুয়া পড়েই যাই। আর ওরা অনেকে আসে প্যান্ট শার্ট, হ্যাট কোট ঝুলিয়ে। এইসব নিয়ে আমাকে নানান উঁচু নিচু কথা বলে। একদিন ভীষণ রাগ হল আমার। শিক্ষককে বলে দিলাম। তিনি ছেলেদের ডেকে বকাঝকা করলেন আর আমাকে বললেন, জনে জনের কান মুলে দিতে। আমি তো লজ্জায় মরি। ওরা আমার সহপাঠী। অনেকে আবার আমার থেকে অনেকটা লম্বা। সত্যিই যদি কান মুলতে হয় তো আমাকে চেয়ারে উঠে তা করতে হত। আমি ইতস্ততঃ করছি। তাই বুঝেই কি না, শিক্ষক আমাকে রেহাই দিলেন। আমিও ওরকম গর্হিত কাজ করা থেকে বেঁচে গেলাম। হাঁফ ছাড়লাম। সেদিনই প্রতিজ্ঞা করলাম, পড়াশোনা করে পরীক্ষায় বেশি নম্বর নিয়ে আমি ওদের টেক্কা দোবো।… সত্যিই তাই হল। উঁচু ক্লাসে ওঠার পরীক্ষায় আমি সকলের আগে। আমার ধারেকাছে কেউ আসতে পারল না। আমার কাজ হাসিল করলাম।

-তোমার খুব জেদ ছিল, তাই না জ্যাঠা?

ঈশ্বরচন্দ্রের দূর সম্পর্কীয় ভাইয়ের ছেলে, বিনয় প্রশ্নটা করেছিল। তখনই হঠাৎ ঈশ্বরচন্দ্রের মনে পড়ে গেল, তাঁর পুরনো এক শোনা কথা। কথাটা মায়ের মুখে শোনা- নাকি তাঁর জন্মের সময় বলা হয়েছিল । বলেছিলেন তাঁর পিতামহ, রামজয় তর্কভূষণ। সকলের সামনে এখন তিনি প্রশ্ন রাখলেন, গরুর বাচ্ছা হয়, বাছুর বলি তাকে। বাছুরের সঙ্গে অনেক সময় এঁড়ে শব্দটা জুড়ে বলা হয়, এঁড়ে বাছুর। জন্মেই মাথা ঝুঁকিয়ে  কেমন তিড়িং বিড়িং করে লাফাতে থাকে। তাই তাকে বলা এঁড়ে । কথাটা শুনেছিস?

তারাপদর পাশ থেকে মুখ বাড়িয়ে একজন উত্তর করল,শুনেছি দাদা।

ছেলেটা ঈশ্বরচন্দ্রের মাসীর ছেলে। তপন নাম। পড়াশোনায় অন্যদের থেকে একটু দড়। ঈশ্বরচন্দ্র তাকে শোনাতে থাকলেন, জানিস তো, আমার জন্মাবার পর ঠাকুরদা আমার বাবাকে বলেছিলেন, ঘরে একটা এঁড়ে জন্ম নিয়েছে। বাবা সেসময় বাইরে থেকে বাড়ির দিকে ফিরছিলেন। মাঝ পথে বাবাকে দেখে ঠাকুরদা ওই কথা বলায়, বাবা তাড়াতাড়ি বাসায় ফিরে সত্যি সত্যিই গোয়ালের দিকে যাচ্ছিলেন, সদ্য জন্মানো এঁড়ে বাছুরকে দেখতে। বাবা জানতেন, সেসময় বাড়ির একটা গাই গাভীন অবস্থাতে আছে। ভেবেছেন, গরুই বাচ্ছা দিয়েছে।  তাই দেখে ঠাকুরদা হাঁ হাঁ, করে উঠলেন। গোয়াল ছেড়ে ঘরের দিকে যেতে বললেন বাবাকে। আমি তখন দাইমার হাতে পড়ে ট্যাঁ, ট্যাঁ, শব্দ করে কাঁদছি।…তা আমি ঠাকুরদার সেই এঁড়ে, বুঝলি!

ঈশ্বরচন্দ্র রঙ ঢং করে কথা বলায় হো হো শব্দে সকলে হাসতে থাকল।

এদিকে রাত হয়ে গিয়েছিল। ভোরে উঠে নৌকো ধরতে হবে। ঈশ্বরচন্দ্র সকলকে শুয়ে পড়বার পরামর্শ দিলেন। নিজেও শুয়ে পড়লেন।

ভোর ভোর উঠে দামোদরের ঘাটে পৌঁছলেন। রাজবলঘাট। সেখান থেকে ফেরি চলে। ঈশ্বরচন্দ্র জলের দিকে তাকালেন।  ধীরে কুলকুল শব্দে জল বয়ে চলেছে । ঘোলা জল। আসছে রাজ্যির পথ পেরিয়ে, পালামৌ, হাজারীবাগ, কোডারমা, ধানবাদ হয়ে। নদের উৎস ছোটনাগপুরের মালভূমি। এবার সেই জলবাধা পেরতে হবে।

ফেরি বওয়া চালু হয়েছে। ফেরিতে সকলকে নিয়ে নদী পেরলেন। আবার হন্টন। তবে এখন সকলের শরীর তরতাজা। রাতের ঘুমে পূর্বদিনের পথ চলার ক্লান্তি দূর হয়ে গেছে।

এখনও অনেক পথ বাকি । পথে এল পাতুল গ্রাম । সেখানে ঈশ্বরচন্দ্রের মামার বাড়ি।  দিনের কিছুটা সময় সেখানে বিশ্রাম নিলেন । নাওয়া খাওয়া সারলেন। তারপর আবার হাঁটা শুরু করলেন সকলে। বীরসিংহ গ্রামে যখন পৌঁছলেন সন্ধ্যে হয় হয়।

বীরসিংহ গ্রাম নিয়ে ঈশ্বরচন্দ্রের মনে একটা গর্ব রয়েছে। তা যে শুধুই তাঁর জন্মস্থান, সেকারণে নয়। জন্মাবার পর কটা বছর আর তিনি গ্রামে থেকেছেন? আট বছর পেরতে না পেরতেই ঘর ছাড়া হয়ে বাবার হাত ধরে কলিকাতায় চলে গিয়েছেন। কিন্তু শৈশবের ওই আটটা বছর বীরসিংহ গ্রাম তাঁর কাছে কিছু স্মৃতি দিয়ে গেছে যার জন্যে জন্মস্থানকে তিনি জগতের এক সফল দৈববাণীর স্থান বলে বিবেচনা করেন ।  ঠাকুরদা রামজয় তর্কভূষণ ও মা ভগবতীদেবীই তাঁর এই ধারণার মূলযন্ত্রী।

আজকেও এই ছাব্বিশ বছর বয়সে তিনি যখন গ্রামের পথে পা রাখলেন, তাঁর মনে হল, এক পবিত্র ভূমির আঙিনাতে প্রবেশ করেছেন। শরীরের সব ক্লান্তি নিমেষে দূর হয়ে গেল ।

গ্রামের পথ ধরে এগোচ্ছেন। মুখোমুখি হলেন কয়েকজন বয়োবৃদ্ধের। সকলেই বীরসিংহবাসী।  পিতৃবয়সীও কেউ কেউ রয়েছেন। অতি ভদ্রজন। অত্যন্ত বন্ধুবৎসল। ঈশ্বরচন্দ্র তাঁদেরকে বাবার মতই সম্মান দেন। পুত্রসম ঈশ্বরচন্দ্রকে দেখে তাঁরা এগিয়ে এলেন। গ্রামের আদি বাসিন্দা ঠাকুরদাসের পুত্র শহর কলিকাতায় যে বেশ একজন নামি পুরুষ হয়েছে, বিদ্যাসাগর উপাধি পেয়েছে, এ খবর তাঁদের গোচরে অনেক আগেই এসেছিল। তেনারা বয়োজ্যেষ্ঠ হলেও ঈশ্বরচন্দ্রের শহুরে খ্যাতির জন্যে করজড়ো করে নমস্কার জানিয়ে কুশল জিজ্ঞাসা করলেন। ঈশ্বরচন্দ্রও প্রতি নমস্কার জানিয়ে  নিজের সংবাদ দিলেন। পরে প্রশ্ন রাখলেন, খুড়ামশাইরা, আপনাদেরও সব কুশল তো?

একজন উত্তর করলেন, আছি বাবা একরকম। তা এবার অনেকদিন পর গ্রামে এলে যে তুমি?

-একরকম তাই, খুড়ো।

-আচ্ছা,বাড়ি যাও। তোমাদের তো বেশ ক্লান্ত  দেখাচ্ছে…

-খুড়ো, পথটা তো হেঁটেই এসেছি।

-কেন গো? গোরুগাড়ি, পাল্কি পেলে না?

-তা নয়। হাঁটাটাই বেশি পছন্দ করি। পথ চলতে আমার ভাল লাগে। তাই ছেলেগুলোকেও হাঁটিয়ে নিয়ে এলাম, হা, হা…

-তা বটে। তবে রাতে বিশ্রাম নিয়েছিলে তো, বাবা?

-বিলক্ষণ। মশাটে সরাইখানায় রাত কাটিয়েছি। সেখান থেকে আজ সকালে বেরিয়ে দামোদর পেরিয়ে পাতুল গ্রাম হয়ে এই আসছি।  গ্রামে এখন কয়েকটা দিন আছি। পরে আবার দেখা হবে…

-এসো, এসো, বাবারা ।  ভাইদেরও সঙ্গে করে নিয়ে আসলে বুঝি?

-হ্যাঁ। ওরাও দিন কয়েকের জন্যে নিজেদের বাড়িতে কাটিয়ে যাক। এই আর কি…

-ঠিক আছে। সন্ধ্যে হয়ে আসছে। তাড়াতাড়ি বাসায় পৌঁছোও।

নমস্কার জানিয়ে ঈশ্বরচন্দ্র এগিয়ে চললেন। গ্রামের প্রান্ত থেকে বাড়ির দূরত্ব আধ ক্রোশ। হনহনিয়ে হাঁটতে থাকলেন। পথে আরও এরকম দুচারজনের মুখোমুখি হয়ে সামান্য বার্তালাপ সেরে বাড়ি  পৌঁছলেন। ছেলেরা যে যার বাড়ির দিকে রওয়ানা দিল।

বাড়ুজ্যে পরিবারের বসতবাড়ি পাঁচিল দিয়ে ঘেরা। আধ মানুষ সমান উঁচু পাঁচিল। সেখানে ভিতরে প্রবেশের জন্যে নির্দিষ্ট দরজা, যাকে সদরদরজা বলা হয়, তা বসতবাড়ি থেকে অনেকটা দূরে। তা পেরিয়ে ঈশ্বরচন্দ্র ভিতরে ঢুকলেন। দু দণ্ড দাঁড়ালেন সেখানে। সামনে খোলা এক চাতাল।  অনেকটা জায়গা জুড়ে তার বিস্তৃতি। বসতস্থান চাতালের শেষপ্রান্তে । পিছনে চাকর, মুনিষ, থাকবার জায়গা।  ছোট ছোট কয়েকখানা ঘর। ঘরগুলো সামনের চাতাল থেকে দেখা যায় না। ঈশ্বরচন্দ্র তবু এদিক ওদিক উঁকিঝুঁকি মারলেন। নজরে এলো না কেউ । খোলা চাতাল ধরে বাড়ির দিকে এগোলেন। মাঝে পড়ল বাস্তুবাড়ি সুরক্ষার জন্যে আর এক দরজা; যা কিনা, সহজে অতিক্রম্য নয়। সুরক্ষিত দরজাটা বাড়ির মধ্যমদ্বার। পাকাপোক্ত করে বানানো। হঠাৎ করে কেউ যা খুলতে পারবে না। ভিতর থেকে মজবুত করে চেন-তালা লাগিয়ে রাখা হয়। অবশ্য সেটা হয় রাতের সময়ে। দিনে ওই দরজা খোলাই থাকে। বসবাসের বাড়িখানা পোড়া ইট দিয়ে তৈরী।  ওপর থেকে পুরু মাটির প্রলেপ লাগানো। বাড়ির সামনে মাটিলেপা প্রশস্ত উঠোন। জমি থেকে অনেকটা উঁচুতে। দুটো সিঁড়ি ভেঙে উঠোনে উঠতে হয়। সেখানে পৌঁছিয়ে উঠোনে পা রাখার আগে তিনি আবার একবার থামলেন। চোখ ঘোরালেন এদিক ওদিক।

দিনের আলো নিভে গেছে। সাঁঝের অন্ধকার ঘনিয়ে এসেছে চারিদিকে। অশরীরী ছায়ার মতো  পাঁচিল ধার দিয়ে দাঁড়ানো গাছের লম্বা সারির ওপর দৃষ্টি ফেললেন। আম, জাম, কলা, পেয়ারা, নিম, সুপারি সমেত নানান গাছের সারিতে সাজানো বাগান।  গাছগাছালির কিছু তাঁর নিজের হাতে লাগানো; কিছুবা বাবা অথবা ভাই শম্ভুচন্দ্রের হাতে।  তাঁর অনুপস্থিতিতে ওঁরাই গাছের যত্নআত্তি করে।

কলিকাতা থেকে যখনই বাড়ি আসেন, এখানের এই রূপটাই তিনি দেখতে চান। শহরের ইট কাঠের জঙ্গল তাঁর মন টানে না; যতখানি কি না, গ্রামের এই মেঠো বাড়ি তাকে প্রশান্তি দেয়।

বসতবাড়ির ঘরগুলোর অবস্থান লম্ব আকারে। দেওয়াল এধার থেকে ওধার চলে গেছে।  পোড়া ইট আর ঝামা দিয়ে তৈরী দেওয়াল। কায়দা করে তারই মাথায় আর একটা তলা উঠেছে। দুতলার সামনের দিকটায় লম্বা ঝুল দালান। দালান ঘিরে কাঠের রেলিং। বাড়ির মাথায় খড়ের ছাউনি।

এখানে আসলেই ঈশ্বরচন্দ্র তাঁর পৈতৃক বাসস্থানটাকে এভাবে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখেন। তৃপ্তি পান। যতই হোক শৈশব এবং কিশোরবেলার অনেকটা সময় যে তাঁর এখানেই কেটেছে। এই বাড়ি নিয়ে তাঁর গর্ব রয়েছে। সারা বীরসিংহ গ্রামে এরকম বাড়ি হাতে গোনা কয়েকটা।

 

এত বড় বাড়ি,তার বাসিন্দা না হলেও গণ্ডা চারেক মানুষ, তবু কেমন খাঁ খাঁ করছে বাড়ির বাইরেটা। হতে পারে সন্ধ্যে নেমে গেছে, সেকারণে। সন্ধ্যের পর বাড়ির সামনের চাতাল বা উঠোনে কেউ থাকে না। সকলেই যে যার ঘরে  ঢুকে পড়ে। নিজের নিজের কাজে ব্যস্ত থাকে।

বাড়ির ওপর তলার ঘর থেকে অল্প আলো ঠিকরে নিচে এসে পড়েছে। আলো লন্ঠনের।  রেড়ির তেলের লন্ঠন। সে আলোয় তেমন তেজ নেই। তবু  সাঁঝের লন্ঠনের আধো ছায়া আধো অন্ধকার আলো  ঘরটাকে চেনাচ্ছে। ঈশ্বরচন্দ্র একবার ওপরের দিকে তাকালেন। ওখানেই তাঁর শয্যা ঘর। দীনময়ীও থাকে সে ঘরে। তাঁর অনুপস্থিতিতে একলা ঘরে দীনময়ীর রাত কাটে।

এবার অনেকদিন পরে আসা। ওপরের দিকে তাকিয়ে তাঁর মনে ইচ্ছে জাগল, সকলের অলক্ষ্যে এখনই একবার স্ত্রীমুখ দর্শন হোক । দীর্ঘ বিরহের আকুল নয়ন তাঁর। মনে অনন্ত ইচ্ছে। শরীরে মৃদু আলোড়ন। …কিন্তু পরক্ষণেই বুঝলেন, এই সাঁঝে সে কি আর এখন শয্যা ঘরে আছে?  আছে রসুই ঘরে।  রাঁধুনির সঙ্গে হাতে হাত মিলিয়ে সংসারের কাজ সারছে…

নিজের মনেই হাসলেন। বিরহ যে কত মধুর, তা টের পেলেন। কিন্তু তাঁর তখনও অজানা, ওই ঘরেই ভর সন্ধ্যেতে দীনময়ী একলা শুয়ে রয়েছে । আর, সে বেচারিও জানে না, আজ তার স্বামী বাড়ি আসছে।

মাঝের দরজা পেরিয়ে পা বাড়িয়ে তিনি ভিতরে ঢুকছেন, সামনেই পড়ল শম্ভুচন্দ্র। সেজ ভাই। তিনিও কলিকাতায় ঈশ্বরচন্দ্রের সঙ্গে থাকেন। তবে এখন কিছুদিন হল বাড়িতে এসে রয়েছেন। ঠাকুরদাসের সঙ্গে চাষবাসের কাজের তদারকির জন্যে মাঝে মধ্যে বাড়িতে চলে আসেন। বিশেষ করে ধান কাটার সময়।  কিছুদিন কাটিয়ে যান। শম্ভুচন্দ্র ভালো মুনিষ চড়াতে পারে। যদিবা কলিকাতায় তাঁর পড়াশোনার চল রয়েছে।

আচমকা দাদাকে দেখে শম্ভুচন্দ্র অবাক! তিনি  যাচ্ছিলেন নিজের ঘর থেকে বেরিয়ে অন্য ঘরে।  থমকে দাড়িয়ে পড়েছেন। মনে প্রশ্ন,  দাদা! এসময়ে! কোনও খবর তো দেয়নি?ঢোঁক গিলে প্রশ্নগুলো উগরে দিলেন।

-হ্যাঁ রে। এই এসে গেলাম। তোরা সকলে কুশলে আছিস তো…? ঈশ্বরচন্দ্রের কথা।

তোতলাতে শুরু করল শম্ভুচন্দ্র, আম্রা…আ…আমরা ভালো আছি। তবে কদিন ধরে বউদির শরীরটা ঠিক নেই।

-কেন! তার আবার কী হল! খবর দিসনি তো! গলায় উদ্বেগ খেলল ঈশ্বরচন্দ্রের।

-না দাদা, চিন্তা করবার কিছু নেই।

ভাই দাদাকে কিছু একটার ইঙ্গিত দেবার প্রয়াস করল। ব্যাপারটা ঈশ্বরচন্দ্র বুঝলেন, আবার নাও বুঝে থাকতে পারেন। তবে স্ত্রীর জন্যে মনটা উতলা হল।  তবু মনে হল, আগে মায়ের খোঁজ নেওয়া দরকার।

জানতে চাইলেন, মা কোথায়? বাবাকে তো দেখছি না?  বাবা কি বাইরে ? পর পর প্রশ্ন। হয়তো বা দীনময়ীর কাছে একটু তাড়াতাড়ি পৌঁছবার তাগিদ রয়েছে তাঁর।

শম্ভুচন্দ্র সব প্রশ্নেরই উত্তর করলেন। জানালেন, মা আহ্নিকে বসেছেন। বাবা বউদির জন্যে ওষুধ আনতে কবরেজের কাছে গেছেন।

-বাবার বয়স হয়েছে। সন্ধ্যের পর একলা  বেরতে দিস কেন? ঈশ্বরচন্দ্রের গলার স্বর ভারী।

-চিন্তা কোর না, বাবার সঙ্গে ঈশান  রয়েছে।

 

চলবে…

শেয়ার করতে:

You cannot copy content of this page