আবার এসো ফিরে

এক সম্ভ্রান্তলোক আমার সঙ্গে দেখা করতে এসেছিলেন। তিনি আমাদের মুদ্রাযন্ত্র আপিসে এসেছিলেন সেখানে তিনি বেশ কিছু বই সুন্দর বাঁধানো অবস্থায় দেখে টিপ্পনী কাটলেন, মহাশয়, বহু টাকা খরচা করে এই বইগুলো বাঁধানো কি খুব যুক্তির কাজ হয়েছে?  আমি তাঁকে প্রশ্ন করি, কেন, এতে দোষ কি? উনি বললেন, ওই টাকায় অনেকের উপকার হতে পারত। ওনার কথা শুনে আমি কিছুক্ষণ চুপ করে ছিলাম। পরে অন্য কথা পারলাম। ভদ্রলোকের গায়ে একটা শাল ছিল। দেখে বুঝলাম, শালখানা বেশ দামী। উপস্থিত বুদ্ধি খেলে গেল মাথায়। প্রশ্ন করলাম, মশায়, আপনার এই শাল জোড়া কোথায় কত টাকায় কিনেছেন?  জিনিষটা তো বেশ হয়েছে! আমার কথায় বাবু একটু অসাবধান হয়ে শালের নানান গুণ বর্ণনা করে বললেন, শালটার দাম পাঁচশ টাকাতাও দুবছর আগে কেনা। আমি বললাম, মশায়, শাল তো ঠাণ্ডা দূর করবার জন্যে পরা। পাঁচ সিকের কম্বলেও তো শীত দূর হয়। তবে এত টাকার শাল  গায়ে দেবার প্রয়োজন কী? ওই টাকায়ও তো অনেকের উপকার হত। আমার গায়ের চাদরটা দেখিয়ে বললাম, সারা শীত আমি এই মোটা চাদর গায়ে দিয়ে থাকি  এর দাম পাঁচ টাকা। ভদ্রলোক আমার কথা শুনে লজ্জা পেয়ে গেলেন। নিজের অন্যায় স্বীকার করে ছাপাখানা থেকে তাড়াতাড়ি বেরিয়ে চলে গেলেন। আমি হাসতে থাকলাম।     

আচ্ছা, চিঠি আজ এখানেই শেষ করলাম। সাবধানে থেকো শরীরের প্রতি যত্ন নিও।    

                                    ইতি

                               আশীর্বাদক স্বামী

                               ঈশ্বরচন্দ্র শর্মা

 

এরপর…

(৫)

 

কলিকাতার উত্তর পূর্ব অঞ্চল জোড়াসাঁকো। গঙ্গার গা ঘেঁষা। কুলীনদের বাস। তার মধ্যে পিরালী ব্রাহ্মণ পরিবার ঠাকুর বংশ। জমিদার। ব্রাহ্ম  সমাজের অংশ। পূর্ব পুরুষের কাল থেকেই ঠাকুর পরিবার ধন দৌলতে মোড়া। প্রিন্স দ্বারকানাথের সময়ে তা বহু গুণ বেড়েছে। দেশ বিদেশে ব্যবসা বাণিজ্যের কারণে। ঠাকুর পরিবার শুধু ধনীই নয়, লেখা পড়া,  গান বাজনা, কলিকাতার নব্য সংস্কৃতির ধারক বাহকও। সেখানে এখনের গৃহকর্তা হচ্ছেন দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর।

জমিদার পুত্র দেবেন্দ্রনাথ ভাবালু প্রকৃতির মানুষ। পড়াশোনা, পত্র পত্রিকা প্রকাশ, বাঙালী সংস্কৃতির বিকাশে সারাক্ষণ নিজেকে ব্যস্ত রাখতে ভালোবাসেন।  বাবা দ্বারকানাথ ঠাকুরের ঠিক বিপরীত ধর্মী মানুষ তিনি।

দ্বারকানাথ জমিদার পুত্র ছিলেন বটে। তবে তিনি ছিলেন রামলোচন ঠাকুরের দত্তক পুত্র। মেজ ভাইয়ের সন্তান। রামলোচনরা হচ্ছেন কুশারী ।

দেবেন্দ্রনাথের পিতামহ, রামলোচন ঠাকুরের জমিদারী ছিল কলিকাতার উপকণ্ঠে বেলগাছিয়ায়। মাত্র তেরো বছর বয়সে বাবাকে হারিয়ে দ্বারকানাথ মানুষ হন তাঁর পালিকা মা অলকাসুন্দরী ও  বড়মামা রাধানাথের তত্ত্বাবধানে।  নানান বিষয়ে লেখাপড়া করে  জ্ঞানার্জন করেন । প্রাপ্ত বয়সে সরকারের অধীনে দেওয়ানের চাকরী নেন। তৎকালীন অন্যান্য জমিদারদের মামলা মোকদ্দমায় আইনি- এজেন্ট হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেন । সঙ্গে নিজের অর্থ প্রতিপত্তি এবং বহু জমিদারীর মালিকও হন। শুধু এখানেই দ্বারকানাথ থেমে থাকেননি। তিনি ব্যবসায় নামেন। নানান ধরণের ব্যবসা। ব্যাঙ্ক, ইন্সিওরেন্স, কয়লা, নীলচাষ, জাহাজ চলাচল, এমন সবকিছুর ব্যবসা খোলেন। শেষে নিজেই জাহাজ ভাড়া নিয়ে আমদানি-রপ্তানির ব্যবসায় প্রচুর অর্থ উপার্জন করেন।

বাবা হচ্ছেন ধনদৌলতে ভরা রহিস ব্যক্তি। অথচ ছেলে তাঁর অনেকটাই বিপরীত। এত ধন দৌলতের মাঝে দেবেন্দ্রনাথ মনের শান্তি পান না। তিনি ভিন্ন প্রকৃতির। দ্বারকানাথ ধনী গণ্যমান্য স্বদেশী ও দেশের ইংরেজদের নিয়ে বাসায় আমোদ প্রমোদ করেন । দেবেন্দ্রনাথ তখন বাড়ি ছেড়ে অন্য জায়গায় চলে যান।  এই কারণে দেবেন্দ্রনাথ  বেলগাছিয়ায় জমিদার বাবার বিলাসবহুল প্রাসাদোপম বাসস্থান ছেড়ে জোড়াসাঁকোর বাড়িতে চলে এসেছেন। দ্বারকানাথের ওই ঐশ্বর্যমণ্ডিত  বাসস্থানে নিজেকে কিছুতেই মানাতে পারেন না। তিনি যুবা পুরুষ। নিজের ইচ্ছে মোতাবিক কিছু কিছু কাজকর্ম করতে চান। অথচ দ্বারকানাথের কঠোর শাসনে তা তাঁর পক্ষে করে  ওঠা সম্ভব হয় না। কত কাঁহাতক আর সারাদিন ধরে ব্যাঙ্কে বসে বসে কাঁচা টাকা গোণা যায়? বাবা না হয় ব্যাঙ্ক স্থাপনা করেছেন। নাম দিয়েছেন ইউনিয়ান ব্যাঙ্ক। দেশীয় ব্যাঙ্কে টাকা গচ্ছিত রাখবার জন্যে অনবরত দাতা গ্রহীতার ভিড়। সেসব সামলাতে গিয়ে দেবেন্দ্রনাথের নিজের কোনও কাজ হয় না। তাঁর নিজস্ব ভাবনার বিকাশ ঘটাবার কাজে ব্যাঘাত সৃষ্টি করছে নিত্যনৈমিত্তিকের একঘেঁয়েমি কাজ। অথচ আবার দোর্দণ্ডপ্রতাপ দ্বারকানাথের মুখের ওপরেও বেশি কিছু বলতে পারছেন না। স্বভাবতই দিনকে দিন মন ভেঙে যাচ্ছে তাঁর।

জীবনের কোনও এক মর্মস্পর্শী ঘটনায় এখন দেবেন্দ্রনাথের চিন্তাধারা উচ্চমার্গের দিকে বহমান। জীবনের উদ্দেশ্য কী? তার উত্তর খুঁজতে লেগেছেন তিনি। তবে এটুকু তিনি বুঝেছেন, ভোগমত্ততাই জীবনের সব নয়। ঐশ্বর্য, বিলাসিতা, অপরের উপর প্রভুত্ব করা, এসব অতি নগণ্য বিষয়। যা কিনা জীবনে সুখ এনে দেয় না। সুখ দেয় ঈশ্বর চিন্তায়। নিরাকার ঈশ্বরকে মনে মনে তিনি সাধনা করেন । তিনি ব্রাহ্মধর্ম নিয়েছেন। এক এক সময় তাঁর মনে হয়, পিতৃদত্ত সব ঐশ্বর্য দান করে  নিজে মুক্ত হয়ে যান। তার কিছুটা করেছেনও। অবশ্যই বাবার অগোচরে। বাবা তখন কলিকাতায় অনুপস্থিত। বিলেতে গিয়েছিলেন। সেখানে ইংরেজ রাজরাজা, প্রভু, অমত্যদের সঙ্গে মেলামেশায় ব্যস্ত। উদ্দেশ্য, দেশে নিজের ব্যবসা বাড়ানো। তারপর তো সেখানেই দেহত্যাগ করলেন। তাঁর দ্বিতীয়বারের বিলেত গমনের পরে।

 

দেবেন্দ্রনাথের সম্পাদনায় এখন নিয়মিত প্রকাশ হয়ে চলেছে বাংলার রেনেসাঁ যুগের প্রথম সারির পত্রিকা তত্ববোধিনী।  পত্রিকা প্রকাশ হয় জোড়াসাঁকোর ঠাকুর বাড়ি থেকে।  পত্রিকার এক বিশেষ সভা ডেকেছেন তিনি। তাতে ঈশ্বরচন্দ্রকে যোগ দেবার আহ্বান জানিয়েছেন।  ঈশ্বরচন্দ্র  পত্রিকার প্রবন্ধ নির্বাচনী কমিটির সদস্য।

দেবেন্দ্রনাথ  আজ মনে মনে স্থির করে  রেখেছেন, ওই সভাতেই তিনি ঈশ্বরচন্দ্রের জন্যে বড় কিছু ঘোষণা করবেন।  ঈশ্বরচন্দ্র দীর্ঘ পাঁচ বছর ধরে পত্রিকার প্রবন্ধ নির্বাচনের কাজে নিয়েজিত রয়েছেন। তাঁর কলেজ জীবনে নানান প্রবন্ধ রচনায় বিশেষ পুরস্কার প্রাপ্তি এবং বিদ্যাসাগর উপাধি পাবার পরেই তত্ত্ববোধিনী পত্রিকাতেও সম্পাদকের উৎসাহে তিনি প্রবন্ধ লিখছেন । তখন থেকে দেবেন্দ্রনাথ ওই পত্রিকার সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করছেন। নজর পড়েছিল ঈশ্বরচন্দ্রের লেখার উৎকর্ষতার ওপর। তাঁকে প্রবন্ধ নির্বাচক কমিটির সদস্যও করে  নিয়েছিলেন।

দেবেন্দ্রনাথ চান ঈশ্বরচন্দ্র ওই পত্রিকা সম্পাদনার ভার নিন।  এমন এক বিদ্যার সাগর থাকতে অন্য কারোও নাম তাঁর মনে স্থান পাচ্ছে না। তাঁরই সমবয়সী ছাব্বিশ-সাতাশ বর্ষীয় ঈশ্বরচন্দ্রকে অন্য অনেকাপেক্ষা বর্ষীয়ান প্রাজ্ঞ জনদের থেকে বেশি উপযুক্ত মনে করেন দেবেন্দ্রনাথ। তা না হলে, তখন রয়েছেন ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত, অক্ষয়কুমার দত্ত, রাজেন্দ্রলাল মিত্র, রামনারায়ন তর্করত্ন, রামতনু লাহিড়ী, প্যারিচাঁদ মিত্র মহাশয়দের মতো বিশিষ্ট বুদ্ধিজীবীর দল। তাঁদের বাদ রেখে দেবেন্দ্রনাথ ঈশ্বরচন্দ্রকে ওই দায়িত্ব দিতে চান, ঈশ্বরচন্দ্রের লেখনী, বুদ্ধিমত্তা, বলিষ্ঠ বক্তব্যের স্থাপনা, সুললিত বাংলা ভাষার প্রবর্তন করা , সঙ্গে ইংরেজি ভাষাতেও পারদর্শিতা থাকা, এসবই তার কারণ।

দেবেন্দ্রনাথের আহ্বানে ঈশ্বরচন্দ্র জোড়াসাঁকো ঠাকুর বাড়িতে যাচ্ছেন। পায়ে হেঁটে। পথের দৃশ্য দেখতে দেখতে চলেছেন তিনি ।

পথ শুরু হয়েছে গঙ্গার ঘাট থেকে। সোজা রাস্তা। রাস্তার দুপাশে পাকা বাড়ি। ঘেঁষাঘেঁষি নয়; দুরে দূরে । মাঝে  খোলা মাঠ। মাঠের গা ঘেঁসে যেসব বাড়ি রয়েছে সেগুলো কাঁচা। মাথায় খড় বা ঝাউপাতার ছাউনি। অপেক্ষাকৃত গরীব লোকের বাস সেগুলোতে। পাকা বাড়ির দু তলা তিনতলা করে ধনী মানুষেরা রয়েছে। ইংরেজ, বাঙালি, মারোয়ার প্রদেশীয় আমীর শ্রেণির লোকজন তাঁরা । জায়গাটা বাজার অঞ্চল। পাকা বাড়ির নীচের অংশে দোকান। গদি জোড়া বপু নিয়ে মহাজন বসে আছে। তারা প্রায় সকলেই মাড়োয়ারী সম্প্রদায়ের। বাজারের কারণে রাস্তায় মানুষের যথেষ্ট ভিড় রয়েছে। তাদের কাটিয়ে ঈশ্বরচন্দ্র চলেছেন। পাশ দিয়ে  পাল্কি চলেছে। একাধিক। তার কোনটায় পর্দা ফেলা। ভিতরে রয়েছে বড়ঘরের মহিলারা। আর কিছু পাল্কী পর্দা ছাড়াই পুরুষ মানুষদের নিয়ে চলেছে। টমটম গাড়িও যাচ্ছে লোকের ভিড় কাটিয়ে। গাড়ির মাথায় বসে কোচয়ান মুখে হ্যাট হ্যাট শব্দে যেমন নিজের ঘোড়াকে দৌড় করাচ্ছে; তেমনই পথের লোকজনকেও এত্তেলা দিচ্ছে  গাড়ি যাবার পথ করে দেওয়ার জন্যে। টমটম গাড়ি বাবুদের। সাহেব সুবোরাও রয়েছে তার মধ্যে। ঈশ্বরচন্দ্র কিন্তু পায়ে হাঁটায় স্বচ্ছন্দ। সাধারণের দলে তিনি। পাল্কী , টমটমে পয়সা খরচ করা তাঁর ধাতে নেই। তা তাঁর স্বভাব বিরুদ্ধ।

পথ অনেকটা। ঈশ্বরচন্দ্রের কাছে এ দূরত্ব কিছু নয়। মাইলের পর মাইল তিনি হেঁটে পার হতে পারেন। এখনও তাই করছেন। চলায় কোনও তাড়াহুড়োর বালাই নেই। দেবেন্দ্রনাথের কাছে পৌঁছতে হবে বেলায়। এখন সবে দশটা বাজে।

শীতকালের দিন। কাঁধের মোটা চাদরটা গায়ে জড়িয়ে নিয়েছেন। পরণে ন’হাতি ধুতি। হাঁটুর নিচ পর্যন্ত ঝুলে রয়েছে।  সাধারণত যা থাকে হাঁটুর উপরে। শীতের জন্যে ধুতির ঝুল নিচ পর্যন্ত নেমেছে। পায়ে পাঁচ আনা দামের রবারের চটি। ভারী পায়ের পাতার সঙ্গে সেঁটে বসেছে। তাই পরে দিব্যি হাঁটছেন।

চলতি পথে একটা পাল্কীকে অণুসরণ করতে শুরু করলেন। এমন নয় যে তিনি রাস্তা চেনেন না। তবে, কী মনে হল, সেটার পিছনে হাঁটছেন। ওই পাল্কিতে চলেছে কোনও বড়লোকের ব্যাটা। ভিতরে দৃষ্টি দিয়ে দেখতে পাচ্ছেন আরোহীকে। গায়ে তাঁর দামী পোশাক। বিলিতি কাপড়ের পাঞ্জাবী। গলায় সোনার ভারী চেন। হাতের দশ আঙুলে পাথর বসানো আংটি। রীতিমতো দামী পাথর। পাঁচ আঙুল বাইরে করে পাল্কির ছই ধরে রয়েছে। সূর্যের আলো পাথরের ওপর পড়ায় চিরিক চিরিক ছটা ছড়াচ্ছে মাঝেমধ্যে।

অনেকটা পথ পাল্কির অনুসরণে আসবার পর সেটা বাঁদিকে মোড় নিয়ে গোলদিঘির রাস্তায় ঢুকে গেল। ঈশ্বরচন্দ্র সোজা পথে যাবেন।  কিছুটা এগিয়ে পড়লেন চিৎপুরের পথে। স্থানটা মুসলমান অধ্যুষিত। পথের লোকজন তারাই। তাদের পরণে লুঙ্গি, গায়ে রঙিন পাঙাবী। মাথায় ফেজ টুপি। এই পথেও কেনাকাটার দোকান রয়েছে। তবে তা সবই ওই মুসলমানদের। রাস্তার দুপাশে ছোট ছোট মুসলিম মহল্লা। ছোট মতো একটা মসজিদও দেখতে পেলেন । তিনি হাঁটতে থাকলেন। কিছু পরে গন্তব্যে পৌঁছলেন। দেবেন্দ্রনাথের বাড়ি।

বিশাল বাড়ি। মস্তবড় দরজা। পাকাপোক্ত লোহার শিক দিয়ে তৈরী। প্রধান দরজা পেরিয়ে ভিতরে প্রবেশ করছেন। বাধা পেলেন। মোচওয়ালা বিহারী দারোয়ান ফটক পাহারা দিচ্ছিল। হেঁকে উঠল, কাঁহা যাইয়েগা বাবু?

বিহারী আগন্তুককে ঠিকই আটকেছিল।  এমন পোষাক আষাক, জুড়িগাড়ি বিহীন মানুষকে দেখে পাহারাদার প্রশ্ন করবেই। এ বাড়িতে তাঁর মতো সদাসিধে বাহুল্যহীন সাজপোশাক, জুড়িগাড়িবিহীন পায়ে হেঁটে কেউ আসে কিনা সন্দেহ। ঈশ্বরচন্দ্র গম্ভীর স্বরে জবাব দিলেন, দেবেন্দ্রনাথ মহাশয়কে খবর দাও। ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর দেখা করতে এসেছেন।

কে জানে, লোকটা আগে থেকে হয়তো বিদ্যাসাগর নামটা শুনে থাকবে। তাতেই কি না, সেলাম ঠুকে সসম্মানে তাঁকে  নিয়ে সোজা বাড়ির ভিতরে চলল। তিনি চলেছেন উঠোন, বাগান পেরিয়ে।

লম্বা পথ। চুন সুরকি দিয়ে বাঁধানো। মাঝে বাগান। সার দিয়ে গাছ। রঙ বেরঙের বাহারি ফুলে ফুলে ভরা।  বাগানের তিনদিক দিয়ে ঘর। একটার পর একটা। বাড়িটা দুতলা। একতলা দুতলা করে  কয়েক গণ্ডা ঘরের লাইন। ঘরের দরজা জানালা রঙে রঙে চকচক করছে । সবই বন্ধ। মানে, অন্দরমহল। মহিলাদের বাস সেখানে। বনেদী বাড়ির মহিলা।

ওপর নীচে করে ঈশ্বরচন্দ্র তাকালেন। লোকজনের দেখা নেই কোথাও। ভাবলেন, এঁনারা তো সকলেই অসূম্পশ্যা নয়। এ বাড়ির কিছু ভিন্নতা রয়েছে। সমাজের উঁচু স্তরের মানুষ এবাড়ির বাসিন্দারা। ব্রাহ্ম সমাজভুক্ত। সাধারণ থেকে এঁদের আচার ব্যবহারও অনেকটা পৃথক। মহিলাদের মধ্যে লেখাপড়ার চল রয়েছে যথেষ্ট। এঁনারা পর্দানশীন নন। এ বাড়িও দ্বারকানাথের তৈরী। এখানে তাঁর ছেলেমেয়েদের বাস। ইচ্ছে হলেই দ্বারকানাথের চল ছিল  বেলগাছিয়া থেকে এবাড়িতে চলে আসার।  আবার ফিরে যেতেন সেখানে। এখন অবশ্য তিনি নেই। গত হয়েছেন। দেবেন্দ্রনাথ এ বাড়ির গৃহকর্তা। ঈশ্বরচন্দ্র এর আগে এক আধবারই এখানে এসেছেন। বহুদিন পর দেবেন্দ্রনাথের আহ্বানে আবার আসছেন।


দারোয়ান তাঁকে এনে বসিয়েছে বাড়ির বৈঠকখানায়। বিশালাকার ঘর। এমাথা ওমাথা ঘাড় ঘুরিয়ে দেখতে হয়। ঘরের এদিক থেকে ওদিক করে  কয়েকটা দেশি বিলিতি সোফা লাগানো। দুটো আরামকেদারাও রয়েছে সেখানে। মাথার উপরে একাধিক ঝাড় লন্ঠন। বিলিতি কাচের। রাতে জ্বলন্ত মোমবাতি ঘর আলোয় ভরিয়ে রাখে। ঈশ্বরচন্দ্র এসেছেন দিনের সময়। তাই সেই শোভা দেখার সৌভাগ্য তাঁর হল না।

মাঝের একটা সোফায় বসেছেন তিনি । ভাবছেন দেবেন্দ্রনাথের সৌভাগ্যের কথা। তখনও  তিনি জানেন না যে এই বৈভব দেবেন্দ্রনাথের নাপসন্দ। রাজার ছেলে, রাজাই হয়, এ তো জানা কথা। ক’জন আর রাজা শুদ্ধধনের সন্তান হয়ে ভিক্ষুক বেশ নিয়ে বোধিসত্ত্ব হয়? তবে ঈশ্বরচন্দ্রের জ্ঞানে এটুকু ছিল, তত্ত্ববোধিনী পত্রিকার পরিচালন ভার এখন পূর্ণমাত্রায় দেবেন্দ্রনাথের ওপর বর্তেছে। যা কিনা তাঁর পক্ষে সামলানো সম্ভব হচ্ছে না। বিশেষ করে  পত্রিকার নিয়মিত সম্পাদক অক্ষয়কুমার দত্তের পদে ইস্তফা দেবার ইচ্ছা প্রকাশের পর। এত সুনামের এক পত্রিকার খবর বাংলার বিশিষ্ট জনদের কে না জানে?

আবার এসো ফিরে

ঈশ্বরচন্দ্র অপেক্ষা করছেন। ইতিমধ্যে সেই দারোয়ান আর একজনকে ঘরে এনে বসালো। ঈশ্বরচন্দ্র তাকে বিলক্ষণ চেনেন। ভদ্রলোক ঈশ্বরচন্দ্রের থেকে বয়সে কিঞ্চিত বড় হবেন। তবে বাংলার সাহিত্য আঙ্গিনায়  ওনার নামডাক ভালোই রয়েছে। সেই সূত্রে ঈশ্বরচন্দ্রের সঙ্গে নতুন আগন্তুকের পরিচয়।  আগন্তুকের নাম ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত। কোলকাতার নামী পত্রিকা,  সংবাদ প্রভাকরের সম্পাদক তিনি। ঈশ্বরচন্দ্রও এক সময় ওই পত্রিকায় লেখালিখি করেছেন।

দুজনের মধ্যে নমস্কার বিনিময় হল। একে অপরের কুশল সংবাদ নিলেন। সামান্য কথাবার্তা বিনিময় হচ্ছে যখন, তখনই সেখানে একে একে এসে উপস্থিত হলেন আরও কয়েকজন বিশিষ্ট ব্যক্তিত্ব। তাঁদের মধ্যে রয়েছেন কানাইলাল পাইন, রামতনু লাহিড়ী, কৃষ্ণমোহন বন্দ্যোপাধ্যায়, গোপালচাঁদ মিত্র, নবীনচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় । সকলেই প্রাজ্ঞ, বিদগ্ধজন। এবং ঈশ্বরচন্দ্রের থেকে বয়সে প্রবীণ, কেবলমাত্র নবীনচন্দ্র ঈশ্বরচন্দ্রের থেকে চার বছরের ছোট। বয়সে নবীন ঈশ্বরচন্দ্র তাঁদের সকলকেই যে চেনেন, এমন নয়। তবে প্রাথমিক পরিচয়ের পর নাম স্মরণ করে  সম্যক পরিচয়ের বাইরের পরিচিতিতে চিনতে পারলেন। বাক্যালাপ চলল। সাধারণ কথাবার্তা। আসল কথা শুরু হল দেবেন্দ্রনাথ ঘরে আসবার পর। তবে তা হল তত্ত্ববোধিনী পত্রিকার বিদায়ী সম্পাদক অক্ষয়কুমার দত্তর অনুপস্থিতিতে। তিনি অসুস্থ। সভায় অনুপস্থিত।

প্রায় রাজবেশে এলেন দেবেন্দ্রনাথ। ঠাকুর পরিবারের পুরুষদের যে বেশ, তাতে তিনি সজ্জিত। অতি সুপুরুষ ব্যক্তি। লম্বায়  দীর্ঘ মানুষ। বপুও বিশাল। ফর্সা রঙ। পরণে সাহেবি প্যান্ট শার্ট । গায়ের লম্বা ঝুল কোটের নিচে দিয়ে প্যান্টের কিছু অংশ উকি দিচ্ছে। কোটের উপরিভাগে কারুকার্য করা অতি মূল্যবান কাশ্মীরিশাল বিছানো। মুখ শশ্রুগুম্ফ যুক্ত। চোখের নজর তীক্ষ্ণ। মাথায় জড়ানো উষ্ণীষ। সব মিলিয়ে রাজার বেশে এসে তিনি ঘরে ঢুকলেন। সকলকে অভিবাদন জানালেন। গৃহকর্তার প্রতি সম্মান প্রদর্শনের জন্যে অন্যেরা উঠে দাঁড়িয়ে তাঁর অভিবাদন গ্রহণ করলেন। দেবেন্দ্রনাথ আসন নিলেন। বিশেষ রকম সজ্জিত এক আসন ।  সেটা যে তাঁর জন্যে নির্দিষ্ট করা রয়েছে, তা তাঁর দখল নেওয়া থেকেই বোঝা গেল।

দিনের সভার উদ্দেশ্য বর্ণনা করলেন তিনি। এ যে তত্ত্ববোধিনী পত্রিকার জন্যে এক বিশেষ সভা, তা এতক্ষণে সকলে জানতে পারলেন।  দেবেন্দ্রনাথ বলতে থাকলেন, আপনারা সকলেই জানেন, তত্ত্ববোধিনী পত্রিকার মতো এই সময়ের এক মননশীল সংস্কৃতিমনস্ক ধর্ম ও জ্ঞানানুশীলন পত্রিকার প্রকাশ উপযুক্ত সম্পাদকের অভাবে দিন দিন ক্ষীণ হয়ে পড়ছে। আমি নিজে এই পত্রিকার প্রতিষ্ঠাতা হয়ে চাই না, এমন পত্রিকা শীর্ণ দশা প্রাপ্ত হয়ে বন্ধ হয়ে যাক। এখন এর কার্যভার ও সম্পাদনার কাজ আমার একলার পক্ষে বহন করা সম্ভব হচ্ছে না। তাই আপনাদের সকলকে আমন্ত্রণ করে আনা। এ বিষয়ে আপনাদের কী অভিমত, তা জানালে পরে আমি আমার বক্তব্য রাখব।

আবার এসো ফিরে

-আমার সংবাদ প্রভাকর পত্রিকার পাশাপাশি আপনার তত্ত্ববোধিনী পত্রিকা চলুক এটাই আমার অভিমত। কথাটা  ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত বললেন।

-আমরাও তাই চাই। বাংলার নবজাগরণের যুগ সমাগত। এই সময়ে এই ধরণের পত্রিকা যত বেশি সংখ্যায় প্রকাশিত হয়, ততই মঙ্গল। এ যাবৎকাল এই পত্রিকা বহু উত্থান পতন দেখেছে। তবে আমাদের এই সভা সর্বতোভাবে রাজকীয় ক্রিয়াকর্ম বিষয়ে সম্পর্কশূন্য থেকে জাতীয় ভাষা ও ধর্মপ্রণালীর উৎকর্ষসাধনে দেশ ও দশের উপকার করছে বলেই আমার মনে হয়। এখন এই পত্রিকার প্রকাশ অবশ্যই সুচারু ভাবে হওয়া উচিত। আমার উক্তির আগেই আমি বহুবচন শব্দ ব্যবহার করেছি। সকলেরই আমার কথার প্রতি আস্থা রয়েছে বলেই মনে করি।

লম্বা একটানা কথা বলে রামতনু বাবু তাঁর বক্তব্য শেষ করলেন। অন্যেরা তাঁর কথায় সম্মতি জানালেও ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত বলে উঠলেন, আশাকরি, এই পত্রিকা কারোও ব্যক্তিগত মত প্রকাশের পীঠস্থান হবে না। সে বিষয়ে আমাদের সজাগ থাকতে হবে।

-গুপ্ত মহাশয়, বলে, দেবেন্দ্রনাথ প্রসঙ্গটাকে স্বল্প বিস্তার এবং খোলামেলা করবার উদ্দেশ্যে বললেন, আমার মনে হয়, পত্রিকার সম্পাদকও যদি স্বয়ং সমাজের উপকারের জন্যে কোনও বিষয় নিয়ে গুরুত্বপূর্ণ মতামত দিতে চান, সেক্ষেত্রে তো আপনার কথা অনুযায়ী তা তিনি করতে পারবেন না। অথচ, সম্পাদকের সেই স্বাধীনতা থাকা উচিত। এটাই আমার মত।

-অবশ্যই। আমরাও তাই মনে করি ।

উপস্থিত সকলে দেবেন্দ্রনাথের কথার যথার্থতার স্বীকৃতি দিলেন। বাদ রইলেন, ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত।

-কিন্তু পত্রিকার সম্পাদক যে ইস্তফা দিয়ে বসে রয়েছেন।

কথাটা কানাইলাল মহাশয় বলে উঠলেন। পরে তিনি আরও কথা যোগ করলেন, পদটা অবৈতনিক। আমার মনে হয়, এই পদের জন্যে উপযুক্ত বৃত্তি নির্দিষ্ট  করে  আমরা অক্ষয়কুমার মশাইকে একবার অনুরোধ করতে পারি, তিনি যদি ইস্তফা দেওয়া থেকে নিজেকে বিরত করেন। আমার এও মনে হয় এই পদের বেতন মাসিক পঁচিশ টাকা ধার্য করা যেতে পারে।

ঈশ্বরচন্দ্র কানাইলালের প্রস্তাব সমর্থন করলেন। দেবেন্দ্রনাথ এতক্ষণ চুপ ছিলেন। বেতনের প্রস্তাব তিনিও মানছেন। তবে, তাঁর বক্তব্য, কেবল তত্ত্ববোধিনী  পত্রিকার আয়ে যদি বেতন দেওয়া যায়, তবে তা হতে পারে। কিন্তু তত্ত্ববোধিনী সভা এবং তত্ত্ববোধিনী পত্রিকার আয় সংযুক্ত করে তা দেওয়া অবিধি হবে।

পড়ুন- আবার এসো ফিরে

অক্ষয়কুমারের শারীরিক অবস্থার কথা সকলের জানা ছিল। পত্রিকার জন্যে এত বছর অত্যধিক পরিশ্রমের ফলে তাঁর শিরঃপীড়া রোগ দেখা দিয়েছিল। এমন এক দুরারোগ্য রোগে আক্রান্ত থাকাতে অক্ষয়কুমারের আয়ের সঙ্কোচ, সঙ্গে ব্যয়ের আধিক্য ,দুইয়ের জন্যে তিনি বেশ অসুবিধায় ছিলেন। আজকের সভা তাঁর জন্যে মাসিক বৃত্তি পঁচিশ টাকা ধার্য করায় তিনি যে বিশেষ উপকৃত হবেন, তাতে কোনও সন্দেহ নেই। তবে প্রশ্ন, তাঁর অসুখের কারণে তিনি কি আর পত্রিকা সম্পাদকের গুরু দায়িত্ব বহন করতে পারবেন?

এমন যখন আলোচনা চলছে, দেবেন্দ্রনাথ বললেন, এই দোলাচলের মধ্যে না থেকে, আমি প্রস্তাব রাখছি, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর মহাশয়কে এই কাজে নিযুক্ত করা হোক।

শেয়ার করতে:

You cannot copy content of this page