একগুচ্ছ ঘুমের ওষুধ এবং পিউ কাঁহা
পর্শিয়া ব্যানার্জী
দীপশিখা হেডফোন খুলে সোজা তাকিয়ে থাকে ল্যাপটপের দিকে। পাশে রাখা একটা চিঠি আর কয়েকটা ঘুমের ওষুধ। ও হ্যাঁ, সে ঠিক করেছে আজকের পর আর কাউকেই জ্বালাতন করবে না। বরং শান্তিতে ঘুমোবে। কারণ সে জানে বেঁচে থাকতে কেউ তাঁর মূল্য দেবে না। অনেক লড়াই করেছে, আর না! আর পারছে না সে। নিজের কনফিডেন্স ডাউন হয়ে গেছে পুরোপুরি।
ডায়েরির পাতায় ভাঁজ করে রাখল চিঠিটা। সে জানে আগামী দশদিন কেউ তাঁর খোঁজ করবে না। ততদিনে সে এক অন্য জগতে। সে লিখতে শুরু করল…
এভাবেও ফিরে আসা যায়
বারবার
প্রতিবার
এক শূন্যতা ঘেরা পৃথিবীতে।
তবু ওই চোখ তাকিয়ে থাকে
বলে না, কিছুই বলে না
আর নিস্তব্ধ হতে হতে সেও
ঘুমের অতলে …
…………
এভাবে আর কতক্ষণ, দীপশিখা ঘুমের মধ্যে বিড়বিড় করে। কাঠবেড়ালি… কাঠবেড়ালি। ঘুমের মধ্যেই দেখতে থাকে স্বপ্ন। স্বপ্নের মধ্যেই জীবন। একটা হলুদ ফুলের বাগানে সে হেঁটে যাচ্ছে। অনেকটা দূরে দাঁড়িয়ে আছে নীল। মুচকি হাসতে হাসতে ছবি তুলছে তাঁর পাগলামির। নিশ্চয়ই কিছু খারাপ ছবি সে তুলে রাখবে পরে দেখবার জন্যে। দীপশিখা গিয়ে ওর হাত ধরে, আর বলে ওঠে … এত্তোগুলো খরগোশ ওই…ওইখানে, দেখবে চলো।
দীপশিখা ওর হাত ধরে টানতে গিয়ে তাঁর ঘুম ভেঙে যায়। উঠে বসে বিছানায়। জানলা খুলে বসে থাকে। ঘুমের ওষুধ কোনো কাজ দেয় না। ডক্টরের সঙ্গে কনসালটেশন কোনও কাজে দেয় না। ক্রমাগত সে একা হতে হতে শূন্য হয়ে গেছে। অথচ এই যে বলে যাচ্ছে কথার পর কথা, সে জানে নীল কখনোই আর তাঁর কথা শুনবে না। এগিয়ে আসবে না আগের মতো। বরাবরের মতো সরে যাওয়ার জন্যে সে ডিসিশন নিয়ে নিয়েছে। আর বলেছে এইটুকুই থাক!
বাইরে কুকুরের ঘেউ ঘেউ। একটা দুটো গাড়ি জানলার বাইরে তখনও হর্ণ মেরে যাচ্ছে। দীপশিখা জানলায় এসে দাঁড়ায়। এখান থেকে অনেকদূর পর্যন্ত দেখা যায়। ওর বুকের ভেতর কেমন চিনচিনে ব্যথা। গতকাল রাতে বমি করেছে বেশ কয়েকবার। উহু এইসব কিছু কাউকেই জানানোর নয়। যেমনভাবে কষ্টগুলো গলা টিপে মেরে ফেলতে হয়। যেমন ভাবে জোর করে ভালো থাকার অভিনয় করতে হয়।
ও নীলের ছবিটা দেখতে থাকে। একমুহুর্তও ভুলে থাকতে পারে না। কষ্টটা গলা অবদি এসে থমকে গেছে। নীলের ভালোর জন্যে তাঁকে সরে যেতেই হবে। ও বুঝতে পারে, নীল চাইছে চলেই যায় সে অনেকটা দূরে। বিরক্ত হয়ে গেছে দীপশিখার ওপর।
…………………
দীর্ঘ রাত জানলায় কেটে যায়। ঘড়িতে ৫টা ১০। ও মনে মনে আওড়ায়…
ঠিক কীভাবে আর কীভাবে
বুঝিয়ে বলতে পারি
তোমাকে…
আদরের স্বরখানি নরম
তুমি আলতো হেসে
শুধু একবার
জড়িয়ে ধরো আর
বলো…
যা হয়েছে ভুলে যাই
বাড়িয়ে দিই হাত…
তুমি পায়রার উষ্ণতা মেখে
জীবন হয়ে যাও… আর একবার।
দীপশিখা ব্যাগ গুছিয়ে নিয়েছে। আজ তাঁর চলে যাওয়ার কথা। সে জানে না। কোথায় এবং কোনখানে গেলে তাঁর কষ্ট কমে যাবে। ঠিক ততটাই দূরে চলে যাবে সে। চিঠিটা সে বাইরে বের করে রাখে। তাঁর এই সোলো ট্রিপের কথা একমাত্র সোমু জানে। নীল বারবার বলত, একা একা ঘুরে বেড়াও। মানুষকে চেনো। আর সে জানে এখান থেকে আর ফিরবেই না কখনো। দীপশিখার চোখে হাসি। বিছানায় পড়ে থাকা নীলের দেওয়া টেডিটা তুলে নিয়ে জড়িয়ে ধরে একবার। চোখ জলে ভরে আসলেও সে অপেক্ষা রেখে যায় বরাবরের জন্য। ওদিকে জানলায় তখনও একটা পিউ কাঁহা ডেকে যাচ্ছে… পিউ কাঁহা… পিউ কাঁহা।