জাপানি মননে-মানসে রবীন্দ্রনাথ

প্রবীর বিকাশ সরকার  (জাপান প্রবাসী লেখক ও গবেষক )

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সঙ্গে জাপানের সম্পর্ক প্রায় ১২০ বছরের মতাে। তিনি মােট পাঁচবার জাপান ভ্রমণ করেছিলেন। ফলে তার জাপানে রয়েছে বহুস্মৃতি, ঘটনা ও ইতিহাস। কিন্তু আজও পর্যন্ত সেইসব সম্পূর্ণভাবে গ্রন্থাকারে অন্তর্ভুক্ত করা যায়নি। ফলে বৃহত্তর বাঙালি এবং ভারতীয়রা জানেনই না যে, রবীন্দ্র-জাপান সম্পর্ক কতখানি বিস্তৃত, গভীর এবং তাৎপর্যপূর্ণ আজকের ভূ-রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে। আজও জাপানিরা কীভাবে তাঁকে সশ্রদ্ধচিত্তে স্মরণ করেন এবং সংরক্ষণ করে চলেছেন তাঁর স্মৃতি সমূহ ‘ওওকুরায়ামা স্মারক ভবনে” এলে তা সহজেই অনুভূত হয়। এই প্রবন্ধে তুলে ধরছি সেই স্মারক ভবনের কিছু চিত্র।

বন্দর নগরী য়ােকোহামা, রাজধানী টোকিও থেকে ২৭ কিমি বা ১৭ মাইল দূরে অবস্থিত। এটা বিশ্ববিখ্যাত একটি সামুদ্রিক বন্দর জাপানের। ১৯১৬ সালে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর যখন প্রথম জাপান ভ্রমণে আসেন তখন দক্ষিণ-পূর্ব জাপানের আরেকটি স্বনামধন্য ‘কোবে’ সমুদ্র বন্দরে অবতরণ করেন। তারপর ওসাকা শহর হয়ে ট্রেনে চড়ে রাজধানী টোকিওতে উপস্থিত হন। টোকিওতে তিনি তাঁর জাপানি বন্ধু বিশিষ্ট চিত্রশিল্পী য়ােকোয়ামা তাইকানের (১৮৬৮-১৯৫৮) বাড়িতে প্রায় দশ দিন অবস্থান করার পর য়ােকোহামার অভিজাত রেশম ব্যবসায়ী হারা তােমিতারােও’র (১৮৬৮-১৯৩৯) সবুজ স্বর্গতুল্য বাগানবাড়ি ‘সানকেইএন’-এ আতিথ্য লাভ করেন প্রায় তিন মাসের জন্য। তখন তিনি য়ােকোহামার বিভিন্ন স্থান পরিভ্রমণ করেন। ফলে এই বন্দরনগরীকে খুব ভালােবেসে ফেলেছিলেন কবিগুরু! সেই মায়ার টানে তার পাঁচবার জাপান ভ্রমণের মধ্যে এখানে আরও একবার আসেন ১৯২৯ সালে বন্ধুবর হারা’র সঙ্গে সাক্ষাৎ করার জন্য।

 

 

উক্ত য়ােকোহামা বন্দর নগরীতে ‘ওওকুরায়ামা’ নামে একটি শহর বর্তমান। এখানে সবুজ পাহাড়ের উপরে ‘ওওকুরায়ামা কিনেনকান বাংলায় যার অর্থ ‘ওওকুরায়ামা স্মারক ভবন’, এই নামে একটি দৃষ্টিনন্দন স্থাপত্য আছে যা আধুনিক জাপানের গৌরব। প্রাচীন গ্রিসের হেলেনিক শৈলীর এরকম স্থাপত্য আর দ্বিতীয়টি জাপানে নেই। এই ভবনটিকে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের তীর্থস্থান বলা যায়, যদিওবা কবিগুরু কখনাে এখানে পদার্পণ করেননি কিন্তু তাঁর নিজের স্বাক্ষরকৃত দেড়শতাধিক গ্রন্থ, প্রচুর মূল্যবান তথ্য-উপাত্ত-দলিলপত্র, আলােকচিত্র এবং স্বপ্রেরিত উপহার সংরক্ষিত আছে। অতিসম্প্রতি দলিল-উপাত্তগুলাের ডিজিটাল আর্কাইভসও তৈরি করা হয়েছে। কয়েক বছর আগে ২০১৫ সালে, বিশিষ্ট রবীন্দ্রসঙ্গীত শিল্পী রেজওয়ানা চৌধুরী বন্যার ভ্রমণসঙ্গী হওয়ার সুবাদে এই ভবনে গেলে পরে নতুন কিছু আলােকচিত্র এবং দলিলপত্র প্রতিষ্ঠানের সংশ্লিষ্ট গবেষক উচিকোশি মহাশয় দেখালেন। প্রবীণ জাপানি রবীন্দ্রভক্তরা তাদের নিজস্ব সংগ্রহ থেকে এগুলাে এই ভবনে জমা দিচ্ছেন বা পাঠাচ্ছেন যাতে হারিয়ে না যায়। এরকম উদাহরণ রবীন্দ্রনাথের আপন দুই দেশ ভারত ও বাংলাদেশে চিন্তা করাই কঠিন! জাপান বলেই তা সম্ভব হচ্ছে কারণ জাপানিরা ইতিহাস-সচেতন কিন্তু তার চেয়েও বড় কথা, জাপানি মননে-মানসে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বিগত শতবর্ষ ধরেই আলােকিত ও আলােচিত। বাঙালি হিসেবে তাঁর এই সমাদর এবং সম্মান আমাদেরও গৌরব বলে মনে করি। বিশ্বের আর কোনাে জাতির মানুষ কবিকে এত ব্যাপক এবং গভীর শ্রদ্ধা ও ভালােবাসায় আত্মস্থ করেছেন বলে আমার অন্তত জানা নেই! এত মাতামাতি আর কোনাে জাতি করেনি, এমনকি বাঙালি বা ভারতীয়রাও নয় বলেই প্রতীয়মান হয়–এই কারণে যে, এত বিপুল মুদ্রিত দলিলপত্র পাওয়া গেছে বিভিন্ন স্থানে ও ব্যক্তির কাছে তাকে কেন্দ্র করে যা কেবলই বিস্ময়ের উদ্রেক করে! বিদেশের আর কোনাে দেশে এত সংখ্যক দুর্লভ ছবিও পাওয়া যায়নি!

এই দর্শনীয় তিনতলাবিশিষ্ট স্থাপত্যটি নির্মাণ করিয়েছিলেন আধুনিক জাপানের বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ, গবেষক এবং তােওয়ােও বিশ্ববিদ্যালয়ের আচার্য ড.ওওকুরা কুনিহিকো (১৮৮২-১৯৭১) ১৯৩২ সালে। স্থানীয় পাহাড়ের নামে নামকরণ হলেও প্রকান্তরে ড.কুনিহিকো’র জীবন ও কর্মকাণ্ডের স্মারক ভবনই হচ্ছে এই প্রতিষ্ঠানটি। জাপানের প্রথম ‘আধ্যাত্মিক সংস্কৃতি বিষয়ক গবেষণা সংস্থা তথা ‘ওওকুরা স্পিরিচুয়াল কালচার ইন্সস্টিটিউট প্রতিষ্ঠানের প্রধান কার্যালয় হিসেবে প্রি-হেলেনিক শৈলীতে এই বাড়িটি নির্মাণ করান তিনি। বিস্তৃত জায়গা নিয়ে গঠিত ওওকুরায়ামা স্মারক ভবনের চতুর্দিকে রয়েছে বিস্তৃত সবুজ বাগান। যেখানে নামি-দামি বৃক্ষাদি ছাড়াও রয়েছে উমে, সাকুরা প্রভৃতি ফুলের অজস্র বৃক্ষরাজি। সাকুরা জাপানের জাতীয় ফুল-সদৃশ। এখানে উমে ও সাকুরা ফুলের ঋতুতে অনুষ্ঠিত হয়। বর্ণাঢ্য ফুলদর্শন উৎসব ‘হানামি। এছাড়া এই উদ্যানে দশ হাজার মানুষ জড়াে হয়ে প্রতিবছর উপভােগ করেন সঙ্গীতানুষ্ঠান, শিশুদিবসের উৎসব। পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন পরিপাটি এমন একটি ভবন এবং স্থান জাপানে সত্যিই বিরল।

১৯৮১ সালে এই স্মারক ভবনটি রক্ষাকল্পে য়ােকোহামা নগর প্রশাসন দায়িত্বভার গ্রহণ করে এবং নাম পরিবর্তিত করে বর্তমান নাম রাখা হয়। ১৯৯১ সালে স্থানীয় সাংস্কৃতিক সম্পদ হিসেবে ঘােষণা করা হয়। এই ভবনের অভ্যন্তরে রয়েছে ১০টি সভাক্ষক, ৮০ আসনবিশিষ্ট শিন্তোও ধর্মীয় মন্দির ‘জিনজা’র অনুকরণে নির্মিত মিলনায়তন, ৬৫ মিটার

দীর্ঘ গ্যালারি ইত্যাদি। রয়েছে একটি সমৃদ্ধ গ্রন্থাগার। অভ্যন্তরভাগে কিছু সংস্কার করা হলেও বিংশ শতকের প্রারম্ভ যুগের আসবাবপত্র তেমনি সংরক্ষিত আছে। এখানে প্রবেশ করার পর অনুভব করা যায় একটি রােমাঞ্চকর যুগকে যা মিলিয়ে গেছে অনেক আগেই। কিন্তু রয়ে গেছে অক্ষত অবস্থায় তার রেশ ও আলােকচ্ছটা। রবীন্দ্রনাথের স্মারক সামগ্রী সংরক্ষণের কারণে এর মাত্রা আজ অন্যরকম।

এই ভবন এবং এর প্রতিষ্ঠাতার সঙ্গে দুজন নমস্য বাঙালির স্মৃতি গভীরভাবে বিজড়িত অনেকেই আমরা সেই ইতিহাস জানি না। একজন কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর অন্যজন দূরপ্রাচ্য টোকিও মিলিটারি ট্রাইবুনালের (১৯৪৬-৪৮) ভারতীয় বাঙালি শিক্ষাবিদ ও বিচারপতি ড.রাধাবিনােদ পাল (১৯৮৬-১৯৬৭)। তাঁর জন্ম অবিভক্ত বাংলার নদীয়া জেলার সলিমপুর গ্রামে বৃটিশ যুগে। বর্তমানে এই গ্রামটি বাংলাদেশের কুষ্টিয়া জেলার অন্তর্গত। ১৯৫৩ সালে বিচারপতি এখানে এসেছিলেন তার জাপানি বন্ধু এদেশের প্রথম আধুনিক প্রকাশনা সংস্থা হেইবােনশা পাবলিশার কোম্পানির প্রতিষ্ঠাতা, শিক্ষাবিদ ও মৃৎশিল্পী ইয়াসাবুরােও শিমােনাকা’র (১৮৭৮-১৯৬১) আমন্ত্রণে। ড.কুনিহিকো ছিলেন শিমােনাকা’র ঘনিষ্ঠ বন্ধু। এই ভবনে শিমােনাকা আয়ােজিত আন্তর্জাতিক দর্শন বিষয়ক একটি আলােচনা সভায় বিচারপতি পাল ভারতীয় বেদ ও আইন বিষয়ে প্রবন্ধ পাঠ করেছিলেন। অবশ্য সেই ঘটনার স্মৃতি কিছু না থাকলেও স্মৃতিভবনের ইতিহাসে তথ্য হিসেবে উল্লেখিত রয়েছে।

ড.কুনিহিকোর সঙ্গে গুরুদেব রবিঠাকুরের বন্ধুত্ব স্থাপিত হয়েছিল ১৯২৯ সালে যখন টোকিওর মেগুরাে শহরস্থ তার প্রাসাদোপম বাড়িতে প্রায় এক মাস আতিথ্য গ্রহণ করেছিলেন তখন। উল্লেখ্য যে, এই বছর রবীন্দ্রনাথ দু’বার জাপানে পদার্পণ করেন–একবার কানাডা যাওয়ার পথে এবং আমেরিকা থেকে ফেরার পথে। সে-বছর তার আমেরিকায় বক্তৃতা দেবার কথা ছিল কিন্তু পথিমধ্যে সঙ্গী ব্যক্তিগত সচিব অধ্যাপক অপূর্বকুমার চন্দ (জন্ম-মৃত্যু?) কবির পাসপাের্ট হারিয়ে ফেলেন। যে-কারণে মার্কিন অবিভাসন কর্মকর্তারা তাকে প্রবেশ করতে দেয়নি বরং উল্টো অপদস্থ করে নােবেলবিজয়ী ব্রিটিশ-ভারতীয় কবিকে! কবিগুরু ক্ষুদ্ধ, ভগ্নচিত্ত এবং অসুস্থ হয়ে জাপানে বিশ্রামের জন্য জাহাজ থেকে বার্তা পাঠান তার বিশিষ্ট ভক্ত এবং দোভাষী মনােস্তত্ত্ববিদ কিয়ােতাে ইম্পেরিয়াল বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপিকা ড.কোওরা তােমিকে (১৮৯৬-১৯৯৩) বলে কথিত আছে। এই সংবাদ জাপান-প্রবাসী ভারতীয় স্বাধীনতা সংগ্রামের মহাবিপ্লবী রাসবিহারী বসুর (১৮৮৬-১৯৪৫) কাছেও পৌঁছায়। গুরুদেবের বিশ্রামের উপযুক্ত একটি বাসস্থান খুঁজে বের করার দায়িত্ব পড়ে তার ওপর। জাপানে কবিগুরুর সঙ্গে একাধিকবার সাক্ষাকারী রাসবিহারী তার ঘনিষ্ঠ বন্ধু শিল্পপতি –কাগজ ব্যবসায়ী এবং শিক্ষানুরাগী ড.ওওকুরা কুনিহিকোকে অনুরােধ জানান কবিগুরুকে তার বাসভবনে আতিথ্য দেবার জন্য। ড.কুনিহিকো সানন্দে রাজি হন। তিনি এশিয়া মহাদেশে সাহিত্যে প্রথম নােবেল শান্তি পুরস্কারপ্রাপ্ত রবীন্দ্রনাথের নাম জানতেন, এও জানতেন রাসবিহারীর মাধ্যমে গুরুদেব তাঁর গ্রন্থ “থটস” বা “চিন্তা” পাঠ করেছেন। কালবিলম্ব না করে ড.কুনিহিকো কবিগুরুকে তার বাসভবনে আমন্ত্রণ জানান। এটাই ছিল কবিগুরুর শেষ জাপান। ভ্রমণ। যদিওবা কবিগুরু মৃত্যুর আগে আরেকবার জাপান ভ্রমণের আকাঙ্ক্ষার কথা জানা যায় মাদাম কোওরা তােমি’র জীবনবৃত্তান্তে। ১৯৩৫ সালে তিনি শান্তিনিকেতনে গিয়েছিলেন গুরুদেবের সঙ্গে সাক্ষাৎ করার জন্য।

১৯২৯ সালে ড.কুনিহিকো’র জীবনেও এই ঘটনা ছিল একটি অবিস্মরণীয় প্রাপ্তি। কবিগুরু যেমন তার উদার-দরাজ আতিথেয়তায় অত্যন্ত মুগ্ধ হয়েছিলেন, ড.কুনিহিকোও নােবেলবিজয়ী কবি’র সান্নিধ্য পেয়ে অত্যন্ত আনন্দিত হয়েছিলেন তা তাঁর স্মৃতিলেখায় জানা যায়। তার মননে গভীর প্রভাব বিস্তার করেছিলেন কবি। এই গভীর সম্পর্ককে চিরস্থায়ী করার জন্য ড.কুনিহিকো স্বরচিত গ্রন্থসহ জাপানের ইতিহাস, সংস্কৃতি, দর্শন, সাহিত্য, শিল্পকলাবিষয়ক মহাগ্রন্থাদি কবিকে উপহার প্রদান করেন। অনুরূপ কবিও ভারতে ফিরে গিয়ে তাঁর স্বরচিত গ্রন্থাদিসহ শতাধিক বই ও একটি ভারতীয় নৌকোর মডেল প্রতি-উপহারস্বরূপ কুনিহিকোকে পাঠান ১৯৩১ সালে। যেগুলাে ‘ওওকুরায়ামা স্মারক ভবনে সংরক্ষিত আছে পূর্বেই উল্লেখ করেছি।

২০০২ সালের কথা। জাপান-বাংলা শিক্ষা-সংস্কৃতিক বিনিময় সম্পর্কের শতবছরপূর্তি। যার সূচনা হয়েছিল ১৯০২ সালে জাপানি মনীষী ও শিল্পাচার্য ওকুকুরা তেনশিন (১৮৬৩-১৯১৩) এবং কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সাক্ষাৎ ও বন্ধুত্বের মধ্য দিয়ে ব্রিটিশ-ভারতের রাজধানী কলকাতায়। এই উপলক্ষে একটি প্রবন্ধ লেখার জন্য তথ্য খুঁজে বেড়াচ্ছিলাম। আমার প্রতিবেশী স্বনামধন্য জাপানশীর্ষ রবীন্দ্রগবেষক অধ্যাপক কাজুও আজুমার (১৯৩১-২০১১) কাছ থেকে কিছু। তথ্য সগ্রহ করেছি। আরও কিছু তথ্য দরকার ছিল, বিশেষ করে ১৯৬১ সালে জাপানে অনুষ্ঠিত রবীন্দ্রজন্মশতবর্ষ সম্বন্ধে। কিন্তু আজুমা স্যার এই সম্পর্কে বিশেষ কিছু বলতে পারলেন না কারণ তাঁর যথেষ্ট বয়স হয়েছে অনেক কিছুই ভুলে গেছেন। তাঁর বাড়িতে দশ হাজার বাংলা বই আছে, অধিকাংশই রবীন্দ্রাথের এবং রবীন্দ্রবিষয়ক। জাপানি ভাষার তাে আছেই। একদিন আলাপকালে বললেন, ‘গুরুদেবের জন্মশতবর্ষের ইতিহাস জানার মতাে গ্রন্থ আছে কিনা আর থাকলেও কোথায় আছে তা তাে বলতে পারছি না। খুঁজতে হবে। তবে বিচ্ছিন্নভাবে কিছু প্রকাশনা তাে পাবেনই তাতে

কোনাে ভুল নেই। কষ্ট করে খুঁজুন। প্রকাশনা যখন আছে স্যার বলেছেন তাহলে নিশ্চয়ই কোথাও আছে সন্দেহ নেই। কারণ জাপানিরা যেকোনাে উদ্যোগ-অনুষ্ঠানের তথ্যপ্রমাণ মুদ্রিত আকারে সংরক্ষণ করে থাকে। আমি বললাম, তাহলে কোথায় গেলে জানা যাবে সেনসেই (স্যার)? আজুমা স্যার বললেন, ‘য়ােকোহামাতে আছে। ওওকুরায়ামা কিনেনকান ভবনে সেখানে কিছু পাওয়া যেতে পারে। চল্লিশ বছর পেরিয়ে গেছে তথ্য-উপাত্ত আছে কিনা কে জানে? ড.ওওকুরা কুনিহিকো মারা যাওয়ার পর অনেক কিছুই বদলে গেছে জাপানের। সে তাে আপনি ভালাে করেই জানেন! এইসব নিয়ে এখন গবেষণা করার মতাে জাপানি মানুষজনও খুবই কম!’ আমি পুনরায় বললাম, “স্যার, ১৯৯৯ সালে অবশ্য সেখানে আমি প্রথম গিয়েছিলাম বেশকিছু রবীন্দ্রবিষয়ক দলিলপত্র পেয়েছিলাম। কিন্তু আরও দরকার। স্যার বললেন, ‘রবীন্দ্রবিষয়ক দলিলপত্র বিস্তর আছে আপনি পড়ে শেষ করতে পারবেন না! টোকিও বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্রন্থাগারে বহু আছে। ওওকুরায়ামা কিনেনকান ভবনেও অনেক আছে আমি জানি।

আজুমা স্যারের কথামতাে দমে না গিয়ে খুঁজে বের করলাম ওওকুরায়ামা কিনেনকান ভবনের ঠিকানা ও টেলিফোন নম্বর নেইমকার্ড ফোল্ডার থেকে। ফোন করে জানতে পেলাম নতুন কিছু তথ্য জমা হয়েছে ওখানে। জানতে পারলাম বেশকিছু দলিলপত্র পাওয়া গেছে। একদিন অফিস থেকে ছুটি নিয়ে গেলাম খাড়া পাহাড়ের উপরে অবস্থিত সুদৃশ্যমান ওওকুরায়ামা স্মারক ভবনে। প্রথমবার যে-দুজন কর্মকর্তার সঙ্গে পরিচয় হয়েছিল তাঁদের নেইমকার্ড দেখাতেই কাউন্টার থেকে একজন মধ্যবয়স্ক ভদ্রমহিলা আমাকে বসতে বলে ভেতরে চলে গেলেন।

কয়েক মিনিট পরেই সেই দুজন এসে হাসিহাসিমুখে আমাকে অভ্যর্থনা জানালেন। তাঁরা হলেন পরিচালক নেমােতাে মহাশয় এবং গবেষক উচিকোশি মহাশয়। টেলিফোনে আলাপকৃত আমার চাহিদা মেটাতে প্রচুর দলিলপত্র ও ছবি টেবিলে আগেই এনে রাখা ছিল সেগুলাে দেখিয়ে বললেন, আপনার পছন্দমতাে নির্বাচন করুন আমরা ফটোকপি করে দেব। আর আলােকচিত্র ধার দেয়া যাবে।

আমি অদূরে অবস্থিত প্রাচীন বৃহৎ টেবিলে সাজিয়ে রাখা অনেক গ্রন্থ, পত্রপত্রিকা ও আলােকচিত্র দেখে বিস্ময়ে হতবাক হয়ে গেলাম! প্রথমবারের চেয়ে এবার দেখলাম কয়েকগুণ বেশি। ইতিমধ্যে এগুলাে সংগ্রহ করা হয়েছে। যা যা দেখার এবং প্রয়ােজনীয় মনে করলাম আলাদা করে রাখলাম। প্রায় ঘণ্টা তিনেক কীভাবে যে মিলিয়ে গেল টেরই পেলাম না! কবিগুরু রচিত ও প্রেরিত শতাধিক বাংলা ও ইংরেজি গ্রন্থ বাদ দিলে আর সব দলিলপত্রই জাপানি ভাষায় মুদ্রিত। নতুন কয়েকটি আলােকচিত্র পেলাম যা একেবারেই দুর্লভ। একজন মহিলা কর্মী এসে বাছাইকৃত দলিলপত্রাদি নিয়ে গেলেন। জেরােক্স কপি করার জন্য অবশ্যই মূল্যের বিনিময়ে।

প্রায় দুই ঘণ্টার বেশি লাগলাে কপি পেতে ফলে এই সময়টা উচিকোশি মহাশয়ের সঙ্গে ভূগর্ভস্থ দপ্তরে গেলাম। একাধিক কক্ষের চতুর্দিকে স্তুপ স্তুপ বইপত্র, সাময়িকী, পত্রপত্রিকা, দলিলদস্তাবেজ, হার্ডবাের্ডের বাক্স পা ফেলাই মুশকিল! প্রতিদিন নতুন নতুন দলিলপত্র আসছে আর ক্রমাগত গবেষণা হচ্ছে। সেগুলাে ইন্টারনেটে আপলােড হচ্ছে। আবার গ্রন্থাদির আকারে মুদ্রিত হচ্ছে। এলাহী কাণ্ড যাকে বলে! অবশ্য এই সংগ্রহ ও গবেষণার মধ্যে রবীন্দ্রনাথজাপান সম্পর্ক বিষয়টিও অন্তর্ভুক্ত। খুব আনন্দিত হলাম যে উপমহাদেশ থেকে ৭০০০ মাইল দূরে অবস্থিত দ্বীপবর্তী দেশে বাঙালি কবি রবীন্দ্রনাথ উপস্থাপিত এবং গবেষিত হচ্ছেন বিদেশিদের দ্বারা! অথচ বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকা শহরে একটি জাদুঘর নেই তার নামে! কী হাস্যকর দীনতা আমাদের! ভূগর্ভস্থ একটি কক্ষে পূর্বে দেখা কবিগুরু’র সেই বিপুল আকৃতির সাদাকালাে আলােকচিত্রটির মুখােমুখি হলাম। তারই পাশে একটি কাচের বাক্সে সংরক্ষিত রবীন্দ্রনাথ প্রেরিত ভারতীয় নৌকোর মডেলটিও রয়েছে। অনুমতিক্রমে ছবি তুললাম। চমৎকার বড় আলােকচিত্রটি হার্ডবাের্ডে সাঁটা। সত্যিই দেখার মতাে অপূর্ব একটি ছবি! দুটোই প্রতিষ্ঠানের বিশেষ বিশেষ অনুষ্ঠানে প্রদর্শিত হয়ে থাকে। দুটোই য়ােকোহামার মূল্যবান সাংস্কৃতিক সম্পদ।

এই ভবনে যা পেলাম তা যে আমার কাছে কতখানি মূল্যবান বােঝানাে কঠিন! হয়তাে বিলুপ্ত সিন্ধু সভ্যতা আবিষ্কার করিনি কিন্তু য়ােকোহামায় রবীন্দ্রনাথকে আবিষ্কারের আনন্দ কোনােভাবেই কম অমূল্য নয়! অবিস্মরণীয়ও নয় এই জীবনে! নিজের কাছেই অবিশ্বাস্য মনে হল! ৭০০০ মাইল দূরে একদিন রবীন্দ্রসভ্যতা এই দেশকে মাতিয়ে দিয়েছিল ভাবতেই রােমাঞ্চ অনুভব করলাম! উচিকোশি মহাশয় জানালেন, রবিঠাকুরের জন্মশতবর্ষ উদযাপন উপলক্ষে যে ‘টেগাের মেমােরিয়াল অ্যাসােসিয়েশন গঠিত হয়েছিল ১৯৫৮ সালে তার মূল দপ্তর ছিল এই ভবনে। কার্যকরী অফিস ছিল টোকিওর মেজিরাে শহরে। আবার এই ভবনের ভেতরেই একটি কক্ষে আলাদাভাবে রবীন্দ্র গবেষণা কক্ষ স্থাপন করা হয়েছিল। এখানে রাখা হয়েছিল রবীন্দ্রনাথ প্রেরিত গ্রন্থ, উপহারসমূহ; সমগ্র জাপান থেকে খুঁজে আনা অসংখ্য

দলিলপত্র, ছবি যা এখন অধিকাংশই নেই। ১৯৭১ সালে ড.কুনিহিকো মারা যাওয়ার পর রবীন্দ্র-আন্দোলনটাই স্তিমিত হয়ে গিয়েছিল। ড.কুনিহিকো’র ইচ্ছে ছিল ‘টেগাের মেমােরিয়াল ফাউন্ডেশন’ নামে একটি প্রতিষ্ঠান গঠনের কিন্তু করতে পারেননি, সেটা হলে পরে জাপানে রবীন্দ্র স্মৃতি জাদুঘর গড়ে উঠত বলে তার বিশ্বাস। তিনি আমাকে দুতিনতলা পর্যন্ত বিস্তৃত বিশাল গ্রন্থাগারেও নিয়ে গেলেন যেখানে রবীন্দ্রনাথের স্বাক্ষর সম্বলিত শতাধিক গ্রন্থ সংরক্ষিত, যদিওবা বইগুলাে অনেকটাই জরাগ্রস্ত হয়ে পড়েছে। ভাবতে ভালাে লেগেছে যে এই গ্রন্থগুলাে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর নিজ হাতে নির্বাচন করেছিলেন, স্পর্শ করেছিলেন–আর সেই স্পর্শের উষ্ণতা যেন আমার হাতের আঙুলে অনুভব করলাম!

সেদিন যা পেলাম বেশকিছু ম্যাগাজিন, দৈনিক পত্রিকার কাটিং, গ্রন্থ, অপ্রকাশিত আলােকচিত্র এবং গেক্কান সাচিয়া বা ‘মাসিক সত্য’ নামে ২২টি ট্যাবলয়েড পত্রিকা সবগুলাের জেরােক্স কপি করে নিয়ে এলাম। এই পত্রিকাটি ছিল ‘টেগাের মেমােরিয়াল অ্যাসােসিয়েশনের মুখপত্র। ছবিগুলাে দেখে বিশ্বাসই করতে পারছিলাম না যে, সত্যিই এই ব্যস্ততম ভােগবাদী দেশটিতে প্রায় অর্ধ শতাব্দি পূর্বে ঋষিতুল্য রবীন্দ্রনাথের শততম জন্মবর্ষ বিশাল ঘটা করে উদযাপিত হয়েছিল! ১৯১৬ সাল থেকে ১৯৬১ সাল পর্যন্ত জাপানে গৃহীত অনেক দুর্লভ ছবি খুঁজে পেলাম। ধার করে আনলাম স্ক্যান করে রাখার জন্য।

নবআবিষ্কারের আনন্দে সারা পথ আমি দারুণ উত্তেজনায় কাটালাম ট্রেনের মধ্যে, যেমনটি ১৯৯৯ সালে হয়েছিল প্রথম আবিষ্কারের সময়! বাসায় ফিরে দলিলপত্রগুলাে পড়ার চেষ্টা করলাম কয়েক সপ্তাহ ধরে কঠিন জাপানি ও চীনা কানজি অক্ষরে লিখিত অজস্র প্রতিবেদন, প্রবন্ধ, নিবন্ধ, স্মৃতিচারণ সবই রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে। তাছাড়া তাঁর প্রবন্ধ, গল্প, কবিতার অনুবাদ তাে আছেই। প্রায় সাড়ে তিন বছর ধরে বিশাল পরিকল্পনা নিয়ে রবীন্দ্রনাথের শততম জন্ম বার্ষিকী উদযাপনের খবর বহির্বিশ্বের আর কোনাে দেশেই পাওয়া যায়নি! সেই কর্মকাণ্ডেই ইতিহাস অধিকাংশই সংরক্ষিত হয়নি। জানতামই না যে, ওসাকা, নাগাসাকি, কোবে, য়ােকোহামা, কিয়ােতাে, নারা প্রভৃতি মহানগরে রবীন্দ্রনাথ গিয়েছিলেন! তাকে নিয়ে একাধিক অনুষ্ঠান হয়েছিল। যদি ওওকুরায়ামা কিনেনকান’ ভবনে না যেতাম অনেক তথ্যই আরও কতকাল ঘুমিয়ে থাকত কে জানে! জানতেই পারতাম না, জাপানি মননে-মানসে রবীন্দ্রনাথের চিন্তা, দর্শন, শিক্ষা এবং মানবতাবাদ কতখানি বিস্তৃত স্থান দখল করেছিল ১৯০২ থেকে ১৯৬১ সাল পর্যন্ত! তার কিছু তথ্য তুলে ধরতে সক্ষম হয়েছি মূল জাপানি ভাষা থেকে বাংলায় অনুবাদের মাধ্যমে ৩টি গ্রন্থে, যথাক্রমে, ‘জাপানে রবীন্দ্রনাথ (হাতেখড়ি, ঢাকা, ২০১৬) এবং জাপানে রবীন্দ্রনাথ’ (বলাকা, ঢাকা, ২০১৭) এবং রবীন্দ্রনাথ ও জাপান: শতবর্ষেষের সম্পর্ক’ (তৃতীয় সংস্করণ, আত্মজা পাবলিশার্স, কলকাতা, ২০২০)। আরও বিস্তর তথ্যউপাত্ত, ইতিহাস লেখার বা অনুবাদের বাকী রয়ে গেছে। কবে শেষ করতে পারব কে জানে!

১৯৬১ সালের পরও রবীন্দ্রভাবনা নতুন প্রজন্মের জাপানি মননে-মানসে প্রবাহবান থাকার অনেক ঘটনা বিদ্যমান যা গ্রন্থে অন্তর্ভুক্ত করে রাখার প্রয়ােজনীয়তা রয়েছে। মাত্র দশ বছরের বালক বয়সে যিনি নাটক ‘ডাকঘরে’র মাধ্যমে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথকে বুকের ভেতরে ধারণ করেছিলেন অধ্যাপক কাজুও আজুমাই পরবর্তীকালে হয়ে উঠেছিলেন জাপানের শীর্ষতম রবীন্দ্রগবেষক! তাঁর মতাে বড়মাপের বিদেশি রবীন্দ্রভক্ত আর জন্ম নেননি, নেবেন কিনা বলা কঠিন! বিপুল কাজ তিনি করেছেন এবং রেখে গেছেন স্মৃতিসমূহ তাঁর প্রাণের ঐশ্বর্য গুরুদেব রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে নিয়ে জন্মভূমি জাপানে এবং ভারতে। বাংলাদেশে একাধিকবার গিয়েছেন তিনি, ছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের দোভাষী এবং ঘনিষ্ঠ বন্ধু ও শুভাকাঙ্ক্ষী; প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছিলেন বাংলাদেশ-জাপান কালচারাল সেন্টার’ সিলেটে প্রায় সাড়ে ৬ কোটি টাকার মহাপরিকল্পনা নিয়ে কিন্তু তাঁরই শিষ্য সিলেটের নাগরিক দারাদ আহমেদ সমস্ত টাকাই আত্মসাৎ করে বাংলাদেশ থেকে নিরাপদে পালিয়ে বিদেশে চলে গেছে! যার কোনাে সুরাহা হয়নি আজ পর্যন্ত! কাজুও আজুমা’র মহীয়সী স্ত্রী যিনি আরেক বিশিষ্ট রবীন্দ্রভক্ত ও বাংলা ভাষার শিক্ষক মাদাম কেইকো আজুমা প্রধান মন্ত্রী শেখ হাসিনাকে চিঠি লিখেও কোনাে উত্তর পাননি মৃত্যু পর্যন্ত! সেই রবীন্দ্রঅন্তপ্রাণ, বাংলাভাষা ও বাঙালিপ্রেমী প্রয়াত অধ্যাপক কাজুও আজুমাকে কোনাে বিশেষ সম্মান প্রদান করেনি বাংলাদেশি কোনাে ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠান, এমনকি সরকারও! অথচ তিনি বিশ্বভারতী থেকে অর্জন করেছেন মর্যাদাসম্পন্ন ‘দেশিকোত্তম’, পশ্চিমবঙ্গ সরকার থেকে রবীন্দ্র পুরস্কার জাপানের রাষ্ট্রীয় কোক্কা কুনশােও’ পদকসহ অনেক স্বীকৃতি পুরস্কার ও ডিলিট। বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধেও রয়েছে তার অনেক অবদান মূলত গুরুদেবের কারণে–সেই অবদানেরও কোনাে মূল্যায়ন হয়েছে বলে আমার জানা নেই। এতবড় বিশ্বমাপের একজন রবীন্দ্রভক্তকে যখন বাংলাদেশ মূল্যায়ন করেনি তখন বুঝতে অসুবিধা হয় না যে, পক্ষান্তরে রবীন্দ্রনাথকেই অবমূল্যায়ন করা হয়েছে!

কিন্তু তারপরও মহৎপ্রাণ অধ্যাপক কাজুও আজুমা বাঙালিকে কখনাে ছােট করে দেখেননি, অভিযােগ করেননি, বিস্মৃত হননি বাঙালিকে–বাঙালির ভাষাকে। যে ভাষাকে ভালােবেসে অন্তিম দিনে বলেছেন, পরজন্মে বাঙালি হয়ে জন্মাতে চাই’, বাঙালিকে কী গভীরভাবেই না ভালােবেসেছিলেন তিনি! ২০১৭ সালের ১২ নভেম্বর প্রকাশিত হয়েছে আজুমা

স্যারের শেষ রবীন্দ্র-প্রণতি ‘তাগাে-রু নাে সেকাই’ তথা ‘টেগােরের জগৎ’–তার বিভিন্ন সময় লিখিত রচনাসমূহের সাড়ে ৭০০ পৃষ্ঠার সংকলন বিখ্যাত দাইসান বুমমেইশা প্রকাশনা সংস্থা থেকে।

আরাই কানপােও বা কাম্পাে প্রকৃত নাম আরাইকান জুউরােও (১৮৭৮-১৯৪৫) জাপানের বিশিষ্ট আধুনিক চিত্রশিল্পী যার সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের পরিচয় হয়েছিল ১৯১৬ সালে য়ােকোহামার সানকেইএন বাগানবাড়িতে হারা তােমিতারােও’র মাধ্যমে, ১৯১৭-১৮ পর্যন্ত গুরুদেবের আহবানে কলকাতার জোড়াসাঁকোস্থ ঠাকুর বাড়ির বিচিত্রা ভবনে চিত্রকলা শিখিয়েছেন–তাদের পবিত্র স্মৃতিকে স্মরণীয় করে রাখার জন্য তােচিগি-প্রিফেকচারের উজিইয়ে শহরের সাকুরা নামক স্থানে ৮৪১ বর্গক্ষেত্র জুড়ে গড়ে তােলা হয়েছে নিরাভরণ ‘কানপােও-তাগাে-রু হেইওয়া কোওএন’ বা ‘কাম্পাে-টেগাের শান্তি পার্ক’ ১৯৯৫ সালে শিল্পীর একদা বাসকৃত জায়গায়। আরাই কাম্পােও’র বংশধররা এই জায়গাটি দান করে দিয়েছেন সাকুরা নগর প্রশাসনকে, নগর প্রশাসনই এর দেখভাল করছে। বাগানে একটি ঐতিহ্যবাহী ‘চা-শিৎসু বা ‘চা-গৃহ’ বিদ্যমান। জাপানি মননে রবীন্দ্রনাথ কতখানি মায়া বিস্তার করলে পরে এরকম একটি উদ্যান নির্মাণ করা সম্ভব এই পার্কটি তারই জ্বলন্ত প্রমাণ! ভূভারতে বা বাংলাদেশে এরকম একটি রবীন্দ্র স্মারক উদ্যান খুঁজে পাওয়া যাবে কি! শুধু তাই নয়, ২০ বছরেরও বেশি আগে অধ্যাপক কাজুও আজুমা’র উদ্যোগে উজিইয়ে শহরে গঠিত হয়েছে ‘কাম্পাে-তাগাে-রু কাই’ তথা ‘কাম্পাে-টেগাের সংস্থা যার প্রেসিডেন্ট হচ্ছেন নােজাওয়া বুনরিউ, মিয়ােফুকুজি বৌদ্ধ মন্দিরের পুরােহিত, যিনি একাধিকবার গিয়েছেন ভারতে, নেপালে; অবস্থান করেছেন তার প্রিয় কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের শান্তিনিকেতনে। আলাপকালে জানালেন, সংস্থাটি কানপােও-টেগাের স্মারক বক্তৃতার আয়ােজন করে থাকে। ২০১৭ সালের ১৯শে নভেম্বর, রােববার ছিল বিশ্বভারতীর বিশিষ্ট কর্মকর্তা কবি, শিল্পী এবং লেখক নীলাঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায়ের Rabindranath Tagore and his Japanese Correspondences শীর্ষক গুরুত্বপূর্ণ গবেষণামূলক বক্তৃতা। অনুষ্ঠানে আমার সৌভাগ্য হয়েছিল উপস্থিত থাকার এবং সুযােগ হয়েছিল নতুন করে জাপানি মননে-মানসে রবীন্দ্রনাথের আলােকে রবীন্দ্র-জাপান সম্পর্কের ইতিহাসকে অনুভব করার।

 

আলােকচিত্র:

১] য়ােকোহামাস্থ ওওকুরায়ামা স্মারক ভবন (ছবি: ওওকুরায়ামা কিনেনকান) ২] ওওকুরায়ামা স্মারক ভবনে রবীন্দ্রনাথ বিষয়ক দলিলপত্র (ছবি: লেখক) ৩] ওওকুরায়ামা স্মারক ভবনে রবীন্দ্রনাথ প্রেরিত ভারতীয় নৌকো (ছবি: লেখক) ৪] টেগাের মেমােরিয়াল অ্যাসােসিয়েশন, জাপান এর মুখপত্র (ছবি: লেখক)। ৫] ১৯২৯ সালে ড.ওওকুরা কুনিহিকোর টোকিওস্থ বাসভবনে রবীন্দ্রনাথ (ছবি: ওওকুরায়ামা কিনেনকান) ৬] প্রয়াত জাপানশীর্ষ রবীন্দ্রগবেষক অধ্যাপক কাজুও আজুমা সস্ত্রীক তাঁর বাড়িতে (ছবি: লেখক) ৭] ২০১৫ সালে ওওকুরায়ামা স্মারক ভবনে রেজওয়ানা চৌধুরী বন্যা (ছবি: লেখক)

শেয়ার করতে:

You cannot copy content of this page