দেবেন না কি দাদা এবং দিদিরা ‘বিয়ের বিজ্ঞাপন’!

রাই কমল

বয়স কুড়ি পেরোল কি পেরোলো না, তার পরেই শুরু হয়ে যায় ‘কি ব্যাপার দাদা, আপনার মেয়ের বিয়ে দেবেন না’। ওদিকে ছেলে ছাব্বিশ পেরিয়ে সাতাশ। অমনি শুরু হলো, ‘কি রে বিয়ের বয়স তো পেরিয়ে যাচ্ছে। বিয়ের পিঁড়িতে এবার বোস’। এ তো গেল এখনকার কথা। আবার এখন তো অনলাইনের যুগ। বিকল্পের পর বিকল্প। ম্যাট্রিমনি সাইট ঘেঁটে খুঁজে নিন একের পর এক পছন্দের জীবনসঙ্গী। এ পছন্দ নয় তো কি হয়েছে, আর একজন আছে তো।

গ্রামে গঞ্জে আগে হাতে ছাতা আর মুখে কগাল হাসি নিয়ে ঘটকদের দেখা পাওয়া যেত। আর কিছু থাকুক না থাকুক, তাঁদের কাছে পাত্র-পাত্রীর ছবি পাওয়া যাবে অবশ্যই। এরপর কাগজের বিজ্ঞাপন দেখে অনেকেই পাত্র-পাত্রী খুঁজে নেন। কিন্তু তাই বলে এই খোঁজার ব্যাপারটা কিন্তু দেড়শ বছর আগে এতটা সহজ ছিল না। বাংলা খবরের কাগজে যখন প্রথমবার পাত্র পাত্রীর বিজ্ঞাপন দেওয়া হয়েছিল। সভ্যসমাজ এটি মানতে পারেনি একেবারেই। কেমন ছিল বাংলায় বিয়ের ধরণটি-

“একজন কর্মচারী যিনি ২০ বছর কর্মকার্য করিয়াছেন, এখন তাহার বিবাহ করিবার ইচ্ছা হইয়াছে তিনি এমন একটি কনে চান যাহার বয়স ২৫ বৎসরের অধিক নহে এবং সংসারের কাজকর্মে বিশেষ নিপুণ। টাকাকড়ির প্রয়োজন নাই। বর বেশ সুখে স্বচ্ছন্দে আছেন। কনেরা দরখাস্তের সঙ্গে যেন নিজ নিজ চেহারার ছবি পাঠাইয়া দেন। যাঁহার চেহারা পছন্দ না হইবে তাহার চেহারা (অর্থাৎ ছবি) ফিরাইয়া দেওয়া যাইবেক। কনেরা ও কে নামে শিরোনাম দিয়া, এক্সচেঞ্জ গেজেট ছাপখানায় অধ্যক্ষের নিকট দরখাস্ত পাঠাইয়া দিবেন।”

১৮৭১ সালের ১১ জুলাই ছিল সেই দিন। সেটা ১৯ শতকের কথা। এক বঙ্গসন্তান করে বসলেন এই আশ্চর্য কাজ। সংবাদপত্রে দিয়ে দিলেন বিয়ের বিজ্ঞাপন। সেই সময় কেউ ভাবতেই পারেন না সংবাদপত্রে বিজ্ঞাপন দিয়ে বিয়ে হতে পারে। সেইসময় বাংলার ‘এক্সচেঞ্জ গেজেট’ নামক এক সংবাদপত্রে বেরোল একটি বিশেষ বিজ্ঞাপন। বিয়ে সংক্রান্ত ওই বিজ্ঞাপনটি ছিল এইরকমই। ইতিহাস খতিয়ে দেখলে দেখলে, এটিই ছিল বাংলা সংবাদপত্রের প্রথম পাত্র-পাত্রীর বিজ্ঞাপন।

যা দেখে রীতিমতো শোরগোল পড়ে যায় বাংলায়। খবরের কাগজে বিজ্ঞাপন দিয়ে যে বিয়ে করা যায়, এমন ঘটনায় সেইসময়কার রক্ষণশীল সমাজও জেগে উঠল। তারা ভাবতে শুরু করলেন, এ কি অনাচার! শহর জুড়ে কানা ঘুষো তো ছিলই, পাশাপাশি সেই আগুনেও ঘি ঢালে অন্যান্য পত্রিকাগুলো। অনেকে প্রচার করতে লাগল, সংবাদপত্রে গাড়ি ঘোড়া, বাড়ির বিজ্ঞাপন তো লোকে দেয়। কিন্তু বিয়ের জন্যে বিজ্ঞাপন ঠিক চিন্তা করে উঠতে পারা যায় না।

“খবরের কাগজে বিজ্ঞাপন দিয়া লোকে তো ঘর বাড়ি গাড়ি ঘোড়াই কিনিয়া থাকে, কিন্তু বিজ্ঞাপন দিয়া কিরূপে বিবাহের সম্বন্ধ স্থির হইতে পারে, আমরা তো তাহা ভাবিয়া চিন্তিয়া ঠিক করিয়া উঠিতে পারিলাম না। কন্যাটি কেমন ঘরের মেয়ে, উহার চরিত্র কিরূপ, কেবল একখানা দরখাস্ত পড়িয়া যে কিরূপে এই সমস্ত অবগত হওয়া যায় এবং কিরূপেই বা এই সমস্ত গুরুতর বিষয় বিশ্বাস করিতে পারা যায়, বাঙ্গালির বুদ্ধিতে ইহা ঘটিয়া ওঠা দায়। ছি ছি লজ্জার কথা, দরখাস্ত করিয়া একজন কুলকামিনী অপর একজন অপরিচিত ব্যক্তিকে পতিত্বে বরণ করিবে? এমন বিবাহের চেয়ে যাবজ্জীবন আইবুড়ো থাকা ভাল।”

এমনকি সাহেবি শিক্ষা এবং ইংরেজি শিক্ষাকেও কাঠগড়ায় তোলে সেইসময়ের বঙ্গ সমাজ। এই পদ্ধতিতে বিবাহ করে যে ‘সংসারে সুখ পাওয়া যায় না’, এমন কথাও ফলাও করে বলা হয়। কিন্তু এর পাশাপাশি, ১৮৭১ সালের এই বিজ্ঞাপন তখনকার প্রচলিত বহু ধারণাকেই ভেঙে দিয়েছিল। অবশ্য তখন সংখ্যাগরিষ্ঠ অনেকেই মানেনি এই ঘটনাকে। আর পরবর্তীকালে তো আমরা দেখেছি এই ‘পাত্র-পাত্রী চাই’ বিজ্ঞাপনই খবরের কাগজের অন্যতম প্রধান অংশ হয়ে উঠেছে।

 

ঋণ স্বীকার – কলির শহর কলকাতা / হরিপদ ভৌমিক, ডেইলি বাংলাদেশ

শেয়ার করতে:

You cannot copy content of this page