ধুলো
তৃতীয় পর্ব
সন্দীপ চক্রবর্তী
দু’দিন পর রমেনবাবু সুস্থ হলেন। সাধারণত রোগভোগের পর কথা কম বলেন। কিন্তু এবার কথা ফিরে আসা মাত্র হাঁকডাক শুরু করে দিলেন। নন্দকে ডেকে বললেন, ‘পণ্ডিতকে একবার খবর দে।’
কথাটা নন্দর পছন্দ হল না। পণ্ডিত মানে শশধর মুখোপাধ্যায়। হাড়ে হারামজাদা শয়তান একটা। জ্যোতিষীগিরির নাম করে লোক ঠকায়। নন্দ দুচক্ষে দেখতে পারে না। কিন্তু রমেনবাবুর খুব বিশ্বাস। প্রত্যেকবার অসুখ থেকে উঠে একবার ডাকবেনই। কাজ কিছুই না। শোভেনের ঠিকুজিটা এগিয়ে দিয়ে জিজ্ঞাসা করবেন, ‘কবে আসবে বলে মনে করছ?’ শশধর ঝানু মাল।
হাবিজাবি নানান অঙ্ক কষে বলবে, ‘আজ্ঞে এ বছরই একটা এসপার-ওসপার হয়ে যাবে কত্তা। আপনি কিছু ভাববেন না।’ তারপর পঞ্চাশ টাকা ট্যাঁকে গুঁজে চটিতে ফটাস ফটাস আওয়াজ তুলে পিঠটান দেবে। নন্দ বেজার মুখে বলল, ‘ওকে আবার কেন। যা বলে কিছুই তো মেলে না।’ রমেনবাবু চটে গেলেন, ‘তুই থামবি। ফলিত জ্যোতিষের কী বুঝিস তুই! বাজে না বকে এখনই যা। বল, খুব জরুরি দরকার। আজই যেন একবার আসে।’ শশধর এল বিকেলে। রোগা সিড়িঙ্গে চেহারা। মাথাটা শরীরের তুলনায় বড়ো। বয়েস ষাটের ওপরেই হবে। নাকের ডগায় নেমে আসা চশমাটা পিছনে ঠেলে দিয়ে সে ঠিকুজি পরীক্ষা করতে বসে গেল। ‘কেমন আছে সেটা কি বলা যাবে?’
রমেনবাবু জিজ্ঞাসা করলেন। শশধর অমায়িক হেসে বলল, ‘ছেলে আপনার ভালোই আছে কত্তা৷ ভালো চাকরি করছে। ছেলেপুলে পরিবার নিয়ে তার বেশ সুখের জীবন।’ রমেনবাবু বেশ উৎফুল্ল হয়ে উঠলেন, ‘তাই নাকি! তা, সেটাই তো জীবনে দরকার। সুখ না থাকলে জীবনে আর কী থাকল! সোনালদিতে কবে আসবে কিছু দেখতে পাচ্ছ?’ ‘রথযাত্রার আগে আপনার বাড়িতে একটা পুত্র সমাগম যোগ আছে। তবে একটা কথা কত্তা। অভয় দেন তো বলি–‘ ‘হ্যাঁ হ্যাঁ বলো না–‘ শশধর চশমার কাচ মুছে বলল, ‘যোগ যা আছে তা আছে। কিন্তু শুধু যোগে তো কাজ হয় না। তাকে কাজে লাগাতে গেলে কিছু উদ্যোগ-আয়োজন করতে হয়।’
‘হেঁয়ালি রাখো পণ্ডিত। যা বলার স্পষ্ট করে বলো।’ ‘আজ্ঞে কত্তা, গাছের আম গাছ তো আর আপনার হাতে দিয়ে যায় না। গাছের ডাল থেকে পাড়তে হয়। আমার কথার গ্যারিন্টি যদি চান তা হলে একটা পুত্রমঙ্গল যজ্ঞ করে ফেলুন। দেখবেন পরের দিনই ছেলে আপনার বাবা বলে এসে পেন্নাম করবে।’ দু’দিন ধরে চিন্তা করলেন রমেনবাবু। শশধর এ প্রস্তাব আগেও দিয়েছে। তখন তিনি রাজি হননি। কিন্তু এবার পুত্র সমাগম যোগ রয়েছে। এই সময় যজ্ঞটা যদি করে নেওয়া যায় তা হলে সত্যিই হয়তো কাজ হবে। একটা সুখের মুহূর্ত তৈরি হল বটে কিন্তু বেশিক্ষণ স্থায়ী হল না।
টাকার চিন্তা বড়ো হয়ে উঠল। যজ্ঞ করার টাকা পাবেন কোথায়? জমিদার বাড়ির ছেলে বলে জীবনে চাকরি-বাকরি করেননি। ব্যবসাবুদ্ধিও ছিল না। পূর্বপুরুষের রেখে যাওয়া সম্পত্তি ভেঙে চালিয়েছেন চিরকাল। সুখ-অসুখ, পাল-পার্বণ, বারব্রত থেকে শুরু করে শোভেনের লেখাপড়া পর্যন্ত সবই হয়েছে সঞ্চয় ভেঙে। এখন থাকার মধ্যে আছে বিঘে তিনেক ধানজমি, এই রাজবাড়ি আর ব্যাঙ্কে কয়েক হাজার টাকা। এ হেন কুবেরের পুঁজি ভাঙলে দু’টি প্রাণীর চলে কী করে! সিদ্ধান্ত নিতে না পারলে রমেনবাবু উত্তেজিত হয়ে পড়েন। অন্নপূর্ণার কথা মনে পড়ে। আজ সে যদি থাকত তা হলে পরামর্শ করতে পারতেন। সবাই তাকে এই ধ্বংসস্তূপে একলা রেখে কেটে পড়েছে৷
অভিমানে রমেনবাবুর চোখের পাতা ভিজে গেল। সন্ধ্যে নামতে আর বিশেষ দেরি নেই। পুব দিকের মহলের হেলে পড়া বারান্দার দিকে অন্যমনস্ক ভঙ্গিতে তাকিয়ে ছিলেন রমেনবাবু। হঠাৎ কে যেন বলল, ‘আমাকে কেন দোষ দিচ্ছেন বাবা। আমি তো আপনাকে ছেড়ে যাইনি। আপনিই আমাকে চলে যেতে বলেছিলেন।’ চমকে উঠলেন রমেনবাবু।
কে কথা বলল? শোভেন ফিরে এল নাকি? ঘরের ভেতর পাতলা অন্ধকার। নন্দ বোধহয় বাইরে গেছে। আলো জ্বালা হয়নি। হরিশচন্দ্রের পালঙ্কে বসেই রমেনবাবু হাঁক দিলেন, ‘শোভেন এলি? কোথায় তুই বাপ! আমার কাছে আসছিস না কেন?’ কেউ সাড়া দিল না। অন্ধকারে নিজেকে ছাড়া আর কাউকে খুঁজে পেলেন না রমেনবাবু। শোভেন আসেনি। তিনি ভুল শুনেছেন। এরকম আজকাল হয়। বাস্তব আর কল্পনায় কোনও পার্থক্য থাকে না। কিন্তু শোভেন না আসুক, যে কথা রমেনবাবু শুনলেন সেটা কি মিথ্যে? শোভেন তো তারই কথায় বাড়ি থেকে চলে গিয়েছিল। রমেনবাবু পুবের মহলের দিকে তাকালেন। কিন্তু কিছুই দেখতে পেলেন না। অন্ধকারে ডুবে গেছে সব। (ক্রমশ)
ছবি- ইন্টারনেট