নিখোঁজের তালিকায়

সৌপ্তিক চক্রবর্তী 

মিসিং রিপোর্ট

সেই যে সকাল সাড়ে ছটা-সাতটায় শৈবাল মর্নিং ওয়াকে গেছে প্রায় একটা বাজতে গেল এখনো ফিরছে না। বেশ টেনশন হচ্ছে পৃথার। এই কদিনের জন্য ওরা বেড়াতে এসেছে উত্তরবঙ্গে। পাহাড়ের কোলে ছোট্ট একটা গ্রাম। মনোরম প্রকৃতির মধ্যে ছবির মতো সুন্দর। শৈবালই জায়গাটা পছন্দ করে। বাগডোগরা এয়ারপোর্ট থেকে ঘন্টা দেড়-দুই। এনজেপি রেলওয়ে স্টেশন থেকেও ওইরকমই।

ওদিকে সঞ্জয়ের রুমটাও সকাল থেকেই তালাবন্ধ। আর থাকতে না পেরে পৃথা হোমস্টের মালিক থাপাকে বলল পুলিশে খবর দিতে। থাপা আর একটু ওয়েট করতে চাইছিলেন কিন্তু পৃথার পীড়াপিড়ীতে পুলিশে ফোন করে তাদের আসতে বললেন।

ঘন্টাখানেক বাদে ওসি ইন্সপেক্টর গুরুং, সাব ইন্সপেক্টর ছেত্রী আর একজন ড্রাইভারকে নিয়ে এসে পৌঁছলেন দ্য অর্কিড হোমস্টেতে। ট্যুরিস্ট মিসিং শুনেই ব্যাপারটাকে তিনি সিরিয়াসলি নিয়েছেন। ট্যুরিজমই এখানকার সবকিছু।

হোমস্টেতে ঢুকে গুরুং ভালো করে জরিপ করে নিলেন। মেইন রাস্তাটা থেকে একটা রাস্তা বেশ কিছুটা উঠে এসে শেষ হয়েছে হোমস্টের সামনে। সামনেটায় পার্কিং। দু-ধাপ সিঁড়ি উঠে রিসেপশন। রিসেপশন রুমের ভেতরের দরজা দিয়ে একতলায় একটা ছোট ড্রইংরুম, তার লাগোয়া ওপেন কিচেন, একটা বাথরুম আর একটা বেডরুম। একতলায় মি ও মিসেস থাপা থাকেন। এই হোমস্টেটা ওনাদের। 

রিসেপশন রুমের বাইরে লাগোয়া সিঁড়ি দিয়ে দোতলায় উঠে একটা বড় রুম আর সামনে ঠিক রিসেপশন রুমের ওপরটায় একটা টেরেস। গুরুং জানলেন ওপরের রুমটাই সবচেয়ে বড়, চারজনের। সিঁড়ির পাশের প্যাসেজ দিয়ে ভেতরে এগিয়ে একটা ছোট লন। লনের শেষে পাশাপাশি দুটো কটেজ। ডান হাতে আরো দুটো কটেজ। আর একটা ছোট্ট বাগান। বাঁ হাতে কিচেন কাম ডাইনিং, স্টাফরুম আর একটা কমন টয়লেট। লনের মাঝে তিনটে ছাতার নিচে টেবল-চেয়ার পাতা। মোটামুটি এই হল দ্য অর্কিড হোমস্টে। 

পৃথা লনে একটা ছাতার নিচে চেয়ারে বসেছিল। তার পাশে মিসেস থাপা বলেছিলেন। মি থাপার নির্দেশে একজন স্টাফ আরো দুটো চেয়ার এনে গুরুং আর ছেত্রীর বসার ব্যবস্থা করে দিল। থাপা পৃথাকে গুরুংএর সাথে পরিচয় করিয়ে দিলেন। গুরুং নমস্কার করে ও ছেত্রীর পরিচয় দিয়ে পৃথাকে জিজ্ঞাসাবাদ শুরু করলেন। ছেত্রী সেলফোনের রেকর্ডরটা অন করে দিল।

গুরুং- আপনি নিশ্চয়ই আপনার হাজব্যান্ডের ফোনে ট্রাই করেছেন?

পৃথা- হ্যাঁ, অনেকবার। সুইচড অফ বলছে।

গুরুং- বেশ নাম্বারটা দিন।

পৃথা শৈবালের নাম্বারটা গুরুংকে দিল।

গুরুং নাম্বারটা সেভ করে নিয়ে প্রশ্ন করলেন- আপনার হাজব্যান্ডের ফুল নেম?

পৃথা- শৈবাল রায়।

গুরুং- বয়স ও হাইট? আন্দাজ?

পৃথা- ৩২। হাইট … লম্বাই। এই পাঁচ-নয় হবে।

গুরুং- ঠিক কটার সময় উনি বেরিয়েছিলেন।

পৃথা- ঘড়ি দেখিনি, আমি ঘুমাচ্ছিলাম, ও বেরোনোর আগে বলে গেল যে বেরোচ্ছি। তবে সাড়ে ছটা-সাতটা হবে। রোজ ওরকম সময়েই ও মর্নিং ওয়াকে যায়। 

গুরুং- ওকে। তা উনি যখন বেরোচ্ছেন কি কি পরেছিলেন বলতে পারেন?

পৃথা- হ্যাঁ, মানে ওগুলো পরেই গতকাল বেরিয়েছিল। জ্যাকেট, জিন্স আর পায়ে স্নিকার্স।

গুরুং- রংগুলো বলতে হবে, ম্যাডাম। 

পৃথা- কালো জ্যাকেট, নীল জিন্স আর গ্রে আর সবুজ মেশানো স্নিকার্স।

গুরুং- চশমা পরতেন? মাথায় টুপি ছিল না?

পৃথা- না, চশমা পরত না। টুপি ছিল না। জ্যাকেটে হুডি আছে।

গুরুং- গুড।  সাথে কিছু ছিল না?

পৃথা- না।

গুরুং- শিওর?

পৃথা- হ্যাঁ, ওর সাইডব্যাগটা ঘরেই আছে আর ট্রলিদুটোও।

গুরুং- আচ্ছা, আপনাদের মধ্যে কোনো ঝগড়া-অশান্তি হয়নি তো? মানে হয়ত রাগ করে কোথাও গেছেন।

পৃথা- না।

গুরুং- বেশ, আপনারা কবে এসেছেন?

পৃথা- গত শনিবার সকালে।

গুরুং-ওকে, আর আজ হল গিয়ে সোমবার।  তা কিসে এসেছেন?

পৃথা- ফ্লাইটে।

গুরুং- কোথা থেকে এসেছেন?

পৃথা- কলকাতা।

গুরুং- কলকাতার ঠিকানা?

পৃথা কলকাতায় তাদের রাজারহাটের ফ্ল্যাটের ঠিকানা দিল।

গুরুং- বাড়িতে কে কে আছেন?

পৃথা- এখানে শুধু আমরা দুজনেই থাকি। রেন্টেড।

গুরুং- তা ওনার পৈতৃক বাড়ি কোথায়?

পৃথা- মালদায়। 

গুরুং- মালদার কোথায়?

পৃথা- ইংরেজ বাজার, পিনকোড জানি না।

গুরুং- বাড়িতে কে কে আছেন? 

পৃথা- দাদা, বৌদি আর ভাইঝি আছে। শ্বশুর-শ্বাশুড়ি মারা গেছেন। 

গুরুং- ওকে, তো ওখানে খবর নিয়েছেন?

পৃথা- না।

গুরুং- কেন?

পৃথা- মানে, ওখানে হঠাৎ করে চলে যাবে কেন?

গুরুং-  বেশ, ওখানকার কোনো নাম্বার আছে?

 পৃথা শৈবালের দাদার নাম্বারটা গুরুং কে দিল।

গুরুং- আপনার বাপের বাড়ি কোথায়?

পৃথা- কলকাতায়।

গুরুং- ঠিকানা?

পৃথা তার বিজয়গড়ের বাড়ির ঠিকানা দিল।

গুরুং- বাড়িতে কে কে আছেন?

পৃথা- বাবা, মা আর ঠাকুমা।

গুরুং- ওকে, তা আপনার হাজব্যান্ড কি করেন?

পৃথা- আই টি ইঞ্জিনিয়ার।

গুরুং- কোন কোম্পানিতে আছেন?

পৃথা-উইপ্রোতে।

গুরুং- অফিস কোথায়?

পৃথা- সল্টলেক সেক্টর ফাইভ।

গুরুং- বরাবর এখানেই আছেন?

পৃথা- না, এই বছর দুয়েক।

গুরুং- তার আগে কোথায় ছিলেন?

পৃথা- কানাডাতে একটা ফার্মে। নামটা ভুলে গেছি।

গুরুং- আপনি কিছু করেন?

পৃথা- না, আমি হাউজওয়াইফ।

গুরুং- এনি ওয়ে, আপনাদের কতবছর বিয়ে হয়েছে?

পৃথা- বছর দেড়েক।

গুরুং- আগে থেকে চিনতেন শৈবালকে?

পৃথা- না, সম্বন্ধ করে বিয়ে।

গুরুং- ওকে। আপাতত এইসব ইনফরমেশনই চলবে। ওনার একটা ফটো দিতে পারেন?

পৃথা ফেসবুক থেকে শৈবালের একটা প্রোফাইল পিকচার ডাউনলোড করল। গুরুং ওকে তাঁর নাম্বারটা দিয়ে হোয়াটসঅ্যাপ করতে বললেন। পৃথা ছবিটা পাঠানোর পর। ছবিটা সেলফোনে দেখতে দেখতে গুরুং বললেন- চিন্তা করবেন না। আমরা খোঁজ খবর শুরু করছি। সন্ধের মধ্যেও উনি না ফিরলে আপনি মি থাপার সঙ্গে এসে মিসিং ডায়েরি করে দেবেন। এনি ওয়ে, আপনাদের চেক আউট কবে?

পৃথা- কালকে

গুরুং- ফেরা, ফ্লাইটে?

পৃথা- না, এনজেপি থেকে সন্ধের ট্রেনে। 

গুরুং আর ছেত্রী ওদের থেকে বিদায় নিয়ে বেরিয়ে পড়লেন।

সন্ধের পরও শৈবাল ফিরল না। পৃথা থাপার সাথে থানায় গেল। এদিকে সঞ্জয়ও সন্ধ্যা পর্যন্ত ফিরল না দেখে থাপা সেকথা জানালেন গুরুংকে। 

গুরুং থাপাকে বললেন- কই, সকালে তো আপনি কিছু বললেন না?

থাপা- না, আসলে তখন ভেবেছিলাম হয়ত সাইট সীইং-এ গেছেন। সবসময় তো গেস্টরা আমাদের বলে যান না। কিন্তু সন্ধে হয়ে গেল এখন ফিরলেন না! এখানে তো সন্ধের পর গাড়িও চলে না। তাই ভাবছি কোনো বিপদ-আপদ হল না তো!

গুরং- তা, উনি কি একলাই এসেছিলেন?

থাপা- হ্যাঁ।

গুরুং- হুম। কোথা থেকে এসেছিলেন?

থাপা- কলকাতা।

গুরুং- পরিচয়পত্র দেখেছিলেন।

থাপা- হ্যাঁ। ভোটার কার্ড। ছবি তুলে রেখেছি।

পৃথা শৈবালের মিসিং ডায়েরি করল। থাপা করলেন সঞ্জয়ের।

 

সারপ্রাইজ

রবিবার সকালে হঠাৎই পৃথা সঞ্জয়ের মেসেজ পেলঃ তুমি যে কটেজেই থাকো না কেন একবার বারান্দায় এসে দাঁড়াও। শৈবাল তখন তৈরী হচ্ছিল সাইট সীইং-এ যাওয়ার জন্য। পৃথা অলরেডি তৈরী হয়ে ছিল। বারান্দায় গিয়ে দাড়াতেই দেখল লনে একটা চেয়ারে বসে সঞ্জয় তার দিকে তাকিয়ে হাসছে। আরো একটা মেসেজ করল সঞ্জয়ঃ কি, কেমন সারপ্রাইজ দিলুম? 

পৃথা সত্যি সত্যিই অবাক হয়ে গেছে। সঞ্জয় পারেও বটে। সেই কোলকাতা থেকে এতদূর শুধু তাকে সারপ্রাইজ দিতে এসেছে। পৃথা হেসে রুমে ঢুকে গেল। সঞ্জয় ডাইনিং এ চলে গেল। একটু পরে পৃথা ও সঞ্জয় গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে পড়ল সাইট সীইং-এ ।

গাড়ি যেতে যেতে পৃথা মনে করতে থাকল তার কলেজের সেইসব দিনগুলোর কথা। সঞ্জয়ের সাথে রঙিন প্রেমের সেইসব দিন।

কিন্তু সঞ্জয়কে কিছুতেই তার বাবা মেনে নেননি। আর সঞ্জয় তেমন কিছু করতেও পারেনি। হাফ গ্র্যাজুয়েট হয়ে বসেই ছিল বাড়িতে। ক্লাবে আড্ডা মেরে, ক্যরম খেলে দিন কাটাচ্ছিল। ওর বাবার পয়সা ছিল। পরে একটা ফাস্টফুড সেন্টার করেছিল। ইদানিং দিব্যি চলছে।

একপ্রকার জোর করেই পৃথার বাবা তার বিয়ে দিয়ে দেন বিদেশ ফেরত শিক্ষিত-মার্জিত ইঞ্জিনিয়ার শৈবালের সাথে। শৈবালকে পৃথা কোনোদিনই ভালবাসতে পারেনি। তার প্রতি সে শুধু দায়িত্ব-কর্তব্যটুকু করে, ব্যাস। এমন নয় যে শৈবাল তার সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যে কোনো ত্রুটি রেখেছে কিন্তু ওই সঞ্জয়কেই সে আসলে সব দিয়ে বসে আছে। তাই শৈবালকে লুকিয়ে আজও পৃথা সঞ্জয়ের সাথে শরীর-মন ভাগ করে আসছে। ওর কাছাকাছি এলেই একটা তীব্র আকর্ষণ টের পায়। শুরু থেকে আজ অব্ধি সেই একইরকম আকর্ষণ।

ফ্ল্যাশব্যাক

সাইট সীইং থেকে ফিরে পৃথা সঞ্জয়কে দেখতে পেল না। রুমে ঢুকে চেঞ্জ করে ফ্রেশ হয়ে নিল দুজনেই। পৃথা ট্যাবটা হাতে নিয়ে গা এলিয়ে দিল বিছানায় আর শৈবাল একটা স্কচের বোতল, গ্লাশ আর জলের বোতল নিয়ে কটেজের বারান্দায় গিয়ে বসল। কিচেনে বলে এসেছিল একটু পরেই রুমবয় এসে একপ্লেট চিকেন পকোড়া দিয়ে গেল।

ড্রিংক করতে করতে শৈবালের মনে পড়ে গেল সেই দিনটার কথা যেদিন সে প্রথম পৃথার সেলফোনে সঞ্জয়ের মেসেজ দেখেছিল। মাস চারেক আগের কথা। পৃথা সেলফোনটা রেখে ওয়াশরুমে গিয়েছিল। শৈবাল কাছেই ছিল। হঠাৎ হোয়াটসঅ্যাপে দুটো ম্যাসেজ ঢোকে। লক স্ক্রিনের ওপর ফুটে ওঠা মেসেজ দুটোঃ

মিসিং ইউ। একটা স্যাড সাইন।

কবে দেখা হচ্ছে? একটা লাভ সাইন।

পৃথা ওয়াশরুম থেকে ফিরে সেলফোন নিয়ে বেডরুমে চলে যায়। শৈবাল কিছু বলে না। বুঝতেও দেয় না কিছু। সন্দেহ একবার মনে ঢুকলে তা সবসময়ই খচখচ করে। তাই এরপর থেকে পৃথার সেলফোনে তার অনুপস্থিতিতে কোনো হোয়াটসঅ্যাপ নোটিফিকেশন এলেই শৈবাল চোখ বোলাতো। অল্প কিছুদিনের মধ্যেই শৈবাল আরো দুটো মেসেজ দেখে সঞ্জয়ের। তার মধ্যে লাস্টেরটা ছিলঃ কাল দুপুর ৩টেয়, হলদিরামসের সামনে।

কাজটা চিপ হচ্ছে জেনেও শৈবাল ব্যক্তিগত কাজ আছে বলে পরদিন লাঞ্চের পরপর বেরিয়ে পড়ে অফিস থেকে। হলদিরামের কাছাকাছি গাড়িটা পার্ক করে আড়ালে অপেক্ষা করতে থাকে। কিছুক্ষণের মধ্যেই পৃথা আসে। একটা ছেলেকে দেখে হেসে এগিয়ে যায়। হাগ করে। ছেলেটা খানিকটা আগেই এসেছিল।

ওরা হলদিরামসে ঢোকে না। হাঁটতে থাকে। শৈবাল দুরত্ব রেখে পিছু নেয়। ওরা নিজেদের গল্পে মশগুল থাকায় ও শৈবাল নিরাপদ দূরত্ব বজায় রাখায় ওরা শৈবালকে লক্ষ্য করে না। কিছুটা হেঁটে ওরা ওয়োর একটা সস্তা লজে ঢুকে যায়। শৈবাল যা বোঝার বুঝে যায়। এইসব লজে ঘন্টা প্রতি রুম ভাড়া দেওয়া হয় তা শহরের যে কোনো আহম্মকও জানে। 

শৈবাল পৃথাকে কিছু বুঝতে দেয় না। কিন্তু মনে মনে পরিকল্পনা করে এই প্রতারণার শাস্তি পৃথাকে সে দেবেই। ডিভোর্স কোনো শাস্তি নয়। বরং ডিভোর্সে ক্ষতি তার আর লাভ পৃথারই। তার প্রেমের পথে আর বাধা থাকবে না আর ওদিকে শৈবাল ফাঁসবে কোর্ট-কাছারির চক্করে। সময়, সম্মান ও অর্থ সবই নষ্ট হবে তার।

এরপর কিছুদিন ভালো করে ভেবে একটা জুতসই প্ল্যান করে শৈবাল। বারবার রিভাইজ করে প্ল্যানটা যাতে সেটা ফুলপ্রুফ হয়।

ডেডবডি

পরদিন সকাল থেকেই গুরুং এলাকায় পুরোদস্তুর খোঁজখবর শুরু করে দিলেন। দু-দুজন মিসিং। আবার একই হোমস্টে থেকে। বিষয়টাকে তিনি যথেষ্ট গুরুত্ব দিয়েছেন। ইতিমধ্যেই গতকাল রাতে তাঁর নির্দেশে ছেত্রী কাছাকাছির সব নার্সিংহোম-হসপিটালগুলোতে শৈবাল-সঞ্জয়ের খোঁজ নিয়েছেন। রেজাল্ট নেগেটিভ। থানার সবার কাছেই সঞ্জয়ের ছবি পাঠানো হয়েছে। 

এ এস আই বিনয়কে ডেকে গুরুং আশেপাশের সবকটা ট্রাভেল কোম্পানি আর সার্কলের গাড়ির স্ট্যান্ডে  গিয়ে শৈবাল-সঞ্জয়ের খোঁজ নিতে বললেন। বিনয় একজন কনস্টেবলকে নিয়ে বেরিয়ে পড়ল।

এর কিছুক্ষণ পরই একটা ট্রেকারে করে স্থানীয় চার পাঁচজন যুবক থানায় এসে জানাল যে একটু দূরে খাদের মধ্যে একটা বডি পড়ে আছে। গুরুং তখুনি ছেত্রীকে নির্দেশ দিলেন রেসকিউ টিমের সাথে ফলো আপ করে বডি নিয়ে আসতে। যদিও বডি কিনা সেটা প্রশ্ন সাপেক্ষ। বেঁচেও তো থাকতে পারে।

বডি রেসকিউ করতে করতে দুপুর হয়ে গেল। হ্যাঁ, ডেডবডিই। ঝরনার ধারে পাথরের ওপর পড়েছিল। বডির থেকে একটু দূরে মানিব্যাগটা পাওয়া গেল। ভেতরে হাজার কয়েক টাকা, ডেবিট কার্ড, ভোটার কার্ড আর লোকনাথবাবার একটা ছবি। ছেত্রী ডেবিট ও ভোটার কার্ডে দেখলেন মৃত ব্যক্তির নাম সঞ্জয় পাল। ঠিকানা কলকাতার। সেলফোনটা টুকরো টুকরো হয়ে ভেঙে ছড়িয়ে ছিল আশেপাশে। তবে অনেক খোঁজাখুঁজি করেও সিমকার্ড সহ কিছু অংশ পাওয়া গেল না। সম্ভবত ঝরনায় পড়ে ভেসে গেছে। 

ইতিমধ্যে বিনয় ট্র্যাভেল কোম্পানি আর সার্কল ঘুরে ফিরে এল। রেজাল্ট নেগেটিভ। কোনো কোম্পানি থেকেই শৈবাল বা সঞ্জয় কোনো গাড়ি বুক করেনি। আর সার্কলের ড্রাইভাররা কেউই শৈবালকে আইডেন্টিফাই করতে পারেনি।

দুপুরে থাপা এসে বডির ফিজিক্যাল আইডেন্টিফিকেশন করে গেলেন। গুরুং কলকাতার স্থানীয় থানায় সঞ্জয়ের মৃত্যুসংবাদ দিলেন। বডি পোস্ট মর্টেমে চলে গেল।

থাপা ফিরে এই দুঃসংবাদ দেয় পৃথাকে। তবে তাকে শক্ত থাকতেও বলেন। কিন্তু সঞ্জয় আর নেই শুনে পৃথা শোকে ম্যুহমান হয়ে পড়ে। চুপচাপ ঘরে ঢুকে যায়। 

বিকেলের দিকে পৃথা গুরুংকে ফোন করে শৈবালের কোনো খবর আছে কিনা জানতে চায়। গুরুং জানান খোঁজ চলছে। তবে কোনো নার্সিংহোম-হসপিটালে শৈবাল অ্যাডমিটেড হয়নি এবং মালদাতেও যায়নি। তারা ভেরিফাই করে দেখেছেন।

পৃথা জানতে চায় যে তাকে আর কতদিন এখানে থাকতে হবে। তার বাবা-মা টেনশন করছেন। প্লাস তার হাতে টাকা পয়সাও তেমন নেই বিশেষ। গুরুং স্পষ্টতই তাকে জানিয়ে দিলেন যে সে চাইলে অ্যাট দ্য আর্লিয়েস্ট কলকাতা ফিরে যেতে পারে কারণ এখানে থেকে তার কোনও লাভ নেই। যা করার পুলিশই করবে আর শৈবালের কোনো খোঁজ পাওয়া গেলে তাঁরাই তাকে জানাবেন। 

দ্য প্ল্যান

সোমবার শৈবাল যখন ঘুম থেকে উঠল পৃথা তখন ঘুমাচ্ছিল। প্রতিদিনের মতোই ফ্রেশ হয়ে জামাকাপড়-জুতো পরে তৈরী হয়ে নিল। তারপর সাইডব্যাগটা খুলে তার পাসপোর্ট, জিরো পাওয়ারের একটা চশমা আর দুটো এয়ার টিকিট বার করে ভরে নিল জ্যাকেটের ভেতরের জিপটানা পকেটে। নতুন একটা মাস্ক বার করে ভরল জিন্সের পকেটে। আর সবশেষে তার কানাডার রেসিডেন্ট কার্ডটা বার করে নিয়ে নিল মানিব্যাগের কার্ডহোল্ডারে। এখানে বেড়াতে আসার আগে শৈবাল পৃথার অলক্ষ্যে এগুলো তার অফিসের সাইডব্যাগে ভরে রেখেছিল। এয়ার টিকিট দুটো কেটেছিল অফিস থেকে। বাগডোগরা টু মুম্বাই আর মুম্বাই  টু টরন্টো।

শৈবাল বেরোনোর আগে পৃথাকে ‘বেরোচ্ছি’ বলে দরজাটা ভেজিয়ে দিয়ে বেরিয়ে গেল রুম থেকে। পৃথা ঘুমের মধ্যে একবার ‘হুম’ বলল শুধু। 

হোমস্টের বাইরে এসে শৈবাল সেলফোন্টা সুইচ অফ করে দিল। তারপর হাঁটতে শুরু করল। নির্জন রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতে পকেট থেকে নতুন মাস্কটা বের করে ঢেকে নিল নাক-মুখ। তারপর চশমাটা বের করে পরল।  হুডিটা তুলে ফিতেটা বেঁধে নিল গলার কাছে।

পৃথা বা তার শ্বশুরবাড়ির কেউ জানত না যে শৈবাল কানাডার পার্মানেন্ট রেসিডেন্ট। তার দাদাও জানত না। পৃথা এটাও জানত না যে এখানে বেড়াতে আসার মাস দুয়েক আগেই শৈবাল কোম্পানিতে রিজাইন করেছে। আসার আগের আগের দিনই ছিল তার লাস্ট ডে ইন অফিস। 

যাই হোক, শৈবাল হাঁটতে হাঁটতে চলে এল একটা ভিউপয়েন্টে। দূরে পাহাড়ের দিকে তাকল। মাস্ক নামিয়ে বুক ভরে তাজা বাতাস নিল। একটা সিগারেট ধরাল। কিচকিচ পাথির ডাক, ঝরনার শব্দ, দূরের সবুজ পাহাড় আর একটা বুনো মিষ্টি গন্ধে শৈবাল কিছুক্ষণ তন্ময় হয়ে থাকল। তারপর মাস্কটা তুলে নিয়ে হাঁটতে থাকল সার্কলের দিকে। সার্কলটায় কিছু গাড়ি দাঁড়িয়ে থাকে।

একটা টাটা সুমো নিয়ে শৈবাল চলে এল শিলিগুড়ি বাস টার্মিনাস। বাস টার্মিনাস থেকে বেরিয়ে একটু হেঁটে এসে রাস্তার ধারের একটা টুপি-সানগ্লাশের দোকান থেকে একটা ক্যাপ কিনল। হুডিটা নামিয়ে ক্যাপটা পরে নিল মাথায়। তারপর একটা রেস্তারাঁয় ঢুকে জমিয়ে ব্রেকফাস্ট করল। 

ব্রেকফাস্ট সেরে রেস্তারাঁ থেকে বেরিয়ে একটা ট্যাক্সি নিয়ে চলে এল কসমস মল। সেখানে বেশ কিছুক্ষণ ঘোরাঘুরি করে দু সেট ফরমাল শার্ট-প্যান্ট, একটা জিন্স, একটা সোয়েটার, গোটা চারেক টি শার্ট, ২ জোড়া শর্টস আর ব্রিফস কিনল। সোয়েটারের ট্যাগ কাটিয়ে জ্যাকেট খুলে সেটাকে পরে নিল। জ্যাকেটটা রাখ্ল সোয়েটারের প্যাকেটে। তারপর একটা ট্রাভেল অ্যাক্সেসরিসের দোকান থেকে কিনল একটা কেবিন ট্রলি। নতুন জামাকাপড় আর জ্যাকেটটা তাতে ভরে প্যাকেটগুলো দোকানেই ড্রপ করে দিল।

তারপর মল থেকে বেরিয়ে একটা ট্যাক্সি নিয়ে সোজা চলে এল বাগডোগরা এয়ারপোর্ট। আর কি? এবার পরপর ফ্লাইটে মুম্বাই-দিল্লি-ফ্র্যাঙ্কফুর্ট হয়ে দিন দেড়েকেই পৌঁছে যাবে সুদূর টরন্টো। আর পৃথা পড়ে থাকবে এখানে। না ডিভোর্সি, না উইডো। শৈবালের কোনো খোঁজই সে আর পাবে না। 

পুনশ্চঃ পরদিন অর্থাৎ বুধবার, সঞ্জয়ের বাবা ও পিসতুতো দাদা এসে তার বডি নিয়ে কলকাতা রওনা দিলেন। সঞ্জয়ের পোস্টমর্টেম রিপোর্ট বলছে যে পড়ে গিয়ে আঘাতজনিত কারণে মৃুত্যু। অন্য কোনো রকম অস্বাভাবিকতা অর্থাৎ আগে মাথায় আঘাত করার বা বিষ কিংবা মাদক প্রয়োগে অচেতন করার কোনো ট্রেস নেই। বুধবারই দুপুরের ফ্লাইটে কলকাতা রওনা দিল পৃথা। গুরুং শৈবালের ফটো ও ডিটেইলস পাঠালেন শিলিগুড়িসহ আশেপাশের অন্যান্য থানায়।

ছবি- গুগল

শেয়ার করতে:

You cannot copy content of this page