পাপাঙ্গুলের ঘর

এখনকার ছোট বাচ্চাদের কেউ জিজ্ঞেস করে না তারা বড় হয়ে কি হতে চায়। আমাদের ছোটবেলায় প্রায় সব বাচ্চাকে এই প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হতো। তখন সেটাই ছিল বড়দের এন্টারটেনমেন্ট। সেসময় ফেসবুক ছিল না। স্কুল ও পাড়ার বন্ধুদের সার্ভে করে দেখেছিলাম অধিকাংশের উত্তর হতো ডাক্তার বা ইঞ্জিনিয়ার, কেউ কেউ পাইলটও বলতো। আমি কোনো উত্তর খুঁজে পেতাম না। শুধু রোববার ছাড়া প্রতিদিন বাবাকে একই সময়ে ঘর থেকে বেরোতে আর ঘরে ঢুকতে দেখতাম আর ভাবতাম আমি আর যাই হই এমনটা হবো না। ছোট থেকেই বুঝেছিলাম গতে বাঁধা জীবন আমার জন্য নয়।


সময়ের চাকা ঘুরতে ঘুরতে কিভাবে একদিন আমি, বেকার আমি, হতাশায় ডুবে যাওয়া আমি, সত্যজিৎভক্ত আমি তাঁর নামেরই একটা অ্যালবাম শাফল্‌ অল করে চালিয়ে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে ব্রাশ করছি। হঠাৎ এক চেনা কন্ঠস্বর শুনি, কিছু শব্দ যা আমায় স্তব্ধ করে দেয়, “ওরা ছাকনি চড়ে সাগর পাড়ি দেবে, দেবেই দেবে।” পাপাঙ্গুল আমার মনের সাগরে প্রবেশ করে। শব্দগুলো কান দিয়ে ঢুকে ফুসফুসে চাপ দিতে থাকে, তালের সাথে হতে থাকে সিস্টোল-ডায়াস্টোল। চোখ ফেঁটে জল আসে, “সে এক আজব ঠাই, গাছ ছাড়া আর সেথায় কিছুই নাই” আমি যেন দেখতে পাই। “নীল মাথাতে সবুজ রঙের চুল” আমার পৃথিবীকে আমি দেখতে পাই। এমন কিছু কান্না থাকে যেগুলো পরম তৃপ্তির হয়, সেই চোখের জল শোষণ করে নেয় ত্বক। সেদিন আমি পাই পাপাঙ্গুলকে। মনে হয় যেন এটা আমার জন্যই লিখে গেছেন সত্যজিৎ রায়। সেদিন থেকে ফেসবুকে নিজের নাম পাল্টে রেখে দিই পাপাঙ্গুল জয়।


তারপর বছর দুয়েক আগের কথা, একজন বইকর্মী হিসেবে বইপাড়ায় প্রবেশ করি। সেখানে গিয়েই হয় আসল ম্যাজিক। স্বপ্নগুলো বাস্তবের সাথে একই ট্র্যাকে দেখতে পাই দূরে, অনেক দূরে। বইপাড়ার অন্যান্য বইকর্মীদের দেখে এক অদম্য অণুপ্রেরণা পাই। বইকর্মীদের ভালোবাসাই বইপাড়ার অক্সিজেন। বুক ভরে নিই। অনেক প্রকাশক, লেখক, কবি ও অজস্র বইকর্মীর সাথে ভালোবাসা-ভরসার সম্পর্ক তৈরী হয়। সেই সম্পর্কগুলোকেই পুঁজি করে আমি ও আমার স্ত্রী সংযুক্তা মিলে তৈরী করি “পাপাঙ্গুলের ঘর”। সোদপুরে রথীন্দ্র সিনেমা হলের ঠিক সামনে ষোলো বছর ধরে চলতে থাকা একটা ঝালমুড়ির দোকানকে এক সুসজ্জিত বইঘরের রূপ দিই। গত জানুয়ারি মাসের ৯ তারিখ যার প্রথম বর্ষপূর্তি কেক কেটে উদযাপণ করা হল। ঘর বড় হওয়ার থেকে সুসজ্জিত হওয়ার সুখ অনেক বেশি।


সূচনার প্রথম বছরেই পাপাঙ্গুলের ঘর কোভিড, লক-ডাউন, আমফান অনেক প্রতিবন্ধকতার সম্মুখীন হয়। বাস ট্রেন সব বন্ধ থাকায় সাইকেলে করে সোদপুর থেকে কলেজ স্ট্রীট গিয়ে বই আনা শুরু করি। কুরিয়ার-পোস্ট সব বন্ধ থাকায় নিজেই যতটা সম্ভব সাইকেলে করে পাঠকদের কাছে বই পৌঁছে দিই। বছর শেষে দুটো বইমেলায় পাপাঙ্গুলের ঘর তার জায়গা করে নেয় ও অজস্র পাঠকদের ভালোবাসা-ভরসা পায়।


আগামী ৮ মার্চ, নারী দিবসে পাপাঙ্গুলের ঘর প্রকাশনা হিসেবে আত্মপ্রকাশ করতে চলেছে। দক্ষিণারঞ্জন মিত্র মজুমদার ও কালীপ্রসন্ন দাস গুপ্ত প্রণীত “আর্য্য নারী’ আমাদের প্রথম বই। যার সম্পাদনা করেছেন সংযুক্তা রায় ও প্রচ্ছদ করেছেন বিপাশা মিত্র। প্রকাশক হিসেবে আমার মূল উদ্দ্যেশ্য নতুন পাঠকের জন্ম দেওয়া, যারা পড়ে না তাদের বইমুখী করা। “লেখালিখি করে কি আর পেট চলে?” এমন প্রশ্নকে অর্থহীন প্রমাণ করা।
অবশেষে সেই নারী যার জন্য এসব কিছু সম্ভব হয়েছে সংযুক্তার প্রতি এবং বাংলার সকল বইকর্মী ও বইপ্রেমীদের প্রতি ভালোবাসা, শ্রদ্ধা ও কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপণ করে আমার বক্তব্য শেষ করছি।

শেয়ার করতে:

You cannot copy content of this page