প্রথম তূর্য-ধ্বনি

 প্রীতম পাল

 

— তূর্যের কি হয়েছে অতীন? প্লীজ বল আমাকে। শুনেছি ও গত তিন দিন ব্যাঙ্কে আসে নি৷ ও বাড়িতেও নেই। ও তো এরকম করে না কখনও। What happened to him? অতীন প্লীজ বল আমাকে।
— সুরভী, তুই ওর গার্লফ্রেন্ড। আমি তো তোকে এই কথা জিজ্ঞেস করবো ভেবেছিলাম। আমি নিজেও কনফিউজড। গত দুবছরে তূর্য কোনো C.L. নেয় নি। আর সে নাকি তিনদিন বেপাত্তা। ওর বিহেভিয়ারও কেমন অদ্ভুতভাবে চেঞ্জড হয়ে গেছে। নো ক্লু সুরভী।
— অতনু, আমরা তূর্যকে দশ বছর ধরে চিনি। সেই কলেজ লাইফ থেকে। He is such a decent guy….এতো ভদ্র ছেলে যে কোনো লোকের মুখের ওপর জোরে কথা বলতো না। আমার বাবার সাথে আমাদের রিলেশনশিপ নিয়ে কথা বলতে গিয়ে তো ঘেমে নেয়ে একাকার। সেই ছেলে হঠাৎ তার কলিগের সাথে মারামারি করে বসলো! অবিশ্বাস্য!
— এতো চিন্তা করিস না। মনে হচ্ছে এমন কিছু নিয়ে ও ডিস্টার্বড যেটা কাউকে বলতে পারছে না। তুই একবার কথা বলে দ্যাখ।
— কি করে কথা বলবো? ওর ফোনও তো সুইচড অফ। কোথায় আছে তারও তো কোনো হদিস নেই!
— একটু ওয়েট করি। নিশ্চই চলে আসবে।
— তুই কোনো খবর পেলে জানাস অতনু।
— অফকোর্স। চল তোকে তোর বাড়িতে ড্রপ করে দিই।
— হুম। চল।
*************

অন্ধকার ঘরে মোমবাতি আলোয় বসে আছে তূর্য। খোলা জানালা দিয়ে বয়ে আসা সামান্য বাতাসে মৃদু কেঁপে উঠছে মোমবাতির ক্ষুদ্র অগ্নিশিখা। তিনদিন পর সে সুন্দরবনের সন্দেশখালি দ্বীপ থেকে ফিরেছে। তিনদিন ধরে সে ঘুরে বেড়িয়েছে পাগলের মতো। ছোটবেলা থেকেই তার মন খারাপ হলে দূরে কোথাও চলে যেত। বরাবরের মতো এবারও গেছিলো সে কিছু দিন ধরে বিচলিত মনটাকে শান্ত করতে। সারারাত জেটি ঘাটে বসে শুনেছে লঞ্চের ভোঁ। ইছামতী তার ইচ্ছা মতো শাখা প্রশাখা ছড়িয়ে দিয়ে আপন মনে বয়ে চলেছে সাগরের অভিমুখে। রাতের নক্ষত্র তবু তাকে কোনো দিশা দেখায় নি। নদী ঘাটের শীতল বাতাস তবু তার ক্লান্ত চোখে এনে দেয় নি দু-এক আঁজলা ঘুম। যেন দু-চোখের পাতায় ঝুলে আছে কোলরিজের সেই মৃত অ্যালবাট্রস! বার বার ভেসে উঠছে সেই দৃশ্য! সে কি পারতো না সে মেয়েটিকে বাঁচাতে? তবে কেন পারলো না? কেন একটিবার চেষ্টা করলো না?

বন্ধ ঘরে বসে দুচোখ বন্ধ করতেই সে মনে মনে দেখতে পায় সেই রাতটার দৃশ্য।

প্রতিদিনের মতোই ব্যাঙ্কের ডিউটি শেষ করে সে তার হেঁটে হেঁটে তার ফ্ল্যাটে ফিরছিলো। সেদিন ছুটি পেতে একটু বেশিই রাত হয়ে গেছিলো। তাকে বাড়ি ফেরার পথে বালি ব্রিজ ক্রশ করতে হয়। নীচ দিয়ে অলস চালে বয়ে যায় ভাগীরথী। সে সেই রাতে যখন ব্রীজের কাছে পৌঁছালো তখন রাত প্রায় দশটা। ডিসেম্বরের শীত, তাই পথ-ঘাট একটু বেশিই নিঝুম। ব্রীজটা সম্পূর্ণ শুনশান। চোখের দৃষ্টিতে লেগে আছে কুয়াশার প্রলেপ। আনমনে ব্রীজের বাম দিক দিয়ে হেঁটে চলেছে তূর্য। ব্রীজের মাঝামাঝি আসতেই তার চোখে পড়লো তার বিপরীত দিকে ব্রীজটার রেলিঙ ঘেঁষে মানান্য ঝুঁকে দাঁড়িয়ে আছে একটি কম বয়সী মেয়ে। পড়নে হলুদ টপ। খোলা চুলগুলো বাতাসে উড়ছে। মেয়েটিকে দেখা মাত্রই দাঁড়িয়ে গেলো তূর্য।
” এতরাতে এখানে কী করছে মেয়েটি? কী দেখছে এমন করে ঝুঁকে? ” মনে মনে ভাবলো সে। তাদের মাঝখানে বড়জোর পাঁচ -ছয় পা দূরত্ব। দূরে কোন জাহাজের বাঁশি বেজে উঠল। সাপের ফনা তুলে বয়ে আসছে নদীর ঠান্ডা বাতাস।
তূর্য বেশ বুঝতে পারছে, ঈষৎ দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো মেয়েটি। শরীরটা যেন সামান্য কেঁপে উঠল তার। তূর্যের সমস্ত শরীর যেন ভড়শূন্য হয়ে উঠেছে।
মেয়েটি ক্ষনিকের জন্য একবার ঘুরে তাকালো তূর্যের দিকে। ব্রীজের আলো এসে পড়েছে সেই মুখে। ক্ষনিকের জন্য শুধু। তূর্য স্পষ্ট দেখতে পেলো সেই কোমল মুখখানি কী অদ্ভুত রকমের শান্ত, ঢেউহীন, নির্বাক। যেন জীবনের সব প্রশ্ন – উত্তর শেষ, চাওয়া-পাওয়ার সব হিসেব যেন মিলে গেছে — আর সামান্য কিছুও বাকি নেই। যেন সুৃয়োপোকার খোলস ছেড়ে প্রজাপতি হয়ে কোথাও উড়ে যাওয়ার সময় এসেছে তার!

ক্ষনিকের ওই দৃষ্টিতে ছিল এক দুর্বোধ্য শিলালিপি। সেখানে হয়তো লেখা আছে —
” জোয়ারের সময় এখন….
তবে আর খড়কুটোর কী প্রয়োজন!”

মেয়েটি রেলিঙে পেট রেখে আরেকটু ঝুঁকল। পাদুটো ভেসে উঠলো শূন্যে। তূর্য দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখছে নিশ্চল দেবতার মতো।

হঠাৎ মেয়েটি আর নেই সেখানে। কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই “ঝপ্” করে শব্দ ছলকে উঠলো নদীর বুক থেকে। সঙ্গে সঙ্গে ছুটে গেলো তূর্য উল্টো দিকে রেলিঙের কাছে। ঠিক যেখানে মেয়েটি দাঁড়িয়ে ছিল এতক্ষণ। সে ঝুঁকে নীচে তাকাতেই দেখতে পেলো, নদীর বুকে একটা বিন্দুকে কেন্দ্র করে অস্থির ঢেউ ফুলে উঠছে চারিদিকে। রাত্রির ধ্যানভঙ্গ নক্ষত্ররাজি নিষ্পলক চেয়ে চেয়ে দেখছে কীভাবে ঝরে পড়া হলুদ পাতার মতো একটি হোলদে রঙের টপ পড়া মেয়ে এই হিমেল বাতাসে খসে পড়লো নদীর বুকে। ধীরে ধীরে গঙ্গাবক্ষের সেই আস্ফালন শান্ত হয়ে এলো। আবার নিস্তব্ধতা নেমে এলো কুন্ডলীত কুয়াশার চাদর মুড়ি দিয়ে। জলের বুকে সামান্য দাগটুকুও সম্পূর্ণ মুছে গেলো। কেউ কোনো কথা বললো না — না নদী, না আকাশ, না এই নির্জন ব্রীজ, না সে।

তারপর ঘরে ফেরার পথ ধরে হাঁটতে হাঁটতে তূর্যের কেবলই মনে হলো —
কেন বাঁধা দিলাম না আমি? পারতাম না কি ছুটে গিয়ে মেয়েটির হাত ধরে টেনে আনতে? পারতাম না তাকে একবার চিৎকার করে বলতে…. এভাবে যেও না…মরতে এমনিতেই হবে একদিন…এতো তাড়া কেন? এসো, আগে দুজন একসাথে কফি খাই…
শুধু একটা হাত হয়তো ওর কাঁধে রাখাটা দরকার ছিল। একটা সম্পূর্ণ রাত এই নির্জনে একসাথে গল্প করতে করতে হাঁটার প্রয়োজন ছিল। কিন্তু এসবের কিছুই করলাম না৷ চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইলাম। কেন? ভীতু আমি? স্বার্থপর? নার্ভাস? আত্মকেন্দ্রিক? তবে যে সবাই ভাবে আমি ভীষণ ভাল ছেলে! সৎ, চরিত্রবান, ভদ্র, শান্ত, উদার, উপকারী! সুরভি বলে আমি নাকি ওর গর্ব!
আসলে, আমি একটি ভীতু? কাপুরষ? নির্ঝঞ্ঝাট থাকার আছিলায় একজন ভীষণ সুনাম লোভী মানুষ? আজ কী করলাম আমি — খুন? হ্যা, খুনই তো! চাইলে তো বাঁচাতেই পারতাম আমি ওই জীবন – মৃত্যুর মাঝখানে ব্রীজের রেলিঙে ঝুঁকে থাকা মেয়লটিকে। কিন্তু পারলাম না। কে আটকে ধরলো আমার দুটো পা? আমার আত্মমগ্নতা? কে চেপে ধরলো আমার গলা? স্বার্থবদ্ধ ভালোমানুষি?
আমাদের মতো ভালমানুষরা নিঃশব্দে কতো হত্যা করে চলে প্রতি নিয়ত তার বিচার কোথাও হয় না! হয়তো মানুষই একমাত্র প্রাণী যে কখনো মেনে নেয় না সে নিজে যা সেটি! মানুষ দেবতার পুজো করে ফুল দিয়ে, আর অসুরের ছবি আঁকে রক্ত দিয়ে!

তূর্যের ফোনটা কিছুক্ষণ ধরে বেজেই চলেছে।
সে টেবিল থেকে মোবাইলটা তুলে দেখলো — সুরভি কলিং। তার আঙুল লাল বটমের দিকে এগিয়ে গেলো। মনে মনে ভেসে উঠলো সদ্য জন্ম নেওয়া চারটি লাইন —

” সব চরিত্র পথনাটিকার,
আমরা যাকে মহাকাব্য মানি —
যে ভীষ্ম শ্রেষ্ঠ রথি….
সেও অসহায়…সামনে শিখণ্ডিনী! ”
***************

— কি ব্যাপার তূর্য? চার দিন ধরে ফোন ধরছো না আমার?
— শুধু তোমার নয়, কারোরই ধরছি না।
— কেন, সেটা বলবে তো?
— এমনি।
— এমনি মানে? কি হয়েছে তোমার সেটাও বলছো না! জব-এও যাচ্ছো না! শরীর খারাপ কিনা সেটাও তো বলবে নাকি! What’s the matter? Say something. Speak out Turjo . Speak.
— “কথা জমে পাহাড় হতে পারে যদি
পাহাড় ভেঙে নেমে আসুক নীরবতার নদী…”
হা হা হা… বসো, সুরভী, বসো। এত অবাক হয়ে কী দেখছো? তোমায় তো বললাম, কিছুই হয় নি আমার। আচ্ছা, কিছু না হওয়াটা কী হওয়া নয়? Nothing happened to me…অথবা বলতে পারো, What happened to me is nothingness.
— কী আবোল তাবোল বকে চলেছো পাগলের মতো? are you normal?
— নর্মাল? মানে বলতে চাইছো, the average of madness? হা হা হা… আমি বুঝতে পারি না সুরভী, কেন মানুষ এত কালঘাম ছোটায় নিজেকে নর্মাল প্রমান করার জন্য?
— তবে তুমি মনে করো তুমি যেটা করছো ঠিক করছো?
— কি ঠিক, কি ভুল কে বলে দেবে সেটা? কে?

“আমরা সবাই আমাদের মতো ঠিক
আমরা সবাই নিজেদের মতো ভুল,
যে মৌমাছি মধু খায় ফুল থেকে
তারও ঠোঁটের ডগায় বিষাক্ত হুল!”

তুমি আমার সামনে দিয়ে হেঁটোনা সুরভী, আমি তোমায় অনুসরণ নাও করতে পারি। তুমি আমার পেছনেও হেঁটো না, আমি তোমায় পথ দেখাতে নাও পারি। যতক্ষণ পারো, পাশাপাশি হেঁটো। সবচেয়ে ভাল হয় যদি একাকী হাঁটতে পারো।
— কী বলতে চাইছো তুমি তূর্য? we are in a relationship. সবাই জানে আমরা বিয়ে করবো। আর তুমি আমাকে এসব কি বলছো?
— তুমি কোনদিনই হয়তো বুঝতে পারবে না আমি কি বলছি। আচ্ছা সুরভী, তুমি কোনো দিন কাউকে খুন করেছো?
— Stop it!
— বলো না…করেছো?
— না।
— সিওর? How can you be do sure of anything? ভাবো। ভাল করে ভাবো।
— What a crap! আমি কেন খুন করতে যাবো?
কাকেই বা খুন করবো?
— কেন? যখন ন্যায্য দাম না পেয়ে কোনো চাষি আত্মহত্যা করে, আমরা চুপ করে থাকি নি? যখন তোমার ঘরের কাজের মেয়েটার সদ্যজাত সন্তান অপুষ্টিতে মারা যায়, তুমি চিপ্সের প্যাকেট হাতে নিয়ে ট.ভি. দেখতে বসো না? যখন কোনো ট্রেনের হকার লাইনে কাটা পড়ে, তুমি অধৈর্য্য হয়ে বারবার হাতঘড়ি দ্যাখো না?
— এর সাথে আমার খুন করার কী সম্পর্ক?
— সম্পর্ক আছে। আমরা প্রতি মুহুর্তে হত্যা করে চলেছি নির্বিচারে। শুধু গনহত্যা নয়, কীটপতঙ্গ, পশু-প্রাণী, বন-জঙ্গল — সব আমাদের হত্যার লীলাক্ষেত্র। কিন্তু প্যারাডক্স এটাই যে আমরা জানিও না আমরা সবাই একএকজন হত্যাকারী! লুটেরা! আর আমাদের এই চুপ করে থাকাটাই হলো মার্ডার ওয়েপন।
— এর সঙ্গে আমাদের বিয়ের সম্পর্ক কী? আমি কিছুই বুঝতে পারছি না।
— উৎসবে সঙ্গী লাগে। প্রায়শ্চিত্ত করতে হয় একা। আগে দ্যাখো, আমার পাশাপাশি হাঁটতে পারো কিনা।
— তুমি আর কিছু দিন এরকম ভাবে চললে সব হারাবে, বলে রাখলাম আমি। একেবারে একা হয়ে যাবে তুমি।
— একা! আমরা একা, এটা আমাদের ট্র্যাজেডি নয় সুরভী, আমরা চাইলেও একা হতে পারি না এটাই আমাদের ট্র্যাজেডি। জীবনানন্দ কী এমনি বলেছেন?
” মাথার ভিতরে
স্বপ্ন নয় – প্রেম নয় – কোনো এক বোধ কাজ করে ।
আমি সব দেবতারে ছেড়ে
আমার প্রাণের কাছে চ’লে আসি ,
বলি আমি এই হৃদয়েরে :
সে কেন জলের মতো ঘুরে ঘুরে একা কথা কয় !”
***************


চাকরিটা ছেড়ে দিলো তূর্য। না, ছাড়বেই এমনটা ভেবে ছাড়ে নি। অ্যালার্ম ঘড়ির ডাকে সারা দিয়ে সেই সকালেই বিছানা ছেড়েছিল সে।
বাথরুম থেকে বেড়িয়ে এক কাপ চা বানিয়েও খেয়েছিল। ইস্তিরি করা প্যান্ট-সার্ট নামানোই ছিল টেবিলের ওপর। সেসব গায়ে চাপিয়ে চিরুনি হাতে নিয়ে দাঁড়িয়েছিল আয়নার সামনে। তারপর কি যেন হয়ে গেলো। তাড়াতাড়ি সেই পোশাক ছেড়ে একটা ট্র্যাকস্যুট আর ‘ Go to Hell’ লেখা লাল টিসার্ট গায়ে চাপিয়ে রওনা দিলো ব্যাঙ্কের দিকে।
—তূর্য, তুই এই ড্রেসে?
— হ্যা, কেন?
— Don’t you know the office decorum? কী হয়েছে তোর? তুই তো এমন ছিলিস না দোস্ত!
—- আরে এই ড্রেসে রিল্যাক্সড লাগছে। কাজ করতে গেলে আরামটা জরুরি। মুদি দোকানে দেখিস না দোকানদার স্যান্ডো গেঞ্জি আর লুঙ্গি পড়ে দোকানদারী করে।
— মুদি দোকান আর ব্যাঙ্ক এক হলো?
— একই হলো। ফ্যালো কড়ি, মাখো তেল!
— ইয়ার, সবাই নোটিশ করছে তোকে। এমব্যারাস্ড হচ্ছে সবাই!
— অভ্যাসের বাইরে কিছু দেখলে সবাই এমব্যারাস্ড হয়। এটাই স্বাভাবিক। American-রা প্রথম যখন জিন্স নিয়ে এলো, তখনও এমব্যারাস্ড হয়েছিল সবাই। কারণ ওটা industrial wage worker-দের ড্রেস ছিল।

( একটি মেয়ে এসে বলে)
— তূর্যদা, তোমাকে ম্যানেজার স্যার ডাকছেন তাঁর চেম্বারে।
— ok. I am coming.
………………………………………
— Good morning Mr Turjo Sengupta.
— What is good in the morning Sir? Bye the way…nice weather.
— তূর্য, কিছু দিন ধরেই তোমাকে দেখছি, তুমি মেন্টালি সুস্থ নও। Take my advice boy. Go to a psychiatrist. তুমি একজন ব্রিলিয়ান্ট ছেলে। আমরা তোমাকে হারাতে চাই না।
— Thanks Sir. আমি নিশ্চয়ই সাইকিয়াট্রিস্টের কাছে যাবো। আমি তো এতদিন জানতাম, পায়ের মাপ অনুযায়ী মানুষ জুতো পড়ে। কিন্তু বাস্তবে দেখি, জুতোর মাপে পা-কেই ঠেলে-ঠুলে ফিট করানো হয়! ফিট না হলে পা-টাই বাদ!
— তূর্য, তুমি বাস্তবকে অস্বীকার করতে পারো না। You cannot surpass the reality.
— স্যার, সূর্য কোন দিকে ওঠে?
— হোয়াট?
— জানতে চাইছি, কোন দিকে সূর্যোদয় হয়?
— কোন দিকে আবার? পূর্ব দিকে।
— গাছের পাতার রঙ কী স্যার?
— স..সবুজ!
— স্যার, আপনি সিওর?
— What do you mean?
— হা হা হা হা হা… You can’t be so sure of anything Sir.
প্রথমত, সূর্যোদয় আমরা পুব দিকে দেখি পৃথিবী থেকে। জুপিটারে পুবদিকে হয় না।
দ্বিতীয়ত, গাছের পাতার রঙ যে সবুজ দেখি, সেটা দিনের আলোয়। রাতের অন্ধকারে কালো। অনেক পশু-প্রানী সব কিছু সাদা-কালোয় দ্যাখে৷ তাদের পৃথিবীতে সবুজ নেই।
স্যার, রিয়েলিজমও সাব্জেক্টিভ। একটা ইলিউশান যেটা আপনার বিলিভ-সিস্টেমে ফিট করে গেছে৷ কোনো কিছুর ফিক্সড মিনিং নেই স্যার। every meaning is contextual.
দেখুন না স্যার, আপনি পঞ্চাশ বছর বয়েসেই বৃদ্ধ হতে চলেছেন, অথচ হাজার হাজার বছর ধরে দাঁড়িয়ে থাকা হিমালয় এখনও ইয়ং মাউন্টেন — যুবক পর্বতমালা!
— ননসেন্স! তুমি সত্যিই পাগল হয়ে গেছো৷ শোনো তূর্য, আমি তোমাকে কিছুদিনের লীভ দিচ্ছি। আশা করি তুমি সুস্থ হয়ে ফিরবে৷
— স্যার, এর চেয়ে ভাল এই লেটারটা রাখুন।
— ( চিঠির ভাঁজ খুলতে খুলতে) এটা কী?
— ইস্তফা পত্র।
— হোয়াট! তুমি জানো তুমি কী করছো?
— না। আমরা কেউই জানি না আমরা কি করছি।
— my goodness!
( দরজা বন্ধ হওয়ার শব্দ)

সুরভী আর তূর্য বসে আছে সাইকিয়াট্রিস্ট, ডঃ মুখার্জির চেম্বারে। ডক্টর মুখার্জি হাসিখুশি মানুষ। বয়স চলিশের কাছাকাছি। সুরভীর কাছে তুর্যের আনন্যাচারাল বিহেভিয়ারের কথাগুলো শুনে এবার তিনি বিপরীতে বসে থাকা তুর্যের দিকে অল্প ঝুঁকে বসলেন।
— মিস্টার সেনগুপ্ত, আমি আপনাকে তূর্য বলে ডাকতে পারি?
— আমাকে হারাধন বলেও ডাকতে পারেন। জাস্ট আগে থেকে একটু জানিয়ে দেবেন আপনি কখন কী নামে ডাকবেন, তাহলে রেসপন্স করতে সুবিধা হবে।
— না না… আপনাকে অন্য নামে ডাকবো কেন? আপনাকে তূর্যই বলবো।
— আচ্ছা।
— এবার আমি আপনার কাছে আপনার নিজের সম্পর্কে কিছু জানতে চাই।
— নিজের সম্পর্কে মানে?
— মানে, এই ধরুন, আপনার পরিচয়…আপনি কি করেন…
— ও আচ্ছা। ওই মানে ইন্টারভিউতে যেমন জিজ্ঞেস করে — ইন্ট্রডিউস ইয়োরসেল্ফ?
— সর্ট অফ।
— তার মানে তো, আমার নাম, আমার বাপ-মায়ের নাম, আমার জন্মতারিখ, আমার ঠিকানা, আমার প্রফেশন….
— সেসব দিয়েই না হয় শুরু হোক।
— কিন্তু ডঃ মুখার্জি, এসবের মধ্যে আমার পরিচয় কোথায়? এসব দিয়ে আমার নিজের সম্পর্কে আপনি জানবেন কী করে?
— বলতে চাইছেন এসব আপনার পরিচয় বহন করে না?
— হা হা হা…পরিচয়? মানুষ আধার কার্ড নয় ডাক্তারবাবু।
এই দেখুন না….আমার নাম তূর্য সেনগুপ্ত… আমি ঠিক করি নি। আমার বাবা- মাকেও আমি সিলেক্ট করি নি। আমার জন্মতারিখেও আমার কোনো হাত নেই। আমার নেশানালিটি, জাতি, ধর্ম, বর্ণ — কোনোটাতেই আমার ইচ্ছা-অনিচ্ছা জড়িয়ে নেই। এগুলোর কোনোকিছুর ওপরেই আমার কোনো চয়েস নেই। তাহলে এসব দিয়ে আমার পরিচয় পাবেন কি করে?
— আপনার প্রফেশন তো আপনার চয়েস।
— না মিস্টার মুখার্জি। Its not a choice…. its just a mere selection between three or four options…
দেখুন না, মধ্যবিত্ত সমাজে একটু লেখাপড়ায় ভাল হলে তার অপশানগুলো কী থাকে? ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, টিচার, ব্যাঙ্কার, সরকারি চাকরিজীবী, নয় তো নিজের ছোটখোটো ব্যাবসা। অথচ, একজন শিল্পপতির বাড়ির অপশানগুলো দেখুন — একটাই — নেক্সট শিল্পপতি। কখনো কোনো মুন্ডা বা সাঁওতালকে দেখেছেন ইন্ডাসট্রিয়ালিস্ট হতে? বা, টালিগঞ্জের নায়ক হতে? Our options are already given…we have to select…
— বেশ, মানলাম। আপনি তো ব্যাঙ্কের এতবড় চাকরি ছেড়ে দিয়েছেন। আপনি কী করতে চান?
— আপাততঃ বাড়ি গিয়ে ঘুমাতে চাই।
— আমি বলতে চাইছি, বেঁচে থাকতে গেলে তো রোজগার করতে হবে৷ তো আপনি কোন জীবিকা বেছে নিতে চান?
— এখনো কোনো প্ল্যান নেই। তবে ভাবছি চাষাবাস করবো?
— চাষ করবেন? কি বলছেন? are you joking? এতো শিক্ষিত হয়ে….
— কেন? আপনি শিক্ষিত হয়ে ডাক্তার হতে পারেন,আর আমি লেখা পড়া করে চাষ করতে পারি না?
— ডাক্তার হওয়া আর চাষি হওয়া কী একই হলো?
— কখনোই এক নয়। আপনি কী মনে করেন চাষিরা শিক্ষিত নয়?
— What rubbish!
— আপনি জানেন কখন ধান রুইতে হয়? আপনি জানেন কিভাবে বীজ ছড়াতে হয় মাটিতে? ডঃ মুখার্জি, ওরা জল-কাদা মেখে থাকে, আর আপনারা যখন রক্ত-পুঁজ হাতে মাখেন তখন কোনো সমস্যা নেই? ওরা মাটির ঘরে থাকে, ওরা গরীব৷ সেটার দায় তো তাদের নয়, আপনাদের- আমাদের। আমরা উচিৎ দাম দিই না, তাই… আপনি চিকিৎসা করে যদি টাকা না পেতেন, তবে আপনার পেশার কোনো মূল্য থাকতো কারোর কাছে ?
ডক্টর, একটা জাতির সাস্থ্য তাদের ডাক্তারদের ওপর নির্ভর করে না, করে সে দেশের চাষিদের ওপর।
— ( সুরভী) তুমি চুপ করবে? কিছু দিন ধরেই কীসব অদ্ভুত কথাবার্তা বলতে শুরু করেছো। আমার নিজের লাইফে এখন কী আছে জানি না!
— ( তুর্য) আমরা কেউই জানি না। তো এই নিয়ে এত দুশ্চিন্তা করছো কেন?
— ( সুরভী) ডাক্তারবাবু, আপনি কী বুঝলেন? ও ঠিক হয়ে যাবে তো?
— নিশ্চয়ই। সময় লাগবে। আমি মেডিসিন দিয়ে দিচ্ছি।
— ( তুর্য) হা হা হা হা হা…. মেডিসিন! ওকে, দিন ডক্টর। ওঝার কাছে গেলে যেমন জলপোড়া না দিলে মান থাকে না, ডাক্তার যদি প্রেসক্রিপশনে ওষুধ না লেখে তাহলে কী ক্রেডিবিলিটি থাকে! লিখুন লিখুন, ওষুধ লিখুন৷ হা হা হা…
***************

” ইন্দ্রপ্রস্থ তৈরি হবে
খান্ডব বনে জ্বলছে আগুন আজও…
সব হত্যা খুন নয়!
মঞ্চে আবার নকল রাজা সাজো!

পাশার ঘুঁটি একপা – দুপা
এগিয়ে যায় যুদ্ধের ময়দানে…
সব হত্যা খুন নয় —
গান্ডীব তোলো ধর্মের ফাংশানে। ”

লেখার পুরোনো ডায়েরিটার পাতা ওল্টাতে ওল্টাতে এই লেখাটায় চোখ যেতেই থামলো তূর্য। একটু অবাক হয়ে ভাবলো — একবছর আগে লিখেছিলাম কবিতার এই লাইনগুলো! তখন তো দু-চোখে স্বপ্ন ছিল, কেরিয়ারে আরও উন্নতি করবো, বড় বাড়ি বানাবো সল্টলেকে, সুরভীকে বিয়ে করে টোটাল গৃহস্থ জীবন। তখন কী ভাবে লিখলাম আমি এই লাইনগুলো! কী বুঝতাম আমি তখন?
তারপরক্ষনেই মনে হলো, আমরা কি কিছু নিজে লিখি! কেউ যেন হাত ধরে লিখিয়ে নেয়! যারা বোঝে তারা লেখে না, যারা লেখে তারা বোঝে না; যারা ভাবে তারা বলে না, যারা বলে তারা ভাবে না; যারা দ্যাখে তারা খোঁজে না, যারা খোঁজে তারা দ্যাখে না….
আমাদের একটাই স্বাশ্বত সঞ্চয় — ভয়। আমরা ভীতু বলে চরিত্রবান, ভীতু বলে যুদ্ধ করি, ভীতু বলে কাব্য লিখি, ভিতু বলে অন্য মানুষের হাত খুঁজি। মানুষ কী আজকাল বড় বেশি সাহসী হয়ে উঠেছে?
আমার কী সাহস হয় নি সেই রাতে ব্রীজের ওপর ঠায় দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে একটা মেয়ের আত্মহত্যা দেখার?

তূর্য আস্তে আস্তে এগিয়ে গেলো তার দেয়ালে ঝোলানো ক্যালেন্ডারটার দিকে। হাতে তুলে নিলো টেবিলের ওপর রাখা কলমটা। দুটো চোখ তার পাথরের মতো স্থির। ঠোঁটের কোনে একটা বাঁকা হাসি।
**************
( দরজায় কড়া নাড়ার শব্দ)
— তূর্য! তূর্য!
— এসো সুরভী। ভেতরে এসো।
( দরজা খোলার শব্দ)
— তুমি এটা কি করে করতে পারলে তূর্য?
— কেন? কী করলাম আবার?
— তুমি জানো না তুমি কী করেছো? আজ আমার জন্মদিন…তুমি একটা কল করে উইশ টুকু করলে না! ( কাঁদো কাঁদো গলায়)
— আজ কিভাবে তোমার জন্মদিন? ( সুরভীর কান্নার শব্দ)
আচ্ছা আচ্ছা….হ্যাপি বার্থ ডে।
— থাক, উইশ করতে হবে না তোমায়।
— আহা এত চটছো কেন? ঠিক আছে, এর মধ্যে একদিন আমি তোমার বার্থডে পালন করবো।
— এর মধ্যে একদিন মানে? অন্য কোনো দিনে আমার বার্থডে পালন করবে?
— হ্যা। তো কি হয়েছে? তুমি সিওর আজ তোমার জন্মদিন?
— না সিওর হওয়ার কি আছে?
— দাঁড়াও দাঁড়াও…আমি একটু ক্লিয়ার হয়ে নিই। ঠিক কোন দিনটা তোমার জন্মদিন? তোমার বডি যেদিন ভূমিষ্ট হয়েছিল?
— যতদূর জানি, সেই দিনকেই জন্মদিন বলে।
— কেন বলে? তোমার জন্ম তো অনেক আগেই হয়েছিল! মায়ের গর্ভে থাকার সময় তো তুমি নিষ্প্রাণ ছিলে না৷ সেদিক থেকে তোমার জন্মমূহুর্ত হলো সেই সময়টা যেই মুহুর্তটায় লক্ষ লক্ষ বীর্যের মধ্যে কোনো একটি বীর্য ডিম্বাণু স্পর্শ করেছিল৷ সেটা ক্যালেন্ডারের কোন দিন তোমার জানা আছে?
— কেন, তোমার ক্যালেন্ডারে এসব দিনে রেড মার্ক দেওয়া আছে?
— না না…আমার ক্যালেন্ডারে তো কোনো রেড মার্কই নেই…ওই দ্যাখো…

তূর্য তার দেয়ালে ঝোলানো একটা ক্যালেন্ডারের দিকে তর্জনী তুলে ইশারা করলো। সুরভী সেই ক্যালেন্ডারের দিকে তাকাতেই ভ্রু কুঁচকে গেলো। সে বিছানা থেকে উঠে এগিয়ে গেলো সেদিকে।

— এটা কী তূর্য?
— কেন? আমার ক্যালেন্ডার। ব্যাঙ্কের দেওয়া ক্যালেন্ডারের উল্টোদিকের সাদা পিঠে নিজে হাতে বানিয়েছি। দ্যাখো, ঠিক হয়েছে না? তোমাকেও একটা বানিয়ে দেবো।

সুরভী দেখলো, তূর্যের আঁকা সেই ক্যালেন্ডারে সব খোপে “শূন্য ” সংখ্যা বসানো। সোম থেকে রবি — কোনো বারের উল্লেখ নেই, কোনো মাসের বিভাজন নেই, কোনো সাল — তারিখ লেখা নেই।
শুধু খোপের পর খোপ জুড়ে কেবল ‘ শূন্য ‘! একটা খোপের রঙ সাদা, অন্যটার রঙ কালো। দাবার বোর্ডের মতো।
— এসব কী তূর্য?
— বুঝলে না? আরে এতদিন লক্ষ্যই করি নি যে এক থেকে একত্রিশ পর্যন্ত দিনের সংখ্যা লেখা থাকে। অথচ, শূন্যটাই নেই! আর্যভট্ট যে এত বড় একটা আবিষ্কার করেছিলেন তার কোনো প্রয়োগ হলো না এখানে? তাই শূন্যটা বসিয়ে দিলাম। তার পর ‘এক’ সংখ্যা লিখতে গিয়ে ভাবলাম, ০ -র পরে ১ যে আসবেই তার তো কোনো মানে নেই! সময় দশমিকেও এগাতে পারে, তাই না? ভেবে চিন্তে শূণ্যই বসালাম আবার। আমরা সবাই তো মহাশূন্যের মধ্যেই!
— ও মাই গড!
— কেমন হলো? ব্যাপক না? তার পর দ্যাখো, সপ্তাহ, মাস — এসবের মনগড়া ভাগ করে ব্যাপারটা জটিল করি নি৷ সব দিনই এক — কী তফাৎ আছে? সব রিপিটেশন। ওই সাদা-কালো রঙদুটো দিয়েছি দিন আর রাত বোঝাতে। তবে গোধূলি আর ঊষার সময়টাকে কী রঙ দিয়ে কিভাবে সেট করবো একটু ভাবতে হবে।
— কে তোমায় দায়িত্ব দিয়েছে নিজের মতো এমন অদ্ভুত ক্যালেন্ডার বানাতে?
— আরে চটছো কেন? নিউটনকেই বা কে দায়িত্ব দিয়েছিল গ্র্যাভিটেশান আবিষ্কার করতে? ক্যালেন্ডার তো মানুষই বানিয়েছে, এলিয়েন এসে তো বানিয়ে দেয় নি। আমি আমার মতো মডিফাই করলাম!
— জাস্ট ইম্পসিবল!
একি! তোমার দেয়ালঘড়ির কাটাগুলো কোথায়?
— খুলে দিয়েছি।
— But why???
— অনন্ত কালকে ওই তিনটে কাটায় বেঁধে রাখার কোনো মানেই হয় না৷
— তবে সময় বুঝবো কী করে?
— বস্তুর সাথে সেই বস্তুর ছায়াটাও দেখো। সময় আমাদের সবার সাথেই ছায়া হয়ে ঘুরে বেরাচ্ছে।
— তুমি কী পাগল? ঘড়ি আছে, তার কাঁটা নেই। ক্যালেন্ডার বানিয়েছো — তাতে সব শূন্য!
— আরে তুমি শূণ্যকে এত নেগেটিভভাবে দেখছো কেন? যদিও এতে তোমার দোষ নেই। পাশ্চাত্যে
‘ জিরো’ মানেই গোল্লা! নাথিংনেস! ফাঁকা!
কিন্তু সুরভী, আমাদের আদি সভ্যতায় তা নয়।
‘ জিরো’ আর ‘ শূন্য’– দুটোরই চিহ্ন গোলাকার বৃত্ত হলেও সাহেবদের কাছে ‘ জিরো’ মানে ‘ নাথিং’, কিন্তু আমাদের সংস্কৃতিতে ‘ শূন্য ‘ হলো
‘ এভরিথিং ‘ — ইটারনিটি — সাম টোটাল অফ পার্টস নয় — আ কমপ্লিট হোল! এর কোনো যোগ নেই, বিয়োগ নেই, গুন নেই, ভাগ নেই — সব সংখ্যার অঙ্কুর, সব সংখ্যার সমাধি! প্রাচীন ঋষিদের ভাষায় ” পরমব্রহ্ম “।

সুরভীর দুচোখ দিয়ে যেন আগুন বেরিয়ে এলো। রাগে দুটো ঠোঁট কেঁপে উঠল। কিছুক্ষণ ঠায় দাঁড়িয়ে রইল তূর্যের দিকে চেয়ে। তারপর এক দৌড়ে দরজা দিয়ে বেরিয়ে গেলো।
তূর্য এগিয়ে গিয়ে দরজাটা বন্ধ করে চুপচাপ চেয়ারে এসে বসলো।
দুচোখ বুজে ফেলতেই কিসের এক দুর্বোধ্য ঘোরে মুখ দিয়ে অস্ফুটে বেরিয়ে এলো কয়েকটি লাইন —
” যজ্ঞ – কুন্ডে জন্মেছিলে তুমি যজ্ঞসেনী —
সে আগুনে কান্না নেই —
লেলিহান রক্ত বিলাসিনী…..
মুক্তকেশের গহন বনে
বিলীন যত শাস্ত্রের বই —
কান্না নেই — আছে কেবল এক বক্ষ ঘৃণা,
পঞ্চভাগে টুকরো হৃদয়
শত যুদ্ধেও জোড়া গেলো না! ”


***************
— অতনু, আমার হাতে আর কিছু নেই রে৷ সব শেষ হয়ে যাচ্ছে। তূর্যের মাথায় যে কী ভূত চাপলো বুঝতে পারছি না।
— সুরভী, আমি এটা বুঝতে পারছি, কোনো একটা সক-এ ওর কোনো সাইকিয়াট্রিক ডিসওর্ডার হয়েছে। ও নিজের একটা জগৎ তৈরি করে ফেলেছে। সেখানে ওর নিজস্ব কোড অফ কন্ডাক্ট। মনে হচ্ছে তোর আরও একটু সময় দেওয়া দরকার।

পিছন থেকে সমীর এসে চেয়ার টেনে বসে।
— ( সমীর) কি সময় দিবি আর তোরা? জানিস এই দুদিন ধরে ও কী করছে?
— ( সুরভী) কেন? ও আবার কী করলো?
— ( সমীর) আর বলিস না। দুদিন ধরে দেখছি তূর্য এদিক – ওদিক হন্যে হয়ে ঘুরে বেরাচ্ছে। জিজ্ঞেস করলাম — ব্যাপার কী? বললো — বাড়িরা ও মডগেজ রাখছে৷ কারণ জানতে চাইতে ও বললো, দরকার আছে। গ্রামে যেতে হবে।
— ( অতনু) গ্রামে যেতে হবে? কেন? ও কী করতে চাইছে কিছুই বোঝা যাচ্ছে না৷
— ( সমীর) আরও আশ্চর্যের ব্যাপার হলো, ও ঘরে ঘরে গিয়ে ভিক্ষা করছে। সর্ব নিম্ন একটাকা। তারপর যে যা দেয়।
— ( সুরভী) ভিক্ষা করছে? তূর্য ভিক্ষা করছে?
— ( সমীর) আমার কাছেও কৌটো পাতলো। জিজ্ঞেস করাতে বললো —
” সমীর, তোরা ভিক্ষাকে এতো হীন চোখে দেখিস কেন? পাশ্চাত্যে ভিক্ষাবৃত্তিকে হীন ভাবে দেখানো হয়েছে ঠিকই, কিন্তু ভেবে দ্যাখ, আমাদের দেশের প্রাচীন ঋষিরা ভিক্ষা করেই দিনযাপন করতেন। এমন কী বড় বড় নাম করা বৌদ্ধ ভিক্ষুদের কথাও শোনা যায়। পুরাণে আছে, আমাদের শিবও কাশীতে ভিক্ষা করেছেন। এমনকি তার বউ অন্নপূর্ণার থেকে ভিক্ষা নিয়েছেন। তিনিই কিনা কাশী-বিশ্বনাথ!
আমি বললাম — তূর্য, তোর আত্মসম্মান নষ্ট হচ্ছে না এতে?
— আত্মসম্মান? হা হা…আমাদের পরের জিনিস লুট করতে আত্মসম্মান যায় না…আর ভিক্ষা করলে চলে যায়? মহাপ্রভু ভিক্ষা করাতে কী তার সম্মান নষ্ট হয়ে গেছে?
— পরের জিনিস লুট মানে? কী আবার লুট করলাম?
— কতো উদাহরণ দেবো বল তো? আচ্ছা, একটা সাধারণ এক্সামপেল দিচ্ছি। ছোটবেলায় রচনায় লিখতিস? — Cow gives us milk…
বইয়েও লেখা থাকে।
— হ্যা, লিখেছি তো! এতে প্রবলেমটা কী?
— এখানেই তো সমস্যা, যে কোনো প্রবলেমই নেই। কেন, we plunder milk from cow লিখলে কী প্রেসটিজে লাগে?

সুরভী টেবিলে একটা চাপর দিয়ে উঠে দাঁড়ালো।
— আর নয়। অনেক হয়েছে। আমি আজই ওর সাথে একটা এসপারওসপার করবো।
**************

নন্দনের পেছনের দিকে একটা ফাঁকা বেঞ্চে বসে আছে তূর্য। পরনে নীল রঙের একটি পাঞ্জাবি আর আকাশী জিন্সের প্যান্ট। কাঁধে একটা ঝোলা ব্যাগ। সুরভীর জন্য অপেক্ষা করছে সে। অনেকদিন পর তার এদিকে আসা। আগে প্রায় সময়ে সিনেমা – থিয়েটার, বা বন্ধুদের সাথে আড্ডা দিতে চলে আসতো এখানে। এই নন্দন- রবীন্দসদন- অ্যাকাডেমি-শিশির মঞ্চ — মোহরকুঞ্জ; সামান্য এগোলেই একদিকে ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল, আরেকদিকে সেন্টপল্স ক্যাথিড্রাল — বিড়লা প্ল্যানেটোরিয়াম ; উল্টো দিকে বিখ্যাত গড়ের মাঠ — এই হলো তিলোত্তমা কলকাতার প্রানভোমরা! The Cultural Capital of Indian–র হৃদয়! এখানে লোকজন আসে, চা-স্ন্যাক্স খায়, ধোঁয়া ওড়ায়, ঋত্বিক ঘটক বা স্পিলবার্গ নিয়ে কথার পিঠে কথা সেলাই করে; এখানে আসতে হলে দেশ-কাল-সমাজ-সাহিত্য নিয়ে বেশ কিছু ইনফরমেশন ডেটাবেস মগজের মধ্যে রেডি রাখা খুবই জরুরি। এদেরই চোখ,মুখ, হাত, পা — সেসবের বিচিত্র ভঙ্গিতে নড়াচড়া দেখছিল তূর্য এতক্ষণ ধরে গাছের তলায় বসে। লিফলেট ফেরি করা ছেলেগুলোর দৌলতে ইতিমধ্যেই চার-পাঁচটা ছোট-বড় লিফলেট হাতে উঠে এসেছে। একখানা তো সান্ধ্য সাহিত্যপত্রিকা। একজন দিদিকে দেখা যায় প্রায় পনেরো বছর ধরে এখানে সে ঘুরে ঘুরে বিক্রি করে। কত ধরনের লেখা তাতে — ” উত্তমের সিনেমা, সিনেমার উত্তম “; ” নাটকের নবনির্মান নিয়ে সাম্প্রতিক ভাবনা”; ” রবীন্দ্রনাথের প্রেতচর্চা”… আরও কতো! সেই সব পত্রিকা, লিফলেটগুলো খুবই নিপুণভাবে সেডহীন বেঞ্চ থেকে বা গাছতলার গোল বেদীগুলোর ওপর পড়ে থাকা পক্ষীবিষ্ঠা বা, ধুলো-বালি অনায়াসে নিজের কাগুজে শরীর দিয়ে ঢেকে দিতে পারে। জনগনও সেই জ্ঞানগর্ভ কাগজগুলোকে নিরুপদ্রবে পশ্চাৎদেশে রেখে ঘন্টার পর ঘন্টা
” নবনাট্য ভাবনা” বা ” ঋতুপর্ণের ক্যামেরাদৃষ্টি” নিয়ে আলোচনা মনোনিবেশ করতে পারেন। যুগটাই তো মাল্টিপার্পাসের যুগ!

এই মহাকাব্যিক ও অতিনাটুকে আবহাওয়ায় তূর্যের মনের দু-চারটে কবিতার লাইন ভেসে এলো। সেটাই গুন গুন করে সুর দিয়ে গাইছিল —

” হাতফাইলে বাওডেটা, শরীরময় ক্রসিনের ঘ্রাণ,
রকে বসে মহাদেব সৃজনশীল গাঁজায় দেন টান;
শহরজুড়ে গুজব ওড়ে,ইউটিউবে নানা রেসিপি
‘খুঁড়োর কল’ বানিয়ে দিয়ে বিশ্বকর্মা দারুণ হ্যাপি
রেশনে দিচ্ছে বিজ্ঞাপন,চাঁদ বন্দী বাতাসার
কৌটোয়
চায়ের প্লেটে ব্রহ্মান্ড জলখাবারের অমলেট-ও হয়!”

লাইনগুলো মনের ব্ল্যাকবোর্ডে ভেসে উঠতেই আপন মনে হা হা করে হেসে উঠল তূর্য।

— তুমি পাগলের মতো হাসছো কেন?
— আরে সুরভী… এসে গেছো?
— তুমি নাকি ভিক্ষা করছো আজকাল?
— এই একটা ভাল কথা মনে করিয়েছো। এই কৌটোয় যা পারো ওই ফাঁক দিয়ে গলিয়ে দাও। সর্বনিম্ন এক টাকা।
— I can’t believe it. What does it mean?
— এটা তো তোমার পার্টিসিপেশনের জন্য চাইলাম।
— কিসের পার্টিসিপেশান?
— এই শহরের চারিদিকে কতো গ্রাম আছে যেখানে কোনো হাসপাতাল নেই। মানুষ চিকিৎসা পায় না। শহরের হাসপাতালে নিয়ে আসতে আসতেই যমরাজ সেই রুগির প্রজন্মের নতুন ঠিকানা সেট করে ফ্যালে৷ সেরকমই একটা গ্রামে এই টাকায় হাসপাতাল বানাবো। ছোটখাটো ভাবে বানাতেও মোটামুটি এক কোটি লাগবে ধরে রেখেছি৷
— তুমি আর কোনো কাজ পাওনি? এক কটি টাকা চাঁদা তুলে জোগাড় করবে?
— সিম্পল স্ট্যাটিস্টিক্স। এককোটি মানুষের কাছে যাবো। সবাই এক টাকা করে দিলে এনাফ! তাদের নাম, ঠিকানা এই ডায়েরিতে নোট করে নিয়েছি। তারাও সেই হাসপাতালের অংশিদার। ন্যুনতম খরচায় চিকিৎসা পাবে।
— একটা হাসপাতালেই সব সমস্যা মিটে যাবে?
— না, সব সমস্যা মিটবে না। এক-আধটি লোকের তো সমস্যা মিটবে। সেটাই হোক।
রাস্তায় নামো বন্ধু, রাস্তাই একমাত্র রাস্তা!
— আমার এখনও বিশ্বাস হচ্ছে না। এসব করার দায় কি শুধু তোমার? এসব কী কারোর একার কাজ?
— আমি পিকনিক করছি না যে সবাইকে নিয়ে করতে হবে। আর কি জানো, every body’s work is nobody’s work….
— তুমি এসব নিয়েই থাকবে? আমাদের ভবিষ্যতের কথা একবারও ভাববে না?
— আমি যা করছি আমাদের ভবিষ্যতের কথা ভেবেই করছি। আমি চাই আমাদের সন্তান একটু সুস্থ মাটিতে জন্ম নিক।
— বুঝেছি। চললাম আমি। হয়তো আজকের পর থেকে আর কোনো যোগাযোগ থাকবে না তোমার সাথে আমার। ভাল থেকো। বাই।
— ওঃ…হঠাৎ যদি কোথাও কোনোভাবে দেখা হয়ে যায়… মানে বলা তো যায় না…তখন কি আমি নিজে থেকে তোমার সাথে দু-একটি কথা বলবো, নাকি চোখ সরিয়ে অচেনার ভান করে চলে যাবো?
— তোমার যা ইচ্ছে। আশা করবো যেন দেখা না হয়! আর এই নাও আমার একটাকা।
( কৌটোয় পয়সা ফেলার শব্দ হলো)
— থ্যাঙ্ক ইউ।
— বাই….
( সুরভী গটগট করে হেঁটে চলে গেলো)

নন্দনের সান্ধ্য আলোয় তূর্য স্পষ্ট দেখতে পেলো কিছু দূরেই একটা ছাতিম গাছের নীচে দাঁড়িয়ে আছে হলুদ টপ পড়া সেই মেয়েটি। কী করুন তার দৃষ্টি। চুল দিয়ে জল গড়িয়ে পরছে। সারা শরীর সিক্ত। কোত্থেকে গঙ্গার স্নিগ্ধ বাতাস এসে লাগলো তূর্যের চোখে মুখে। ঘোর কাটতেই দেখতে পেলো সেই ছাতিম গাছের তলাটা সম্পূর্ণ ফাঁকা। কেউ নেই!
আরে কী ওটা? চকচক করছে!
সে এগিয়ে যেতেই দেখতে পেলো, সেই গাছটার বেদীর ওপর পড়ে আছে একটা একটাকার কয়েন!


( রাস্তায় ট্র্যাফিকের শব্দ)
— তূর্য! অ্যাই তূর্য!
— আরে সমীর যে!
— কেমন আছিস?
— কেন বলবো?
— অ্যা..
— ছাড়। এখন ব্যাস্ত আছি মাইরি। পরে কথা হবে৷
— ব্যাস্ত মানে? অতীনের বাড়ি যাবি না?
— অতীনের বাড়ি? কেন?
— তুই খবর পাসনি? ওর বাবা মারা গেছে তো কাল৷
— ও..তাই?
— যাঃ বাবা…একজনের বাবা মারা গেছে সেই খবর শুনে এমন ভাব করলি যেন আমি বললাম, ওর বাড়িতে কারেন্ট চলে গেছে!
— মানুষ মারা যাওয়ার চেয়ে কলকাতায় ওই সব বড়লোকের পাড়ায় ইলেক্ট্রিক যাওয়াটাই বেশি আশ্চর্যের নয় কী?
— তোর আবার সেই গোলমেলে কথা! বাদ দে। এখন চল আমার সাথে অতীনের বাড়ি। আমি ওখানেই যাচ্ছিলাম। এতোক্ষণে বডি চলে এসেছে বোধ হয়।
— ওখানে বডি’র সাথে দেখা করে কী হবে? জ্যাঠামশাইয়ের সাথে তো আর দেখা হবে না।
— আরে আমি জেঠুর ডেডবডির কথাই বলছি। তোকে তো খুব ভালবাসতো। শেষ বারের জন্য দেখা করবি না?
— জেঠুর ডেডবডি আমাকে দেখে নিশ্চই খুব খুশি হবেন, তাই না?
— ভাট বকিস না। চল তো….
………………

সমীর আর তূর্য গেট খুলে ঘরের ভেতরে এসে দাঁড়ালো। ড্রয়িংরুমের মাঝখানে সাদা কাপড়ে ঢাকা অবস্থায় শোয়ানো আছে ধূর্জটিপ্রসাদ ভট্টাচার্যের নিষ্প্রাণ দেহ। নাকের দুটি ছিদ্রে তুলো গোঁজা; দুটি বন্ধ চোখের ওপর তুলসীপাতা। বুকের ওপর সাদা সাদা ফুলের স্তুপ। মাথার কাছে একগুচ্ছ ধূপকাঠি ধরানো। পালা করে করে কেঁদে চলেছে সেই দেহ ঘিরে থাকা আবালবৃদ্ধবনিতা। ঘরের এক কোনে মুখ ব্যাজার করে দাঁড়িয়ে আছে অতীন। এক বৃদ্ধা অতীনের মাথায় হাত বোলাতে বোলাতে কাঁদছে আর বলে যাচ্ছে….. সবই কপাল! কার যে কখন ডাক আসে! হায় ভগবান! ছেলেটা মা গেছিলো সেই কোন কালে, আজ বাপটাও চলে গেলো! ভগবান যখন নিলোই, আমায় নিলো না কেন? পোড়া কপাল…..

তূর্য সমীরের কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিস করে বললো — দোস্ত, ওই বুড়িটি কে? ওই যে অতীনকে আদর করছে আর ভ্যা ভ্যা করে কাঁদছে….চোখে সোনালি ফ্রেমের চশমা… এই বয়েসেও গায়ের চামড়ায় CFL ল্যাম্প জ্বলছে!
— আরে, উনি তো অতীনের পিসিমা। কানাডায় মেয়ের সাথে থাকে। সঙ্গে জামাই। বিশাল বড়লোক।
— সে কি রে! অতীনের বাপের যখন চাকরি চলে গেলো, অতীন টিউশনি করে কলেজের খরচা চালাতো, তখন কোথায় ছিল রে এই CFL পিসিমা?
— আরে কোনোকালেই খোঁজ খবর রাখতো না।
— তাহলে ওমন মরাকান্না কাঁদছে কেন?
— মরাবাড়িতে এসে ওরকম কাঁদতে হয়।
— ও আচ্ছা, এটাও ম্যানার্স, সেটা বলবি তো! দাঁড়া, অতীনের কাছে যাই। তুই এই ফাঁকে একটু কেঁদে নে।

— ( তূর্য) পিসিমা, ভাল আছেন?

তূর্য হাসি-হাসি মুখ নিয়ে হাতজোড় করে সামান্য ঝুৃঁকে যথাসম্ভব বিনয়ের সাথে প্রশ্নটা করে পিটপিট করে চেয়ে আছে পিসিমার দিকে।
পিসিমা কান্না থামিয়ে তূর্যের দিকে কেমন একটা বিরক্তি সহকারে তাকালো। ইতিমধ্যে অতীনও সোজা হয়ে বসে কেমন হতভম্ব হয়ে এদিকে-ওদিক তাকাচ্ছে।

— পিসিমা আমি কপাল দেখে ভাগ্য বলতে পারি। আপনাকে কানে কানে একটা কথা জানানোর ছিল।
— কি কথা?
— বলছি বলছি…
তূর্য পিসিমার কানের কাছে মুখ নিয়ে গিয়ে ফিসফিস করে বললো…
— পিসিমা, আমি জ্যাঠামশাইয়ের ভাগ্যগননা করেছিলাম। যে সময় মারা গেছেন তিনি, তখন রাহু আর কেতু দু’জনেই শনির পাশে হাত ধরাধরি করে দাঁড়িয়েছিল। খুব বিপদ!
— কেন? এতে বিপদের কী আছে?
— কি আছে মানে! সাঙ্ঘাতিক ব্যাপার। ওনার আত্মা এত চট করে মুক্তি পাবে না। আমি পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছি, জ্যাঠামশাইয়ের প্রেতাত্মা ওইখানে দাঁড়িয়ে আপনার দিকে ড্যাবড্যাব করে চেয়ে আছে।
— আমার সাথে ছ্যাবলামো হচ্ছে!
— আমি এমন মরার ঘরে এসে ছ্যাবলামো মারবো? আমি কী পাগল? ভাল কথা যখন শুনবেন না, তখন চললাম।
— আরে না না বাবা… ঘাট হয়েছে.. বলো বাবা..দাদা আমার দিকে কেন চেয়ে আছে?
— আপনি একটু আগেই ওরকম করে কাঁদছিলেন না! আমি ওদিকে দাঁড়িয়ে স্পষ্ট শুনলাম, জ্যাঠা মশাইয়ের ভূত বললো — আহা রে.. বোনটি আমার এত কষ্ট পাচ্ছে! কালই ওকে নিয়ে যাবো। একা একা ভাল লাগে না। বোনটি থাকলে সুবিধা হবে!
— অ্যা…!!!
— তো কাল কী আপনি যাবেন ওনার সাথে?
— কো..কো..কোথায়?
— প্রেতলোকে।
— না বাবা…বালাই শাট…তুমি কিছু একটা করো বাবা..
— উমমম..এতো সোজা নয়। তাও আমি চেষ্টা করছি। তবে আপনি এমন করে কাঁদবেন না। বরং উনি যদি দেখেন যে আপনি অতীনকে হেল্প করছেন তাহলে মনে হচ্ছে আপনাকে নেবে না।
— একদম বাবা.. আমি অতীনকে একটা ফ্ল্যাট কিনে দেবো।
— না না…ওসবের দরকার নেই। মাঝে মাঝে খোদ খবর নেবেন। সুবিধা-অসুবিধায় থাকলেই হবে। আর একটা কাজ করতে হবে।
— কী বাবা?
— শ্রাদ্ধ হয়ে গেলে এক মাস টানা কিছু পূণ্য অর্জন করতে হবে। তাহলে প্রেতলোকে আর চাইলেও উনি আপনাকে নিয়ে যেতে পারবেন না। সাবস্টিটিউট হিসাবে বৈকুন্ঠ লোকে সীট রিসার্ভ করে রাখাটা জরুরি।
— ঠিক বলেছো বাবা। কীভাবে পূণ্য করবো?
— বেশি কিছু না। আপনি বরং আপনার দাদার নামে একটা স্কলারশিপ রেডি করে দশ কুড়িটা মেধাবী বাচ্চাদের পড়াশোনার দায়িত্ব নিন। আর একমাস দুইবেলা গরীবভোজন করান। এতেই হবে৷
— সে তো খরচ অনেক…
— সেও ঠিক। থাক, এমনিতেই বয়স হয়েছে। দাদার সাথে প্রেতলোকে গেলেই বা কী?
— না না বাবা…যা বলেছো তাই হবে। একমাস সেরকমই করবো।
— আচ্ছা। তবে এখন কিন্তু কান্নাকাটি করতে যাবেন না। ‘ যা হয় ভালোর জন্যই হয়’ বলে চলে যান নিজের ঘরে। নজর যখন আপনার ওপর পড়েছে…বেকার রিস্ক নিয়ে….
— ঠিক কথা বাবা! ঠিক কথা! এক্ষুনি যাচ্ছি…

পিসিমা হঠাৎ উঠে দাঁড়িয়ে সবাইকে চমকে দিয়ে,
” যা হয় ভালোর জন্য হয়…যা হয় ভালোর জন্য হয়…” বলতে বলতে দ্রুত পায়ে বেরিয়ে গেলেন ঘর থেকে।

সবার চোখ তখন তূর্যের দিকে। সমীর ছুটে এসে তার পাশে হাত ধরে দাঁড়িয়েছে। অতীন চোখে মুখে আতঙ্ক মিশ্রিত বিস্ময়।

তূর্যের কোনোদিকেই তেমন একটা ভ্রুক্ষেপ নেই।
সে অবলীলায় মেঝেতে শায়িত জ্যাঠামশাইয়ের মৃতদহের সামনে হাঁটু মুড়ে বসে বুকের ওপর থেকে ফুলগুলো সরাতে লাগলো।
এবার অতীন ভাঙা গলায় বিস্ময়ের সাথে গর্জে উঠলো — এই তুর্য, কি করছিস?
ততক্ষনে সবাই প্রায় কান্না থামিয়ে তূর্যকে দেখছে। তূর্য অতীনের দিকে তাকিয়ে অত্যন্ত স্বাভাবিকভাবে বললো —
— এত ফুলের ভাড়ে জ্যাঠামশাইের বডি চ্যাপটা হয়ে যাবে৷ জীবনকালে তো এতো ফুল কোনো দিন পান নি বোধ হয়! বাই দ্যা ওয়ে, আমি ওনার জামার পকেট-টা খুঁজছিলাম। ফুলে ঢাকা পড়ে গিয়েছিল।
—- ( সমীর) চুপ কর তূর্য।
—- ( অতীন) পকেট দিয়ে কী করবি?
—- ( তূর্য) তোর এখানে এলেই বরাবর জ্যাঠামশাইয়ের জন্য সিগারেট আনতাম। আমাদের সিক্রেট ডীল ছিল৷ এসেই চুপচাপ পকেটে ঢুকিয়ে দিতাম। তাই ভাবলাম, এতদিন সিগারেট দিয়েছি, আজ বেকার ফুল এনে কী হবে ? তাই এটাই নিয়ে এলাম।

তূর্য ব্যাগ থেকে একটা সিগারেটের প্যাকেট বের করে জ্যাঠামশাইয়ের বুক পকেটে ঢুকিয়ে দিলেন। সঙ্গে একটা আস্ত দেশলাই।

এসব দেখে অতীনের সুন্দরী স্ত্রী ঝংকার দিয়ে উঠলো…
—- এটা কীরকম অসভ্যতা! মানুষটা মারা গেছে, আর আপনি এভাবে ওনাকে অপমান করছেন?
— ( তূর্য) উনি মারা গেছেন? কবে?
— ( অতীনের স্ত্রী) আপনি কী পাগল? আপনি জানেন না উনি কাল রাতে স্ট্রোকে মারা গেছেন?
— ( তূর্য) না, জানতাম না তো! আশ্চর্য! আমি তো জানতাম, উনি দুবছর আগে সেই দিনই মারা গেছিলেন যেদিন নিজের সুখের জন্য একটা কাজের লোকের ভরসায় রেখে তোমরা ওনাকে ছেড়ে নিউটাউনে নতুন ফ্ল্যাটে চলে গেছিলে।
শোন অতীন, তোর বাবা তো মারা গেছে…ওনার এখন কোনো কিছুরই বোধহয় দরকার নেই…. তুই বরং সিগারেটটা খেয়ে নিস। বাই।
( তূর্যের চলে যাওয়ার শব্দ। ব্যাকগ্রাউন্ডে অতীনের স্ত্রীর কথা শোনা যাচ্ছে…
— অ্যাই তুমি সিগারেট খাও? বলো নি তো আমায়।…কি ব্যাপার.. জিজ্ঞেস করছি না? বলো…)
**************

নিঝুম রাত্রি। ঘন কুয়াশার চাদরে মুড়ে আছে জনপদ। দেখতে দেখতে দুটো বছর কেটে গেলো৷ তূর্যের গাল এখন দাড়িতে ভর্তি। মাথার চুল ঘন হয়ে কাঁধে নেমে এসেছে। শরীর বেশ শীর্ণকায়। চোখদুটো আরও গভীর। তবু তার বয়স বাড়ে না। সে দাঁড়িয়ে থাকে তার নিজস্ব ক্যালেন্ডারের পাতায়, যেখানে সময় অখন্ড, কাল অনন্ত। সে হেঁটে চলে এ শহর থেকে সে শহর… এ গ্রাম থেকে সে গ্রাম…. সে দেখে চলে জীবনের পটচিত্র, তার নাসিকায় অজানা ফুলের গন্ধ, তাকে ছু্ঁয়ে যায় প্রতি রাতে ভাগীরথীর ঠান্ডা বাতাস, তার দুটো কানে জলের গভীর থেকে ভেসে আসে অতি ছোট্ট একটা শব্দ — ঝুপ!
তারই অনুরণনে বেজে ওঠে বুকের মধ্যে এক অমোঘ তূর্যধ্বনি!

আজ সে এই গভীর রাতে নিশ্চুপে এসে দাঁড়িয়েছে ব্রীজের ওপর রেলিঙে হেলান দিয়ে। চোখের ওপর শান্ত, বহমান ভাগীরথী। নোঙর-বাঁধা বড় লঞ্চগুলো স্থির হয়ে আছে ছবির মতো। তূর্যের ভারাক্রান্ত মনে উঁকি দিয়ে যাচ্ছে কিছু এলোমেলো লাইন….

“যে কথাটা তোমায় বলা হবে না কোনদিন
তা আমি রোজ যত্ন করে
শুইয়ে রাখি পাশে…এক বিছানায়…
সারা রাত্রি আমার বুকে খুঁড়তে থাকে মাটি
ঘুম আসে না.. .অসহ্য বুকের যন্ত্রনায়।

যে কথাটা কোনদিন হবে না বলা তোমায়..
তার সঙ্গে বাসে অটোয় খুচরো পয়সা গুনে
এই শহরেই হারিয়ে যাই ভ্রষ্ঠ আলিঙ্গনে..
পায়ের চটি খইতে থাকে নিস্পন্দ পথে
আমি খুঁজি ঠিকানা তার। সে শুধু পথ চেনায়..

আমি তাকে ভুলিয়ে রাখি হাজার রকম গল্প কথায়.. মাথায় কাঁধে হাত বুলিয়ে বুজিয়ে দি চোখের পাতা..
তবু রাত্রি এলেই কাজল চোখে এক-নদী তেষ্টা ভীষণ… কুয়াশায় মোড়া ব্রীজের ধারে
এসে দাঁড়ায় এ- কলকাতা! ”

— কাকে খুঁজছো ওমন করে?
— তুমি?

তূর্য দেখতে পেলো রেলিঙে হেলান দিয়ে তার পাশাপাশি দাঁড়িয়ে আছে হলুদ টপ পড়া সেই যুবতী মেয়েটি।

—- আজ এলাম তোমার সাথে দেখা করতে।
—- আ..আমি ক্ষমা চাইছি…সেই রাতে আমি তোমায় বাঁচাতে পারি নি।
—- ( খিলখিল করে হেসে উঠল মেয়েটি) তুমি আমাকে মারতেও তো পারো নি।
—- আমি সংবাদপত্রের অফিস থেকে তোমার ঠিকানা নিয়ে পরের দিনই তোমার দেশের বাড়ি, সেই সুন্দরবনে গিয়ছিলাম। সেখানে গিয়ে শুনলাম….
—- জানি৷ গিয়ে দেখলে, আমার ছোট্ট বাড়িটা তালাবন্ধ। ব্যাঙ্ক সীজ করে নিয়েছে।
—- হ্যা, তোমার বাবা চাষাবাদ করতেন। খুবই কষ্ট করে বাড়ি বন্ধক রেখে তোমাকে কলকাতায় পড়তে পাঠিয়েছিলেন। কিন্তু বন্যায় সব ফসল নষ্ট হয়ে যাওয়ায় তিনি কীটনাশক বিষ খেয়ে আত্মহত্যা করেন।
—- ঠিকই শুনেছো। বাবা কী-বা করতো এছাড়া! মা চলে গেছে আমাকে জন্ম দিয়েই। হাসপাতালেও নেওয়া যায় নি তাকে। খেয়াঘাটেই নৌকার ওপর ভূমিষ্ট হলাম আমি। জন্ম নিলাম জলের বুকের ওপর। কোনো নার্স নয়, নদীর ঢেউ আমায় প্রথম দোল খাওয়ালো।
—- কলকাতায় বিডন স্ট্রিটে তোমার মেস-এর ঠিকানাতেও গেছিলাম।
—- হুঃ… কী শুনলে সেখানে? আমি একটা নষ্ট মেয়ে?
—- লোকে তো পাঁচ কথা বলবেই…
—- তোমার ছয় নম্বর কথাটা কী শুনি..
( খিলখিল করে হেসে উঠল সে)
—- আমি সবই খবর নিয়েছি। তোমার বাবা গত হওয়ার পর তুমি একটা ছোট কম্পানিতে কাজ করতে নিজের খরচা চালানোর জন্য।
—- শুধু একটা কম্পানি নয়… কলকাতার কতো অফিস… কোথাও একমাস…কোথাও তিনমাস…নোংরা প্রস্তাবগুলো খুব স্বাভাবিক ভাবে আসতে থাকতো, আর আমি সবাইকে অবাক করে খুব অস্বাভাবিকভাবে চাকরি ছাড়তে থাকলাম৷ দেশের বাড়িটাও দখল হয়ে গেছে। গ্রাম থেকে আসা মেয়ে আমি… চোখের ওপর মাট-ঘাট-নদী-নালা দেখে বড় হয়েছি। পুকুরপাড়ে ঝগড়া করেছি, বিপদ এলে তাদেরকেই পাশে পেয়েছি। কিন্তু, যখন অর্থের অভাবে কলকাতার কানাগলির গোলকধাঁধার মধ্যে পথ হারালাম, আর বেরিয়ে আসার রাস্তা ছিল না। কলেজে মাইনে বাকি পড়লো, ঘরভাড়া বাকি…. এমন সময় এক বান্ধবী নিয়ে গেলো একটা বাড়িতে। সেখানে নাকি কাজের হদিস দেবে। গিয়ে বুঝলাম, সেটা একটা মাংসের দোকান। মেয়েমানুষের মাংস! ছুটে পালিয়ে এলাম ঠিকই, কিন্তু পালিয়ে যাবোই বা কোথায়? খাল-বিল-মাঠের পাখি ধরা পড়লো শহরের খাঁচায়।
আমার বায়না হলো। যেতে হবে শহরের এক নামী হটেলে। মিনিস্টারের ছোটভাই আছেন সেখানে। আমায় নিয়ে যাওয়া হলো, থালায় সাজানো নৈবেদ্যের মতো!
গল্পটা এভাবেও শেষ হতে পারতো। হলো না। বলেছিলাম না? জলে জন্ম আমার —- বাবা আমার নাম রেখেছিল ” মৃত্তিকা”; ডাকতো ‘মাটি’ বলে। অথচ,কপাল দ্যাখো — মাটিতেই দাঁড়াবার ঠাঁই হলো না আমার ।
সেই দিনই পুলিশ রেড করলো হটেলে। থানায় সারা রাত কাটাতে হলো আমায়। এই পূণ্যবান শহরে আমি হয়ে গেলাম নষ্ট মেয়ে! গ্রামে ফেরারও পথ নেই। অবশেষে এই ব্রীজ থেকেই ঝাপ দিয়ে ফিরে গেলাম নদীর অতলে।
—- কাল যাচ্ছি আমি। তোমার গ্রামে।
—- জানি হাসপাতাল বানাচ্ছ। দুবছর ধরে টাকা জমিয়েছো।
—- হ্যা, যাতে সেখানে আর কেউ বিনা চিকিৎসায় মারা না যায়। ভাবলাম, তোমার মা থেকেই শুরু করা যাক।
—- অনেক আঘাত, অনেক বিপদ, অনেক প্রতিকূলতা আসবে। এতো সহজ হবে না।
—- বেঁচে থাকার চেয়ে কঠিন কী কিছু আছে?
আমি জানি না আমি জীবন থেকে কী চাই, কিন্তু এটা জানি, আমি জীবনের থেকে কী চাই না।
—- তুমি যে জগতে যাচ্ছো, তা তোমাদের সুখের বসন্তের থেকে বহু দূরে…. সেখানে অনন্ত শীত… ভেবে দেখেছো?
—- না ভাবি নি। ভাবার প্রয়োজনও মনে করি নি।
এই সাহেবী জগৎ যাকে রাস্তার লোক বলে, প্রাচীন ভারতে তারাই ছিল পরিব্রাজক। আমি কোনো যুদ্ধে যাচ্ছি না যে হার-জিতের চিন্তা করবো; ঘরও বাঁধবো না যে তা ভেঙে যাওয়ার ভয় পাবো। আমি গাছ লাগাতে যাচ্ছি শুক্ন, কঠিন মাটিতে। আমার একটু ছায়া হলেই হবে। তুমি শীতের কথা বলছিলে? শীত হলো সেই বসন্ত যখন প্রতিটি হলুদ পাতাই তার নিজস্ব ফুল। Winter is the Spring in disguise when each fallen yellow leaf is its flower!
— বেশ, তবে যাও।
— তুমি যাবে তো আমার সাথে?
— তোমাকে যেতে হলে তো একাই যেতে হবে। তবে জানি, তুমি একদিন ঠিক আমার গ্রামে ফিরিয়ে আনবে আমায়। তোমার গাছে আমি পাখি হয়ে ফিরে আসবো। তোমার পুকুরে আমি মাছ হয়ে খেলা করবো। তোমার শশ্যক্ষেতে আমি ফসল হয়ে নির্মল বাতাসে দোল খাবো। আমি আবার নবান্নের থালায় নতুন ধান হয়ে ফিরে আসার অপেক্ষায় থাকবো তূর্য।

ধীরে ধীরে কুয়াশার ঘন পর্দায় আচ্ছন্ন হয়ে গেলো তূর্যের দৃষ্টি। হঠাৎ সেই ‘ ঝুপ’ করে একটা ক্ষীন ধ্বনি ভেসে এলো নদীবক্ষ থেকে। তূর্য চিৎকার করে ডেকে উঠলো —- মৃত্তিকা! মৃত্তিকা! মাটি-!

মনের ভেতরে উথলে ওঠা দু-চারটে লাইন তূর্য অস্ফুটে বিড়বিড় করতে করতে পথ হেঁটে ফিরছিল ঘরের দিকে।

— ” পুরুষের চোখে মুখে
যে কৌরবেরা থাকে,
তা চিনে ফেলো যদি—
সব নারীই দ্রৌপদী! ”

ভোরবেলায় শিয়ালদা স্টেশন তার স্বভাব পরিচিত মেজাজে নেই। একটু ঝিমিয়ে আছে এই শীতে। হাসনাবাদ লোকাল ছাড়তে এখনও আধঘন্টা বাকি।
তূর্য টিকিট কেটে বাইরে এসে দাঁড়ালো। চোখের সামনে ঝুলে আছে ফ্লাইওভারটা। সে সেদিকে মুখ করেই সিগারেটের ধোঁয়া ছাড়লো। তারপর মোবাইল ফোনটা বের করে একটা একটা করে ফোন নাম্বারগুলো ডিলিট করতে শুরু করলো।
এইভাবে সুরভীর নাম্বারটা আসতেই আঙুলটা থেমে গেলো।

— কি হলো? থামলে কেন? করো ডিলিট।

চমকে উঠে ভূত দেখার মতো তূর্য দেখলো তার ঠিক মুখোমুখি দাঁড়িয়ে আছে সুরভী।

— তুমি?
— হ্যা আমি। সমীরের থেকে খবর পেলাম তুমি সুন্দরবন চলে যাচ্ছো।
— হ্যা।
— ভালোই করছো। ওটাই তোমার থাকার সঠিক জায়গা।
— তা ঠিক।
— তাহলে ছেড়ে চললে এই শহর?
— আপাতত। একটু সময় লাগবে। তবে একদিন ঠিক ডেকে নেবো এই শহরকে।
— যাচ্ছো যখন — যাও। তবে একটাই কথা বলবো। ওখানে চোখ বুজে ধ্যানে বসে তপস্যা কোরো না৷ প্রাণ খুলে উৎসব করো। এই দেশ চিরকাল ব্রতপার্বণে বেঁচে থেকেছে। কঠিন দারিদ্র্যেও ভাদু গেয়েছে, রামের বনবাসে চোখের জল ফেলেছে। জীবনে দারিদ্র্য এসেছে, কিন্ত জীবনকে দরিদ্র হতে দেয় নি৷ তাই ওদের কোনো উপকার করতে যেও না। ওরা ভাল আছে। শুধু, যারা তাদের গান, ছড়া, উৎসব কেড়ে নিচ্ছে, তাদের নিরস্ত্র করো৷
— তাই হবে, সুরভী। চা খাবে?
— যেদিন আবার হঠাৎ করে দেখা হবে, সেদিন একসাথে চা খাবো। আজ নয়।
— বেশ।
ট্রেনের সময় হয়ে এলো। আসি তবে।
— এসো। হয়তো আবার দেখা হবে।
— জানি। দেখা হবে। কৈলাস যদি আমার হয়, কাশী তোমার। শিব কৈলাশে আদিযোগী, কিন্তু কাশীতে সে ভিক্ষু, অন্নপূর্ণার দ্বারে তার শেষ ভিক্ষা!
তোমার সাথে নিশ্চয়ই দেখা হবে।

জনতার কলরব ভেদ করে ট্রেন প্রবল তূর্যধ্বনি তুলে ছুটে চললো গঙ্গা ছেড়ে ইছামতীর দেশে….

অলংকরণ – Elisa-Talentin

শেয়ার করতে:

You cannot copy content of this page