বৃষ্টির দিনে

অনীশ ঘোষ

সকাল সকাল ঘুম থেকে উঠেই মেজাজটা ভীষণ খিঁচড়ে গেল ঋকের। এমনিতে সে লেট রাইজার। অফিস থেকে ফিরে জামাকাপড় পাল্টে ফ্রেশ হয়ে খেয়ে উঠতে উঠতেই প্রায় রাত সাড়ে বারোটা–একটা হয়ে যায়। এর পর রোজ নিয়ম করে বসতে হয় লেখালিখি নিয়ে। অনেক রাত অবধি জেগে নেট ঘাঁটা, রেফারেন্স বইপত্তরের পাতা ওল্টানো, নোট নেওয়া, তার পর ফাইনালি লেখা শুরু ও শেষ করা ইত্যাদিতে ব্যস্ত থাকতে হয়। শুতে শুতে আরও রাত, মানে প্রায়শই তিনটে বেজে যায়। ঋকের সকাল হয় বেশ দেরিতে, দশটারও পরে। এই রুটিনই চলে আসছে বিশ/বাইশ বছর ধরে। বিয়ের আগে থেকেই। মেঘনা এ বাড়িতে আসার পর কিংবা তিতলি হওয়ার পরেও ঋকের এই অভ্যাস একই রকম থেকে গেছে, বদল ঘটেনি। তবে মাঝে মাঝে যে রুটিনের কিছু এদিক–ওদিকও হয়, সেটাও ঘটনা। আজ যেন সেরকমই একটা রুটিন–ভাঙা দিন ঋকের কাছে।

মেয়ে–বৌকে নিয়ে আজ বেশ সকাল সকাল বেরোতে হবে তাকে। যেতে হবে অনেকটা দূর। জরুরি নেমন্তন্ন রক্ষা করতে। দেরি করা চলবে না বলে রাতে শোবার আগে ঘড়িতে অ্যালার্ম দিয়ে রেখেছিল ঋক। ঠিক সাতটায় অ্যালার্ম বাজলেও চোখটা যেন ছাড়তেই চাইছিল না, আঠার মতো লেগে ছিল। আর–একটু গড়িয়ে নিয়ে সেকেন্ড রিমাইন্ডারটা বাজলেই উঠে পড়বে ভেবে পাশ ফিরে শুতে গিয়েই বাইরে বৃষ্টির ভারী শব্দটা কানে এল তার। ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি হচ্ছে। মেঘের গর্জনও চলছে। ভোররাতে একবার টয়লেটের জন্যে উঠতে হয় তাকে। তখনই জলপতনের তীব্র ঝমাঝম শব্দে বুঝেছিল তুমুল বৃষ্টি নেমেছে। সকালের প্রোগ্রামটার কথা ভেবে একটু আশঙ্কাও হয়েছিল ঋকের। কিন্তু তখন ভেবেছিল, কতক্ষণ আর টানবে! বড়জোর ঘণ্টা খানেক। ভোরের দিকে নিশ্চয়ই ধরে যাবে। কিন্তু কোথায় কী! মনে তো হচ্ছে জলের তোড় আরও বেড়েছে! জানালার পর্দা সরিয়ে চোখ ফেলতেই বুঝল, রাতের মতোই অন্ধকারে ডুবে আছে বাইরেটা। সাতটা বেজে গেছে, রোদ তো দূরের কথা, বরং চারপাশটা ঘুটঘুটে কালো হয়ে আছে। আজ যে বৃষ্টির ঢ্যামনামি সহজে শেষ হবে না, মনে হল তার। এখন কী করবে ঋক! এমনিতে এরকম বর্ষা নামলে সকালের দিকে ঘুমটা জম্পেশ হয়। বিছানা ছাড়ার প্রশ্নই থাকে না। ঋককে অফিস বেরোতে হয় দুপুর গড়িয়ে। কিন্তু আজ তো আর শুয়ে থাকলে চলবে না। কিন্তু সাততাড়াতাড়ি উঠেই বা কী করবে এই ঘোর বর্ষার মধ্যে! আকাশ তো ভেঙে পড়ছে!‌ বহর দেখে তো মনে হচ্ছে ইতিমধ্যে রাস্তাঘাট পুরোপুরি পুকুর হয়ে বসে আছে! ট্রেনের খবর যে আদতে কী— সেটা তো ভাবাও যাচ্ছে না। কিন্তু কিছু তো একটা করতে হয়।

এই মূহূর্তে বৃষ্টিটাকে হিন্দি ছবির তিলে খচ্চর ভিলেন বলে মনে হল ঋকের। মনে হচ্ছে না শালা সহজে রেহাই দেবে বলে। কপালে ভালোই অশান্তি আছে ভেবে সাতসকালেই মেজাজটা চটকে গেল ঋকের। এমনিতে এরকম ঘোর রেনি ডে–তে ঘরে শুয়ে–বসে সময় কাটানো ছাড়া তেমন কিছু করারও থাকে না। বাইরে বেরোনো মানেই বরং ফালতু ঝামেলা। কিন্তু আজ তো তার ফ্যামিলি নিয়ে বেরোনোর কথা একটু পরেই।

এর মধ্যে অ্যালার্ম বাজার আওয়াজে ইনডাকশনে চায়ের জল চাপিয়ে দিয়েছিল মেঘনা। বেড টি নিয়ে চলে এসেছে শোবার ঘরে। এর মধ্যেই স্নানটানও সারা। ঋকের হাতে চায়ের কাপ ধরিয়ে দিয়ে মেঘনা বলল, ‘একটু তাড়াতাড়ি করো কিন্তু আজ। তোমার তো আবার নড়তে–‌চড়তে আঠেরো মাস! সাতটা বেজে গেছে, খেয়াল আছে তো?’

বড্ড পিসিমা পিসিমা ভাব মেয়েটার। এইটুকু বয়স, অথচ সব বিষয়েই এক্সপার্টস কমেন্ট ঝাড়তে মুখ বাড়িয়ে আছে যেন! সুযোগ পেলেই ঋককে ঠুকে দেয়। আরে বাবা, বাইরের ওয়েদারটা আগে দেখো একবার! ঋক কিছু বলে ওঠার আগেই হুড়মুড় করে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেছে মেঘনা। রয়েবসে কাজ করলে আজ আর তার চলবে না। এখন তার চলন একেবারে ক্ষীপ্র হরিণীর মতো।

চায়ে চুমুক দিতে দিতে আরেকবার জানালার বাইরে তাকায় ঋক। আকাশ আর বৃষ্টিটাকে ফের একটু মেপে নিয়ে মনে মনে একটা ভাবনা ছকে ফেলে সে। মেঘনাকে একবার বলে দেখবে নাকি, আজকের প্রোগ্রামটা ক্যানসেল করাটাই ভালো হবে! বরং এক হাঁড়ি খিচুড়ি বসিয়ে দাও। সঙ্গে ওমলেট আর পাঁপড় ভাজা। অফিসে তো ছুটি নেওয়াই আছে। বেশ জমিয়ে খিচুড়ি খেয়ে একটা লম্বা ঘুম দেওয়াটাই এই ওয়েদারে অ্যাপ্রোপ্রিয়েট!

কিন্তু বলবে কোন সাহসে? এই প্রস্তাবটা মেঘনার সামনে ফেলা মানেই যে বিশাল অশান্তি, সেটা কি আর ঋক জানে না! তেমন কিছু ঘটলে সেটা সামলানো তার ঠাকুর্দারও কম্ম নয়। উফ, কী যে গেরোতে পড়েছে! কী করবে এখন, বুঝে উঠতে পারছে না!‌ এগোলে বিপদ, পিছোলেও বাঘিনীর ভয়!

বেশ খানিকটা সময় আগুপিছু ভাবতে ভাবতেই চলে গেল। কিন্তু পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার মতো কিছুই মাথায় এল না। ইতিমধ্যে ঋকের সাড়াশব্দ না পেয়ে পাশের ঘর থেকে তাড়া দেওয়া হাঁক পাড়ল মেঘনাই, ‘কী গো! কী হল তোমার? উঠলে, নাকি আবার শুয়ে পড়েছ! উফ, কী যে করি না তোমাকে নিয়ে! আমার হয়েছে যত জ্বালা!’

মেঘনার হাঁকডাকে সাড়া দিয়ে ঋক বলল, ‘আরে এই তো উঠে গেছি রে বাবা!’

মনে মনে ভাবল সে, জ্বালা কী আমারও কম মেঘনা! তুমি আর তার কী বুঝবে! আমি যে এখন কী যে করি ভাবতে গিয়ে সকালের পটিটা পর্যন্ত আটকে গেছে!

আসলে মেঘনারও তো কোনও দোষ নেই। আজকের দিনটা ওর কাছেও সত্যিই বেশ গুরুত্বপূর্ণ। আজ ওর একমাত্র মামাতো বোনের আইবুড়ো ভাত। সেজমামার বাড়ি যাওয়ার জন্য তাই কাল থকেই সে যেন একেবারে মুখিয়ে আছে। কথা ছিল এক সপ্তাহ আগেই চলে যাওয়ার। মামার বাড়িতে থেকে তিতলির বিয়ের কেনাকাটা, গোছগাছ সব ওরই করে দেওয়ার কথা ছিল। সেজ মামিমা সুগার আর থাইরয়েডে কাবু থাকে প্রায়শই, সঙ্গে আবার হাঁটুর ব্যথা, প্রেশার হাই। একগাদা ওষুধ খায় নিয়মিত। কাজের লোক দিয়ে দুবেলা রান্না করাতে হয়। তাই মামা–মামিমা দুজনেই চেয়েছিলেন অন্তত সপ্তাখানেক আগে এসে মেঘনা শেষটুকু সামলে দিক। নিজের বিয়ের কেনাকাটা বেশিটাই অবশ্য তিতলি নিজেই সেরেছে ওর বেস্ট ফ্রেন্ড সুদেষ্ণাকে সঙ্গে নিয়ে। ছেলের বাড়ির দিক থেকে মাপজোক যা দরকার সেজমামাই সেসব করে দিয়েছে। মামি দু–একদিনের বেশি সঙ্গে বেরোতেই পারেনি। কিন্তু চেষ্টা করবে বলে কথা দিয়েও ওই আগে যাওয়াটা আর হয়ে ওঠেনি মেঘনার। আসলে ঋকের অফিস থেকে হুটহাট ছুটি মেলে না, তার ওপর গুনুটা আছে, মাত্র দু’‌বছরের পুঁচকেটাকে সামলাতে ঝক্কিও খুব। ওকে নিয়ে মেঘনা যে রওনা দেবে, মামিমার কাছে ছেড়ে রেখে মার্কেটিং বা অন্য কাজগুলো সারবে— তাতে যেমন অসুবিধে বিস্তর, মামিমার পক্ষে ওই শরীরে একরত্তি দুষ্টুটাকে সামলানোও সত্যিকারের কঠিন। তার ওপর ঋকের জন্যেও চিন্তা আছে। ওর আবার বাইরের খাবার খাওয়ায় ডাক্তারের কড়া বারণ। বছর খানেক আগে পেটে একটা আলসার মতো ধরা পড়েছিল। প্রচুর টেস্ট ইত্যাদি করে ভালো স্পেশালিস্ট দেখিয়ে তবে সামলানো গেছে। অনেক কিছুই বাড়িতেও খাওয়া চলে না। বিয়ের আগে থেকে আজেবাজে যা খুশি যখন–তখন খেয়েই রোগটা বাধিয়ে বসেছিল। ফলে একা বরকে বাড়িতে ফেলে রেখে মামার বাড়ি যেতে মন থেকে একেবারেই সায় পায়নি মেঘনা। ঋক অবশ্য বলেছিল অফিসের ক্যান্টিনে নয়, নিজেই ও যা হোক দুটো সেদ্ধ রান্না করে চালিয়ে নিতে পারবে। কিন্তু ধমকে থামিয়ে দিয়েছে মেঘনা।

তবে তার এই আগে যাওয়াটা ভেস্তে যাওয়ায় মামাতো বোন তিতলির গাদা গাদা অভিযোগ বোমার মতো ধেয়ে এসেছে আদরের ছোড়দির প্রতি। শেষমেশ বুঝিয়ে–‌সুঝিয়ে ম্যানেজ করা গেছে কিছুটা। ওদিকে বসকে অনেক ধরেকয়ে দিন তিনেকের একটা ছুটি ম্যানেজ করতে পেরেছে ঋক। তবে আগেই জানিয়ে দিয়েছে, বৌভাতে তার যাওয়া হয়ে উঠবে না। ওই দিনেই তাকে জয়েন করতে হবে অফিসে। আগে থেকে দুজনের ছুটি নেওয়া আছে। ফলে জ্বর–পেটখারাপের অজুহাতও চলবে না। অন্যথা হলেই টাকলু বসের গালাগাল বাঁধা!

সব শুনে মেঘনা বলেছিল, ঠিক আছে, আইবুড়ো ভাত আর বিয়েটা তো আগে কাটুক। বৌভাতের দিন তুমি না হয় রাতে সেজমামার বাড়িতেই ডাইরেক্ট ফিরো অফিস থেকে। পরের দিন সকালেই না হয় বাড়ি ফিরে আসবখন আমরা।

যদি মামা–মামিমা আটকে দেন? ঋকের প্রশ্নে মেঘনা জবাব দিয়েছিল, পরের কথা পরে দেখা যাবে।

সুতরাং আজকের দিনটা তাদের যাওয়া ভেস্তে গেলে কী যে তুমুল অশান্তি হবে, ভেবে কূলকিনারা পাচ্ছিল না ঋক। দিন বুঝে ক্ষণ, বৃষ্টিটাও আর নামার সময় পেল না! শালা, কাল রাতে একবার ঢালল, ফের ভোর থেকে শুরু হয়েছে তো হয়েইছে, থামার কোনও নাম নেই! কী যে বিপত্তিতে পড়েছে সে! আজ আর যে কোনওভাবেই আকাশের হাল দেখিয়ে মেঘনার হাত থেকে নিস্তার পাওয়া যাবে না, সেটা খুব ভালোই জানে ঋক। মেঘনার এখন ঝড়বাদলা দেখার মতো মানসিকতা নেই। পৃথিবী উল্টে গেলেও ওকে আজ যেভাবেই হোক মামার বাড়ি পৌঁছতেই হবে! ঋকের তাই এখন শিরে সংক্রান্তি। মনে মনে বৃষ্টির মুণ্ডুপাত করতে করতে টয়লেটে ঢুকে পড়ে সে।

কিন্তু সেখানেও যে জটিল ভাবনা পিছু ছাড়ে না! এরকম আবহাওয়ায় এই অশোকনগর থেকে ট্রেন, বাস পাল্টে সেই কোথায় বজবজে পৌঁছনো চাট্টিখানি কথা!‌ ব্রাশ করতে করতেও বিগড়ে যাওয়া মেজাজটাকে কন্ট্রোলে রাখতে পারছিল না ঋক। কেন যে লোকে এই ঘোর বর্ষার মরশুমে বিয়ের ডেট ফিক্সড করে কে জানে! গোটা বছর পড়ে রয়েছে, অথচ দেখো, বেছে বেছে ঠিক এই সময়েই বিয়ে ঠিক করা। আক্কেল বলে কিছু নেই! বর্ষার সিজনে বিয়ে মানেই তো ফালতু একগাদা এক্সট্রা ঝামেলা ঘাড়ে এসে পড়া। যখন–তখন ঝুপঝুপ–টুপটুপ থেকে একেবারে ঝমঝমিয়ে নেমে পড়তেই পারে, সঙ্গে ঝড়, বাতাস— এ সবই তো এই সময়ের রোজকার ব্যাপার। আর আজকের মতো এমন বর্ষা মানেই তো সব কাজ মাটি। মানুষকে ঝামেলায় ফেলতে এরকম বৃষ্টির কোনও জুড়ি আছে! আধ ঘণ্টার বর্ষাতেই রাস্তায় জলটল জমে একশা। রাস্তা তো নয়, যেন একখানা নদী, নয়তো প্যাচপেচে জলকাদায় একেবারে চাষের খেত! সব দিক থেকে নাকালের একশেষ! আর এমন অবস্থায় জলকাদা ঠেলে, হাজারটা ঝক্কি সামলে বিয়েবাড়ি অ্যাটেন্ড করা মানে তো পুরো মুডটাই চৌপাট! কোথায় সেজেগুজে, পোশাকে চমক মেরে, ফুরফুরে মেজাজে বিয়েবাড়িতে হাজির হওয়া আর কোথায় বর্ষায় নাস্তানাবুদ হয়ে ভিজেনেয়ে স্পেশাল মেজাজের বারোটা বেজে যাওয়া! বিশেষ করে একমাত্র শ্যালিকার বিয়েতে চেনাজানা মানুষজন, আত্মীয়স্বজনদের সঙ্গে দুটো খোশ গল্প, শ্যালক–শ্যালিকাদের সঙ্গে একটু ঠাট্টা–ইয়ার্কি, খুনসুটি আর শেষে পাত পেড়ে চর্ব্যচোষ্য ভোজন— নির্ভেজাল একটা ছুটির মস্তিতে কাটানো— সব পণ্ড এই এক বৃষ্টিতে! শালা যেন কাবাব মে হাড্ডি! ক্যাজুয়াল মুডটাই হাপিস করে দেয়! তাছাড়া এই বৃষ্টিতে দূরের লোকজনেরা অ্যাটেন্ডও করতে পারে না। প্রচুর খাবারদাবার নষ্ট, নানান দুর্ভোগ— তবু কেন যে আগুপিছু না ভেবেই বেআক্কেলে কিছু মানুষ এই সময়েই বিয়ের দিন ঠিক করে কে জানে! শুধু কি অন্যদের, নিজেদেরও তো ভোগান্তির একশেষ! তবু লোকগুলোর টনক নড়ে না!

কিন্তু এ সব কথায় যে চিঁড়ে ভিজবে না সে জানে! তার যে এখন কোথাও বেরোনোর ইচ্ছেটা একেবারে মিইয়ে গেছে, এটাও তো ঘটনা। ঘোর বৃষ্টির মরশুম এসে গেছে, যখন–তখন বৃষ্টি হতেই পারে এটাও ঠিক, তবু ঋকের সব গায়ের ঝাল গিয়ে পড়ে বৃষ্টিটার ওপর।

অনেক ভেবে ঋক ঠিক করে, আজকের বদলে যদি কাল যাওয়া যায়, নিদেনপক্ষে আজ বিকেলের দিকেও আবহাওয়াটা যদি একটু ভালো হয়— মেঘনাকে একবার বলেই দেখা যাক না! এর জন্যে তার কপালে কী নাচছে, সেটা নিয়ে রীতিমতো আশঙ্কা থাকলেও, একবার শেষ চেষ্টা করে দেখলে হয়। ওদিকে শ্রীমতী তো এতক্ষণে বোধহয় মেয়েকেও রেডিটেডি করে ফেলেছে, যে গতিতে ভোর থেকে ছুটছে!

টয়লেটে সময়টা বড্ড বেশি নিয়ে ফেলেছে ঋক। বাইরে থেকে দরজা ধাক্কিয়ে মেঘনা হাঁক পাড়ে, ‘কী হল, আজকে কি বাথরুমেই সারাদিনটা কাটাবে বলে ঠিক করেছ নাকি! কোন যুগে ঢুকেছ খেয়াল আছে!’

ঋক বলে, ‘আরে বাবা, এটা তো কোনও মন্দির নয়, যে ধম্মকম্ম করছি বলে সময় লাগছে! কাজ মিটলেই ঠিক বেরোব!’

‘আজ একটু যেন বেশি কাজ ওখানে মনে হচ্ছে! আমরা কখন রেডি হয়ে গেছি, তোমার তো দেখছি কোনও হেলদোল নেই।’ মেঘনার তাড়া খেয়ে ঋক বলে, ‘এই তো হয়ে এসেছে। আর একটু ওয়েট প্লিজ!’

মেঘনা গজগজ করতে থাকে, ‘ওয়েট করতে করতে শেষে তিতলির বিয়েটাও না মিটে যায় দেখো! যত দায় যেন আমার!’

কার যে দায় কে জানে! যাক গে যা বলছে বলুক। টয়লেট থেকে বেরিয়ে ঋক ভাবে, আমাকেও আমার কথাটা একবার পাড়তেই হবে। যা থাকে কপালে, ক্যাজুয়ালি বলে দেখা যাক কাজ হয় কিনা! একদম ঘাবড়ে গেলে চলবে না। শোবার ঘরে ঢুকে ঋক দেখে, ততক্ষণে আলমারি খুলে বিছানার ওপর একগাদা শাড়ি, চুড়িদার, গয়নার বাক্স সব ডাঁই করে ফেলেছে মেঘনা। একদিকে বেশ কিছু পোশাক, গয়না আলাদা করে রাখা। মানে বিয়েবাড়ির জন্য দরকারি জিনিসের বাছাইপর্ব শেষ। তবু রক্ষে যে মেয়েকে এখনও ঘুম থেকে তোলেনি।

ওকে দেখেই মেঘনা ফের গজরাতে শুরু করে, ‘এ কী, চানটাও সারোনি এখনও! আমি তো ভাবলাম সব সেরে বেরোবে। উফ, কী যে করি আমি! কখন যে শেষ পর্যন্ত বেরোতে পারব! মানসম্মান নিয়ে টানাটানি হবে এক বাড়ি লোকজনের সামনে। কী কুক্ষণে যে এই লোকটার পাল্লায় পড়েছিলাম!’

এ সব কথা এখন গায়ে মাখলে চলবে না। কাজ হাসিলের চেষ্টা চালাতে হবে ঋককে। একটু শঙ্কিত হয়েই কথাটা শুরু করে ঋক, ‘তুমি তো গোছগাছ সব প্রায় সেরেই ফেলেছ দেখছি। কিন্তু আমার একটা কথা বলার ছিল, বুঝলে?’

‘বলে ফেলো। কার জন্যে আর দিনক্ষণ দেখছ!’ মেঘনার গলায় ঝাঁজ বাড়ছে দেখে আর ইতস্তত না করে ঋক বলে, ‘বলছিলাম কী, এই বৃষ্টিতে এখন বেরোনোটা কি ঠিক হবে? বেশ রিস্ক হয়ে যাবে মনে হয়। কী বলো?’

দড়াম করে আলমারির পাল্লাটা ঠেলে দিয়ে মেঘনা ছুটে আসে ঋকের মুখোমুখি, ‘মানে? কী বলতে চাও খুলে বলো তো! তিতলির বিয়েতে আমাদের যাওয়াটা তা হলে ক্যানসেল হচ্ছে, তাই তো?’

প্রশ্নের জবাবে এভাবে পাল্টা প্রশ্ন নিয়ে তেড়ে আসবে মেঘনা, এমন পরিস্থিতির জন্যে ঠিক তৈরি ছিল না ঋক। একটু ভড়কে গিয়ে আমতা আমতা করে উত্তর দেয়, ‘আরে না না, তা নয়। ক্যানসেল কেন হবে! কিন্তু ওয়েদারটা দেখছ তো! এই বৃষ্টির মধ্যে বেরিয়ে শেষে যদি কোনও বিপদের মধ্যে পড়তে হয়, তখন…’ ঋকের কথা শেষ করতে না দিয়ে মুখ ঝামটা দিয়ে মেঘনা বলতে থাকে, ‘আরে তার মানে তো এটাই দাঁড়াল যে না গেলেই ভালো। পরিষ্কার। অত ধানাইপানাইয়ের কী আছে! ব্যাটাছেলের এরকম মিউমিউপনা দেখলে না আমার হাড়পিত্তি জ্বলে যায়! উফফ!’

ঋক চেষ্টা করে বোঝাতে, ‘আজকে তো রাস্তায় গাড়িঘোড়াও খুব কম থাকবে। ট্রেন ঠিকঠাক চলছে কিনা তাও জানি না। রাস্তায় বেরিয়ে জলে ভিজে যদি গুনুর শরীরটরীর আবার খারাপ করে, তবে তো…’

ঋককে থামিয়ে দিয়ে মেঘনা বলতে শুরু করে, ‘কেন, ভিজবে কেন? আমার মেয়েকে কীভাবে সামলাতে হয় আমি জানি। তুমি আবার কবে এ সব খেয়াল রাখো! আসলে কী বলতে চাও ঠিক করে বলো তো!’

ঋক বলে, ‘ঠিক করেই তো বলতে চাইছিলাম। তুমি তো বারবার গুলিয়ে দিচ্ছ সব! আসলে গাড়িটাড়ি ঠিকমতো পাব কিনা বুঝতে পারছি না। তাই আর কী…’

রাগে মেঘনার চোখমুখ, টকটকে ফর্সা গাল, নাকের পাটা একেবারে লাল হয়ে উঠেছে এর মধ্যে। ‘তাই, তাই কী? আজ বুঝি কেউ আর রাস্তাঘাটে বেরোচ্ছে না! কেউ কোথাও যাচ্ছে না, কোনও কাজকর্ম করছে না। সবাই তোমার মতো বাড়ি বসে পা নাচাচ্ছে খালি! সব খোঁজটোজ নিয়ে এলে বুঝি?’ রেগে ফুঁসে দুমদাম পা ফেলে বসার ঘরের সোফায় গিয়ে নিজের শরীরটাকে যেন আছড়ে ফেলে মেঘনা।

বৌয়ের যুক্তির সামনে পড়ে দিশেহারা হাল ঋকের। মিনমিন করে বলে, ‘না, আসলে বৃষ্টিটাও তো ধরার কোনও লক্ষণ দেখছি না।’

ফের তেড়ে ওঠে মেঘনা, ‘তো? কী করে এরকম বেআক্কেলে একটা কথা বলতে পারলে তুমি! তিতলির বিয়ে!‌ আমার নিজের একমাত্র মামাতো বোন, আর তোমার যুক্তি কী, না, বৃষ্টি হচ্ছে তাই নাকি যাওয়া ক্যানসেল করা উচিত!‌’

ঋক বলতে যায়, ‘না, মানে, তা না…’ সঙ্গে সঙ্গে তাকে থামিয়ে দিয়ে মেঘনা বলতে থাকে, ‘সেজমামা, মাইমা কী মনে করবে একবার ভেবে দেখেছ? কবে থেকে গিয়ে ওখানে থাকার কথা, ওদের সঙ্গে বিয়ের শপিংয়ে বেরোনোর কথা। সব তো গেল!‌ একটা ছুটিও তো ম্যানেজ করতে পারলে না! আজ আইবুড়ো ভাতে দুনিয়াসুদ্ধু আত্মীয়স্বজন আসবে, কালই কতজন এসে গেছে, দু–‌দুটো বাড়ি সেজমামা ভাড়া নিয়ে রেখেছে, আর আমরা বৃষ্টি বলে বাড়ি বসে ভ্যারেন্ডা ভাজব! শেষ মুহূর্তে ব্যাগড়া দিতে এসেছ! কী মনে করেছটা কী! আগে থেকে যাইনি বলে এমনিতেই তিতলি ফোনে একগাদা কথা শুনিয়ে দিয়েছে। শোনানোরই কথা। আমার বিয়েতে ও এক মাস আগে থেকে সব ফেলে এসে পড়ে ছিল। কত কাজ করে দিয়েছে। বাবি–মামমাম যা বলেছে, সব হাসিমুখে করে দিয়েছে। আমার সঙ্গে কতবার শপিংয়ে বেরিয়েছে। আর আমি! ওর বিয়েতে কোনও কাজেই লাগতে পারলাম না। শুধু তোমার জন্যে। তোমার এই সংসারের জোয়াল ঠেলতে গিয়ে এমনিতেই আমার সব আনন্দ মাটি হয়ে গেছে। ও তো বলবেই। বেশ করেছে বলেছে। আরও বলবে। বৃষ্টির দোহাই দিচ্ছ এখন!‌ এর পরে আমি আর কোনওদিন ওদের সামনে গিয়ে দাঁড়াতে পারব! তোমার নিজের কাছের কারও বিয়ে হলে দেখতাম কী করতে! বৃষ্টি দেখিয়ে দিয়ে ঘরে শুয়ে নাক ডেকে ঘুমোতে, নাকি ঠিক এতক্ষণ হাজির হয়ে যেতে! ছি ছি, তোমাকে ভরসা করাটাই আমার ভুল হয়েছে। এখন তিতলিটার বিয়েটাই মিস করব আমি!’

গড়গড় করে একগাদা ক্ষোভ উগড়ে দিয়ে সোফা থেকে উঠে কাঁদতে কাঁদতে শোবার ঘরে ঢুকে গেল মেঘনা। পিছন পিছন দৌড়ে এল ঋক। রাগে গজগজ করতে করতে বিছানার ওপর থেকে গোছানো জিনিসপত্তর তুলে নিয়ে ঘরময় ছুঁড়ে ফেলতে শুরু করল মেঘনা। কী করে এখন ম্যানেজ দেবে, বুঝতে পারছে না ঋক। মেঘনার চোখ দুটো যেন এখন আগুনের গোলা!‌

সত্যিই, একেবারে বিলো দা বেল্ট হিট করেছে মেঘনা। ওর কড়া কড়া বাক্যবাণের কী জবাব দেবে ঋক! একেবারে মোক্ষম সব যুক্তি! অন্য সময় হলে বৌকে খেপিয়ে দিয়ে তার এই রাগী রাগী চেহারাটা বেশ তারিয়ে তারিয়ে উপভোগ করা যেত। মেঘনার এই ফুটন্ত চেহারাটা বেশ ভালোই লাগে দেখতে ঋকের। রাগের মধ্যেও একটা মিষ্টি মিষ্টি ব্যাপার খুঁজে পায় ঋক। সেটা প্রাণ ভরে দেখার লোভ থাকে তার। আদর করে রাগটাকে গলিয়ে জল করে দেওয়ার ইচ্ছে হয়। কিন্তু আজ ব্যাপারটা সত্যিই বেশ সিরিয়াস জায়গায় পৌঁছে গেছে। ব্যাপক খচে আছে এখন তার বৌ। এখন কিছু বলা মানেই জাস্ট আগুনে ঘি ঢালা!‌ সেটা বোকামি হবে। পাগলিটা শেষে কী করতে কী করে বসবে, হাল সামলানো মুশকিল হয়ে যাবে!

সাতপাঁচ ভাবতে ভাবতেই ঋকের মুখ ফসকে যেন বেরিয়ে আসে, ‘এখান থেকে বজবজে যেতে দুবার ট্রেন পাল্টাতে হবে জানোই তো। এতটা রাস্তা, ওদিকে কাল রাতেই টিভিতে বলেছে দুর্যোগ নাকি আরও বাড়বে। কোত্থেকে শালা চুলবুল না কী একটা নিম্নচাপ এসে হাজির হয়েছে!’

গুছিয়ে কথা বলবে কী ঋক, শুরু করতেই ছ্যাঁক করে ওঠে মেঘনা। নমস্কারের ভঙ্গিতে দু’হাত জোর করে ঋকের সামনে এসে বলে, ‘ঘাট হয়েছে বাবা! তোমাকে যেতে হবে না। কিন্তু আমি তো আর সব ছেড়েছুড়ে তোমার বাড়িতে সংসার ঠেলতে বসে থাকতে পারব না। তুমি সারাদিন ভালো করে ঘুমিয়ে নাও। ছুটি তো নেওয়াই আছে। শুধু দয়া করে কীভাবে যেতে হবে একবার বলে দিলে ভালো হয়। আমি গুনুকে নিয়ে একাই চলে যেতে পারব। তিতলির বিয়েটা তো একদিনই হবে। বৃষ্টি দেখিয়ে তোমার চলতে পারে, আমার চলবে না।’

এবার সত্যিই প্রমাদ গোনে ঋক। কথাটা পাড়ার আগে সে ভেবেছিল, ভালো করে বুঝিয়ে বলতে পারলে হয়ত মেঘনা ঠিক বুঝবে পরিস্থিতিটা। এইরকম ওয়েদারে মেয়ে–বৌকে নিয়ে এতটা দূরের রাস্তা পাড়ি দেওয়াটা যে সত্যিই রিস্কের ব্যাপার, সেটা মেনে নেবে। ট্রেনের গোলমাল থাকতে পারে, ঠিকঠাক ট্রেনই চলছে না হয়ত সব সেকশনে। হয়ত জলের তলায় লাইন ডুবে আছে কোথাও! এমন একটানা তেড়ে বৃষ্টিতে সেরকম হওয়াটা অস্বাভাবিক নয়। ফলে একগাদা ঝামেলা ফেস করতে হতে পারে রাস্তায় বেরোলে। তাই ঋক ভেবেছিল যদি আজকের দিনটা কোনওভাবে কাটিয়ে দেওয়া যায়, তা হলে কাল ভোর ভোর বেরিয়ে পড়বে ওদের নিয়ে। না হয় আইবুড়ো ভাতটা ফসকে যাবে, কিন্তু বিয়েটা তো অ্যাটেন্ড করা যাবে, তাছাড়া বৌভাত তো আছেই। কিন্তু ওর কথা শুনে মেঘনা যে এরকম খেপে ফায়ার হয়ে যাবে, সেটা মাথায় আসেনি তার। আসলে মেয়েটা তো খুব মুডি। আর মামার বাড়ির সঙ্গে ওর সম্পর্কটাও খুব শক্তপোক্ত, ঋক জানে। মেঘনার বড়মামা বিয়েথা করেননি। মেজমামা ছেলেবেলাতেই অ্যাক্সিডেন্টে মারা যান। ছোটমামার এক ছেলে, সিঙ্গাপুরে চাকরি করতে গিয়ে সেখানেই এক কলিগকে বিয়ে করে থিতু হয়ে গেছে। বাকি এই সেজমামা, তাঁর আবার একমাত্র মেয়ে তিতলি। মামার বাড়ির দিক থেকে সামনে আর কারও বিয়ে–‌থার ব্যাপার নেই। সে দিক থেকে দেখলে তিতলির বিয়েতে সব আত্মীয়স্বজন এক হয়ে বেশ জমাটি একটা গেট টুগেদার হবে। তিতলির সঙ্গে মেঘনার সম্পর্কটাও বোন কাম বন্ধুর মতো। খুব ভাব দুজনের। মেঘনার থেকে বছর দুয়েকের ছোট তিতলি। ইদানীং সময়ের অভাব, কাজের চাপে দু’তরফে তেমন একটা যাতায়াত না থাকলেও ফোনাফুনি চলে নিয়মিতই। সুতরাং মেঘনার এই রিঅ্যাকশনটা খুব ন্যাচারাল। এ সবই তার জানা, কিন্তু এতটা গভীরে ভাবেনি ঋক। মেঘনার এটা একেবারে ভিতরের টান! ঋকের নিজের মামাদের সঙ্গে সম্পর্কটা বেশ আলগা হয়ে গেছে অনেক দিন হল, নানা কারণে কেউ আর কারও তেমন খোঁজখবরও রাখে না। কিন্তু সকলের ক্ষেত্রে তো এরকম ঘটে না। বরং উল্টোটাই বেশি হয়। এমনকি ছিঁড়ে যেতে যেতেও, আলগা হয়ে গেলেও কোথাও একটা সুতোটার জোর থাকে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই। আর তিতলিদের পরিবারে সেটা যে বেশ পোক্ত বাঁধনে ধরা আছে, সেটা তো সে দেখে আসছে বিয়ের পর থেকেই।

না, সত্যিই বাড়াবাড়ি করে ফেলেছে সে। কেন যে এমন ক্যাজুয়াল হতে গেল হঠাৎ! আসলে অফিসে সাতদিনের একটা ই এল–এর দরখাস্ত করেছিল ঋক, মঞ্জুর হয়নি। ফলে বিয়ের তিন/চারদিন আগেই যে সেজমামার বাড়ি যেতে চাইছিল মেঘনা, সেটা আর হয়ে ওঠেনি। ওই প্ল্যানটা ভেস্তে যাওয়াতে খুব একটা আপত্তি বা ঝামেলা অবশ্য করেনি মেঘনা। ঋকের অফিসের ব্যাপারটা বুঝে ব্যাপারটা মেনেই নিয়েছিল। সে জন্যে ঋক ভেবেছিল এই প্রস্তাবটাও হয়ত সহজে পাস হয়ে যাবে। প্রস্তাবটার মধ্যে যে একটা খিঁচ আছে, সেটা অবশ্য তার বেশ ধারণা ছিল। তবুও ক্যাজুয়ালি সেটা প্লেস করতে গিয়েছিল। তাতে যে এমন একটা সিন ক্রিয়েট হবে, সেটা অবশ্য একবারের জন্যেও মাথায় আসেনি। মানে এই যে পুঁচকেটাকে নিয়ে একাই বজবজে রওনা দেওয়ার কথা বলছে— এটা তো ওর কাছে একেবারেই অসম্ভব একটা ব্যাপার! তবু যে সাহস করে ঋকের মুখের ওপরে কথাটা বলে দিল মেঘনা, এতেই বোঝা যায় কতটা সিরিয়াস ও। মফস্‌সলে জন্ম, বেড়ে ওঠা, স্কুলকলেজ, মায় বিয়ে পর্যন্ত পাশের পাড়ায়— মেঘনার গোটা জগৎটা ছোট্ট একটা শহরতলিকে ঘিরেই থেকে গেছে। বাইরের বিশাল জগৎটাকে ওর একফোঁটাও চেনা নেই। বিয়ের আগে মা–বাবা, বিয়ের পরে ঋক— এদের হাত ধরেই কলকাতা বা দূরদূরান্তে মাঝেমধ্যে যেটুকু যাতায়াত। ট্রেন–বাসের রুট চেনে না, শিয়ালদায় নেমে ফের সাউথ থেকে বজবজের ট্রেন ধরা, নুঙ্গিতে নেমে ফের অটো বা রিকশা— তার ওপর এরকম একটা বিশ্রী ওয়েদার, বৃষ্টি— সব মিলিয়ে গোটা বিষয়টা যেখানে ঋককেই বিস্তর ভাবাচ্ছে, সেখানে ও কিনা একাই অত বড় একখানা ট্রলি নিয়ে, মেয়েকে কোলে নিয়ে অত দূরে বোনের বিয়েতে গিয়ে হাজির হতে চায়! মেঘনার কাছে তো গোটা ব্যাপারটাই একটা জটিল অঙ্কের মতো! সাতপাঁচ না ভেবে বলেছে ঠিকই, কিন্তু ঋক তো আর সেটা হতে দিতে পারে না! কোনও প্রশ্নই নেই! নতুন করে সব কিছু আবার তাকে সামলে নিতে হবে এখুনি, বুঝতে পারে ঋক। বৌয়ের এমন অন্ধকার মুখ দেখা তার একদম না–পসন্দ! মনে মনে আরেক প্রস্থ ওয়েদারকে গালাগাল দিতে দিতেই সে ভাবতে থাকে কী করা যায়, কী করা যায়!

গুম মেরে বিছানার ওপর বালিশে মুখ গুঁজে উপুড় হয়ে পড়ে আছে মেঘনা। শরীরটা কেঁপে কেঁপে উঠছে। খুব কাঁদছে মেয়েটা। ওর মান ভাঙাতে হবে আগে। সিচুয়েশন যেমনই হোক, নিজেকে একেবারে স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা করে ঋক। পুরনো দিনের একটা পছন্দের গান বেশ জোরে গাইতে গাইতে বিছানার দিকে এগিয়ে যায় সে। ‘আকাশ এত মেঘলা যেও না কো একলা…’ প্রেম করার দিনগুলোয় ঋকের গাওয়া কয়েকটা গানের মধ্যে এটা দুজনেরই খুব প্রিয় ছিল। পুরনো আমলের হলেও। বৃষ্টি আসবে আসবে এমন অবস্থায় মেঘনাকে আরও কিছুটা সময় আটকে রাখার ছলে কলেজের মাঠে পা ছড়িয়ে বসে গানটা যে কতবার শুনিয়েছে ঋক ওকে। মেঘনা মিটিমিটি হাসত, কিন্তু ভিজেটিজে বাড়ি ফিরলে মামমাম যে তাকে একেবারে আস্ত খেয়ে ফেলবে, সেটাও ভয়ে ভয়ে বারবার বলত ঋককে। কিন্তু মেঘনার সে কথায় পাত্তা না দিয়ে ঋক ওই গানটাই ফের গেয়ে উঠত। গান শেষ করে বলত, ‘আরে বাবা, ভেজোই না একটা দিন একটু আমার সঙ্গে! মায়ের বকুনির থেকে এর দাম যে অনেক বেশি, তবে তো সেটা বুঝবে!’ এই গানটাকেই আজ ফের তার অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করতে চায় ঋক। এই গানেই তার বৌয়ের মান এখন ভাঙাতে হবে তাকে।

মনে মনে একটা সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলার পর বেশ ফুরফুরে মেজাজেই গানটা ধরেছিল ঋক। কিন্তু সেটা কানে যেতেই বালিশ থেকে মুখ তুলে জলে ভরা চোখ নিয়েই তার দিকে ভুরু বেঁকিয়ে কড়া নজরে তাকাল মেঘনা। উরিব্বাস, ব্যাপক খেপে আছে তো তার গিন্নি। না, গানটা বোধহয় এখন ঠিক সুট করবে না। বুঝতে পেরে চেপে গেল ঋক। অন্য রাস্তা ধরতে হবে। সোজা বিছানায় মেঘনার পাশে ঘনিষ্ঠ হয়ে বসে পড়ল সে। দু’গাল বেয়ে শ্রাবণের অঝোর ধারা বইছে। মেঘনাকে কাছে টেনে নিয়ে পরম আদরে সেই জল মুছিয়ে দেয় ঋক। ফুঁপিয়ে কেঁদে চলেছে মেঘনা। চোখের পাতা ভিজে ভারী, লাল। নাকের পাটা ফুলে ফুলে উঠছে। লালের মধ্যে নাকের বাঁদিকের এক কুঁচি হীরের নাকছাবিটা চিকচিক করে জ্বলছে যেন। সেদিকে লোভীর মতো চেয়ে থাকে ঋক। মিটিমিটি হাসি তার ঠোঁটের কোনায়। যেন মজা দেখছে। ফের খেপে উঠল মেঘনা, ঋকের হাত দুটো তার গাল থেকে এক ঝটকায় ছুঁড়ে সরিয়ে দিতে গেল সে। সামলে নিয়ে তার নাকটা ধরে একটু নাড়িয়ে দিয়ে ঋক বলল, ‘কী হল! এখন তুমি শুয়ে শুয়ে সময় নষ্ট করছ! কত বেলা হল খেয়াল আছে? ওঠো ওঠো। আমি চট করে চানটা সেরে আসছি। ঠিক আধ ঘণ্টার মধ্যে কিন্তু বেরিয়ে পড়ব আমরা। একটা ওলা বুক করে দিয়েছি বুঝলে! ট্রেনের আশায় থাকলে ভুগতে হত আজ। তা ছাড়া গাড়িতে গেলে সময়ও অনেক সেভ হবে। নাও, চটপট করো। গুনুকে রেডি করে ফেলো। বেশি দেরি হলে বিয়েবাড়ির মজাটাই মাটি। একমাত্র শ্যালিকার বিয়ে বলে কথা! চুটিয়ে মস্তি করতে হবে।’

কথাগুলো প্লেস করে দিয়েই এক গ্লাস জল চাইল ঋক মেঘনার কাছে। আড়চোখে তাকিয়ে দেখল, গিন্নির চোখে জল, কিন্তু মুখে একগাল হাসি। দৌড়ে গিয়ে ফ্রিজ থেকে একটা জলের বোতল বের করে নিয়ে এসে তার হাতে ধরিয়ে দিল মেঘনা। ঢকঢক করে খানিকটা ঠান্ডা জল গলায় চালান করে একটা বড় হাঁফ ছাড়ল ঋক। আরেকবার বৌকে কাছে টেনে কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিসিয়ে বলে, ‘কেঁদেকেটে লাল হয়ে তোমাকে এখন যা লাগছে না মাইরি! এই অবস্থায় যে কেউ দেখলেই প্রোপোজ করে বসবে শিওর!’

কপট রাগ চলকে ওঠে মেঘনার চোখেমুখে। মুখে বলে, ‘যাও তো! ন্যাকামো করতে এসেছে!‌ যত সব ফালতু কথা!’

‘আরে এটাই একমাত্র খাঁটি কথা! তোমার গালের এই সেক্সি টোলটা দেখে বুড়োহাবড়াগুলো পর্যন্ত কাত হয়ে যায়!  তার ওপর এই ভিজে ভিজে মিষ্টি মুখখানা! উফফ, আমি যে কী করি!’ বলে মেঘনার দিকে তাকিয়ে চোখ মটকায় ঋক।

‘কিচ্ছু করতে হবে না! কফি করে দিচ্ছি। ওটা খেয়ে দয়া করে চান করতে যাও, বুঝলে! ততক্ষণে গুনুকে একটু দুধ খাইয়ে রেডি করে ফেলি।’ বলে টেবিলের কিচেনের দিকে দৌড়য় মেঘনা।

‘আমার জন্যেও একটু রেখো কিন্তু!’ চেঁচিয়ে বলে ঋক। কিচেন থেকে মেঘনার গলা ভেসে আসে— ‘অসভ্য!’

শেয়ার করতে:

You cannot copy content of this page