মুখোশের দেশে

দ্বৈপায়ন মজুমদার

বসন্ত দরজায় উপস্থিত । এই সময় পুরুলিয়াকে দু’হাতে রাঙিয়ে তোলে প্রকৃতি । পলাশ আর শিমুলের রঙে রঙিন এই জেলার পথঘাট । এমনিতেই পুরুলিয়া মানে অরণ্য, পুরুলিয়া মানে ছোট বড় পাহাড়, পুরুলিয়া মানে রুক্ষ প্রান্তর আবার পুরুলিয়া মানে নীলচে জলের খরস্রোতা নদী । যেন কোন শিল্পীর খামখেয়ালে তৈরি এক বিশাল ক্যানভাস । ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা অসংখ্য টিলা, রুক্ষ প্রান্তরের মধ্যে একটা আপন খেয়ালে বয়ে চলা নদী ।

আর এমন জেলায় শিল্প আর শিল্পী থাকবে না তা আবার হয় নাকি ? পুরুলিয়ার ছৌ নাচ তেমনই এক শিল্প । ঋত্বিক ঘটকের এক অসামান্য সৃষ্টি আছে এই ছৌনাচ নিয়ে । পুরুলিয়া জেলার এক অসাধারণ লোক শিল্প ছৌ । শুধু এই রাজ্য না, দেশ এবং দেশের বাইরেও এক নিজস্ব জায়গা আছে এই নাচের । ছৌ শিল্পীরা অনেক কষ্টের মধ্যেও আজও বাঁচিয়ে রেখেছেন এই শিল্পকে । চুড়ান্ত শারীরিক নৈপুণ্য লাগে এমন এক শিল্পের নাম ছৌ নাচ । ছৌ নাচের একটা বিশেষ অংশ এর মুখোশ।

আমাদের এই রূপসী রাজ্যের একটা গ্রামেই তৈরি হয় এই মুখোশ । আগেই বলেছি, ভরা বসন্তে পুরুলিয়ার আকর্ষণ আলাদা । আবার দাপুটে শীত পেরিয়ে গেলেও বসন্তেও রাতের দিকে একটা মিঠে ঠান্ডার পরশ থাকে । এই পরিবেশ উপভোগ করতে হলেও কলকাতার কাছাকাছির মধ্যে পুরুলিয়ার মত জায়গা খুব কম আছে । আর তাই পুরুলিয়া ভ্রমণে গিয়ে প্রকৃতির স্নেহ আদর নিতে নিতে ঘুরে আসা যায় চড়িদা, মুখোশ তৈরির গ্রাম ।

পুরুলিয়া শহর থেকে সড়ক পথে প্রায় দু’ঘন্টা লাগে চড়িদা আসতে । বাগমুন্ডি কাছেই এই গ্রাম । পুরুলিয়া থেকে খয়রাবেরা ড্যাম যাওয়ার পথে পড়বে এই চড়িদা । ছৌ নাচের মুখোশ তৈরি হয় এই গ্রামেই । গ্রামের প্রায় দেড়শোর বেশি বাড়িতে তৈরি হয় এই মুখোশ । কাগজ আর রঙ মিশিয়ে তৈরি এক ম্যাজিক । কত ধরনের কত সাজের মুখোশ । শোনা যায় বাগমুন্ডির রাজা এই মুখোশের প্রচলন করেন । কাগজের উপর আঠা আর রঙ দিয়ে তৈরি হয় মুখোশ ।

তবে ছৌ নাচ শুধু পুরুলিয়ার নয় । ঝাড়খণ্ড আর উড়িষ্যার সামান্য কিছু জায়গাতেও আছে এই শিল্প । এক ধরণের মার্শাল আর্ট আর উচ্ছলতার এক দারুণ মিশেল এই ছৌ নাচ । তবে উড়িষ্যার ছৌ নাচে মুখোশ নেই । তার বদলে ব্যাবহার করা হয় রঙ । তাই মুখোশের জন্য এই গ্রামের গুরুত্ব আলাদা । আসলে ছৌ নাচের মধ্যে দিয়ে যে গল্প বলা হয় তার চরিত্রগুলো ফুটিয়ে তোলে এই মুখোশ । বহু পর্যটক আসেন চড়িদাতে । অনেকের ঘরেই হয়ত ঝুলতে দেখা যায় এই মুখোশ । ঘর সাজানোর এমন উপকরণ সংগ্রহ করেন অনেকেই ।

কলকাতা থেকে একাধিক ট্রেন আছে পুরুলিয়া যাওয়ার । আর সড়ক পথে কলকাতা থেকে গাড়ি করে গেলে ছ’ঘণ্টার কিছুটা বেশি । পুরুলিয়া শহর এবং পুরুলিয়ার বিভিন্ন ট্যুরিস্ট স্পটে সরকারি ও বেসরকারি একাধিক থাকার ব্যবস্থা আছে । গড়পঞ্চকোট থেকে খয়রাবেরা, বড়ন্তি থেকে মাঠা, জেলায় দেখার জায়গা অসংখ্য । তাই সময় পেলে দিন দু’য়েকের জন্য পুরুলিয়া একটু ঘুরে আসুন, দেখুন রুক্ষ পাহাড়, রাস্তার দু’পাশে নিজের খেয়ালে ফুটে থাকা শিমুল, পলাশ আর সঙ্গে অবশ্যই এই মুখোশ গ্রাম ।

ছবি- লেখক 

শেয়ার করতে:

You cannot copy content of this page