রুমালে মুখ মুছে লেখার আগে

৷৷ ভজন দত্ত।।

রুমাল।আপাত নিরীহ একটি শব্দ।সভ্য সমাজের একটি চিহ্ন। পকেটে পকেটে বা হাতে হাতে যা অনায়াসে স্থান লাভ করেছে । রুমাল ও কবিতা এই দুটি শব্দই সাধারণ দৃষ্টিতে তিনটি শব্দ দিয়ে তৈরি হয়েছে।  কবিতা থাক। কবিতাকে পাশ কাটিয়ে  আসুন রুমাল দিয়ে একটু ঘাম মুছে নিন কিংবা মেকাপ একটু ঠিক করে নিন। রু মা ল। তিনটি শব্দ,কি ঠিক আছে তো?বেশ, তবে আর রুমালে মুখ মুছে, বা না মুছে শব্দটিকে এবার ভাঙুন। তবে পাবেন র,উ,ম,আ,ল,অ। ছিল তিন। হলো ছয়।প্রাতঃস্মরণীয়  সুকুমার রায় সেই কবেই তো রুমাল থেকে বেড়াল করেছেন!

এখন  রু নিয়ে আলো না ফেলে, যদি রুমাল থেকে ল সরিয়ে রাখেন, তবে রুমা-কে পাবেন। রুমা! রুমা তো, মা দুর্গারই এক নাম। রু থকে উ খুললেই শুধু ‘র’। যারা বাঁকুড়া ও পুরুলিয়ার ভাষা জানেন, তারা জানেন এই ‘র’ মানে ‘থাক’।ছেলে হয়তো  মায়ের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে কোথাও যেতে চাইছে, মা বললেন,’না,র। র বলছি, র।’

না,না, ‘র’  কিছু আলোচনা করে বিব্রত করার অবকাশ এখানে নেই। ‘র’ খাওয়ার যুগ পেরিয়ে এলেও এই সভ্য সমাজে এখনো অনেকে ‘র’-চায়ে এখনো মজে। সে যে যাতে পারেন মজুন, তাতে আর কার কীইবা এসে যায়!

তো,সেই উ-এর সঙ্গে  মা যোগ করলে হয় উমা। উমা, মা দুর্গার এক অতি পরিচিত  নাম। রুমা ও উমা! পাঠক হাত আপনার। সেটি কপালে ঠেকাবেন, না নাকে বা অন্য কোথাও আঙুল দেবেন সে স্বাধীনতা আপনার।

আবার ‘উ’ বাদে শুধু ‘র’ যোগ করলে হয়,রমা। ‘ল’ এখন থাক। ‘ল’ নিয়ে সাওয়াল জবাবের পর পরেই আসতে পারে, ‘ইয়োর অনার’। তো, রমা তো লক্ষ্মীর আরেক নাম! আবার মা থেকে আকার সরিয়ে রু-এর পাশে ‘ম’ বসলে প্ল্যানট্যান না করেও, কত সহজেই আমরা পেয়ে যাই  একটি রুম। আহা! কত কত রকম ও নাম তার। থাক। পাঠক, আপনি এখন বেডরুমে থাকলে শুয়ে শুয়ে পড়তে পারেন বা নাক ডাকিয়ে ঘুম বা উমম বা যাখুশি করতেই পারেন!

‘রুম’ যদিও ইংরাজি শব্দ, তবুও এখন আমরা আকছার রুম শব্দটি ব্যবহার করি। তাহলে, পাওয়া গেল, রুমা, উমা,রুম ও রমাকে ।

এখন মা থেকে আকার খুলে পরের ল বর্ণকে তার পাশে বসালে পাবেন মল। না না!নাকে রুমাল দেওয়ার মত কিছু হয় নি।বৃক্ষহীন এই পৃথিবীতে এখন তো মলে মলেই নতুন সংসারের বীজ ছড়ানো হচ্ছে। এখন এই মলের বহুবিধ মানে । উমা,রমা বা রুমা, রুম থেকে বেরিয়ে সোজা মলে যেতেও পারে কিংবা রুমে বসেও মলত্যাগ করতে পারে,কিংবা মল ত্যাগ করে রুমে ফিরে রেস্টও করতে পারে।আবার ওরা পায়ে মল পরে ঘুরে বেড়াতেও পারে কিংবা দুটি মলকে পাশাপাশি বসিয়ে মলমল শাড়ি বা কাপড় জাতীয় কিছু ব্যবহার করতেও পারে। কী করবে, সেটা নিয়ে রুমা,উমা বা রমা-ই ঠিক করুন।আমাদের শুধু শুধু ভেবে মাথা নষ্ট করে কী লাভ বলুন!

আবার রুমাল থেকে প্রথম শব্দ রু সরালেই হয় মাল, আর মা সরালে হয় রুল। নিন,ঠেলা সামলান।না,রুলের গুঁতো খেতে হবে না,এবার তবে আপনি কী করবেন?

রমা, উমা, রুমা, মাল এবং রুল, এবং মা, সবই হতে পারে।শব্দই তো পরম ব্রহ্ম!ব্রহ্ম তো নির্গুণ পরমাত্মা! আমাদের নিবাস তো এক ব্রহ্মডাঙায়। সেখানে, আমরা ক্ষুদ্র, অতি ক্ষুদ্র মানব।তারচেয়ে ভালো,  আসুন খোসা ছাড়াই শব্দের।

আপনি যখন শব্দের খোসা ছাড়াচ্ছেন,তাকে দেখছেন, তখন কতটা দেখবেন, কতটা দেখতে পারেন,ভাবুন।ভাবুন না, এক-একটি শব্দের এক-একটি অক্ষর কোনটি নারী বা পুরুষ এবং তারা সকলেই গাছের মতই নগ্ন। আচ্ছা নগ্ন হলেই কী সব দেখা হয়! ঐ যে গাছটি দাঁড়িয়ে আছে দূরে বা কাছে, প্লিজ একবার তাকান তার দিকে। কি,আপনি কী গাছের  শেকড় দেখতে পাচ্ছেন?মাটি না খুঁড়ে, গাছ উপড়ে না ফেলে,একটি জলজ্যান্ত গাছের শেকড় দেখার জন্য চাই তৃতীয় নয়ন। ভাবুন,আপনি শরীরের ওপরে সব পরে আছেন তবুও আপনাকে কেউ কেউ দেখে নিচ্ছেন ঐ গাছের শেকড় দেখার মতো করে।আর নগ্ন করলেই কি আমরা সবকিছু দেখতে পাই? না,দেখা সম্ভব?

পৃথিবীর আলোর মতোই  নগ্ন শরীর একেক সময় একেক রকম। দাহ করার আগে শবদেহ থেকে শেষ বস্ত্রখণ্ডটুকু সরিয়ে ফেলার দৃশ্য যারা দেখেছেন, তারা জানেন,সেই  নগ্নতা এবং নারী ও পুরুষ একান্তে মিলিত হওয়ার নগ্নতা তা কখনোই এক হতে পারে না।

পৃথিবীতে মানুষ নামের প্রাণিটি তিনটি চোখ নিয়ে জন্মায়।আমরা বাইরে থেকে দেখি তার দুটি চোখ।সাহিত্যে তাই নিয়ে এত এত বর্ণনা হয়ে গেছে,তা নিয়ে আর নতুন কিছু লেখার আগে ভাবতে হবে। ধীরে ধীরে মানুষ অনেক চর্চা ও সাধনা এবং ভাবনার পর নতুন কিছু পায়। পায় তার তৃতীয় নয়ন , তা দিয়ে মনের আলোতে সে দেখতে পায়। সকলেরই যে ঐ নয়ন উন্মোচন হয়,সকলেই যে ঐ নয়ন দিয়ে দেখতে পান সেকথা বলা যায় না। ঐ নয়ন থাকে মানুষের অন্তরে।তা বিকশিত করতে হয়।তার জন্য, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘অন্তর মম বিকশিত করো অন্তরতর হে’ সংগীতটি না গাইলেও চেষ্টা করতে হয়।এই চেষ্টাকে প্রকৃষ্ট থেকে উৎকৃষ্টে নিয়ে যাওয়ার পথে যা কিছু আছে সে সকলি অন্তর দিয়ে উপলব্ধি করতে হবে। একজন কবিকে নিরন্তর এই উপলব্ধির ‘ট্রায়াল এন্ড এরর’ মেথডের মধ্যে দিয়ে যেতে হয়। যেভাবে বাল্মিকী একদিন মরা মরা বলতে রাম উচ্চারণ করতে পেরেছিলেন,যেভাবে বিষাদ তাকে দিয়ে সৃষ্টি করিয়ে নিয়ছিলো,’মা নিষাদ…’ বলে সেই বিখ্যাত শ্লোক। এভাবেই কবি কবিতা লেখেন।কবিতা ভাবেন, কবিতা যাপন করেন, একজন সাহিত্যিক যখন সাহিত্য সৃজন করেন, তখন তিনি তার মনের রু দিয়ে সেই আলো জ্বালার কাজটি করেন।তিনি তৃতীয় নয়নের অধিকারী হলে অনেকের থেকে বেশি দেখবেন, ভাবাবেন। সমাজের সকল অন্ধকার থেকে আলো ছিঁড়ে ছিঁড়ে এক একটি  সৃষ্টি পরম মমতায় অক্ষরে অক্ষরে ভরে দেন।তারা কেউ স্বীকৃতি পান, কেউ আজীবন অস্বীকৃত হয়েও জেগে থাকেন, জাগিয়ে রাখেন, অক্ষরকর্মীদের মধ্যে বেঁচে থাকেন।

শেয়ার করতে:

You cannot copy content of this page