জন্মশতবর্ষে সত্যজিৎ প্রসঙ্গে
বিগত ২ মে ‘দেশ’ পত্রিকায় সত্যজিৎ রায় সম্পর্কে সায়ম বন্দ্যোপাধ্যায়ের রচনাটি এত মামুলী, এত অগভীর, এত অপরিণত, এত আজগুবী, এত অর্ধ-সত্যদুষ্ট, এত ক্লিশে যে এই মর্যাদাপূর্ণ সংখ্যার পক্ষে বেমানান।
(১) প্রথমেই সত্যজিৎ ও গোদারের ছবির তুলনা। সায়মবাবুর বক্তব্য, ছবির চিত্রভাষার প্রেক্ষিতে গোদার কোন আপস করেননি। কিন্তু সত্যজিৎ করেছিলেন। সত্যজিৎ চলচ্চিত্রের প্রথাগত নিয়মগুলি ভাঙতে পারেন নি। কিন্তু সত্যজিৎ করেছিলেন। কারণ সত্যজিৎ তাঁর প্রতিটি ছবিতে একটি ‘গল্প’ বলেছেন। এই ব্যাপারে তিনি মৃণাল সেনের ২০১৫ সালের একটি বক্তব্যকে হাতিয়ার করেছেন। যাঁর কথায়, সত্যজিৎ ‘সিনেমার ভাষার নতুনত্ব’কে মানেন নি। কিন্তু চলচ্চিত্র শিল্পের ইতিহাসে চ্যাপলিন, আইজেনস্টাইন বা বার্গম্যানের চিরায়ত ছবিতে প্রসঙ্গে ১৯৬৯ সালেই সত্যজিৎ লেখেন ‘চিত্রভাষার ব্যাপারে বিপ্লবের পুরোধা হলেন জাঁ লুক গোদার।‘ ওই প্রবন্ধেই পরে লিখেছিলেন, ‘বিদেশের অনেক পরিচালকই আজকাল গোদারের মতো আধুনিক জীবনের সমস্যা নিয়ে ছবি তুলছে, কিন্তু দুঃখের বিষয়, এঁরা প্রায় সকলেই গোদারেরই অন্ধ অনুকরণ করছে। এদের না আছে গোদারের পাণ্ডিত্য, না আছে তাঁর Wit, না আছে চলচ্চিত্রের কনভেনশন সম্পর্কে ধারণা।‘ তাই এই বিষয়ে সত্যজিৎ সম্পর্কে সায়মবাবুর মতামত অর্ধ সত্য কণ্টকিত।
(২) এবার ‘সোনার কেল্লা’ ছবির প্রসঙ্গ। সায়মবাবুর বক্তব্য, ‘এই গল্পে সত্যজিৎ ‘ইরর্যাশনালকে’ স্বীকৃতি দিয়ে ‘চোখে পড়ার মতো বৈপরীত্য’ সৃষ্টি করেছেন। কারণ ছবির নায়ক ;জাতিস্মর’। এখানেও সায়মবাবুর বক্তব্যের অস্ত্র (যদিও ভোঁতা) মৃণাল সেনের মতামত। কারণ সত্যজিৎ নাকি ছবিতে ‘ধর্মীয় কুসংস্কারের’ শিকার। এই বক্তব্য ভিত্তিহীন ও অসার। কারণ জীবনের দিনান্তবেলাতেও সত্যজিৎ ‘গণশত্রু’ থেকে ‘আগন্তুক’ ছবিতে ধর্মীয় মৌলবাদ প্রাতিষ্ঠানিক ধর্ম এবং আচার-কুসংস্কারের বিরুদ্ধে সোচ্চার ছিলেন। ‘সোনার কেল্লা’ ছবির এই বিস্ময় বালক কী পূর্বজন্মের কথা বলে? এই নিতান্ত মধ্যবিত্ত পরিবারের মুকুল ধর কি আসলে ‘জাতিস্মর’? সত্যজিৎ এই অজানা জগৎ সম্পর্কে কোন স্পষ্ট নিদান দেন নি।
(৩) সায়মবাবুর মতে, সত্যজিৎ ‘রেনেসাঁস পুরুষ’। ১৯৪৬ সালে ঐতিহাসিক সুশোভন সরকার তাঁর ‘Notes on the Bengal Renaissance’ গ্রন্থে ‘বাংলার নবজাগরণ’ কথাটি বলেছিলেন। কিন্তু জীবনের শেষে এসে ১৯৭৯ সালে এই পুস্তকের ‘Supplementary Notes’ তিনি স্বীকার করেন যে, উনিশ শতকের এই আরোপিত ‘নবজাগরণ’ বা ‘পুনর্জন্মের’ সঙ্গে বাংলার শিকড়ের সম্পর্ক ছিল একেবারেই ক্ষীণ। তাই পরবর্তী সময়ে সমাজ বিজ্ঞানীরা বাংলার এই পর্বের নাম দিয়েছেন ‘সংস্কার আন্দোলন’। তাছাড়া ইউরোপীয় রেনেসাঁসের প্রধান জ্যোতিষ্ক লিওনার্দো দ্যা ভিঞ্চিকে বিশ্বের রেনেসাঁস প্রতিভার মডেল মনে করা ভুল। মিকেলঞ্জেলো, শেকসপিয়ার বা মাকিয়াভেলি একটি বিষয়েরই মহান প্রবক্তা ছিলেন। সত্যজিতের বহুমুখী প্রতিভার জন্য তাঁর গায়ে ‘রেনেসাঁস’এর লেবেল লাগানো অনৈইতিহাসিক এবং হাস্যকর ‘ক্লিশে’।
(৪) সায়মবাবুর অভিমত সত্যজিতের সাহিত্যে যৌনতা না থাকার কারণ তাঁর ‘ব্রাহ্ম-পিউরিট্যানিজম’। এই বিষয়ে তিনি বোধহয় চিদানন্দ দাশগুপ্তের কথায় প্রভাবিত। কারণ, চিদানন্দবাবুর ভাষায় সত্যজিতের মানসে প্রাধান্য পেয়েছে ‘স্বাধীনতার পরবর্তীকালীন ক্ষয়িষ্ণু ব্রাহ্মসম্প্রদায়ের শুচিবায়ুগ্রস্ত জড়তা’। সত্যজিৎ ‘কলকাতা’ পত্রিকাকে দেওয়া একটি সাক্ষাৎকারে তীব্র শ্লেষের সঙ্গে বলেছিলেন, ‘চিদানন্দ আমার সম্বন্ধে যে লেখা লিখেছে… তাতে সত্যজিৎ রায় কেন এরকম হলেন, তাঁর মিডল ক্লাস, হেনতেন, তাঁর ব্রাহ্ম আপব্রিঙ্গিং, পঁচিশ রকমের কথা আছে’। সায়মবাবুর মতে, সত্যজিতের কয়েকটি ছবিতে, ‘যৌনতার কিছুটা ইঙ্গিত’ আছে মাত্র। তাহলে ‘পিকু কী?’ তাছাড়া ‘অরণ্যের দিনরাত্রি’ ছবিতে সঙ্গমদৃশ্য বা ‘ঘরে বাইরে’তে পরপর চুম্বনদৃশ্য সায়মবাবুর অপরিণত বক্তব্য নশ্বাৎ করে।
(৫) সত্যজিতের ‘আর্যশেখরের জন্ম ও মৃত্যু’ একজন প্রতিভাধর প্রডিজির ‘আত্মদর্শন, পারিবারিক শিকড়ের অনুসন্ধান এবং জিনতত্ত্ব ও সূর্যের অভিকর্ষ সম্পর্কে’ গবেষণা এবং অবশেষে তাঁর মর্মান্তিক মৃত্যুর উপাখ্যান। সায়ম বাবুর মতে, আর্যশেখর সত্যজিতের ‘অল্টার ইগো’। আর্যশেখরের বাবা একজন নিতান্ত বাস্তববাদী, ঘোর অর্থলোলুপ উকিল। তাই আর্যশেখরের সংশয় হয়, সে কি আদৌ এরকম একজন নিকৃষ্ট, গড়পড়তা, কেজো পেশাদার উকিলের সন্তান? বাবা সৌম্যশেখরের কাছে এই প্রশ্ন তোলায় আর্যশেখর প্রহৃত হয়। কত বড় আহাম্মক হলে সত্যজিতের সঙ্গে কেউ আর্যশেখরের পিতা ও তাঁর পারিবারিক পটভূমির তুলনা কতে পারে? সত্যজিতের পিতা অকালপ্রয়াত জিনিয়াস সুকুমার রায়সৃষ্ট ‘ননসেন্স রাইম’-এর তুলনা সারা বিশ্বে বিরল। সুকুমার রায় অকালে প্রয়াত হলে বাঙালির ইতিহাসের সেই মহাকাব্যিক ট্র্যাজিডির ধারাভাষ্য দিয়ে গেছেন স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ। সত্যজিতকে নিয়ে এই ধরনের শিশুসুলভ মস্করা আর কতদিন চলবে?
অরূপ মুখোপাধ্যায়