সাঁওতাল-হুল কথা
লিখছেন অরুণোপল শীল
স্বাধীনতা দিবস বলতে আমরা শুধু ১৫ই আগস্ট বুঝি। কিন্তু ১৬০ বছর আগে ১৮৫৫-৫৬ সালে পশ্চিমবঙ্গের ভগনাডিহি গ্রামে বীর সিধু-কানুর নেতৃত্বে এ বিদ্রোহ হয়েছিল। ইতিহাসে যা সাঁওতালি ‘হুল’ বা সাঁওতাল বিদ্রোহ নামে পরিচিত। শাসনব্যবস্থার ভিত শক্ত করতেই ইংরেজ শাসক গোষ্ঠী অন্যায়, শোষণ ও নিপীড়নের পথ বেছে নিয়েছিল এবং তাদের আক্রমণ থেকে আদিবাসী সাঁওতাল জনগোষ্ঠীও বাদ যায়নি।
সেদিনের সাঁওতালি হুল ছিল ইংরেজ শাসক গোষ্ঠী ও তাদের দালাল জমিদার শ্রেণি, সুদখোর মহাজন, নিপীড়ক প্রশাসনের বিরুদ্ধে সংঘটিত প্রথম শক্তিশালী সশস্ত্র প্রতিবাদ। সিপাহি বিদ্রোহের কিছুদিন আগেই এই বিদ্রোহ সংঘটিত হয়। সাঁওতালি জাতি তার নিজ ভূমিতে স্বাধীন সাঁওতালি রাজ্য প্রতিষ্ঠার দাবিতে গর্জে উঠেছিল সেদিন। সিধু-কানুর গ্রাম ভগনাডিহিতে কুড়ি,পঁচিশ হাজার সমবেত সাঁওতালি বিশাল সমাবেশে এই বিদ্রোহের ঘোষণা করে।এই বিদ্রোহ দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়ে। নিম্নবর্গের হিন্দু, ডোম, তেলীসহ অন্যান্য জাতিসত্তার মানুষেরাও শোষণ থেকে মুক্তির আশায় এ বিদ্রোহে অংশ নেয়। ১৮৫৫-৫৬ সালে সাঁওতালি ‘হুল’ ইংরেজ শাসনের শক্ত ভিত্তিমূলে আঘাত হানে।
মহাজন ও দাদন ব্যবসায়ীদের শোষণ-নিপীড়ন এবং ব্রিটিশ পুলিশ-দারোগাদের অত্যাচারে নিষ্পেষিত সাঁওতাল জনগণের মুক্তির লক্ষ্যে ১৮৫৫ সালে সিধু মুরমু ও কানু মুরমু এবং দুই ভাই চান্দ ও ভাইরো ভারতের নিজ গ্রাম ভগনাডিহতে এক বিশাল সমাবেশের ডাক দিয়েছিলেন। সাঁওতাল জনগণ মহাজন ও দাদন ব্যবসায়ীদের নিপীড়নে নিঃস্ব হয়ে পড়েছিল সে সময়। মহাজনের ঋণের ফাঁদে পড়তে হতো বংশপরম্পরায়। স্ত্রী-পুত্ররা মহাজনের সম্পত্তি হয়ে পড়ত। পুলিশের সহায়তায় তাদের গবাদিপশু ও জমি কেড়ে নেওয়া হতো। প্রতিবাদ করলে পাল্টা গ্রেপ্তারের শিকার হতো; এমনকি সে সময় ব্রিটিশ সরকারের উল্টো খড়্গ নেমে আসত তাদের ওপর।
এই বিদ্রোহে সিধু ও কানু নিজেদের প্রাণপাত করে। বিদ্রোহের নেতা সিধু-কানু গ্রেপ্তার হলে বিদ্রোহীরা ছত্রভঙ্গ হয়ে যায়। তাদের মনোবল ভেঙে পড়ে। ইংরেজদের নথি থেকে জানা যায়, সেদিন বিদ্রোহ দমনের নামে বহু গ্রাম আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দেওয়া হয়। হাজার হাজার সাঁওতালকে গ্রেপ্তার করে জেলে ঢোকানো হয়।
৩০ জুন ঐতিহাসিক সাঁওতাল হুল দিবস বা সাঁওতাল বিদ্রোহ দিবস নামে পরিচিত। ১৮৫৫ সালেই যে সাঁওতাল বিদ্রোহের সূচনা তা নয়, এর আরও ৭৫ বছর আগে ১৭৮০ সালে সাঁওতাল জননেতা তিলকা মুরমুর (যিনি তিলকা মাঞ্জহী নামে পরিচিত) নেতৃত্বে শোষকদের বিরুদ্ধে সাঁওতাল গণসংগ্রামের সূচনা হয়। তিনি সর্বপ্রথম সাঁওতাল মুক্তিবাহিনী গঠনের মাধ্যমে পাঁচ বছর ধরে ইংরেজ শাষকদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম চালান। ১৭৮৪ সালের ১৭ জানুয়ারি তাঁর তিরের আঘাতেই ভাগলপুরের ক্লিভল্যান্ড প্রাণ হারান। ১৭৮৫ সালে তিলকা মাঞ্জহী ধরা পড়েন এবং তাঁকে ফাঁসি দেওয়া হয়। পরবর্তী সময়ে ১৮১১ সালে বিভিন্ন সাঁওতাল নেতার নেতৃত্বে দ্বিতীয়বার গণ-আন্দোলন গড়ে তোলা হয়। এরপর ১৮২০ সালে তৃতীয়বার এবং ১৮৩১ সালে চতুর্থবার সাঁওতাল গণসংগ্রাম গড়ে ওঠে।
অবশেষে শোষণহীন স্বরাজ প্রতিষ্ঠার জন্য ১৮৫৫ সালের ৩০ জুন ৩০ হাজারেরও অধিক সাঁওতালকে নিয়ে সমাবেশ এবং কলকাতা অভিমুখে প্রথম গণযাত্রা করেন বীর সিধু-কানুরা। ভারতীয় উপমহাদেশের ইতিহাসে রাজনৈতিক সংগ্রামের জন্য মিছিল বা গণযাত্রার সূচনা এটাই প্রথম; যার ধারাবাহিকতায় আজও উপমহাদেশের বিভিন্ন রাজনৈতিক দল মিছিল-লংমার্চ করে আসছে। পদযাত্রার সময় অত্যাচারী মহাজন কেনারাম ভগত ও জঙ্গিপুরের দারোগা মহেশাল দত্ত ছয়-সাতজন সাঁওতাল নেতাকে বিনা অপরাধে গ্রেপ্তার করেন। সিধু ও কানুকে গ্রেপ্তার করতে উদ্যত হলে বিক্ষুব্ধ সাঁওতাল বিপ্লবীরা ৭ জুলাই পাঁচকাঠিয়া নামক স্থানে মহাজন কেনারাম ভগত, মহেশাল দত্তসহ তাঁদের দলের ১৯ জনকে হত্যা করে এবং সেখানেই সাঁওতাল বিদ্রোহের আগুন প্রজ্বলিত হয়। এরপর টানা আট মাস ধরে চলে সাঁওতাল বিদ্রোহ।
সাঁওতাল বিদ্রোহের নেতৃত্ব যে শুধুই সিধু-কানু বা চান্দ-ভাইরোরা দিয়েছেন তা নয়, তাঁদের সঙ্গে সাঁওতাল নারীদের নিয়ে বিপ্লব করেছিলেন দুই বোন ফুলো মুরমু ও ঝানো মুরমু। ব্রিটিশ সেপাইরা ফুলো মুরমুকে নৃশংসভাবে ধর্ষণ ও হত্যা করে তাঁর লাশ রেললাইনে ফেলে রেখে যায়। ইতিহাসের প্রথম বীরাঙ্গনা হিসেবে সাঁওতাল জাতিসত্তা তাঁকে আজও শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করে। অবশেষে ১৮৫৬ সালের ফেব্রুয়ারির প্রথম সপ্তাহে ইংরেজদের সঙ্গে লড়াইয়ে সিধু নিহত হন এবং দ্বিতীয় সপ্তাহে কানুকে ফাঁসি দেওয়া হয়।
সেদিনের সাঁওতাল বিদ্রোহের রক্তাক্ত পথ ধরে মুণ্ডা বিদ্রোহ, তেলেঙ্গানা বিদ্রোহ, টংক আন্দোলন, তেভাগা ও পরবর্তীকালের নকশালবাড়ি আন্দোলনসহ আরও অনেক আন্দোলন হয়েছে। সে কারণে মহাশ্বেতা দেবীর সেই উক্তি যেন এখনো সত্য ‘আদিবাসীরা আজও যেখানে হকের লড়াই লড়ছে, সে লড়াই সিধু-কানু ও বিরসা মুণ্ডাদের ফেলে যাওয়া লড়াই। শালবনে ফুল ফোটার যেমন শেষ নেই, আদিবাসীদের লড়াই সংগ্রামের তেমন শেষ নেই।’
সাঁওতাল হুলে সাঁওতালরা পরাজয় বরণ করলেও তারা শোষকদের কাছে আত্মসমর্পণ করেনি। তারই ধারাবাহিকতায় তেভাগা আন্দোলন ও আমাদের স্বাধীনতাযুদ্ধে সাঁওতালদের অবদান অবিস্মরণীয়।