সান্দাকফু-র সন্ধে

রূপকথা বসু

উফ এতো কাজের চাপ আর নিতে পারছি না। এরকম চলতে থাকলে এবার সব ছেড়েছুড়ে দিয়ে হিমালয়ে চলে যাব। আর ভালো লাগছে না। নিজের মনেই গজগজ করতে করতে থাকে শাখী ওরফে দীপশিখা। অহেতুক যদি কেউ চিৎকার করে, কার ভালো লাগে। বসের এই এক দোষ, কোথায় কি ঝামেলা হবে আর অফিসে এসে তিনি সবাইকে ঝাড়বেন। অবশ্য এক একদিন এক একজনের পালা পড়ে। আজ তাঁর উপর দিয়েই যা গিয়েছে তা হরিবল। আর নিতে পারছে না সে। এক তো এবার পুজোয় কোথাও যেতে পারেনি। বাড়িতে বসে ঘ্যান ঘ্যান করেছে অঞ্জনের সঙ্গে। তাঁর উপর একটা গোটা মাস চলে গেলো কোথাও যাওয়া হলো না ।

ডেস্ক থেকে ফোনটা তুলে সে ফোন করল অঞ্জনকে। অঞ্জন হয়ত ফোনে কারো সঙ্গে ব্যস্ত, এই দেখে সে আবার গেলো ক্ষেপে। এই যে এখন একটু কাজের কথা বলব। উনি ব্যস্ত হয়ে পড়লেন। পার্স থেকে টাকা নিয়ে সে অফিসের বাইরে এলো। একটা সিগারেট না খেলেই নয়। মাথা খুলবে না। তার ওপর আজ লাঞ্চটাও স্কিপ। এভাবে লাঞ্চের আগে কখনো মিটিং ডাকে কেউ। শাখী একটা টেক্সট করল অঞ্জনকে। ফ্রি হয়ে কল কোরো। এবার সে আরামসে এক কাপ চায়ের সঙ্গে সিগারেটে টান দিল। তারপরেই মাথায় এলো এবার ওর জন্মদিনে সান্দাকফু ট্রেকে গেলে কেমন হয়। সেই যে গুরুদোংমার যাওয়াটা ক্যান্সেল করতে হলো। তাও আবার তাঁর নিজেরই শরীর খারাপের জন্যে। সেখানে অবশ্য কিছু করারই ছিল না। চাইলে অঞ্জন তাঁর বন্ধুদের সঙ্গে যেতেই পারত। কিন্তু তাঁর কথা ভেবেই যায় নি।

তবে এবার আর তাঁর তর সইছে না। আর কাকে কাকে বলা যায় এই ভাবতে ভাবতে নীলাঞ্জন আর মোহনার কথা মনে পড়ল। বৃষ্টি যাবে কিনা কে জানে। তবু তাঁকে একবার জানানো যেতেই পারে। আফটার অল আমাদের প্রিয় মোগলি সে। যেই ভাবা অমনি সে তিড়িং করে লাফিয়ে উঠল। আশেপাশে লোক ছিল না, থাকলেই নির্ঘাত পাগলই ভেবে নিত। অনিল তামাং-এর কথা মনে পড়ল তাঁর। লোকটা কলকাতায় এসেছিল কাজে। অফিসের একটা মিটিং এ খুব খাতির করছিল। বলেছিল, ম্যাডাম কখনও নর্থবেঙ্গল গেলে জানাবেন। সব ব্যবস্থা করে রাখব। ফোন নম্বরটা নিয়ে রাখুন। অনেক আশা নিয়ে সে ফোন নম্বরটা খুঁজে ফোন করেই ফেলল।

–      হ্যালো, হা অনিল জি , ম্যায় কলকাতা সে বোল রহি হু। পেহেচানে ক্যায়া।

–  ওপাশ থেকে বেশ ক্যাচর ম্যাচরের আওয়াজের পড়েই কানে এলো, হা কৌন, আরে ম্যাডামজি, হা পেহেচান লিয়ে আপকো। বলিয়ে ক্যায়সে ইয়াদ কিয়া হামকো।

–   আরে অনিল জি, বো আপ বোলে থে না পাহাড় মে ঘুমনা হো তো আপকো ইয়াদ করনে কে লিয়ে। তভি।

–    হা জ্বী, জরুর। আইয়ে। কব আইয়েগা হামে সির্ফ একবার বোল দিজিয়েগা। হাম পুরা ইন্তেজাম করকে রখেঙ্গে।

–   আভি তক তো ঠিক নেহি কিয়ে। পর আপকো হাম এক দো দিন মে বোল দেংগে। অউর সব বড়িয়া না।

–   হা সব ঠিকঠাক। আভি হম রাখতে হ্যায় ম্যাডামজি।

শাখী ফোনটা রেখেই বেশ চনমনে হয়ে উঠল। এবার সে গিয়েই ছাড়বে। কেউ আটকাতে পারবে না। সে যদি চাকরি থাকে থাকুক, না থাকলে থাকবে না। ছুটির অ্যাপ্লিকেশনটা কালই সে বসের টেবিলে দিয়ে আসবে। সে জানে, এটা দেখেই বসের হম্বিতম্বি বেড়ে যাবে। কিন্তু ওই যে, এবার তো যা হবে তা হোক পর্যায়ে পৌঁছে গেছে সে।

অফিসে ঢুকে বাকি কাজ শেষ করেই সে ঠিক করল আজ একটু তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরবে। যেই বলা, অমনি পেছন থেকে বসের হাঁক দীপশিখা একবার কেবিনে এসো। আর কি করে। রাগ তাঁর নাকের ডগায় এমনিতেই থাকে, তাঁর উপর আজ। সে যাই হোক আজ একটু সামলে থাকা ভালো।

স্যারের রুমে ঢুকে দেখল আরও বেশ কয়েকজন রয়েছে। তাই সে একটু জড়োসড়ো হয়ে একটা কোণেই চুপচাপ থাকল। স্যার চেয়ারে বসেই ওকে দেখিয়ে বলল, এই হল আমাদের পি আর মিস দীপশিখা। আপনারা কলকাতায় প্রোগ্রামের জন্যে ওর সঙ্গে বাকি কথা বলে নেবেন। তারপর আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, আমি কাল অফিস করেই দিল্লী বেরিয়ে যাব চার দিনের জন্যে। তারমধ্যে তুমি এদিকের কাজগুলো দেখে নিও।

সে’ও বাধ্য মেয়ের মতো ঘাড় ঘুড়িয়ে হ্যাঁ বলে বেরোতে যাবে, স্যার বলে উঠল দীপশিখা আজকের মিটিং এর ফাইলটা রেডি করে দিয়ে যাও। আবারও মাথা হেলিয়ে বেরিয়ে এলো। ডেস্কে এসে দ্যাখে প্রায় ৭টা মিসড কল অঞ্জনের। সে তাড়াতাড়ি ব্যাগ গুছিয়ে কম্পিউটার শাটডাউন করে ফোন কানে দিয়েই বেরোতে বেরোতে অঞ্জনকে বলল, আর ৫ মিনিট দাঁড়াও আসছি।

লিফটের কাছে এসে দ্যখে বেশ লম্বা লাইন। আর দেরি না করে সিঁড়ি দিয়েই হুড়মুড় করে নামতে শুরু করল। আজ সে পড়েছে নীল রঙের কুর্তি আর জিন্স। নামতে না নামতেই আবার ফোন অঞ্জনের।

– আরে এসো জলদি। কখন থেকে দাঁড়িয়ে আছি।

– আসছি, আসছি, উফ দু মিনিট অপেক্ষা করতে পারে না এতই চঞ্চল। এদিকে নিজে যখন ঘন্টার পর ঘন্টা দাঁড় করিয়ে রাখে।

নীচে নেমে দ্যখে চায়ের দোকানের সামনে অঞ্জন দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে সিগারেট খাচ্ছে। মুখে তাঁর একরাশ অভিযোগ।

শাখী এবার একটূ নিজেকে ঠিক করে অঞ্জনের সামনে দাঁড়াল। গিয়েই গালগুলো ধরে টেনে দিয়ে বলল। – এই এই এত রাগ কেন হ্যাঁ।

–    কি করব এত দেরী যদি করিস তো।এক তো কতবার ফোন করলাম। উত্তর নেই কোনো।

–    কি করব, খড়ুস স্যারের রুমে ছিলাম যে।

–   বল, কি বলবি এবার। এত করে মেসেজ করলি।

–   বলছি যে শোন না। অনেকদিন তো কোথাও ঘুরতে যাইনি। চল না কোথাও ঘুরতে যাই। আমি জায়গাও ঠিক করে ফেলেছি। সান্দাকফু।

–    আরে থাম থাম, এক নিশ্বাসে এতগুলো কথা বলে গেলে কি করে হবে। নে চা টা খা আগে। তারপর গঙ্গার ধারে গিয়ে বসি একটু। বাকি কথা সেখানেই।

অগত্যা চলো তবে যাওয়া যাক, বলে শাখী আর অঞ্জন বাইকে চেপে বসল। শাখী বেশ জোরেই জড়িয়ে ধরল অঞ্জনকে। আসলে অফিসের পর এইটুকু সময় তাঁর কাছে স্বপ্নের মতো। ও তখন বাচ্চা মেয়ে হয়ে যায়। আসলে ছোটবেলা থেকে এতো ঝড় ঝামেলা পোহাতে হয়েছে তাকে। যার জেরে ছোটবেলাটাই ভালো করে হয়ে ওঠেনি তাঁর কাছে। অঞ্জনের সঙ্গে দেখা হওয়ার পর থেকে সে একদম তাঁর সেই নিজের জগতে থাকে। সাধারণ একটা জীবন, আর অল্পতে খুশি হওয়া। আর কি চাই। কিন্তু ঘুরতে যাওয়ার প্রশ্ন এলে সে এক পায়ে খাড়া থাকে সবসময়। তাকে কেউ আটকাতে পারে না এই একটা জায়গায়। আর অঞ্জনও তেমনি। ভীষন ভালোবাসে ঘুরতে। ট্রেকিংএও  সে বেশ তুখোড়।

ওরা দুজনেই মায়ের ঘাটে এসে বসল। গঙ্গার এই ঘাটটা তাদের দুজনেরই বেশ পছন্দ। অফিস ফেরত দুজনেই মাঝে মাঝে এখানে এসে বসে। আর গল্প করতে থাকে আবোল তাবোল। অবশ্য এই আবোলতাবোল গল্পগুলো একমাত্র শাখীই করে। আর অঞ্জন শুধু শোনে। আর অবাক হয়ে থাকে। মাঝে মাঝে তো শাখী বলেই ফেলে, আচ্ছা তুমি আমার এই বকবক কি করে সহ্য করো বলো তো। শুনেই অঞ্জন বলে, আরে এটাই তো তোর প্লাস পয়েন্ট। তুই বকবক করলেই আমার খুব ভালো লাগে। এতদিন তো আমিই বকবক করেছি। এবার তোর বকবকানি শুনি।

অঞ্জনের কাঁধে মাথা রেখে এবার সে বলে, চলো না সান্দাকফু ঘুরে আসি। কতদিন হলো কোথাও যাইনি।

–  হ্যাঁ, সেতো অনেকদিন হলো। আমারও যে যেতে ইচ্ছে করছে না তা নয়। কিন্তু।

–    কিন্তু কি, আমি কোনো কিন্তু শুনব না। কাল ছুটির অ্যাপ্লিকেশন দিচ্ছি। আর নীলাঞ্জন, মোহনা, বৃষ্টিকেও বলছি আজকেই। আমি কথাও বলে নিয়েছি অনিল জ্বীর সঙ্গে।

–   এরমধ্যে তুই কথাও বলে নিলি। ওরে দাঁড়া দাঁড়া। আগে ছুটি পাই তো। এদিকে কতো কাজ বাকি। সব সামলাতে হবে তো। তুই ছুটি পেলেও আমি পাবো কি সেটা দেখি আগে।

–  ধ্যাত, তুমি না একটা যা তা। ভালো লাগছে না আর কিছু।

–  আচ্ছা ঠিক আছে, তুই ওদের সবার সঙ্গে কথা বল। আমি দেখছি কি করা যায়।

ইয়ে… বলে লাফিয়ে উঠল শাখী। আশেপাশের লোকেরা ওর দিকে তাকিয়ে হেসে ফেলল। অঞ্জন তাড়াতাড়ি ওর হাত ধরে টেনে বসিয়ে নিল পাশে।

–  এবার খুশি তো। চল এবার ফেরা যাক। তবে আমার মিষ্টিটা কিন্তু পাওনা রইল। সুদে আসলে সব তুলে নেব।

–   ধ্যাত ! তুমি না

একটা পাহাড়ি রাস্তায় শাখী আর অঞ্জন হাত ধরে ধরে হাঁটছে। বেশ হু হু করা হাওয়া দিচ্ছে। আর ততই শাখী অঞ্জনের হাত শক্ত করে ধরছে। সন্ধে নেমে আসছে এদিকে। আর বেশ বরফও পড়তে শুরু করেছে। সামনে একটা মৃদু আলোর দিকে ওরা হাঁটতে শরু করল। হঠাৎ একটা গাড়ির আওয়াজ আসতেই ওরা পেছনে ঘুরতেই, গাড়ির হেডলাইটের আলো চোখের ওপর। আর দুজনেই তাল সামলাতে না পেরে বরফের ওপর।  তারপরেই হঠাৎ দুমদাম আওয়াজ। কি হচ্ছে সেটা বুঝল তখন, তাঁর ঘুম ভেঙে গেছে। দ্যখে অফিসের পোশাক পড়েই সে ঘুমিয়ে পড়েছিল। দরজায় মাসি ধাক্কা দিয়ে ডাকছে। শাখী  দিদি ও শাখী দিদি, খাওয়ার যে ঠান্ডা হয়ে গেল।

স্বপ্নের রেশ তাঁর কাটেনি এখনও। সে খানিকটা ধাতস্থ হয়ে বলল, হ্যাঁ মাসি দাঁড়াও আসছি। সে তাড়াতাড়ি উঠে চোখেমুখে জল দিয়ে জামা কাপড় ছেড়ে নিল। খাওয়ারটা নিয়ে এসে দেখল অঞ্জনের মিসডকল। হাতে ফোন নিয়ে হ্যালো বলতেই, ওপাশ থেকে ভেসে এলো- কীরে ঘুমোচ্ছিলিস তুই? এটা ঘুমনোর সময় হলো। এই না তুই ঘুরতে যাওয়ার প্ল্যান করছিস।

–   হ্যাঁ গো, বলো। ঘুমিয়ে পড়েছিলাম একটু। এত ক্লান্ত লাগছিল।

–  কথা বললি তুই সবার সঙ্গে?

–  না, না হয়নি, দাঁড়াও বলছি। জানো তো স্বপ্ন দেখছিলাম এই মাত্র তুমি আর আমি পাহাড়ে বরফের রাস্তায় হাঁটছি।

–   ওহ বাবা, দ্যখো কাণ্ড, পাগলী স্বপ্নও দেখতে শুরু করেছে। এবার ওঠ তো, স্বপ্ন না দেখে সবাইকে বল। আমি ছুটি ম্যানেজ করতে পারব।

–  আরে দারুণ, দারুণ। আচ্ছা ফোনটা রাখো আমি বলছি সবাইকে।

অঞ্জন ফোনটা রাখতেই সে খাওয়ারটা ঢেকে রেখে প্রথম ফোনটা করল মোহনাকে।

–  হ্যালো, হ্যাঁরে শোননা কথা আছে, দাঁড়া একবার ফোনে বৃষ্টি আর নীলাঞ্জনকেও নিয়ে নিই। সবাইকে একসঙ্গে বলব।

–  আচ্ছা

সবাইকে ফোনে নিয়ে এবার সে বলল, এই তোরা সান্দাকফু যাবি? টিকিট কাটছি নেক্সট মান্থের শেষে।

প্রথমেই গাঁইগুই শুরু করল বৃষ্টি। আমার কি আর যাওয়া হবে রে। এতো কাজ। তাছাড়া বাড়িতে বাবা মা যেতে দেবে না এখন। মোহনা বলল, হ্যাঁ আমি যেতে পারি কিন্তু নীলাঞ্জন যেতে পারবে কি না।

নীলাঞ্জন বলল, যাব, কিন্তু খুব বেশিদিন পারব না।  শাখী বলে উঠল, হ্যাঁ হ্যাঁ বেশিদিনের প্ল্যান নয় ওই মোট ৫ দিনের ধরে রাখ। হ্যাঁরে, বৃষ্টি চল না রে। বৃষ্টি খেঁকিয়ে উঠল, হ্যাঁ আমি একা একা যাই, আর তোমরা দুইজোড়া কপোত কপোতি বকবকম করতে করতে চলো। আমার কি মন নাই হ্যাঁ… বলেই নাকি কান্না শুরু করল।

শাখী ওকে থামানোর জন্যে বলল। মুখপুড়ি কত এলো গেলো। একটাকেও তো টিকতে দিস না। কাকে নিয়ে যাবি বল তো। এই জন্যে বলি, একটু ঘোরাফেরা কর। সবার সঙ্গে মেশ। তা না, ওই কম্পিউটারের সামনে বসে দিনরাত কাজ আর কাজ। বৃষ্টি এবার খানিকটা চুপ হয়ে গেলো। ওদিকে মোহনাও তখন থেকে কি একটা বলবার চেষ্টা করে চলেছে। কিন্তু আমাদের বকবক কুইন থামলে তো। শাখী ওকে চুপ করিয়ে বলল, চল না রে। যদি ওখানেই তোর সেই জনের দেখা পেয়ে যাস।

–     ধ্যাত ইয়ার্কি মারিস না তোরাখ রাখ দেখছি আমি। অনেক কাজ আছে।

–    আমাকে রাতেই জানা কিন্তু।

–     আচ্ছা ঠিক আছে।

বৃষ্টি ফোনটা রাখতেই মোহনা এবার বলল,- আচ্ছা খুব ঠান্ডা তো ওখানে। ঠান্ডার জিনিস পত্র কিনতে হবে। আর তাছাড়া আমি ট্রেকিং করিনি কখনও।

–  সে ট্রেকিং না জানলেও চলবে। এখানে রোজ মর্নিং ওয়াক করিস তো। ফিট থাকলেই হলো।

–    আমার সে চাপ নেই। আমি আগেও ট্রেকিং করেছি। পাহাড়ে চড়েওছি। ওদিক থেকে বলে উঠল নীলাঞ্জন।

–    তাহলে তো আর চাপ নেই। আমি টিকিট বুক করে নিচ্ছি আমাদের ৫ জনের। ওই ২১ শে ডিসেম্বর। বড়োদিন পালন করে আমরা নেমে আসব। আর বৃষ্টির টিকিটটাও কেটে নিচ্ছি। ও এখন দোনামোনা করছে। ঠিকই যাবে। চল বাইবাই। বাকি জানাচ্ছি তোদের।

–   টা টা

ফোন রেখেই শাখী টেক্সট করল অঞ্জনকে। ‘অল ডান। টিকিটটা বুক করে ফেলো। নেক্সট মান্থ ২১ তারিখ।  এবার সে সকাল হওয়ার অপেক্ষা করতে শুরু করল। কখন সকাল হবে।

পাহাড়ি রাস্তায় একটা বাইক উঠছে বেশ ৯০র মতো গতিতে। আর পাহাড়টাও বেশ খাড়াই। সামনের টার্নে যদি ওপাশ থেকে গাড়ি চলে আসে তাহলেই বিপত্তি। হ্যাঁ, একবার এরকম একটা ট্রিপ ছিল ভুটান সীমান্তের বিন্দু’তে।  দাদা, ভাইরা মিলে প্রায় ১৬ জন। হ্যাঁ এক একটা বাইকে ২ জন করে মোট ৮টা বাইক। সেই ট্রিপটা ছিল বেশ রোমাঞ্চকর। পরবর্তী মুহুর্তে কি আছে সেটা জানা নেই। সে যাকগে পাহাড় বেশ ভয় করত শাখীর। মানে ওই হাইট ফোবিয়া আর কি। এমনিতে ছোটখাটো পাহাড়ে উঠেছে সে। কিন্তু একটু বড়ো ট্রেকে সে যায়নি কখনো। বাড়ি থেকে অ্যালাও করেনি। বাড়ির একমাত্র মেয়ে হলে যা হয়। একদম যেন নাদুস নুদুস, হোতকা বাচ্চা হয়ে থাকলেই যেন তাদের ভালো। আর সেও হয়েছে তেমনি। বাড়ির উলটো। যা যা বারণ করবে, সেটাই সে করবে। একরোখা জেদী তো সে কোনওদিন ছিল না। হতে বাধ্য হয়েছে। বাড়ি থেকে বেরিয়ে আসার জেদটাও তারই।

এবার তাকে আটকায় কে। সে যাবেই সান্দাকফু। যাই হোক। এবার শাখী ভাবতে শুরু করল। সব তো প্ল্যান হলো। শেষমেশ যাওয়া হবে তো। সেই যে গুরুদোগমার যাওয়ার প্ল্যানটা ক্যানসেল হওয়ার পর তাঁর মনে ভয় ঢুকে গেছে। এটাও না শেষ মুহুর্তে ক্যানসেল হয়ে যায়। আসলে মনের ভেতর তৈরি হয়ে যাওয়া ঘুরতে যাওয়ার প্ল্যান প্রোগ্রাম গুলো যদি আর না হয়, তাহলে যে কি মন খারাপ হয়। এটা যার হয় সে বোঝে কি কষ্ট।

কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছে সে। সকালে ঘুম ভাঙল তখন ৮টা বেজে গেছে। মাসি চলে এসেছে ঘর ঝাড় দিতে। সেও আর দেরি না করে চা খাওয়ার জল বসিয়ে দিয়ে সকালের পেপারটা নিয়ে বসল। সব পাতা উল্টে সে শুধু হেডিংগুলো দেখে নিল একবার। আজ আবার সেই ক্লায়েন্টের পেপার রেডি করতে হবে। স্যারকে ছুটির অ্যাপ্লিকেশন দিতে হবে। কেনাকাটা করতে হবে। কত কাজ, উফ!

অফিসে এসে শাখী ডেস্কে খানিকক্ষণ চুপচাপ বসে থাকল। কম্পিউটার খুলে ডেস্কটপ ওয়ালপেপারে একটা বরফঘেরা পাহাড়ের ছবি লাগিয়ে নিল। এরপর ছুটির অ্যাপ্লিকেশন বানিয়ে প্রিন্ট আউট নিয়ে রেখে দিল। স্যার এলেই দিয়ে দিতে হবে। তার আগে সমস্ত কাজ সেরে নেওয়ার জন্যে ডুবে গেল কাজে।

কি যেন একটা ঘোর লেগে আছে তাঁর চোখে মুখে। কাউকে বলতে পারবে না সেটা কি। কি অদ্ভুত একটা মায়া মায়া চারদিক। আজ যেন তাঁর সত্যি সত্যি ছুটির সময় চলে এসেছে। এই বদ্ধ জীবন আর ভালো লাগে কতদিন। উফ বরফের ওপর দিয়ে হেঁটে যাওয়া। পাহাড়ি রাস্তার বাঁকে এক অন্য জগত। রূপকথার জগত। যে জগতের হাতছানি সে অনেকদিন থেকেই স্বপ্নে জাগরণে বহুবার পেয়েছে।

তাঁর এই ঘোর কাটল বৃষ্টির ফোনে।

–   হ্যালো, হ্যাঁ বল রে। কি ডিসাইড করলি। যাবি তো?

–   হ্যাঁ, না মানে যেতে তো ইচ্ছে করছে। কিন্তু মা ভীষণ রেগে আছে। বলছে একা কোথাও যেতে দেবে না।

–    একা মানে, আমরা তো আছি। আমাদের তো চেনে।

–     মা বলছে বোনকে নিয়ে যেতে। ওরও তো ছুটি থাকবে।

–   হ্যাঁ সে না হয় যাবে। তাহলে তো আরও ভালো। বেশ আমি অঞ্জনকে বলছি আর একটা টিকিট কাটতে। পরে ট্রেনে অ্যাডজাস্ট করে নিলে হবে।

ফোন রেখে সে আবার কাজে ডুবে গেল। এরমধ্যে সেই ক্লায়েন্ট এসে হাজির। সেটা মিটিয়ে স্যারের রুমে একবার ঢু মেরে দেখল স্যার কি করছেন। দেখল স্যার কারো সঙ্গে ফোনে ব্যস্ত। এই তো সময়। সে টুক করে ডেস্কে গিয়ে লিভ অ্যাপ্লিকেশনটা নিয়ে এসে নক করল দরজা। স্যার তাকে দেখে আসতে বলল ইশারায়। শাখী দাঁড়িয়ে রইল গিয়ে চুপচাপ। দু- মিনিট কেটে যাওয়ার পর স্যার বলল, হ্যাঁ বলো কি বলবে?

খানিক ইতস্তত করে শাখী বলল,- স্যার নেক্সট মান্থে আমার কয়েকদিনের ছুটি চাই। লিভ অ্যাপ্লিকেশনটা এগিয়ে দিয়ে, সে দাঁড়িয়ে রইল। স্যার অবাক চোখে দু সেকেন্ড তাকিয়ে বলল,

–    কি ছুটি, এখন কোনো ছুটি ফুটি হবে না। এদিকে এত কাজ, আর তুমি চাইছ ছুটি।

–  স্যার, নেক্সট মান্থে। এখন না। আমি সব কাজ সেরে রেখেই যাব। বুঝিয়েও দিয়ে যাব বৈভবকে।

–  ক’দিনের শুনি

–  ওই  ৬ দিন

–  আজ আমি দিল্লী যাচ্ছি। ফিরে এসে কাজ দেখে বলছি।

–   স্যার, স্যার। অনেকদিন ছুটি নিইনি। এটা কি ভালো হবে, যে না বলে ছুটি নেবো।

–   আরে, এতো দেখছি মুখে মুখে তর্ক করছে।

–   স্যরি স্যার ।

–    আচ্ছা ঠিক আছে। নিও। যাও এখন কাজ গুলো সেরে ফেলো। আর গতকাল-এর ক্লায়েন্টের কি খবর সেটা রিপোর্ট করো।

–    ওকে স্যার। আসছি এখুনি।

স্যারের রুম থেকে বেরিয়ে শাখী খানিকটা লাফিয়ে নিল। এমনিতে খড়ুশ বস ছুটি দিতে চান না। এবার হঠাৎ এতটা উদার হয়ে গেলেন। যাক আর কোনো চিন্তা রইল না। এবার গো টু সান্দাকফুউউউউউ…

সান্দাকফু ট্রেক নিয়ে অঞ্জনেরও বেশ একটা আলাদা উত্তেজনা আছে। যদিও এই ট্রেক তাঁর কাছে নতুন নয়। সে এর আগেও প্রায় ৩-৪ বার সান্দাকফু গিয়েছে। কিন্তু শাখীর তো যাওয়া হয়নি। টিকিট কাটা হয়ে গেছে অঞ্জনের। অফিস থেকে ফিরে সে মানি দিদির দেওয়া ‘ভোলগা থেকে গঙ্গা’ বইটা পড়ছিল। আর ভাবছিল আসলেই ইতিহাস কীভাবে বদলে যেতে পারে। আর্য- অনার্য, বেদ, ব্রাহ্মণ- অব্রাহ্মণ। কত শত যুগ থেকে অনন্ত যাত্রা। এই যাত্রাই তো তাকে টেনে নিয়ে যায় শুধু। তাঁর পা টেকে না এক জায়গায় । শুধু যেন চলতেই থাকে, চলতেই থাকে। শাখী কোথায় যেন হারিয়ে গিয়েছিল বইটা পড়তে পড়তে। এরকম তাঁর আর একবার হয়েছিল রবিশঙ্কর বলের ‘দোজখনামা’ বইটা পড়তে গিয়ে। সে ঘোর কিছুতেই কাটে না। ব্যক্তিগত ভাবে ওই একটা বই তাঁর জীবন দর্শন পালটে দিয়েছে একেবারে। শাখীর মন খারাপ হলেই ডুবে যায় ওই বইয়ের পাতায়। কিসসা শোনে মির্জা গালিব আর সাদাত হোসেন মান্টোর। মির্জা সাব বলছেন- 

‘বুকদহ্‌মে মানীকা কিসসে করে সওয়াল

আদম নেহী হ্যায়, সুরত-এ আদম বহত হ্যায় ইহাঁ…’

অর্থাৎ মাটির পুতুলের রাজ্যে কার কাছে বিশ্বরহস্যের অর্থ শুধাব ? এখানে মানুষ নেই, মনুষ্যাকৃতি অবশ্য অনেকেই আছে।

শাখী আবারও বুঁদ হয়ে যায় এক অন্য জগতে। এই বিশ্বরহস্যের কতটুকুই বা সে জানে। কতটুকুই বা সে ঘুরে দেখেছে। তাঁর ভেতরের দুরন্ত মেয়েটা বেরিয়ে আসতে চায় বারবার। আর সে ততই লাগাম দিয়ে রাখে। আর স্বপ্ন দেখতে থাকে অনেক। যে স্বপ্নগুলো তাকে বাঁচিয়ে রাখে। শাখী অঞ্জনকে বলেছে। শুধু বছরে দু বার ঘুরতে যাবে তারা। একটু বড়ো ট্যুরে। আর ছোটোখাটো ঘোরাগুলো তো থাকবেই। এটাই তো জীবন। খানিক ক্রিস্পি না হলে কি আর জমে। শাখী ভাবে, আর ২০ দিন আছে। এর মধ্যে হোটেল বুক করে নিতে হবে। অনিল জ্বীর সঙ্গে কথা বলতে হবে। কেনাকাটাও আছে প্রচুর। আবার এদিকে বাবা-মা’কেও হালকা ভাবে বলতে হবে যে, ঘুরতে যাচ্ছি বন্ধুদের সঙ্গে। সে অঞ্জনকে ফোন করে জানাল কাল দেখা করতে, আর বৃষ্টির বোনের কথাও জানাল। তারপর ফোন রেখে ঘুমিয়ে পড়ল সে।

সকাল ৮টায় ধড়মড়িয়ে ঘুম থেকে উঠল শাখী। তারপর দরজা খুলতে যাওয়ার আগে তাঁর মনে পড়ল আজ তো রবিবার। আবার ফিরে এসে শুয়ে পড়ল সে। সেই ঘুম ভাঙল অঞ্জনের ফোনে। – কীরে, এই রবিবারের দিনটা তুই এভাবে ঘুমিয়ে শেষ করলি। ওঠ ওঠ। পাঁচ মিনিটে রেডী হয়ে বাইরে বের হ। আমি তোর ফ্ল্যাটের সামনে। শাখী ধড়মড় করে ওঠে। ঘুম জড়ানো গলায় বলে, ওপরে উঠে এসো। আমি মাসীকে বলে দিচ্ছি দরজা খুলে দিতে।

–    না না তুই তাড়াতাড়ি নীচে নেমে আয় তো। এক জায়গায় যাবো। তারপর লাঞ্চ করে। দেখি কোথায় যাওয়া যায়।

–     আচ্ছা দাঁড়াও আসছি ১০ মিনিট।

শাখী তাড়াহুড়ো করে স্নান করে জিনস আর টপটা গলিয়ে বেড়িয়ে পড়ল। নীচে নামতে নামতে ঠোঁটে লাগিয়ে নিল ম্যাট ফিনিশ লিপস্টিকটাও। গেট খুলে বাইরে বেরিয়েই দেখল অঞ্জন বাইকের ওপর বসে সিগারেট খাচ্ছে। তাকে দেখেই হাতের ঘড়ির দিকে তাকিয়ে বলল।– অলরেডী লেট। চল এবার জলদি। মুভির টিকিট কেটেছি। হাতে এক ঘন্টা আছে, লাঞ্চ করে মুভি দেখতে যাব। শাখীকে হেলমেট ধরিয়ে সে বাইকে স্টার্ট দিল।

দুপুরে লাঞ্চ করে মুভি দেখে বেরিয়ে, দুজনে ঠিক করল একটু শপিং করবে। তাই বিগ বাজারের দিকে বাইক ঘুড়িয়ে নিল। আজকের শপিং-এ শাখী একটা জ্যাকেট আর ফ্লিস কিনল। বাকি আর পরে কিনবে বলে বেরিয়ে আসছিল মল থেকে। ফোন বেজে উঠল শাখীর। ব্যাগগুলো অঞ্জনকে গছিয়ে দিয়ে সে ফোন ধরে হ্যালো বলতেই ওপারে মোহনা।

–   আরে কোথায় গেলি, তোকে এইমাত্র দেখলাম বিগ বাজারে। লম্বা কাউন্টারের সামনে দাঁড়িয়ে আছি। ভেতরে আয়

–   নারে, আর ভেতরে যাব না। আমরা বরং সিইএসসির মোড়টায় দাঁড়াচ্ছি তুই আয়।

–    আচ্ছা দাঁড়া তাহলে। নীলাঞ্জনও আছে সঙ্গে। ১০ মিনিটে আসছি।  

ব্যস্ত রাস্তা পেড়িয়ে ওরা দুজনে সিইএসসির মোড়টায় দাঁড়ালো। চা না খেলেই নয়। ওখানেই একটা চায়ের দোকান আছে। বেশ ফেমাস। গাড়ি পার্ক করে সেখানেই হেঁটে গেল শাখী আর অঞ্জন। প্রায় পনের মিনিট বাদে দুজনে এসে হাজির। মোহনা বেশ হেলদি হয়ে গেছে, আর গ্ল্যামার বেড়ে গেছে মনে হচ্ছে। এটা বলতে যাবে। অঞ্জন চার কাপ চা এর অর্ডার দিল। শাখী মোহনার হাত ধরে একটু টেনে নিয়ে গেল দূরে। গিয়েই বলল, কিরে ব্যাপার কি! এত গ্ল্যামার বেড়ে গেছে। কি ব্যাপার, হুম?

–   ধুর সেসব কিছু না।

–   আহা, বুঝি বুঝি সব বুঝি। ডুবে ডুবে আর কত জল খাবে বাছা। বিয়ের পিঁড়িতে বোসো এবার। বলছি কাকীমাকে দাঁড়া।

–   বাদ দে না এসব। এখন বল কি কি কিনলি তুই সান্দাকফু যাওয়ার জন্য।

–  এই একটা ফ্লিস আর জ্যাকেট। বাকি আছে সবই।

–  আমিও জ্যাকেট, মোজা, টুপি কিনলাম। যা ঠান্ডা ওখানে। কি যে হবে। জানি না। হ্যাঁ রে, হাঁটতে পারব তো বরফে।

–  আরে ভয়ের কি আছে। আর আমরা তো আছি। আচ্ছা বৃষ্টির কি খবর?

–  সেটা জানি না। দেখি আজ একবার ফোন করব।

চা শেষ করার পর শাখী আর অঞ্জন বেরিয়ে এলো ওখান থেকে। সবে ৮টা বাজে। শাখী একবার কানে কানে অঞ্জনকে বলল ঘাটে গিয়ে বসব একটু, যাবে? অঞ্জন খানিক ইতস্তত করে বলল, চলো তবে অনেকক্ষণ বসব না।

৫ মিনিটেই গঙ্গার ধারে চলে এলো তারা। বেশ হাওয়া দিচ্ছে ফুরফুরে। শীতের আমেজ শহরে ঢুকতে এখনও বেশ দেরী। হাওয়ায় শাখীর চুল উড়ছিল। হঠাৎ সে অঞ্জনের কাঁধে মাথা দিয়ে বলল, হ্যাঁ গো, সান্দাকফুতে গিয়ে থাকব কোথায়? আর অনিল জ্বীকে তো ফোন করাই হোলো না। অঞ্জন মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলল, এখন করে নিলেই হয়।

শাখী ফোনটা তুলে অনিল জ্বীর নাম্বার ডায়াল করল। ওপাশে তখন হ্যালো টিউনে বাজছে, রেশম ফিরিরি… রেশম ফিরিরি। গানটা মাঝপথে থামিয়েই ফোন ধরলেন তিনি।

–    হাঁ ম্যাডামজী বোলিয়ে। হাম সোচ রহে থে আভীতক কোয়ী ফোন নেহি আয়া

–   বো থোড়া দোস্ত লোগোসে বাতচিত করনে মে দেরী হো গয়া। হাঁ তো শুনিয়ে। হামলোগ ইহা সে যা রহে হ্যায় ২২ তারিক কো। সুবহা হামলোগ শিলিগুড়ি জংশন মে উতরেঙ্গে। অর ২৭ তারিখ ট্রেন হ্যায় বাপসি কে। আপ উসি হিসাবমে এক ট্যুর প্ল্যান কর দিজিয়ে। গাড়ি, র‍্যহেনে কে লিয়ে জগাহ। সব মিলাকে এক হিসাব করকে হামে মেইল কর দিজিয়ে

–   জ্বী ম্যাডাম। ঠিক হ্যায়। আপলোগ কিতনে আদমি আ রহে হ্যায়

–   ছয় জন

–  ওকে ম্যাডামজ্বী। ডান। রখতে হ্যায় আভি 

ফোন রেখেই শাখী অঞ্জনের গালদুটো ধরে চটকে দিল। চুলগুলো এলোমেলো করে দিয়ে বলল, আহ! শেষমেশ যাচ্ছি তাহলে। অঞ্জন মিটিমিটি হাসতে হাসতে, শাখীর কাণ্ড দেখছিল। পাগল মেয়ে একটা। জড়িয়ে ধরে নাকটা টেনে দিয়ে বলল, হ্যাঁ যাচ্ছি। এবার চলো তবে ফেরা যাক। খিদেয় পেট চু চু করছে। অবশ্য মিষ্টি খেলে খিদেটা আপাতত কমে যেত। অমনি শাখী কোনোদিকে না দেখেই দু গালে দুটো চুমু খেয়ে বলল, হয়েছে। এবার পেট ভরেছে। চলো এবার।

ঘটনার আচম্বিকতার ঘোর না কাটিয়েই অঞ্জন উঠে পড়ল। আর যেই উঠে ধরতে যাবে শাখীর হাত। অমনি খরগোশের মতো দে ছুট ওখান থেকে। এই পাগলপনতিগুলোর জন্যেই তো এত্তো ভালো লাগে শাখীকে।

দেখতে দেখতে তাদের যাওয়ার সময় হয়ে এলো। আর এক সপ্তাহ। সবাই মোটামুটি রেডি। শাখী অফিস থেকে ফিরে রুম গোছাচ্ছিল। জানলার কাঁচে অনেকদিন ধরে একটা মৃত প্রজাপতির ডানা লেগে ছিল। সেটাকে তুলে একটা বইয়ের ভেতর রেখে দিল সে। এটা তাঁর ছোটবেলার অভ্যেস। কি জানি কেন, সেই প্রজাপতিটার রঙিন ডানায় নিজেকে উড়তে দেখত। আর মৃত প্রজাপতির যে স্বপ্ন ছিল সেটা আগলে রাখার জন্যেই সে ডানা কুড়িয়ে ডায়েরিতে রেখে দিত। হঠাৎ তাঁর ফোন বেজে উঠল। অগোছালো কাপড়ের ভিড়ে ফোন খুঁজতে খুঁজতে রিং হয়ে থেমে গেল। ফোন তুলে দেখতে পেলো বৃষ্টির মিসডকল। ঘুড়িয়ে ফোন করতেই। ওপাশে বৃষ্টি খানিকক্ষণ চুপ থেকে বলে উঠল, আমার যাওয়া হবে না রে। তোরা যা। শাখী অবাক হয়ে বলল, মানেটা কি? টিকিট কাটা হয়ে গেছে, হোটেল বুক। আর তুই এখন বলছিস যাবি না। আবার কার সঙ্গে ঝামেলা করলি ভাই।

–   না রে ঝামেলা করিনি। সত্যি বলছি।

–         এই তুই চুপ কর তো, সব বুঝি তোর ন্যাকামি গুলো। ওসব না বলে, এটা বল যে তোর প্যাকিং কতদূর। দ্যখ বেশি কিছু নিবি না। শেষে তোকেই বইতে হবে কিন্তু।

–         ধুর বা…

–         আবার গালাগালি কেন? বলে ফেল না কি হয়েছে?

–         বোনের জন্য যেতে পারব না

–         এটা কোনো কথা হোলো

আরও কিছু বলতে যাবে মুখের ওপর ফোনটা কেটে দিল বৃষ্টি। মনটা খারাপ হয়ে গেলো। কি বলবে বুঝতে পারল না। আবার আশাও ছাড়ল না। সে অঞ্জনকে আর এত রাতে ফোন করে এই খবরটা দিল না। কাল বললেই হবে।

সকালে ঘুম ভেঙ্গে দ্যখে হোয়াটস অ্যাপ গ্রুপ থেকে বৃষ্টি লিভ করেছে। আর তারপর প্রায় চল্লিশখানা মেসেজ। কি কেন কি হয়েছে, ব্লাব্লাব্লা… সকাল সকাল মাথাটাই গেলো বিগড়ে। এই এদের জন্যে কোথাও যাওয়া হয় না। একটা ট্যুর যদি ভালো ভাবে হয়। শাখী আবার চুপ হয়ে গেল। ওর বেশ ভয় করতে লাগল, এবারও কি গুরুদোঙবার এর মতো যেতে পারবে না। বিছানা ছেড়ে আর উঠতে ইচ্ছে করছে না। আর ৫ দিন মোটে। কত কাজ সামলে একটু যাওয়ার সময় করে নিয়েছিল সে। বেশি কিছু না ভেবে সে ফ্রেশ হয়ে অফিস চলে গেল। আজ অনেক মিটিং আছে। অঞ্জনকে লাঞ্চ টাইমে ফোন করে বলল কিছু জিনিস কিনতে হবে, অফিসের পর দেখা কোরো।

এদিকে অনিল জ্বী সব বুক করে এস্টিমেট একটা বাজেটের মধ্যে হোটেল গাড়ি বুক করে রেখেছে। পাঠিয়েও দিয়েছে মেইল করে শাখীকে। শাখী জানিয়েছে অল ডান। ট্রেনে উঠবার আগে একটা ফোন করে দেবে সে।

এরমধ্যে আর বৃষ্টিকে কেউ ফোন করেনি আর। আসলে ওরা সবাই রেগে আছে বৃষ্টির ওপর। ও প্রত্যেকবারই কোনো না কোনো বাহানা করে। শাখী অঞ্জনকে বলে দিয়েছে বৃষ্টি আর ওর বোনের টিকিট ক্যানসেল করে দিতে। অঞ্জন বলেছে, যাওয়ার আগের দিন অবদি দেখবে, তারপর ক্যানসেল করবে। ঘরে ফিরে ব্যাকপ্যাক গুছিয়ে নিল সে। খুব অল্প জামা, ঠান্ডার জিনিস,  গ্লাভস, মোজা, টুপি, ফ্লিস, জ্যাকেট। ক্রিম, ভেসলিন, আন্ডার গার্মেন্টস, প্যাড, ওষুধ, গ্লুকোজ। ইমার্জেন্সি কিছু শুকনো খাওয়ার, জলের বোতল। গুছিয়ে নিয়ে যখন সে বসল ঘরের অবস্থা প্রায় চোখে পড়ার মতো। এত কিছু জিনিস ছড়িয়ে ছিটিয়ে। মা দেখলে নির্ঘাত মাথায় হাত দিয়ে বসত। আর বলত, কি সন্তান জন্ম দিয়েছি। কিচ্ছু শিখতে পারল না মুখে শুধু বড়ো বড়ো কথা।

অবশেষে সেই কাঙ্খিত দিনটা এসে উপস্থিত হলো। যেদিন শাখী, অঞ্জন, মোহনা, নীলাঞ্জন রেডী হয়ে যে যার মতো শিয়ালদহ স্টেশনে ল্যান্ড করল, স্যরি, উপস্থিত হলো। এক ঘন্টা আগে স্টেশনে বসে বসে  বোর হয়ে যাচ্ছিল সবাই। শাখী বলে উঠল, বৃষ্টিটা এলে কি ভালোই না হতো। কত মজা করতে করতে যেতাম। ওপাশ থেকে অঞ্জন বলে উঠল, আমি তো সোজা বাঙ্কারে উঠে ঘুম। শাখী ওর দিকে চোখ সরু করে তাকালো একবার, তারপর হেসে বলল, ঘুমাতে দিলে তো!

ট্রেন যথাসময়ে ট্র্যাকে দিয়ে দিয়েছে। এবার যে যার ব্যাগ তুলে হাঁটতে শুরু করল স্লিপার কামরার দিকে। ওদের কামরা একটু শেষের দিকে। তাই অনেকটাই হাঁটতে হোলো। অবশেষে সিটে ব্যাগটা ফেলে ধপ করে বসে পড়ল মোহনা। উফ, এইটুকুতেই হাঁফিয়ে গেলাম রে। পারব তো সান্দাকফু উঠতে। অঞ্জন ব্যাগ গোছাতে গোছাতে বলল, ‘হ্যাঁ হ্যাঁ কেনো পারবি না। মনের ওপর জোর রাখ। আখির ইয়ে বান্দা কিস কাম কা। এতদিন পাহাড় চড়ার অভিজ্ঞতা আছে। আর তোদের সামলে উঠতে পারব না। তা হয় কখনো।‘

ট্রেন ছাড়ার আর কয়েক মুহুর্ত বাকি। ওপরের বাঙ্কে দুজন অলরেডি উঠে বসে গেছে। অঞ্জনের মন খারাপ হয়ে গেল, তাঁর ওই একটাই শখ ট্রেনের ওপরের বাঙ্কার। এই বৃষ্টির জন্য যত সব। নিজে তো এলোই না। আর আমাদের মন খারাপ করে দিল। ব্যাগ গোছাতে গোছাতেই ট্রেন ছেড়ে দিল। ওদিকে দু একটা স্লিপারের পরে বেশ তুমুল একটা ঝগড়া চলছে সিট নিয়ে। নিশ্চয়ই আরএসিতে। কিন্তু গলাটা চেনা চেনা লাগছে কেন? অঞ্জন শাখীকে ডেকে বলল একবার চল তো পাশের বগিতে। লোকজন সরিয়ে একটু এগোতেই ওরা দেখতে পেল বৃষ্টি একজন লম্বা তাল পাতার সেপাই এর মতো লোকের সঙ্গে ঝগড়া করছে। তাড়াতাড়ি ওর দিকে এগিয়ে গিয়ে বৃষ্টিকে ওখান থেকে সরিয়ে নিয়ে এলো শাখী। জড়িয়ে ধরে, লাফিয়ে উঠে বলল, তুই এখানে কি করছিস? আর টিকিট পেলি কি করে, আমরা তো ক্যানসেল করে ছিলাম। বৃষ্টি ব্যাগটা কাঁধ থেকে নামিয়ে বলল, সে অনেক গল্প, একটু জল দে দেখিনি। কি ভেবেছ, কি হ্যাঁ তোমাদের দুই কপোত- কপোতিকে একা একা ছাড়বো ভেবেছ। একটা দায়ীত্ব আছে না আমার। উফ কি ঝড়টাই না সামলাতে হোলও।

মোহনা আর নীলাঞ্জন হাঁ করে ওর দিকে তাকিয়ে আছে দেখে বৃষ্টি বলে উঠল, চলো না তোমাদের কি জ্বালাতনটাই না করি। ওভাবে হাঁ করে কি দেখছ, সামলে বস। মোহনা অবাক হয়ে বলল, আহ, মরণ। ডিস্টার্ব করবি না একদম। অমনি বৃষ্টি মজা করে বলে উঠল, মামনি তাই বললে কি আর হয়। হঠাৎ ওপর থেকে একজন পাঞ্জাবী ছেলে বলে উঠল, আপ লোগ কাহাঁ জায়েঙ্গে।

বৃষ্টি এতক্ষণ খেয়াল করেনি, আমরা ছাড়াও আরও দুজন রয়েছে ওপরের সিটে। ও বেশ ইতস্তত করে বলল, এনজেপি। ফিসফিস করে বলে উঠল, আপকো ইসসে ক্যায়া।

–         আচ্ছা, হাম লোগ ভি যা রহে হ্যায় এনজেপি, ফির বহা সে সান্দাকফু, ফালুট

–         (এই সেরেছে, এগুলো এবার জ্বালাবে) ও, আচ্ছা আচ্ছা, বহত বড়িয়া

বৃষ্টি আর কথা না বাড়িয়ে মোহনার পাশে বসে গেল। টিকিট চেকার আসতেই টিকিট চেক করে গেল সবার। খাওয়া দাওয়ার পর বৃষ্টি সাইড বার্থ এর লোকটাকে তাঁর সিটে পাঠিয়ে দিয়ে উঠে গেল সেখানে। এদিকে শাখী আর অঞ্জন একদিকের লোয়ার আর মিডল বার্থে উঠে কেবলি বিরক্ত হয়ে একে অপরের মুখের দিকে তাকাচ্ছে।

ট্রেনের লাইট আস্তে আস্তে বন্ধ হতে শুরু করেছে। শাখী এপাশ ওপাশ করছে তখন থেকে। ঘুমোতে পারছে না। হঠাৎ নীচের সীট থেকে নাক ডাকার আওয়াজে সে নীচে তাকিয়ে দ্যাখে অঞ্জন নাক অবদি চাঁদর ঢেকে ঘুমিয়ে পড়েছে। শাখী এবার বেশ মজা পেল। মাথায় খেলে গেল বদমাশি বুদ্ধি। সে হালকা করে হাতটা অঞ্জনের গালের কাছ দিয়ে কানে রেখে টুক করে টেনে দিল। আর দিয়েই নিজে চাদর চাপা দিয়ে ঘুমনোর ভান করল। অঞ্জন একবার চোখ খুলে তাকিয়ে এবার চাদর মুখ অবদি টেনে ঘুমিয়ে পড়ল। এদিকে শাখী বিশেষ পাত্তা না পেয়ে রেগে গিয়ে এবার চিমটি কেটে দিল জোরে। আহ, বলে অঞ্জন এবার চোখ খুলে শাখীকে বলল, ঘুমিয়ে পড় না, কাল সকালে তো পাহাড়ে। আর ঘুমোতেও দেবো না তোকে। এখন একটু দে ঘুমোতে, নিজেও ঘুমো।

শাখী আর কি করে সে মোবাইল খুলে গান চালিয়ে আকাশপাতাল ভাবতে শুরু করল।  এই প্রথম শাখী বাড়িতে না বলে কোথাও যাচ্ছে। তাও আবার পাহাড়ে। সে শুধু তাঁর দাদুকে বলেছে, ঘুরতে যাচ্ছি বন্ধুদের সঙ্গে। আর মা বাবাকে বলেছে অফিস ট্যুর এ যাচ্ছে। জীবনে সে কখনো তাঁর নিজের শান্তির সঙ্গে আপোষ করেনি করবেও না। আর চায়ও না কারোর জন্যে তাঁর শান্তি নষ্ট হোক। অঞ্জন পাশে থাকলে সে মনে ভীষণ জোর পায়। ভেতর থেকেই একটা আলাদা চার্ম পায়। সব কাজ ভালো হয় তাঁর। ওর মধ্যে যে মাটির গন্ধ আছে, আবার পাহাড়ি একটা মায়া আছে, একটা এত্তো বড়ো আকাশ আছে। শাখী মনে মনে হাসল খানিকক্ষণ। সে একবার ঘুমন্ত অঞ্জনের দিকে দেখে আবার শুয়ে পড়ে।

সকাল হয়ে গেছে। আর ২ ঘন্টার মধ্যে পৌঁছে যাব। মোহনা আর নীলাঞ্জন উঠে গেছে। মিডল বার্থ নামিয়ে ওরা বসে আছে। মোহনা জানলার দিকে চেয়ে, আর নীলাঞ্জন আধ শোয়া হয়ে মোহনার গায়ে হেলান দিয়ে। বৃষ্টি এখনও ঘুমোচ্ছে। নীচে অঞ্জন উঠে মোবাইল ঘাটছে। শাখী ধড়মড় করে উঠে পড়ল। নেমে এসে সেও মিডল বার্থ নামিয়ে দিয়ে ফ্রেশ হতে গেল। ঠান্ডাটা এবার হু হু করে লাগছে। তাহলে সান্দাকফুতে কতো হবে আন্দাজ করতে পারছে।  

শাখী ফ্রেশ হয়ে এসে দ্যাখে প্রায় সবাই উঠে গেছে কামরায়। বৃষ্টি নীচে নেমে এসে গল্প জুড়ে দিয়েছে মোহনার সঙ্গে। মোহনা ঠান্ডায় প্রায় সব পড়ে নিয়েছে। এতোগুলো কেনো পড়েছে, সে নিয়ে এক প্রস্থ ঝগড়া হয়ে গেল নীলাঞ্জনের সঙ্গে। অঞ্জন ব্যাগ থেকে বিস্কিট বের করে খেতে শুরু করেছে। এই এক ওর অভ্যেস, গাড়িতে থাকলে তাঁর মুখ চলবেই। কিছু না কিছু তাঁর চাই। বৃষ্টি তাঁর হাত থেকে কেড়ে নিতে গেল। আর ওমনি সে উল্টে গেল সীটের মধ্যে। ওপর থেকে দুজন দেখছে এটা খেয়াল করার পর সে চুপ করে বসে রইল। আড়চোখে সে দেখল কালকের ছেলেটাকে। শাখী দেখছিল ওর ব্যাপারস্যাপার গুলো। বেশ ভালো লেগেছে মনে হচ্ছে। হ্যাঁ, হ্যাঁ মন মে লাড্ডু ফুটা। 

এবার ব্যাগ গুছিয়ে তারা নামার জন্যে রেডি হয়ে গেল। বৃষ্টি ছেলেগুলোর পেছনে দাঁড়িয়ে আছে। গলায় ঝোলানো তাঁর ক্যামেরা এদিক ওদিক করছে। আর বেশ চঞ্চল। শাখী একটু এগিয়ে গেলো। বলল, কি রে বলব নাকি, নাম্বারটা নেবো, বল বল। এই তুই চুপ করবি, কে না কে, তাঁর আবার নাম্বার, ভ্যাগ বলেই বৃষ্টি দরজার কাছে চলে গেল। পেছন থেকে এসে জিজ্ঞেস করল, কি হল হঠাত। ও এরকম করল কেন? শাখী বলল, ও কিছু না। তুমি একবার অনীল জ্বীকে ফোন করো, আমার ফোন থেকে লাগছে না। ফোন লাগল না অনীল জ্বীর। ব্যাপারটা বেশ গুরুতর হয়ে উঠল এবার। এদিকে ট্রেন আউটারে দাঁড়িয়ে। আর কিছুক্ষণের মধ্যে পৌঁছে যাব।

উফ অবশেষে শাখী এসে পৌঁছেছে শিলিগুড়ি জংশন। মাঝখানে তাঁর বেশ স্বপ্ন মনে হচ্ছিল ব্যাপারটা। আসলে সে যেটা ভাবত, সেটা কোনওদিন হতে দিত না তাঁর বাড়ির লোকেরা। আর তাঁর ঠিক ততটাই জেদ ছিল। বাড়ির লোক যদি উত্তরে চলে, সে চলে দক্ষিণে। একটা অদ্ভুত জেদ তাঁর চোয়াল জুড়ে ছড়িয়ে পড়ে। যুদ্ধ জয়ের মতো। এবার সে জয়ী হয়েছে। তাঁর চোখে মুখে সেই আলোর ছটা।

এরকম একটা স্বপ্ন স্বপ্ন দিনে হারিয়ে যেতে ইচ্ছে করে। মনে হয় এই তো এখানেই আছে সেই জায়গাটা। সমস্ত ভালো-লাগা এসে ভিড় করে মনে। এত্ত মিষ্টি একটা স্টেশন সে দ্যখেনি আগে। কি যে ভালো লাগে। হ্যাঁ তাঁর মুল্যায়ন গুলো এরকমই। এই নিয়ে অঞ্জন, বৃষ্টি তাঁর পেছনে লাগে সবসময়। সবকিছুই সে সহজ সরল নজরে দ্যখে। ঘড়িতে সকাল ১০ টা ৪০। বেশ কনকনে ঠান্ডা হাওয়াটা যখন চোখে মুখে লাগছে, উফ তাঁর আমেজটাই আলাদা। শাখী একবার ব্যাগ গুলো দেখে নিয়ে বাকি সবাইকে দাঁড় করিয়ে ওয়াশ রুমে গেলো। সেখান থেকে ফিরে দ্যখে ওরা এদিক সেদিক বসে আছে। শাখী আরও একবার অনীল জ্বীকে ফোন করল, পেল না। না কোনও গাড়ি এসেছে ওদের  নিতে। না কেউ ওদের অপেক্ষা করছে। ওরা তো বেশ মুশকিলেই পড়ে গেলো। এবার অঞ্জন হাল ধরল। শাখীকে খানিক বকাঝকা করবার পর সে ব্যাগ নিয়ে সামনের দোকান গুলোর দিকে এগিয়ে গেল। চায়ের দোকানের সাথে কিছু খাওয়ার দোকান আর ট্রাভেল সংস্থার ছোট ছোট গুমটি ঘর গুলো সারি করে সাজানো। উল্টোদিকেই টোটো, মারুতি, জীপ পর পর দাঁড়িয়ে। ওরা একটা চায়ের দোকানে লাগেজ রেখে দাড়াতেই দু’ একজন হাঁক পাড়তে শুরু করল, ‘দার্জিলিং, দার্জিলিং, মানেভঞ্জন।’  

শাখী চায়ের দোকানে গিয়ে বসল। আর তখুনি একটা মাঝারি হাইটের ছেলে এসে দাঁড়াল ওদের সামনে। ম্যাডাম জ্বী বহত দেড় সে দেখ রহে হ্যায় আপলোগোকো কোয়ী দিক্কত হ্যায় তো বাতাইয়েগা, পাস মে হি হামারা ট্রাভেল এজেন্সি হ্যায়, সস্তে মে কর দেঙ্গে। ওর বলার সাথে সাথে  ওদিক থেকে চায়ের  কাপ হাতে অঞ্জন এসে দাঁড়াল।  অঞ্জন সবটা শুনে একবার শাখীর দিকে তাকিয়ে ইশারায় বলল, আমি কথা বলছি। বৃষ্টি, মোহনা ওরা ওয়াশরুমে গিয়েছে। অঞ্জন এবার নীলাঞ্জনকে ডেকে ছেলেটার সঙ্গে সামনে একটা গুমটি মতো অফিস ঘরে ঢুকে গেল। শাখী তখনও চা খেয়ে যাচ্ছে। এমন সময় বাড়ি থেকে ফোন। হ্যাঁ রে পৌঁছে গেছিস। সাবধানে ঘোরাফেরা করিস। আর তোর বাবাও টেনশন করছে, তাই একটু ঠিকঠাক ভাবে থাকিস। শাখী শুধু হ্যাঁ, হু করে গেলো। ফোন রেখেই সে ব্যাগ কাঁধে নিয়ে এগিয়ে গেল। ট্রাভেল এজেন্সির হোর্ডিং এ নামটা দেখে নিল একবার। নিউ গুপ্তা টুর অ্যান্ড ট্রাভেলস। ভেতরে ঢুকে দেখল অঞ্জন বেশ মন দিয়ে ছেলেটার সঙ্গে কথা বলছে। গাড়ি, হোটেল সব নিয়ে একটা টোটাল অ্যামাউন্ট নিয়ে চাপান উতোর চলছে। আর যেহেতু অঞ্জন বেশ কয়েকবার সান্দাকফু গিয়েছে তাই তার জানা আছে ঠিক কতোটা কি টাকা লাগে। শেষে ২৫ হাজার থেকে নেমে ২১ হাজারে সে গাড়ি আর হোটেলের সব ব্যবস্থা করে দিল। শাখীর বেশ মাথা ধরে আছে। ও আর কোনও রিস্ক না নিয়ে ওষুধ খেয়ে নিল। ঘুরতে এসে যদি শরীর খারাপ হয় তাহলে তো ঘোরাটাই মাটি। 

অবশেষে সান্দাকফুর পথে। পশ্চিমবঙ্গের উচ্চতম শৃঙ্গ যার অর্থ “Height of the Poison Pants”. অঞ্জন বলল, সান্দাকফু-তে একধরনের বিষাক্ত গাছ জন্মায়, যার থেকে এই সান্দাকফু নামটি এসেছে। গাড়িতে উঠে বেশ রিল্যাক্স করে বসে গেল সবাই। অঞ্জন বসল ড্রাইভারের পাশের সিটে। শাখী, মোহনা, নীলাঞ্জন মাঝখানের সিটে আর বৃষ্টি বসল পেছনের সিটে একদম পা তুলে দিয়ে। মাটিগাড়া পেরোতেই ড্রাইভার বেশ বকতে শুরু করল। এক জায়গায় দাঁড়িয়ে সে কি একটা প্যাকেট নিল। নিয়েই গাড়িতে বসে বলল, ইসব সাথ মে রাখনা পড়তা হ্যায়। ইতনা রাস্তা চলেঙ্গে তো থোড়া বাবাজ্বি কা প্রসাদ লে লিয়ে। ‘ওহ আচ্ছা ইয়ে বাত’ বলে অঞ্জন গাড়ির জানলায় মাথা রেখে ঠান্ডা বাতাস গায়ে লাগাতে শুরু করল। শাখী পেছনে বসে সাইড মিররে অঞ্জনের মুখটা দেখছিল। আর মিটমিট করে হাসছিল। ওর সেই কথাটা মনে পড়ছিল, একটা তারা ভরা রাতের আকাশ, একটা টেন্ট। অঞ্জন আর সে দাঁড়িয়ে আছে খোলা আকাশের নীচে। চারদিক নিস্তব্ধ। পাহাড়ি হাওয়া ফিসফিস করে কথা বলছে শুধু। হঠাৎ বৃষ্টি পেছন থেকে চিল্লিয়ে উঠল, কিরে তোদের কি কারো খিদেটিদে পায় না নাকি। গাড়ি দাড় করাতে বল, খিদেয় মরে যাচ্ছি। ড্রাইভার বলে উঠল, ম্যাডাম থোড়া রুকিয়ে সামনে হি এক বড়িয়া সা ধাবা হ্যায়, ওহি যো খানা হ্যায় খা লিজিয়েগা, ফির গাড়ি একদম সে রুকেগা মানেভঞ্জন মে। 

দার্জিলিং এর সিঙ্গলিলা জাতীয় উদ্যানের পাশে পশ্চিমবঙ্গ-নেপাল সীমান্তের এই শৃঙ্গ সবচেয়ে উঁচু পয়েন্ট।এভারেস্ট, কাঞ্চনজঙ্ঘা, লোতসে এবং মাকালু- পৃথিবীর সবচেয়ে উঁচু বিন্দু। ছোটবেলা থেকে শাখীর ভূগোলের এইসব খুব ভালো লাগত পড়তে। বাকি সব পড়া বাদ দিয়ে শুধু ভূগোল নিয়েই থাকত। কেমন যেন একটা নেশা। হ্যাঁ, আর সেই নেশাই তাকে বারবার ঠেলে দিয়েছে অজানার দিকে।  অজানাকে জানার সেই যে নেশা তার ছোটবেলা থেকে তৈরি হয়েছে। শেষ হবে একদম নিশ্বাস ফুরলেইমা বলে সে নাকি একটা বাঁদর তৈরি হয়েছে। জীবনেও যে কিছু মানলো না, শুধু এই গাছ ওই গাছ, এই শহর ওই শহর। কোথাও এক ফোঁটা দু-দণ্ড বসতে শিখল না। শাখী হাসে আর বলে, তোমরা কি আর জানবে পথে পথে ঘোরার কি মজা। কি শান্তি। 

সান্দাকফু হলো তাদের জন্যে স্বর্গ যারা হয়ত খুব ভালো ট্রেকার না কিন্তু পাহাড় ভালোবাসে। সান্দাকফুকে হয়ত এজন্যেই বলা হয়ে থাকে ট্রেকার্স প্যারাডাইস। শারীরিক সেরম কোনো সমস্যা না থাকলে হেঁটে যাওয়াটাই উত্তম কারন এতে সান্দাকফু ট্রেকের সবটুকু সৌন্দর্য্য উপভোগ করা যায়। আর শাখী জানে যে, বৃষ্টি আর মোহনার একটু হলেও কষ্ট হবে। কিন্তু কষ্ট একটু হলেও আনন্দ পাবে হাজারো গুন বেশী। 

ওরা গাড়ি থেকে নামল খাবার জন্য। বৃষ্টি আগেই দৌড়ল ওয়াশরুমের দিকে। তারপর এঁকে এঁকে বাকি সবাই একটা টেবিল এ বসে পড়ল গোল করে। উলটো দিকে নেপালী এক মহিলা তার চোদ্দ-পনের বছরের মেয়েকে বুঝিয়ে দিচ্ছে কিছু। অঞ্জন আর নীলাঞ্জন দুজনেই গেল অর্ডার করতে। প্রথমে নেওয়া হলো ৩ প্লেট চিকেন মোমো আর এক প্লেট ভেজ। শাখী ভেজ মোমো খেতেই খুব ভালো বাসে। তার সঙ্গে দিয়ে গেল গরম গরম ধোঁয়া ওঠা স্যুপ। এতেও খিদে না মেটায় আবার এক দফা ডিমের পোচ। আহ এই ঠান্ডায় যেন অমৃত। তারপর এলো বিখ্যাত চা। ওদিকে ড্রাইভার তাড়া দিচ্ছে। সাব জ্বী জলদি চলিয়ে, এক বজে তক পহচ জানা চাহিয়ে। ফির লৌট না ভি হ্যায়। শাম কো থোড়ি দিক্কত হ্যায় ইধার। মোহনা আর বৃষ্টি গাড়ির দিকে যেতেই একটা গাড়ি ওদের একদম গা ঘেঁষে এসে দাঁড়াল। বৃষ্টি চিৎকার করে কিছু একটা বলতে যাবে। তখুনি সেই ট্রেনে দেখা ছেলে দুটো গাড়ির দরজা খুলে নেমে এলো। বৃষ্টির মুখটা ছিল দেখার মতো। অর্থাৎ সে হয়ত চাইছিলই যে আবার দেখা হোক। মোহনা ওকে টানতে টানতে নিয়ে গেল। শাখী, অঞ্জন আর নীলাঞ্জন গাড়িতে উঠে বসল। এবার একটু অল্টারনেট করে বসল সবাই। নীলাঞ্জন গেল সামনে। অঞ্জন এসে বসল মোহনা আর শাখীর পাশে। আর বৃষ্টি যথারীতি পেছনের সিটে বসেই যাবে ঠিক করল। 

হু হু করে হাওয়া দিচ্ছে এবার। শাখী জানলার পাশে বসেছিল। তাই জানলার কাঁচ নামিয়ে দিল। মাথা রাখল অঞ্জনের কাঁধে। এতটা ট্রেন জার্নির পর একটু চোখ বুজে এসেছিল শাখীর। পেছন থেকে বৃষ্টি আওয়াজ দিল, কি হে জোড়া শালিক। বেশি কাছাকাছি ঘেঁষো না। আমি কিন্তু বলে দেবো কাকিমা কে। শাখী চোখ বন্ধ করেই বলল, যা না বল, আমি ভয় করি না। ওর গুতোয় আর ঘুমনো হল না। এবার চোখের বেশ আরাম হলো। চারিদিকে এত সবুজ আর সুন্দরের মেলা। চা বাগান এর ভেতর দিয়ে গাড়ি চলছে। পাহাড়ি রাস্তায় এবার ওঠা শুরু। দূরে মেঘ গুলো কেমন আনমনা। যেন কোনও এক কিশোরী বেণী দুলিয়ে এক্কা দোক্কা খেলছে। আর উঁচু উঁচু পাহাড় গুলো বুড়ো দাদুর মতো গম্ভীর। কত দিন এতো সবুজ দেখেনি সে। ছোটবেলা মামা বাড়িতে গিয়ে সে সারাদিন চা বাগানে বসে থাকত। হ্যাঁ তার দাদুর বাড়ি উত্তরবঙ্গে। কিন্তু কখনই ঘোরা হয়নি এইদিকটা। ঘুরতে যাওয়ার নাম উঠলেই মায়ের কাছে ধমক খেতে হতো, আর ঠাকুমা বলত ধিঙিপনা না করলেই নয়। পাড়া প্রতিবেশীর কাছে কোনও মান সম্মান রইল না আর। আহ, সেই সব দিন। শাখী জানলার কাঁচ খুলে বাইরেটা দেখছে। সে বার বার ফিরে আসবে এইসব দেখার জন্যে। 

আস্তে আস্তে ঠান্ডা বাড়তে শুরু করল। মেঘও জমতে শুরু করেছে। মেঘের ফাঁক দিয়ে রোদের আঁকিবুঁকি। পাহাড়ি রাস্তায় গাড়ি তখন ফুল স্পিডে। গাড়িতে গান চলছে, ইন বাদিও মে টকরা চুকে হ্যায়… হামসে মুসাফির ইউ তো কয়ি। পাহাড়কে বাঁ দিকে রেখে গাড়ি উঠছে তো উঠছেই। ঝরা পাতা উড়িয়ে, নিঃসঙ্গ পথিককে পিছনে ফেলে। জড়িয়ে ধরছে হিম ঠান্ডা হাওয়া। রাস্তার পাশের বাড়িগুলো কী সুন্দর। লাল, নীল, বেগুনী। উঠোন জুড়ে ফুলের গাছ। হাত বাড়ালেই এবার মেঘ ছুঁয়ে ফেলবে শাখী। মাঝে মাঝে রাস্তাটা ডুব মারছে গাছের ছায়ায়, খাদের ভেতর থেকে উঁকি মারছে অতলান্ত সবুজ।

সান্দাকফু ট্রেকে সিজন ভেদে তাপমাত্রা দিনের বেলা ১২-২০ ডিগ্রি সেলসিয়াস এবং রাতের বেলা মাইনাস ৫ থেকে ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস পর্যন্ত হতে পারে। শাখীর বেশ ভালোই ঠান্ডা লাগছিল। সে হাতে গ্লাভস পড়ে নিয়েছে অলরেডী। তবু ভেতরটা যেন বেশ কাঁপিয়ে দিয়ে যাচ্ছে।  ঠান্ডার সাথে বাতাস দিচ্ছে হু হু করা। যদিও তাঁদের আসাটা বেশ ভালো সময়েই হয়েছে। কিন্তু লাক কতটা ভালো সেটাই দেখার। রডোডেনড্রন যখন ফোটে তখন কি যে সুন্দর দেখায় চারদিক। কিন্তু সেও তো এপ্রিল থেকে মে-র সময়টা। সে যাক গে ঠান্ডায় প্রায় জমে যাওয়ার জোগাড়। চা না পেলে যেন জমেই যাব। নীলাঞ্জন আর মোহনাও তখন থেকে বেশ খুনসুটি করছে। মানেভঞ্জন এখনও প্রায় এক ঘন্টা। ড্রাইভার ওদিক থেকে বকবক করে যাচ্ছে। তার তখন চিন্তাভাবনার লেভেল হাই। সে বকেই যাচ্ছে। পাইনের জঙ্গলের ভেতর দিয়ে একটার পর একটা বাঁক আসছে আর মোহনা চোখ বন্ধ করছে। পেছনে বৃষ্টি কানে হেডফোন দিয়ে জানলা দিয়ে তাকিয়ে আছে। মেয়েটা এত চুপচাপ হয়ে গেল কেন, কে জানে। আর একটা মারাত্মক টার্ন নেওয়ার পর আমাদের সবার অবস্থাই বেশ সঙ্গীন। এবার গাড়ি এক জায়গায় দাঁড়াল। এখান থেকে মানেভঞ্জন দেখা যায়। আমরা চা নিয়ে একটা বেঞ্চে বসলাম।

মেঘগুলো পর পর যেন হেঁটে যাচ্ছে কোনও এক মিছিলের দিকে। না কোনও তাড়া নেই তাঁদের। শুধু জানিয়ে দেওয়া যে সন্ধে নেমে আসার আগে সবাই যেন ঘরে ঢুকে যায়। ঝুপড়ি চায়ের দোকানগুলোর পাশেই আমরা যেখানে বসেছিলাম, সেটা একটা কবরখানা। অনেক পুরনো সে কবরস্থানে এখন আর  নতুন কাউকে দাফন করা হয় না। একটা পাহাড়ি কুকুর প্রায় গা ঘেঁষে শাখীর পাশে এসে দাঁড়াল। শাখীর হঠাত মনে হল এই অতলান্ত গভীর খাদের পাশে দাঁড়িয়ে একটা অন্য জগত। ওপাশেই সেই রূপকথার জগত। শাখী খানিকক্ষণ চুপ করে দাঁড়িয়ে রইল। বৃষ্টি ছবি তুলছে পাইন গাছের, জঙ্গলের। পাহাড়ের গা এলিয়ে যাওয়া মেঘেদের। আর শাখী কেমন যেন এক হারিয়ে যাওয়া স্বপ্নের ঘোরে একটু এগিয়েই গিয়েছিল। হঠাত অঞ্জনের ডাকে সে সম্বিৎ ফিরে পেল। এবার এখান থেকে যেতে হবে। চল জলদি। 

গাড়ি এবার যে রাস্তায় আমাদের নিয়ে যাচ্ছে, সে রাস্তাটা এতটাই খারাপ। যেন আমরা রাইডে উঠেছি। যেখান থেকে একটু এদিক ওদিক হলেই। কাজ খতম। পাথুরে রাস্তার বাঁকে ড্রাইভার যে গাড়ি চালাচ্ছে তাতে আমরা গাড়ির মধ্যেই লাফাচ্ছি। যে যার সিট আঁকড়ে বসে আছি। 

কিছুক্ষণের মধ্যেই একটা ভালো রাস্তা আর বেশ কিছু বাড়ি চোখে পড়ল।  ঘড়িতে বাজে ৩টে। এর মধ্যেই রোদ্দুর পড়ে এসেছে। গাড়ি একটা জায়গায় গিয়ে থামল। সামনেই একটা হোটেল। আর বেশ কিছু দোকান সারি দিয়ে। যেখানে শীতের জামা কাপড়, রঙিন টুপি, মাফলার বিক্রি করছে নেপালী মহিলারা। ড্রাইভার বলল, সাবজ্বী আ গয়ে হমলোগ। শাখী তো বেশ হতভম্ব। এর মধ্যে পৌঁছে গেলাম। বলল যে এক ঘন্টা লাগবে। ড্রাইভারকে জিজ্ঞেস করতে সে বলল, বো জিস রস্তে সে আপলোগো কো লেকে আয়ে, উস রস্তে মে কোয়ী নেহি যাতা। পর হাম তো পাক্কা খিলাড়ি হ্যায়। তভি আপকো হাম চালিশ মিনিট মে পহচা দিয়া।  মুখে বাহ বলে ড্রাইভারকে বলল, হ্যাটস অফ টু ইউ। আপ কামালকে হো।’ ওদিকে নীলাঞ্জন আর অঞ্জন গাড়ি থেকে সব ব্যাগ পত্তর নামাতে শুরু করেছে। মোহনা, বৃষ্টি কোমরে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে। দেখেই মনে হচ্ছে কি ঝড়টাই না গিয়েছে। 

বৃষ্টি চেঁচিয়ে উঠল, আর কতক্ষণ। পারছি না আর দাঁড়াতে। ধুর, কি রাস্তা দিয়ে নিয়ে এলো মাইরি।  ওই ছোট রাস্তার মধ্যেই ১০ থেকে ২০ বছরের বাচ্চা ছেলেরা একটা গার্ডার দিয়ে বানানো কিছু একটাকে ফুটবল এর মতো ড্রিবলিং করছে। দেখেই মনে হয় এদের পায়ের জোর কতটা। যারা এত সাবলীল ভাবে স্প্রিং খেলছে। তাহলে ফুটবলে তাঁদের কবজা হবে নাই বা কেন।  যাই হোক, ওদিকে কথা বার্তা হয়ে গেছে। আগামীকালের জন্যে গাড়ি বুক করা হবে এখান থেকেই। আপাতত হোটেলের দিকে এগোতে শুরু করলাম। আসলে এগোলাম না, খানিকটা পিছিয়ে আসতে হোলো। হোম স্টে’টা পাহাড়ের খাদে গা ঘেঁষে। সিঁড়ি দিয়ে নীচে নেমে একটা করিডর পেরিয়ে দুটো রুমের হোম স্টে, খাওয়া দাওয়া সহ। একটা ২ বেড, আর একটা ডরমেটরি। একে তো ঠান্ডায় হাত পা জমে যাচ্ছে। তার ওপর খিদেয় পেটে ছুঁচোয় ডন মারছে। যে যার মতো রুমে ঢুকে পড়ল ওরা। ড্রেস  চেঞ্জের ব্যাপার নেই, শুধু ফ্রেশ হয়েই দরজা লক করে বেরিয়ে পড়ল ওরা। পাহাড়ের ওই পাড়ে সূর্য ঘুমের দেশে যাওয়ার প্রস্তুতি শুরু করে দিয়েছে। আর মেঘের আনাগোনা আস্তে আস্তে বেড়েই চলছে। শাখী অঞ্জনের সঙ্গে একটু এগিয়ে দেখছিল কোথায় কি খাবারের দোকান আছে। ঠান্ডা হাওয়া ভেতর থেকে কাঁপিয়ে যাচ্ছিল। গরম মোমোর খোঁজে সামনেই এক নেপালি দিদির দোকানে ঢুকে পড়ল। পেছনে বৃষ্টি আর মোহনা। নীলাঞ্জন হোটেল এর রুম লক করে খানিক পড়ে এলো। ততক্ষণে শুরু হয়েছে কে কি খাবে । বৃষ্টি এক প্লেট চিকেন মোমো অর্ডার করল। মোহনা আর নীলাঞ্জন ভাত আর চিকেন কষা অর্ডার করল। শাখী কি খাবে ডিসাইড করতে না পেরে বলল নুডলস খাবে, আর অঞ্জন এক প্লেট বিফ মোমো অর্ডার করল। এখানে সব কিছু সন্ধে সাতটার মধ্যেই বন্ধ হয়ে যায়। তাই মিষ্টি দেখতে দিদিটা বলল, আপলোগো কো অগর খানা চাহিয়ে হো তো বোল দিজিয়েগা, হাম লোগ পহচা দেঙ্গে। অঞ্জন বলল, বাহ বেশ তো, তব রাত কে লিয়ে ফিফিটিন পিস রোটি অর চিকেন হি ভেজ দিজিয়েগা। হামলোগ সামনে হি হ্যায় প্রধান হোমস্টে পে। 

খাওয়া দাওয়ার পর ঠিক করা হল সাইড ভিউ করতে বেরনো হোক। বৃষ্টি ক্যামেরা হাতে কখন একটা বেরিয়ে গেছে শাখীরা কেউ খেয়াল করেনি। ওর এই স্বভাব, হুটহাট করে কোথায় বেড়িয়ে যায়। আবার হাজিরও হয় ভূতের মতো। ও তো বলেই রেখেছে, সে যখন টপকে যাবে, মজাদার ভূত হবে আর নীলাঞ্জন মোহনা, শাখী অঞ্জনের বেড রুমে গিয়ে লাইভ দেখবে। এই শুনে মোহনা ওকে এই মারে কি সেই মারে। সে যাক গে। ওরা চারজনেই বেরিয়ে পড়ল। অঞ্জন ক্যামেরা না নিয়ে গোপরোটা নিয়ে চলল। মোহনা অনেকটা এগিয়ে গেছে। ওকে ডাকতে ডাকতে নীলাঞ্জনও প্রায় দৌড়ে গেল। শাখী অঞ্জনকে বলল, নিশ্চয়ই আবার কিছু নিয়ে দুজনের ঝামেলা হয়েছে। বেশ তো ছিল। অঞ্জন বল, সে যাকগে তুই এদিকে আয় তো। বলেই শাখীকে জড়িয়ে হাঁটতে শুরু করল। হাতে হাত রেখে দুজনে হাঁটছে আর গল্প করছে। ওরা যে হোম স্টে’ তে উঠেছে সেই চড়াই থেকে দেখা যাচ্ছিল। একটা মাঠও আছে। হালকা কুয়াশার ভেতর কয়েকটা বাচ্চা ছেলে খেলছে। ওদের চিৎকার, খুনসুটি পুরো পাহাড়ি এলাকায় ছড়িয়ে পড়ছিল। অঞ্জন তাঁর প্রথমবার পাহাড়ে আসার কথা বলছিল। আর শাখী মন দিয়ে শুনছিল। ওর বেশ ভালো লাগছে এভাবে হাঁটতে। পাইনের জঙ্গল বেশ ঘন এদিকে। হুটহাট গাড়ির আসছে। একটা বাংলোর সামনে দাঁড়াল ওরা। কেমন যেন সেই হলিউডের সিনেমার মতো। দীর্ঘ পাইন গাছ গুলো কত কত বছর এভাবে দাঁড়িয়ে আছে। শাখীর বেশ ভয় করতে লাগল একটু। ভুতুড়ে ব্যাপার স্যাপার। অঞ্জন ওকে ভয় দেখানোর জন্যে অনেক চেষ্টাও করল। 

এবার সন্ধে নেমেই গেছে প্রায়। মানেভঞ্জনে খুব তাড়াতাড়ি সন্ধে নেমে আসে। তাঁর উপর লোকজনও প্রায় কম এখন। ওরা নেমে আসছিল, একটা দুটো করে লাইট জ্বলে উঠছে পাহাড়ি বাড়িগুলোতে। যেন আকাশের গায়ে তারা ফুটে ওঠা। শাখী অনেকক্ষণ আনমনা হয়ে অঞ্জনের হাত ধরে হাঁটছে দেখে। অঞ্জন বলল, এই তোমার একটা লেখা শোনাও না। খুব ইচ্ছে করছে শুনতে। শাখী খানিক চুপ করে বলল, আমি যে সেভাবে বলতে পারি না কিছুই। তবে এই পাহাড়ে নিয়ে এসে তুমি আমার একটা স্বপ্ন পূরণ করেছ। সত্যিই কখনও ভাবিনি যে, এভাবে আসতে পারব। বরাবর চেয়েছিলাম। কিন্তু সঠিক সঙ্গী পাইনি। তোমার জন্যে সেই স্বপ্ন পূরণ হল।  অঞ্জন শাখীর হাতটা আরো জোরে চেপে ধরে হাতে একটা আলতো করে চুমু খেলো। 

১০

রাতে ওরা তাড়াতাড়ি খাবার খেয়ে যে যার মতো শুয়ে পড়ল। বৃষ্টি একা একটা বিছানায় ৩টে কম্বল নিয়ে একদম নট নড়ন চড়ন। ওর আর শব্দ পাওয়া যাচ্ছে না কোনও। অঞ্জন শাখীও শুয়ে পড়ল তাড়াতাড়ি। ওদিকে মোহনা আর নীলাঞ্জনের মধ্যে কিছু একটা নিয়ে খানিক মন কষাকষি চলছে। সেটাও থেমে গেল। অঞ্জন একটা সিগারেট ধরিয়ে বাইরে ব্যালকনিতে গিয়ে দাঁড়াল। ওর দেখাদেখি শাখীও পাশে গিয়ে দাঁড়াল। টেম্পারেচার এখন মনে হয় ৩ কি ৪ ডিগ্রিতে। বাইরেটা একদম নিস্তব্ধ। শুধু টুপটাপ করে শিশির পরার শব্দ শোনা যাচ্ছে। আর বাতাস এসে কানে কানে বলে যাচ্ছে এবার ঘুমোতে যাও। 

কাল সকাল আটটায় আসবে ড্রাইভার। তাই একটু তাড়াতাড়ি ঘুমনোই ভালো। বৃষ্টি অঘোরে নাক ডেকে ঘুমোচ্ছে। পাহাড়ি শেয়ালের ডাকে একটু চমকে উঠে শাখীও এবার ঘুমনোর চেষ্টা করল। অঞ্জনকে জড়িয়ে ধরে সে ঘুমিয়েই পড়েছিল। হঠাত রাত ৩টে নাগাদ ওর ঘুম ভাঙল। দেখল দেওয়ালে একটা ছায়া। নাইট বাল্বের আলোয় শুধু ঘড়িটা দেখা যাচ্ছে। টিকটক আওয়াজ ছাড়া আর কিছুই শোনা যাচ্ছে না। কেমন ভয় করতে লাগল শাখীর। ও হলুদ নাইট বাল্বের দিকে অনেকক্ষণ তাকিয়েই রইল। আর কিছুতেই ঘুম আসল না। ওর মনে হলো কেমন একা একটা রুমের মধ্যে শুয়ে রয়েছে, আর চারদিকে কারা সব ফিসফাস করছে। সে কোনওমতে চোখ বন্ধ করে আবার জড়িয়ে ধরল অঞ্জনকে। 

সকাল বেলা ঘুম ভাঙল পাহাড়ি এক পাখির ডাকে। জানলার পর্দা সরিয়ে দেখল সকাল অনেকক্ষণ আগে হয়ে গেছে। ও ঘর থেকে খিলখিল করে হাসির শব্দ আসছে। তার মানে নীলাঞ্জন মোহনা জেগে গেছে। বৃষ্টি যথারীতি বিছানায় নেই। আকাশের সেই গুরু গম্ভীর ফিসফাস আর নেই। মেঘ কেটে গেছে। আর আজকের দিনটাও একটা দারুন দিন। আজ বড়দিন। গোটা পাহাড় সেজে উঠেছে লাল সাদায়। জানলার কাচে তখনও গুঁড়ো গুঁড়ো শিশিরকণা লেগে। বাইরের গাছটার ডালপালায় অচেনা সব পাখি। শাখী উঠে পড়ল। অঞ্জনও উঠে ফ্রেশ হয়ে নিল। ব্রেকফাস্ট করতে হবে। তারপর বেরনো আছে। অনেকটা পথ। এখান থেকে টুমলিং, তারপর কালাপোখরি অবদি ল্যান্ড রোভার গাড়িতে করেই যাব ঠিক হলো। বাকি পথ হেঁটে। আর ফেরার সময় ট্রেকিং। 

আজকের চলা শুরু সিঙ্গলিলা ন্যাশনাল পার্কের ভেতর দিয়ে।  কিছুটা এগিয়ে এসে সিঙ্গালিলা ন্যাশনাল পার্কের এন্ট্রি পার্মিট নিতে হয় । সিঙ্গালিলা ন্যাশনাল পার্কের এন্ট্রি গেট ছাড়িয়ে গাড়ি যতই এগিয়ে চলল, রাস্তার চড়াইও তত বাড়তে শুরু করেছে । প্রথম দুই তিন কিলোমিটার এই বুঝে গেছি জার্নিটা কি রকম হতে চলেছে। বোল্ডার বসানো পাথুরে রাস্তায় গাড়ীর ঝাঁকুনিতে মাঝে মাঝেই এদিক ওদিক ঠোকা লাগছে । কিন্তু রাস্তার দুপাশের চোখজুড়ানো, মনভুলানো দৃশ্য সবকিছু ভুলিয়ে দিচ্ছে । কিছুক্ষণ আগে পর্যন্ত আমরা ৫ জন ছিলাম, তারপর আমাদের দুজন নতুন বন্ধু মিলিয়ে ৭ জন এবং আমাদের গাড়ির ড্রাইভার শেরপা। সব মিলিয়ে আমরা ৮ জন এখন । 

ও হ্যাঁ এই নতুন দু’জনের কথা বলে নিই। এরা হলো সেই তারা, যারা ট্রেনে বৃষ্টির সঙ্গে কথা বলছিল। কাল বিকেলে যখন সে ক্যামেরা নিয়ে হাওয়া হয়েছিল, তখুনি নাকি এদের দেখা পেয়েছিল। আর আমন্ত্রণ জানিয়েছিল একসঙ্গে যাওয়ার। তা ভালোই হলো। একসঙ্গে গেলে জোরও পাওয়া যায় বটে। 

সান্দাকফু’তে আমরা উঠব সানরাইজ হোটেলে। সব আগে থেকেই বুক করা আছে। তাই সে চাপ নেই। 

বেশ কিছুক্ষণ গাড়ি চলার পর আমরা যখন চিত্রে তে পৌছলাম। আশপাশের সৌন্দর্য পুরো বদলে গেছে। গাছ খুব একটা নেই। কিন্তু নীল আকাশ আর চারদিকের পরিবেশ মিলিয়ে বেশ অন্যরকম। ল্যানডরোভারের সামনেই বসেছে মোহনা। সে সকালেই বলে রেখেছিল, গাড়িতে আজ সে ড্রাইভারের সিটেই বসবে। তার পাশে নীলাঞ্জন। আর শাখী, অঞ্জন, বৃষ্টি আর ওই দুজন চাপাচাপি করে পেছনেই বসেছে। অরিজিত সিং এর গান চালিয়ে শেরপা নিজের মতো গাড়ি চালিয়ে যাচ্ছে। একবার এদিক টার্ন, একবার ওদিক টার্ন। আমরা একটা দেশলাই বক্সের ভেতর যেন ড্রপ খাচ্ছি। এরকম করে প্রায় দুলতে দুলতেই পৌছলাম গৈরিবাসে। এখান থেকে সান্দাকফু প্রায় ১৬ কিমি। আর এই ১৬ কিলোমিটার রাস্তাই হলো পুরোপুরি অফরুট। 

চিত্রে থেকেও উঁকি দিচ্ছে কাঞ্চনজঙ্ঘা, স্লিপিং বুদ্ধ । আমরা খুব বেশী সময় অতিক্রান্ত না করে সেখান থেকে আবার ল্যান্ড রোভারে চেপে বসলাম । রাস্তা বলতে প্রায় কোন রাস্তাই নেই । বড় বড় পাথর বসানো গ্রাভেল রোড । তার উপর দিয়ে ১৯৫৭ সালের ল্যান্ড রোভার ছুটে চলেছে । আমাদের পরবর্তী গন্তব্য টামলিং। এইখান থেকে সমস্ত কাঞ্চনজঙ্ঘা রেঞ্জ একসাথে খুব সুন্দর ভাবে দেখা যায় । তাই এখানে নেমে একপ্রস্থ ছবি না হলে কি আর হয় । সিঙ্গালিলা ন্যাশনাল পার্ক ফেব্রুয়ারি মার্চ মাসে সেজে ওঠে রোডোডেনড্রনের রঙিন পোশাকে । তা ছাড়াও বিভিন্ন বন্য প্রানীদের বসবাস এখানে । তাই চলার পথে শক্ত করে ল্যান্ডরোভারের লোহার রডগুলি ধরে থাকার সাথে সাথে চোখ থাকছিল আশেপাশের ঘন জঙ্গলে এবং দূরে তুষারাবৃত পর্বতমালা তে ।

মানেভঞ্জন থেকে সান্দাকফু মাত্র ৩২ কিলোমিটার হলেও এই দূরত্ব অতিক্রম করতে প্রায় চার থেকে পাঁচ ঘন্টা লেগে যায় । কারণটা আর কিছুই না, এখানে রাস্তা বলতে যা বোঝায় তা হল বড় বড় পাথর বিছানো কিছুটা সমতল জায়গা । গাড়িতে গান চলছে ‘লম্বরগিনি চালায়ে জানে ও/  সানু ভি ছুট্টা দে দো… আর পাশ থেকে মোহনা ‘ওম ভূবঃ ভব স্বঃ তৎসবিতুবরণ্যয়ম ভার্গো দেবস্য ধীমোহিধীয়োয়ন প্রচোদয়াৎ’ জপ করে চলেছে। আর শাখী, অঞ্জন বৃষ্টি ততই হাসছে। মোহনা রেগে আর কথাই বলছে না। শুধু চুপ করে জপ করে যাচ্ছে। 

টামলিং পৌঁছে আমরা কিছু খাওয়ারের জন্যে দাঁড়ালাম। এখানে হালকা রোদ্দুর আর মেঘ করে আসছে এবার। ওয়েদার খারাপের দিকে। ছোট হোমস্টেটা বেশ সুন্দর। গরম গরম কফি, ম্যাগি আর সেদ্ধ ডিম খেয়ে আমরা গাড়িতে উঠে বসলাম আবার। কিছু দূর যেতেই দুজন নেপালী বি এস এফ গার্ড গাড়ি আটকালো। যেহেতু এই রাস্তাটা নেপালের ভেতর দিয়ে গেছে, তাই ড্রাইভারকে কিছু জিজ্ঞেস করছিল আর কি। শাখীকে দেখে জিজ্ঞেস করল, কাহা সে হো আপলোগ। শাখী বলল, কলকাত্তা। বেশ মজা করেই বলছিল ওরাও, হাম লোগ বাংলাদেশ সে হ্যায়। ওদের উর্দীতে লেখাই আছে নেপাল গার্ড। তাই আর কিছু না বলে ওই লাল লাল গালের দুই জওয়ানকে ওখানেই আলবিদা করে আবার এগিয়ে চলতে শুরু করল। এবার রাস্তা ভীষণই খারাপ। আর ওয়েদারের অবস্থা বেশ খারাপের দিকেই যেতে শুরু করেছে। বরফ আমরা টামলিং ঢোকার আগেই পেয়েছি অল্প অল্প। এদিকে ঝাকুনিতে শরীরের কলকবজা ঢিলে হওয়ার জোগাড়। গৈরিবাসে পৌছনোর রাস্তায় শাখী দেখল একটা গাড়ি কিছুতেই এগোতে পারছে না। রাতের বরফ গলে জায়গাটা কাদায় আরও বাজে হয়ে গেছে। গাড়ির চাকা এগোচ্ছে না কিছুতেই। ওদের গাড়ি আবার কিছুটা পিছিয়ে আনল ড্রাইভার। নীচে থেকে ওই গাড়ি ঠেলে তুলছিল দুজন জওয়ান। হয়ত ফ্যামিলি নিয়ে ঘুরতে বেরিয়েছে। ওদের পাশ কাটিয়ে ল্যান্ড রোভার এগোতে লাগল। পাথুরে রাস্তা আর মেঘ জমে থাকা আকাশ। সামনে কিছুই দেখা যাচ্ছে না। মোহনা বেশ ভয় পেয়েছে। ভয় যে শাখীও পায়নি তা নয়। সে শুধু অঞ্জনের একটা হাত ধরে আছে। আর মাঝে মাঝেই ঠোকর খাচ্ছে গাড়ির জানলায়। মনে হচ্ছিল আজ আর আস্ত থাকবে না কিছুই। রাস্তায় বেশ বরফ জমেছে। তাঁর মধ্যেও অনেকে হেঁটে হেঁটে যাচ্ছে। হয়ত নীচে আরও নীচে সওদা করতে। বাড়ির জিনিস পত্র আনতে। এদের শক্তি দেখলে সত্যি অবাক হতে হয়। আর আমরা সমতলের মানুষ এতটাও পারব না কখনও। শাখীর এই প্রথমবার সান্দাকফু আসা। বাড়িতে যদি জানতে পারে, তাকে আস্ত রাখবে না। কিন্তু কি করবে, আদত সে মজবুর। বৃষ্টি ছেলে দুটোর সঙ্গে বেশ মজা করছে। দেখেও ভালো লাগল, যে সে খোলস ছেড়ে বেরোতে পেরেছে। 

এর মধ্যে গৈরিবাস পৌছে গেছি। একটা ধূসর দিন। একটা চেক পোস্ট। একটা ছোট হোটেল আর কয়েকটা বাড়ি ছাড়া কিছুই দেখতে পেলো না শাখী। গাড়ি এখানে থামবে কিছুক্ষণ। তাই তারা নেমে গেলো গাড়ি থেকে। মোহনা অঞ্জনকে নিয়ে হোটেলে ঢুকল ওয়াশরুমে যাওয়ার জন্যে। কয়েকটা বাচ্চা ছেলে চওক মতো জায়গায় ব্যাডমিন্টন খেলছে। তাদের হাসির আওয়াজ গোটা পাহাড় জুড়ে ছড়িয়ে পড়ছে। লাল লাল গালের টুকটুকে বাচ্চাগুলো কি মিষ্টি। তাদের দেখলেই সূর্য নিজেই লজ্জায় মুখ লুকোবে। ড্রাইভার ওদের কিছু চকলেট আর বিস্কিট দিয়ে এলো। এখানকার এটাই রীতি। যে ড্রাইভারই আসুক না কেন। ওদের জন্যে কিছু না কিছু আনবে। শেরপাও বিভিন্ন জায়গায় থেমে বাচ্চাদের কিছু না কিছু দিচ্ছিল। 

গৈরিবাস থেকে এবার কালিপোখরির দিকে যাত্রা শুরু। শেরপা তাঁর ল্যান্ডরোভার নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে, আর আমরা ততই অবাক হচ্ছি। অঞ্জনের কাছে যদিও ব্যাপারটা নতুন নয়। সে বুঝিয়ে দিচ্ছিল কোথায় কি। গল্প করছিল তাঁর প্রথমবার বন্ধুদের সঙ্গে আসার অভিজ্ঞতা। গাড়ির ঝাঁকুনিতে সবারই অবস্থা কাহিল। একটু এদিক ওদিক হলেই গাড়ি খাদে। শাখীর একটুও ভয় লাগছিল না, কেবল রোমাঞ্চ অনুভব করছিল। এই তো চাই, এটাই তো ছিল জীবনের চাওয়া। 

দীর্ঘদিনের জমে থাকা স্বপ্নটা আজ বাস্তব । মনের মধ্যে ভালোলাগা উপচে পড়ছে। প্রাণের মধ্যে এসেছে এক নতুন চঞ্চলতা । ওরা সকলেই ব্যস্ত প্রকৃতির রসাস্বাদনে। চেটেপুটে খেয়েও যেন স্বাদ মেটে না । প্রতি মুহূর্তে বদলে যাচ্ছে রূপসীর রূপ । এখানে সূর্যের প্রথম কিরণ যেন গ্যালন গ্যালন সোনা গলিয়ে ঢেলে দিয়ে যায় চারিদিক । বেলা বাড়ার সাথে সাথে তার বয়স যেন বাড়তে থাকে । তার যৌবন এর উচ্ছলতায় চারদিক মাতিয়ে তোলে । কালিপোখরি পৌছনোর পর বেলা তিনটে হয়ে গেছে। শেরপা বলল  ডিসেম্বর মাস, তাই রাস্তায় বরফ জমে গিয়ে শক্ত হয়ে যাওয়ার জন্য তার উপর দিয়ে গাড়ি চালানো সম্ভব নয় । তাই সান্দাকফু গাড়ি নিয়ে যাওয়া রিস্কি হয়ে যেতে পারে । আর বিপদও অনেক । অঞ্জন বলল, এখান  থেকে ট্রেক করবে। শাখী রাজি হয়ে গেল। শুধু মোহনা আর বৃষ্টি খানিক দোনোমোনো করতে লাগল। তারপর উপায় না দেখে ওরাও বলল, ঠিক আছে। ঠিক করা হল লিড করবে অঞ্জন, শাখী, বৃষ্টি আর মোহনা থাকবে মাঝে নীলাঞ্জন থাকবে পেছনে। আর বাকি দুজনও আসবে ওদের পেছনে। ফিরে যাওয়ার সময় যদি কোথাও যাওয়া যায় সেটা দেখা যাবে।

বরফ পড়তে শুরু করে দিয়েছে। সঙ্গে হাওয়ার তেজও বাড়তে শুরু করল। বেশ বেগ পেতে হবে এবার। সবার কাঁধেই রাকস্যাক। আর সঙ্গে একটা লাঠি। প্রথমে রাস্তা বেশ ঠিকঠাক। চড়াই কম। এবার শুরু হল আসল রাস্তা। কিছুদূর যেতে না যেতেই হালকা নিশ্বাসের কষ্ট । শাখী, মোহনা, বৃষ্টি একটা করে বাঁক উঠছে আবার বসে পড়ছে। চারদিক এই তিনটেতেই কেমন অন্ধকার। গাছের ওপর সাদা তুষারের স্তর। রাস্তায় কেউ সাদা চাদর পেতে দিয়েছে। দূর দূর অবদি কিছুই দেখা যাচ্ছে না। কপালে দুর্ভোগ আছে।  ওপর থেকে দুজন নেমে আসছে। শাখীদের দেখে বল, সামহালকে জাইয়েগা, রাস্তা বহুত হি খারাব হ্যায়। 

খাড়াই রাস্তা শুরু হয়ে গেছে। অঞ্জন বলল, শর্টকার্ট আছে। সিঁড়ি দিয়ে উঠলে তাড়াতাড়ি পৌঁছতে পারব। কিন্তু সিঁড়ি দিয়ে উঠতে বেশি হাঁফ লাগছিল তাই আবার রাস্তা দিয়েই চলতে শুরু করলাম। সবাই বেশ আস্তে আস্তেই হাঁটছে। শাখী যতটা পারছে দম নিয়ে নিয়ে অঞ্জনের পেছন পেছন হাঁটছিল। নাহলে ধপাস করে পড়ে যাওয়ার ভয়। রাস্তা যেন কিছুতেই শেষ হচ্ছে না। 

সান্দাকফুর একটা মজার ব্যাপার হলো, পাহাড়ের মাথার উপর দিয়ে যে রাস্তা গেছে, সে রাস্তার একপাশে ভারত আর একপাশে নেপাল । সারা পৃথিবী জুড়ে যেখানে সীমান্ত সমস্যা নিয়ে যুদ্ধ বেধে যায়, সেখানে চোখের নিমেষে এক দেশ থেকে আর এক দেশে চলে যেতে পারবেন । খেলার ছলে । অথবা রাতে ঘুমোতে যাই নেপাল এ আর সকাল এ উঠে ব্রাশ করলাম ভারত এ । এক অনন্য অনুভূতি । শেরপা চালেট এবং সানরাইজ হোম স্টে দুটি নেপালে অবস্থিত। ভারতের দিকে একটি ইয়ুথ হোস্টেল রয়েছে । “It is Hell and It is Heaven”. 

শাখী ভাবল রাস্তাটা হেল- এর মতো আর পৌঁছে যাওয়ার পর এটা সত্যিই হেভেন। এদিকে বারবার জলের তেষ্টা পাচ্ছে। কিন্তু শাখীদের কারও কাছেই জল নেই। মানেভঞ্জন থেকে আসার সময় যে জল নেওয়া হয়েছিল। তার প্রায় অর্ধেকটাই শেষ গাড়িতেই। 

বিকেল পাঁচটা বাজে। সন্ধে প্রায় হয়ে এসেছে। কিছুতেই আর রাস্তা শেষ হচ্ছে না। পাহাড়ের একটা বাঁক আসতেই খাড়াই এতটাই বেশি, পড়ে গেলেই অতল গভীরে তলিয়ে যেতে হবে। একটা জায়গায় এসে দেখল ওরা প্রত্যেকেই আলাদা হয়ে গেছে। শাখী আর অঞ্জন একটু এগিয়ে গেছে। আরও পেছনে নীলাঞ্জন আর মোহনা। বৃষ্টি আর ওই দুই জনকে দেখাই যাচ্ছে না প্রায়। অঞ্জন শাখীর মনোবল বাড়ানোর জন্যে গল্প করে যাচ্ছে, বলছে, এই তো আর একটু। এই দ্যখ মাইলস্টোনে লেখা সান্দাকফু আর ১ কিলোমিটার। 

শাখীদের গতি বাড়ল একটু এবার। প্রতি বাঁকে কাঞ্চনজঙ্ঘার আরও কিছুটা অংশ খুলে যাচ্ছে। আর ওরা শুধু দেখে যাচ্ছে ধূসর প্রেক্ষাপট। অবশেষে এলো সেই মাইলস্টোন, যার গায়ে লেখা ‘সান্দাকফু ০ কিলোমিটার’। সেটা যে কেবলই ধাঁধাঁ সে আর কেমন করে জানবে। যদিও অঞ্জন জানত। বলেনি শুধু শাখীরা মনোবল কমে যাবে বলে। সেখানে দাঁড়িয়ে ছবিও তোলা হলো কিছু।  সেখান থেকে সান্দাকফু গ্রামের শুরু। আসল জায়গায় পৌছতে এখনও প্রায় দেড় কিলোমিটার চড়াই। 

শাখী একটা পাথরের ওপর ধপ করে বসে পড়ে জিজ্ঞেস করল, আচ্ছা তুমি যখন প্রথম বার এসেছিলে, কোথায় যেনো একটা শুয়ে পড়েছিলে। আর তোমাদের সেই ছবিগুলো তুলেছিলে।  অঞ্জন বলল, সেটা আর একটু গেলে। এখন যা বরফ পড়ছে, আর রাস্তাও বেশ খারাপ। কি করে বুঝব কোথায়। বরফ গলে গিয়ে যে জায়গা গুলো কাদা হয়ে গেছে সেই জায়গায় একটু এদিক ওদিক হলেই ধপাস। শাখী উঠে পড়ল, ওর ঠোঁট, জিভ শুকিয়ে আসছে। হাটছে তাই খুব আস্তে। অঞ্জনের ব্যাগ ধরে ধরে। ওদিকে পেছনে নীলাঞ্জন একবার ডাক দিল, কীরে তোরা আছিস তো সামনে। অঞ্জন চেঁচিয়ে বলল, হ্যাঁ আয় তোরা সাবধানে। 

১১

সন্ধে ছ’টা বেজে গেছে। অনেক ওপর থেকে হালকা একটা আলোর আভা দেখা যাচ্ছে। পাহাড়ি সন্ধে যে এরকম খতরনাক হয়। তা এই প্রথম শাখী বুঝল। চারদিকে কেউ কোথাও নেই। এবার গাছের পাতাও আর দেখা যাচ্ছে না। টেম্পারেচার ৪ এর কাছাকাছি। হাত পা অবশ হয়ে যাওয়ার জোগাড়। শাখী আর অঞ্জন দাঁড়িয়ে পড়ল বাকিদের জন্য। শাখীর হেডফোনে গান চলছিল তখন… নমো নমো জ্বী শংকরা… ভোলেনাথ শংকরা… এখন ঈশ্বরই একমাত্র পারে তাড়াতাড়ি পৌঁছোতে। কিন্তু মনে তো জোর আনতে হবে। ওরা একে একে এসে পৌঁছনোর পর আবার চলতে শুরু করল। অন্ধকার নেমে এসেছে। চারদিকে কেমন হলিউড সিনেমার মতো একটা ফিল। হঠাৎ ধপাস করে একটা আওয়াজ। নীলাঞ্জন পিছলে পড়ে গেছে বরফে।  একদিকে পাহাড়ি নেকড়ের ভয় তো আছেই, তার ওপর স্নো ফল হয়েই চলেছে। শাখী আর হাঁটতে পারছে না। অঞ্জন ওকে নিয়ে একটু পিছিয়ে পড়ল। ওর নিশ্বাসে হালকা প্রবলেম হচ্ছিল, আর ভীষণ জল তেষ্টাও পেয়েছে। সামনেই একটা টার্ন। আর বেশ দূর থেকে আওয়াজ আসছে মানুষের। নীলাঞ্জন চিৎকার করে ডাকল, কই রে তোরা। সাথে বৃষ্টিও কি সব বলছে। একশ মিটার হাঁটতে দম ফেটে যাচ্ছিল প্রায়। টার্নটা নিতেই আধো অন্ধকার আর সোলার লাইটের সাদা আলোর ঝিলিক, আর দেখতে পেল বনদফতরের কতগুলো বাড়ি। যেন সত্যিই ওরা স্বর্গে পৌঁছে গেছে। শাখী এবার জোর পেল। অঞ্জন পিছিয়ে গিয়ে কয়েকটা ছবি তুলল পয়েন্টের। 

হোটেল সানরাইজে পৌঁছে যে যার রুমে ঢুকে গেল। যেহেতু নীলাঞ্জন, মোহনা, বৃষ্টি আগেই পৌঁছে গিয়েছিল তাই ওরা আগুনের চুল্লির সামনে গরম হতে বসে পড়েছে। হোটেলের দরজা বন্ধ করে ওরা ওখানেই ডিনার সেরে নিল। গরম গরম চাউমিন। তারপর খানিক পানাহার করে সবাই ঘুমোতে চলে গেলো। শাখী গা বেশ গরম। ও একটা প্যারাসিটামল খেয়ে নিল। এদিকে অঞ্জনেরও অল্টিটিউড শিকনেসের জন্যে বমি পাচ্ছিল। তাই সে ওয়াশরুমে গিয়ে ফ্রি করল নিজেকে, নাহলে আবার খারাপ হতো শরীর। বাথরুমে জল নেই, কারণ বরফ জমে গেছে পাইপ। অগত্যা রুম সার্ভিসকে বলে গরম জলের ব্যবস্থা করা হলো আবার। 

১২

হাওয়ার তান্ডব চলল সারারাত। টেম্পারেচার মাইনাস ২ ডিগ্রি। শাখীরা তিনটে কম্বল গায়ে চাপা দিয়ে তবেই ঘুমোতে পেরেছিল। ভোর ৪টে ৩০-এ জানলা আলোয় আলোয় ভরতি। তারপর আবার মেঘ করে এলো। শাখী আর অঞ্জন নীলাঞ্জনদের রুমে গিয়ে ওদের ডাকতেই ওরা বেরিয়ে এলো। কিন্তু বাইরে তখন শুধুই সাদা আর সাদা।  এখানে ছাদে উঠে সানরাইজ দেখতে হলে এক্সট্রা চার্জ দিতে হয়। ওরা ছাদে উঠে দেখল, কিছুই দেখা যাচ্ছে না। মেঘ করে এসেছে। রডোডেনড্রন গাছগুলো কেউ ঢেকে দিয়েছে চাদরে।  হোটেলের লন-এ এক হাটু বরফ জমে। 

‘স্লিপিং বুদ্ধা’ এবার তাঁদের দেখা হলো না। তিনি এখন মেঘ শয্যায় শুয়ে।  সেই গল্প কথায় শোনা, লাল রেখা চিরে নতুন সূর্যের আলো হীরের মতো ঝলসে উঠল পাহাড়ের বুকে। সেই সোনালী রঙ আর মেঘেদের চরে বেড়ানো, সবই শাখীদের হাতছাড়া রইল এবার। ভাগ্য বলতে এটুকুই, গাড়িতে করে আসার সময়, টামলিং থেকে ক্ষনিকের দৃশ্য, যা তাঁদের আবার টেনে আনবে এই দুর্গম সান্দাকফু’তে। 

শুধু সান্দাকফু নয়, এরপর চামলাং, বরুণৎসে, নুপৎসে ও চোমলোনজো দেখার ভাগ্য ঠিক আবার নিয়ে আসবে। 

অবশেষে ফেরার পালা। টানা উৎরাই। ঈশ্বর এখনও নিদ্রিত। মেঘ লুকোচুরি খেলছে ওদের সঙ্গে। প্রাকৃতিক পরিবেশ নষ্ট করতে করতে আমরা তার ঘুমের ঘরেও হানা দিয়েছি। তবু তাঁর ঘুম ভাঙেনি। হয়ত মাঝরাতে যখন সবাই ঘুমের দেশে, বাতাসে যখন পাগলপারা ভালোবাসার সুর ওঠে। তখন তিনি হয়ত নেমে আসেন। বসে থাকেন এই রডোডেনড্রনের ছায়ায়। তাঁর পায়ে ঝিরি ঝিরি বরফের সাথে ঝরে পড়ে গুচ্ছ রডোডেনড্রনের লাল পাপড়ি। 

আস্তে আস্তে নামতে থাকে ওরা। ফরেস্ট ডিপার্টমেন্টের একটা বোর্ডে লেখা দেখতে পায় শাখী। ‘ leave nothing but footprints, take nothing but memory’ । হ্যাঁ এখান থেকে অনেক স্মৃতি নিয়ে ফিরে যাচ্ছি। কিন্তু ফেরত আমরা আসবই। 

মেঘবালিকার গল্প শুনতে। ঝিরিঝিরি বরফের রাস্তায় নিজের পায়ের ছাপ ফেলতে। পাহাড়ি ঝর্নার গান শুনতে। সেদিন রডোডেনড্রনের পাপড়ি ছড়িয়ে থাকবে চারদিক। আর পাহাড়ে গুন গুন করে উঠবে ভ্রমর। ‘ঘরেতে ভ্রমর এলো… গুনগুনিয়ে। 

শেয়ার করতে:

You cannot copy content of this page