সুবর্ণভূমে পুষ্পকেতু

অনন্যা পাল

স্বপ্ন পূরণ

রাজপুরী সংলগ্ন এলাকার প্রাচীরের বাইরে ছায়াঘেরা বনবীথি, প্রকৃতির খেয়ালে বেড়ে উঠেছে সেখানে শাক, কৌশিক প্রভৃতি মহীরূহ; স্থানে স্থানে কিংশুক, চম্পক জাতীয় ফুলের বৃক্ষও শোভা বাড়িয়েছে অরণ্যের। বনান্তর ভেদ করে তৈরী হয়েছে চলার পথ, মানুষের হতক্ষেপে সে পথ মসৃণ ও প্রশস্ত। পায়ে হেঁটে রাজপুরী যেতে দীর্ঘ রাজপথের পরিবর্ত্তে এই বনপথ ব্যবহার করাই বেশী সুবিধাজনক। বনবীথির শেষ প্রান্তে শুরু হয়েছে অভিজাত পল্লী, মন্ত্রীমন্ডলী ও উচ্চপদস্থ আধিকারিকদের বাস সেখানে।  পল্লীর শুরুতেই, একখানি উদ্যান ঘেরা প্রাসাদ একেবারে স্বতন্ত্র; রুচি ও প্রাচুর্যের অপূর্ব মেলবন্ধন ঘটেছে তার উন্নত স্থাপত্যে। কাঠের তৈরী এই দোতলা গৃহটির বিশেষ শোভা তার কারুকার্য করা থাম ও খিলান; শয়নকক্ষ সংলগ্ন জানালাগুলি যেন একেকটি রথ, এমনই তাদের গঠনশৈলী। প্রাসাদের চারপাশ ঘিরে উদ্যান, তার একাংশে মনোরম ফুলবন, যুথী, জাতি চামেলীর সম্ভারে সে মালঞ্চ স্বর্গের পারিজাত; অন্যপাশে একখানি পাথরে বাঁধানো পুষ্করিনী, দুষ্প্রাপ্য নীললোহিত বর্ণ সুগন্ধি উৎপল ফুটে আছে তার জলে। ধাপে ধাপে তৈরী কৃত্রিম জলাকর রয়েছে পুষ্করিনীর একপাশে, তারই স্রোতে ঢেউ খেলে যায় পুস্করিনীর গহীন বুকে; পাড় ঘেঁষে বেড়ে ওঠা গুটিকয় নারিকেল বৃক্ষের প্রভাবে ছায়াময় বাঁধানো ঘাট।

কালো মেঘের আচ্ছাদনে ঢাকা পড়েছেন সূর্যদেব, শ্রাবণের দুপুর অবিশ্রান্ত ধারাস্নানে গুরুগম্ভীর; বৃষ্টি ধারায় টুপ টুপ শব্দ ওঠে উদ্যানবীথির জলাশয়টিতে। কক্ষসংলগ্ন খোলা জানালায় একটি সুখাসনে আধশোয়া ভঙ্গীতে বসে কুমার পুষ্পকেতু; দীর্ঘদেহী একহারা চেহারা, তপ্তকাঞ্চণবর্ণ, মুখখানি সৌন্দর্য ও বুদ্ধির দীপ্তিতে অনুপম, দেখে ভুল হয় বুঝি শাপভ্রষ্ট কন্দর্প। হাতে খোলা একখানি পুস্তক, নিবিষ্ট হয়ে আছেন কুমার তারই পৃষ্ঠায়।

“শুক্লপক্ষের রাত্রি, শয্যাপাতে একাকী অপেক্ষায় রাজা উদয়ন; আধো আলো আধো অন্ধকারে নীলাভ সমুদ্রকক্ষ যেন স্বপ্নপুরী। অসুস্থা পদ্মাবতীকে দেখতে এসেছিলেন রাজা, রানী নেই কক্ষে, তাই এই অপেক্ষা। কিন্তু, মধ্যরাত্রির তন্দ্রালু আবেশে কার চিন্তা আবিষ্ট করে তাঁকে, সে কি পদ্মাবতী, না কি অন্য কেউ? যে নেই, ধুসর অতীতে বিলীন হয়েছে বহুদিন, তাকে স্মরণ করে কি লাভ! দীর্ঘশ্বাসে ভারি হয় কক্ষের বাতাস, প্রেমিকের ক্লান্ত চোখে নেমে আসে বিষণ্ণ তন্দ্রা, শুধু দুফোঁটা অশ্রু জেগে থাকে নয়নকোণে। শান্তপায়ে কে যেন এসে দাঁড়ালো শিয়রে, সুকোমল হাতখানি বুঝিবা ছুঁতে চায় রাজার মস্তক; আধো ঘুমে চোখ খোলেন তিনি। একি স্বপ্ন না বাস্তব? তবে কি প্রেমিকের বিরহ-কল্পনা প্রেয়সীরূপে দেখা দিল এই মধুরাতে?

‘বাসবদত্তা!’ ডেকে ওঠেন রাজা গভীর আবেগে।

অমনি পিছু হঠে নারী মুর্তি, নিমেষে মিলিয়ে যায় অন্ধকারে। চমকে উঠে বসেন রাজা, খোঁজেন সেই প্রিয়মুখ; জানেন হারিয়েছেন তাকে অগ্নিদুর্ঘটনায় চিরকালের মত, তবু মন মানেনা।

‘ফিরে এসো রানী, হৃদয়েশ্বরী!’

কক্ষান্তরে অশ্রুজলে ভাসে অবন্তীকুমারী, রানী পদ্মাবতীর সখী সে। প্রাণ চায় ছূটে যেতে স্বামীর বাহুবন্ধনে, তবু মন জানে এ অসম্ভব।“

সিক্ত বাতাসে বারিবিন্দু ছুঁয়ে ছুঁয়ে যায় কাঁধ, উত্তরীয়টিকে আরও নিবিড় করে  জড়িয়ে নেন কেতু অন্যমনে; জাতিপুষ্প আর আর্দ্র মৃত্তিকার মিলিত গন্ধে ছড়িয়ে পড়ে একপ্রকার অলস মেদুরতা। স্বপ্ন ও বাস্তব, পাওয়া ও না পাওয়ার মায়াদ্বন্দের অপূর্ব মূর্ছনা কবি ভাসা-র নাট্যকাব্য ‘স্বপ্নবাসবদত্তাম্’; মোহমুগ্ধ হয়ে থাকেন কুমার একান্ত মনোযোগে।

বৃষ্টি থেমে যায় কিছু পরে, সেইসাথে কয়েকটি শিশুর কোলাহলে মুখরিত হয়ে ওঠে নিস্তব্ধ উদ্যান; পুষ্পকেতু ফিরে তাকান। শিশুরা সকলেই রাজবংশজাত, এরমধ্যে একজন পুষ্পকেতুর অগ্রজ সুমন্তের পুত্র শুদ্ধ; পিতৃব্যকে দেখে একটু হেসে  সঙ্গীদের সাথে কোলাহলে যোগ দেয় শুদ্ধ। শিশুগুলি জলাকরটির একপাশে জড়ো হয় একান্ত আগ্রহে। সঙ্গে আসা দুই সেবকের কাঁধের ঝুলি থেকে বেরিয়ে আসে ছোট ছোট সুদৃশ্য নৌবহ, হালকা কার্পাসকাষ্ঠে তৈরী খেলনা গুলি সুক্ষ কারুকাজে হুবহু একেকটি সমুদ্রযান। এবার, প্রত্যেকটি শিশু খেলনা নৌকা হাতে এগিয়ে যায় জলের কাছে, একে একে জলে ভাসায় নিজ নিজ বহিত্র। পুষ্পকেতু মুগ্ধ চোখে চেয়ে থাকেন বহুক্ষণ, তাঁর মায়াবী চোখে ঘন হয় স্বপ্নের ঘোর; আলগোছে হাত থেকে পড়ে যায় সাধের পুস্তক, খেয়াল করেননা তরুণ কুমার।

***

সম্রাট সমুদ্রগুপ্তের মগধ  সাম্রাজ্য এক বিশাল ভূখণ্ড; ইরাবতীর উপকুল থেকে পূর্বে ব্রহ্মপুত্র, উত্তরে হিমালয়ের পাদদেশ থেকে দক্ষিণে কৌরল পর্যন্ত তার ব্যপ্তি। কার্তিপুরা, যৌধেয়, মদ্র থেকে পূর্বে সমতট, কামরূপ, দেবক; অথবা উত্তরে নেপাল, কুনিন্দা থেকে দক্ষিণে কাঞ্চি ও কৌরল, নিজ চেষ্টায় সম্রাট মগধ লাঞ্ছনের অন্তর্ভুক্ত করেছেন এদের সকলকেই একে একে। কোশলের মহেন্দ্রদেব, মহাকান্তরের ব্যাঘ্ররাজ, কুবের, উগ্রসেন, ধনঞ্জয় প্রভৃতি পরাক্রমী রাজা নিঃসংকোচে মেনে নিয়েছেন তাঁর একাধিপত্য। পররাজ্যলোভী শক ও কুষান গোষ্ঠীকে রুখতে প্রয়োজন তাঁর মত একনায়ক স্ম্রাটের, সেকথা অনুভব করেছেন সমস্ত আর্যরাজা। সমুদ্রগুপ্তও স্বপ্ন দেখেছেন এক অখন্ড আর্যাবর্তের, সমগ্র পৃথিবীতে গৌরবান্বিত হবে যার নাম; সেকারনেই সিংহল, সুবর্নভূমি, চীন ও পারস্যের সাথে বৈদেশিক সম্পর্ক গড়তেও বিশেষ উদ্যোগী তিনি, দূর্জেয় মাগধী নৌবহর ছড়িয়ে পড়েছে প্রাচ্যে ও পাশ্চাত্যে। পাটলীপুত্র মগধ সাম্রাজ্যের রাজধানী; সম্বৃধি ও গরিমায় অনন্য। গঙ্গা, সদানীরা ও হিরণ্যপ্রভার সঙ্গমে গড়ে উঠেছে এখানে নৌবন্দর, দেশী বিদেশী শ্রেষ্ঠী ও নাবিকদের সমাগমে,ব্যস্ত তার পথঘাট, জনসমাগমে সদা উজ্জীবিত পান্থশালা, পণ্যবিথী; উন্নত আর্থিক ও প্রশাসনিক ব্যবস্থায় নাগরিক জীবন স্বচ্ছল ও শান্তিপূর্ণ। সম্রাট সমুদ্রগুপ্ত সদা মনযোগী প্রজাদের সুখ স্বাচ্ছন্দে; তাঁর ব্যক্তিগত তত্বাবধানে নিযুক্ত প্রশাসনিক অধিকারিকগণ নিজ নিজ ক্ষেত্রে একাধারে সুদক্ষও কর্মনিষ্ঠ।

বিশাখগুপ্ত পাটলিপুত্রের মহাদন্ডনায়ক; নগরী ও তৎসংলগ্ন জনবীথির আইনশৃঙ্খলা রক্ষার গুরুদায়িত্ব তাঁর ওপর; সম্পর্কে তিনি সম্রাটের বৈমাত্রেয় ভ্রাতা। মিতবাক স্বভাবগম্ভীর মানুষটি কর্তব্যনিষ্ঠতার জন্যে জনপ্রিয়; সম্রাট নির্ভর করেন তাঁর দূরদর্শিতার উপর অনেকাংশেই।

‘শৈলদেশের এই আমন্ত্রণ অতি সম্মানের; মহামতি ধূর্জটিদেবকে পাঠানই মনস্থ হয়েছে তাহলে?’

‘হ্যাঁ, রাজা চন্দ্রদমন তাঁর বিষ্ণুমন্দিরে বিগ্রহপ্রতিষ্ঠার উপলক্ষে বেদজ্ঞানী উপাচার্যের অনুরোধ পাঠিয়েছেন; ধূর্জটিদেব বেদজ্ঞ তো অবশ্য, সেইসঙ্গে তাঁর কূটনীতিজ্ঞানও তুচ্ছনীয় নয়।‘ বিশাখগুপ্তের বাসভবনে, আলাপে মগ্ন বিশাখগুপ্ত ও মহাসন্ধি বিগ্রাহিক হরিষেণ।

হরিষেণ, সম্রাটের মন্ত্রীমন্ডলীর অতি বিচক্ষণ সদস্য, রাষ্ট্রীয় বিভাগের কর্মকর্তা। তিনি একাধারে রাজনীতিজ্ঞ, সুলেখক এবং সঙ্গীতজ্ঞ; দৃঢ়তা ও মানবিক গুণের এক অপূর্ব সমন্বয় ঘটেছে মহামন্ত্রীর ব্যক্তিত্ত্বে। বিশাখগুপ্তের সাথে তাঁর বহুদিনের পারিবারিক বন্ধুতা, তবে এইমূহুর্তে তিনি বন্ধু নয় বন্ধুপুত্রের সাথে দেখা করতে এসেছেন।

‘পুষ্পকেতু আপনার স্নেহধন্য, শুভসংবাদটি আপনি নিজমুখে জানালে বেশী আনন্দিত হবে সে’, বিশাখগুপ্ত মন্তব্য করেন।

‘হ্যাঁ, জানি সেকথা; সমুদ্রযাত্রা তার বহুদিনের স্বপ্ন। সম্ভাবনাময় পুরুষ সে, নিজেকে ছড়িয়ে দেবে বৃহত্তর জগতে আমারও সেই আশা’।

‘তার জননী কিছু বিচলিত হবেন এ সংবাদে, দীর্ঘ পথ, বিপজ্জনক নৌযাত্রা; বহুদিনের অদর্শন ঘটবে তার উপর।

‘এ বিষয়ে আপনার হস্তক্ষেপেই কার্যসিদ্ধি হবে’, হেসে উত্তর দেন হরিষেণ।

‘প্রণাম পিতা, প্রণাম আর্য, ডেকে পাঠিয়েছিলেন আমাকে?’ পুষ্পকেতু প্রবেশ করেন আলোচনা কক্ষে। সুন্দর কান্তি, মার্জিত ব্যাক্তিত্ব, মেঘমন্দ্র স্বর; গোপন গর্বে আত্মপ্রসাদ অনুভব করেন বিশাখগুপ্ত।

‘একটি সংবাদ দেবার ছিল বৎস্য, সংবাদ গুরুতর, তাই আমাকেই আসতে হোল আজ’। হরিষেনের বক্তব্যে কিছুটা আশ্চর্য বোধ করেন পুষ্পকেতু।

‘সুবর্নভূমির শৈলদেশের কথা তোমার অজানা নয়; সেদেশের পরাক্রমী রাজা চন্দ্রদমন আমাদের মিত্র। সম্প্রতি একটি বিষ্ণুমন্দির নির্মাণ করেছেন তিনি, সেই মন্দিরের বিগ্রহপ্রতিষ্ঠা হবে আর্যাবর্তের বেদজ্ঞ ব্রাহ্মণ দ্বারা, এই  তাঁর ইচ্ছা। মহামতি ধুর্জটিদেব যাবেন সেই কার্যে স্থির হয়েছে সেকথা, তবে ধুর্জটিদেব একলা নন, সাথে তুমি যাবে রাজপ্রতিনিধি হয়ে, সম্রাটের তাই মত’।

‘আপনার এই আনুকুল্য আমার স্বপ্নের অতীত’, বিহ্বল শোনায় পুষ্পকেতুর কন্ঠস্বর, ভিজে ওঠে চোখের পাতা।

‘আনুকুল্য নয় বৎস্য, তুমি নিজ যোগ্যতায় অর্জন করেছ এই সম্মান। বিগত মেষ সংক্রান্তিতে যে অঘটন ঘটেছিল রাজ অতিথিশালায়, বিপর্যয়ের রূপ নেয়নি তা শুধু তোমারই বুদ্ধিবলে; সেকথা ভুলিনি আমি, ভোলেননি সম্রাটও। তোমার উপর পূর্ণ আস্থা রাখি আমরা সকলেই।‘ গভীর স্নেহে বলে ওঠেন হরিষেণ।

বাইরে, গম্ভীর আকাশে হঠাতই দেখা দেন অংশুমালী, বর্ষণক্লান্ত প্রকৃতি স্বর্ণালী হয়ে ওঠে তাঁর প্রভায়; আলোকিত হয় পুষ্পকেতুর মুখ ভবিষ্যতের হাতছানিতে।

***

শ্রাবণসন্ধ্যার শুক্লপক্ষ, আধখানা চাঁদ মেঘের আড়াল থেকে আলোকিত করে তুলেছে তারাহীন আকাশ। নিভৃত শয়নকক্ষে দীপদন্ডের আলো হালকা বাতাসে ছন্দময়, কুরুঙ্গীতে জ্বলে ধুপ, যুথী ও মালতীর মিলিত গন্ধ ভেসে আসে মালঞ্চ থেকে। খোলা জানালার পাশে দাঁড়িয়ে এক নারী আনমনে চেয়ে আছে আকাশের পানে; পরনে কচি কিশলয় বর্ণ হরিত বসন, খোপায় মল্লিকা, অঙ্গে জাতিপুষ্পের আভরণ; আধো আলোয় মুখখানি লাবণ্যে ঢলঢল।

‘কার চিন্তায় আত্মমগ্ন প্রিয়ে, কে সে ভাগ্যবান?’ পিছন থেকে ভেসে আসে মধুসম্ভাষণ, চমকে ফিরে তাকায় নারী সলজ্জ হরষে। দীপের আলোয় স্পষ্ট হয় এক বালিকা বধূর সুকুমার মুখ।

‘চাঁদ উঠেছে আকাশে’, অস্ফুট উক্তিতে সারল্য।

‘তাতেই ভুলেছ আমায়? প্রান চায় রাহু রূপে গ্রাস করি অর্বাচীনকে।‘

বালিকার পাশে এসে দাড়ান এক সুবেশ তরুণ; অভিজাত, সুন্দর চেহারা, ভারি প্রসন্নতা মাখা ব্যাক্তিত্ব। বধূকে বিব্রত করতে কপট ঈর্ষা ফুটে ওঠে তাঁর স্বরে, চোখে খেলা করে কৌতুক।

‘না না, রাহু হবেন কেন? আপনি তো…’

‘আমি কে?’

‘আপনি, আপনি আর্যপুত্র’।

‘যাক, নিশ্চিন্ত করলে দেবী, অন্ততঃ এটা জানা গেলো যে আমি অসুর নই’।

বালিকার সরলতা ভারি আমোদ দেয় তার কৌতুক প্রিয় স্বামী উল্মুককে, প্রণয়ের সাথে সাথে এক গভীর স্নেহে রসসিক্ত তাদের স্বল্পদিনের দাম্পত্য জীবন। চম্পাবতীর সাথে উল্মুকের বিবাহ হয়েছে গত বৈশাখী পূর্ণিমায়; উল্মুকের পিতা অক্ষপট-বালাধিকৃত অগ্রষেন; মগধ সাম্রাজ্যের যাবতীয় আয়ব্যায়ের হিসাব ব্যবস্থার আধিকারিক তিনি। ভবিষ্যতে পুত্র তাঁর স্থান নেবে এই আশা মনে মনে পোষন করেন অগ্রষেন, সেকারণেই বর্তমানে পিতার তত্ত্বাবধানে শিক্ষানবিশি করছেন উল্মুক পুস্তপালের দপ্তরে। তবে হিসেব নিকেসের নীরস কার্য তাঁর সুক্ষ রসবোধ ক্ষুণ্ণ করতে পারেনি একথা বোঝা যায় সহজেই; ফলতঃ আমোদপ্রিয়, সংবেদনশীল মানুষটি উচ্চবংশজাত হয়েও সহজ সরল, সর্বজনপ্রিয়।

***

পশমের আসনে বসে লেখন পীঠিকার উপর নিবিষ্ট মনে একটি মানচিত্র পর্যেবেক্ষনে ব্যস্ত পুষ্পকেতু, সামনে ইতস্তত ছড়িয়ে রয়েছে কিছু পুঁথি; মেঘলা আকাশের প্রভাবে ছায়াছন্ন কক্ষের পরিবেশ, তবু আলোর অভাব বিঘ্ন ঘটাতে পারেনা মনযোগে।

‘এমন বাদল দিনেও সেই জ্যামিতি?’ কৌতুকবাক্য ছুঁড়ে দিয়ে ঘরে প্রবেশ করেন উল্মুক; পুষ্পকেতুর বাল্যসখা তিনি, দুজনার বয়স ও মনের মিল রীতিমত চর্চার বিষয়।

‘জ্যামিতি নয়, ভূগোল’, চমকে তাকিয়ে, হেসে ফেলেন কেতু।

‘বল কি, জ্যামিতি, সঙ্গীত, কাব্য, এর উপর আবার ভূশাস্ত্র? এ তো রীতিমত চিন্তায় ফেললে হে’।

‘চিন্তা কিসের?’

‘বলা কি যায়, সংসারধর্মে যে প্রকার অনীহা তোমার, শেষকালে শাস্ত্র চর্চার হিড়িকে না গৃহত্যাগী হও!’

‘গৃহত্যাগী হবার তেমন কোনও ইচ্ছা নেই, তবে দেশত্যাগী হবার একটি সম্ভাবনা জেগেছে সম্প্রতি’।

‘বল কি! সমতট না কামরূপ?’

‘দৃষ্টি আর একটু প্রশস্ত কর মিত্র, আজকাল চম্পাবতীর আঁচলের আগে আর কিছু ভাবতে পারছ না যে!’

‘অঞ্চলের বাতাস বড় মনোরম, তুমি এর মর্ম বুঝবে কেমন করে?’ কপট দীর্ঘশ্বাস ফেলেন উল্মুক।

‘এই করেই মাটি হবে তুমি।’ হেসে পীঠিকার উপর রাখা মানচিত্রটিতে পুনরায় মনযোগী হতে চেষ্টা করেন পুষ্পকেতু।

উল্মুকও ছাড়ার পাত্র নন, পীঠিকার সমুখে বসে পড়ে তিনিও দেখতে চেষ্টা করেন চিত্রপট।

‘এ যে সুদুর প্রাচ্য, শেষকালে চৈনিকদেশে চললে নাকি সখা? পিতৃব্যা ভেঙ্গে পড়বেন যে!’

‘একটু বেশীই ভেবে ফেললে এবার, অতখানি নয়; সুবর্নভূমি’।

‘তাই বা কম কিসে! পুস্তপালের দপ্তরে কলম পেশা কারবার, আমার কাছে এও যে কল্পনার অধিক! সব কথা খুলে বল দেখি।‘

উল্মুকের উৎসাহে খুলে বলেন সব কথা পুষ্পকেতু।

‘আশ্বিনের মধ্যভাগে তাম্রলিপ্ত যাত্রা, আর সেখান থেকে পালৌর হয়ে সাগর পাড়ি কার্তিক পূর্ণিমায়।‘

‘কত বন্দর, ভিন্ন দেশ, ভিন্ন জাতি, কত না বিচিত্র তাদের সংস্কৃতি, শুনে রোমাঞ্চ জাগছে মনে!’

‘সঙ্গী হতে চাও?’

‘নোঙ্গর বাধা তরী আমি, সাগরে ভাসি উপায় কি?’ একটু থেমে জবাব দেন উল্মুক।

‘ক্ষেদ জাগছে কি মনে, ভেবে বল।‘

‘না হে, বন্ধন বড় মধুর, সেখানে ক্ষেদের অবকাশ নেই’, পরিহাসে উড়িয়ে দেন উল্মুক বন্ধুর বাক্য।

‘সে তো উত্তম! তবে, তোমার অভাব অনুভব করব আমি, জেনে রেখো সে কথা’।

মিত্রের কাঁধ স্পর্শ করেন উল্মুক গভীর স্নেহে, হেসে ওঠেন দুজনেই যৌবনের সহজাত উচ্ছ্বাসে।

***  ***

দুরূহ  শব্দের  অর্থঃ

শাক – সেগুন গাছ, কৌশিক –  শাল গাছ,  কিংশুক – কৃষ্ণচূড়া, জলাকরকৃত্রিম ফোয়ারা, পিতৃব্য – কাকা, পিতৃব্যা – কাকিমা, পীঠিকা – পিঁড়ে

 

অলংকরণ- অন্তর্জাল

 

(চলবে)

শেয়ার করতে:

You cannot copy content of this page