সুবর্ণভূমে পুষ্পকেতু
অষ্টম পর্বের পর…
অনন্যা পাল
সিংহপুর
অমরাবতীর রাজধানী সিংহপুর চীনসমুদ্রের নিকটবর্তী এক জনপদ; যার একপাশে মনমুগ্ধকর সোনালী তট ও আদিগন্ত জলরাশি এবং অন্যদিকে পাহাড়ঘেরা সবুজ বনানী। জনপদের একাংশ গিয়ে মিশেছে এক সুবিস্তীর্ণ উপত্যকায়; পাহাড় ও সমুদ্রের সমন্বয়ে নগরীর শোভা অতুলনীয়; উপরন্তু এই ভৌগলিক গঠন তাকে করেছে প্রাকৃতিক ভাবে সুরক্ষিত। মহারাজ বীরবর্মনের পূর্বতন কোনও পুরুষ আর্যাবর্তের চম্পাদেশ থেকে এখানে এসেছিলেন এমনটাই মনে করা হয়; তাঁর সাথে এসেছিল বিশাল বাহিনী, ধীরে ধীরে এই অমরাবতীতেই তৈরী হয় এক নতুন আর্যবসতি। সেকারণে, এদেশের অধিবাসীরা চম্পাদেশীয় হিসাবে নিজ পরিচয় দিতে পছন্দ করেন। অমরাবতীর সামরিক শক্তি অসামান্য, বিশেষতঃ চীনসাগর থেকে মালব উপসাগর অবধি এদেশের নৌসেনার একাধিপত্য এককথায় প্রশ্নাতীত। যুবরাজ ভদ্রবর্মন সাবালকত্ব লাভের পর থেকে বিশেষভাবে উদ্যোগী হয়েছেন নৌশক্তি বৃদ্ধি করতে, অমরাবতীর সম্পদের অন্যতম মূল উৎস্য সামুদ্রিক বাণিজ্য। তিনি মৎস্যমুখী বিশেষ যুদ্ধনাওয়ের সৃষ্টি করেছেন তাঁর নৌবহে; সেগুলি হালকা ও অতিদ্রুতগামী, বাতাসের সাথে সামঞ্জস্য রেখে শীঘ্র দিক্পরিবর্তনে সক্ষম। এই নৌবাহিনী চালনার জন্যে গড়ে উঠেছে সুশিক্ষিত নাবিক ও আতর্কিতে আক্রমনকারী সৈন্যদল।
সিংহপুর নগরীর মাঝখানে পরিখাঘেরা সুরক্ষিত অঞ্চলে রাজপ্রাসাদ ও অমাত্যমণ্ডলীর বাসস্থান, এছাড়াও প্রাচীরের উত্তরপূর্ব দিকে এক সরোবরের তীরে পাশাপাশি রয়েছে ভদ্রেশ্বর ও ভগবতী মন্দির। শক্তির উপাসক চম্পা রাজপরিবারের কুলদেবতা দেবাদিদেব ভদ্রেশ্বর। পরিখার মুখ্যদ্বারের দুপাশে পাথরের সুবিশাল গজসিংহ মূর্তি একাধারে দ্বারপাল ও ভদ্রেশ্বরের পবিত্র বাহন হিসাবে প্রতিষ্ঠিত; অমরাবতীর রাজকীয় লাঞ্ছনও গজসিংহ। মহারাজ বীরবর্মন ও যুবরাজ ভদ্রবর্মন দুজনেই অত্যন্ত ধর্মনিষ্ঠ, যুবরাজ নগরীতে উপস্থিত থাকলে ভদ্রেশ্বর মন্দিরে নিত্যপূজা না করে জলস্পর্শ করেন না।
***
মেষ সংক্রান্তির শুভদিন, আর্যাবর্তের মতই অমরাবতীও নতুন বছরের শুভারম্ভে মেতে ওঠে তিনদিনব্যাপী উৎসবে। ভগবতী মন্দিরে বিশেষ পূজার্চনা ও ঘরে ঘরে মিষ্টান্ন পাক, নতুন বস্ত্র পরিধানের মাধ্যমে পালিত হয় এই উৎসব। অপরাহ্নে রাজসভায় আয়োজিত হয়েছে নৃত্যগীতের আসর, মহারাজ বীরবর্মন একজন একনিষ্ঠ সঙ্গীতানুরাগী। তবে এদিনের উৎসব আরো উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে শৈলদেশ থেকে যুবরাজের সদ্য প্রত্যাবর্তনে; প্রতিবেশী দেশের সঙ্গে আলোচনা আশাব্যঞ্জক হয়েছে, সর্বোপরি অদূর ভবিষ্যতে আত্মীয়তার সম্ভাবনাও দেখা দিয়েছে। কর্মপিপাসু যুবরাজ এযাবৎকাল বিবাহে বিমুখতা দেখিয়ে এসেছেন, মহারাজ এ নিয়ে দুশ্চিন্তায় ছিলেন; আকস্মাৎ এই বিবাহ সম্ভাবনায় রাজপরিবারে খুশীর পরিবেশ; তবে এই মত পরিবর্তন হৃদয়ঘটিত না রাজনৈতিক সে বিষয়ে সন্দেহের অবকাশ থেকেই যায়।
রাজসভায় মহারাজের আসনপীঠের সমুখে আলপনা বেষ্টিত গোলাকৃত স্থান নৃত্যের জন্য নির্ধারিত, তার একপাশে ভূমিতে আস্তরন বিছিয়ে প্রস্তুত যথাক্রমে মৃদঙ্গ, বাঁশী ও মঞ্জিরাবাদক। মহারাজের অনুমতি নিয়ে শুরু হয় বাঁশীতে সুরলিত তান, আর তার সাথে বেজে ওঠে মৃদঙ্গ ও মঞ্জিরা। দুইজন সুন্দরী নর্তকী রমনীয় দেহভঙ্গীমায় শুরু করে নৃত্য মৃদঙ্গের তালে তালে, আলপনা ঘেরা স্থানে ঘুরে ঘুরে নেচে চলে দুজন, মহারাজ ও সভাগৃহের তিনদিক জুড়ে উপবিষ্ট সভাসদদের অনুষ্ঠান উপভোগের সুবিধার জন্যেই এই ব্যবস্থা। ক্রমে সুর ও লয়ের নিবিড় সমন্বয়ে উৎসব অপরাহ্ন বর্ণময় হয়ে ওঠে।
সভায় উপস্থিত নেই যুবরাজ, নৃত্যগীত উপভোগ করে সময় নষ্ট করা তাঁর স্বভাব বহির্ভূত; আপাতত তিনি ব্যস্ত আছেন গুপ্তচরমন্ডলীর সাথে বিশেষ মন্ত্রণা সভায়। শিবদাস, ভাগ্য, প্রসাদ ও ত্রিচূড় চার দলনেতা উপস্থিত রয়েছেন এই সভায়, এঁরা প্রত্যেকেই যুবরাজের একান্ত বিশ্বাসভাজন ও এক একেকটি গুপ্তচরবাহিনীর অধিকর্তা।
‘উত্তরের চৈনিকরাষ্ট্র দেব-গোপুরের কি সংবাদ ভদ্র প্রসাদ? তাঁদের রাষ্ট্রদূত শৈলদেশে উপস্থিত ছিলেন, কোনও বিশেষ সামরিক প্রস্তুতির সংবাদ আছে কি?’
‘সেরকম কোনও উদ্যোগ লক্ষিত হয়নি রাজন, তবে শৈলরাজ কিছু বিশেষ শুল্ক ছাড়ের ব্যবস্থা করেছেন তাদের চীনাংশুকে, পরিবর্তে গন্ধদ্রব্য ও মশলা সম্পূর্নভাবে শৈলদেশ থেকেই সরবরাহ হবে সূর্যভূমিতে, এরকম সম্ভবনার আভাস রয়েছে।‘
‘বড় ধূর্ত মহামাত্য দুর্জয়বর্মা; আর্থিক আনুকুল্যের বিনিময়ে বাণিজ্যিক আধিপত্যের প্রসার করতে চায়!’ যুবরাজের মুখ গম্ভীর হয়ে ওঠে।
‘ব্যাধপুরে চরসংখ্যা বৃদ্ধি করুন ভদ্র শিবদাস, সেইসঙ্গে কাটিগারেও’।
‘কিন্তু সেখানে তো সন্ধিপ্রস্তাব চলছে রাজন!’ বিস্মিত শোনায় শিবদাসের কন্ঠস্বর।
‘আত্মীয়তা যতক্ষণ না প্রতিষ্ঠিত হয়, সাবধানে থাকা বাঞ্ছনীয়; তাছাড়া মগধ প্রতিনিধির দলটি যতদিন আছে, চক্ষুকর্ণ খোলা রাখা প্রয়োজন। আমি চাইনা, সম্রাটের কাছে কোনও বিকৃত তথ্য পরিবেশিত হয়।‘
‘কলিঙ্গপত্তনে বিদেশী বণিকদের কাছে থেকে কিছু বিশেষ সংবাদ পাওয়া গেছে কি?’ ভদ্র ভাগ্যকে প্রশ্ন করেন যুবরাজ।
‘সেরূপ বিশেষ কিছু নয়, তবে আর্য বণিকদের মধ্যে স্বর্ণমুদ্রা আহরণের প্রবণতা বেড়েছে, শোনা যায় রোমক স্বর্ণমুদ্রার প্রাদুর্ভাব ঘটেছে আর্যভূমিতে।‘
‘সে তো অতি সুসংবাদ আমাদের জন্যে; স্বর্ণের আশায় সুবর্ণভূমীর সাথে বাণিজ্য বৃদ্ধি করবে আর্যাবর্ত, এতে আমাদের সম্বৃদ্ধি।‘
‘সম্বৃদ্ধি নিশ্চিত করতে কাটিগারের আধিপত্য নিয়ন্ত্রন করতে হবে রাজন’, ত্রিচূড় মন্তব্য করেন।
‘সেকারণেই এই সন্ধিপ্রস্তাব ভদ্র; যুদ্ধবিগ্রহে শক্তিক্ষয়, ধনক্ষয়’। এরপর মন্ত্রণাসভা শেষ হয়।
***
মহারাজ বীরবর্মনের তিন সন্তানের মধ্যে একটি মাত্র পুত্র, কুমার বজ্র। বজ্র শৈশব থেকেই ধীর স্থির, অন্তর্মুখী প্রকৃতির, বয়স বাড়ার সাথে সাথে শস্ত্রবিদ্যার প্রতি তাঁর অনীহা ও বেদশাস্ত্রে পাণ্ডিত্য মহারাজকে একাধারে চিন্তিত ও গর্বিত করে তোলে। বজ্রবর্মন যে সিংহাসনের পক্ষে অনুপযুক্ত, একথা বুঝেছিলেন মহারাজ; হয়তো নিজেকে প্রস্তুত করবেন বজ্র ধীরে ধীরে, নিজেকে এই ভেবে প্রবোধ দিতেন তিনি। সামন্তকন্যা দিব্যাকুমারীর সাথে তারুন্যের প্রথম লগ্নেই বিবাহ দিয়েছিলেন পুত্রের; দিব্যাকুমারী একাধারে সুন্দরী ও বীরাঙ্গনা, তিনি স্বামীকে ক্ষত্রধর্ম পালনে উৎসাহিত করতে পারবেন এই ছিল আশা। স্বামীকে উৎসাহিত করতে পারেননি দিব্যা, কিন্তু জন্ম দিয়েছিলেন এক অসামান্য পুত্রের। অতি শৈশব থেকেই মায়ের প্রভাবে ভদ্রবর্মন বহির্মুখী ও স্বভাবগম্ভীর ছিলেন, যুদ্ধবিদ্যায় তাঁর আগ্রহ ও সাবলীল দক্ষতা অবাক করেছিল রাজপরিবারের সকলকেই। তাই ভদ্রর বয়ঃসন্ধিকালে তাঁকে যুবরাজ ঘোষনা করতে দ্বিধা করেননি বীরবর্মন; এই সিদ্ধান্তে খুশী হয়েছিল অমাত্যমণ্ডলী এবং সমগ্র রাজপরিবার, স্বস্তি পেয়েছিলেন কুমার বজ্রও।
স্বভাব ও চরিত্রের বৈপরীত্য থাকলেও যুবরাজ ও তাঁর পিতার মধ্যে বিশেষ প্রীতির সম্পর্ক; সময় পেলে বজ্রের মহলে প্রায়ই যাতায়াত করেন ভদ্র, নিভৃত সময় কাটান দুজনে নানান আলোচনায়।
মেষ সংক্রান্তির পরের দিন পিতাপুত্রের একত্রে মধ্যাহ্নভোজনের আয়োজন হয়েছে; শৈলদেশ থেকে ফিরে অবধি সেদিনই পিতার সাথে প্রথম সাক্ষাৎ যুবরাজের। আহারের পরে বিশ্রাম কক্ষে কথাবার্তা চলে দুজনের মধ্যে।
‘তোমার ব্যাধপুর যাত্রা সফল হয়েছে তো পুত্র?’ কুমার বজ্র প্রশ্ন করেন যুবরাজকে।
‘অনেকাংশেই সফল, তবে সন্ধিপ্রস্তাব সাক্ষরিত না হওয়া অবধি কিছু বলা শক্ত’।
‘কেন, এ ব্যাপারে কিছু সংশয়ের কারণ ঘটেছে কি?’
‘সন্ধি বিষয়ে শৈলরাজ আগ্রহী বলেই বোধ হয়েছে আমার; তবে সন্ধির শর্তাবলীতে রাজী হবেন কিনা সেটাই দেখার’।
‘শর্তাবলী কি তোমার আরোপিত?’
‘কতকটা তাই, তবে এতে দুই দেশই লাভবান হবে বলে আমার বিশ্বাস।‘
‘তোমার বিশ্বাসে অন্যেও আস্থা রাখবে এমন আশা না করাই বাঞ্ছনীয় পুত্র; সমস্ত পৃথিবীকে নিজ মূল্যবোধের তুলাদণ্ডে মাপতে যেয়ো না, এতে ক্লেশ বাড়বে।‘
‘এ আপনি কি বলছেন পিতা? এই সন্ধি প্রচেষ্টা আমার ব্যক্তিগত স্বার্থে নয়, রাষ্ট্রস্বার্থ জড়িয়ে আছে এর সাথে। বিদেশী বাণিজ্যতরীর পত্তনীতে সঠিক বন্টনের প্রস্তাব করেছি আমি, এতে অন্যায় কোথায়?‘
‘তাহলে বিচলিত হচ্ছ কেন, প্রস্তাব যুক্তিসঙ্গত হলে তারা মানবে নিশ্চয়; চন্দ্রদমন বিচক্ষণ ব্যক্তি শুনতে পাই।‘ বজ্রবর্মন মন্তব্য করেন স্মিত হেসে।
‘চন্দ্রদমনের ছায়াসঙ্গীটিকে নিয়েই দুশ্চিন্তা; দুর্জয়বর্মা অতি ধূর্ত। সংবাদ পেলাম, ভিতরে ভিতরে দেব-গোপুর দেশের চৈনিকদের সাথে একাধিকার বাণিজ্যের চুক্তির চেষ্টায় আছে।‘
‘কিন্তু দেব-গোপুর তো আমাদের প্রতিবেশী রাজ্য, তারা আমাদের প্রতি আনুকুল্য না দেখিয়ে চন্দ্রদমনের সহায় হোল কেন ভেবে দেখেছ সে কথা?’
‘আপনি ঠিক কি ইঙ্গিত করছেন পিতা?’ যুবয়াজের কন্ঠস্বর কিছুটা শীতল শোনায়।
‘সামরিক শক্তি দিয়ে সব কার্যে সিদ্ধি হয় না ভদ্র, কলিঙ্গপত্তনে ব্যবসায়ে অনীহা প্রকাশ করলেই যদি বাণিজ্যতরণী লুন্ঠন করে তোমার সেনা, শৈলদেশ তো তার সুযোগ নেবেই।‘
‘শেষে আপনিও বিশ্বাস করলেন এই মিথ্যা রটনায়?’ ভদ্রবর্মনের কন্ঠে অভিমানের সুর স্পষ্ট হয়।
‘কিন্তু কি যুক্তি আছে তোমার কাছে স্বপক্ষ সমর্থনে? উপর্যুপরি এই ঘটনায় বহির্জগতে এই কথাই তো প্রচার হবে, যে চম্পাদেশীয়রা চৈনিক তরণী আক্রমন করে সাধারন জলদস্যুদের মত’।
‘দেব-গোপুরের বেশ কিছু তরণী বিগত কয়েকমাসে আমাদের সমুদ্র সীমানায় প্রবেশ করেছে রাতের অন্ধকারে, শুল্ক ফাঁকি দিতে কলিঙ্গপত্তনে প্রবেশ না করেই পাড়ি দিয়েছে তারা দক্ষিণে। এর প্রতিকার করতে, সমুদ্রে পথ রোধ করে শুল্ক আদায় করেছে চম্পা নৌসেনা, সেও আমাদের অধিকৃত এলাকাতেই; এতে অন্যায় কোথায়?’
‘অন্যায় নয়, রাজনৈতিক ভুল পুত্র। নৌকা লুঠ না করে, দেব-গোপুরে দূত পাঠাতে পারতে, সাবধান করে দিতে এরূপ অনৈতিক কাজের বিরূদ্ধে; প্রয়োজনে প্রহরা বৃদ্ধি করতে সুমুদ্রে, যাতে সীমা অনুপ্রবেশ না ঘটে।‘
‘এ সকল প্রয়াস তখনই সফল হবে, যখন শৈলদেশ আমাদের মিত্রশক্তি রূপে পাশে থাকবে। সেকারণেই এত চেষ্টা পিতা’, কিছুটা থেমে উত্তর দেন যুবরাজ।
‘আচ্ছা এবার বল, বিবাহপ্রস্তাবটিও কি রাজনৈতিক, নাকি ব্যক্তিগত স্বার্থও কিছু আছে তোমার এতে?’ তাঁর একটু আগের তীক্ষ্ণ মন্তব্যে পুত্র ব্যাথিত হয়েছেন বুঝে আলোচনা লঘু করতে সচেষ্ট হন বজ্রবর্মন, কথা বলার ভঙ্গীতে তাই পরিহাসের সুর জেগে ওঠে।
‘আমার কাছে রাষ্ট্রই সব পিতা, ব্যক্তিস্বার্থের জায়গা নেই সেখানে’, যুবরাজ আলোচনায় ইতি টানেন গম্ভীর স্বরে।
***
বৈশাখী পূর্ণিমা তিথি, শৈলদেশ থেকে দূত এসেছেন সিংহপুর রাজসভায়, পূর্ণ সভাগৃহে উপঢৌকন ও সম্মানজ্ঞাপনের পর মহামাত্যের হাতে তুলে দেওয়া হয় শৈলরাজ চন্দ্রদমনের পত্র। সভাশেষে, একান্ত কক্ষে মহামাত্য পাঠ করেন সে পত্র মহারাজ বীরবর্মন, যুবরাজ ও ঘনিষ্ঠ অমাত্যদের উপস্থিতিতে। পত্রের বক্তব্য অতি প্রাঞ্জল; –
‘বাণিজ্য তরণী বন্টনের যে প্রস্তাব যুবরাজ করেছেন, তাতে শৈলদেশ আগ্রহী, কিন্তু এব্যাপারে সিদ্ধান্তে পৌঁছতে ব্যবসায়কারী দেশগুলির সম্মতি নেওয়া প্রয়োজন বলে রাজা চন্দ্রদমন মনে করেন। তাছাড়া কাটিগারে তরণী সংক্রান্ত পরিসংখ্যান পরীক্ষার উদ্দেশ্যে অমরাবতীর আধিকারিকের উপস্থিতি তাঁর কাছে অত্যন্ত অসম্মানজনক, এই প্রস্তাবে তিনি রাজী নন, কলিঙ্গপত্তনেও নিজকর্মী নিয়োগে তাঁর আগ্রহ নেই। পরিশেষে অত্যন্ত দুঃখের সাথে জানানো হচ্ছে যে রাজকুমারীর সাথে যুবরাজ ভদ্রবর্মনের বিবাহ সম্ভবপর নয়, এব্যাপারে রাজনন্দনীর সম্মতি নেই। সেক্ষেত্রে, যুবরাজ আগ্রহী থাকলে রাজপরিবারের অন্য কোনও সদস্যার সাথে বিবাহ ঘটতে পারে।‘
পত্র পাঠ শেষ হলে কিছুক্ষণের জন্য নৈশঃব্দ নেমে আসে কক্ষের মধ্যে; মহারাজের মুখ চিন্তাকুল, অপ্রস্তুত ভাব ফুটে ওঠে অমাত্যদের অভিব্যক্তিতে। শুধু যুবরাজের মুখ দেখে বোঝা যায় না কিছু, তিনি নীরবে সভাত্যাগ করেন মহারাজের অনুমতি নিয়ে।
***
মধুপূর্ণিমার মায়াবী রাত্রি চন্দ্রমা কিরণে উদ্ভাসিত, স্নিগ্ধ দখিনা বাতাস কক্ষে বয়ে আনে জাতিপুষ্পের সুরভী; জানালার সমুখে সুখাসনে বসে যুবরাজ, নিকটে রাখা দীপদন্ডের আলোয় তাঁর মুখভাব চিন্তাক্লিষ্ট, গম্ভীর, চোখদুটি বড় ক্লান্ত, বিষাদমাখা। সামনে উৎপিটিকায় খোলা পড়ে রয়েছে রেশমপট্টে আঁকা একখানি নারীমুর্তি, এটি ভারি যত্নে রচিত রাজকুমারী সোমাশ্রীর আবক্ষ প্রতিকৃতি। যুবরাজ ক্রমে দৃষ্টি নিবদ্ধ করেন সেই দিকে; চিত্রপট থেকে যেন সরল হাসিতে উচ্ছ্বল হয়ে ওঠেন কুমারী। যুবরাজের দৃষ্টি নরম হয়ে আসে ধীরে ধীরে, চেয়ে থেকেন তিনি নিষ্পলকে, এইমূহূর্তে কর্মবীর কুমার শুধুই এক আত্মসমাহিত তরুণ। সময় কেটে যায়, রাত্রি গভীর হয়ে ওঠে, আচমকা পেচকধ্বনিতে জেগে ওঠে নিস্তব্ধ পুরীর নিভৃত শয়ন কক্ষখানি, চমকে ধ্যানভঙ্গ হয় কুমারের। দেখতে দেখতে তাঁর মুখের রেখায় ফুটে ওঠে অভূতপূর্ব কাঠিন্য, চোখের দৃষ্টি বুঝিবা কোনও দৃঢ় সংকল্পে অস্বাভাবিক রকমের উজ্জ্বল। চিত্রপট খানি হাতে নিয়ে মুষ্ঠিবদ্ধ করেন তিনি আচমকা, আর তার পরেই ছুঁড়ে দেন সেটি দীপদন্ডের উপর চরম ক্রোধে। চীনাংশুক জ্বলে ওঠে আগুনের স্পর্শে লেলিহান শিখায়; সেই রক্তবর্ণ আলোক অতৃপ্ত হৃদয়ের চিতার মত মূহুর্তে বদলে দেয় মায়াবী রাত্রিকে জিঘাংসার উৎসবে।
*** ***
টীকাঃ দেব-গোপুর – উত্তর ভিয়েতনামের তৎকালীন চৈনিক উনরাজ্য