সুবর্ণভূমে পুষ্পকেতু

প্রথম পর্বের পর

 

 দ্বিতীয় পর্ব 

অনন্যা পাল

 

অন্তরালে

পাটলীপুত্রের মহাদণ্ডনায়কের কার্যালয়টি প্রথম ভাদ্রের সিক্ত অপরাহ্নে উত্তেজনায় চঞ্চল, শান্তিপূর্ণ জনপদে হঠাৎই ঘটে গেছে এক অনর্থ। বর্ধিষ্ণু শ্রেষ্ঠীপল্লির অধিবাসী ভদ্র রুচিপতির তেজারতি কারবার, ধানিজমি, বসতবাটি ও গহনাদি বন্ধক রেখে টাকা ধার দেওয়া তাঁর পৈত্রিক ব্যবসা; ওইদিন বেলা দ্বিতীয় প্রহরে গৃহসেবক কক্ষ পরিষ্কার করতে গিয়ে দেখে শ্রেষ্ঠী বাইরের কক্ষে বসবার মন্দুরাটির সমুখে পড়ে আছেন, পিঠে আমূল বিঁধে আছে একখানি খঞ্জর। মহাদন্ডনায়ক বিশাখগুপ্তের নেতৃত্বে বসেছে আলোচনা সভা, সেখানে উপস্থিত আছেন উচ্চপদস্থ কর্মচারীরা; আর আছেন তরুণ পুষ্পকেতু। পুষ্পকেতু মহাদন্ডনায়কের পুত্র, তবে কার্যালয়ে তাঁর উপস্থিতি সে কারণে নয়; ইতিমধ্যেই নিজের বুদ্ধিমত্তা ও বিশ্লেষনী ক্ষমতার গুণে তিনি মিমাংসা করেছেন অনেক সমস্যার, হরিষেন সেকারণেই এত স্নেহ করেন তাঁকে;  কর্মক্ষেত্রে পিতাও অনেকাংশে নির্ভর করেন তাঁর বিচারবুদ্ধির উপর।

‘সকালের ঘটনা সবিস্তারে বল জর্তু, শঙ্কা কোর না’, বিশাখগুপ্তের গম্ভীর কন্ঠস্বরে আশ্বাস ফুটে ওঠে।

‘তখন বেলা দ্বিতীয় প্রহর প্রায়, গোশালায় গরুগুলিকে যাবস দিয়ে প্রভুর কর্মকক্ষের সমুখে যাই; বাইরের কেউ নেই নিশ্চিত হয়ে সম্মার্জনী নিয়ে প্রবেশ করি এরপর। আর তারপরেই ওই ভীষণ দৃশ্য!’ হাহাকার করে ওঠে পরিচারক জর্তু।

‘শান্ত হও জর্তু, এই পরিস্থিতে তোমার সাহায্য ছাড়া  আমরা অসহায়; সঠিক ভাবে জানাও ঠিক কি ঘটেছিল’।

‘প্রভু  মন্দুরার সমুখে লেখনপীঠে উপুড় হয়ে পড়েছিলেন, পিঠে বিঁধে ছিল চৈনিক খঞ্জরের একখানি; রক্তাক্ত ছিল তাঁর দেহ ও পিঠিকা’।

‘চৈনিক খঞ্জর বুঝলে কিরূপে? সে তো বিঁধে ছিল পিঠে!’

‘কক্ষের দেওয়ালে শোভা পায় একজোড়া চৈনিক খঞ্জর, ভারি সুন্দর তাদের হাতলের কারুকাজ; দেখেই চিনেছিলাম তাই।‘

‘কক্ষে কেউ ছিলনা নিশ্চিত হতে কক্ষের ভিতরে  দৃষ্টিপাত করেছিলে নিশ্চয়ই? তখন মৃতদেহ চোখে পড়েনি?’ এতক্ষণে প্রশ্ন করেন পুষ্পকেতু।

‘দৃষ্টিপাত করিনি দেব, কর্মকক্ষের দরজা ভেজানো ছিল প্রতিদিনের মতই, আমি কপাটে শব্দ করে জানান দেই। ভিতর থেকে কোনও আওয়াজ না পেয়ে বুঝি কক্ষ শূন্য। তখন নিঃশব্দে প্রবেশ করি, তবে কক্ষটি দীর্ঘ, দরজা থেকে মন্দুরা চোখে পড়েনা; প্রভুকে আবিষ্কার করি কিছুপরে।‘

জিজ্ঞাসাবাদ এগোয়, ক্রমে যা জানা যায় তা এই প্রকার –

ভদ্র রুচিপতির কর্মকক্ষটি মূলগৃহ থেকে কিছুটা বিচ্ছিন্ন, শুধুমাত্র একটি দরজার মাধ্যমে উঠান সংলগ্ন অলিন্দের সাথে সংযুক্ত; বাইরে থেকে কক্ষে প্রবেশের জন্যে আছে একটি পৃথক দরজা। এই ব্যবস্থা মূলতঃ খাতকদের পরিচয় গোপনের উদ্দেশ্যে; রুচিপতির খাতকদের অনেকেই সমাজের বিশিষ্ট ব্যক্তি, দুঃসময়ে পড়ে বাধ্য হয়ে আসেন মহাজনের কাছে। স্ত্রী ও দুই শিশুপুত্র নিয়ে রুচিপতির সংসার, পিতা, মাতা দেহ রেখেছেন বছর কয়েক আগে; তাঁর কনিষ্ঠ ভ্রাতা নিজ সংসার নিয়ে পল্লীমধ্যেই পৃথক গৃহে বাস করেন। রোজকার মতই ঘটনার দিন প্রাতঃরাশ সেরে কর্মকক্ষে গিয়েছিলেন শ্রেষ্ঠী; ভিতরভাগের দরজা আলগোছে বন্ধ ছিল, ফলে কেউ দেখা করতে এসেছিল কিনা জর্তু জানতে পারেনি।

‘কর্মকক্ষটিতে আপাতত কেউ যেন প্রবেশ না করে, সেব্যবস্থা করা হবে কার্যালয় থেকে, জানিও তোমার প্রভুপত্নীকে। শ্রেষ্ঠীর দেহ পরীক্ষা শেষ হলে সৎকারের অনুমতি মিলবে কিছুক্ষণের মধ্যেই, নিশ্চিন্ত থেকো‘; প্রয়োজনীয় নির্দেশ দিয়ে গৃহে ফেরার অনুমতি দেওয়া হয় জর্তুকে, তার সঙ্গী হয় দুই রক্ষী।

গৃহের পরিচারিকা সুরভীর বক্তব্য থেকে জানা যায় বৈদ্যগৃহ থেকে প্রভুপত্নীর জন্য ওষধি নিয়ে ফেরার সময়, শ্রেষ্ঠী দেবদত্তকে সে দেখেছিল প্রভুগৃহ থেকে বের হয়ে যেতে।

‘শ্রেষ্ঠী বোধ করি বিচলিত ছিলেন কোনো কারণে,অতিদ্রূত বেরিয়ে যান তিনি আমাকে প্রবল ধাক্কায় মাটিতে ফেলে;‘ জানায় সুরভী।

এরপরে শ্রেষ্ঠী দেবদত্তকে ডেকে আনা হয় জিজ্ঞাসাবাদ করার জন্যে। মহাজন গৃহে গিয়েছিলেন এ কথা প্রথমে অস্বীকার করলেও পরে মেনে নেন তিনি; তবে একথাও জানান যে রুচিপতি সুস্থ ও জীবিত ছিলেন সেসময়।

‘রুচিপতি আপনার প্রতিবেশী, তাঁর সাথে আপনার সম্পর্ক কিরকম?’ দেবদত্তকে প্রশ্ন করছেন বিশাখগুপ্ত।

‘একজন মহাজনের সাথে, খাতকের যে সম্পর্ক, তাঁর সাথে আমার সম্পর্কও ছিল সেই রকম।‘

‘আপনি, তাঁর খাতক ছিলেন?’

‘অবস্থার চাপে হয়ে পড়েছিলাম সম্প্রতি।‘

‘কিন্তু তিনি তো আপনার প্রতিবেশীও বটে, আমি সেই সম্পর্কের কথা জানতে চাইছি’।

‘খাতক হয়ে পড়লে, বাকী সকল সম্পর্ক তুচ্ছ হয়ে যায়; তাই সে প্রসঙ্গ আর আসে না এখানে।‘

‘আপনি রুচিপতির প্রতি বিশেষ ক্ষুব্ধ বলে বোধ হচ্ছে, এর কোনও বিশেষ কারণ আছে কি?’

‘নিজ ভাগ্য বিড়ম্বনায় তিক্ত হয়ে পড়েছি আর্য,কারও প্রতি ব্যক্তিগত ক্ষোভ নেই’।

‘সম্ভবত আজ সকালে আপনিই শেষ জীবিত দেখেন রুচিপতিকে, আর কেউ ছিল কি সেখানে? আপনি খুবই বিচলিত ছিলেন সেসময়ে এরই বা কারণ কি?’

‘শ্রেষ্ঠীর সাথে আমার সাক্ষাৎকালে দ্বিতীয় কেউ ছিল না সেখানে; আর, কর্জভার দূর করতে না পারলে বিচলিত হবারই তো কথা, এর বেশী কিছু নয়’।

‘আপনি বণিক সোমদত্তের পুত্র, অত্যন্ত স্বচ্ছল পরিবারের সন্তান, হঠাৎ এই ভাগ্যবিপর্যয় ঘটল কি ভাবে?’

‘তিন বছর আগে পাড়ি দিয়েছিলাম সুবর্ণভুমিতে, পিতার মৃত্যুর পর সেই আমার প্রথম সমুদ্রযাত্রা, সাথে ছিল বহুমূল্য পণ্য। সবই ঠিক চলছিল, কিন্তু পথিমধ্যে মালবপ্রণালীতে জলদস্যুর হাতে পড়ে, সর্বস্বান্ত হই; কোনোক্রমে প্রাণটুকু বাঁচিয়ে, দেশে ফিরি বহুকষ্টে।‘ দীর্ঘশ্বাস ফেলেন দেবদত্ত, বিষাদের রেষ ছড়িয়ে পড়ে সভামধ্যে।

‘রুচিপতির কাছে কর্জ নিলেন কবে?’

‘গত বছর আশ্বিনে’।

‘ঋণ ফেরতের সময়কাল ফুরিয়েছিল কি?’

‘আষাঢ়ের শুরুতে ফিরিয়ে দেবো কথা ছিল, তবে দেশে ফিরতে অর্ধপক্ষকাল দেরী হয়, সময় পারিয়ে যায় ঋণ ফেরতের’।

‘একটু বিষদে বলুন ভদ্র, আমরা জানতে আগ্রহী’।

‘সমুদ্রযাত্রা থেকে ফিরে, কর্মহীন জীবন কাটালাম কিছুকাল; সঞ্চিত ধন নিঃশেষ করে পণ্য খরিদ করেছিলাম সমুদ্রযাত্রার সময়, ফলে রোজগারের প্রয়োজন দেখা দিল ফেরার কিছুদিনের মধ্যেই। নতুন করে কিছু বাণিজ্য করতে মূলধন লাগে, তা আমার ছিল না। তখন অনেক ভেবে, স্থির করলাম, কর্জ নিয়ে ব্যাবসা করব, ব্যাবসায় লাভ হলে ঋণ্মুক্ত হয়ে সুদিন ফেরাবো। এরপর, প্রতিবেশী রুচিপতির থেকে ঋণ নিয়ে বাণিজ্যে যাই’।

‘আবার সুবর্ণভুমি?’

‘না, দূরদেশে যাবার মূলধন কোথায়? নদীপথে প্রথমে যাই তাম্রলিপ্ত, সেখান থেকে মুক্তা ও চিনাংশুক সংগ্রহ করে পাড়ি দেই পশ্চিমে। ভৃগুকচ্ছে, পশ্চিমগামী যবন বণিকদের কাছে সে পণ্য বিক্রয় করে, গজদন্ত ও গন্ধদ্রব্য সংগ্রহ করি। ফেরার পথে সে সামগ্রী ভালো দামে বিক্রি হয় কোশল ও উজ্জয়িনীতে’।

‘সেক্ষেত্রে ঋণশোধে বাধা ছিল কোথায়?’

‘ঋণ শোধের সময় পেরিয়ে গিয়েছিল, বাধা সেখানেই।‘ খানিক স্তব্ধ থেকে উত্তর দেন দেবদত্ত।

‘আপাতত আর জানবার নেই কিছু, তবে মৃত্যুরহস্য ভেদ না হওয়া পর্যন্ত নগর ত্যাগ করবেন না’, অবশেষে বিশাখগুপ্ত বিদায় দেন শ্রেষ্ঠীকে।

‘দেবদত্তের ক্ষোভের কারণ কি শুধুই ঋণদায়?’ চিন্তান্বিত দেখায় মহাদণ্ডনায়ককে।

‘প্রতিবেশীর কাছে দুঃসময়ে হাত পাতা বড় সহজ কাজ নয়; আত্মাভিমান বড় সুক্ষ বস্তু’, পুষ্পকেতু মন্তব্য করেন।

‘রুচিপতির হত্যারহস্যের সমাধান কার্যালয়ে বসে হবে না; গভীরে যেতে হবে সমস্যার’, বিশাখগুপ্ত অর্থপূর্ন দৃষ্টিপাত করেন পুত্রের প্রতি।

‘আপনি অনুমতি দিলে, আমি চেষ্টা করতে পারি দেব’, স্মিত হেসে উত্তর দেন কেতু। পরিতুষ্টিতে উজ্জ্বল হয় গর্বিত পিতার মুখ।

***

‘আবার নতুন রহস্য! তুমি যে রহস্যভেদী হয়ে উঠলে ক্রমে!’

রুচিপতি হত্যার সংবাদ শুনে সেদিন অপরাহ্নে মিত্রের গৃহে উপস্থিত হন উল্মুক। রহস্যভেদ অভিযানে সঙ্গী হতে তাঁর সবসময়ই বিশেষ আগ্রহ, পুষ্পকেতুও উপভোগ করেন বন্ধুর এই নিরীহ কৌতুহল।

‘তা আর উপায় কি, রহস্য যখন গৃহে এসে হাতছানি দেয়, অগত্যা!’ এরপর, দুপুরের ঘটনা বিস্তারে জানান কেতু উল্মুককে।

‘কাল সকালে যাব একবার রুচিপতির গৃহে, দিনেরবেলা কর্মকক্ষটি পর্যবেক্ষণ করা প্রয়োজন, সঙ্গী হতে চাও?’

‘দপ্তরে আজই জানিয়ে এসেছি স্বাস্থ্য ভালো নেই, দু একদিন বিশ্রামের প্রয়োজন’, উল্মুকের অর্থপূর্ন মন্তব্যে হেসে ওঠেন পুষ্পকেতু।

***

পরদিন সকালে রুচিপতির গৃহে উপস্থিত হন দুইবন্ধু, পূর্ব সংকল্প মত। গৃহটি একতল বিশিষ্ট হলেও, অনেকখানি জায়গা জুড়ে তৈরী হয়েছে। পল্লীর পথ থেকে অঙ্গনদ্বার, তারপরে সমুখে খানিক খোলা জমি ছাড়িয়ে গৃহে প্রবেশের মূলদ্বার। তবে, সেই দ্বার ছাড়াও, গৃহের বামদিকে আর একখানি ছোট দরজা লক্ষ্য করা যায়, সেটি রুচিপতির কর্মকক্ষে প্রবেশের বাইরের দরজা, সন্দেহ থাকেনা। আয়তনে বেশ বড় হলেও, তেমন সুশ্রী নয় গৃহটি, সম্পন্ন ব্যক্তির বাসগৃহ বলে হঠাৎ বোঝা যায় না; সমুখের অঙ্গনটিও তেমন রুচির পরিচয় রাখেনা, কয়েকটি আম্র ও পনস বৃক্ষ ছায়া ফেলেছে সেখানে, জমি ঘাস ও আগাছায় পরিপূর্ন। এসবের মধ্যেও একটি বিষয় লক্ষ্যনীয়, গৃহের প্রবেশদ্বার দুটি ভারি মজবুত, উত্তম শাককাষ্ঠে নির্মিত।

‘কক্ষের কোনো বস্তু সরানো হয়নি তো?’ কার্যালয়কর্মী দ্বারা শৃঙ্খলিত অন্দর সংলগ্ন দরজাটি খুলে জর্তুর সাথে কর্মকক্ষে প্রবেশ করেন পুষ্পকেতু ও উল্মুক।

‘না দেব, কাল আপনাদের কার্যালয়ে যাবার পূর্বে এই কপাট বন্ধ করেছিলাম, কক্ষের বাইরের দরজাটিও ভিতর থেকে অর্গলবদ্ধ করি সেসময়ে।‘

ভিতরকার বদ্ধ হাওয়ায় রক্তের মৃদু কটু গন্ধ নাকে এসে লাগে; মৃত্যুর কালোছায়া অনুভূত হয় সুক্ষ তন্ত্রীতে, অজান্তেই দীর্ঘশ্বাস ফেলেন কেতু। কক্ষটিতে আসবাব সামান্যই, একখানি উপাধান সম্বৃদ্ধ আরামদায়ক মন্দুরা বাইরের দিকে মুখ করে রাখা; তার সমুখে লেখনপীঠ, পীঠিকার ভিতর ভাগে গহ্বর, জরুরি কাগজপত্র রাখার উদ্দেশ্যে। মন্দুরার মুখোমুখি দুখানি সুদৃশ্য আসন খাতকের বসবার স্থান, বামপাশে রাখা পানীয় জলের কুম্ভিকা ও দুটি পানপাত্র। এছাড়া কক্ষের এককোনে রয়েছে একটি লোহার সিন্দুক, মজবুত ও বৃহৎ। তবে আসবাব কম হলেও শূণ্য নয় কক্ষটি, দেয়াল জুড়ে বানানো নিধানিকায় সারি সারি সাজানো হিসাবের লেখপুস্তক। মন্দুরার পিছনের দেওয়ালে শোভা পাচ্ছে একজোড়া চৈনিক খঞ্জরের একখানি, দ্বিতীয়টির কোষ শূন্য; তার নীচে ঝোলানো রয়েছে একটি ভাদ্র মাসের দিনপঞ্জিকা। বাইরের দরজাটি ভিতর থেকে অর্গলবদ্ধ, দেওয়ালে একটি জানালাও রয়েছে, সেটিও ভিতর থেকে বন্ধ। পুষ্পকেতু পর্যবেক্ষন শুরু করেন প্রতিটি বস্তুর, উল্মুক হিসাব-বহিগুলিতে মনযোগী হন।

‘কাল প্রভুকে আবিষ্কার করলে যখন, বহির্দ্বার ও জানালা বন্ধ ছিল কি?’ জানতে চান পুষ্পকেতু।

‘দরজা আলগোছে ভেজানো ছিল, জানালা খোলাই ছিল, পরে আমি বন্ধ করি।‘

‘সিন্দুকের তল্লিকা কি প্রভুপত্নীর কাছে?’

‘আজ্ঞে না, সিন্দুকের তল্লিকা  সকল সময়ে প্রভুর কোমরে বাঁধা থাকত, কালও তাই ছিল। দেহের বাকিবস্তুর সাথে সেটিও এখন আপনাদের দপ্তরে।‘

লেখন পীঠিকাটিতে মনযোগী হন পুষ্পকেতু এরপর। পীঠিকার পাশে ভেঙ্গে পড়ে আছে দোয়াত, দোয়াতের কালি ও লাল রক্ত মিলিতভাবে শুকিয়ে পীঠিকার উপরভাগ কৃষ্ণবর্ণ, একপাশে পড়ে আছে কলম এবং রয়েছে একটুকরো রেশমের কাপড়, রক্তের দাগে তার সত্যকার রং চেনা যায় না।

‘বিগত বিশ বছরের হিসাব রয়েছে এই সংগ্রহে, তবে চলতি বছরের হিসাব-বহি চোখে পড়ছে না’, নিধানিকার সমুখ থেকে মন্তব্য করেন উল্মুক’।

‘সেটি রয়েছে এইখানে’, পীঠিকার গহবর থেকে একটি লেখপুস্তক বের করেন পুষ্পকেতু।

এরপর কর্মকক্ষের বাইরের দরজাটি দিয়ে বের হয়ে বাইরের র্পরিবেশ মন দিয়ে লক্ষ্য করতে থাকেন  কুমার। বহির্দ্বারের নীচে দুটি সিঁড়ি ও তার নীচে একখানি পাথরের পট, অতিথির পাদুকা রাখার জন্যে সেটি রাখা হয়েছে; তার সামনে দিয়ে সরু চলার পথ বাগানের প্রাচীর অবধি গিয়ে একটি অপেক্ষাকৃত ক্ষুদ্র অঙ্গনদ্বারে মিশেছে; যেকারণে মূল অঙ্গনদ্বারটি ব্যবহার না করেও কর্মকক্ষে প্রবেশ করা সম্ভব। চলার পথটি বর্ষার প্রকোপে কর্দমাক্ত, যদিও গৃহে প্রবেশের মূল পথ পাথর ফেলে চলাচলের উপযোগী রাখা হয়েছে। মূল পথ দিয়েও কর্মকক্ষে প্রবেশ সম্ভব; বর্যা ঋতুতে ছোট পথটির ব্যবহার নেই সন্দেহ থাকেনা। কর্মকক্ষ সংলগ্ন বাগানের অংশটি দিনের আলোতেও ছায়াঘন, কয়েকটি পনস বৃক্ষ ঘিরে রেখেছে তার দেওয়াল সংলগ্ন জমি; পরিচর্যার অভাবে জমি দীর্ঘ ঘাস ও আগাছায় পরিপূর্ণ। সিঁড়ির নীচে রাখা প্রস্তরপটটি কর্দমাক্ত, লক্ষ্য করেন কেতু।

‘কাল অন্ততঃ একজন কেউ দ্বিতীয় পথ ধরে কর্মকক্ষে এসেছিল’, উল্মুকের উদ্দেশ্যে বলেন তিনি।

‘কাদা তো পল্লীপথ থেকেও এসে থাকতে পারে’, উল্মুক যুক্তি দেন।

‘সেক্ষেত্রে দর্শনপ্রার্থী কোনও প্রতিবেশী’।

‘এত নিশ্চিত হচ্ছ কি ভাবে?’

‘তোমার কি মনে হয়, বর্ধিষ্ণু খাতক পায়ে হেঁটে আসবেন শ্রেষ্ঠীর কাছে? শিবিকায় এলে, পাদুকা কর্দমাক্ত হয় কি করে? হত্যাকারী প্রতিবেশী হওয়াই সম্ভব, নচেৎ সে শিবিকা কিছু দূরে ত্যাগ করে, পদব্রজে বাকি পথ এসেছে ও সকলের অলক্ষ্যে এই দ্বিতীয় অঙ্গনদ্বার ব্যবহার করেছে।‘

কথা বলতে বলতে উভয় মিত্র ছোট অঙ্গনদ্বারটিতে উপস্থিত হন, দ্বারের পাশে বর্ষার জলে বেড়ে ওঠা একটি কাঁটা ঝোপ দৃষ্টি আকর্ষন করে দুজনের। ঝোপের গায়ে লেগে থাকা একটি ছিন্নভিন্ন বস্ত্রাংশ সাবধানে ছাড়িয়ে নেন পুষ্পকেতু; হালকা পীতাভ বর্ণের কারুকার্যময় রেশমখন্ডটি কোনও শৌখিন ব্যক্তির উত্তরীয়ের ছিন্নাংশ সন্দেহ থাকেনা। অর্থপূর্নভাবে তাকান কুমার মিত্রের দিকে।

‘আততায়ীর বস্ত্রখন্ড, তাড়াতাড়িতে ঝোপে আটকে ছিঁড়ে গেছে, তাইতো?’ উল্মুক মন্তব্য করেন।

‘আততায়ী কিনা জানিনা, তবে অনাহুত অতিথি তো বটেই’।

এরপর  কক্ষে ফিরে এসে বাইরের দরজাটি নিজে হাতে বন্ধ করেন পুষ্পকেতু।

‘আপাতত, দেখা হয়েছে; কক্ষটি কপাটবদ্ধই থাকবে যতদিন অনুসন্ধান কার্য চলে। প্রভুপত্নীর সাথে একবার দেখা করতে চাই, এখন সম্ভব কি?’ জর্তুকে উদ্দেশ্য করে মন্তব্য করেন কুমার।

রাজপুরুষ দুজনকে অলিন্দে বসবার আসন দিয়ে জর্তু অন্দরে সংবাদ দেয়। কিছু সময় বাদে সুরভী এসে জানায় শ্রেষ্ঠীপত্নী অত্যন্ত কাতর হয়ে রয়েছেন, এখন দেখা করা সম্ভব নয়। সুরভীর পায়ে পায়ে অলিন্দে এসে দাঁড়ায় একটি সুন্দরকান্তি শিশু, বয়স চার কিংবা পাঁচ; তার মাথার কেশ চূড়ো করে বাঁধা, সেখানে একটি শিখিপাখা, পরনে হলুদে ছোপান অন্তরীয়, তবে হাতে বাঁশী নয়, একখানি কাপড়ের কন্দুক। পিতৃশোক ছুঁতে পারেনি অবোধ শিশুকে, কি হারিয়েছে সে বোধ তার নেই। স্নেহবশে হাত বাড়িয়ে দেন পুষ্পকেতু তার দিকে, মিষ্টি হেসে কন্দুকখানি ছুঁড়ে দেয় সে পরিবর্তে।

‘এটি প্রভুর কনিষ্ঠপুত্র জয়ন্ত’ সুরভী জানায়।

‘আর জ্যেষ্ঠটি?’

‘সে গুরুগৃহে থেকে অধ্যয়ন করে; পিতার সৎকারের উদ্দেশ্যে গতকাল এসেছে গৃহে, পারলৌকিক কর্ম মিটলে ফিরে যাবে আবার‘; কথাকটি বলে চোখ মোছে সুরভী।

‘কাল বৈদ্যগৃহে গিয়েছিলে ওষধি আনতে, প্রভুপত্নী কি রুগ্না?’

‘রুগ্না নন, তবে নিদ্রাহীনতায় ভোগেন, সেকারনেই ওষধি’।

‘এই গৃহে পরিচারক কয়জন?’

‘জর্তু ও আমি। জর্তু গৃহ, গোশাল ও বাগানের পরিচর্যা করে থাকে, প্রভুগৃহেই তার বাস; আমি পাকশাল ও অন্দরের কাজ করি, প্রভাতে আসি, কর্মশেষে অপরাহ্নে নিজ কুটিরে ফিরে যাই।‘

‘কাল দিবাকালে গৃহমধ্যে এসেছিল কেউ?’

‘ভদ্র শচীপতি, প্রভুর কনিষ্ঠ ভ্রাতা এসেছিলেন কাল, প্রভুপত্নীর সাথে অন্দরেই ছিলেন’।

‘কোন সময় এসেছিলেন তিনি? দীর্ঘকাল ছিলেন কি এইগৃহে?’

‘তাঁর আগমনের সময়কাল বলতে পারিনা, তবে জর্তু শীতল তক্রের খোঁজে আসে রসবতীতে, তার কাছেই জানতে পারি কনিষ্ঠ শ্রেষ্ঠী এসেছেন’।

‘তিনি কতসময় ছিলেন এরপর জান কিছু?’

‘স্বামিনী আমাকে মৎস্য অন্ডের রসাম্ল বানাতে নির্দেশ দেন নতুন করে, এই ব্যাঞ্জন ভদ্র শচীপতির অতিপ্রিয়। সে থেকে মনে হয়েছিল, ভদ্র মধ্যাহ্ন ভোজন কাল অবধি থাকবেন; কিন্তু পাক সারা হতে অন্দরে গিয়ে তাঁকে আর দেখিনি। এরপর আমি ওষধি আনতে বৈদ্যগৃহে যাই।‘

এরপর দুই বন্ধু বিদায় নিয়ে প্রতিবেশীদের খোঁজে রওয়ানা হন। রুচিপতির গৃহের ডান পাশে শ্রেষ্ঠী দেবদত্তের দ্বিতল গৃহটি সুন্দর, তবে অবস্থার গতিকে কিছুটা শ্রীহীন। আর বামপাশে রত্নজীবী বিষ্ণুদত্তের গৃহ, সে গৃহ স্বাচ্ছল্য ও রুচি দুয়ের সমন্বয়ে চোখে পড়ার মত। দেবদত্তের সাথে পূর্বেই দেখা হয়েছে, অতএব, এই মূহুর্ত্তে বিষ্ণুদত্তের গৃহে যাওয়াই স্থির হয়। রাজ পুরুষরা এসেছেন জেনে শ্রেষ্ঠী নিজে বেরিয়ে আসেন অভ্যর্থনায়। মধ্যবয়সী, সুঠাম চেহারা, দেখলেই মনে হয় নিয়মনিষ্ঠ; মানুষটি মিষ্টভাষী ও সদালাপী, তবে অভিজ্ঞ ব্যবসায়ী সন্দেহ থাকেনা তাঁর কথার বাঁধুনিতে। অভিবাদন শেষে অতিথিদের সাদরে নিয়ে যান তিনি গৃহের বাইরের বিশ্রামকক্ষে; কক্ষটি বিশিষ্ট অতিথিদের আপ্যায়নের জায়গা, প্রাচুর্যের নিদর্শন তার রুচিপূর্ন সজ্জায়। কক্ষমধ্যে একখানি সুখাসনে বসে এক ব্যক্তি, বিষ্ণুদত্তর থেকে বয়সে কিছুটা বড়, সদাশয় চেহারা, পোশাক আশাকে সম্পন্নতা লক্ষ্য করা যায়; গৃহস্বামী পরিচয় করিয়ে দেন উভয়পক্ষের।  মানুষটি, পল্লীর আর এক অধিবাসী, শ্রেষ্ঠী ভবভূতি, পেশায় স্বর্ণব্যবসায়ী, বিষ্ণুদত্তের বন্ধুস্থানীয়।

 

‘শ্রেষ্ঠী রুচিপতির সাথে শেষ কবে দেখা হয়েছিল আপনার?’ বিষ্ণুদত্তকে প্রশ্ন শুরু করেন পুষ্পকেতু।

‘রুচিপতি বয়সে নবীন হলেও আমার বিশেষ মিত্র ছিলেন, এছাড়াও ব্যাবসায়ের প্রয়োজনেও তাঁর গৃহে আমার যাতায়াত ছিল। গতকাল প্রভাতে শেষ কথা হয় তাঁর সাথে; তখন তো জানিনা সেই শেষ’। গভীর আবেগে কন্ঠরোধ হয়ে আসে বিষ্ণুদত্তের, উত্তরীয় প্রান্তে চোখ মোছেন তিনি, কিছুটা অপ্রস্তুত ভাবে।

‘কাল সাক্ষাৎ হয়েছিল? একটু বিশদে বলুন ভদ্র’।

‘আপনি হয়তো জানেন আর্য, বেশ কিছুকাল হোল পাশ্চাত্য বাণিজ্যে রোমক মুদ্রার প্রাদুর্ভাব ঘটেছে, স্বর্ণমুদ্রা অপেক্ষা ক্ষৌমবস্ত্র, সুগন্ধিকা, প্রবাল, স্ফটিক বা গুরুরত্নে শুল্ক পরিশোধ করতে বেশী আগ্রহী রোমক বণিকেরা; ফলে দিনার হয়েছে অগ্নিমূল্য। সেকারণে, রোমকমুদ্রার বিনিময়মূল্য বিষয়ে বৈশ্য সমিতির কার্যালয়ে একটি সভা ছিল গতকাল। সভায় আমি, ভদ্র ভবভূতি ও রুচিপতি একত্রে যাব এরকমই ঠিক ছিল। যাত্রার সময় সেকারণে আমরা রুচিপতিকে ডাকতে যাই, তবে সে যেতে অস্বীকার করে; এক বিশিষ্ট খাতকের অপেক্ষায় আছে এমনই জানায়। অতঃপর আমরা সভার উদ্দেশ্যে রওয়ানা দেই, সভা থেকে ফিরে শুনতে পাই দুর্ঘটনার কথা‘।

‘রুচিপতির সাথে ব্যবসায় সংক্রান্ত কি সম্পর্ক ছিল আপনার?’

‘রুচিপতির বন্ধকী কারবার, ভূসম্পত্তি ছাড়াও স্বর্নালঙ্কার ও মনিরত্ন জমা রেখে কর্জ দেওয়া প্রচলিত রীতি। সেকারণেই, রত্নের বিনিময়ে কোনও বড় কর্জ দেবার আগে সে মনিমূল্য যাচাই করিয়ে নিত আমার কাছে। অনেকক্ষেত্রে, ঋণ অনাদায়ী হয়ে পড়লে রত্নবিক্রয়েও তাকে সাহায্য করেছি আমি।‘

‘ভদ্র ভবভূতি, রুচিপতির সাথে আপনারও কি ব্যাবসায়িক সম্পর্ক ছিল?’

‘আজ্ঞে না। রুচিপতির পিতা ছিলেন আমার অগ্রজের মত, তাঁর জীবিতকালে যাতায়াত ছিল ঐগৃহে; আজকাল সামাজিক কর্তব্য ব্যাতিরেকে তেমন আসা যাওয়া নেই।‘

এরপর আর কথা এগোয়না বিশেষ, বিষ্ণুদত্তের গৃহ থেকে বিদায় নেন পুষ্পকেতু ও উল্মুক।

‘কেমন বুঝছ?’ সরব হন উল্মুক এতক্ষণে।

‘বোঝার মত কিছুই তো পাওয়া যায়নি এখনও; কোন বিশিষ্ট খাতকের অপেক্ষায় ছিলেন রুচিপতি সেটা জানা প্রয়োজন। চল একবার দেবদত্তের গৃহে যাই’।

দেবদত্তের গৃহে গিয়ে জানা যায়, তিনি বাইরে আছেন, তবে ফিরবেন শীঘ্রই, পুষ্পকেতু অপেক্ষা করাই সঙ্গত মনে করেন। শ্রেষ্ঠীপত্নী অত্যন্ত অতিথিবৎসলা, পরিচারকের হাতে বিশ্রামকক্ষে অতিথিদের জন্যে শীতল তক্র, সক্তুমোদক ও ঘৃতপুর পাঠান কিছুক্ষণের মধ্যেই।

‘গৃহস্বামীর ব্যবসায় ভাগ্য যেমনই হোক, পত্নীভাগ্য অতিউত্তম’, মোদক চিবোতে চিবোতে মন্তব্য করেন উল্মুক।

‘সুস্বাদু মিষ্টান্ন খেয়েই গলে গেলে যে! দেবদত্তকে সন্দেহের তালিকা থেকে বাদ দি তাহলে কি বল?’ দুই বন্ধু পরিহাসে ব্যস্ত, এসময়ে শ্রেষ্ঠী কক্ষে প্রবেশ করেন।

‘আপনাদের অপেক্ষায় রাখলাম, আমি এর জন্য ক্ষমাপ্রার্থী; আগে থেকে সংবাদ পাঠালে এই কষ্ট হোত না।‘

‘কষ্ট কিছু নয়, বেশ সুখেই ছিলাম আমরা’, হাতের আধখাওয়া ঘৃতপুরটি দেখিয়ে উত্তর দেন উল্মুক। সহজ রসিকতায় দেবদত্তের মুখমন্ডলের অস্বস্তির মেঘ  কেটে যায় কিছুটা।

‘কিছু প্রশ্ন ছিল আপনার কাছে, সেকারণেই এলাম আজ। গতকাল রুচিপতির গৃহে যাবেন সে কি আগেই ঠিক ছিল?’

‘একথা কেন বলছেন?’ আশ্চর্য হয়েছেন মনে হয় দেবদত্ত।

‘রুচিপতি বিষ্ণূদত্তকে জানিয়েছিলেন, যে খাতকের অপেক্ষায় আছেন’।

‘রুচিপতি আমার নাম জানিয়েছিলেন?’

‘না ঠিক সেভাবে স্পষ্ট করেননি, তবে তাঁর কথার ইঙ্গিত ও পরবর্তীতে আপনার সেখানে যাওয়া, সব মিলিয়ে একথাই মনে হয়’।

‘আমি যে যাবো রুচিপতির পক্ষে আগে থেকে সেকথা জানা  সম্ভব ছিল না।‘

‘কারন?’

‘কারন, আমি নিজেই জানতাম না যে সেখানে যাব। কাল বৈশ্যসমিতির সভায় যাবো ভেবে গৃহ থেকে বের হই, ঋণ সংক্রান্ত বিষয়ে মন অশান্ত ছিল, পথে রুচিপতির গৃহ পড়ে, কি মনে হতে তার কর্মকক্ষে উপস্থিত হই’।

‘আপনার সাথে তাঁর ঠিক কি কথাবার্তা হয়েছিল জানতে পারি কি?’

‘বিশেষ কিছু নয়, রুচিপতি ব্যস্ত ছিলেন আমাকে পরে দেখা করতে বলেন।’

‘এরপরে বৈশ্য সমিতিতে গিয়েছিলেন কি?’

‘নাঃ, এরপর আর যাওয়া হয়নি, আমি নিজের গৃহে ফিরে আসি সেসময়ে।‘

‘এই মত পরিবর্তন কি রুচিপতির সাথে বাগ বিতন্ডার ফল, না কি তার চেয়েও কিছু বেশী?’ পুষ্পকেতুর কন্ঠস্বর কঠিন শোনায়।

‘অবস্থার গতিকে আপনারা আমাকে সন্দেহের চোখে দেখছেন, জানি সেকথা; কিন্তু সেদিন আমার সাথে রুচিপতির কোনও কলহ ঘটেনি, ঋণজনিত অশান্তির জেরে মন বিভ্রান্ত ছিল, সেকারণেই গৃহে ফিরে আসি।‘

‘আপনি বলছেন ঋণ সংক্রান্ত বিষয়ে অশান্তিতে ছিলেন, অশান্তির কারণ একটু বিশদে বলুন। রুচিপতি কি আপনার বিরুদ্ধে সমিতিতে অভিযোগ জানিয়েছিলেন?’

দীর্ঘক্ষণ নিস্তব্ধ থাকেন দেবদত্ত, বুঝিবা প্রশ্নের উত্তর নিয়ে দ্বন্দে আছেন এরূপ বোধ হয়। অবশেষে কোনও সিদ্ধান্তে উপনীত হন অসীম চেষ্টায়; পুষ্পকেতুর প্রশ্নের উত্তরে তিনি যা জানান তা এইপ্রকার।

দেবদত্তের পিতামহ অশ্বিনীদত্ত বাণিজ্য জীবনের শুরুতে সিংহল থেকে একখানি বিরল পদ্মরাগ মণি সংগ্রহ করেন, আর সেই বাণিজ্যযাত্রা থেকেই তাঁর সৌভাগ্যের শুরু। এরপর শ্রেষ্ঠীর বিশ্বাস জন্মায়, ঐ পদ্মরাগ তাঁর সৌভাগ্যলক্ষী, মণিটি বিক্রয় না করে নিজের কাছেই রেখে দেওয়া মনস্থ করেন তিনি, মণিটি বংশেই থেকে যায়; পিতার মৃত্যুর পরে সেই পদ্মরাগ উত্তরাধিকার সূত্রে বংশের প্রথম সন্তান হিসাবে দেবদত্ত অর্জন করেন। বাণিজ্যে সর্বস্বান্ত হয়ে যখন ঋণ নেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন শ্রেষ্ঠী, জমানত হিসাবে কি রাখবেন সে সমস্যা দেখা দেয়। বসতগৃহ দেবদত্তের একার নয়, কনিষ্ঠ দুই ভ্রাতাও এই গৃহের অংশীদার, তাছাড়া বৃদ্ধা মাতা এখনো বর্তমান; গৃহ বন্ধক রাখতে মন সায় দেয় না। পত্নীর অলংকার রাখা চলত, কিন্তু এই কয়মাস সংসার চালাতে তার একটা অংশ আগেই বিক্রি হয়ে গেছে, যা বাকি আছে হাতছাড়া করতে সাহস করেননি তিনি। অতঃপর একটিই পথ খোলা ছিল, আর তা হোল পদ্মরাগ মণি বন্ধক রেখে অর্থ সংগ্রহ। রুচিপতি প্রতিবেশী ও পারিবারিক বন্ধু, তাঁর কাছে খাতক হবার ইচ্ছা ছিলনা দেবদত্তের; নগরে মহাজনের অভাব নেই। কিন্তু পদ্মরাগ যে কারুর কাছে গচ্ছিত রাখতে ভরসা হয়নি, ঋণ পরিশোধে সমস্যা হলে সেটি হস্তান্তর হবার ভয় ছিল। তাই সবদিক চিন্তা করে রুচিপতির কাছে কর্জ নেওয়াই স্থির হয় এরপর।

কর্জ দেওয়ার সময়ে রুচিপতি আশ্বাস দেন পদ্মরাগ মণি দেবদত্তেরই থাকবে, তিনি কোনোমতেই বিক্রয় করবেন না রত্ন; তবে প্রথামত চুক্তিপত্র তৈরী হয়, তাতে ঋণশোধের সময় সময়সীমা ছিল আষাঢ়ের শুক্লাপ্রতিপদ। নদীপথে উজ্জয়িনীর কাছে ঝড়ের মুখে পড়ে নৌযান, বাধ্য হয়ে কিছুকাল আটকে থাকতে হয় সেখানে, ফলে দেবদত্ত প্রতিপদের পরিবর্তে শুক্লাষ্টমীতে নগরে ফেরেন। গৃহে ফেরা মাত্র রুচিপতির কাছে ছুটে যান তিনি  ঋণ শোধ করতে, অতিরিক্ত সময়কালের জন্য অধিক অর্থ দিতেও প্রস্তুত ছিলেন তিনি; কিন্তু রুচিপতি মণি ফেরত দিতে অস্বীকার করেন নিতান্ত আকস্মিক ভাবেই। এরপর বারংবার অনুনয় বিনয়েও ফল হয়নি কিছু, রক্তচোষক মহজনের স্বরূপ বেরিয়ে আসে প্রতিবেশী বন্ধুর খোলস ছেড়ে।

‘রুচিপতির প্রতি আপনার ক্ষোভের কারণ বোঝা গেলো; কিন্তু বাঁধা রাখা বস্তু বাজেয়াপ্ত করা মহাজনের স্বধর্ম, শ্রেষ্ঠী অনৈতিক কিছু করেননি’; পুষ্পকেতু মন্তব্য করেন।

‘অনৈতিক নয় সে আমি জানি, সেকারণেই নীরব আছি এবিষয়ে; বন্ধু ভেবে মানবিক ধর্ম আশা করেছিলাম, সে আমারই ভুল। মণি, গৃহের সকলের অজান্তে বন্ধক রেখেছিলাম, বৃদ্ধা মাতার কাছে কিভাবে সত্য প্রকাশ করব জানিনা’; দেবদত্তের দীর্ঘশ্বাসে ভারী হয়ে ওঠে কক্ষের বাতাস।

অতঃপর শ্রেষ্ঠীর গৃহ থেকে বিদায় নেন দুই বন্ধু।

***

মধ্যাহ্নভোজন পর্ব শেষে পুষ্পকেতুর বিশ্রামকক্ষে উপাধানে অর্ধশায়িত উল্মুক, পুষ্পকেতু অভ্যাসমত একটির পুঁথির পৃষ্ঠায় মনযোগী; বাইরে মৃদু বর্ষণ, শীতল বাতাসে শান্তির পরিবেশ। এক পশলা বৃষ্টির মতই তাম্বুল করঙ্ক হাতে কক্ষে প্রবেশ করেন এক সুশ্রী যুবতী; তাঁর চলার ছন্দে কৃত্রিম ব্যস্ততা, খদিরে রাঙ্গা ঠোঁটে মৃদু হাসি, দুচোখে প্রসন্ন কৌতুহল; এক লহমায় আলস্য কাটিয়ে জেগে ওঠে নিদ্রালু কক্ষটি।

‘চম্পাবতীর কাছে শুনেছি গুহ্যকথা, সাবধানে থাকবেন আর্য’, উল্মুকের সামনে দুখানি সুগন্ধি তাম্বুল এগিয়ে দিয়ে বলে ওঠেন নারী কপট আশঙ্কায়।

‘কিরকম? চম্পাবতীকেই বা পেলেন কোথায়?’

‘আগে তাম্বুল।’

‘খাইনা!’

‘আজ খাবেন’, রসিকতা ভরে তাম্বুল দুটি মুখের কাছে ধরেন রমনী।

‘অগত্যা!’ উল্মুক অসহায় ভঙ্গীতে মুখে পোরেন সে দুটি; নির্মল কৌতুকে রসসিক্ত হয় দুজনের কথবার্তা।

রমনী, পুষ্পকেতুর ভাতৃবধূ সুগন্ধা; বয়সে ছো্ট দেবর ও দেবর সখার সাথে স্নেহ ও বন্ধুত্বের এক অপূর্ব বন্ধন তিনি তৈরী করেছেন নিজগুনে শ্বশুরগৃহে আসার পর থেকেই। সুগন্ধার সরস অত্যাচার মনে মনে উপভোগ করেন দুইবন্ধু, জ্যেষ্ঠ্যাজ্ঞানে সম্মানও করেন; তেমনি সময়ে অসময়ে তাঁকে কুপিত করতেও ছাড়েননা।

‘এবারে গুহ্যকথা শুনি?’

‘শুনলাম আর্যের শরীর খারাপ, পুস্তপাল ব্যস্ত হয়ে বিশ্রাম মঞ্জুর করেছেন কয়েকদিনের?’

‘এটাই গুহ্যকথা?’

‘না গুহ্যকথা এই যে, অসুখ নেই; রহস্যভেদে ব্যস্ত’।

‘একথা চম্পা না জানালেও গোপন থাকত কি আপনার কাছে?’

‘না, আমার কাছে থাকত না; তবে ব্রতসঙ্কীর্তনে বাকি সকলের কাছে থাকত বোধকরি। পুস্তপাল-গৃহিনীও ছিলেন সেখানে’।

‘সর্বনাশ! কিন্তু সঙ্কীর্তনে যাবার প্রয়োজন কি ছিল?”

‘আজ পার্বতী ব্রতের নিরম্বু উপবাস, বলেনি চম্পা? শীঘ্র গৃহে গিয়ে পরিচর্যা করুন তার’।

‘কি কান্ড, পুস্তপাল-গৃহিনী!’ ব্যস্ত হয়ে ওঠেন উল্মুক।

‘ভয় নেই। গুহ্যকথা ভালোরকম ফাঁস হবার আগেই সামলে দিয়েছি আমি’, কথাকটি বলে কৌতুক হাসিতে বাতাস উজ্জিবীত করে কক্ষ ত্যাগ করেন সুগন্ধা।

উল্মুকের পর্যুদস্ত ভাব নীরবে উপভোগ করছিলেন পুষ্পকেতু, এতক্ষণে সোচ্চারে হেসে ওঠেন তিনি।

***

‘রুচিপতিকে হত্যার সুযোগ ও কারণ দুটোই দেবদত্তের ছিল; রুচিপতির গৃহ থেকে বের হয়ে আসার সময় তার দিশেহারা ভাবও অত্যন্ত সন্দেহজনক।‘ সায়াহ্নে পিতার সাথে অনুসন্ধান বিষয়ে আলোচনায় বসেছেন পুষ্পকেতু।

‘সেক্ষেত্রে তাকে কারাবদ্ধ করতে বাধা কোথায়? এহেন জঘন্য অপরাধের শাস্তি দৃষ্টান্তমূলক হওয়া কর্তব্য।‘

‘আগে রুচিপতি গৃহিনীর সাথে একবার কথা বলা প্রয়োজন; দেবদত্তের উপর নজরদারীর বন্দোবস্ত তো করাই হয়েছে।‘

‘বেশ তুমি যা যথার্থ মনে কর; আমার সম্মতি রইল’।

***

বিশাখগুপ্তের কার্যালয়ে রুচিপতির অঙ্গের থেকে পাওয়া সমস্ত সামগ্রী সংগৃহীত ছিল, পুষ্পকেতু সেগুলি দেখবার উদ্দেশ্যে ভদ্র চিত্রকের সাথে দেখা করেন। চিত্রক একজন অভিজ্ঞ দণ্ডাধিকারিক; কর্মজীবনের শুরুতে গুপ্তচর বিভাগে নিয়োজিত ছিলেন দীর্ঘসময়, ফলে মানবশরীর ও বিষবিজ্ঞানেও তাঁর বুৎপত্তি।

‘শ্রেষ্ঠীর মৃতদেহ পরীক্ষা করে আপনার কি ধারণা হয়েছে আর্য?’

‘খঞ্জর পিছন থেকেই বিদ্ধ হয়েছে, তবে আততায়ী তার ডানপাশে ছিল, তাই খঞ্জর পিঠের ডানপাশ থেকে ঢুকে বামদিকে চালিত হয়েছে। ঘটনাস্থল ও মৃতের মুখভঙ্গী থেকে আরো একটি বিষয় স্পষ্ট, আঘাতের জন্য শ্রেষ্ঠী প্রস্তুত ছিলেননা, আঘাত যেমন আকস্মিক তেমনই অপ্রত্যাশিত।‘

‘সেকারণেই জলের কুম্ভিকা আপন স্থানেই ছিল, মুন্দুরার উপাধান জায়গাচ্যূত হয়নি’, পুষ্পকেতু স্বগোক্তি করেন অন্যমনে।

‘অবশ্য! তাছাড়া, খঞ্জর সুতীব্রভাবে লক্ষ্যভেদে সক্ষম হয়েছে, ফলে রক্তপাতও তুলনামূলক কম। মৃতের নখ, বা দাঁতে আততায়ীর কেশাগ্র, চর্মচিহ্ন কিছুই ছিলনা, কোনো সংঘাত ঘটেনি আমি  নিশ্চিত।‘

‘আততায়ীর বসনে রক্তচিহ্ন লাগার কথা কি এক্ষেত্রে?’

‘রক্তছিটা লাগবে তবে খুব বেশী নয়,কারণ খঞ্জরের নখর অতীব তীক্ষ্ণ, তাছাড়া আঘাত করা হয়েছিল একাগ্রচিত্তে এবং বলপ্রয়োগ করে। আততায়ী যুবাপুরুষ এবং বলশালী ব্যাক্তি এবিষয়ে সন্দেহ নেই।‘

এরপর, সংগৃহীত বস্তু পরীক্ষায় মনযোগী হন পুষ্পকেতু। কর্ণকুন্ডল, হাতের বলয়, গলায় রুদ্রাক্ষ এবং বামহাতের অনামিকায় ছিল একখানি পুষ্পরাগখচিত আংটি; সামর্থের বিচারে শ্রেষ্ঠী অত্যন্ত অনাড়ম্বর জীবনযাপন করতেন মৃতের আভুষণ থেকে তা স্পষ্ট হয়। কোমরের বন্ধনী থেকে পাওয়া গিয়েছিল দুইখানি তল্লিকা, তার একটি আকারে বড়, সম্ভবত সিন্দুকের; অন্যখানি ক্ষুদ্র, ধারণা হয় সেটি গহনার বাক্স জাতীয় কোনও ক্ষুদ্র পেটিকার। ভদ্র চিত্রকের অনুমতি নিয়ে চাবি দুখানি নিজ সংগ্রহে রাখেন পুষ্পকেতু। এরপর, দুই বন্ধুতে আবার যাত্রা করেন রুচিপতির গৃহের উদ্দেশ্যে, সাথে যান দুই দন্ডালয় কর্মচারী। সকালেই শ্রেষ্ঠীপত্নী জর্তুর মুখে সংবাদ পাঠিয়েছিলেন, তিনি সাক্ষাৎ করতে প্রস্তুত, এছাড়াও সিন্দুকখানি পরীক্ষার প্রয়োজন।

‘রুচিপতির গহনায় রুচি ছিল একথা বলা চলেনা, তবে বৃহস্পতিকে তুষ্ট রাখতে গুরুরত্ন আঙ্গুলে ধারণ করতে ভোলেননি’, উল্মুক মন্তব্য করেন পথে।

‘অহো! তোমার পর্যবেক্ষণ শক্তি যে রীতিমত তীক্ষ্ণ হয়ে পড়েছে, একি চম্পাবতীর সঙ্গগুণ?’

‘এই তোমার এক রোগ কেতু, নিজে বিবাহ করবে না, আর আমাকে গঞ্জনা দিতে ছাড়বেনা’, কপট ভ্রুকুটি ফুটে ওঠে উল্মুকের কপালে।

***

শ্রেষ্ঠীগৃহের বহির্কক্ষটি তাঁর সাধারন জীবনযাত্রারই প্রতিফলন, কয়েকটি সুখাসন, দুটি খট্টিকা ও একখানি সুখশয্যা ছড়িয়ে আছে ইতস্তত; কক্ষের শোভাবৃদ্ধির কোনও বিশেষ চেষ্টা চোখে পড়েনা সেখানে। রাজপুরুষদের অপেক্ষায় রেখে জর্তু অন্দরে যায় সংবাদ দিতে; ইতিমধ্যে, রাজকর্মচারী দুজন কর্মকক্ষের দরজা খোলার কাজ শুরু করেন। সুরভীর সাহায্যে শ্রেষ্ঠীপত্নী ধীরপায়ে বহির্কক্ষে প্রবেশ করেন কিছুপরে; রুচিপতি গৃহিনী রেবা বয়সে যুবতী, চেহারা কৃশ, শোকের ছায়ায় মুহ্যমান লতার মতই কোনোক্রমে আসন গ্রহন করেন তিনি।

‘এসময়ে আপনার শান্তিভঙ্গ করার কারণে আমরা ক্ষমাপ্রার্থী’, পুষ্পকেতুকে কিছুটা বিব্রত দেখায়।

‘অপরাধীর শাস্তিতেই আমার শান্তি, আপনাদের সাহায্য করা তো কর্তব্য’।

রেবার কন্ঠস্বরের অদ্ভুত দৃঢ়তা ঠিক যেন তাঁর দুর্বল অবয়বের সাথে মেলে না, পুষ্পকেতু ও উল্মুক দুজনেই চমকে তাকান তাঁর মুখপানে। ক্রমে তাঁদের চোখে ফুটে ওঠে বিস্ময় ও মুগ্ধতা; তৈলহীন রুক্ষ কেশচূর্ণের ঘেরাটোপে রেবার শোকতপ্ত মুখশ্রী অপূর্ব সুন্দর, বিষাদের ছায়া মেখে অনুপম তার সুষমা।

‘গত পরশু, অর্থাৎ দুর্ঘটনার দিবসে, গৃহে কোনও বাইরের লোক এসেছিল কি?’ বিহ্বলতা কাটিয়ে প্রশ্ন শুরু করেন পুষ্পকেতু।

‘গৃহমধ্যে দিবাকালে বাইরের লোক আসত না, তাঁরা কর্মকক্ষে সাক্ষাৎ করতেন স্বামীর সাথে; সেইদিন কেউ এসে থাকলেও আমার জানার কথা নয়।‘

‘দেবদত্ত আপনার স্বামীর খাতক ছিলেন, আপনি জানতেন?’

সুরভীকে কক্ষ থেকে চলে যেতে বলেন রেবা, এরপর একটু ইতস্তত করে, স্বীকার করেন যে তিনি জানতেন সে কথা।

‘তাহলে একথাও জেনেছিলেন বোধকরি, যে দেবদত্তের একটি দুষ্প্রাপ্য রত্ন গচ্ছিত ছিল আপনার স্বামীর কাছে?’

এর উত্তরে রেবা যা জানান তা কতক এইপ্রকার;-

দুর্ঘটনার তিন চার দিন আগে একদিন কর্মকক্ষে বিশেষ কোলাহল শুনে জর্তু রেবাকে সংবাদ দেয়, রেবা ব্যাপার জানতে কক্ষের অলিন্দ সংলগ্ন দরজার আড়ালে থেকে ঘটনা বোঝার চেষ্টা করেন। কক্ষের ভিতর শ্রেষ্ঠী দেবদত্তের সাথে রুচিপতির বিবাদ বেধেছিল একটি পদ্মিরাগমণির বিষয়ে, দেবদত্ত অত্যন্ত উত্তেজিত হয়ে পড়েছিলেন, প্রথমে শাসানি ও অবশেষে ক্রোধ বশে অভিশাপ দিয়েছিলেন যে, অন্যায় ভাবে কেড়ে নেওয়া রত্ন দূর্ভাগ্যের কারণ হবে। এই সময়, রেবার দেবর শচীপতিও উপস্থিত হন কক্ষে, ভ্রাতার সাথে দেখা করতে এসেছিলেন তিনি। তিনিই বহুকষ্টে দেবদত্তকে সংযত করে ফেরত পাঠান।

‘স্বামীকে অনুরোধ করেছিলাম রত্ন ফেরত দিতে, তিনি শোনেননি, রাগ করেছিলেন আমার উপর; দেবদত্তের অভিসম্পাত ফলে গেলো অবিলম্বেই’; যন্ত্রণায় কন্ঠস্বর রোধ হয়ে আসে, অশ্রুধারা ভিজিয়ে দেয় সদ্যবিধবার কপোল।

‘ভদ্র শচীপতি পৃথক গৃহে বাস করেন, এর কোনও বিশেষ কারণ আছে কি?

এই প্রসঙ্গে রেবা জানান যে তাঁর শ্বশুর মশায়ের মৃত্যুর পর থেকে দুই ভায়ের সম্পর্কে চিড় ধরে, মূলতঃ ব্যাবসা সংক্রান্ত কারণে। দুই ভ্রাতা স্বভাবে সম্পূর্ণ বিপরীত, রুচিপতি, অন্তর্মুখী ও তীক্ষ্ণ ব্যাবসায়বুদ্ধিসম্পন্ন; শচীপতি বিলাসী, বাস্তবজ্ঞানহীন ও মুক্তহস্ত। ফলে, মহাজনী ব্যাবসায়ে শচীপতির কারণে লোকসান দেখা দিতে থাকে প্রায়শই, এই নিয়ে কলহ ও অশান্তি লেগেই থাকত। অবশেষে শ্রেষ্ঠীর মাতা দেহ  রাখলে রুচিপতিই ভ্রাতাকে মূলধনের অর্ধেক ও একখানি আম্রকুঞ্জ বুঝিয়ে দিয়ে পৃথক করে দেন। সেই আম্রকুঞ্জ বিক্রয় করে পল্লীর মধ্যে নিজস্ব গৃহ নির্মাণ করেন শচীপতি। একত্রে থাকায় যে অশান্তি ঘটছিল, তা মিটে গিয়ে সৌহার্দ্য ফিরে আসে অচিরেই। শচীপতির সংসারে, পত্নী, দুই কন্যা ও এক পুত্র; রুচিপতি গৃহে তাদের আসা যাওয়া আছে নিয়মিত। শচীপতি প্রসঙ্গে আরো জানা যায় যে, তিনি এখন আর মহাজনী ব্যাবসা করেননা, তবে কিসের বাণিজ্য করেন রেবার সঠিক জানা নেই।

‘আপনার অনিদ্রা ব্যাধি কতকালের?’

‘জয়ন্তের জন্মকাল থেকেই এরকম অবস্থা, ওষধি ভিন্ন আমার চলেনা’। রেবার বক্তব্যে অসহায় ক্ষোভ প্রতিফলিত হয়, নবীন বয়সে এই ব্যাধি কত যন্ত্রণার অনুভব করেন দুই বন্ধু। এরপর রেবাকে কিছুটা সময় দিয়ে পুষ্পকেতু প্রসঙ্গান্তরে যান।

‘অঘটনের দিন শ্রেষ্ঠীকে আপনি শেষ কখন জীবিত অবস্থায় দেখেন?’

‘প্রাতঃরাশ সেরে কর্মকক্ষে যাওয়ার কালেই শেষ সাক্ষাৎ’; আবেগে কেঁপে যায় সদ্যবিধবার কন্ঠস্বর।

‘এরপর আপনি কি নিজকক্ষেই ছিলেন? জর্তু ও সুরভীর গতিবিধি সম্পর্কে কিছু বলতে পারবেন কি?’

‘সুরভী পাকশালেই ছিল সকাল থেকে, পরে বেলা বাড়লে তাকে বৈদ্যগৃহে পাঠাই। জর্তু বহির্গৃহের কাজ করে, আমার সাথে সাক্ষাৎ কমই হয় দিবাভাগে। তবে সেদিন জয়ন্ত দুগ্ধ পান করতে চাইছিল না, জর্তু বাগানে নিয়ে গিয়ে কন্দুক খেলার ছলে দুগ্ধপান করায় তাকে; কিছু পরে আমার দেবর  আসায়, গৃহমধ্যে ফিরে আপ্যায়নের  জল, পানীয় বয়ে নিয়ে আসে সে। পরে নিজের কাজে যায় জর্তু, আমার সাথে দেখা হয়নি আর।‘

‘শচীপতি এসেছিলেন সেদিন? তিনি কি আপনার সাথে সাক্ষাৎ করেই ফিরে যান, নাকি কর্মকক্ষেও গিয়েছিলেন?’

‘আমার কাছেই এসেছিলেন তিনি, কিছু সময় বাক্যালাপের পরে প্রস্থান করেন; কর্মকক্ষে যাননি’।

‘আপনি নিশ্চত হচ্ছেন কি ভাবে? ভ্রাতৃগৃহে এসে ভ্রাতার সাথে সাক্ষাৎ না করেই চলে যাওয়া স্বাভাবিক কি?’

‘অন্দর থেকে কর্মকক্ষে যেতে অলিন্দ হয়ে যেতে হয়, তিনি তা করেননি। তাছাড়া শ্বশুর্য আমার কাছেই এসেছিলেন।‘

‘কোনও বিশেষ প্রয়োজনে?’

‘কুশল খবর নিতেই এসেছিলেন, বিশেষ উদ্দেশ্যে নয়’; কথাকটি রেবা বেশ জোরের সঙ্গেই বলেন, বোঝা যায় এপ্রসঙ্গে অধিক আলোচনায় আগ্রহ নেই তাঁর।

‘কতসময় ছিলেন শচীপতি?’

‘স্থির বলতে পারিনা, তবে ছিলেন বেশ কিছু সময়’।

এরপর শ্রেষ্ঠানীর কাছে বিদায় নিয়ে, জর্তুর সাথে কর্মকক্ষের দিকে যান দুই মিত্র। কর্মকক্ষে ইতিমধ্যেই রাজ কর্মচারী দুজন জানালার কপাট উন্মুক্ত করেছেন, কক্ষটি উজ্জ্বল আলোয় পুরোনো ক্লেদ মুছে ঝলমলে। শুধু লেখন পিঠিকাটি ভয়াবহ দুর্ঘটনার মুক সাক্ষী হয়ে জেগে আছে দুঃসপ্নসম। পুষ্পকেতু সিন্দুকটির কপাট মোচন করেন সঙ্গের চাবী দিয়ে; সিন্দুকের একাংশে খাতকের বাঁধা রাখা সম্পত্তির সনন্দ সারিবদ্ধ করে রাখা, অন্যপাশে কয়েকটি থলিতে স্বর্ণমুদ্রা। এছাড়া, রয়েছে একখানি গহনার পেটিকা, সেটিতে তালযন্ত্র নেই, ভিতরে একরাশ বহুমূল্য অলঙ্কার, প্রত্যেকটির সাথে লালসুতা যুক্ত সুচপত্র, তাতে খাতকের নাম লেখা। সিন্দুকের নীচের অংশের সামনের দিকে একটি সুদৃশ্য ক্ষুদ্র পেটিকা, উন্মুক্ত অবস্থায় রাখা। তার ভিতরে রক্ষিত রয়েছে ছোট ছোট রেশমের থলিকায় মহামূল্য জহরাত, সেখানেও সুচপত্রে স্বত্বাধিকারীর নাম উল্লিখিত। এই পেটিকাটির কপাটে তালযন্ত্র রয়েছে, যদিও এইমূহুর্ত্তে সেটি খোলা। পুষ্পকেতু, কার্যালয় থেকে সংগৃহীত ক্ষুদ্র তল্লিকাটি এই পেটিকার তালযন্ত্রে প্রয়োগ করেন, তালযন্ত্র বন্ধ হয় অনায়াসে। এরপর, অতি মনযোগসহ প্রতিটি রত্ন সুচপত্রে লেখা নামের সাথে পরীক্ষা করেন পুষ্পকেতু; দেবদত্তের মণির সন্ধান মেলেনা সেখানে। সমগ্র সিন্দুকে খোঁজাখুঁজি চলে এরপর, দেবদত্তের পদ্মরাগ সেখানে নেই, উল্মুক ও সঙ্গী রাজকর্মচারী দুজন নিশ্চিত করেন সেকথা। এরপর রেবার কছে সংবাদ নিয়ে জানা যায় গৃহমধ্যে কোনও সিন্দুক নেই, আছে একখানি শাককাষ্ঠের মজবুত পেটিকা, সেটির তল্লিকা থাকে শ্রেষ্ঠানীর কাছেই। পুষ্পকেতুর অনুরোধে পেটিকাটি খোলা হয় সর্বসমক্ষে, সেখানে কিছু রৌপ্যমুদ্রা ও রেবার গহনার পেটিকা ভিন্ন আর কিছুর সন্ধান মেলে না।

এরপর কর্মকক্ষ আবার অর্গলবদ্ধ করে কার্যালয়ে ফেরেন পুষ্পকেতু ও উল্মুক; ইতিমধ্যে রাজকর্মচারী দ্বারা শচীপতির কাছে সংবাদ যায় কার্যালয়ে উপস্থিত হতে। পরিস্থিতি জটিল, জরুরী আলোচনা বসে বিশাখগুপ্তের সাথে, উপস্থিত থাকেন সেখানে ভদ্র চিত্রকও।

‘রত্নটি যে চুরি গিয়েছে এবিষয়ে সন্দেহ নেই; হত্যাকারী পরিচিত ব্যাক্তি এবং এমন কেউ যে রত্নের বিষয়ে জড়িত। তার সম্মুখে রুচিপতি সিন্দুক খুলে মণিটি বাক্স থেকে বের করে আবার সিন্দুক লাগিয়ে চাবি কোষবদ্ধ করে, তারপর লেখন পিঠিকায় একটি রেশমপট্ট বিছিয়ে সেখানে রত্নটি রাখার উদ্যোগ করছে; সেসময় দিনপঞ্জি দেখার অছিলায় আততায়ী তাঁর পিছনে দিকে যায় ও চৈনিক খঞ্জর কোষমুক্ত করে তাঁকে আঘাত করে সর্বশক্তি দিয়ে। রত্ন কিছুক্ষণের মধ্যে আবার সিন্দুকে ফেরত রাখার ইচ্ছা নিয়েই বের করেছিল রুচিপতি, সেকারণেই রত্নের বাক্সটিতে তল্লিকা লাগায়নি; তবে আততায়ী তাঁকে সে সুযোগ আর দেয়নি‘ পুষ্পকেতু আলোচনা শুরু করেন।

‘সেক্ষেত্রে অপরাধী দেবদত্ত এবিষয়ে কোনও সন্দেহ থাকে কি?’ বিশাখগুপ্ত মন্তব্য করেন।

‘ঘটনা বিশ্লেষনে সে ধারণাই দৃঢ়বদ্ধ হয়। মণি ফেরত পেতে সে মরীয়া হয়ে উঠেছিল। তাছাড়া, হত্যার দিনে রুচিপতির সাথে তার সাক্ষাৎপর্বে কি এমন ঘটেছিল যে বৈশ্যসমিতিতে না গিয়ে সে গৃহে ফিরে গেলো?’ পুষ্পকেতু যুক্তি দেন।

‘হত্যাকারী নিঃসন্দেহে একজন সমর্থ যুবাপুরুষ, নিহতের পরিচিতও বটে’, ভদ্র চিত্রক সমর্থনে মন্তব্য করেন।

‘শুধু একটি বিষয়ে কিছু অস্পষ্টতা রয়ে যাচ্ছে’; হত্যার পশ্চাতে মূল দ্বার দিয়ে প্রস্থান করলেন কেন দেবদত্ত? দ্বিতীয় পথে গেলে লোকচক্ষে আসার সম্ভাবনা অনেক কমে যেত না কি?’

‘কেতু একথা মনে রেখো, দেবদত্ত বণিক, ক্ষত্রিয় নয়, হত্যা, রক্তপাত তার ধমনীতে নেই। সে যা করেছে, তা আক্রোশ বশে ও তাৎক্ষণিক আবেগে, ফলে হত্যার পরে বিচলিত হয়ে পড়াই তার পক্ষে স্বাভাবিক; সেক্ষেত্রে গোপনীয়তা রক্ষার চিন্তা মনে আসবে কিরূপে? সবদিক বিচার করে দেবদত্তকে কারাবদ্ধ করাই যুক্তিযুক্ত। ভদ্র চিত্রক আপনি দেবদত্তের গৃহে রত্ন অনুসন্ধনের ব্যাবস্থা করুন; অবশ্য, রত্ন না পাওয়া গেলেও আশ্চর্যের কিছু নেই, শ্রেষ্ঠী সেটি সরিয়ে ফেলেও থাকতে পারেন অন্যত্র।‘

দেবদত্তকে কারারোধের আদেশ দিয়ে সভাভঙ্গ করেন বিশাখগুপ্ত। কিছুপরে, এক রক্ষী এসে সংবাদ দেয় শচীপতিকে তাঁর গৃহে পাওয়া যায়নি; তিনি এমূহুর্তে কোথায়, গৃহস্বামীণি জানেননা; অতঃপর দন্ডকারিক কার্যালয়ে সাক্ষাতের শমণ শ্রেষ্ঠানীর কাছেই দিয়ে এসেছে কার্যালয়কর্মী।

***

দেবদত্ত কারারূদ্ধ হয়ে সম্পূর্ণ ভেঙ্গে পড়েন, কিন্তু বারে বারে অস্বীকার করতে থাকেন হত্যার অপরাধ; তাঁর গৃহে অনুসন্ধান চালিয়ে রত্নের হদিশ মেলেনা। বিচারের দিন ধার্য হয় ঠিক আট দিন পরে আগামী শুক্লাএকাদশী তিথিতে।

পরের দিন বন্দর সংলগ্ন একটি শুন্ডালয়ে শচীপতিকে আবিষ্কার করে দন্ডাধিকারিকের কার্যালায়ে নিয়ে আসে কয়েকজন রাজকর্মচারী। কর্মচারীদের বক্তব্য থেকে পুরো ঘটনাটি জানা যায় এরপরে। শচীপতি ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী, বন্দরে আগত বাণিজ্যতরী থেকে বিভিন্ন সৌখিন পণ্য সংগ্রহ করে বিত্তবান ব্যাক্তিদের কাছে সুমূল্যে বিক্রয় করা তাঁর পেশা; আমোদপ্রিয় ও সদালাপী স্বভাবের কারণে নগরের বর্ধিষ্ণু গৃহের বিলাসী যুবাপুরুষদের সাথে তাঁর হৃদ্যতা আছে, ব্যাবসায়ে তা সহায়ক হয়েছে। তবে সুরা ও দ্যুতক্রীড়ায় আসক্তির কারণে তাঁর অর্থাভাব লেগেই থাকে, বিগত কয়েক বছরে বেশ কয়েকবার শুভাকাঙ্ক্ষীদের হস্তক্ষেপে কর্জসংক্রান্ত কলহ থেকে মুক্তি পেয়েছেন শচীপতি। বন্দর সংলগ্ন শুন্ডালয়টিতে শচীপতির নিয়মিত যাতায়াত, সেখানে অক্ষক্রীড়ার বন্দোবস্ত আছে; মূলতঃ বিদেশী বণিকদেরই সভা বসে সে অক্ষসভায়। সম্প্রতি, উপর্যুপরি অক্ষক্রীড়ায় পর্যুদস্ত হয়ে শুন্ডপতি জটায়ুর কাছে ঋণগ্রস্ত হয়ে পড়েছেন শ্রেষ্ঠী, দ্যুতক্রীড়ায় মূল্য বাকি রাখা চলেনা, তবুও নিয়মিত গ্রাহক এই কারণে এতদিন নীরব ছিল সে, কিন্তু গতকাল অবস্থা চরমে পৌঁছয় এবং বাদ বিবাদে ক্রুদ্ধ জটায়ু দন্ডাধিকারিকের কাছে অভিযোগ জানানোর সিদ্ধান্ত নেয়। এ অবস্থায়, বন্দরে নিযুক্ত আধিকারিক জানতে পারেন বিষয়টি এবং তারপর দণ্ডাধিকারিকের কার্যালয়ে জটায়ু ও শচীপতি দুইজনকেই আনা হয়।

‘শ্রেষ্ঠীর বিরুদ্ধে কিসের অভিযোগ তোমার?’ জিজ্ঞাসাবাদ শুরু হয় জটায়ুকে দিয়েই, প্রশ্ন করেন পুষ্পকেতু।

‘শচীপতি অক্ষক্রীড়ায় আসক্ত, তবে নিজ ক্ষমতা অনুযায়ী ক্ষুদ্রপণেই খেলত সে। কিন্তু, অর্ধপক্ষকাল পূর্বে সন্ধ্যাকালে যথারীতি পানশালায় এসে আমার কাছে বড় মূল্য কর্জ চাইল; বৃহৎ পণে ভাগ্যপরীক্ষা করবে এমন ইচ্ছা তার। আমি প্রথমে ইতিস্তত করি, তার উপার্জন সীমিত একথা আমার অজানা নয়। তখন শচীপতি বলে, তার ভাগ্যপরিবর্তন ঘটেছে, বর্ধিষ্ণু ভ্রাতার কাছ থেকে বেশ কিছু অর্থপ্রাপ্তি হতে চলেছে দু-এক দিনেই। এরপর তাকে অর্থ দিতে দ্বিধা করিনি, আমার বহুকালের গ্রাহক সে।‘

‘শুধুমাত্র মুখের কথায় কর্জ দিলেন?’

‘হ্যাঁ দিলাম; সে দ্যুত ও মদ্যে আসক্ত, বেহিসেবি, শ্রমবিমুখ, কিন্তু ভদ্রব্যাক্তি, অন্তত এতদিন তাই জানতাম।‘

‘ভুল ভাঙ্গল কিসে?’

‘গত কয়েকদিবসে আমার শুন্ডালয়ে আকন্ঠ মদ্যপান করেছে শচীপতি, কর্জশোধের কথা বলতে গেলে কেবলি ক্রন্দন; শেষে জানায়, ভ্রাতার মৃত্য ঘটেছে, এখন মূল্যপরিশোধ অসম্ভব, কিছুকাল আরো সময় চাই। তাতেই ধৈর্য্যচ্যুতি ঘটে আমার, ধার বাকীতে কারবার চলেনা আমাদের, কর্জ পরিশোধের সময় এলে গ্রাহকের এসকল অজুহাত অনেক দেখেছি এর আগে। অতঃপর, দন্ডাধিকারিকের কাছে অভিযোগ জানানোই উচিৎ মনে হয়।‘

এরপর, উপযুক্ত বিচারের আশ্বাস দিয়ে জটায়ুকে ফেরত পাঠানো হয়। শচীপতির সাথে একান্তে বাক্যালাপের অনুমতি নিয়ে, তাঁকে পৃথক কক্ষে জিজ্ঞাসাবাদ শুরু করেন পুষ্পকেতু।

‘শ্রেষ্ঠী রুচিপতির সাথে আপনার শেষ কবে দেখা হয়েছিল?’

‘ভ্রাতার মৃত্যুর দিন দশেক আগে’, একটু ভেবে উত্তর দেন শচীপতি।

‘শ্রেষ্ঠীর মৃত্যুর দিবসে সাক্ষাৎ করেননি তাঁর সাথে?’

‘না তো!’ বিস্মিত শোনায় শচীপতির কন্ঠস্বর।

‘কেন?’

‘মানে?’

‘জানতে চাইছি, ভ্রাতৃগৃহে গেলেন অথচ ভ্রাতার সাথে সাক্ষাৎ করলেন না কেন? এটা কি স্বাভাবিক?’

‘আমি গিয়েছিলাম ভাতৃবধূর কাছে, ভ্রাতার কাছে কিছু অর্থ পাবার আশায়। আমার অপেক্ষা, ভাতৃবধূর অনুরোধে বেশী কাজ হবে, এমনটাই ভেবেছিলাম’।

‘জটায়ুকে যে অর্থপ্রাপ্তির ইঙ্গিত দিয়েছিলেন অর্ধপক্ষকাল পূর্বে, সে কি মিথ্যাচার ছিল?’

এর উত্তরে শচীপতি নীরব থাকেন, স্পষ্ট হয় বলার মত কিছু নেই তাঁর।

‘ভ্রাতার মৃত্যুর দিনে আপনার গতিবিধি বর্ণনা করুন’।

‘সেদিন ভাতৃবধূর সাথে সাক্ষাতের পরে বন্দরে যাই পণ্যসংক্রান্ত সংবাদ সংগ্রহের উদ্দেশ্যে, এরপর জটায়ুর পানশালায় যাই। অপরাহ্নকালে জর্তু কয়েকজন সঙ্গী সহ সেখানে উপস্থিত হয় দুঃসংবাদ নিয়ে। তখন তার সাথে শ্মশানে যাই দেহসৎকার করতে।‘

‘দিনের বেলা পানশালায় যাবার কারণ জানতে পারি কি?’

‘সেখানে এক বিশিষ্ট গ্রাহকের উপস্থিতি আশা করছিলাম, সেকারণেই যাওয়া।‘

‘ভদ্রা রেবা আপনাকে মধ্যাহ্ন ভোজনের অনুরোধ করেছিলেন, কিন্তু আপনি আহার না করেই বিদায় নিলেন কেন?’

‘বিশেষ কাজ ছিল বন্দরে, বলেছি আপনাকে; আহারে বসলে বিলম্ব ঘটত।‘

‘কাজ আছে একথা বোধকরি আগে স্মরণ ছিল না? নতুবা, শ্রেষ্ঠানী আপনার আহারের ব্যাবস্থায় নতুন করে ব্যাঞ্জন রান্নার নির্দেশ দিতেন না!’

পুষ্পকেতুর প্রশ্নবানে অস্বচ্ছন্দ দেখায় শচীপতিকে। তাকে আপাততঃ গৃহের বাইরে না যাবার নির্দেশ দিয়ে বিদায় দেন কুমার।

***

ভাদ্রের মেঘলা দ্বিপ্রহরে, জানালার পাশে একলা দাঁড়িয়ে পুষ্পকেতু, কপালে চিন্তার ভাঁজ, বাদল দিনের বিষন্নতা যেন ছায়া ফেলেছে তাঁর সুকুমার মুখে।

‘কি ভাবছেন কেতু? মন ভালো নেই?’ নিঃশব্দে কখন কক্ষে প্রবেশ করেছেন সুগন্ধা, জানতে পারেননা কুমার।

‘কিছু না।‘

‘শ্রেষ্ঠীর হত্যারহস্য নিয়ে ধ্বন্দ কাটেনি বুঝি?’

‘যুক্তির বিচারে হৃদয় সায় দিচ্ছেনা দেবী‘; দীর্ঘশ্বাস ফেলেন কেতু।

‘আপনি মহতপ্রাণ, ন্যায় নীতির শাসনে হৃদয়বত্তাকে বিসর্জন দেননি; শ্রীপদ্মনাভ আপনার সহায় হোন।‘

***

‘ভদ্রে, আমি আপনার সাহায্যপ্রার্থী, দয়া করে নিঃসংকোচে শচীপতির বিষয়ে সব কথা আমাকে বলুন; হত্যার দিন তার আসার সত্যকার কারণ কি ছিল সেকথা জানা একান্ত প্রয়োজন।‘ রেবার বহির্কক্ষে তাঁর সাথে একান্ত সাক্ষাতে অনুরোধ জানান পুষ্পকেতু পরেরদিন।

কিছুক্ষণ নীরব থেকে বক্তব্য শুরু করেন রেবা, তার গলার স্বর বুঝিবা কেঁপে ওঠে একটু।

‘শচীপতিকে নিয়ে সংসারে অশান্তি অনেককালের, আগেই বলেছি আপনাকে; তবে অশান্তির কারণ শুধুই অর্থসংক্রান্ত নয়। রূপবান, স্বাস্থ্যবান, আমোদপ্রিয় দেবর আমার কোপনস্বভাব স্বামীর থেকে অনেকবেশী জনপ্রিয় ছিলেন চিরকালই, পিতা মাতারও পক্ষপাতিত্ব ছিল তাঁর প্রতি; এর ফলে স্বামী তাঁকে ঈর্ষা করতেন। এমনকি, বিবাহের পর আমার সাথে তাঁর সখ্যতাও ভালো চোখে দেখেননি তিনি। শ্বাশুড়ির মৃত্যুতে অবস্থা চরমে উঠল, তখন আমার দ্বিতীয়পুত্র জয়ন্ত গর্ভে; পুত্রের পিতৃত্ব নিয়ে পর্যন্ত সন্দেহ প্রকাশ করেন স্বামী। লজ্জায় আত্মাহুতি দেব মনস্থ করেছিলাম;  কিন্তু তার পূর্বে, শুধুমাত্র আমার সম্মানার্থে দেবর নিজ সংসার নিয়ে পৃথকান্ন হন, সম্পত্তিতে লোকসান স্বীকার করেও। আমাদের স্বামীস্ত্রীর সম্পর্ক এরপরে আর জোড়া লাগেনি, আমার অনিদ্রা রোগের শুরুও তখন থেকেই। শ্রেষ্ঠী স্বর্গত হয়েছেন, তবু বলব, তিনি সদাশয় ব্যক্তি ছিলেননা; নিজের ভ্রাতাকে বঞ্চিত করেছিলেন, ভদ্র দেবদত্তের সাথেও অন্যায় করেছিলেন। যেদিন ভদ্র দেবদত্তের সাথে তাঁর কলহ বাধে, শচীপতি এসেছিলেন কিছু অর্থের প্রত্যাশায়; দেবদত্তের রোষ থেকে তিনিই সামলান সেদিন স্বামীকে। শ্রেষ্ঠী ধূর্ত হলেও সাহসী ছিলেননা, দেবদত্তের তর্জনে বিলক্ষণ ভয় পেয়েছিলেন, অথচ নামমাত্র মূল্যে পাওয়া দুর্লভ রত্নের লোভও ছাড়তে পারছিলেন না। রত্নবিক্রয়ে লাভের অংশ দেবার আশ্বাস দিয়ে দেবরকে তিনি রাজী করান যাতে দেবর নিজের অনুচরদের দিয়ে দেবদত্তকে ভয় দেখিয়ে রত্নের আশা ত্যাগ করতে বাধ্য করেন। দুর্ঘটনার দিন, শচীপতি আমার কাছে এসেছিলেন মনি বিক্রয় হয়েছে কিনা সংবাদ নিতে, আমি সেব্যাপারে কিছু জানতাম না, তাছাড়া ওঁকে এসবের মধ্যে না জড়াতে অনুরোধ করি আমি। আমার সাথে এই নিয়ে কিছু তর্কালাপ হয়, এরপর জয়ন্তকে নিয়ে কিছুক্ষণ ব্যাস্ত হয়ে পড়ি, সেই সময়ে আমাকে কিছু না জানিয়ে মধ্যাহ্ন ভোজন না করেই চলে যান তিনি।‘

***

জটায়ুকে পুনর্বার ডেকে পাঠান পুষ্পকেতু সেদিন অপরাহ্নে।

‘রুচিপতির মৃত্যুর দিবসে শচীপতি এসেছিলেন আপনার পানশালায়?’

‘এসেছিলেন আর্য। দিবাকালেই পানশালায় এসে সুরাপান শুরু করেন তিনি; ছিন্নবসন, বিশ্রস্ত কেশ, বিহ্বল চোখের দৃষ্টি; শ্রেষ্ঠী সৌখিন ব্যক্তি, তাই অবাক হই আমি। এরকম অবস্থার কারণ জিজ্ঞাসা করলে সঠিক কিছু জবাব দেননি তখন, ভেবেছিলাম হয়তো কর্জসংক্রান্ত বিবাদে জড়িয়ে পরেছিলেন কারো সাথে। পরে অপরাহ্নকালে কয়েকজন এসে ভ্রাতার মৃত্যসংবাদ দিয়ে ডেকে নিয়ে যান তাঁকে।‘

‘ছিন্ন বসন? শ্রেষ্ঠীর সেদিনকার পরিচ্ছদের বর্ণনা দিতে পারেন ভদ্র?’

‘আমার পানশালায় প্রতিদিন কতলোকের আনাগোনা, পরিচ্ছদের সঠিক বর্ণনা দেই কিরূপে?’

চিন্তিত মুখে জটায়ুকে বিদায় দেন পুষ্পকেতু; তাঁর চোখের দৃষ্টিতে বিভ্রান্তি।

***

কারাকক্ষটি চাপ চাপ অন্ধকারে রহস্যময়, বহু উচ্চে ক্ষুদ্র গরাদ বেয়ে নেমে আসা শেষ বিকেলের আলো তার সাথে যুক্ত করেছে আশাহীন বিষন্নতা। পাষাণশীতল মেঝেতে প্রস্তরমুর্তির মত বসে আছেন শ্রেষ্ঠী দেবদত্ত; নিষ্ঠুর পারিপার্শিকতা, অন্তহীন নিস্তব্ধতা কিছুই যেন ছুঁতে পারেনা তাঁকে আর; ভবিতব্যের কাছে আত্মসমর্পন করেছেন তিনি চরম নির্লিপ্ততায়।

কিছুপরে, প্রকোষ্ঠের কবাট খোলার শব্দে চোখ তুলে তাকান দেবদত্ত, বাইরের আলোর প্রেক্ষাপটে দরজার সমুখে দেখা দেন এক ছায়ামূর্তি, ক্ষমাসুন্দর মোহনরূপে; একি বাস্তব না বিভ্রম!

‘হতোদ্যম হবেননা ভদ্র, আপনার নির্দোষিতা প্রমাণ হবে’, পুষ্পকেতুর মন্দ্রস্বর দৈববাণীর মতই ঘোষিত হয় কারাকক্ষে।

‘কে প্রমাণ করবে?’ হতাশার হাহাকার জেগে ওঠে দেবদত্তের কন্ঠস্বরে।

‘আমি; আস্থা রাখুন ভদ্র। শুধু একটি প্রশ্নের সঠিক উত্তর দিন, রুচিপতিকে সেদিন জীবিত দেখেছিলেন কি তাঁর কর্মকক্ষে?’

‘আজ পর্যন্ত আপনার কাছে একটি মাত্র অসত্য ভাষণ করেছিলাম, ভয় ছিল সত্য কেউ বিশ্বাস করবে না; আজ আর কিছু আসে যায়না। রুচিপতির কর্মকক্ষে সেদিন আবেগতাড়িত হয়ে গিয়ে পড়েছিলাম, কিংবা হয়তো নিয়তি টেনে নিয়ে গিয়েছিল, কে বলতে পারে। কক্ষে প্রবেশ করে তাকে ছুরিকাবিদ্ধ হয়ে পড়ে থাকতে দেখি, মৃত্যু গ্রাস করেছিল তার প্রাণ বেশ কিছু আগেই বুঝতে অসুবিধা হয়নি। সে দৃশ্য দেখে ভয়ে আমার বুদ্ধিবৃত্তি লোপ পায়, দিগবিদিক জ্ঞানশূন্য হয়ে ছুটে বেরিয়ে যাই তার গৃহ থেকে সর্বনাশ এড়াতে।‘

‘আমার প্রাণ থাকতে, অন্যের অপরাধের শাস্তি আপনাকে নিতে হবে না, কথা দিলাম’।

‘তবে আমিও কথা দিলাম আর্য, মুক্তির বিনিময়ে আপনাকে অদেয় আমার কিছু থাকবে না, তা সে যদি নিজ প্রাণের মূল্যেও হয়’।

***

বেশ কয়েকদিন বর্ষনের পরে এক রোদঝলমলে দিনে ঋতু পরিবর্তনের আভাস মনকে প্রসন্ন করে, পথপার্শ্বে জেগে ওঠা শুভ্র কাশক ফুল বয়ে আনে সুদিনের আশ্বাস। পুষ্পকেতু অশ্বপৃষ্ঠে অন্যমনস্ক নিজস্ব চিন্তায়, সঙ্গী উল্মুক কাব্য করে ওঠেন পাশ থেকে, সুনীল আকাশ আর কাশক ফুলে ঢেউতোলা দখিনা বাতাস তাঁকে মাতিয়েছে আসন্ন নবান্ন উৎসবের আমেজে।

রুচিপতির গৃহে আগ থেকে সংবাদ না দিয়েই উপস্থিত হয়েছেন দুই মিত্র, প্রয়োজন জরুরী। গৃহের অঙ্গনে দুগ্ধপান উপলক্ষে মাতাপুত্রের কপট কলহ বৃন্দাবনের নন্দগৃহের কথা মনে পড়ায়; পুষ্পকেতু বিঘ্ন ঘটাতে ইতস্তত করেন।

‘আর্য আপনি, এসময়ে?’ পদশব্দ পেয়ে নিজেই সম্বোধন করেন রেবা।‘

‘ঘটনার আকস্মিকতায় আসতে হোল এভাবে, আমি মার্জনা প্রার্থী’।

‘অন্দরে আসুন কুমার, আমি জর্তুকে আহ্বান করছি’।

‘তার কোনও প্রয়োজন নেই ভদ্রে, বক্তব্য সামান্যই, এখানেই বলা চলে।‘

‘বলুন কি জানতে চান?’

‘দুর্ঘটনার দিনে শচীপতি ঠিক কখন প্রস্থান করেন, সেকথা জানা প্রয়োজন’।

‘আমরা বহির্কক্ষে বসে কথা বলছিলাম, জর্তু রেখে গেছে শীতল তক্র কিছু আগে, আমি রসবতীতে গিয়ে সুরভীকে মৎস্য অন্ডের রসাম্ল বানাতে নির্দেশ দেই আর সেই সাথে কিছু মিষ্টান্ন নিয়ে আসি শ্বশুর্যের জন্যে। আমাদের মধ্যে কিছু তর্কালাপ চলছিল মণিসংক্রান্ত বিষয়ে; অর্থের জন্য তিনি মরীয়া, তাই আমার উপদেশ মানতে নারাজ ছিলেন। এসময়ে, জয়ন্ত অঙ্গন থেকে কাদা মেখে কক্ষে প্রবেশ করে; তার এ এক নতুন দুষ্টামি; আমি তখন তাকে নিয়ে কিছু সময়ের জন্য স্নানাগারে যাই পরিচ্ছন্ন করাতে, ফিরে এসে দেখি কক্ষ শূণ্য, শ্বশুর্য বিদায় নিয়েছেন’।

‘ব্যাঘ্র তাতঃ কর্দম মেখেছিলেন, তাই আমিও’; মুচকি হেসে মন্তব্য করে ছোট্ট জয়ন্ত, আত্মপক্ষ সমর্থনে। মাতার আরোপ মানতে নারাজ সে বোঝা যায়।

‘ফের দুষ্টামি? মিথ্যাচার কোরনা জয়ন্ত!’ তিরস্কার করে ওঠেন রেবা।

‘ব্যাঘ্র তাতঃ কে?’

‘শ্রেষ্ঠী বিষ্ণুদত্ত আমাদের অগ্রজের মত, তিনি একটি রূপার তৈরী ব্যাঘ্র উপহার দিয়েছিলেন জয়ন্তকে, তাতেই এই সম্বোধন’; হেসে বলেন রেবা।

‘আপনাকে, আর একটিই প্রশ্ন করার আছে ভদ্রে, সেইদিন শচীপতি কি রঙের উত্তরীয় ধারণ করেছিলেন? একটু ভেবে উত্তর দেবেন, আপনার কথার উপর একটি প্রাণ নির্ভর করছে’।

‘তিনি হালকা পীতবর্ণের রেশমী উত্তরীয় পরেছিলেন আর্য’, কথাকটি বলতে গিয়ে রেবার মুখ রক্তশূন্য দেখায়, বুঝিবা কোনও সর্বনাশের আশঙ্কায়।

***

‘এখন কি শচীপতি গৃহে?’ উল্মুক প্রশ্ন করেন রুচিপতির গৃহ থেকে নিষ্ক্রমনের পরে। কয়েকজন দন্ডালয় কর্মী পুষ্পকেতুর নির্দেশের অপেক্ষায় কাছেই দাঁড়িয়ে ছিলেন।

‘তার আগে একটি ছোট্ট প্রয়োজন আছে শ্রেষ্ঠী ভবভূতির সাথে, এটুকু পথ পায়ে হেঁটেই  যাই চল’। পুষ্পকেতু উত্তর দেন।

শ্রেষ্ঠী ভবভূতি গৃহে ছিলেন, এত সকালে অনাহূত অতিথিদের দেখে অবাক হলেও, আপ্যায়নে ত্রুটি রাখেননা।

‘অযথা আপনার সময় নেব না ভদ্র, গুটিকয়েক কথা ছিল শুধু। রুচিপতি হত্যার দিনে, আপনি তাঁকে জীবিত দেখেছিলেন?’

‘আমি তাঁকে জীবিত দেখিনি, তবে কথোপকথন শুনেছিলাম; বেঁচে থাকার প্রমাণ হিসাবে সেটাই তো যথেষ্ট’।

‘এক্ষেত্রে যথেষ্ট নয়। আপনি নিজে বাক্যালাপ করেছিলেন কি? একটু বিশদে বলুন’।

‘সেদিন একসাথে বণিক সমিতিতে যাব স্থির ছিল, আমি সেই উদ্দেশ্যে বিষ্ণুদত্তের গৃহে যাই। এরপর অশ্বশকট প্রস্তুত হলে, রুচিপতির গৃহের সামনে উপস্থিত হই। বিষ্ণুদত্ত তাঁকে ডাকতে যান, আমি শকট থেকে নামিনি, তবে বিষ্ণূদত্ত যখন কর্মকক্ষের জানালা দিয়ে তাঁর সাথে বাক্যালাপ করেন, আমি সকলই শুনতে পাই।‘

‘বাক্যালাপে, বিষ্ণুদত্তের স্বর শুনতে পান, নাকি রুচিপতির উত্তরও? অঙ্গনদ্বার থেকে অতদূরে সকল কথা স্পষ্ট শোনা সম্ভবপর কি?’

‘না, কেবল বিষ্ণুদত্তের কন্ঠস্বর শুনেছিলাম, বাক্যালাপের মর্মোদ্ধার করা অতদূর থেকে সম্ভব ছিলনা। তবে দেখে বোঝা যাচ্ছিল যে বিষ্ণুদত্ত কক্ষস্থ ব্যক্তির সাথে বাক্যালাপ করছেন’; খানিক চিন্তা করে বিব্রত ভাবে উত্তর দেন ভবভূতি।

এরপরে, অতিদ্রূত ঘটে যায় কয়েকটি ঘটনা।

শচীপতির গৃহে গিয়ে তাঁকে আরও একবার  দুর্ঘটনার দিন রুচিপতির সাথে সাক্ষাতের বিষয়ে প্রশ্নকরা হয়, আর জানানো হয়, তাঁর বস্ত্রখন্ড পাওয়া গেছে ঘটনাস্থলে। উত্তরে তিনি স্বীকার করেন কর্মকক্ষে যাবার কথা, সাথে একথাও জানান যে রুচিপতিকে ছুরিকাবিদ্ধ দেখে ভয় পেয়ে পলায়ন করেছিলেন তিনি।

জয়ন্তকে আলাদা করে প্রশ্ন করেন পুষ্পকেতু নিজে, উত্তরে সে জানায় প্রভাতে দুগ্ধপান করার পরে কন্দুক নিয়ে খেলছিল বাগানে, কন্দুকটি কুড়োতে পনসবৃক্ষের আড়ালে গিয়েছিল সে, তখন দেখে তার ব্যাঘ্রতাতঃ কর্মকক্ষ থেকে বের হয়ে বস্ত্রে কর্দম মেখে দ্রুত প্রস্থান করলেন ছোট অঙ্গনদ্বার দিয়ে। তাঁকে দেখে তারো ইচ্ছা হয় কর্দম লিপ্ত হতে, ফলে সেও কর্দম মাখে।

বিষ্ণুদত্তের গৃহসেবককে প্রশ্ন করে জানা যায়, গৃহস্বামী প্রতিদিনের মত প্রাতঃভ্রমণে বেরিয়ে যখন ফেরেন, তাঁর বস্ত্রে কাদা লেগে ছিল, পথিমধ্যে ভূপতিত হয়ে এমন হয়েছে তিনি জানিয়েছিলেন।

‘এরপরেও আর কিছু বলার থাকে কি শ্রেষ্ঠীবর?’ বিষ্ণুদত্তের মুখোমুখি হন পুষ্পকেতু।

‘এক অবোধ বালক আর তুচ্ছ দাসের কথার ভিত্তিতে আমার বিরূদ্ধে অভিযোগ আনবেন কুমার? বণিক সমিতি এই অনাচার মেনে নেবে বলে মনে করেন আপনি?’

‘মণিটি খুঁজে পেতে আমাদের বিশেষ সময় লাগবেনা ভদ্র, ততক্ষণ নাহয় ধৈর্য রাখুন।‘

এরপর দন্ডালয় কর্মীদের পুঙ্খানুপুঙ্খ তল্লাসীতে, একটি সিন্দুকের চোরাকুঠুরী থেকে উদ্ধার হয় সেই মহার্ঘ্য পদ্মরাগমণি; দেবদত্তকে দিয়ে সনাক্ত করানো হয় সে রত্ন। অতঃপর সব দোষ স্বীকার করে আত্মসমর্পন করেন বিষ্ণুদত্ত।

‘গোলাপী বর্ণ, বিদ্যুৎচ্ছটা, সম্পূর্ণ নিদাগ, এমন উৎকৃষ্ট পদ্মরাগ পূর্বে দেখিনি আমি; রুচিপতি মূল্যপরীক্ষার জন্য দেখাল যখন লুব্ধ হয়েছিলাম। সে মণিটি বাজেয়াপ্ত করার পর, আমি কিনতে চেয়েছিলাম উচ্চমূল্যে, বলেছিলাম, এই দেবদূর্ল্ভ রত্ন সে বিক্রয় করতে পারবেনা, আমি রত্নব্যাপারী, আমি পারব। কিন্তু, শুনল না রুচিপতি; বোধহয় মোহে পড়ে গিয়েছিল মণিটির, কি অসম্ভব আকর্ষণ শক্তি ওই একটুকরো পাথরের, আমিও অনুভব করেছি। বেশ কয়েকদিন চিন্তা করে হত্যার পরিকল্পনা করলাম, তখন রত্নলাভের আশায় আমার উন্মাদপ্রায় দশা। ঐদিন প্রভাতে রোজকার মত ভ্রমণে বের হই, কিন্তু সকলের অলক্ষ্যে ছোট অঙ্গনদ্বার দিয়ে রুচিপতির কক্ষে যাই। সে তখন সবে হিসাব নিয়ে বসেছে, বললাম, মণিটি একবার দেখাও, দেবদত্ত বলে বেড়াচ্ছে মণিতে খুঁত আছে; একবার পরীক্ষা করি। সে সিন্দুক খুলে মণিটি বের করে লেখন পিঠিকায় রেশমপট্টের উপর সেটি রাখার উদ্যোগ করছে; আমি দিনপঞ্জি দেখার অছিলায় তার পিছনে গিয়ে, চৈনিক খঞ্জর বের করে তাকে আঘাত করি। এরপরে, মণিটি থলিকায় ভরে সাথে নিয়ে বেরিয়ে যাই, অঙ্গনের কর্দম বসনে লাগাই রক্তছিটা ঢাকতে। দেবদত্ত ঠিকই বলেছিল, মণির অভিশাপ রুচিপতি কেও ছাড়েনি, আমাকেও ছাড়ল না’। ধীরে ধীরে নিজ বয়ান সমাপ্ত করেন বিষ্ণুদত্ত দণ্ডাধিকারিকের সভাগৃহে।

***

‘আইনত পদ্মরাগটি এখন আপনার, কার্যালয় থেকে প্রত্যার্পন করা হবে আপনাকে ভদ্রে’, বিচার শেষ হয়েছে বিষ্ণুদত্তের, প্রাণদন্ডের আদেশ হয়েছে তার বিচারসভায়। পুষ্পকেতু এসেছেন শ্রেষ্ঠানীর সাথে সাক্ষাৎ করতে।

‘ধর্মতঃ এই মণি শ্রেষ্ঠী দেবদত্তের, তাঁকেই ফেরত দেবেন আর্য। আমি ওঁর কাছে করজোরে ক্ষমা চাইছি আমার স্বামীর বিশ্বাসঘাতকতার জন্য, বলবেন পারলে স্বামীকে ক্ষমা করতে; হয়তো তাতে তাঁর স্বর্গলাভ হবে‘; দুফোটা অশ্রু গড়িয়ে পড়ে রেবার চোখের কোল বেয়ে।

‘আপনার স্বামীর কর্মকক্ষটি আমরা খুলে দিয়েছি, আপনি ব্যাবহার করতে পারেন এখন।‘

‘হ্যা, প্রয়োজন হবে, শ্বশুর্য বসবেন এখন থেকে সেখানে, পৈতৃক ব্যাবসায় তিনিই দেখবেন যে।‘

‘কিন্তু, তিনি অস্থিরমতি, পারবেন কি?’

‘আমার আস্থা আছে, সুযোগ পেলে নিশ্চয়ই পারবেন। আমি জ্যেষ্ঠা ভগিনীসমা, আমার পদস্পর্শ করে শপথ নিয়েছেন শুন্ডালয়ে আর যাবেন না’।

‘মঙ্গল হোক আপনাদের; শুভমস্তু।‘

***

অপরাহ্নকাল, নিজের কক্ষে বীণার তারে সুর তুলছেন পুষ্পকেতু, কুরুঙ্গীতে জ্বলছে সুগন্ধী ধূপ, পাশে রাখা পুষ্পাধারে একগাছি পারিজাত মালা। সেবক এসে খবর দেয়, শ্রেষ্ঠী দেবদত্ত এসেছেন সাক্ষাৎলাভের আশায়। তাঁকে কক্ষে নিয়ে আসতে নির্দেশ দিয়ে, জানালার বাইরে তাকান কেতু, আকাশে ভেসে বেড়াচ্ছে সাদা মেঘের পুঞ্জ, মুগ্ধ চোখে চেয়ে থাকেন তিনি।

‘আপনার ঋণ শোধ হবার নয়, তবু এই সামান্য প্রীতি উপহার, আমি নয় গৃহিনী পাঠালেন’, দেবদত্তের হাতে একখানি রৌপ্যথালিতে সুক্ষ কাপড়ে ঢাকা বিবিধ মিষ্টান্ন।

‘এতো অমৃত! আমি গ্রহণ করলাম সমস্ত অন্তর দিয়ে, জানাবেন ভগিনীকে। ঋণ কিছু নেই ভদ্র, আপনি দন্ড পেলে সে দন্ডের ভাগী হতাম আমিও।‘

‘কথা দিয়েছিলাম কুমার, আমার জীবন, প্রাণ সকল আপনার।‘

‘প্রাণ নয়, বন্ধুত্ব চাই। শীঘ্রই যাত্রা করব সুবর্ণভূমে, সঙ্গী হবেন সখা?’

‘অবশ্য!’

গভীর আবেগে আলিঙ্গনবদ্ধ হন দুজনে।

***  ***

দুরূহ  শব্দের  অর্থঃ

যাবসজাব বা ভুসি, মন্দুরাডিভান বা আরামদায়ক নীচু বিছানা, অলিন্দবারান্দা, কুম্ভিকা – জলের কুঁজো, নিধানিকা – তাক, তল্লিকা – চাবি, শিবিকা – পাল্কি, অন্তরীয় – ধুতি জাতীয় পরিধান, কার্পাস কন্দুক – কাপড়ের বল, রসাম্ল – টক বা চাটনি, ক্ষৌমবস্ত্র – লিনেন, সুগন্ধিকা – পারফিউম, গুরুরত্ন বা পুষ্পরাগ – পোখরাজ, পদ্মরাগ মণি – রুবি বা চূণী, খট্টিকা – মোড়া, সুখাসন সোফা, তালযন্ত্র – তালা, শুণ্ডালয় – পানালয়, অক্ষক্রীড়া – পাশা, কাশক ফুল – কাশ ফুল, শ্বশুর্য – দেওর

শেয়ার করতে:

You cannot copy content of this page