সুবর্ণভূমে পুষ্পকেতু

অনন্যা পাল

তৃতীয় পর্বের পর…

নৌযাত্রা

গঙ্গাতীরে একটি অপেক্ষাকৃত নির্জন বেলাভূমি, তার ডানদিকে সূর্যরশ্মিতে উজ্জ্বল নগরীর সুউচ্চ তোরণ আর বামদিকে কিছুদূরে শ্মশানস্থল, সেখানে বনরাজির অন্তরালে বিশেষ ভাবে লক্ষ্য করলে চোখে পড়ে দু একটি চিতার লেলিহান শিখা। বেলা তৃতীয়প্রহর প্রায়, বেদমন্ত্রের ধ্বনিতে বেলাভূমির পরিবেশে নির্লিপ্ত প্রশান্তি। হোম শেষ হয়েছে, পিন্ডদান শেষে কদলীপত্রে সেই পিন্ড গঙ্গাবক্ষে বিসর্জন দিতে ধীরে ধীরে এগিয়ে যান উল্মুক; পরনে শুভ্র পাটের বস্ত্র, মুখে তিনদিনের না কামানো শ্মশ্রু-গুম্ফ, চোখদুটি অনিদ্রায় রক্তবর্ণ, পূর্বের প্রাণবন্ত যুবকটিকে খুঁজে পাওয়া যায়না এই বেদনাবিধুর মূর্তিতে। তিনদিন আগে চম্পাকে চিরতরে বিদায় জানিয়েছেন শ্মশানভূমিতে, তার চিতার আগুনে বুঝি অঞ্জলি দিয়েছেন নিজের হৃদয়খানিও; এ কয়দিন অন্নজল মুখে তোলেননি উল্মুক। চলতে চলতে থমকে যায় পা, নিজেকে কষ্টে টেনে নিয়ে চলেন তিনি, শীর্ণ মুখের ভাবে উদাসী বিষন্নতা। ধীরে ধীরে জলে নামেন উল্মুক, স্রোতস্বিনী নদীবক্ষে বিপজ্জনক ভাবে সামনে এগিয়ে চলেন তিনি, আচমকা ঢেউয়ের ধাক্কায় হাত ছাড়িয়ে ভেসে যায় কলাপাতা, আর সেই সাথে নিজেকে সঁপে দিতে চান তিনি। একটি সুদৃঢ় হাত পিছন দিক থেকে টেনে ধরে তাঁকে ঠিক সেই মূহূর্তেই।

‘ছিঃ এ কি কর বন্ধু? এই কি পুরুষের উপযুক্ত কাজ?’ মৃদু তিরস্কারে বিহ্বলতা কাটে উল্মুকের। পুষ্পকেতু ততক্ষণে পাড়ের দিকে টেনে নিয়ে চলেছেন মিত্রকে নিজের সবল বাহূপাশে।

 

‘আপনার অনুমতি পেলে মিত্রকে সঙ্গী করতে চাই সমুদ্রযাত্রায়’, পারলৌকিক কার্যশেষে পুষ্পকেতু উল্মুকের পিতা অগ্রষেনের সাথে সাক্ষাৎ করেন একান্তে।

‘সে কি সম্মত হবে বৎস্য?’ তাঁর কন্ঠে হতাশার সুর।

‘সে ভার আমার, প্রয়োজনে বলপ্রয়োগ করতে হবে তাত, এখানে থাকলে সে মনস্তাপে প্রাণ দেবে’।

‘উল্মুকের কারণে তার জননীও অন্নজল ত্যাগ করেছেন; কি থেকে কি হয়ে গেল, কল্পনাও করতে পারিনা!‘

‘পিতৃব্যা উল্মুককে ছাড়তে চাইবেন কি?’

‘যেখানে প্রাণসংকট, ক্ষুদ্র স্বার্থের অবকাশ কোথায় সেথা! গৃহিনী বুঝবেন নিশ্চয়। তুমি ওকে নিয়ে যাও; আমার আশীষ রইল পুত্র দীর্ঘায়ূ হও, কর্মবীর হয়ে পিতৃকুল উজ্জ্বল কর।‘ বলতে বলতে সজল হয় প্রৌঢ়ের চোখ।

অগ্রষেন পত্নীর তত্ত্বাবধানে গৃহসেবক তোরঙ্গে প্রয়োজনীয় সামগ্রী গুছিয়ে রাখছে। দীর্ঘযাত্রার প্রয়োজন তো বড় সামান্য নয়! আর মাত্র দুটিদিন বাকি নদীপথ যাত্রার। উল্মুক দাঁড়িয়ে আছেন জানালার পাশে, নীরব ঔদাসিন্যে তাকিয়ে আছেন বাইরের দিকে, এ যেন অন্য কারো যাত্রার প্রস্তুতি পর্ব; তাঁর কোনও ভূমিকা নেই এসবে।

‘বাহ্, তোরঙ্গ প্রস্তুত দেখছি, তবে আর ভাবনা নেই!’ কন্ঠে উৎফুল্লতা এনে বলে ওঠেন পুষ্পকেতু, কক্ষে প্রবেশ করে। বাল্যবন্ধুর যাত্রা প্রস্তুতি তদারক করতে, নিজ ব্যাস্ততা স্বত্তেও ছুটে এসেছেন তিনি বন্ধুগৃহে।

‘ভাবনা নেই না?’ জানালার বাহিরে দৃষ্টি রেখেই বলে ওঠেন উল্মুক।

‘না নেই; মিত্র সাথে থাকলে আমার আর ভাবনা কিসের?’

‘কিন্তু মিত্রের ভাবনাতেই যে ব্যস্ত হয়ে পড়েছ আজকাল কেতু?’

‘সে অধিকার নেই বলছ?’ পুষ্পকেতুর কন্ঠে অভিমানের ছোঁয়া।

‘অধিকারের কথা নয়, প্রয়োজন ছিল কি এসবের?’ উল্মুকের বাক্যে মৃদু তিরস্কার।

‘আবার এ প্রসঙ্গ কেন বন্ধু? যাত্রা শুরু হলে, দেখবে সব কিছু সহনীয় হয়ে যাবে ধীরে ধীরে’।

‘সমুদ্রের জল অশ্রু অপেক্ষা অধিক লবণাক্ত এই তো?’ উল্মুকের কন্ঠরোধ হয়ে আসে অব্যক্ত বেদনায়।

‘সখা!’ পুষ্পকেতু বন্ধুকে আলিঙ্গন করেন গভীর আবেগে।

***

আশ্বিনের পূর্ণিমা, দিবা প্রথম প্রহর, সূর্যোদয় ঘটেছে কিছু আগে; হেমন্তের শিশির তখনও লেগে আছে দূর্বাদলে; কুয়াশাচ্ছন্ন পাটলীপুত্র বন্দর দূর থেকে কিছুটা রহস্যময়। নগরীর প্রাকারদ্বার খুলে গেছে সূর্যোদয়ের সাথে, আজ সেই পথে ভোর না হতেই মহা ব্যস্ততা। বন্দর উপকুলে অপেক্ষায় সারবদ্ধ সপ্ততরী, প্রতিটি যানের কূপদন্ডের মাথায় মাগধী লাঞ্ছন উড়ছে সাড়ম্বরে। সর্বাগ্রে ও পশ্চাতে যে দুটি নৌকা, সেগুলিতে যাবে রাজকীয় নৌবাহিনী, তিনটিতে চলেছে শৈলরাজের জন্যে বিভিধ উপহার, আর বাকি দুটির একটিতে যাবে সেবকের দল ও নদীপথের প্রয়োজনীয় খাদ্য, পানীয় ও বিবিধ প্রয়োজনীয় সামগ্রী; অন্যটিতে যাবেন ধূর্জটিদেব, পুষ্পকেতু, উল্মুক, দেবদত্ত ও কয়েকজন বিশ্বস্ত রাজকর্মচারী। বন্দরে তাই ভোর না হতেই মাঝি মাল্লা ও কর্মচারীদের ভীড়, কিছু দর্শকও জুটেছে এই মহোৎসবের সাক্ষী হতে; সকলের মনেই নীরব উত্তেজনা।

সাতটি যানের প্রতিটির অধ্যক্ষ বা শশক একেকজন অভিজ্ঞ নৌপাল, এছাড়াও আছে নিয়ামক, দিক নির্ণয় করে নৌকার যাত্রাপথ সুচারু রাখাই তাদের কাজ। তবে এই সম্পূর্ণ নৌবহরের দায়িত্বে নৌবলাধিকৃত দন্তিবর্মা; তিনি সমুদ্রযাত্রাতেও নৌবহরের দায়িত্বে থাকবেন। দন্তিবর্মা মধ্যবয়সী, স্বল্পবাক, গম্ভীর চরিত্রের অভিজ্ঞ সেনানী, নিজ অধিনস্থ তথা মগধ নৌসেনাদলের কাছে অত্যন্ত সম্মানীয়। যাত্রার প্রস্তুতি সমাপ্ত হয়েছে বিগত দিনের শেষভাগে, প্রতিটি নৌকার শশক, তালিকা মিলিয়ে বুঝে নিয়েছেন যাত্রাসামগ্রী।  উপহারবাহী নৌকাতিনটির সিন্দুকসম মন্দির কীলক এঁটে বন্ধ করা হয়েছে দন্তিবর্মার উপস্থিতিতে, সে কীলক খোলা হবে তাম্রলিপ্ত বন্দরে সমুদ্রপোতে সামগ্রী ভরার কালে। এই নৌকা গুলিতে পাহারায় থাকবে পঞ্চাশ জনের তিনটি বিশেষ প্রতিরক্ষা দল, দন্তিবর্মার সাথে নিয়মিত যোগাযোগ রাখবে তারা সমগ্র যাত্রাপথে। ভোর না হতে এখন চলছে নাবিক ও সেবকদের তালিকা অনুযায়ী নৌকাভুক্তিকরন, প্রত্যেকের সাথে রয়েছে মাগধী মুদ্রাঙ্কিত পরিচয়পত্র, রাজানুকুল্যে বিদেশ যাত্রায় যার প্রয়োজন অত্যাবশ্যক।

পুষ্পকেতু ও উল্মুকের ব্যবহার্য্য সামগ্রী এসে পৌঁছিয়েছে আগের দিন সন্ধ্যায়, ব্যাক্তিগত সেবক দ্বৈরথ সযত্নে গুছিয়ে রেখেছে সেসব পেটিকা প্রভুদ্বয়ের কক্ষে। বিলাসবহুল নৌকাটির মন্দিরে চারখানি কক্ষ; একটিতে থাকবেন ধূর্জটিদেব, একটিতে পুষ্পকেতু ও উল্মুক, আরেকটিতে শ্রেষ্ঠী দেবদত্ত ও মন্ত্রী হরিষেনের বিশ্বাসভাজন এক রাজকর্মচারী চতুর্ভুজ এবং চতুর্থটিতে দুজন দৌত্যকর্মে নিপুণ কর্মচারী দধিচি ও শ্রীমন্ত, যাঁরা ধূর্জটিদেবের সহায়ক হিসেবে নিযুক্ত হয়েছেন। সূর্যোদয়ের সন্ধিলগ্নে গৃহকোনে মাতা ও ভাতৃজায়া সুগন্ধার কাছ থেকে বিদায় নিয়েছিলেন পুষ্পকেতু, সজল নয়নের নীরব বিদায়সম্ভাষন ভিজিয়ে দিয়েছিল যাত্রালগ্ন। ঘুমন্ত বালক শুদ্ধের অজান্তেই গৃহত্যাগ করতে হয়েছিল, তার মায়াময় নিদ্রিত মুখের পানে চেয়ে, বুঝিবা এক সুক্ষ বেদনা ছুঁয়ে গিয়েছিল স্নেহশীল মন; নিদ্রাভঙ্গে কত না রোদন করবে বালক, পিতৃব্য সাথে নিলেননা জেনে। বন্দরে যাবার পথে উল্মুককে রথে তুলে নেন কেতু তাঁর গৃহ থেকে; উল্মুকের পিতা অগ্রষেন, বিশাখগুপ্ত ও জ্যেষ্ঠ্যভ্রাতা সুমন্তও বন্দরে আসেন পৃথক অশ্বযানে।

বেদজ্ঞ ব্রাহ্মণ অনঘদেব বসেছেন পূজার্চনায়, যাত্রার শুরুতে অগ্নিদেবের পূজা-উপাচারে নদীপথ নির্বিঘ্ন হবে। তাঁর উদ্দাত্ব কন্ঠের বেদমন্ত্রে শুচিশুদ্ধ হয়ে ওঠে পরিবেশ, ধূর্জটিদেবের সশ্রদ্ধ পুষ্পাঞ্জলিতে যাত্রালগ্ন মঙ্গলময় হয়; পরম ভক্তিতে আশীষ গ্রহণ করেন সপ্তডিঙ্গার শশকদল। যজ্ঞবেদীতে প্রণাম জানিয়ে ধীরে ধীরে নৌকায় প্রবেশ করেন পুষ্পকেতু ও উল্মুক; কেতুর মুখেচোখে আসন্ন অভিযানের উত্তেজনা, উল্মুকের মুখভাবে শুধুই উদাসীনতা। যাত্রা শুরু হয়, প্রভাতের মৃদু  বাতাস কক্ষমধ্যে বয়ে নিয়ে আসে এক মায়া জাগানো শীতের আমেজ, বাইরে ধীরে ধীরে অস্পষ্ট হয়ে আসে নদীতীর; বিশাল গঙ্গাবক্ষের মাঝ বরাবর বয়ে চলে  নৌবহর রাজকীয় চালে।

***

দূরের উপকূলে কখনও চোখে পড়ে বনরাজি কখনও গ্রামাঞ্চল; স্থানে স্থানে নদীর বাঁধানো ঘাটে কর্মব্যস্ত ধীবর নৌকা, কোথাও বা স্নানার্থীর ভীড়; নৌকার পাটাতনে দাঁড়িয়ে লক্ষ্য করেন দুই বন্ধু প্রতিদিন। মাঝনদীতে নোঙ্গর ফেলে, ডিঙ্গি নৌকায় সহায়কেরা যায় টাটকা তরী, ফল মূল সংগ্রহের আশায় নিকটবর্তী গ্রামীণ ঘাটে, রাত্রির শেষ প্রহর থাকতে, জাল ফেলে মাছ ধরে তারা নিজেই। এযেন এক চলায়মান গৃহস্থী; খাদ্য, পানীয়, পরিচর্যা গৃহ সদৃশ্য, তবু গৃহকোন সে নয়।

কেতু নিজেকে ব্যস্ত রাখেন পুথি পাঠের মধ্যে, শেষ বেলায় তান ধরেন বীণায়, সুরঝঙ্কারে মেতে ওঠে সমগ্র বহিত্র, সহযাত্রীরা আগ্রহ ভরে শোনেন সে লহরী। শুধু উল্মুকের যেন কোনও কিছুতেই আগ্রহ নেই আর, এত প্রিয় মিত্রের বীণা বাদন, আজকাল তাও শোনেননা, নিঃশব্দে কক্ষ ত্যাগ করেন, নিজেকে গুটিয়ে নেন সঙ্গীতের আসর থেকে। কুমার সব লক্ষ্য করেও চুপ করে থাকেন, সময়ই ভুলিয়ে দেবে শোক এমনটাই আশা রাখেন মনে। তবু সাবধান হওয়া প্রয়োজন, দ্বৈরথকে বলে রেখেছেন তাই উল্মুকের গতিবিধির প্রতি নজর রাখতে।

দেবদত্ত এই যাত্রায় সঙ্গী হয়েছেন কুমারের সহচর হিসাবে, তাঁর পূর্ব অভিজ্ঞতা কাজে লাগতে পারে অভিযানে এমনই ভেবেছিলেন মন্ত্রী হরিষেনও। তবু দেবদত্ত বণিক, তাই যাত্রায় স্বধর্ম ত্যাগ করতে পারেননি, বিশেষ অনুমতি নিয়েছেন পথিমধ্যে মালব উপকুলে পণ্য ব্যবসায়ের। দেশ থেকে তিনি সঙ্গে নিয়েছেন সুক্ষ কার্পাস বস্ত্র, স্বর্ণসুতার কারুকার্যমন্ডিত কাশীপট্ট ও চন্দনকাষ্ঠের কিছু সামগ্রী; ফেরার পথে সংগ্রহ করবেন দারুচিনি, এলা, লবঙ্গ, কর্পুর ও অগুরু। নৌকার নাবতলে সযত্নে রাখা হয়েছে তাঁর পণ্যদ্রব্য, অবসর সময়ে নিজের কক্ষে হিসাববহিতে নিজেকে ব্যাস্ত রাখেন দেবদত্ত। জীবনে বহুঝঞ্ঝা কাটিয়ে এতদিনে একটু সুখের মুখ দেখেছেন, তাই নিজেকে সম্পূর্ণ রূপে সঁপে দিতে চান কর্মযজ্ঞে।

চতুর্ভুজ যুবাপুরুষ, দেবদত্তের থেকে বয়সে কিছুটা বড়; তবে স্বভাবটি ভারি প্রাণবন্ত। কথা বেশী না বললেও সহজেই বোঝা যায় তিনি রসজ্ঞ ব্যক্তি, জটিল রাজকর্মে ব্রতী হলেও আনন্দপ্রিয় মনটি নষ্ট হয়নি আজও। পাটলিপুত্রে সংসার হলেও কাজের কারণে বেশীরভাগ সময় নানান জায়গায় যাতায়াত করেন, তবে সমুদ্রযাত্রা এই প্রথম। তিনি পর্যবেক্ষনী, ও মিশুকে, নিজের গন্ডীর বাইরে গিয়ে প্রায়ই কথাবার্তা বলে থাকেন সেবক ও সহায়কদের সাথে। দেবদত্ত অন্তর্মুখি মানুষ, তবুও বেশ সখ্যতা তৈরী হয়েছে দুজনের মধ্যে ইতিমধ্যেই।

দধিচি ও শ্রীমন্ত যেন একই মুদ্রার দুই পিঠ, চেহারায় মিল নেই, তবু যেন যমজ; তাঁদের অস্তিত্ব আলাদা করে অনুভব করা কঠিন। হয়তো দৌত্যকর্মের অনুশীলন প্রভাব ফেলেছে এঁদের ব্যাক্তিত্বে, বৈদেশিক সম্পর্ক রক্ষার যে বিশাল কর্মযজ্ঞ, তার সুদক্ষ সেনানী এরকম আরো কতজন রয়েছেন মগধ প্রশাসনে। দধিচি ও শ্রীমন্ত স্বল্পবাক, মেপে কথা বলা এবং দূরত্ব রক্ষা করা এঁদের স্বভাবের অঙ্গ এবং হয়তো পেশারও। এঁরা দিনের বেশ কিছুটা সময় ধূর্জটিদেবের কক্ষে কাটিয়ে থাকেন, তাঁর সান্নিধ্য ও রাষ্ট্র বিষয়ক আলোচনায়।

‘ॐ পূর্ণমদঃ পূর্ণমিদং পূর্ণাৎ পূর্ণমুদচ্যতে ।

পূর্ণস্য পূর্ণমাদায় পূর্ণমেবাবশিষ্য তে ।।

ওঁ শান্তিঃ শান্তিঃ শান্তিঃ ।।‘

প্রভাতের প্রথম প্রহরে গঙ্গাবক্ষ শান্ত, সূর্যকিরণে স্বর্ণময় তার জল, হেমন্তের কুয়াশায় দূরের নদীতীর অস্পষ্ট। নিঃশব্দ পরিবেশে উদ্দাত্ত কন্ঠের শান্তিমন্ত্র ধ্বনি আকাশবানীর মত গুঞ্জরিত হয় বাতাসে; নিদ্রামগ্ন নৌবহর উজ্জিবিত হয় নতুন দিনের সূচনায়। সদ্যস্নাত সৌম্যকান্তি ধূর্জটিদেব যেন আশ্রমিক ৠষি, তাঁর মুখমন্ডলের সমাহিত প্রশান্তি ধ্যানমগ্ন পরিবেশ সৃষ্টি করেছে আচার্যের কক্ষটিতে।

ধূর্জটিদেব অত্যন্ত নিয়মনিষ্ঠ মানুষ, গৃহের মতই নৌযাত্রাতেও ধর্মাচরণ ও বিদ্যাভ্যাস নিয়েই ব্যস্ত থাকেন; তিনি স্বল্পাহারী, প্রভাবশালী ব্যক্তিত্ব হওয়া সত্ত্বেও খুবই সহজ তাঁর জীবনযাত্রা।

‘আজ কতদিন হোল কেতু আমাদের নৌকাবাসের?’ উল্মুক বহুদিন বাদে নিজে থেকে বাক্যালাপ শুরু করেন মিত্রের সাথে। প্রাতঃরাশের পরে নৌকার পাটাতনে দাঁড়িয়ে আছেন দুজনে অভ্যাসমত।

‘দশদিন কেটে গেছে, আজ একাদশ’।

‘এ যেন এক অনন্ত যাত্রায় চলেছি, পৃথিবীটা এক দোদুল্যমান স্থান বিশেষ; কোনোদিন যে স্থির বিছানায় নিদ্রা গিয়েছি, ভাবতে অবিশ্বাস্য লাগছে’।

‘যাত্রার সবে তো শুরু এর মধ্যেই হাঁপিয়ে উঠলে? তবে সমুদ্রযানে বিছানা এমন  চতুর্দোলাসম হবে না আশা রাখা যায়’।

‘এখন এমন বোধ হচ্ছে বটে, যাত্রার শেষে গৃহের বিছানাটি কিন্তু প্রথম কিছুদিন ভারি অদ্ভুত ঠেকবে’, দেবদত্ত নিজের কক্ষের দরজায় দাঁড়িয়ে আলোচনা শুনছিলেন, এখন এগিয়ে এসে মন্তব্য করেন।

‘গৃহের চিন্তা কে করে, এমন ভাসতে ভাসতে সব কিছু ভুলে গেলেই মঙ্গল’, উল্মুক আচমকা  নিজের কক্ষের দিকে রওয়ানা দেন।

‘সখাকে নিয়ে চিন্তা হয়, নিজের দায়িত্বে নিয়ে এলাম তাকে এই দুর্গম যাত্রায়, জানি না কি হবে’, পুষ্পকেতুর কপালে চিন্তার ভাঁজ।

‘একটা কথা বলি কুমার, সুখী জীবনের আলস্যে শোক অতিরিক্ত প্রবল হয়, দুর্গম পথের ঝঞ্ঝায় সে সহনীয় হয়ে যাবে ধীরে ধীরে, নিজের অভিজ্ঞতা থেকে বলছি একথা, বিশ্বাস রাখুন’।

‘এত ব্যস্ত হয়ে চললেন কোথায় ভদ্র চতুর্ভুজ? চতুর্ভুজকে নৌকার গহ্বর থেকে উপরে আসতে দেখে মন্তব্য করেন কেতু।

‘আর বলবেন না, সে এক মহাকান্ড। আপনাদের সংবাদ দেবার উদ্দেশ্যেই এই ব্যস্ততা।‘

‘বলেন কি, আবার কি ঘটল?’

‘আজ প্রাতে সেবকদের জালে কয়েকটি নধর গাঙ্গেয় মৎস্য ধরা দিয়েছে; সর্ষপ সহযোগে মৎস্যব্যাঞ্জন, আর মৎস্যান্ডের রসাম্ল তৈয়ার হচ্ছে পাকশালে। আপনাদের জানানো কর্তব্য বোধ হোল’।

‘ও এই ব্যাপার! তা, না জানালে আমরা ভাগ পেতাম না বলছেন?’

‘আহা তা কেন? কিন্তু শীঘ্রই ঘর্মপাত করে খিদে বাড়ানো প্রয়োজন, নাহলে মৎস্যসম্রাটের অবমাননা করা হয়’।

চতুর্ভুজের কথায় সকলেই হেসে ওঠেন, পরিবেশ মূহুর্তে হালকা হয়।

‘ভদ্র উল্মুককে দেখছি না?’ চতুর্ভুজ প্রশ্ন করেন।

‘কক্ষমধ্যে আছে সে’।

‘শুভসংবাদ তাঁকেও জানিয়ে আসি তবে’।

‘ভদ্র, তার কাছে নাই বা গেলেন’, পুষ্পকেতু চতুর্ভুজকে নিরস্ত করতে চান।

‘আমার ওপর ভরসা রাখুন কুমার, তারুণ্যের প্রথম শোক আমার অভিজ্ঞতায় নতুন নয়’, মূহুর্তে চতুর্ভুজের কন্ঠস্বরে গভীরতা প্রকাশ পায়।

 

‘ভদ্র উল্মুক কি ব্যস্ত রয়েছেন?’ কক্ষে প্রবেশকালে জানান দেন চতুর্ভুজ। উল্মুক নিরন্তর অবকাশে নিজেকে নিয়েই ক্ষুব্ধ, পায়চারী করছিলেন কক্ষমধ্যে অসহায় অস্থিরতায়; চতুর্ভুজকে দেখে বোধকরি অবাক হলেন কিছুটা।

‘আপনার কাছে কিছু সাহায্যের আশায় এসেছি, অনুরোধ ছিল একটি’।

‘সাহায্য আমার কাছে? বলুন?‘

নৌকার ভান্ডারিকের ভান্ডার সামগ্রীর হিসাবে কিছু গোলযোগ ঘটেছে, পাচকের সাথে তার এই নিয়ে বচসা বেধেছে। আপনি হিসাবনবিশ, দয়া করে হিসাব বহিটি যদি একবার দেখে দেন ভারি উপকার হয়।‘

‘এ আর বেশী কথা কি, চলুন এখনি যাই’।

‘হ্যাঁ, সেই ভালো, এদিকে মধ্যাহ্ন ভোজনে গাঙ্গেয় মৎস্যের আয়োজন, এসময়ে পাচককে চটানো বুদ্ধির কাজ নয়। ভদ্র, গাঙ্গেয় মৎস্যে রুচি রাখেন তো?’

‘অরুচি নেই’, হেসে উত্তর দেন উল্মুক। দুজনে নৌকার নাবতলের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে যান নতুন উৎসাহে। পাটাতনে অপেক্ষায় থাকা পুষ্পকেতু উল্মুকের এই ব্যস্ততা লক্ষ্য করে বিস্মিত হলেও কিছুটা নিশ্চিন্ত বোধ করেন। চতুর্ভুজের সাথে দৃষ্টিবিনিময়ে, কৃতজ্ঞতা প্রকাশ পায় কুমারের মুখের ভাবে।

***

আঠারো দিনের মাথায় মাগধী নৌবহর গঙ্গাবাহী হয়ে তাম্রলিপ্তে পৌঁছায়; পথক্লান্ত নবীন যাত্রীরা অবশেষে মাটিতে পা রেখে নিশ্চিন্ত হন। তাম্রলিপ্তের কাছেই মালভূমিতে রয়েছে কয়েকটি তাম্রখনি, সেই থেকেই তার নাম। গঙ্গার একটি শাখা শিলাবতীতে মিশে তাম্রলিপ্তে এসে সমুদ্রে মিশেছে, ফলে নদীবাহিত পণ্য সমুদ্রপোতে এবং সমুদ্রবাহী পণ্য নদীবহিত্রে সহজেই স্থানান্তরিত করা সম্ভব হয় এই বন্দরে।

তাম্রলিপ্ত বৈদেশিক বাণিজ্যে আর্যাবর্তের পূর্বতোরণ; সমগ্র পাশ্চাত্যের সাথে চিনাপ্রদেশের যোগসূত্র এই বিশাল সমুদ্রবন্দর। ভারতভূমীর প্রধানা নদী গঙ্গার যাত্রাপথে গড়ে ওঠা এই বন্দরনগরী অন্তর্বাণিজ্যের সহায়ক, উপরন্তু পাশ্চাত্য থেকে ভ্রুগুকচ্ছে আসে যেসকল পণ্য, নদীপথে তা এসে পৌঁছায় তাম্রলিপ্তে আরো পূর্বেদিকে যাত্রার উদ্দেশ্যে। মগধ রাজধানী পাটলীপুত্রের কাছে তাম্রলিপ্তের গুরুত্ব অপরিসীম।

এই বন্দরটি ঘিরে গড়ে উঠেছে একটি কর্মব্যস্ত স্বচ্ছল নগরী; কলিঙ্গ জনপদের অন্তর্ভুক্ত এই অঞ্চল, কলিঙ্গ গুপ্ত সাম্রাজ্যের অন্তর্গত একটি সামন্ত রাজ্য। তবে তাম্রলিপ্তের অপরিসীম অর্থনৈতিক গুরুত্বের কারণে এখানকার নগরপাল একজন মগধ প্রতিনিধি, যিনি সরাসরি সম্রাট সমুদ্রগুপ্তের অধীন।

পুষ্পকেতুসহ উচ্চপদস্থ রাজকর্মচারীরা তাম্রলিপ্তে নগরপালের তত্ত্বাবধানে একটি রাজকীয় অতিথিশালায় আশ্রয় নিয়েছেন, নগরীর কেন্দ্রস্থলে সে বাসস্থান। সমদ্রযাত্রায় এখনও প্রায় অর্দ্ধপক্ষকাল বাকি, সেই কদিন নগরীতেই কাটাতে হবে। নতুন স্থান, কিছুটা হলেও ভিন্ন সংস্কৃতি, পুষ্পকেতু উৎসাহ বোধ করেন; তিনি আর উল্মুক ছাড়া বাকি সহযাত্রী সকলেই আগেও এসেছেন তাম্রলিপ্ততে। তাই দুই মিত্র প্রতিদিন পায়ে হেঁটে নগর দেখতে বের হন, প্রথম প্রথম উল্মুক নিস্পৃহ ছিলেন, কিন্তু কয়েকদিনের পর তিনিও উৎসাহিত বোধ করছেন; যৌবনের ধর্মে অনেকটাই আগের অবস্থায় ফিরেছেন উল্মুক, দেখে স্বস্তি বোধ করেন সকলেই।

তাম্রিলিপ্ত নগরীটিও প্রাকারবিশিষ্ট, তার কেন্দ্রবিন্দুতে সরকারী দপ্তর ও অভিজাত পল্লী, চওড়া পাথরে বাঁধানো রাজপথ ও তার দুইপাশে বিদেশী পণ্যের ঝলমলে বিপণি। রাজপথের সাথে সংযুক্ত শাখাপথগুলিও পরিষ্কার ঝকঝকে, তারা এঁকে বেঁকে চলে গেছে নগরীর বিভিন্ন দিশায়, কোনও পথে গৃহস্থ পল্লী, কোথাও স্থানীয় হাট, আর কোথাও বা দেবস্থান। নগরীতে ছড়িয়ে আছে অসংখ্য বৌদ্ধ চৈত্য, সেখানে উপাসনার সাথে সাথে চলে বিদ্যাচর্চা, দেশী বিদেশী জ্ঞানপিপাসু মানুষের আনাগোনা সেসব চৈত্যে। সম্রাট সমুদ্রগুপ্ত নিজে বৈষ্ণব, কিন্তু সকল ধর্মের প্রতিই পরম সহিষ্ণু, এসকল চৈত্যগুলির সম্বৃদ্ধি রাজ আনুকুল্যেই।

একদিন বিকেলে নিয়মমত বেরিয়েছেন দুজনে, কোনদিকে যাবেন স্থির করতে পারছেননা।

‘পূবপানে যাই চলো, ওদিকটা এখনও যাওয়া হয়নি’, পুষ্পকেতু প্রস্তাব দেন। সেইমত যাত্রা করেন দুজন, বাক্যালাপে কখন কেটে গেছে তিন-চার দন্ড সময়, সামনেই দেখা দেয় নগরীর বন্দর সংলগ্ন তোরণ।

‘এবার তো ফিরতে হয় হে, প্রাকারের বাইরে তো যাওয়া চলে না; পিপাসাও পেয়েছে, ফেরার পথে জলসত্রে নজর রেখো’, উল্মুক মন্তব্য করেন।

‘তোরণের ওপারে নাহোক, এইপারে তো থাকাই যায় আরো খানিক্ষণ। পিপাসা পেয়েছে বলছ, চল না সামনের ওই পানশালাটিতে যাই’।

‘শুণ্ডালয়? তোমার কি মতিভ্রম ঘটল?’ উল্মুক তিরস্কার করেন মিত্রকে, অত্যন্ত অবাকও হন এরকম প্রস্তাবে।

‘কেন মতিস্থির থাকলে যাওয়া চলে না বলছ? আরে এরকম বিচিত্র নগরে শুণ্ডালয়ও একটি দেখবার বস্তু, চলই না’। পুষ্পকেতুর উপরোধ ফেলতে পারেননা উল্মুক, অবশেষে দুজনে পানশালায় প্রবেশ করেন।

সম্বৃদ্ধ বন্দর নগরীর সম্বৃদ্ধ পানশালা, বিত্তবান বণিক ও রাজপুরুষদের যাতায়াত এখানে, একটু লক্ষ্য করলেই তা বোঝা যায়। প্রশস্ত পানকক্ষে অনেকগুলি উত্পীঠিকা সুখাসন সহ সাজানো রয়েছে কিছু দূরে দূরে; প্রতিটি উত্পীঠিকায় সাজানো রয়েছে রৌপ্যপাত্রে পারিজাত পুষ্প ও সুদৃশ্য দীপদান। কক্ষের এক কোণে একটি বেদীতে বাদ্যযন্ত্রী দুই পুরুষ মৃদু সঙ্গীত পরিবেশন করছে; সুন্দরী পরিবেশিকারা হাতে পানপাত্র নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে অতিথি সেবায়। বিশিষ্ট অতিথিরা পানীয় সেবন করছেন কোথাও একাকী, কোথাওবা সবান্ধব; মূল কক্ষটি ছাড়াও পানশালার ভিতরভাগে রয়েছে ছোট ছোট কক্ষ সেইসব অতিথিদের জন্য যাঁরা নির্জনতা পছন্দ করেন।

‘শীতল তক্র মিলবে কি?’

‘অবশ্য মিলবে প্রভু, দুজনেই তক্র পান করবেন কি?’ উল্মুকের প্রশ্নের উত্তরে পুষ্পকেতুর প্রতি গভীর কটাক্ষপাত করে পানীয় আনতে যায় এক প্রগাঢ় যৌবনা পরিবেশিকা, আরো দুটি তন্বি চামর ও পুষ্পমালা হাতে ব্যস্ত হয় সেবা করতে। কুমারের দেবদুর্লভ কান্তি দেখে আকৃষ্ট হওয়া আশ্চর্যের নয়, উল্মুকের ঠোঁটের কোণে হাসি দেখা দেয়; ঘেমে ওঠেন কেতু।

সুগন্ধি শীতল পানীয়ে শরীর স্নিগ্ধ হয়েছে, সুরের আসরে মন আবিষ্ট, এসময়ে হঠাৎই এক গোলযোগের সূত্রপাত হয়। একটু দূরের একটি পীঠিকায় একাকী সুরাপান করছিলেন এক যবণ বণিক, শ্বেতশুভ্র গায়ের রং, উন্নত নাক, প্রশস্ত কপাল, দীর্ঘকায়, পরনে মূল্যবান ক্ষৌম্য বস্ত্রের সিচয় ও উত্তরীয়। একজন নগর দন্ডাধিকারিক কয়েকজন সহচরসহ এসে তাঁকে নিগ্রহ করতে শুরু করেন। বণিক প্রাকৃত ভাষায় তত পটু নন, তার ওপর আচমকা উত্তেজনার ফলে স্বপক্ষে যুক্তি দিতে পারছেননা, দূর থেকেও বোঝা যায় সেকথা।

‘চলো তো দেখি কি বৃত্তান্ত?’ পুষ্পকেতু কৌতুহলী হন।

নিজেদের পরিচয় দিয়ে দন্ডাধিকারিকের সাথে কথা বলেন কুমার, এরপরে যা জানা যায় তা হোল, বণিক রোমক দেশীয় মণিকার, নাম ক্যাসিয়াস; বেশ কিছুদিন হোল ব্যবসায়ের কাজে তাম্রলিপ্তে বাস করছেন। এমনিতে অভিজাত ও সম্মানীয়, বিত্তবানও বটে; কিন্তু ধর্মদাস নামের এক স্থানীয় ব্যবসায়ী অভিযোগ করেছেন যে ক্যাসিয়াস ও পুন্ডরিক নামের এক পুরুষপুরা নিবাসী বণিক একসাথে ষঢ়যন্ত্র করে তাঁকে প্রতারনা করেছেন। অভিযোগ এই যে, পুন্ডরিকের সাথে এই পানশালাতেই কয়েকদিন আগে আলাপ হয় ধর্মদাসের; পুন্ডরিকের সাথে ক্যাসিয়াসকে বেশ কয়েকবার একত্রে সুরাপান করতে দেখেছেন তিনি ইতিমধ্যে। কথায় কথায় পুন্ডরিক তাঁকে একটি দুষ্প্রাপ্য কমলহীরার কথা জানায়, তার অর্থের প্রয়োজন, তাই রোমক দিনারে মূল্য প্রদান করলে স্বল্পমূল্যে সেটি সে বিক্রয় করতে রাজী আছে বলে জানায়। ধর্মদাস আগ্রহী হন, তখন পুন্ডরিক দুইদিবস আগে সেটি পানশালায় নিয়ে আসে; ক্যাসিয়াস সেসময় পানশালায় উপস্থিত ছিলেন, ধর্মদাস তাঁকে মনি যাচাই করতে বলেন। ক্যাসিয়াস জোরের সঙ্গে জানান, এ মণি অতিমূল্যবান, আর তাতেই ধর্মদাস বিশ স্বর্ণমুদ্রার বিনিময়ে মণিটি খরিদ করেন। গৃহে গিয়ে পরদিন সেটি স্বর্ণকারের কাছে নিয়ে যান অঙ্গুরীয় তৈরীর উদ্দেশ্যে, সেখানে জানতে পারেন, মণি ঝুটো, এটি একটি শ্বেত পুষ্পরাগ মাত্র, যার মূল্য এক দিনারও নয়।

ক্যাসিয়াস তখনও বলে চলেছেন, তিনি মণি পরীক্ষা করেছিলেন, সেটি সত্যিই একটি দুর্মুল্য হীরা ছিল, আর পুন্ডরিকের সাথে তাঁর আলাপ পানশালায়, এর বাইরে তাকে তিনি চেনেননা।

‘পুন্ডরিককে আটক করেছেন কি ভদ্র?’ দন্ডাধিকারিক ত্রিদিবকে প্রশ্ন করেন পুষ্পকেতু।

‘ধরেছি তাকে, স্থল পথে নগরী ত্যাগ করে পশ্চিমপানে পাড়ি দিয়েছিল সে মণি বিক্রীর পরেরদিন ভোর রাতে। অভিযোগ পেয়েই চারিদিকে লোক পাঠাই, ধরা পড়েছে আজ সকালে।‘

‘তার বক্তব্য কি? অপরাধ স্বীকার করেছে?’

‘সে বলছে, ক্যাসিয়াসের কাছেই সে প্রথম জানতে পারে তার মণিটি অতি দুষ্প্রাপ্য, এটি তার পারিবারিক সম্পত্তি। ক্যাসিয়াসের ভরসাতেই ধর্মদাসকে মণি বিক্রয় করেছে সে সরল বিশ্বাসে’।

‘এতই যদি সরল, পরদিন নগরত্যাগ করল কেন সে?’ পুষ্পকেতু মন্তব্য করেন।

‘সরল তো নয়ই, তবে মণি বিক্রিতে এই শর্মারও ভূমিকা আছে, লাভের ভাগ পেয়েছে অবশ্যই; এ আমার বিশ্বাস’। ত্রিদিব নিজের যুক্তিতে অটল।

ক্যাসিয়াস এতক্ষণ কথোপকথন শুনছিলেন, এখন পুষ্পকেতুকে বোঝাতে চেষ্টা করেন তিনি নির্দোষ। পররাজ্যে এসে সামান্য মুদ্রার জন্য নিজের ব্যাবসা নষ্ট করবেন কেন তিনি? তাছাড়া এ তাঁর দেশ রোমক সাম্রাজ্যের জন্যেও লজ্জার বিষয়।

‘পুণ্ডরিকের সঙ্গের বস্তুসামগ্রী পরীক্ষা করেছেন ভদ্র?’

‘আপনার কি সন্দেহ হয় বিক্রয়কালে আসল মণি বদল করেছে সে?’

‘হ্যাঁ, সব শুনে সেরকমই সন্দেহ জাগছে মনে’।

‘তার সকল সামগ্রী শুধু পরীক্ষাই নয় বাজেয়াপ্ত করা হয়েছে আমাদের দপ্তরে, চাইলে আপনিও দেখতে পারেন’।

‘সামগ্রী পরীক্ষার আগে লোকটিকে একবার দেখতে চাই’।

‘বেশ, কার্যালয়ে চলুন তবে। ক্যাসিয়াসকে কিন্তু বন্দী করব আমরা’। এরপরে সদলবলে মহাদণ্ডাধিকারিকের কার্যালয়ে যাওয়া হয়।

পুণ্ডরিক পশ্চিমাপ্রদেশীয় ব্যাবসায়ী, তাই বৈশ্য হলেও সে দীর্ঘকায় ও বলশালী ব্যক্তি, তবে তার চক্ষুদুটি ধূর্ততা ভরা। এসময়ে, বন্দীদশায় তার মুখের ভাব অতি নিরীহ, বাদানুবাদে কিছুটা পর্যুদস্তও। ক্যাসিয়াস তাকে দেখেই ক্রোধে ফেটে পড়েন, নিজস্ব বিজাতীয় ভাষায় তার প্রতি যা বলতে থাকেন, সে যে সুবাক্য নয়, আন্দাজ করা যায় সহজেই।

‘পুণ্ডরিকের দেহ পরীক্ষা করেছেন ভদ্র ত্রিদিব?’

‘করেছি, নির্বস্ত্র করেই পরীক্ষা করেছি তাকে। কোমরে একটি খঞ্জর ছাড়া আর কিছু পাইনি।‘

পুষ্পকেতু দীর্ঘক্ষণ স্থিরদৃষ্টিতে লক্ষ্য করেন আসামীকে, তারপর নির্দেশ দেন, ‘ভদ্র ত্রিদিব ওর কেশগ্রন্থীটি খোলার ব্যবস্থা করুন’।

নির্দেশ শুনে জ্বলে ওঠে পুন্ডরিক, ‘কেশ স্পর্শ করবেন না আমার, চান তো মস্তক নিন। পররাজ্যে এ অপমান অসহ্য!’

অধস্তন কর্মচারী ইতস্তত করছে দেখে পুষ্পকেতু নিজেই এগিয়ে গিয়ে কেশবন্ধে টান দেন, ‘আপাতত কেশই যথেষ্ট, মস্তক না হয় ধীরে সুস্থে নেওয়া যাবে!’ বলতে বলতে কুমারের মুঠিতে ঝলকে ওঠে এক অনিন্দ্যসুন্দর হীরকখন্ড।

ক্যাসিয়াস ছাড়া পেয়ে পুষ্পকেতুর হাতদুটি চেপে ধরে চুম্বন করেন, এই বিজাতীয় অভ্যর্থনার আন্তরিকতা বুঝে নিতে অসুবিধা হয়না কুমারের।

‘রাত্রি হয়েছে, কার্যালয়ের অশ্বযান গৃহে ছেড়ে দেবে আপনাদের তিনজনকে। ভদ্র ক্যাসিয়াস, আমাদের অপরাধ নেবেননা, আমরা কর্তব্য করেছি মাত্র’, ত্রিদিব বিদায় জানান সকলকে।

পরদিন প্রাতে, অতিথিশালায় ক্যাসিয়াসকে দেখে অবাক হন কুমার, ‘কি সৌভাগ্য! ভিতরে আসুন ভদ্র’।

‘আপনি আমার বন্ধুত্ব গ্রহন করুন আর্য, চিরকাল এই উপকার স্মরণে রাখব আমি’।

‘এ কথা বলবেন না ভদ্র, আপনি বিদেশী, পরিস্থিতির চাপে অসহায় হয়ে পড়েছিলেন, একজন মাগধী হিসাবে পাশে দাঁড়ানো কর্তব্য মনে হয়েছিল। মগধ সাম্রাজ্যের আইনে দোষীর শাস্তির থেকে নির্দোষীর মুক্তি বেশী গুরুত্বপূর্ণ।‘

‘আপনার এ ঋণ পরিশোধ করা চলে না, কোনও অর্থমূল্যের উপহার দিয়ে আপনাকে ছোট করব না। সেকারণে, একটি বিশেষ বস্তু এনেছি আপনার জন্যে’; কথাকটি বলে ক্যাসিয়াস একটি ক্ষুদ্র স্ফটিকের কোষ বের করেন কোমরবন্ধ থেকে। কোষটি খুলে ধরেন তিনি, তার ভিতরে দুটি পিঙ্গল বর্ণ বটিকা, একেকটি আন্দাজ আধখানা সুপারির মাপের।

‘কি এ বস্তু?’ পুষ্পকেতু আশ্চর্য্য হন।

‘এর নাম মিথরিদাতম, এটি একটি বিষনাশী প্রতিষেধক; পৃথিবীর যে কোনও বিষকে মানাব শরীরে প্রতিরোধ করার ক্ষমতা এর আছে। রোমক দেশের এ এক অতি গুহ্যবিদ্যা, অতি অল্প লোকই এর নাগাল পায়। আজ থেকে প্রায় ছয়শত বছর আগে পারস্যের সম্রাট মিথরিদেটাস আবিষ্কার করেছিলেন এ ওষধি আত্মরক্ষার কারণে; ক্রমে পারস্য জয়ের পরে রোমক রাজপুরুষের হাতে আসে এই বটিকার প্রস্তুতপ্রণালী, আর আজও তা রোমকের এক গোপন রহস্য হিসাবে রয়ে গেছে।‘

‘আপনার এই অমূল্য উপহার আমি হৃদয় দিয়ে গ্রহণ করলাম ভদ্র, এমন করে উপকারের মর্যাদা রাখেন কেবল মহৎ ব্যাক্তি, আপনাকে প্রণাম’।

***

‘এ তো রীতিমত গল্পকথা হে’, ক্যাসিয়াস চলে যেতে মন্তব্য করেন উল্মুক।

‘গল্পকথা না সত্য, প্রয়োগে প্রমাণ হতে পারে’।

‘প্রার্থনা করি সে প্রয়োজন না হোক; আপাতত বস্তুটিকে গোপন রাখাই শ্রেয়’। উল্মুকের পরামর্শ মত স্থির হয় এই বটিকার কথা কারো সাথে আলোচনা করা হবে না।

‘না হয় এক দূরের বন্ধুর স্মৃতিচিহ্ন হয়েই থাক এটি’, হেসে স্ফটিক কোষটি বাক্সবন্দী করেন পুষ্পকেতু।

***  ***

দুরূহ  শব্দের  অর্থঃ

কদলী – কলা, পট্টবস্ত্র – পাটের কাপড়, অক্ষৌরিত – না কামানো, শশক – জাহাজের ক্যাপ্টেন, কূপদন্ড – মাস্তুল, লাঞ্ছন – পতাকা, নাবতল – নৌকার নীচেরভাগ,গাঙ্গেয় মৎস্য – ইলিশ মাছ, উত্পীঠিকা – টেবিল, সিচয় – আলখাল্লা, কোষ – কৌটো, বটিকা – বড়ি

ছবি সূত্র- ইন্টারনেট

শেয়ার করতে:

You cannot copy content of this page