সুবর্ণভূমে পুষ্পকেতু
অনন্যা পাল
চতুর্থ পর্ব…
সমুদ্র অভিযান
‘শমঃ ন বরুণঃ।
দ্বেষণ বিশ্বতো মুখাতি নাবেব পারয়।
স নঃ সিন্ধুমির নাবয়তি পর্ষা স্বস্তয়ে।।‘
(হে বরুণদেব, সমগ্র বিশ্ব তোমার সম্মুখে। শত্রুর জলযানকে তুমি দূরে সরিয়ে রেখো। আমাদের তরীকে বিশাল সমুদ্র পার করে পূণ্য ও সম্বৃদ্ধির দেশে পৌঁছে দাও।
সমুদ্রদেবতা বরুণদেবের পূজার্চনা চলছে বন্দর ঘাটে, সামনেই তিনটি অর্ণবপোত স্বমহিমায় যাত্রার জন্য প্রস্তুত। ধূর্জতা অর্থাৎ সমুখের যানটি যুদ্ধ নাও, মকরমুখী এই তরণীর পৃষ্ঠমন্দিরটি তার সামনের দিকে, পিছনভাগ উন্মুক্ত পাটাতন। ফলে, সামনে থেকে শত্রু আক্রমণ করলে সেনাপতি কক্ষের বেষ্টনী থেকে যুদ্ধ পরিচালনা করবেন, উন্মুক্ত পাটাতন তীরন্দাজী ও সম্মুখযুদ্ধের উপযুক্ত। যুদ্ধনাও দ্রূতগামী এবং সহজেই গতিপরিবর্তনে সক্ষম; দন্তিবর্মা এটিতেই যাত্রা করবেন দুইশত সৈন্যসহ। নৌবহরের মাঝখানে থাকবে মন্দির সর্বস্ব পোতটি, তার বাইরের শোভা তেমন নেই, তবে মন্দিরটি অত্যন্ত সুরক্ষিত। মন্দিরের পিছনের একটি অংশ আস্তাবলের মত, সেখানে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে পাঁচটি উৎকৃষ্ট পারস্য অশ্ব, অশ্বগুলি ভৃগুকচ্ছে যবন বণিকদের থেকে সংগ্রহ করে স্থলপথে তাম্রলিপ্ত আনা হয়েছিল; এগুলি রাজা চন্দ্রদমনের জন্য সম্রাটের বিশেষ উপহার, সুবর্ণভূমে অশ্ব পাওয়া যায়না। এই নাওটির সুরক্ষায় রয়েছে একশত সৈন্য, অশ্বগুলির সেবার জন্য সঙ্গে চলেছে দুইজন অশ্বপালক। শেষের সমুদ্রপোতটি ময়ূরপংক্ষী, দেওয়ালের সুক্ষকারুকাজ ও সোনা, রূপার অঙ্গসজ্জায়, যেন হুবহু একটি পেখম তোলা ময়ূরপক্ষী। এই যানটি একটি রাজকীয় প্রমোদতরণী, শুধু বাইরের বাহারেই নয়, এর ভিতরভাগও যেন একটি বিলাসবহূল প্রাসাদ, সমস্ত রকম আরাম ও বিনোদনের ব্যবস্থা সেখানে আছে। মন্দিরের কক্ষগুলি প্রশস্ত ও মূল্যবান আসবাব দিয়ে সাজানো; রাজপুরুষদের জন্য তৈরী বিশেষ স্নানাগারে রাজসিক ব্যবস্থা। ধূর্জটিদেব ও পুষ্পকেতু-উল্মুকের জন্য নির্ধারিত শয়নকক্ষ দুটির সঙ্গে রয়েছে নিজস্ব বিশ্রামকক্ষ, এছাড়াও একটি সাধারণ প্রমোদকক্ষ, যেখানে নিত্য সঙ্গীতবাদ্য ও পাশাখেলার বন্দোবস্ত রয়েছে। নাও-পাটাতনের খোলা অংশে আছে তরবারি দ্বন্দ ও মল্লক্রীড়ার সুন্দর ব্যবস্থা। সবমিলিয়ে, একমাসের উপর একটানা যাত্রায় সুখস্বাচ্ছন্দের সবরকম আয়োজনই রয়েছে সেখানে। ব্যক্তিগত সেবক, পাচক, সহায়ক, নৌকর্মচারী ও বৈদ্য ছাড়াও এই যানে চলেছে পঞ্চাশজন সশস্ত্র সৈন্য।
নির্ধারিত শুভক্ষণে তিনটি যানের শশক পরীক্ষা করে নেন নিজ নিজ মচ্ছযন্ত্র একে অপরের সাথে, তিনটি তরণী থেকে বেজে ওঠে শঙ্খধ্বনি, এরপর যাত্রা শুরু হয় দক্ষিণপূর্ব দিশায়। কিছু পরে অস্পষ্ট হয় উপকুল, ধীরে ধীরে মাঝ সমুদ্রে জেগে থাকে শুধু অনন্ত জলরাশি।
নদীপথে যাত্রার তুলনায় এই সাগরপাড়ির অভিজ্ঞতা একেবারেই ভিন্ন; স্থলভূমির সাথে সকল সম্পর্ক কাটিয়ে এযেন এক নিরুদ্দেশ যাত্রা। পুষ্পকেতু তাঁর সহজাত কৌতুহলে নাও পরিচালনার পদ্ধতিতে আগ্রহ বোধ করেন, ঘুরে ঘুরে লক্ষ্য করেন কর্মরত নাবিকদের; শশক অনঘবর্মার সাথে সৌহার্দ্যতাও তৈরী হয় কয়েকদিনের মধ্যে। উল্মুকও নিজেকে ব্যস্ত রাখেন মল্লক্রীড়া, পাশাখেলা প্রভৃতিতে, এসব কাজে চতুর্ভুজ তাঁর সঙ্গী। সন্ধ্যাকালে বসে সঙ্গীতের আসর, তরণীর পেশাদার শিল্পীরা ছাড়াও পুষ্পকেতু মাতিয়ে রাখেন শ্রোতাদের তাঁর বীনাবাদনে।
সমগ্র যাত্রাপথের এই অংশটি একেবারে সমুদ্রবক্ষ ভেদ করে অপরপ্রান্তে পাড়ি, সমুদ্র এখানে অত্যন্ত তরঙ্গবহূল ও বিপদসঙ্কুল, পদে পদে দিগভ্রান্ত হবার আশঙ্কা। মচ্ছযন্ত্র, আকাশের তারামন্ডলী আর মৌসুমী বায়ূর প্রবাহ দিক নির্দেশের প্রধান সহায়। যাত্রার অষ্টম দিনে দুপুর থেকেই আকাশ থমথমে, জলতরঙ্গও শান্ত, অনঘবর্মার মুখ গম্ভীর, নাবিকদের মধ্যে সন্ত্রস্ত্র ভাব।
‘ভদ্রকে চিন্তিত দেখাচ্ছে আজ, কোনও কারণ ঘটেছে কি?’ পুষ্পকেতু জানতে চান অনঘবর্মার কাছে।
‘আজ বড় বেশী শান্ত চারিধার’।
‘পালে বাতাসের অভাব, সেই কি সমস্যা?’
‘না, এই অস্বাভাবিক শান্তি, ঘোরতর অশান্তির দূরাভাস বলে সন্দেহ হয়, চিন্তা সেকারণেই। এই অঞ্চল সামুদ্রিক ঝঞ্ঝা প্রবণ’।
‘এই ঋতুতে কি ঝড় ঝঞ্ঝা ঘটে?’
‘’ঘূর্ণি ঝড় কোনও ঋতুবিশেষে হয় না কুমার, প্রকৃতির খেয়ালেই তা ঘটে থাকে। স্থলভাগে যে ঝড়ের দাপট হয়তো তেমন লক্ষনীয় নয়, মাঝ সমুদ্রে তার প্রকোপেই ছিন্নভিন্ন হতে পারে নৌবহর। গ্রীষ্ম বা বর্ষায় অধিক সম্ভাবনা দুর্যোগের, সেকারণে সেসময় সমুদ্রযাত্রা না করাই শ্রেয়, কিন্তু অদৃষ্ট প্রতিকুল হলে মানুষ কি করতে পারে?’
‘প্রার্থনা করি আপনার আশঙ্কা সত্যি না হোক’।
‘আমিও তাই চাই কুমার’।
দিনান্তের ক্ষয়িষ্ণু আলোয় পশ্চিম দিগন্ত কুঙ্কুম রাঙ্গা, সূর্য গোলক লুকোচুরি খেলছে মেঘের পরতে পরতে। পাটাতনে দাঁড়িয়ে মুগ্ধনয়নে চেয়ে আছেন কুমার প্রতিদিনকার মত, রোজই দেখেন সূর্যাস্ত, তবু পুরোনো হয় না সে। প্রতিদিনই যেন এক নতুন চিত্র আঁকা হয় আকাশের বৃহৎ অঙ্কনপটে।
‘রোজ এত কি দেখ কেতু?’ উল্মুক পাশে এসে দাঁড়ান।
‘দেখি এই অপূর্ব চিত্রকলা’।
‘কিন্তু সূর্যাস্তই কেন, প্রভাতের প্রথম কিরণ সে তো নতুন আশার প্রতীক। দিনান্তের নিভে আসা আলো যেন অন্তিম ক্ষণের প্রতিচ্ছবি’। বলতে বলতে কন্ঠস্বর কেঁপে যায় উল্মুকের।
‘মিত্র, আদি থাকলে অন্তও থাকবে, এই-ই ধ্রুব সত্য। কিন্তু সেই সত্যকে প্রাধান্য দিয়ে জীবনের আর একটি সত্যকে ভুলে থাকা কি ঠিক?’
‘কি সে সত্য?’
‘‘চরন বৈ মধু বিন্দতি
চরন স্বাদু মুদাম্বরম
সূর্যস্য পশ্য শ্রেমাণম যো ন
তন্দ্রয়তে চরন।
চরৈবেতি চরৈবেতি।।
চলাই অমৃত, চলাই অমৃতফল,
সূর্য্য সদা সচল, সেকারণেই তিনি সদা উজ্জ্বল।
অতএব, এগিয়ে চল।।’
উল্মুক নিশ্চুপ হয়ে থাকেন।
‘তুমি সূর্যাস্তের কথা বলছিলে? সূর্য্য নিত্য অস্ত যান আবার পরদিবসে উদয় হবেন বলে, এতো জীবন চক্রের অংশ। এই কুঙ্কুমরাগ মাখা গোধূলি, সে তো দিবসের সবচেয়ে মধুরক্ষণ; এই স্বর্গীয় সুষমায় সমস্ত জগৎ মায়াবী।‘
‘কক্ষ থেকে বের হবেননা কেউ, পাটাতনে আসা নিষেধ, নৌধ্যক্ষের পরবর্তী নির্দেশ না মেলা অবধি সকলকেই গৃহবন্দী থাকার অনুরোধ’, যানের পাটাতন ও কক্ষে কক্ষে পৌঁছে যায় এ বার্তা রাতের আহার শেষ হবার কিছু পরে। বাইরে তখন নিকষ অন্ধকার, বাতাসহীন রূদ্ধ পরিবেশ, নৌযান থেমে গেছে, বটবস্ত্র নামিয়ে নেওয়া হয়েছে। শঙ্খধ্বনিতে বার্তা চলাচল করে তিনটি যানের মধ্যে, চেষ্টা এই যেন একে অন্যের থেকে দূরে সরে না যায় তারা কেউ, বিপদকালে একতাই বল।
রাত্রি তখন গভীর, আচমকা দুলে ওঠে পালঙ্ক, কক্ষের বস্তুসামগ্রী স্থানচ্যূত হয়ে ছড়িয়ে পড়ে এদিক ওদিক। ভীষন আশঙ্কায় চমকে উঠে বসেন দুই মিত্র, ‘অনঘবর্মার আশঙ্কাই সত্যি হোল দেখছি’, পুষ্পকেতু স্বগোক্তি করেন।
‘জানালার কপাট খুলে দেখব একবার?’ উল্মুক কৌতুহল দেখান।
‘সে চেষ্টাও কোর না, বরং উত্তরীয় দিয়ে পালঙ্কের সাথে নিজেদের বেঁধে ফেলি এসো’। কথামত দুজনেই পালঙ্কের খুঁটির সাথে তাড়াতাড়ি নিজেকে বাঁধতে থাকেন।
বাইরের প্রলয় ঝঞ্ঝা বাতাসের উদগ্র উল্লাসে আছড়ে পড়ে নৌযানের উপর সর্বশক্তি দিয়ে, মনে হয় কর্ণকুহর বিদীর্ন হবে, বমনেচ্ছা তীব্র হয় দুলুনির তীব্রতায়, দুজন দুজনের বাহূস্পর্শ করে বসে থাকেন বুঝিবা অনন্তকাল। এভাবে কতসময় চলেছে জানতে পারেননা, তবে অতি ধীরে কম্পন কমে আসে, বাতাসের শব্দ ছাপিয়ে শোনা যায় নাবিকদের চিৎকার।
ক্ষীণ রক্তিম আভা জানালার কপাটের সুক্ষ ফাঁক দিয়ে কক্ষে প্রবেশ করে এক চিলতে মুছে আসা কুঙ্কুম রেখার মত; তবু সেটুকু রশ্মিই বয়ে আনে আশার বার্তা; পাষাণভার নেমে যায় বক্ষ থেকে। ‘আজ বুঝেছি কেতু, জীবন অমূল্য, আশাহীন দিনযাপনে তাকে ক্ষয় করা পাপ’, মিত্রকে গভীর আবেগে জড়িয়ে ধরেন উল্মুক’।
‘ক্ষয়ক্ষতির হিসাব না পেলে বিপদ কেটেছে কিনা বোধকরি জানা যাবেনা বন্ধু; তবু সমুদ্রে তলিয়ে যাইনি এইবা কম কিসে’, পুষ্পকেতু মন্তব্য করেন। কিছু পরে বাইরে থেকে ঘোষণা শোনা যায়, ঝড় কেটেছে।
সকলেই একে একে কক্ষ থেকে বেরিয়ে পাটাতনে উপস্থিত হন, সকলের নিদ্রাহীন মুখচোখে এতক্ষনে স্বস্তির ছাপ জেগেছে। ধূর্জটিদেব প্রৌঢ় ব্রাহ্মণ, তাঁকেই সবচেয়ে বেশী বিদ্ধ্বস্ত দেখায়; তবু একাগ্রচিত্তে তিনি দেবী তারার অর্চনায় মন্ত্রচ্চারণ করে চলেছেন পূর্বমুখে দাঁড়িয়ে; দেবী তারা অর্ণবযাত্রায় প্রলয়কালের রক্ষাকারী দেবী। শশক অনঘবর্মা নাবিকদের সঙ্ঘবদ্ধ করে প্রয়োজনীয় নির্দেশ দিতে ব্যস্ত, পুষ্পকেতু তাঁর কাছে গিয়ে দাঁড়ান।
‘ক্ষতির আশঙ্কা কতখানি ভদ্র?’ প্রশ্ন করেন তিনি।
‘বস্তুগত ক্ষয়ক্ষতি তেমন বিশেষ নয়, তবে বিপদ ঘটেছে অন্যদিকে। তিনটি নৌবহর ছত্রভঙ্গ হয়েছে, আমাদের যানটি দিকভ্রষ্ট, একাকী এই মূহূর্ত্তে।‘ ঠিক সেই সময় কূপদন্ডের উপর থেকে দিশারু জানায় তার দৃষ্টিপথে কোনও অর্ণবযান চোখে পড়ছে না।
‘তাহলে উপায়?’
‘উপায়, আর কি, মচ্ছযন্ত্রের নির্দেশ অনুযায়ী দক্ষিণপূর্ব দিশায় পাড়ি দিতে হবে, এভাবে থেমে থাকলে, পানীয়জলের অভাব ঘটবে কিছুদিনেই। যদি পথ ঠিক থাকে, আগামী সাত দিনে নারিকেলদ্বীপে পৌঁছানো সম্ভব, আর সেখান থেকে আরো অর্ধপক্ষকালে কটাহ বন্দর।‘
‘নারিকেলদ্বীপে নোঙ্গর করবেন কি পোত?’
‘না সেখানে উপযুক্ত বন্দর নেই, আদিম বনমানবের বাসস্থান সে দ্বীপে, নারিকেল বন আর শূন্য বেলাভূমি’।
‘শূন্য বলেই কি সভ্যতার করস্পর্শ পড়েনি সেখানে?’ পুষ্পকেতু প্রশ্ন করেন।
‘একথা সত্য কুমার; লুন্ঠন করার মত সম্পদ থাকলে সভ্যমানব থাবা বসাতে ভুলত না সেখানে’, হেসে উত্তর দেন অনঘবর্মা। তাঁর আচরণে প্রকাশ না পেলেও তিনি যে অতিমাত্রায় চিন্তিত বর্তমান পরিস্থিতিতে, পুষ্পকেতু উপলব্ধি করেন।
ক্রমে দিনের আলো উজ্জ্বল হয়, চারিদিক আগের মত শান্তিময়, শুধু বাকি দুটি বহিত্রের দেখা মেলেনা কোথাও। দিশারু বারে বারে কূপদন্ডে আরোহন করেও আশার কথা শোনাতে পারেনা। শঙ্খধ্বণিও ফিরে ফিরে আসে বাতাসে। অনঘবর্মা বারে বারে দিকনির্ণয়ে বসেন, এতটুকু গণনার ভুলে দিকভ্রান্তির সম্ভবনা, এই অনন্ত সিন্ধুতে ঘুরে মরতে হবে তাহলে অন্তিমকাল অবধি। তিনদিন কেটে যায়, স্বাভাবিক নিয়মে পানাহার, নিত্যকর্ম করে চলে সকলেই, তবু শান্তি নেই কারো মনে।
তপ্ত মধ্যাহ্ন, সূর্যের প্রখরতায় বাইরে থাকা আরামদায়ক নয়; নৌযাত্রীরা নিজের নিজের কক্ষে বিশ্রামরত। হঠাৎ দুলে ওঠে কক্ষ, তবে এযেন এক প্রচন্ড ধাক্কা, ঝঞ্ঝাপ্রবাহের থেকে অন্যরকম এ আঘাত। বিশ্রামকক্ষে পুস্তকে মনযোগী ছিলেন পুষ্পকেতু, সচকিত হয়ে উঠে দাঁড়ান, বিশ্রামরত উল্মুককেও জাগিয়ে তোলেন দ্রূত।
‘কি ও?’
‘বুঝতে পারছি না’।
‘বাইরে যাবে কি?’ উত্তর দেবার আগেই কোলাহল ভেসে আসে খোলা পাটাতন থেকে। ইতিমধ্যে আরো এক ভীষণ ধাক্কায়, টাল খেয়ে সামলে নেন দুই বন্ধু।
‘এভাবে বসে থাকা যায়না, চল দেখি’, পুষ্পকেতু প্রস্তাব করেন। অতঃপর দুজনে তাড়াতাড়ি পাটাতনের দিকে রওয়ানা হন।
সেখানে জনা দশেক নৌসেনানী কোমরে রশি বেঁধে নিজের নিজের দেহ পাটাতনের খুঁটির সাথে বাঁধতে ব্যস্ত। বহিত্রের দক্ষিণদিকের জলরাশি উত্তাল, যেন ভূকম্প ঘটেছে সিন্ধুবক্ষে, দেখতে দেখতে আবার ধাক্কা, এতক্ষণে যেন দুটি আগুনের ভাঁটা জলের উপর ভেসে উঠে তলিয়ে গেলো নিমেষে।
‘জলদৈত্য!’ বিস্ময়ে উচ্চারণ করেন উল্মুক।
‘দৈত্যাকার কূর্ম, সমুদ্রের বিভিষিকা!’ পিছন থেকে মন্তব্য করেন চতুর্ভুজ।
এতক্ষণে সেনানীদের হাতে উঠে এসেছে তীক্ষ্ণ বল্লম, তবে এ অস্ত্র সাধারন বল্লমের থেকে কিছু আলাদা। এর দন্ডের অংশটি অত্যন্ত দীর্ঘ, প্রায় দশ হাত। এবার তারা বল্লম তাক করে জলতরঙ্গ লক্ষ্য করে। ইতিমধ্যে আবার উত্তাল হয় সমুদ্রবক্ষ, এভাবে বারংবার আঘাতে যানের নাবতলের সমূহ ক্ষতির আশঙ্কা। কিন্তু জলজীবের দেখা মেলে না, ফলে বল্লম হাতে চলতে থাকে ধৈর্য্যের পরীক্ষা।
অবশেষে কয়েক লহমার জন্যে দেখা দেয় সেই ভীষণ চক্ষুদ্বয় আর একবার, একসাথে দশটি বল্লম ছুটে যায় লক্ষ্যে। জলদৈত্য বুদ্ধিমান, নিমেষে তলিয়ে যায় সে গভীরে, প্রায় সবকটি বল্লমই লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়েছে বোঝা যায়, শুধু তারমধ্যে দুখানি সম্ভবত মস্তক ছুঁয়েছে দানবের, পাটল বর্ণ হয়ে ওঠে জল। নতুন উৎসাহে সেনাদল আবার তৈরী হয় বল্লম হাতে; কিন্তু এবার আঘাত আসে যানের সামনে থেকে। আঘাতের আকস্মিকতায়, একটি কূপদন্ড ক্ষতিগ্রস্ত হয়, তার একাংশ ভেঙ্গে পড়ে মাথায় আঘাত পায় পাটাতনে দাঁড়িয়ে থাকা এক কর্মী। জায়গা বদল করতে সময় দরকার, ততক্ষণে আবার আঘাত আসে সামনে থেকে; এরই মধ্যে এক নবীন সেবক, সবচেয়ে উঁচু কূপদন্ডটিতে দ্রূত আরোহন করে, উচ্চতা থেকে জলতরঙ্গ দেখে দানবের গতিপথের অনুমান করতে চেষ্টা করে সে। তার নির্দেশ মেনে নতুন উৎসাহে শুরু হয় বল্লম ছোঁড়া। অবশেষে, বহুক্ষণ লড়াইয়ের পর ক্লান্ত জীবটির গতি কমে আসে, বারেবারে তার মস্তক জলের উপর দেখা দিতে থাকে। এরপর লক্ষ্যভেদ সহজ হয়, বল্লমবিদ্ধ হয়ে সলিল সমাধি ঘটে দানবের, রূদ্ধশ্বাস অপেক্ষার পর নিশিন্ত হন যাত্রীদল অবশেষে। নবীন সেবকটিকে আবেগে আলিঙ্গন করেন স্বয়ং অনঘবর্মা।
‘এবারের যাত্রা বড় বিঘ্নময়’, চিন্তান্বিত কন্ঠে স্বগোক্তি করে ওঠে এক নাবিক।
‘চুপ কর! এরকম চিন্তা নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে সকলের মনে’, ধমকে ওঠে দিশারু শুদ্রক।
***
কেটে গেছে আরও দুটি দিন, দেখা মেলেনি বাকি দুটি যানের, অনঘবর্মার চিন্তাক্লিষ্ট মুখে আশঙ্কার মেঘ; ঘন ঘন মচ্ছযন্ত্র বিচার করেন তিনি ঘুরে ফিরে। সেদিন সন্ধ্যা নেমেছে, তাঁর সাথে পাটাতনে দাঁড়িয়ে পুষ্পকেতু, দুজনেই অন্যমনস্ক নিজ নিজ চিন্তায়।
‘কি মনে হয় ভদ্র, আমরা দিকভ্রষ্ট না অন্যদুটি যান?’
‘বলা শক্ত কুমার, গণনার সামান্য হেরফেরে একে অন্যের থেকে বিচ্যুতি অস্বাভাবিক নয়, তবে অনেকগুলি দিন কেটে গেলো, আশঙ্কা সেখানেই’।
‘নারিকেলদ্বীপ, তার আর কতদূর?’
‘আমার হিসাব মত দু একদিনের পথ; অবশ্য নিজের গণনা বিদ্যায় আস্থা রাখা দুস্কর হচ্ছে ক্রমে’।
‘মনে ক্ষেদ রাখবেন না ভদ্র, যা ঘটেছে তার দায় আপনার নয়’।
‘এতগুলি মানুষের প্রাণ আমার দায়িত্বে, আমারি ভুলে যদি বিনষ্ট হয় সবকিছু, খেদ সেখানেই!’, দীর্ঘশ্বাসে ভারি হয়ে ওঠে পরিবেশ।
অতি ভোরে শঙ্খনিনাদে ঘুম ভেঙ্গে যায় পুষ্পকেতুর, পাশে উল্মুক গভীর নিদ্রামগ্ন, শীতল বাতাসে কেঁপে কেঁপে ওঠে তার দেহ। পায়ের কাছে পড়ে থাকা আস্তরনটি সযত্নে তার গায়ে টেনে দিয়ে কক্ষ ত্যাগ করেন কেতু। ততক্ষণে পাটাতনে কোলাহল জেগে উঠেছে, তবে এযেন নিত্যদিনের ব্যস্ততা নয়, কিছু বিশেষ উপলক্ষ। পথে চতুর্মুখের সাথে দেখা হয় কুমারের, ‘শঙ্খধ্বনি শুনেছেন কুমার?’
‘হ্যাঁ, দিনশুরুর সঙ্কেত’।
‘না, এ ধ্বনি আমাদের বহিত্রের নয়’, কথাটি বলে অর্থপূর্ণভাবে তাকান চতুর্মুখ।
তাঁর কথা সত্য প্রমাণিত করে দূরের দিগন্তে দেখা দেয় একখানি মকরমুখী যান, তার মাগধী লাঞ্ছন ভোরের আলোয় মহিমাময়। জয়ধ্বনি জেগে ওঠে নাবিকদের উল্লাসে, ছুটে আসেন সকলেই একে একে কক্ষ ত্যাগ করে।
নারিকেলদ্বীপের ঘন সবুজ বনানী ধীরে ধীরে সরে যায় দৃষ্টিসীমার বাইরে, তৃষিত চোখে চেয়ে থাকেন কুমার সেদিকে; সুদীর্ঘ জলযাত্রায় ডাঙ্গার মানুষের কাছে স্থলের আশ্বাস বড় লোভনীয়।
‘দ্বীপটি মনে ধরেছে তোমার, থাকতে ইচ্ছা যায়?’ উল্মুক বহুদিন পরে আবার আগের মত রসিকতা করেন।
‘মন্দ কি? সভ্যতার থেকে দূরে নির্মল জীবনযাত্রা।’
‘ফেরার কালে নেমে যেও তাহলে; নারিকেল বৃক্ষতলে বনমানবীর সাথে দিব্য কাটবে জীবন, একসাথে নারিকেল কাঠির চাটাই বুনবে সুখে; চাইকি জ্যামিতিক নকশা ফুটিয়ে তুলবে চাটাইয়ের বুননে।‘
‘আমার জ্যামিতিপ্রীতি বড় বিষচক্ষে দেখেছ হে, পুস্তপালের দপ্তরই তোমার উপযুক্ত স্থান’; দুজনেই হেসে ওঠেন পুরোনো রসিকতায়।
***
‘কটাহ এখনও প্রায় দশ বারো দিনের পথ, এখন যাত্রা বিঘ্নহীন হলেই শান্তি’, উল্মুক ও চতুর্মুখ মল্লক্রীড়ার বিরতির মধ্যে বাক্যালাপে ব্যস্ত।
‘বিঘ্ন কেবল প্রাকৃতিক দূর্যোগেই ঘটেনা ভদ্র উল্মুক, দীর্ঘযাত্রায় মানসিক অবসাদে ভোগে নাবিকেরা প্রায়শঃই, তাদের অন্তর্কলহ ভীষণ আকার নেয় অনেকক্ষেত্রেই।‘
‘আপনি পূর্বে কখনও সমুদ্রযাত্রা করেছেন ভদ্র?’
না, সে সৌভাগ্য ঘটেনি, এর আগে’, হেসে উত্তর দেন চতুর্মুখ।
‘পুষ্পকেতুর মত আপনারও দেখেছি বিভিদ বিষয়ে অশেষ জ্ঞান; রাজকার্যের কোন দপ্তরে আপনি নিযুক্ত জানতে পারি কি?’
‘না, আর সব বলা চলে, শুধু সেটুকুই বলা চলে না, আমাকে ক্ষমা করবেন ভদ্র। ধরে নিন মগধ ভূখন্ডের আভ্যন্তরীন সুরক্ষার আমি এক সামান্য প্রহরী’, এর পর কথা এগোয় না আর, দুজনে আবার মেতে ওঠেন মল্লযুদ্ধে। চতুর্ভুজ বলশালী ব্যক্তি, বয়সে নবীন হলেও উল্মুকেরই হার হয় বেশীরভাগ সময়ে।
‘ভদ্র চতুর্ভূজ সম্পর্কে তোমার কি ধারণা কেতু?’ সেদিন সন্ধ্যাকালে বিশ্রামকক্ষে পাশা খেলছেন দুই মিত্র।
‘অতিশয় বুদ্ধিমান ও কর্মপটু’।
‘শুধু এই?আর কিছু মনে হয় না দেখে?’
‘তুমি ঠিক কি বলতে চাইছ বুঝেছি, চতুর্ভূজ কিছু রহস্যময়, অত্যন্ত মিশুকে, তবু কোথায় যেন নিজেকে আড়াল করে রাখেন লোকচক্ষু থেকে।‘
‘কোন দপ্তরে কর্ম করেন জানতে চাওয়ায় কোনও সদুত্তর দিলেন না আজ’, উল্মুক বোধকরি কিছুটা ক্ষুব্ধ এনিয়ে।
‘ওঃ এই কথা! তুমি বোঝনি কিছু?’
‘কি বুঝিনি?’
‘তিনি সম্ভবত মাগধী গুপ্তচর, পরিচয় গোপন রাখাই এঁদের মন্ত্রগুপ্তি’।
‘সেকি, কিন্তু সমুদ্রযাত্রায় গুপ্তচর কি কারণে!’ বিহবল হয়ে পড়েন উল্মুক মিত্রের ইঙ্গিতে।
‘আমাদের কাছে এই যাত্রা নেহাত অভিযান, বাকী সকলের কাছে নয়; রাজকার্যে সতর্কতা বাঞ্ছনীয়, সেকারণেই চতুর্ভূজ। তবে একথা পাঁচকান না হলেই মঙ্গল, আর কারো সাথে বার্তালাপ কোর না এ বিষয়ে।‘
‘বিগত যাত্রার নিরিখে এইবারের জলযাত্রায় কিরকম বোধ করছেন ভদ্র?’ এক অলস অপরাহ্নে দেবদত্তকে প্রশ্ন করেন পুষ্পকেতু প্রমোদ কক্ষে।
‘এখনি কিছু বলা কঠিন কুমার, আমার পূর্ব অভিজ্ঞতা তো আপনি জানেন!’
‘সঙ্কট এখনও কাটেনি বলছেন?’
‘কাটিগারে পদার্পন না করা অবধি বলব সঙ্কট কাটেনি।‘
‘আপনি তো বিগত যাত্রায় তক্কোল বন্দরে গিয়েছিলেন? সে কেমন জায়গা?’
‘নাম মাহাত্ম মেনে সুবিশাল তেজ পাতার বন বন্দর সংলগ্ন সমুদ্রতটে, বিদেশী বণিকের আনাগোনায় ব্যস্ত জনপদ। তবে বিগত যাত্রার কথা থাক কুমার, এখন নতুন দিনের আশায় বুক বেঁধে আছি; কটাহতে বিক্রয় করব পণ্য, ফেরার কালে সাথে নেব উত্তম মশলা, এর বেশী কিছু ভাবিনা আমি’। সেই মূহুর্ত্তে উল্মুক ও চতুর্মুখ এসে যোগ দেন, প্রসঙ্গ পরিবর্তন ঘটে এরপরে।
***
এভাবেই কেটে যায় দিন, শুক্লপক্ষের চন্দ্রমা পূর্ণতা পায় ধীরে ধীরে, প্রায় একমাসকাল হোল সমুদ্রযাত্রা শুরু হয়েছিল তাম্রলিপ্ত থেকে। যাত্রার ক্লান্তি করায়ত্ত করেছে যাত্রীদের সকলকেই, এখন শুরু হয়েছে উন্মুখ প্রতীক্ষা, কবে চোখে পড়বে বন্দরের বেলাভূমি।
‘দেখা দিয়েছে, ওই পূর্বদিগন্তে!’, একদিন অপরাহ্নে দিশারু শুদ্রক সংকেত বাক্যে খবর দেয় কূপদন্ডের উপর থেকে।
‘কি দেখা দিয়েছে? বেলাভূমী?’ উল্মুক আগ্রহের আতিশয্যে প্রশ্ন করেন অনঘবর্মাকে।
‘আপনি বোধ করি কিঞ্চিত অধিক উতলা হয়ে পড়েছেন ভদ্র, দেখা দিয়েছে কটাহ শিখর। এই পর্বতচূড়ায় প্রতিরাতে জ্বলে অগ্নিকুন্ড, তারই আলোক দেখে পথ চিনে নেয় সমুদ্রযান, কটাহ বন্দর আর দেরী নেই, মাত্র একদিনের পথ’।
শুরু হয়ে যায় সাজো সাজো রব, সেবকেরা ব্যস্ত হয়ে পড়ে নিজের নিজের প্রভুর তোরঙ্গ ও প্রয়োজনীয় সামগ্রী গুছিয়ে নিতে, বন্দরে কাটাতে হবে বেশ কিছু দিন, সেখানে আরামের অভাব না ঘটে। যাত্রীদের মনেও নতুন উত্তেজনা, বহুদিন পরে আবার স্থলে পা রাখবেন সকলে, যেন সেটাই সবচেয়ে বড় প্রাপ্তি এই মূহুর্ত্তে। নাবিকেরাও আনন্দিত, একেকটি যাত্রার শেষে তারা কৃতজ্ঞতা জানায় ঈশ্বরকে, তাদের এই ভাসমান জীবনের প্রতি পদেই যে লুকিয়ে থাকে অজানা বিপদ।
পরেরদিন অপরাহ্নের নরম আলোয়, অবশেষে নিকটবর্তী হয় স্বর্ণাভ বেলাভূমী, দূর থেকে দেখা যায় অসংখ্য পণ্যবাহী নৌকা ভীড় করে আছে বন্দর সংলগ্ন তটে। ব্যস্ততাময় প্রাচীন কটাহ বন্দর যেন দুহাত বাড়িয়ে স্বাগত জানায় দূরের পথিককে সাদর আগ্রহে।
*** ***
বিঃদ্রঃ উপন্যাসে ছবি ব্যবহার করা হয়েছে কেবল দৃশ্যসুখের জন্যে…