সুবর্ণভূমে পুষ্পকেতু

ষষ্ঠ পর্বের পর…

অনন্যা পাল

শৈলদেশ

প্রভাতের সূর্যরশ্মিতে সুবিস্তৃত বালুকাবেলা বহিত্র থেকে স্বর্ণসুতার মত প্রতিভাত হয়; নিকটেই কাটিগার বন্দর, অধীর আগ্রহে অধিকাংশ যাত্রী জড় হয়েছেন উন্মুক্ত পাটাতনে। বেলাভূমি কিছুটা দূরে থাকতে কয়েকটি ছোট ছোট তরণী এগিয়ে আসে নৌবহরের দিকে, তাদের কূপদন্ডে নাগচিহ্ন দেখে বোঝা যায় সেগুলি রাজকীয় নৌবাহিনীর অঙ্গ। এর মধ্যে একটি থেকে দূত নেমে আসে দন্তিবর্মার সাথে সাক্ষাতের উদ্দেশ্যে; তার কাছে জানা যায়, মহারাজ চন্দ্রদমনের শ্যালক উদয়বর্মা ও পুত্র অভিরাজ কাটিগারে এসেছেন মগধ প্রতিনিধিদের স্বাগত জানাতে। মাগধী নৌকা মূল বন্দরে নয়, বেলাভূমির পৃথক অংশে নোঙ্গর করার ব্যবস্থা হয়েছে, রাজন্যবর্গ সেখানেই অপেক্ষায় আছেন বিগত কয়েকদিন যাবৎ। কটাহ থেকে আগত পণ্যবাহী বহিত্রগুলির মাধ্যমে মাগধী নৌবহরের গতিবিধির সংবাদ পৌঁছেছে এখানে নিয়মিত, সেই ভিত্তিতেই সম্ভাব্য আগমনকাল অনুমান করে এই ব্যবস্থা।

নির্জন বেলাভূমির উপর স্বর্ণালী কারুকার্যময় কাষ্ঠতোরণে নয়মাথাযুক্ত বাসুকী নাগের ফণা যেন সমগ্র ভূখণ্ডের উপর প্রতিপত্তির প্রখর ঘোষণা। তোরণের প্রবেশ পথে হাতির পৃষ্ঠে অপেক্ষায় আছেন কুমার উদয় বর্মা, তিনি শৈলদেশের স্থলসেনার অধিনায়ক, তাঁর সাথে একই বরণ্ডকে বসে রাজকুমার অভিরাজ। সমুখে সারিবদ্ধভাবে দাঁড়িয়ে একশত পদাতিক সৈন্য, তাদের বক্ষে বেতের বর্ম, হাতে সুতীক্ষ্ণ বর্শা; সেনাবাহিনীর সমুখে মকরচিহ্ন যুক্ত ধ্বজাধারী সৈনিক ও কয়েকজন ভেরীবাদক, মকরচিহ্ন সেনাপতির নিজস্ব কেতন।

ধূর্জটিদেবের নেতৃত্বে, শৈলদেশের একখানি বহিত্র থেকে বেলাভূমিতে পা রাখেন রাজপুরুষদের ছোট দল খানি; দুন্দুভি নিনাদে স্বাগত জানান হয় তাঁদের, হস্তিপৃষ্ঠ থেকে নেমে এগিয়ে আসেন উদয় বর্মা ও রাজকুমার। উদয়বর্মা মধ্যবয়সী পুরুষ, গাত্রবর্ণ ও মুখশ্রীতে আর্যরক্তের প্রভাব স্পষ্ট, তিনি বলিষ্ঠ ও তেজদৃপ্ত, তবে উচ্চতা আর্যবংশীয়দের তুলনায় কম, সেটিই তাঁর মিশ্ররক্তের পরিচায়ক। রাজকুমার অভিরাজ নিতান্ত বালক, বয়স নয়-দশের বেশী নয়, তার সুকোমল মুখশ্রী ও ঘনপল্লবযুক্ত দুটি চোখ ভারি মায়াময়, একবার দেখলে তাকিয়ে থাকতে মন চায়। প্রাথমিক অভিবাদন বিনিময় শেষে নিকটের অস্থায়ী শিবিরের দিকে রওয়ানা হন সকলে; মাগধী রাজপুরুষদের জন্য চতুর্দোলার ব্যবস্থা করা হয়েছে এই নাতিদীর্ঘ পথ পেরোনোর উদ্দেশ্যে।

‘এখানে দুইদিন বিশ্রামের পরে, আমরা রাজধানী ব্যাধপুরের উদ্দেশ্যে যাত্রা করব; ব্যাধপুর জলপথে এখান থেকে পাঁচদিনের পথ। অবশ্য, আচার্য যদি অধিক বিশ্রামের প্রয়োজন অনুভব করেন, যাত্রা বিলম্ব করা চলবে।‘ উদয়বর্মা বক্তব্য রাখেন মধ্যাহ্নভোজনের সময়।

‘এখানে অধিক বিলম্বের প্রয়োজন দেখিনা, যতশীঘ্র সম্ভব ব্যাধপুর উপনীত হতে পারলেই মঙ্গল; সঙ্গে আহত যাত্রী রয়েছে, অনঘবর্মা এখনও অশক্ত, এঁদের যথাযথ চিকিৎসার প্রয়োজন।‘ ধূর্জটিদেবের কন্ঠস্বরে উদ্বেগ প্রকাশ পায়।

‘আপনি, নিশ্চিন্ত থাকুন দেব, মাগধী চিকিৎসকদের তত্বাবধানে আহতদের কালকেই দ্রূতগামী নৌকায় যাত্রার ব্যবস্থা করেছি আমি। রাজকীয় বহ্নিগৃহে শুশ্রুষার কোনও রকম ত্রুটি হবেনা তাঁদের।‘

‘জলপথ ভিন্ন কি রাজধানী যাত্রার অন্য উপায় নেই?’ পুষ্পকেতু জানতে চান, এতদিনের জলযাত্রার পর আর নৌকাযাত্রায় আগ্রহ বোধ করছেননা কেউই, স্পষ্ট হয় সে মনোভাব।

‘হস্তিপৃষ্ঠেও যাওয়া চলে, তবে পার্বত্য পথ, শ্বাপদসঙ্কুল ও দুর্গম, জলপথই নিরাপদ ও আরামদায়ক।‘ উদয়বর্মা মৃদু হেসে উত্তর দেন।

***

‘শ্যালক মহাশয় বেশ সদাশয় ব্যক্তি, কি বল? আহার ও বিশ্রামের যে প্রকার বন্দোবস্ত করেছেন এই নির্জন উপকুলে, সে বড় কম কথা নয়!’ উল্মুক আহারের পর কক্ষের একান্তে মন্তব্য করেন।

‘আজকের আহারের তালিকায় বহূদিন পরে নদীর মৎস্য আর টাটকা তরী তোমার হৃদয় জয় করেছে সন্দেহ নেই; তবে হ্যাঁ উদয় বর্মা দক্ষ ব্যক্তি সে বিষয়ে আমি একমত।‘ পুষ্পকেতু সাড়া দেন।

‘শৈলরাজ তেমন বয়স্ক ব্যক্তি নন বোধ করি’।

‘একথা বলছ কেন?’

‘রাজকুমার তো নেহাতই ছেলেমানুষ’।

‘অভিরাজ তাঁর প্রথম সন্তান এমনটা ভাবার কারণ নেই’।

‘কিন্তু, শুনলাম অভিরাজ মহারাজের জ্যেষ্ঠ্যপুত্র, এর পরেরটি আরো শিশু’।

‘জ্যেষ্ঠ্যপুত্র হলেই জ্যেষ্ঠ্যসন্তান হতে হবে কি? কন্যাও তো থাকতে পারে?’ পুষ্পকেতু রসিকতা করে মন্তব্য করেন।

‘তা বটে! এদিকটা ভেবে দেখিনি’, উল্মুকও রসিকতার উত্তরে মুখভঙ্গী করেন, দুজনেই হেসে ওঠেন তাতে।

‘ওহে দ্বৈরথ!’ উল্মুক সেবককে স্মরণ করেন, ইচ্ছা গুরুভোজনের পরে আজ তাম্বুল সেবন করবেন। কিন্তু, কয়েকবার ডেকেও দ্বৈরথের দেখা পাওয়া যায়না, পরিবর্তে শিবিরের প্রবেশপথের বাইরের খোলা অঙ্গন থেকে বিচিত্র শব্দ কানে আসে। কৌতুহলী হয়ে তিনি পরিবস্ত্র সরিয়ে বাইরে গিয়ে দাঁড়ান। সেখানকার দৃশ্য দেখে চমৎকৃত হতে হয়। খোলা ভূমিতে ধী লম্ফ ঝম্ফ করে নানান কসরৎ দেখাচ্ছে, আর নিকটে দাঁড়িয়ে শিশু রাজকুমার মুগ্ধচক্ষে তাই পর্যবেক্ষণ করছেন ও থেকে থেকে করতালি দিয়ে উঠছেন খুশিতে। এতে ধীয়ের উৎসাহ আরো দ্বিগুন হয়ে উঠছে, সে বিচিত্র মুখভঙ্গী করছে শিশুর মনরঞ্জনে। তবে শুধু শিশুটিই নয়, দ্বৈরথ ও রাজকুমারের একান্ত সেবকও তার কাণ্ড দেখে হেসে লুটোপাটি যাচ্ছে।

‘বিস্মিত হয়োনা বন্ধু, সুবর্ণভূমি আর্যাবর্তের আর সকল প্রথা আপন করে নিলেও বর্ণ বৈষম্যকে প্রাধান্য দেয়নি; নাহলে আটবিক কিশোরের সাথে রাজপুত্রের এমন সহজ মেলামেশা সম্ভব হোত না’, পুষ্পকেতু পিছন থেকে বলে ওঠেন।

***

শৈলদেশের রাজকীয় বহিত্রগুলি প্রায় ষাট হাত লম্বা, মাগধী নৌকার তুলনায় নগন্য হলেও যথেষ্ট আরমদায়ী। তরণীর সমুখভাগ নাগমুখী এবং পিছনের  অংশ সর্পপুচ্ছের আকৃতি, সব মিলিয়ে যেন এক একটি বৃহৎ জলচারী ভূজঙ্গ। কাটিগার থেকে জলপথে ব্যাধপুর ত্রিশ যোজন পথ; শৈলবতী রাজ্যের অন্যতম প্রধান নদী, তার পার্বত্য গতিপথে নদীবক্ষ কোনও কোনও স্থানে অগভীর ও পাথুরে, ফলে সাবধানে জলস্রোতের মধ্যস্থল বেয়ে তরণী সঞ্চালন করতে হয়, নাওয়ের গতিও সংযমে রাখতে হয় সেকারণে। নদীবক্ষ তেমন বিস্তৃত নয়, নৌকা পাটাতন থেকে দুপাশের শ্যমল বৃক্ষসারী চোখে পড়ে সহজেই। প্রায় সমগ্র পথ বেয়েই দুপাশে ঘন অরন্যানী, আর তার পিছনে অতন্দ্র প্রহরীর মত পর্বতের সারী। সে পর্বত সকল স্থানে সমান উচ্চতার নয়, তবে পর্বতগাত্র সবক্ষেত্রেই শ্যামলিমাময়; জলপথে নৌকার সাথে সাথে পাহাড়ের এই পথ চলা যেন কোনও অভিভাবকের নীরব প্রহরা।

কুমার উদয়বর্মার সঙ্গী হিসাবে অভ্যর্থনা দলে ছিলেন এক যুবক, তিনি মহারাজ চন্দ্রদমনের সভাসদ, নাম মকরধ্বজ; কয়েক বছর আগে একটি বাণিজ্য নৌবহরের সাথে কলিঙ্গ থেকে কাটিগারে আসে তিনি ভাগ্য সন্ধানে। মকরধ্বজ জাতিতে ব্রাহ্মণ, শিক্ষিত মেধাবী যুবক, সেকারণে শৈলরাজের আনুকুল্য লাভে সময় লাগে নি। তিনি মাগধী রাজপুরুষদের সাথে এক নৌকায় চলেছেন; আন্তরিক স্বভাবের গুণে পুষ্পকেতু ও উল্মুকের সাথে বন্ধুত্ব হয়েছে সহজেই, দিনের অনেকটা সময় এঁরা একসাথেই কাটান এই ক্লান্তিকর জলযাত্রায়।

‘নিজ ভূমি ছেড়ে এই পরবাস ভালো লাগে আপনার? দেশের চিন্তা মনে আসে না?’ একান্ত আলাপচারিতার মুহূর্তে মকরধ্বজকে প্রশ্ন করেন উল্মুক এক নিভৃত অপরাহ্নে।

‘আজকাল আর পরবাস বলে বোধ হয় না তেমন; তাছাড়া কলিঙ্গে কেউ বসে নেই আমার অপেক্ষায়। গুরুকুল ত্যাগের পরে শাস্ত্র চর্চায় দিন যেত, জমিজমা ছিল কিছু; সংসারে থাকার মধ্যে বিধবা মাতা। দেশ দেখার সুপ্ত বাসনা ছিল অনেককালের, তাই মাতৃবিয়োগ হতে সম্পত্তি বিক্রয় করে পাড়ি দিলাম অজানার পথে। প্রথমে কিছুকাল তাক্কোল বন্দরে কাটিয়ে, শেষে উপস্থিত হলাম শৈলদেশে। এরাজ্যে বিদ্বানের ভারি কদর, বিশেষত আর্যাবর্তের ব্রাহ্মণ হলে তো কথাই নেই, তাই আপাতত এদেশেই নোঙ্গর ফেলেছি। ভাগ্যলক্ষী সুপ্রসন্না হলে, ফিরবার ইচ্ছা আছে, ততদিন এই  বা মন্দ কি?’

‘আপনি তো রাজসভার সদস্য, সেবিষয়ে কিছু জানতে আগ্রহ বোধ করছি।‘ পষ্পকেতু যোগ দেন আলোচনায়।

‘রাজসভার উচ্চ পদাধিকারীদের মধ্যে বেশ কিছ ব্যক্তি আর্য বংশোদ্ভূত; মহামাত্য দুর্জয় বর্মা রাজা চন্দ্রদমনের মতই কুষাণ দেশীয়, সম্ভবতঃ মহারাজের সাথেই এসেছিলেন এইরাজ্যে ভাগ্যসন্ধানে, এছাড়া উদয় বর্মার অনুজ ত্রিগুণবর্মা, তিনি নৌসেনার অধ্যক্ষ।‘

‘সেনাধ্যক্ষ পদে কি রাজবংশজ ব্যক্তির অগ্রাধিকার?’

‘হ্যাঁ, সঠিক বলেছেন আপনি, সুবর্ণভূমের রীতি অনুযায়ী সেনাপতির পদে সাধারণতঃ রাজকুমার অথবা রাজভ্রাতাদেরই অগ্রাধিকার। আসলে, কনিষ্ঠ কুমারেরা সিংহাসনে বঞ্চিত হলেও ক্ষমতা ও প্রতিপত্তির দিক থেকে যথেষ্ট বিশিষ্ট।‘

‘সেকারণেই কি জামাতা রাজ্য পেলেও, পুত্রদের আপত্তি থাকে না ভদ্র?’ উল্মুক জানতে চান।

‘অহোঃ, সেটা মন্দ বলেননি। আসলে সিংহাসনের অধিকারীত্বের ক্ষেত্রে এদেশে বীরত্ব, দৃঢ়তা ও সর্বজনপ্রিয়তা ইত্যাদি গুণের উপর জোর দেওয়া হয়, সর্বক্ষেত্রে রাজকুমারদের মধ্যে সেসব গুণের সমন্বয় নাও থাকতে পারে।‘

‘বর্তমানে শৈলদেশে যুবরাজ কে?’

‘মহারাজ চন্দ্রদমন মধ্যবয়স্ক ও সুস্বাস্থ্যের অধিকারী, তাছাড়া অভিরাজ এখনও শিশু; সেকারণেই বোধহয় রাজন নিজ উত্তরাধিকারী হিসাবে কাউকে চিহ্নিত করেননি এখনও।‘

‘এদেশে আর্যবংশদ্ভূত অনেকেই স্থায়ীভাবে বাস করেন কি? রাজআনুকুল্য থাকলে, সেরকম একটা সম্ভাবনা তো থাকেই।‘ পুষ্পকেতুর প্রশ্ন শুনে ব্রাহ্মণের ঠোঁটে মৃদু হাসি দেখা দেয়।

‘আপনি ঠিকই বলেছেন, ব্যাধপুর সংলগ্ন বেশ কয়েকটি গ্রামে আর্যশ্রেণীর মানুষ বাস করেন, তাঁরা বেশীরভাগই স্থানীয় পত্নী গ্রহণ করে পাকাপাকি ভাবে শৈলদেশ নিবাসী। আর্যবাহ্মণদের একটি সম্পূর্ণ গ্রাম আছে; এঁদের অনেকেই রাজ পরিবার ও উচ্চকুলের কন্যা বিবাহ করে বিশেষ পদাধিকারী হয়েছেন।‘

‘আশ্চর্য! রাজকুল তো ক্ষত্রীয়, ব্রাহ্মণের সাথে বিবাহ ঘটে এঁদের?’ উল্মুক বিস্ময় প্রকাশ করেন।

‘এতে অবাক হচ্ছ কেন মিত্র? আর্যাবর্ত থেকে আগত কৌন্দন্য নামের এক ব্রাহ্মণ রাজকন্যা সোমাকে বিবাহ করে এদেশের সিংহাসনে বসেন, তিনিই বর্তমান রাজবংশের প্রতিষ্ঠাতা।‘ পুষ্পকেতু উত্তর দেন।

‘তাহলে, ভদ্র মকরধ্বজের ভবিষ্যৎ অতীব উজ্জ্বল, এ আমি হলফ করে বলতে পারি’, উল্মুকের রসিকতায় রক্তাভ হয়ে ওঠে ব্রাহ্মণের মুখ, সে দেখে হেসে ওঠেন দুই মিত্র।

 

***

বেলা তৃতীয় প্রহর, সূর্য মধ্য গগনে, তারই আলোয় নগর তোরণের স্বর্ণমন্ডিত খিলান বুঝিবা লঙ্কাপুরীর কথা মনে করায়। পাকা ইষ্টকের উঁচু প্রাকারে বেষ্টিত নগরী ব্যাধপুর; তোরণের সমুখে প্রায় চল্লিশ হাত সীমানা জুড়ে প্রবেশ পথের দুধারে সমুদ্রমন্থনের ভাস্কর্য; তোরণের দক্ষিণপাশে বাসুকীর উদ্ধত ফণা ও তার পিছনে দেবসেনা, বামপাশে শ্মশ্রুগুম্ফ মন্ডিত ভয়াবহ অসুরসেনা সর্পের পুচ্ছ ধরে আছে। সবমিলিয়ে এযেন সত্যিই নাগলোকের মহিমাময় প্রবেশপথ; সমীহের সাথে শঙ্কাও জাগায় মনে।

রাজঅতিথিদের দলটিকে নিয়ে রাজপুরীর দিকে চলেছে একটি দীর্ঘ শোভাযাত্রা, তার নেতৃত্বে রয়েছেন উদয়বর্মা, রাজপথের দুধারে অস্থায়ী কাঠামো বানানো হয়েছে দূরে দূরে, সেগুলির উপর থেকে পুষ্পবৃষ্টি করছে সুন্দরী নাগরিকার দল, সাথে মঙ্গল শঙ্খধ্বনি।

‘এযে জীবদ্দশাতেই সুরলোকে এসে পড়লাম হে, অপ্সরাদেরও অভাব নেই’, জনান্তিকে বন্ধুকে উদ্দেশ্য করে মন্তব্য করেন উল্মুক।

‘মিত্র কি মকরধ্বজের মত এস্থানেই থেকে যাবার চিন্তা করছ?‘

‘আমি নগন্য মানুষ, অপ্সরাদের কৃপালাভের আশা রাখি না’।

‘আহা, অপ্সরা কেন নাগকন্যাদের সহৃদয়তা তো জুটতে পারে।‘

‘হ্যাঁ, অতি উৎসাহী হলে রমনীয় সর্পপুচ্ছের ঝাপটানিও’, উল্মুকের আপাত হতাশ মুখভঙ্গীতে কৌতুক প্রকাশ পায়।

***

রাজপুরী সংলগ্ন বিশেষ অতিথিশালায় বসবাসের ব্যবস্থা হয়েছে চতুর্ভুজ, দেবদত্ত, দধিচি ও শ্রীমন্তের। দন্তিবর্মাও যোগ দেবেন সেখানে মাগধী উপঢৌকনগুলির যথাযথ ব্যবস্থা করার পরে। মূল প্রাসাদের উদ্যান সংলগ্ন একটি অংশে আতিথ্যের আয়োজন হয়েছে মাননীয় অতিথি ধূর্জটিদেব, কুমার পুষ্পকেতু ও উল্মুকের; দ্বিতল বিশিষ্ট পুরীর উপরভাগে কয়েকটি কক্ষ শয্যামন্দির ও বিশ্রামের জন্য নির্ধারিত, তার সংলগ্ন উন্মুক্ত অলিন্দ অতি সুসজ্জিত, নীচে বহির্কক্ষ, ভোজনগৃহ ও স্নানাগার।

পথশ্রমের ক্লান্তি দূর করতে বিশদ ব্যবস্থা, আপ্যায়নের ত্রুটি নেই কোথাও; মহামাত্য দুর্জয় বর্মা স্বয়ং এসে সাক্ষাৎ করে গেছেন মহামান্য অতিথিদের সাথে, সেইসঙ্গে জানিয়ে গেছেন পরদিন সকালে রাজসভায় উপস্থিত করা হবে তাঁদের মহারাজের সাথে সাক্ষাতের উদ্দেশ্যে। বহুদিন পরে এই  নিশ্চিন্ত আশ্রয় ও গৃহসদৃশ আরামে দুই বন্ধুর রাত্রি কাটে সুখনিদ্রায়; প্রবীন আচার্য অবশ্য ততখানি নিরুদ্বিগ্ন হতে পারেননা, যে গুরুদায়িত্ব নিয়ে তিনি এসেছেন, তার যথাযথ পালন না হওয়া অবধি সুখনিদ্রার অবকাশ নেই তাঁর।

***

আয়তাকার সুবিশাল সভাগৃহটির খিলান ও স্তম্ভ স্বর্ণালী কারুকার্যে সুসজ্জিত; রক্তিম চিনাংশুকের পরিবস্ত্র শোভিত রয়েছে প্রতিটি দ্বারে, জরিদার রেশমপট্টে মোড়া সভাসদদের জন্য নির্দিষ্ট আসনের সারি; এসব থেকে শৈলদেশের ঐশ্বর্যের সম্পর্কে ধারনা করা যায় সহজেই। বন্দরশুল্ক, স্বর্ণখনি, শস্যশ্যামলা ক্ষেত্রভূমি ও প্রভূত বনসম্পদ, এগুলিই শৈলদেশের প্রাচুর্যের মূল উৎস্য। সভাগৃহের গর্ভকোটরে একখানি সুউচ্চ বেদিকায় পা মুড়ে বসে আছেন ধর্ম মহারাজা শ্রী চন্দ্রদমন, সমুখে একটি মহার্ঘ রেশম বস্ত্রের উপর একপাশে রাখা পুষ্পস্তবক ও অন্যপাশে সুগন্ধী ধূপদানি। শৈলরাজ মধ্যবয়সী এবং সুদর্শন পুরুষ, তাঁর চেহারায় আর্যাবর্তের পশ্চিমাপ্রদেশের ছাপ স্পষ্ট। তপ্ত গৌরবর্ণ, উন্নত নাসা, প্রখরদৃষ্টি, ঋজুদেহী, চন্দ্রদমন যে একজন কর্মঠ ও বিচক্ষণ ব্যক্তি, এক নজরেই তা বোঝা যায়।

দর্শনপ্রার্থী ও সভাসদ্গন হাঁটু মুড়ে জোড় হস্তে বেদিকার সমুখে সম্মান জানান নৃপতিকে, রাজসভার এটাই প্রচলিত নিয়ম। তবে মগধের সম্মানিত প্রতিনিধি, বেদজ্ঞ ব্রাহ্মণ আচার্য ধূর্জটিদেবের ক্ষেত্রে সে নিয়ম খাটে না, যদিও পুষ্পকেতু ও উল্মুককে এবিষয়ে রীতিমত প্রশিক্ষন দিয়েছিলেন দুর্জয় বর্মা সভায় প্রবেশের আগে। প্রাথমিক অভিবাদনপর্ব শেষে মগধ সম্রাটের পাঠানো উপঢৌকন উপস্থিত করা হয় মহারাজের সামনে, সেগুলি গ্রহণ করে তিনি সম্রাটের প্রতি কৃতজ্ঞতা ও আনুগত্য প্রকাশ করেন; বিশেষতঃ পারস্যদেশীয় অশ্বগুলি পেয়ে যে রাজন অতীব চমৎকৃত হয়েছেন নির্ধিধায় স্বীকার করেন সেকথা।

এরপর আলোচনা শুরু হয় বিষ্ণুমন্দিরের বিগ্রহ প্রতিষ্ঠার বিষয়ে। রাজজ্যোতিষী নক্ষত্র বিচার করে দিনস্থির করেন আগামী চৈত্রশুক্লার পঞ্চমী তিথি, মাত্র দুইমাস পরেই সে শুভদিন।

***

আচার্য ব্যস্ত হয়ে পড়েন অচিরেই উৎসব দিনের আচার অনুষ্ঠানের প্রস্তুতিতে, রাজ পুরোহিত ও রাজসভার বিশিষ্ট ব্রাহ্মণ মণ্ডলীর সাথে আলাপ আলোচনা চলে যজ্ঞ ও পূজার্চনার বিষয়ে। পুষ্পকেতু ও উল্মুক নিজস্ব ভঙ্গীতে নগর পরিদর্শন করে বেড়ান; প্রথম দিকে মহাপ্রতিহারী সঙ্গে প্রহরী দিতে চেয়েছিলেন, হস্তিপৃষ্ঠে, নচেৎ অন্তত চতুর্দোলায় ভ্রমণের ব্যবস্থা করতে উদ্যোগী হয়েছিলেন তিনি। কিন্তু দুই নবযুবকের প্রবল আপত্তিতে, সে চেষ্টা সফল হয়নি কোনও মতেই।

***

ব্যাধপুর জনপদ জুড়ে সুদৃশ্য প্রণালী, ছোট ছোট নৌকা ভেসে চলে তার জলে; প্রণালীর পাড় ঘেঁসে বাহারে বৃক্ষের সারি শোভা বাড়িয়েছে নগরী ও রাজপথের। নগরের অধিকাংশ গৃহ পোড়া ইষ্টকের তৈরী, যদিও রাজপ্রাসাদ ও অভিজাত পল্লীর গৃহগুলি মগধের মতই কাষ্ঠ নির্মিত। এদেশের মেয়েরা ভারি স্বাধীনচেতা, পুরুষসঙ্গী বিনা অবাধ যাতায়াত তাদের, দেখে চমৎকৃত হন দুই মিত্র। শুধু তাই নয়, নিজ পছন্দে স্বামী নির্বাচন করে মেয়েরা অধিকাংশ ক্ষেত্রে, অন্ততঃ মকরধ্বজ এমনটাই জানিয়েছিলেন। রাজকুলের মেয়েরাও অন্দরবাসিনী নন, রাজপুরুষদের মতই তাঁরাও হস্তিপৃষ্ঠে নগরের পথে বের হয়ে থাকেন। দেশটি সম্বৃদ্ধ, সাধারণ মানুষও সম্পন্ন গৃহস্থ, সেকারণে পরিবেশ ও আইন শৃংখলা শান্তিপূর্ণ; নাগরিকেরা সহজ সরল ও বিনয়ী। পণ্যবিপণীগুলিতে গন্ধদ্রব্য, কর্পূর, অগরু, পাথরের গহনা আদি নানান সৌখিনদ্রব্য পাওয়া যায়, কেনাবেচায় রৌপ্যমুদ্রার চল সর্বাধিক, এসব দেখে বোধ হয় লোকজন শুধু অর্থবান নয়, তারা বিলাসব্যসনেও অভ্যস্ত।

‘আর্যাবর্ত থেকে এতদূরে এমন একটি সুসভ্য দেশ আছে কল্পনাও করিনি’, নগর দর্শনকালে একদিন মন্তব্য করেন উল্মুক।

‘রাজা যদি প্রজাপালক হন, রাজকোষের সাথে প্রজার গৃহেও লক্ষীর বাস থাকে, সেরাজ্য যে স্বর্গরাজ্যে পরিণত হবে তাতে আর আশ্চর্যের কি আছে?’

‘তাহলে আর কি, বেশ কদিন স্বর্গসুখ ভোগ করে গৃহের পথে ফেরা যাবে কি বল?’

‘হ্যাঁ, যদি না কোনও রাজনৈতিক অসন্তোষের ঝঞ্ঝা স্বর্গসুখে বাধাসৃষ্টি করে’।

‘তুমি কি প্রতিবেশী রাজ্য অমরাবতীর ব্যাপারে ইঙ্গিত করছ?’ উল্মুকে দ্বিধান্বিত দেখায়।

‘হয়তো আমার আশঙ্কা অমূলক, সময়ই বলবে সেকথা, আপাততঃ চল সামনের পানশালাটিতে গিয়ে শীতল করঞ্জরস পান করি’, পুষ্পকেতু হেসে এগিয়ে যান।

***  ***

দুরূহ শব্দের অর্থঃ

বরণ্ডক – হাতির পঠের হাওদা, বহ্নিগৃহ – হাসপাতাল, পরিবস্ত্র – পরদা

Pic- Google, warli painting, madhubani painting, digital art

 

 

শেয়ার করতে:

You cannot copy content of this page