আবার এসো ফিরে

রামেশ্বর দত্ত

ভাই দাদাকে কিছু একটার ইঙ্গিত দেবার প্রয়াস করল। ব্যাপারটা ঈশ্বরচন্দ্র বুঝলেন, আবার নাও বুঝে থাকতে পারেন। তবে স্ত্রীর জন্যে মনটা উতলা হল।  তবু মনে হল, আগে মায়ের খোঁজ নেওয়া দরকার।

জানতে চাইলেন, মা কোথায়? বাবাকে তো দেখছি না?  বাবা কি বাইরে ? পর পর প্রশ্নহয়তো বা দীনময়ীর কাছে একটু তাড়াতাড়ি পৌঁছবার তাগিদ রয়েছে তাঁর

 শম্ভুচন্দ্র সব প্রশ্নেরই উত্তর করলেন। জানালেন, মা আহ্নিকে বসেছেন বাবা বউদির জন্যে ওষুধ আনতে কবরেজের কাছে গেছেন 

-বাবার বয়স হয়েছে। সন্ধ্যের পর একলা  বেরতে দিস কেন? ঈশ্বরচন্দ্রের গলার স্বর ভারী। 

-চিন্তা কোর না, বাবার সঙ্গে ঈশান  রয়েছে

এরপর… 

ঈশান সকলের ছোট।  ভাইকে ঢাল করে শম্ভুচন্দ্র বাবার সুরক্ষা প্রদান করলেন।

ঈশ্বরচন্দ্রের এক পা সিঁড়ির প্রথম ধাপে, অন্য পা নিচের তলার মাটিতে।  ওপরে যাওয়ার প্রস্তুতি। তবু কথা থামালেন না। দীনময়ীর প্রসঙ্গে বললেন, কী এমন হল ওঁর যে বাবাকে একেবারে কবরেজের কাছে যেতে হয়েছে? পরে যোগ করলেন, মা যখন আহ্নিকে বসেছে, তাহলে তো এখন এক ঘণ্টা যাবে। আমি বরং ওপরেই যাচ্ছি। দেখি গিয়ে কী রকম শরীর খারাপ।

সিঁড়ি ভাঙতে থাকলেন। শম্ভুচন্দ্রের উদ্দেশ্যে নির্দেশ করলেন, মা ঠাকুরঘর থেকে বেরলে আমাকে জানাস। আমি নেমে আসব।

-দাদা, তুমি বউদিকে দেখে হাতমুখ ধুয়ে ওপরে বোসো, আমি মন্দাকিনীকে দিয়ে তোমার জলাখাবার পাঠিয়ে দিচ্ছি।

কথাটা বলে শম্ভুচন্দ্র ফিরতে যাবেন, ঈশ্বরচন্দ্র থমকে দাঁড়িয়ে পড়লেন মাঝ সিঁড়িতে। তাঁর গলায় বাজখাই শব্দ উঠল, মন্দাকিনী!…

মন্দাকিনী ঈশ্বরচন্দ্রের ছোট বোন। বিয়ে হয়ে গেছে। শ্বশুরবাড়ি থেকে এখানে এসে রয়েছে এখন।

বলতে বলতে উঠলেন, ওর বুঝি এ বাড়িতে এখন খুব দরকার হয়ে পড়েছে? নিজের ঘর সংসার আলগা রেখে…, কথা আর শোনা গেল না। তিনি দুতলায় উঠে এলেন।

বাড়ির দোতলায় গোটা তিনেক ঘর। তার একটাতে ঈশ্বরচন্দ্র থাকেন । তবে, তাঁর থাকা? দিন গুণে বলে দেওয়া যায়, কটা দিন তিনি ওই ঘরে থেকেছেন।

ওপরে উঠে খোলা দালান দিয়ে গট গট করে হেঁটে শয্যাঘরের সামনে এসে থামলেন। চটিজুতো ছাড়লেন।  ভিতরের দিকে দৃষ্টি ফেললেন। ঘর প্রায় অন্ধকার। লন্ঠনের নিচু করা পলতের মাধ্যমে স্বল্প আকারে যে আলো খেলছে তা ঘরটাকে পুরোপুরি আলোকিত করতে পারছে না । ক্ষীণ এই আলোই বাড়িতে ঢোকবার সময়ে নিচে দাঁড়িয়ে তিনি দেখেছিলেন।

ধীর পদক্ষেপে ভিতরে প্রবেশ করলেন। ঘরের মাঝে চওড়া খাট। খাটের এক কোণে দীনময়ী শুয়ে রয়েছেন। হাত পা গোটানো অবস্থায়। সারা শরীর চাদরে ঢাকা। মুখ আর মাথাটুকু শুধু বার করা। দু চোখ বন্ধ করে শুয়ে রয়েছেন। ঈশ্বরচন্দ্র সামনে এগিয়ে গেলেন। ঘুমন্ত স্ত্রীর মুখের ওপর  দৃষ্টি রাখলেন। তাকিয়ে রইলেন কিছুক্ষণ। দেখে মনে হচ্ছে, দীনময়ীর চোখের মনি সচল। অর্থাৎ সে গভীর ঘুমে নেই। আধোঘুম, আধো জাগরণে চোখ বন্ধ  করে  কিছুটা ঘোরের মাঝে রয়েছে ।

ব্যাপারটা সত্যিই তাই। তিনি সামনে দাঁড়িয়ে থাকায় একটা প্রচ্ছন্ন ছায়া দীনময়ীর চোখের উপরে পড়ছে। ঘরে কারোও উপস্থিতির আঁচ পেলেন তিনি। চোখ না-মেলে প্রশ্ন করলেন, কে?

-আমি। কী হয়েছে ? অসময়ে শুয়ে রয়েছ কেন?

গলার স্বরে দীনময়ী স্বামীর উপস্থিতি বুঝে ধড়মড়িয়ে উঠে বসতে গেলেন; তবে পারলেন না।  অর্ধেক শরীর উঠিয়েও আবার শুয়ে পড়তে হল তাঁকে। শুয়ে শুয়েই এবার হাত বাড়ালেন স্বামীর পায়ের দিকে; হাত পেলেন না।  উঁচু খাট। হাত পৌঁছাল না নিচ পর্যন্ত। তবু পতিভক্তির বাসনা এতটাই প্রবল হল যে তিনি এবার সটান ওঠবার চেষ্টা করলেন।  ঈশ্বরচন্দ্র তাঁকে নিরস্ত করলেন।  আবার প্রশ্ন, কী হয়েছে?

ক্ষীণ কণ্ঠে উত্তর এলো, কদিন যাবৎ দাস্ত হচ্ছে। বন্ধ হচ্ছে না। গায়ে জ্বরও রয়েছে।

ঈশ্বরচন্দ্র উদ্বিগ্ন হলেন। জানতে চাইলেন, ভেদবমিও হচ্ছে না কি?

ঈশ্বরচন্দ্র জানেন, দাস্তর সঙ্গে ভেদবমি হওয়া মানে ওলাওঠার লক্ষণ। শহর কলিকাতায় যার প্রাদুর্ভাব ঘটেছে। তিনি নিশ্চিত নন, এতদূরের গ্রামেও তার আগমন ঘটেছে কি না? তা যদি হয়, তবে বিষয়টা বেশ চিন্তার। জীবন নাশের ব্যাধি ওলাওঠা। নিরাময়ের ওষুধ এখনও বার হয়নি। এতকিছু চিন্তার মাঝে দীনময়ী স্বামীকে নিশ্চিন্ত করে উত্তর করলেন, না, প্রথমদিন একবার হয়েছিল। তারপরে আর হয়নি।

স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললেন ঈশ্বরচন্দ্র। মুখে ব্যক্ত করে বললেন, রক্ষে তাহলে।

পরে  আশ্বস্ত করলেন, চিন্তার কিছু নেই। আমি এসে গেছি। ওষুধ দিয়ে সুস্থ করে তুলব।

-আপনি কি আমার অসুস্থতার খবর পেয়েই এলেন?

-না। এখানে  এসে জানলাম, তুমি অসুস্থ হয়েছ।… সবুর করো। আমার ওষুধের বাক্সে ওষুধটা রয়েছে কি না দেখি।

ঈশ্বরচন্দ্র ব্যস্ত হলেন হোমিওপ্যাথি ওষুধের বাক্স খুঁজে বের করতে। ঘরের তাক হাঁটকাতে শুরু করলেন।

দীনময়ী বলে উঠলেন, সেসব না হয় পরে হবেখন। বাবা তো কবরেজের কাছে গেছেন। আসতে দিন। আপনি এতদূর থেকে এসেছেন, এখন বিশ্রাম করুন।

মিনমিন শব্দে দীনময়ী কথাগুলো উচ্চারণ করলেন। ক্ষীণ কণ্ঠের কথা ঈশ্বরচন্দ্রের কানে পৌঁছাল না। তিনি নিজের কাজে ব্যস্ত হলেন। দেওয়ালের কাছে সরে গেলেন। দেওয়াল ফুঁড়ে কাঠের তক্তা দিয়ে আলমারি গড়া। রাজ্যির বস্তু সেখানে ঠাঁই নিয়েছে। ওখানেই তাঁর ওষুধের বাক্সখানা থাকে। গতবারে এসেও তা দেখে গিয়েছেন। অথচ এখন তা পাচ্ছেন না।

হোমিওপ্যাথি ওষুধ। ছোটখাট কিছু হলে বাসস্থ লোকের ওপর প্রয়োগ হয়। তবে সে বাক্স এখন আর সেখানে নেই। অন্ধকারে তাক হাঁটকাতে শুরু করলেন। বাক্স খুঁজে পেলে ভালো হয়। রোগীর কথা আর রোগের বর্ণনা শুনে তিনি বুঝেছেন, এ ওলাওঠা রোগ নয়। হতে পারে, দীর্ঘদিন পেটের মল ঠিক মতো পরিষ্কার না হওয়ায় তা থেকে উৎপন্ন দূষিত বায়ু রোগের বিস্তার ঘটিয়েছে। এবং তা চরম আকারে হওয়ায়, গায়ে উত্তাপ টেনে এনেছে। সহানুভূতির জ্বর ।  এতে মাথা ব্যথা, গা, হাত পায়ে যন্ত্রণা সবই হবে। এসব বিষয়ে তাঁর অল্পবিস্তর পড়াশোনা রয়েছে। অভিজ্ঞতাও কিছু হয়েছে। নিজেই তো  মাঝেসাঝে অম্লরোগে ভোগেন। পাস দেওয়া ডাক্তার না হলেও কলিকাতায় হোমিওপ্যাথি চিকিৎসা তিনি প্রায়ই করেন । মাঝেসাঝে ভাইদের ওপরে এটা সেটা প্রয়োগ করে  তাদের রোগ নিরাময় করেন ।

ঈস্পিত বস্তু খুঁজে না পেয়ে ঈষৎ উষ্মার সঙ্গে লন্ঠনের পলতে উস্কে দিলেন । ঘরের অন্ধকার অনেকটা দূর হল। সেই আলোয়  ওষুধের বাক্স খোঁজা চলতে থাকল। কিন্তু কোথায় সে বাক্স? আসলে কতদিন পরে গ্রামে আসা। ঘরে কোথাকার বস্তু কোথায় সরিয়ে রাখা হয়, তা কেউই হলফ করে  একবারে খুঁজে বার করতে পারবে না। হয়তো পারত দীনময়ী স্বয়ং। সেই তো এখন এ ঘরের স্থায়ী বাসিন্দা। জানলেও জানতে পারত। তবে এখন আর তাকে জিজ্ঞেস করেও লাভ হবে না, তাঁর শরীরের যা অবস্থা!

বাক্স না পেয়ে বিরক্ত হয়ে শেষে তিনি ভাবলেন, কবরেজের ওষুধ যখন আসছে, অপেক্ষা করেই দেখা যাক। খোঁজাখুঁজির কাজ থেকে নিজেকে বিরত করলেন। ইতিমধ্যে অবশ্য ঈশান এসে খবরও দিয়ে গেছে, ভগবতীদেবী সন্ধ্যে আহ্নিক সেরে ঠাকুরঘর থেকে বেরিয়েছেন।   ততক্ষণে বাইরে থেকে ফিরে এসেছিল সে।

ভাইয়ের কথা শুনে ঈশ্বরচন্দ্র একটু অবাক হলেন,- মা এত তাড়াতাড়ি তো আহ্নিক সেরে পূজোর ঘর ছাড়েন না! একবার সেখানে ঢুকলে একটি ঘণ্টা চোখ বুঁজে বসে থাকেন । শত শত দেবদেবী রয়েছে মায়ের। নামে নামে পূজো আহ্নিক না করলে মা মনে স্বস্তি পান না। অথচ ঈশান বলল, মা আহ্নিক সেরে নিয়েছেন! তবে কি, মা তাঁর আগমন বার্তা পেয়ে ঠাকুরঘর ছেড়ে তাড়াতাড়ি বেরিয়ে এলেন?

দেরী করলেন না তিনি। স্ত্রীর কাছে সাময়িক সময়ের জন্যে ছুটি নিয়ে নিচে নেমে এলেন। ছেলেকে দেখবার জন্যে ভগবতীদেবী তখন উদগ্রীব হয়ে অপেক্ষা করছেন। ঈশ্বরচন্দ্র তাঁর সামনে গিয়ে দাঁড়ালেন।  মাকে প্রণাম করলেন। সাষ্টাঙ্গ প্রণাম।

তাঁর এ অভ্যেস ছোটকাল থেকেই রপ্ত করা। জ্ঞানাবধি তিনি শুনে এসেছেন, ভগবতীদেবী দৈববলে তাঁর প্রথম সন্তান, অর্থাৎ ঈশ্বরচন্দ্রকে পেয়েছেন। তা থেকেই তাঁর এই ভক্তিরসের প্রসার ঘটেছে। সে কাহিনি যে স্বয়ং ভগবতীদেবীর মুখ থেকেই তাঁর শোনা। কী? না, তিনি যখন মাতৃগর্ভে, ভগবতী দেবী উন্মাদ হয়ে গিয়েছিলেন। নানা প্রকার ওষুধ খেয়েও তাঁর রোগমুক্তি ঘটেনি। তখন উদয়গঞ্জ থেকে আগত ভবানন্দ শিরোমণি ভট্টাচার্য নামের এক জ্যোতিষী তাঁর কোষ্ঠী বিচার করে বলে দিয়েছিলেন, শরীরে কোনও রকমের অসুখ নেই। তিনি সুস্থ শরীরে নিরাপদে রয়েছেন। গর্ভে ঈশ্বরের ইচ্ছায় কোনও মহাপুরুষ জন্ম নিয়েছে। তারই তেজঃপ্রভাবে প্রসূতি অধীরা হয়ে পড়েছে। বিশিষ্ট সেই শক্তিশালী শিশু ভূমিষ্ঠ হওয়া মাত্র প্রসূতি সুস্থ হয়ে যাবে। এই বলে জ্যোতিষী সেদিন বিদায় নিয়েছিলেন। এবং কালে প্রকৃত তাই ঘটেছিল। সন্তানের জন্ম হতেই ভগবতী দেবী সুস্থ হয়ে গেছেন। কোনও ওষুধ ব্যতিরেকেই। সেই থেকে তিনি  মাকে ঈশ্বরী বলে গণ্য করে এসেছেন। এই সূত্রে নিজের বিষয়ে ঈশ্বরচন্দ্র যেটুকু জানেন, তা হচ্ছে, তিনি সাত্ত্বিক না হলেও, বিভিন্ন শাস্ত্র তাঁর পাঠ করা রয়েছে। এটুকু বোঝেন, মানুষ দেবদেবীর পুত্তলিকাকে প্রাণ ঢেলে যে পূজো করে, তার অর্ধেকও যদি নিজের জন্মদাতৃর ওপরে অর্পণ করে, তাহলে, ছেলের হাতে মায়ের, তথা পুরুষের হাতে  রমণীকুলের দুর্দশা সমূলে উৎপাটিত হত। স্বামীর মৃত্যুতে বাংলার বধূদের সতী হতে হত না । বিধবাকে দুঃখের দিন যাপন করতে হত না।

প্রিয় পুত্রকে কাছে পেয়ে মা ভগবতীদেবীর মুখে প্রসন্নের হাসি। তিনি পুত্র ঈশ্বরকে তাঁর ঘরে এনে বসালেন। বাড়ির নীচের তলায় ঠাকুরঘর লাগোয়া ভগবতীদেবীর ঘর। ঘরে দুটো খিড়কি। রোদ, হাওয়া- বাতাস খেলে। ঘরে সামান্য আসবাবপত্র। খাট । তাতে টানটান বিছানা বেছানো। ঘরের এক কোণে একটা ছোট আলনা। কাপড়জামা গুছিয়ে রাখা রয়েছে।  কাঠের একটা আলমারি।

খাটের ওপরে বসেছেন দুজনে। ভগবতীদেবী ছেলেকে জিজ্ঞেস করলেন, কলিকাতা থেকে কবে বেরিয়েছ?

ঈশ্বরচন্দ্রের সংক্ষিপ্ত উত্তর, কালকে।

-দামোদর পেরিয়ে এলে?

কলিকাতা থেকে বীরসিংহ গ্রামে আসবার সংক্ষিপ্ত পথটা ভগবতীদেবীর জানা রয়েছে। ঠাকুরদাস কলিকাতায় থাকতে ওই পথে বার দুয়েক তিনি স্বামীর সঙ্গে যাওয়া আসা করেছিলেন। তাই তাঁর এই প্রশ্ন ।

ঈশ্বরচন্দ্র উত্তর করলেন, হ্যাঁ মা। গতকাল পথে একটা রাত সরাইখানায় কাটিয়ে সকালে এসে দামোদর পেরিয়েছি।

-ভালই করেছ, বলে, তিনি অন্য প্রসঙ্গে চলে গেলেন। প্রশ্ন করলেন, তুমি ওপরের ঘরে গিয়ে বউমাকে দেখে এসেছ?

-দেখেছি। উত্তর করলেন ঈশ্বরচন্দ্র।  উপযুক্ত চিকিৎসা না পেয়ে ভুগছে, মা। তবে চিন্তার কিছু নেই, আমি এসে গেছি। ওষুধ দিয়ে দুদিনে সুস্থ করে  তুলব। ।

-তোমার বাবা তো কবরেজের কাছে গিয়েছিলেন।

-শুনেছি।

-ক’দিন ধরে মেয়েটা মুখে কিচ্ছু তুলছে না। কেমন দুর্বল হয়ে পড়েছে। গায়ে উত্তাপও থাকছে।

ভগবতীদেবীর গলার স্বর বিষাদপূর্ণ । তিনি পুত্রবধূকে সময়ে সন্তানের জন্ম না দেওয়ার জন্যে যেমন দুকথা শোনান, তেমন রোগেভোগে তার জন্যে উতলাও হন। তারই প্রকাশ ঘটল এখন তাঁর কথার মধ্যে। ঈশ্বরচন্দ্র তা বুঝলেন।  বুঝলেন বলেই, মায়ের সামনে নিজ পত্নীর প্রতি যৎসামান্য সহানুভূতি প্রদর্শন করে বললেন, তোর বউমার পেট পরিষ্কার হলে অম্ল দূর হয়ে যাবে। সুস্থ হয়ে উঠবে। চিন্তা করিস না। বুঝছি, সারা সংসারের কাজ তোর ওপরে এসে পড়ায় বেশ চাপ পড়ে গেছে। মন্দাকিনীকে আনিয়ে নিয়েছিস?  ও মেয়েটাকেও নিজের ঘরদোর ফেলে রেখে এখানে এসে থাকতে হচ্ছে।

-তা আর কী হয়েছে? মেয়ে মায়ের কাছে এসেছে। না হয়, দুচার দিন একটু বাড়তি খাটাখাটুনি করছেই।  ঘরদোর সামলাচ্ছে। তুমি বাবা, ওসব চিন্তা করে  বউমাকে কিছু বোলো না। মেয়েটা তাড়াতাড়ি সুস্থ হয়ে উঠুক, এটাই চাই। ভালই হয়েছে, তুমি এসে পড়েছ…,

কথার মাঝেই হঠাৎ সুর পাল্টে ভগবতীদেবী প্রশ্ন করলেন, হঠাৎ করে এসে পড়া হল যে ? তোমার সংবাদ সব কুশল তো? আসছ যে, আগে কিছু জানালে না তো?

মায়ের প্রথম প্রশ্নের উত্তর দিচ্ছিলেন ঈশ্বরচন্দ্র, তবে কথার মাঝ পথে ছেলের মুখের কথা কেড়ে নিয়ে ভগবতীদেবী ফের বলে উঠলেন, তবে কি, বউমার জন্যে মন কেমন করছিল?

-সেকথা নয় মা। আমি কি তোর জন্যেও আসতে পারি না? কলিকাতায়  সব সময়েই তোর কথা, বাবার কথা মনে পড়ে। সেই যে হরচন্দ্র গত হতে তোকে শহরে নিয়ে গিয়েছিলাম, তাও তো ক’বছর হয়ে গেল, তারপর আর আসলিও  না।

মুখ ঘুরিয়ে নিয়ে ভগবতীদেবী বললেন, আর শহরে যাওয়া আমাদের! তোমার বাবাও সেই যে এসেছেন, আর ওদিকে ফিরতে চান না। আমাদের জন্যে এই বীরসিংহ গ্রামই ভাল।… যাব। এবার কাশীধামে যাব। এখন বরং বউমাকে তুমি কিছুদিন কাছে নিয়ে গিয়ে রাখো। দ্যাখো, ডাক্তার বদ্যি করে কিছু হয় কি না। আর তো লোকের কথা সইতে পারছি না, বাবা…

মায়ের এমন কথায় ঈশ্বরচন্দ্র কিছুক্ষণের জন্যে বোবা হয়ে গেলেন। মাথা ঝুঁকিয়ে বসে রইলেন। তবে এভাবে চুপ করে থাকা তাঁর স্বভাব বিরুদ্ধ। মায়ের ক্ষোভটা কিসের, তা তিনি ভালই বোঝেন। সেজন্যে যে দীনময়ীকেও কথা শুনতে হয়, এ খবরও তাঁর কানে আছে। কিন্তু এটা কি কোনও হাতের মোয়া? চাইলেই এসে যাবে? -ভাবতে থাকেন,  এর জন্যে তিনি নিজেই দায়ী কি না, কে বলতে পারে? এত বছর ধরে তো সন্তান আনার চেষ্টাই করে যাচ্ছেন। তবু তা না আসলে মেয়েদেরকেই কেন গঞ্জনা সহ্য করতে হবে? সংসারে স্বামীস্ত্রীর মাঝে সন্তান না আসলে, সব দোষ কেন তাদের নিতে হয়?

মন বিরূপ গাইতে থাকলেও নিজেকে সংযত রেখে, মায়ের মন রাখবার জন্যে সত্য, অসত্য মিলিয়ে কথা বলতে থাকেন,- না মা। সেখানে ঘরদোরের অভাব। আমরা কতজনে মিলে মাত্র দুটো ঘর নিয়ে থাকি। ঘর মানে তো এক বৈঠকখানা। ওই ঘরই সেখানে ভাড়া পাওয়া যায়। তাছাড়া পাড়াটাও একটু নটখটে। তবে, ভদ্রজনদের বাড়িতেই আমাদের বাস। আমি জানি, দীনময়ীর সেখানে ভালো লাগবে না। শহরে সদাই চঞ্চল ভাব। ধীরস্থির নয় কেউই। আমার কাছেও দিনরাত লোকের আনাগোনা চলতে থাকে। কাজে ব্যস্ত থাকি সারাদিন। রাতে পড়াশোনা চলে। কখন সময় দোব ওঁকে? এই তো, আসা যাওয়া চলছে। এইই ভালো।

এরপর ঈশ্বরচন্দ্র মুখে প্রথমার চাঁদের মতো হাসি ফুটিয়ে তুললেন। মাকে বললেন, হবে মা, হবে। সময়ে তোর ঘর আলো করতে অনেকই আসবে। দ্রুত প্রসঙ্গ পাল্টালেন, তুই তো জানিস, তোকে না জানিয়ে কোনও কাজ আমি করি না। মা, আজ তোর কাছে একটা আর্জি নিয়ে এসেছি।

তাঁর কথা ধর্তব্যে না এনে ভগবতীদেবী বলে উঠলেন, তা সে কি এখনই শুনতে হবে? না কি আগে তুমি বউমার কাছে গিয়ে একটু বসবে? সে বেচারি গায়ে উত্তাপ নিয়ে একলা ঘরে পড়ে থেকে প্রাণান্ত হচ্ছে। তুমি তো আছো। পরে শুনব। এখন এসো।

ঈশ্বরচন্দ্র অধোবদনে ঘর ছাড়লেন। সিঁড়ি বেয়ে উঠে পায়ে পায়ে নিজের ঘরে গিয়ে ঢুকলেন।

(৩)

 

দিন দুই পর।

রাত গভীর। ঈশ্বরচন্দ্র ঘরের সামনের দালানে কেদারা নিয়ে বসে রয়েছেন।  চতুর্থীর রাত । ভুবন জোড়া নরম হলদে আলো। কিছুটা আগেই এক ঝলক বৃষ্টি হয়ে গেছে। এখনও আকাশে মেঘের আনাগোনা চলছে। চাঁদের সঙ্গে লুকোচুরি খেলা চলছে মেঘের । নীচে অদূরবর্তী আম, জাম, নিম, অশ্বথ গাছের গায়ে আবছা আলোর ছোপ আর বৃষ্টির জল মিলেমিশে প্রকৃতিকে বড় মনোরম করে তুলেছে। ঈশ্বরচন্দ্র সেদিকে তাকিয়ে রয়েছেন।  মন প্রশান্তিতে ভরপুর। কতদিন পর আজ পত্নীসঙ্গ লাভ হয়েছে।

স্মৃতিতে আনতে শুরু করলেন পূর্ব প্রসঙ্গ। তিনি স্ত্রীকে প্রশ্ন করেছিলেন,  তুমি এখন সুস্থ তো, দিনময়ী? উত্তর এসেছিল, আপনি আমাকে  ভুলে যাচ্ছেন…

বিস্মিত তিনি জানতে চাইলেন, সত্যিই কী তাই?

-তাই তো।

চমকে উঠেছেন। আরও বিস্মিত হয়েছেন। বলেছিলেন, দীনময়ী, তুমি কি আমার ভোলার মানুষ?

-না, তবে আপনি এতটা উদাসীন হলে আমি কেমন করে  থাকি বলুন তো? স্ত্রীলোকের মনের কষ্ট কি আপনি বোঝেন না?

অভিযোগ! তিনি নিরুত্তর ছিলেন। বুঝতে পারছিলেন, দীনময়ীর কষ্টটা কোথায়। সন্তানহীন হওয়ার কষ্ট। লোকের তির্যক বাক্যির বেদনা।  কিন্তু এই নিয়ে এখন কী বলবেন? সুখ-মুহূর্তের বিড়ম্বনা।   অথচ, দীনময়ীর প্রশ্নের যুতসই একটা উত্তর দিতেই হয়। তার মনের ক্ষোভটুকু নিরসন করা প্রয়োজন। তবে সে সময় এখনই নয়। ধীরেসুস্থে হবে। নিজেকে সংযত রেখে চিন্তা করেছেন, পুরনো কথায় দীনময়ীর মন ঘোরাবেন ।  ভেবেছেন, সহজ সরল দীনময়ী তার কথা অবশ্যই শুনবে।

পড়ুন প্রথম পর্ব আবার এসো ফিরে

বলেছিলেন, জানো তো দীনময়ী, সব স্ত্রীলোকই হচ্ছে মায়ের জাত। মা যেমন সন্তানকে আতুপুতু করে  রাখতে চায়, স্ত্রীও তাঁর স্বামীকে আঁচলের সাথে বেঁধে রাখতে পারলে সুখী হয়। সেথায় তো জনে জনে একটা সম্পর্ক থাকেই;  কিন্তু কোনও রকম সম্পর্কের বাইরে থেকেও স্ত্রীলোক যে কতখানি দয়া পরবশ হতে পারে, তাঁর নিদর্শন দিচ্ছি, শুনবে?

দীনময়ী কোনও উত্তর করেনি। তিনি বুঝছিলেন, এ সময়ে দীনময়ীর মন অন্য কিছু চাইছে, তবু স্ত্রীর ভাবনার দিশা ঘোরাবার জন্যে কথা চালিয়ে গেছেন। বলেছেন, সেসময় আমরা সব ছোট ছোট। আমাদের গ্রাসাচ্ছাদনের জন্যে বাবা দিনরাত পরিশ্রম করছেন। দশ টাকা মাস মাইনে । তা থেকে পাঁচ টাকা খরচ করে আমাকে পড়াবে মনস্থ করেছেন। অথচ ওনার ওপর আমার এবং গ্রামে সংসারের ভার তখন। খরচ অনেক রয়েছে। ফলে বাবার আরও বেশি উপার্জনের দরকার। একদিন গ্রীষ্মকালে দুপুরের রোদে বাবা অতিরিক্ত উপার্জনের ধান্ধায় পথে পথে ঘুরছেন।   কোথাও কিছু পাচ্ছেন না। শ্রান্ত ক্লান্ত, অভুক্ত অবস্থায় রাস্তা ধরে হাঁটতে হাঁটতে চলেছেন। পথটা  গিয়েছে কলিকাতার ঠনঠনে নামের একটা জায়গার ওপর দিয়ে। বাবা ভীষণ তৃষ্ণা বোধ করছেন। চোখে পড়ল একটা দোকান। দোকানী এক মহিলা। মাঝবয়সী।  পসরা সাজিয়ে বসে রয়েছে। মুড়ি, মুড়কি, খই ইত্যাদি। দোকানীর কাছে বাবা জল চাইলেন। দুপুরের তেজ রোদে তৃষ্ণার্ত এক ব্রাহ্মণ সন্তানকে শুধু জল দেওয়াটা দোকানী অকল্যাণকর মেনে বাবার হাতে জল সহ সামান্য মুড়কি তুলে দিলেন । শ্রান্ত ক্লান্ত মানুষটা  মুড়কি গোগ্রাসে গিলছে দেখে মহিলা বুঝতে পেরেছেন, ব্রাহ্মণ অভুক্ত রয়েছে। প্রশ্ন করে  জানলেন, দুদিন যাবৎ বাবার পেটে কিছু পড়েনি। তৎক্ষণাৎ  উঠে গিয়ে পাশের মিষ্টির দোকান থেকে এক ভাঁড় মিঠে দই কিনে এনে, দই মুড়ি, মুড়কির ফলার করে  বাবাকে খেতে দিলেন। তা খেয়ে বাবার ধড়ে প্রাণ এল।

দীনময়ী শুনল, কিছু বলল না। এরপর তিনি হাত বাড়িয়েছেন। দীনময়ীকে আদর করেছেন। আবার বলা শুরু করেছেন, জানো তো, সে কাহিনি কিন্তু এখানেই শেষ হয়নি। পরম দয়ালু মহিলা বাবাকে দিয়ে প্রতিজ্ঞা করিয়ে নিয়েছিলেন, যখনই মনে হবে, বাবা যেন তাঁর দোকানে গিয়ে ফলাহার করে  আসে। বাবাও যতদিন  কলিকাতায় ছিলেন, ততদিনই মাঝে মধ্যে ওঁর কাছে চলে যেতেন। মহিলা পরম যত্ন করে  বাবাকে ফলাহার করাতেন।

দীনময়ী গল্প শুনেছে। শরীরের উসখুস কম হয়নি । ঠোঁটে আঙুল বোলানো,  চুম্বনের উষ্ণ ছোয়া, দেহকে আষ্ঠেপৃষ্ঠে  জড়িয়ে ধরা, এসব চলছিলই। তিনি দীনময়ীর গায়ের উত্তাপ অনুভব করলেন। ভাবলেন,  তার কি আবার জ্বর এলো? কপাল, গলা স্পর্শ করেছেন । হাতে জলের স্পর্শ। কিসের জল! দীনময়ী কাঁদছে? গালে গলার ভাঁজে হাত রেখে ফের তা পরখ করেছেন। সত্যিই সে কাঁদছিল।  

স্ত্রীকে নিবিড় করে  বুকের মাঝে আঁকড়ে নিয়েছেন । আদর জানিয়েছেন । চোখের জল তখন আর বাঁধ মানেনি দীনময়ীর । শিশুর মতো কেঁদে উঠেছে সে । ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কান্না! নিজের মন খারাপ হয়েছে । প্রশ্ন করেছেন, খুব কষ্ট হচ্ছে, দীনময়ী?

-না। মাথা ঝাঁকিয়ে উত্তর দিয়েছে সে ।

-তবে? তবে কাঁদছ কেন?

-আপনি অনেক দুরের হয়ে যাচ্ছেন…, কান্নার মাঝে দিনময়ীর কথা।

নিজেকে ধিক্কার জানিয়েছেন, তবে কি তিনি সত্যিই  অবিবেচক ব্যক্তি? হতে পারে তিনি পণ্ডিত মানুষ। শহুরে দিন কাটানো ব্যক্তি। সেখানে একলার জীবন কাটছে । দিবারাত্র খেটে চলেছেন। মনের বিশ্রাম নেই। শরীরের আরাম নেই। কিন্তু কী জীবন তিনি কাটাচ্ছেন? মুহূর্তে নিজেকে উষ্ণ প্রস্রবণের ধারে শীতল মেরুদেশ বলে মনে হয়েছে। ভেবেছেন, দীনময়ী যদি এখনও অসুস্থ বোধই করবে, তাহলে তো নিশ্চয়ই এতখানি প্রগলভ হত না। মুখেই তা প্রকাশ করত। তা না করে ,  যখন কাঁদছে, হতে পারে নারীর অন্তর পুরুষের উষ্ণ আলিঙ্গন প্রার্থনা করছে। মনে মনে বলে উঠেছেন, দীনময়ী আমার ধর্মপত্নী। তাকে  এভাবে কষ্ট দেওয়া সাজে না।

এরপর মনকে সঙ্গম অভিমুখ করেছেন। উন্মোচন করেছেন নিজেকে। ধীরে ধীরে মিলেছে দুটি শরীর-দুটি মন-বাসনা নতুন প্রাণ সৃষ্টির উদ্দেশ্যে।  কামের প্রকাশ ঘটিয়েছেন।  তৎক্ষণাৎ সাড়া এসেছে অপর দিক থেকে।

পড়ুন দ্বিতীয় পর্ব- আবার এসো ফিরে

কতক্ষণ, জানা নেই। ঈশ্বরচন্দ্র দালানে বসে জাগতিক শোভা দেখতে দেখতে কৃত  ক্রিয়ার ভাবনায় ডুবে গিয়েছিলেন। মিলনের পরে ক্লান্ত দীনময়ী ঘুমিয়ে পড়লেও ঈশ্বরচন্দ্রের চোখে ঘুম ছিল না। শয্যা ছেড়ে উঠে এসে বসেছিলেন নির্জন বারন্দায়। আনন্দলোকে বিরাজিত শরীর। পূর্ণ তৃপ্ত মন। উচ্চমার্গে বিচরণ করছিলেন। ভগবানে তাঁর বিশ্বাস নেই। তবু সেই পরম পুরুষের কাছে একান্ত প্রার্থনা, দীনময়ীর গর্ভে একটা সন্তান আসুক। আর, তা যদি কিনা হয় এমন এক নৈসর্গিক মিলনে, তবে তাই হোক তাঁর পরম পাওয়া। সে পাওয়া না শুধু হবে তাঁদের একলার। তা তাঁর মায়ের মনের ক্ষোভ-আশা-আকাঙ্ক্ষা মেটাবে। স্ত্রীকেও তিনি সুখী করতে পারবেন।

চলবে…

ইলাস্ট্রেশন- গুগল

শেয়ার করতে:

You cannot copy content of this page