উপন্যাস।। কমরেড নয়ন।। সৌপ্তিক চক্রবর্তী
এক
শেষরাতে হিসু করতে উঠে নয়ন দেখল বাথরুমের বাল্বটা কেটে গেছে। উঠোন-বারান্দা জুড়ে ছড়িয়ে আছে চাঁদের ফিকে আলো। নয়ন দরজাটা আর বন্ধ করল না। ওই আলোতেই ঝাপ্সা সাদা রঙ ঠাওর করে ঠিক কমোডের ভেতর হিসু করতে থাকল। খালি গা। পায়জামাটা লুটিয়ে আছে পায়ের পাতায়। লম্বা ছিপছিপে চেহারা।
হিসু করে, পায়জামা পরে, হাত ধুয়ে সরু লাল সিমেন্ট বাঁধানো টানা বারান্দা দিয়ে হেঁটে তার ঘরে আসতে আসতে নয়ন ‘উফঃ’ করে মৃদু আর্তনাদ করে উঠল। বারান্দার জায়গায় জায়গায় খুবলে গেছে। তারই একটায় বাঁপায়ের বুড়ো আঙুলটা ঘষটে গেছে। ঘরে ঢুকে কিছুক্ষণ আঙুল চেপে বসে থেকে একটু জল খেয়ে আবার শুয়ে পড়ল।
নয়নদের বাড়িটার বয়স প্রায় আশি। মানে একতলাটার। পাড়ার এককোনায়। উঁচু পাঁচিল দিয়ে ঘেরা। ভেতরের রং কিছুটা থাকলেও বাইরের সব উঠে গেছে। বেশ বিরক্তি ধরানো শব্দে লোহার গেট খুলে চিলতে উঠোন। মাঝখানে তুলসীমঞ্চ। বাঁহাতে সরু টনা বারান্দা ধরে দুটো বড় বড় ঘর। ডাঁয়ে ঘুরে ভাঁড়ার ঘর, সিঁড়ি, রান্নাঘর আর বাথরুম। নয়নের ঠাকুর্দা যখন এই বাড়িটা করে থাকতে শুরু করে তখন তার বড় ছেলে, নয়নের জ্যাঠা, আড়াই বছরের খোকা আর ছোট ছেলে, নয়নের বাবা, মায়ের পেটে। তার পিসির জন্ম এই বাড়িতেই। বিয়ে করার আগ দিয়ে জ্যাঠা দোতলায় একটা ঘর আর বাথরুম করে। জ্যাঠতুতো বোন রিংকু হওয়ার পর করে আর একটা ঘর। জ্যাঠতুতো দাদা টিংকু তখন ছয়ে পড়েছে আর নয়ন চারে। দোতলার বাকি জায়গাটা নিয়ে ডাইনিং। তিনতলায় কয়েক বছর হল টিংকু অ্যাটাচ্ড বাথরুম নিয়ে একটা ঘর করেছে।
লোক বলতে তারা পাঁচজন। দোতলায় তার বিরাশি বছরের জ্যাঠা। ইদানীং শয্যাশায়ী। ধরে ধরে বাথরুমে নিয়ে যেতে হয়। জ্যাঠতুতো দাদা টিংকু আর তার বউ নুপুরবৌদি। তিনতলার ঘরটা তার ভাইজি তুলির। সেকেন্ড ইয়ারে পড়ছে। একতলার পেছনের দিকের ঘরটায় থাকে নয়ন। এই ঘরটা প্রথমে ছিল তার ঠাকুর্দা-ঠাকুমার। তার পরে থাকত তার মা। প্রায় দুবছর হল তার মা মারা গেছে। করোনার প্রথম ধাক্কায়। রিংকুর শ্বশুরবাড়ি পাড়াতেই। সামনের ঘরটায় কেউ থাকে না। ওটা পাড়ার সুপ্রিয় মাস কয়েক হল ভাড়া নিয়েছে। ওর নাটকের দল আছে। প্রতি মঙ্গল-বৃহস্পতি রিহার্সাল করে। সাড়ে চারটে-পাঁচটায় আসে সাড়ে সাতটা-আটটা নাগাদ চলে যায়। পরিষ্কার করার দায়িত্ব ওদেরই। একজন ঠিকে কাজের লোক আছে সে দোতলা আর নিচে রান্নাঘরটুকু পরিষ্কার করে।
নয়নের যখন দশ বছর বয়স তখন তার ঠাকুর্দা মারা যায়। লিভার ক্যান্সারে। সে ছিল রিটায়ার্ড ব্যাঙ্কার। এর দুবছর পর আকস্মিক ভাবে লরি চাপা পড়ে মারা যায় তার বাবা। সামান্য টাইপিস্ট ছিল সে। কোনোমতে দিন গুজরান হত। এর বছর চারেক বাদে ব্লাড ক্যান্সারে মারা যায় তার জেঠিমা। ঠাকুমা দীর্ঘজীবি থেকে যখন মারা গেল তখন নয়ন তিরিশ পেরিয়েছে। সেই অর্থে তার ও তার মায়ের ভরণ-পোষণ চালিয়েছে তার জ্যাঠা।
নয়নের জ্যাঠা একটা মার্চেন্ট অফিসে বড় চাকরি করত। টিংকুকে ওখানেই মাঝারি পোস্টে ঢুকিয়ে দিয়েছিল। নয়নকেও চেয়েছিল কিন্তু সে রাজি হয়নি। নয়ন সিপিএমের হোল-টাইমার। মাস গেলে চার-পাঁচ হাজার পায়। বার কয়েক লিকার চা ছাড়া আর কোনো নেশা নেই। প্রতি মাসে দু-আড়াই মতো সংসার খরচা হিসাবে নুপুরবৌদির হাতে দিয়ে দেয়। ব্যাস, দুপুরে-রাতে খাওয়-দাওয়ার আর চিন্তা থাকে না। তাদের বাড়িতে আজও একই হাঁড়ি। জ্যাঠা মরলে হয়তো তা আর থাকবে না। হয়তো ফ্ল্যাট হয়ে যাবে বাড়িটা। ইদানীং রান্নাবান্না পুরোটাই দেখে নুপুরবৌদি। আগে দেখত মা। জ্যাঠার জন্য দিনের বেলা একজন আয়া রাখা হয়েছে। খরচ বেড়েছে। তাই নয়ন তার ঘর ছেড়ে মায়ের ঘরে চলে গেছে। সামনের ঘরটা থেকে ভাড়া বাবদ হাজার দেড়েক আসে তাদের সংসারে।
সামান্য আয় হলেও নয়ন সবসময় পরিস্কার-টিপটপ থাকে। রোজ সাবান দিয়ে স্নান করে। গরমকালে দুবার। হপ্তায় তিনবার শেভ করে। একদিন অন্তর শ্যাম্পু করে। মাত্র তিন-চার পিস থাকলেও এক পাঞ্জাবি-পায়জামা দিন দুয়েকের বেশি পরে না। গরমকালে একদিন। আর জাঙ্গিয়াতো রোজই বদলায়। প্রতি হপ্তায় বদলায় বিছানার চাদর আর বালিশের কভার। জামা-কাপড়-চাদর-কভার সব সস্তার ডিটারজেন্টে সে নিজে হাতে কাচে। মাসে একবার ছোট করে চুল ছাঁটায়। দুবার নখ কাটে। হপ্তায় দুদিন ঘর আর বাথরুম পরিষ্কার করে।
সকালে ঘুম থেকে উঠে চা খেয়ে, পটি করে, চোখ-মুখ ধুয়ে, রেডি হয়ে পার্টি অফিসের চাবিটা নিয়ে হাওয়াইজোড়া পায়ে গলিয়ে নয়ন প্রতিদিনের মতো সাড়ে নটা নাগাদ বাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়ল। পাড়ার মোড়ের কাছে তাদের পার্টি অফিস। পাশেই ন্যড়ার চায়ের দোকানে ঘুগনি-রুটি কিংবা পরোটা-আলুর দম খেয়ে পার্টি অফিস খুলবে। খোলা-বন্ধ-ঝাড়-পোঁছ সব তারই দায়িত্ব। পঁচিশ বছরেরও বেশি সময় ধরে নয়ন প্রাণভরে এই দায়িত্ব পালন করে আসছে। আরও কিছু দায়িত্ব আছে তার। যেমন পাড়ার কয়েকটা বাড়িতে গণশক্তি দেওয়া। মোড়ের মাথায় গণশক্তি সাঁটা। ক্যাডারদের চাঁদা আদায় করা। এইরকম। আর ভোটের আগে তো কথাই নেই! বাড়ি বাড়ি ইস্তেহার বিলি, দেওয়াল লিখন, পোলিং এজেন্ট হয়ে বুথে বসা এরকম আরও অনেক কাজ থাকে তখন। ঢিল ছোঁড়া দূরেই তৃণমূলের পার্টি অফিসটা।
সেই সতেরো বছর বয়েসে সুকুমারদার হাত ধরে তার বামপন্থী রাজনীতিতে পা রাখা। সুকুমারদা তাদের কলেজে এসএফআইয়ের সেক্রেটারী ছিল। সুকুমারদা মারা গেছে অনেকদিন। সত্যিই আদর্শবাদী লোক ছিল একটা। তার খানিকটা হয়তো নয়নও পেয়েছে। কোনো লোভ নেই। শুধু মনপ্রাণ দিয়ে পার্টি করে যাওয়া। পার্টিই তার সব কিছু। পাসকোর্সে গ্র্যাজুয়েট হয়েও সে কোনোদিন কোনো চাকরি করেনি। ভাবেইনি। বিয়ে তো দূরের কথা কোনোদিন কোনো সম্পর্কেই জড়ায়নি সে। অটলভাবে একাগ্র চিত্তে পার্টি করে চলেছে। কাস্তে-হাতুরি-কোদাল-বেলচা কোনোটাই কোনোদিন হাতে না নিলেও আজও একই রকম গর্বে ও যত্নে হাতে তুলে নেয় পতাকা আর ইস্তেহার। সেই যুবা বয়স থেকে আজ অব্ধি ওয়ার্ড কিংবা অঞ্চলের দীর্ঘ থেকে ক্রমশঃ ছোট হয়ে আসা প্রত্যেক মিছিলে সামনের দিকেই থেকে এসেছে বরাবর।
বছর পঞ্চাশের ছিপছিপে-লম্বা শরীরটা টানটান রেখে মাথা উঁচু করে পাড়ায় ঘুরে বেড়ায়, পার্টির এই একনিষ্ঠ হোল-টাইমার, কমরেড নয়ন।
দুই
আজকাল পার্টি অফিস বেশিক্ষণ খোলা থাকে না। সকালে দশটা থেকে বেলা একটা-দেড়টা। আর সন্ধে ছটা থেকে রাত আটটা-সাড়ে আটটা। স্ট্যালিনের ছবিটা মুছতে মুছতে নয়ন ভাবছিল দশ-বারোটা বছর আগে আগে পার্টি অফিসটা সবসময় গমগম করত। বছর পাঁচ-ছয় আগেও অন্তত গোটা ছয়-সাতেক চেয়ার পাতা হত আর এখন রেগুলার বলতে মিহিরদা, এক্স-কাউন্সিলর রথীন মিত্র আর সে। মাঝে মধ্যে সজল কিংবা বিশু। দশটা প্লাস্টিকের চেয়ার দুটো সেটে ধুলো গিলছে। রোজ হয়ে ওঠে না তবে হপ্তায় বার দুয়েক অন্তত নয়ন ধুলো ঝাড়ে।
মিহিরদা এসে পড়ল খানিক বাদেই। গণশক্তির কপিগুলো নিয়ে নয়ন পার্টি অফিস থেকে বেরিয়ে পড়ল। মোড়ের মাথায় তদের বোর্ডে সাঁটবে এক কপি। তারপর যাবে বাড়ি বাড়ি দিতে।
গনশক্তিটা প্রণবদার বাড়িতে দিয়ে রাস্তায় পড়তেই পাশ দিয়ে মোটরসাইকেল চেপে শ্যামল হুশ করে বেরিয়ে গেল। শ্যামলকে দেখতে পেয়ে নয়ন বিরক্ত মুখে ও মনে হারুদার বাড়ির দিকে চলল। শ্যামল পাল্টি খাওয়া মাল। প্রোমোটিং করে। তাদের জমানাতেও কন্সট্রাকশন তুলেছে, এখনও তুলছে! এখন তো শুনছে নাকি বেলঘরিয়াতেও! আগে নয়ন তাকে ভাবত কমরেড-বন্ধু। কত মালই যে পাল্টি খেল লাস্ট দশ বছরে! কতজনই যে ঘরে ঢুকে গেল! আর কতজনই যে আর মেম্বারশিপ রিনিউ করল না! এইসব ভাবতে ভাবতেই হারুদার বাড়ি পৌঁছে গেল।
ভেবেছিল গণশক্তিটা দিয়ে দরজা থেকেই বিদেয় নেবে কিন্তু হারুদা ছাড়ল না। ‘আরে নয়ন, বোস না, এক কাপ চা খেয়ে তারপর যাবি।’ অগত্যা নয়ন ভেতরে ঢুকল। ‘বোস, বোস” বলে একটা হাতল ভাঙা কাঠের চেয়ার দেখিয়ে দিল। নিজে বসল চৌকিতে। আর একটা ছোট্ট ঘর আছে বাড়িতে। অবস্থা ভাল নয়। সেই কবে হারুদার কারখানায় লক-আউট হয়। তখন নয়নদের লালপার্টির জামানা। তারপর থেকে টুকটাক জমি-বাড়ির দালালি করেই হারুদার সংসার চলে। তাতে আর কীই বা হয়! ছেলেটা হাল ধরবে ভেবেছিল। কিন্তু কপাল! এসএসসি দিয়ে বসে আছে আজ ছ-সাত বছর। চাকরি হয়নি। টিউশানির পাশাপাশি এখন আন্দোলন করতে যায়। যদি তাতে সরকারের টনক নড়ে!
‘নয়নের চিনি কম কিন্তু’ হারুদা মৌবৌদিকে উদ্দেশ্য করে বলল। ঘরের এক কোনে স্টোভের সামনে একটা নিচু কাঠের টুলে বসে মৌবৌদি চায়ের জল চড়িয়েছিল। ঘাড় ঘুরিয়ে হেসে উত্তর দিল ‘জানি রে বাবা, নয়ন কি আর আজ প্রথমবার চা খাচ্ছে এখানে!’ হারুদার বাড়িতে লিকারই হয়। দুধ কেনার বিলাসিতা করে না।
গণশক্তিটায় চোখ বোলাতে বোলাতেই হারুদা চিৎকার করে বলে উঠলঃ আরিব্বাস! দেখেছিস নয়ন, মন্ত্রীর মেয়েটার চাকরি খারিজ করেছে হাইকোর্ট! ভাব! এতদিন পাব্লিক বলে গেল আমরা সিপিএম বলে নাকি শুধু শুধু কাদা ছুঁড়ছি। সেদিন মোড়ের মাথায় স্বপন তো আমায় শুনিয়ে শুনিয়েই বলছিল যে আমার ছেলেটার চাকরি হয়নি তাই ওদের সরকারকে দুষছি! এবার বল, কী বলবি? কোর্টের ওপর তো আর কোনো কথা হবে না! শালা, প্রথম থেকেই দুর্নীতিবাজ একটা পার্টি।
হারুদার কথার মাঝেই মৌবৌদি চা দিয়ে গেছে। চায়ে চুমুক মেরে হারুদা আবার বলতে শুরু করলঃ আমরা নাকি চোর! ছেচল্লিশ বছর পার্টি করেছি। তা ছেচল্লিশ বছর ধরে চুরি করে এই দেড়খানা ঘর ভাড়া নিয়ে থাকি! বলে হারুদা হাসতে গিয়ে বিষম খেল। মৌবৌদি স্টোভের সামনে থেকে ঝাঁজিয়ে উঠলঃ ও, ছাড়ো তো, এক কথা খালি সারাদিন।
হারুদা বিষম কাটিয়ে মিটিমিটি হেসে চায়ে চুমুক মেরে বললঃ ছেড়েই তো দিয়েছি গো, না হলে, দুবছর হয়ে গেল আর হারু নন্দী মেম্বারশিপ রিনিউ করল না!
নয়ন মনে মনে ভাবে সত্যিই হারুদার মতো এমন ডাকসাইটে পার্টিকর্মী আজ ফুল বসে গেছে! গত দুটো বিধানসভা ভোটে আর বেরয়নি। অথচ এই হারুদাই পনেরোর পুরভোটে জান লড়িয়ে দিয়েছিল। পোলিং এজেন্ট ছিল সেবার। শেষমেষ যখন তাকে মারতে মারতে বুথ থেকে বার করে দেওয়া হচ্ছে, নাক ফেটে ঝরঝর করে রক্ত পড়ছে তখনও পুলিশ আর কেন্দ্রীয় বাহিনীকে চিৎকার করে বলে যাচ্ছে ‘মাজাকি হচ্ছে এটা! কি করছেন আপনারা এখানে দাঁড়িয়ে? লজ্জা করে না!’
পুলিশ দুটো অবশ্য দাঁত ক্যালাচ্ছিল। নয়ন গিয়ে তাকে স্কুলের গেট থেকে, মানে বুথের সামনে থেকে, সরিয়ে ক্যাম্পে নিয়ে আসে।
হারুদার বাড়ি থেকে বেরিয়ে পাশেই নিত্যর দোকান থেকে একটা কম পাওয়ারের বাল্ব কিনে নয়ন পার্টি অফিসের দিকে হাঁটা দিল। হাঁটতে হাঁটতে ভাবতে থাকলঃ ঠিকই তো! তাদের জামানায় এমন ফি বছর কোনো না কোনো মন্ত্রী কিংবা হেভিওয়েট নেতাকে নিয়ে কোর্ট-কাছারি হত না। কেন্দ্রে কোনো কালেই তাদের সরকার ছিল না। আর সিবিআই তখনও ছিল। যাক গে, হারুদার ছেলেটার চাকরিটা যেন হয়ে যায়। সেই কবের থেকে বেচারা কি পরিশ্রমটাই না করে যাচ্ছে!
ছবি- গুগল
চলবে…